#দূর_দ্বীপবাসিনী,১৬,১৭
মুশফিকা রহমান মৈথি
#১৬তম_পর্ব
এর মাঝেই আফিয়ার আগমণ হলো চারুর রুমে। শান্তার কানে কানে কিছু বললো। এর পর ই শান্তার মুখোভাব পালটে গেলো। থমথমে গলায় বললো,
“শ্রাবণের গাড়ি এখনো পৌছায় নি, ওর কোনো বিপদ হলো না তো”
কথাটা আস্তে বললেও চারুর কান অবধি ঠিক ই পৌছালো। অবাক নয়নে তাকালো শান্তা বেগমের মুখোপানে। উদ্বিগ্ন কন্ঠে বললো,
“কি হয়েছে? শ্রাবণের কিছু হয়েছে?”
আফিয়া মায়ের কাধে হাত রেখে হালকা চাপ দেয়। সাথে সাথে শান্তা বেগম থেমে যান। শান্তা বেগম সর্বদাই অতিউৎসাহী। তাকে কানে কানে বললেও কথাটা চেপে রাখবার মতো বুদ্ধি কিংবা চেষ্টা কিছুই তার ভেতর দেখা যায় না। নিচে সবাই বরের অপেক্ষায় আছে। সকলের সম্মুখে পুনরায় বিয়ের সকল কার্য সম্পাদন করা হবে। ফলে হুজুর আফিয়ার পিতা ইদরিস আলমকে শ্রাবণের ব্যাপারে জিজ্ঞেস করছিলেন। শ্রাবণের দেরি হচ্ছে বিধায় ইদরিস সাহেব তাকে ফোন করে কিন্তু ফোনটি বন্ধ। এই ব্যাপারটা আফিয়া জানতে পেরেই মার কাছে আসে সে। তার চিন্তা ছিলো মা গিয়ে মামুর সাথে কথা বলবে। কিন্তু বরাবরের মতো এবারো অতিউৎসাহী শান্তা বেগম নিজের স্বভাবের অন্তর্ভুক্ত কাজ ই করলেন। শান্তা বেগম মিনিয়ে বললেন,
“কিছু না মা, আসলে শ্রাবণ তো ওর বন্ধুদের সাথে আসছে। তাই হয়তো দেরি হচ্ছে। বোঝই তো”
শান্তা বেগম দাঁত বের করে হাসতে চেষ্টা করলেন কিন্তু মুখে দুশ্চিন্তার প্রবল ছাপ থেকেই গেলো। শ্রাবণের বিপদের কোনো ঠিক নেই, সেদিন ঘরে ভাঙ্গচুর যার সমাধান হয় নি, এরপর তার গাড়ির দূর্ঘটনা, যদিও শ্রাবণ বলেছে এটা একটা স্বাভাবিক ঘটনা তবুও শান্তা বেগমের ধারণা এটা স্বাভাবিক নয়। উপরন্তু আজ নিকের বিয়েতে তার আগমণে এতো বিলম্ব। যে ছেলে নিজ বিয়েতে এতো উৎসাহী ছিলো সে এতো দেরী করবে অকারণে ব্যাপারটা মানতে পারছে না সে। কিন্তু বিয়ে বাড়িতে নিশ্চিত না হয়ে কিছু বলতেও পারছে না। ভাইজানের স্বভাব তো অজানা নয়, এর খেসারত সে কিভাবে তুলবে অজানা। শান্তা বেগম উঠে দাঁড়ালেন৷ মোলায়েম কন্ঠে বললেন,
“তুমি বসো মা, আমি নিচে যাচ্ছি”
তারপর তড়িঘড়ি করে আফিয়া এবং শান্তা পেছন বেড়িয়ে গেলেন। এদিকে শান্তা বেগমের কথাটা বুকের ভেতরে ত্রাশের জন্ম দিলো চারুর। শ্রাবণের কি কোনো ক্ষতি হলো তবে! কেনো আসছে না সে! পুনরায় একই ঘটনা ঘটবে না তো! চারুর উজ্জ্বল মুখে মেঘমেদুর জমলো। কপালে বিন্দু বিন্দু ঘাম নিজের অস্তিত্ব জানান দিচ্ছে। পলি তার হাত ধরে বললো,
“কি রে! তুই কাঁপছিস কেনো? শরীর খারাপ লাগছে”
চারু মাথা নেড়ে “না” বললো। কিন্তু সে ঠিক নেই, তার মনে গতবারের ঘটনা পুনরাবৃত্তির ভয় হচ্ছে। সেই অজানা মানুষটি এই ক দিন কোনো চিঠি দেয় নি। চারুর আশে পাশে তার কোনো অস্তিত্বের আভাষ চারু পায় নি। ফলে মনের ভেতরে চেপে থাকা ভয়টা মুক্তির ডানা মেলেছিলো। চারু ভেবেছিলো, মানুষটি বোধ হয় হার মেনে নিয়েছে। কিন্তু সে ভুল, লোকটি কুমিরের ন্যায় কাঁদার আড়ালে লুকিয়ে ছিলো। এখন সুযোগ বুঝে আক্রমণ করছে। চারুর ভয় গাঢ় হলো, সেদিন শ্রাবণের দূর্ঘটনা তারপর তার অপহরণ এখন শ্রাবণের বিলম্ব সবকিছুর পেছনে সে নয় তো! ভাবতেই বুক কেঁপে উঠছে চারুর। তীক্ষ্ণ যন্ত্রণা হচ্ছে তার। যন্ত্রণাটা প্রবল হচ্ছে শ্রাবণের সাথে বিচ্ছেদের দুশ্চিন্তা মস্তিষ্কে আসতেই। অজান্তেই লোকটির প্রতি একটা মায়া তৈরি হয়েছে চারুর। শ্রাবণ মানে একরাশ নেশাময় আসক্তি। বিরক্তি থেকে লোকটা কিভাবে পছন্দের হয়ে উঠলো টের টিও পেলো না চারু। ধীর পায়ে মনের এক কোনে ঘাপটি মেরে বসে পড়েছে সে। নাহিয়ানের মৃত্যুর পর ভেবেছিলো বিষন্নতাই হবে তার সঙ্গী কিন্তু শ্রাবণ নামক ব্যাক্তিটি সেই বিষন্নতাকে চিরে মনের আঙ্গিনায় নিজের স্থান করেছে। এই মানুষটির কিছু হলে কিভাবে নিজেকে শান্ত রাখবে চারু। জীবনের সব রঙ গুলো আবার নিষ্ঠুরভাবে ফ্যাকাশে হয়ে উঠবে। তখন কিভাবে থাকবে সে। পনেরোদিন পূর্বেই তো মানুষটির সাথে ওতোপ্রোতোভাবে জড়ালো সে। আজ কি সব কিছু বদলে যাবে!
চারু বসে রয়েছে, সময় এগুচ্ছে। সাথে ভয় ও ঘন হচ্ছে। আশেপাশে পুনরায় কানাগোসা শুরু হয়েছে। লোকেদের ফিসফিসানি গুলো গুনগুন করছে মেঘকুঞ্জে। আহসান সাহেব ইতস্তত করে জিজ্ঞেস করছেন,
“শ্রাবণের আসতে দেরি হচ্ছে কেনো?”
মোস্তফা সাহেবের কপালে চিন্তার ভাঁজ। তিনি রাশভারী কন্ঠে বললেন,
“চিন্তা করবেন না, চলে আসবে। হয়তো গাড়ি নষ্ট হয়েছে কি না!”
আহসান সাহেব আর প্রশ্ন করলেন না। তার দূর্বল চিত্তে গতবারের আঘাতটা এখনো ভরে নি। মেয়েকে আরেকবার হেনস্তা হতে, কষ্ট পেতে, ভেঙ্গে পড়তে দেখতে পারবেন না তিনি। পিতার পক্ষে নিজ কন্যার বারংবার এমন দুর্ভোগ যে দেখা সম্ভব নয়। এদিকে জাহানারা এক কোনায় দাঁড়িয়ে আছে। মারুফা ও আসে তার সাথে। পাড়ার বয়স্ক এক মহিলা বিদ্রুপের টানে বললো,
“তোমার মাইয়ার কি দোষ আছে? বিয়ার সময় এরাম হয় কেনো?”
“এ কি বলেন খালাম্মা, আমার মেয়ে তো আপনাদের চোখের সামনেই বড় হয়েছে। দোষ গুন আপনাদের তো জানা”
জাহানারা কাঁপা গলায় কথাটা বলে। বৃদ্ধা পান চিবাতে চিবাতে বলে,
“না আসলে, যা হচ্ছে তাই কইলাম। মনে নিও না বউ। গত বিয়ার বরটা মরলো। আবার সেদিন গায়েব হয়ে গেলো। কি খোঁজা টাই না খুজলা। সেই মাইয়া আইলো রাতে। এখন এই বরের হদিস নাই। তাই আর কি প্রশ্ন জাগলো। কিছু মনে কইরো না”
“দাদী, টেবিল ফাঁকা হয়েছে। আপনারা খেতে বসে যান। অহেতুক সময় নষ্ট করবেন না। বিরিয়ানি ঠান্ডা হবে”
ফট করেই চিত্রা কথাটা বলে উঠলো। এসব প্রতিবেশীদের কোনো কাজ নেই, তারা শুধু তামাশা দেখতে ভালোবাসে। সব খানে একটা টিপ্পনী তাদের থাকেই। অহেতুক টিপ্পনী যার কোনো ভিত্তি নেই। যেমন এখন ই তার বুবুকে দোষ ওয়ালা, জ্বিনের ভর নামক অবান্তর জিনিস গুলো বানিয়ে দিবে। যেখানে তার কোনো দোষ ই নেই। এখন কারোর মৃত্যুর উপর তো মানুষের হাত নেই, তার বুবুর সাথে যাদের বিয়ে ঠিক হলেই সেই লোকের ক্ষতি হয় কথাটা একেবারেই অবান্তর। তবুও এই মহিলারা এই বিশ্রী কটুক্তি দিবে। যেটা চিত্রার অসহনীয় মনে হয়। চিত্রার তেজী কথায় থেমে গেলেন বৃদ্ধা। খাবার খেতে তিনি প্রস্থান করলেন। চিত্রা জাহানারার পাশে দাঁড়ালো। তার হাত ধরে বললো,
“চাচী, চিন্তা করবেন না। শ্রাবণ ভাই ঠিক আসবে। আমার বুবু তো কারোর ক্ষতি করে নি। তাহলে তার বেলায় ই কেনো এমন হবে বলেন, আপনি চিন্তা করবেন না”
চিত্রার কথা সত্যি খাটলো। অবশেষে ঘন্টা খানেক বাদে শ্রাবণদের গাড়ি সত্যি এলো। হালকা সাদা শেরওয়ানীতে প্রবেশ ঘটলো শ্রাবণের। শ্রাবণের আগমনের কথা শুনতেই চিত্রা ছুটে গেলো বুবুর কাছে। কানে কানে বললো,
“বুবু তোর বর এসেছে”
কথাটা শুনতেই বিষন্নতায় ভঙ্গুর চিত্তটি যেনো আশার কিরণ দেখলো। চারু ছুটে গেলো নিজের প্রিয়তমের মুখখানা দেখতে। আড়ালে এক নজর দেখলো নিজের শুভ্র ঘোড়ায় চড়ে আসা রাজকুমারকে। জাহানারা বেগম মিষ্টি খাওয়িয়ে বরণ করলেন শ্রাবণকে। শ্যামমুখে স্নিগ্ধ হাসিটা নজর এড়ালো না চারুর। অজান্তেই প্রশান্তির অশ্রু গাল ভিজিয়ে দিলো। চিত্রা নিচে গেলো, নিজের দুলাভাই এর গেট ধরতে। রেষারেষি হলো শ্রাবণের বন্ধুদের সাথে। কোনায় হাতগুটিয়ে থাকা ধ্রুবের মাঝেই কোনো উল্লাস নেই। তার দৃষ্টি বিষন্নতায় ছেয়ে আছে। বিষন্নতা গাঢ় হলো যখন আড়ালে থাকা চারুর উজ্জ্বল মুখখানি দেখলো সে। চারু তার কখনো ছিলোই না, এ চারু কেবল ই শ্রাবণের যেনো। শ্রাবণের চারুলতা। বুক চিরে দীর্ঘশ্বাস বের হলো ধ্রুবের। মনে মনে আওড়ালো,
“পূর্ণতা তুমি নিছক আমার কল্পনা,
ভালোবাসা তুমি যে বড্ড নিষ্ঠুর”
শ্রাবণের সাথে বিয়েটা সকলের সামনেই হলো আবার। লাজুক মুখে আরোও একবার কবুল বললো চারু। তবে এই কবুলে তার কোনো কষ্ট ছিলো না। কারণ এই কয়েক ঘন্টায় এতোটুকু অনুভূত হয়েছে সে অজান্তেই শ্রাবণকে মনে ঠাঁয় দিয়েছে। তাই অন্তরের মাঝে তার কোনো বাধা নেই মানুষটিকে নিজের স্বামী হিসেবে মানতে। এতো সুখের মাঝেও একটা প্রশ্ন মনে খুত খুত করছে, এতো সময় কোথায় ছিলো শ্রাবণ। মোস্তফা কামাল ছেলেকে জিজ্ঞেস করতে চেয়েছিলেন কিন্তু করেন নি। বাড়ি গিয়ে ধীরে সুস্থেই জিজ্ঞেস করবেন। বিয়ের কাজ সম্পন্ন হবার পর, বর বউ কে পাশাপাশি বসানো হলো। শ্রাবণের নজর তার চারুলতাকে দেখে যাচ্ছে। বউ বেশে বহুবার কল্পনা করেছিলো তাকে। বহুবার নিজের চারুলতার স্নিগ্ধ মুখ তার কল্পনায় ধরা দিয়েছিলো, কিন্তু বাস্তবে লাল বেনারসীতে বধু বেশে তার চারুলতাকে এতোটা সুন্দর লাগবে বুঝতে পারে নি। বারংবার হৃদস্পন্দন বেড়ে যাচ্ছে তার। সকলের আড়ালে ফিসফিস করে চারুর কানে বললো,
“আজ পৃথিবীর সকল সৌন্দর্য্য তোমার কাছে মাথা নত করবে চারুলতা। সৌন্দর্য্য যে স্নিগ্ধ ও হয় সেটার জীবন্ত উদাহরণ তুমি”
চারুলতা নজর নামিয়ে নেয়। লজ্জায় রক্তিম হয়ে উঠলো শ্যাম গালগুলো। এ যেনো অন্য অনুভূতি। প্রিয়তমের প্রেমঘন কথা অন্য শিহরণ জাগাচ্ছে। নথের আড়ালে স্মিত হাসিটা এড়ালো না শ্রাবণের চোখে। কপোত-কপোতীর খুনসুটি চলছিলো, এর মাঝেই ইন্সপেক্টর সামিনের আগমণ ঘটলো মেঘকুঞ্জে। সে এসেই মোস্তফা কামাল সাহেবকে স্যালুট দিলো। মোস্তফা কামাল বললো,
“আরে সামিন, কেমন আছো?”
“স্যার, আলহামদুলিল্লাহ। কিছু কথা ছিলো। একাকীত্বে যাওয়া যাবে?”
“হ্যা, শিওর”
সকলের আড়ালে এক কোনায় দাঁড়ালো তারা, সামিন সাবলীল কন্ঠে বললো,
“স্যার, চারু ম্যাডামের অ/প/হ/র/ণকারীদের খোঁজ পেয়েছি”
“তাই নাকি, ব্রিলিয়েন্ট। তা উগড়েছে কিছু?”
“আসলে স্যার, একটা দুঃসংবাদ ও আছে। চারু ম্যাডামের যে দুজনের অ/প/হ/র/ণকারীর খোঁজ পেয়েছি তারা দু জন ই আ/ত্ম/হ/ত্যা করেছে…….
চলবে
মুশফিকা রহমান মৈথি
#দূর_দ্বীপবাসিনী
#১৭তম_পর্ব
সকলের আড়ালে এক কোনায় দাঁড়ালো তারা, তখন সামিন সাবলীল কন্ঠে বললো,
“স্যার, চারু ম্যাডামের অ/প/হ/র/ণকারীদের খোঁজ পেয়েছি”
“তাই নাকি, ব্রিলিয়েন্ট। তা উগড়েছে কিছু?”
“আসলে স্যার, একটা দুঃসংবাদ ও আছে। চারু ম্যাডামের যে দুজনের অ/প/হ/র/ণকারীর খোঁজ পেয়েছি তারা দু জন ই আ/ত্ম/হ/ত্যা করেছে। স্ট্রেঞ্জ ব্যাপার স্যার৷ দুজন অ/প/হ/র/ণকারীর একজনের নাম নাজমুল এবং অপরজনের নাম করিম। নাজমুল এবং করিম সাধারণত চাঁদা তোলার কাজ করে। বিভিন্ন দোকান, টং, এসব এ সপ্তাহ উঠায়। আগে রাজমিস্ত্রীর কাজ করতো। মুনিবের টাকা নিজে পালিয়ে যায়। এরপর থেকে এসব কাজ করে বেড়ায়। বিভিন্ন হু/ম/কি, রা/হা/জা/নি এসবের ক্লেইম ও আছে। তবে অ/প/হ/র/ণটি চারু ম্যাডামের ই প্রথম। এর পূর্বে তারা কোনো অ/প/হ/র/ণের কেসে ছিলো না। জায়গা খালি করা, চাঁদা তোলা এসবের হু/ম/কি এর জন্য তাকে দু-তিনবার ধরাও হয়েছে। কিন্তু প্রমাণের অভাবে আবার ছেড়ে দেওয়া হয়েছে। এমন মানুষগুলো টা/কার জন্য মানুষের পেটে ছু/রি চালাতে পারে। কিন্তু নিজের হা/ত কে/টে ফেলবে এমন ব্যাপার খুব অদ্ভুত”
সামিনের কন্ঠে অবিশ্বাসের ছাপ স্পষ্ট। তার কথা শুনে মোস্তফা কামালের ও কপালে ভাঁজ পড়ে। ভ্রু যুগল এক বিন্দুতে মিলিত হয়। সাধারণত বেআইনী কাজে যারা জড়িত তাদের মাঝে আ/ত্ম/হ/ত্যার প্রবণতা থাকে না। তারা হয় প্রচন্ড ধূর্ত, তারা জীবনকে খুব ভালোবাসে। জীবনের রঙ্গ তাদের খুব ই পছন্দ। বরং ম/র/তে ভয় পায়। তারা একা থাকতে ভয় পায়, মৃ/ত্যুর পরের একাকীত্ব জীবনকে প্রচন্ড ভয় পায়। যখন ই তাদের উপর মৃ/ত্যু ভর করে, গলা শুকিয়ে আসে তাদের। বারংবার বাঁচার চেষ্টায় নিয়োজিত থাকে তারা। এমন অনেক আ/সা/মীকে দেখেছে মোস্তফা কামাল। বাঁচার কি আকুল নিবেদন। সেখানে এই দুজন আ/ত্ম/হ/ত্যা করেছে ব্যাপারটা অবিশ্বাস্য। মোস্তফা কামাল চিন্তিত কন্ঠে বললেন,
“আচ্ছা, তুমি তাদের খুঁজে পেলে কি করে!”
“স্যার, চারু ম্যাডামের ফোন। সেটা দিয়েই ট্রাক করা। করিম ফোনটার সিম ফেলে দেয়, তারপর গুলিস্তানের মোবাইলের দোকানে বিক্রি করতে গিয়েছিলো। সেখান থেকেই ওকে ট্রাক করা হয়। কয়েকদিন যাবৎ আমরা তাকে ফলো করি। সেখান থেকেই ওর বস নাজমুলের খোঁজ পাই।”
“ধরলে না কেনো তাদের?”
“স্যার আজই ওদের পুরো গ্যাং কে ধরার প্লানে ছিলাম। সিভিল ড্রেসে আমাদের টিম ওদের গোপন জায়গায় রেট দেই। দুজন ই এই ষোলদিন একটা বস্তির ঘরে গা ঢাকা দিয়েছিলো। যেই তাদের ধরার জন্য রুমের দরজা ভাঙ্গি, দুজনের মৃ/ত/দে/হ পাই। একজনের দেহ ছিলো মাটিতে এবং একজনের মেঝেতে। ইট ওয়াজ স্ট্রেঞ্জ স্যার।”
“তোমরা শিওর এটা সু/ই/সা/ই/ড? কোনো মা/র্ডা/র নয়?”
“স্যার, ফোরেন্সিকে পাঠানো হয়েছে। রিপোর্ট না আসা অবধি তো সু/ই/সা/ই/ড ই মনে হচ্ছে। কারণ ঘরে বাহির থেকে কেউ ঢুকে নি। কোনো রকম কোনো ফোর্স বা ভাঙ্গচুর বা বাহিরের কারোর আগমনের কোনো চিহ্ন আমরা পাই নি। লাশের অবস্থা দেখে মনে হলো মৃ/ত্যু/র সময়টা অনেক। হালকা পচন ধরেছে। রিপোর্ট না আসা অবধি বলা মুশকিল স্যার। তবে চিন্তা করবেন না। রিপোর্ট আসলেই আপনাকে ইনফোর্ম করবো স্যার। যদি এটা ষড়যন্ত্র হয়, তবে স্যার লোকটি খুব ধূর্ত। একটা প্রমান ছাড়ে নি। ছু/রি লা/শের পাশেই ছিলো। সব কিছু নিট এন্ড ক্লিন। তবুও ফিসি লাগছিলো বলেই আপনাকে ইনফর্ম করতে এসেছি। ইনশাআল্লাহ অতি জলদি একটা সিদ্ধান্তে উপনীত হতে পারবো স্যার”
মোস্তফা কামাল মনোযোগ সহকারে সামিনের কথা শুনছিলেন। তার মস্তিষ্কে অনেক প্রশ্ন মাথা চাড়া দিয়ে উঠেছে। কিন্তু প্রশ্ন গুলোর উত্তরটাই গোলকধাঁধা। তিনি একবার আড়চোখে নিজ ছেলের দিকে চাইলেন। শ্রাবণ তখন শালিকাদের আবদার পূরণে ব্যাস্ত। কিছু একটা ভেবে তিনি চোখ সরিয়ে নিলেন। সামিনকে বললেন,
“আজ আমার ছেলের বিয়ে, খেয়ে যাও না হয়”
“স্যার, আমি ডিউটিতে আছি। ডিউটিতে এমন বিয়ে খাওয়াটা অনৈতিক কাজ। অন্য একদিন খাবো। আজ আসি”
“হু”
সামিন তার কাছ থেকে বিদেয় নেয়। মোস্তফা কামাল একটা নিঃশ্বাস ছাঁড়লো। তারপর নিজের মুখের ভাব বদলালো। উপস্থিত বরপক্ষে নিজেকে শরীক করলো। কিন্তু মস্তিষ্ক হাজারো প্রশ্ন দাঁড় করাচ্ছে, এটা কি সত্যি আ/ত্ন/হ/ত্যা নাকি ঠান্ডা মাথায় করা খু/ন!!
দেখতে দেখতে বিদায়ের ক্ষণ চলে এলো। চারুকে নিজ হাতে শ্রাবণের গাড়িতে তুলে দিলেন আহসান সাহেব। মা-বাবা এবং চিত্রা থেকে বিচ্ছিন্ন হবার যন্ত্রণা অশ্রু রুপে গড়িয়ে পড়ছে। বিদায়ক্ষণে মাকে জড়িয়ে অনেক কেঁদেছে চারু। যে বাড়িতে তার বেড়ে, যে মানুষদের ঘিরে তার হাজারো সুখের দুঃখের সোনালী মূহুর্ত; সেই বাড়ি, সেই মানুষগুলোকে ছেড়ে যাওয়া কি সহজ! কত স্মৃতি, কত স্বপ্ন। গাড়িতে উঠার পর ও ফুপাচ্ছিলো চারু। শ্রাবণ তখন আলতো করে তার হাতখানা চেপে ধরলো। মিহি কন্ঠে বললো,
“কেঁদো না চারুলতা, আমি আছি তো। তোমার সকল দুঃখগুলো নিজের করে নিবো, আর সকল সুখের চাবিকাঠি এনে দিবো তোমার আঁচলে। কথা দিলাম”
শ্রাবণের কথাটা শুনে কান্নার বেগটা বাড়লো চারুর। হুহু করে পুনরায় কেঁদে উঠলো সে। নেত্রপল্লবে নোনাজল লেপ্টে আছে। চোখের কাঁজল চোখের নিচে বেসামাল হয়ে উঠেছে। তবুও যেনো তার চারুলতাকে সুন্দর লাগছে শ্রাবণের কাছে। হয়তো ভালোবাসাগুলো এমন ই______
চারুর গাড়ি চলে যাচ্ছে। অপলক নজিরে দেখে যাচ্ছে ধ্রুব। বিদেয়ক্ষণে প্রেয়সীর সামনে যায় নি সে। পাছে বিষাদের কালকূট তাকে পান করতে হয়। যে তার ছিলোই না তার জন্য মায়ার পাহাড় জমিয়ে কি হবে! সে সুখে থাক, এই ছোট একটা চাওয়া। তবুও বেহায়া নজর চেয়ে আছে দূরে চলে যাওয়া গাড়িটির দিকে। দৃষ্টির বাহিরে যখন চলে গেলো তখন শূন্য নজর নীলাম্বরীর মেঘের মাঝে নিজেকে খুঁজতে লাগলো। তখন চিকন মেয়েলী কন্ঠ কানে এলো,
“খাবে না?”
পেছনে ফিরতেই দেখলো চিত্রা খাবারের প্লেট হাতে দাঁড়িয়ে রয়েছে। ধ্রুব পাশ কাটিয়ে যেতে লাগলে চিত্রা ধীর গলায় বলে,
“অপূর্ণতা তো বুকে, পেটকে কষ্ট দিচ্ছো কেনো?”
“কে বলেছে আমার বুকে অপূর্ণতা। আমার মস্তিষ্ক, হৃদয় সব কিছু তার স্মৃতিতে পরিপূর্ণ”
“এখনো বুবুকেই ঘিরে তোমার চিন্তা?”
“সে অন্য কারোর, তার উপর আমার কোনো অধিকার নেই। কিন্তু আমার চিন্তা আমার ভাবনা এগুলো একান্ত আমার। আমার প্রণয়টা একান্ত আমার। তাই আমার চিন্তায় বা ভাবনার গহীনে কাকে রেখেছি, তাতে হস্তক্ষেপের অধিকার কারোর নেই। আমার ভালোবাসায় হস্তক্ষেপের অধিকার কারো নেই”
এবার কিছুটা বিচলিত হলো চিত্রা। অভিমানী স্বরে বললো,
“তোমার যদি বিয়ে হয়, তখন ও কি বুবুকেই ভালোবাসবে?”
উত্তরটা দিলো না ধ্রুব। কারণ উত্তরটা তার কাছে নেই। সত্যি কি কাউকে আবারো মনে ঠায় দিতে পারবে! কাউকে মনে ঠায় দেওয়া কি এতোই সোজা!
???
ফুলের বিছানায় বসে রয়েছে চারু। অপেক্ষা শ্রাবণের। শ্রাবণের সাদা ঘরে এই প্রথম এসেছে চারু। লোকটা এতো পরিপাটি হবে জানা ছিলো না চারুর। একেবারে শুভ্র তার ঘর। সাদা দেয়াল, তাকে সাদা পর্দা। বিছানার চাঁদরটিও সাদা। সাদা দেয়ালে শ্রাবণের কিছু ছবি। ছোট বেলার একটি ছবি, একটি এখনের, একটি বাবা-মার সাথে। শ্রাবণের মা নাকি অনেক ছোট কালে মারা গিয়েছেন। শ্রাবণ তখন মাত্র সাত বছর। তার মায়ের ছবিটির দিকে কিছু সময় তাকিয়ে রইলো চারু। শ্রাবণের নীলাভ চোখের রহস্য এই মহিলা। মহিলাটি এ দেশের নন, চেহারায় বাঙ্গালিয়ানা নেই বললেই চলে। কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইলো মহিলাটির দিকে। কি সুন্দরী মহিলা। যেনো পরম করুণাময় তাকে খুব সময় নিয়ে খুতিয়ে বানিয়েছেন। এবার চারুর নজর গেলো শ্রাবণের ছবির দিকে। অজান্তেই হাতটা তার মুখকে ছুয়ে দিলো। পুরুষটি সত্যিই সুন্দর। শ্যামবর্ণের মুখশ্রী, সুঠাম গড়ণ। গ্রীক উপন্যাসের নায়ক চরিত্রদের মতন যেনো। চারুর নজর তাকিয়ে আছে তার স্বামীর ছবির দিকে। ঠিক তখনই……
চলবে
মুশফিকা রহমান মৈথি