#দূর_দ্বীপবাসিনী,১৮,১৯
মুশফিকা রহমান মৈথি
#১৮তম_পর্ব
চারুর নজর তাকিয়ে আছে তার স্বামীর ছবির দিকে। ঠিক তখনই একজোড়া শীতল হাত তার কোমড় আঁকড়ে ধরে। আকস্মিক নিবিড় স্পর্শে ঈষৎ কেঁপে উঠে চারু। এক কড়া মাতাল গন্ধ নাকে ঠেকলো। গন্ধটি চারুর পরিচিত। যতবার শ্রাবণের কাছে গিয়েছে এই সুন্দর গন্ধটি নাকে এসেছে। মাথা খানিকটা নামিয়ে নিলো। ভীষণ লজ্জা তাকে ভর করেছে। শ্রাবণ তার ঘাড়ে থুতনী ঠেকালো। নিবিড় কন্ঠে বললো,
“ছবিতে যাকে ছুয়ে দিচ্ছিলে, বাস্তবে তার ছোয়ায়ই লজ্জা পাচ্ছো?”
প্রশ্নের উত্তরটা দিতে পারলো না চারু। তার হাতদুটো নিজের শাড়ির আচলের কোনার সাথে যুদ্ধ করতে ব্যাস্ত। শ্রাবণ কিছুমূহুর্ত উত্তরের প্রতীক্ষা করলো, তারপর নিজের দিকে ফেরালো তার লজ্জাবতী চারুলতাকে। আলতো হাতে মুখখানা তুলে ধরলো। চারু অবশেষে চোখ রাখলো শ্রাবণের চোখে। শ্রাবণের চোখে তাকাতেই এক অন্যরকম ভয় অনুভূতি হয় চারুর। শ্রাবণের চোখের ভাষা বুঝতে পারে না সে। অস্পষ্ট রহস্য এই নেত্রজোড়ায়। নীলাভ চোখে হাহাকার, উদাসীনতা, ভালোবাসা অয়াবার আক্ষেপ দেখতে পায় চারু। এর সাথে মায়ার জলসমুদ্রের ঢেউ ও নজরে পড়ে। যা চারুকে তলিয়ে দিবে গভীরে। চারু নজর থামিয়ে নিলো। হৃদস্পন্দন বেসামাল হয়ে উঠেছে। এতোকাল শ্রাবণ তার কাছে এসেছিলো বিনা অধিকারে, বিনা কোনো টানে। আজ তার অধিকার প্রবল। আজ তাদের মাঝে সমাজ, পরিবার কিছুর বাধা নেই। মাঝের অদৃশ্য দেয়াল যেনো খসে পড়েছে। শ্রাবণ বা হাত দিয়ে চারুর কপালের চুলগুলো সরিয়ে দিলো। তাদের মধ্যকার দূরুত্ব কমিয়ে দিলো কিঞ্চিত। তার উষ্ণ নিঃশ্বাস আঁছড়ে পড়ছে চারুর মুখমন্ডলে। আবেশে চোখ বুঝে নিলো চারু। কি হতে চলেছে কিছুটা হলেও আন্দাজ করতে পারছে সে। শ্রাবণের নজর তার ঈষৎ কম্পিত অধরের পানে। এক পিপাসা তাকে গ্রাস করছে। কিন্তু চারুকে অবাক করে ঠোঁট ছোয়ালো চারুর আঁখিজোড়ায়। পুনরায় উষ্ণ পরশে কেঁপে উঠলো চারুর শরীর। শিরদাঁড়া বেয়ে বয়ে গেলো উষ্ণ রক্ত। বুকের মধ্যখানে এক অন্যরকম অনুভূতি। ভারী হিয়ে উঠলো নিঃশ্বাস। শ্রাবণ ছেড়ে দিলো চারুকে। এক হাত দূরে দাঁড়ালো। তারপর ধীরস্বরে বললো,
“একদিন তোমার এই কাজলকালো চোখের প্রেমে পড়েছিলাম চারুলতা, সেই প্রেমটা গাঢ় হতে হতে কখন আসক্তিতে পরিণতা হলো টেরটি পেলাম না৷ এই চোখজোড়া ছুঁয়ে দেবার ইচ্ছেটা বড্ড পুরোনো আজ সেই ইচ্ছে আমার পূর্ণ হলো। অযাচিত ভাবে যদি ছুঁয়ে থাকি কিছু মনে করো না। তোমাকে বলে বুঝাতে পারবো না। আজ আমি কি খুশি! মানুষের আকাঙ্খা যখন পূর্ণ হয় তখন তার সুখের ঠিকানা থাকে না। আজ আমার অবস্থাটিও তাই। বহু সাধনার পর তোমায় পেলাম চারুলতা। তাই তোমার অনুমতি ছাড়াই তোমাকে ছুঁয়েছি। এই ভুল আর হবে না। তুমি যেদিন মন থেকে আমায় চাইবে সেদিন ই আমি তোমার সন্নিকটে আসবো। আমি অপেক্ষা করবো চারুলতা। আমার ধৈর্য্য কিন্তু অনেক”
চারু অবাক নয়নে চেয়ে থাকলো শ্রাবণে। তার চাহনীতে আশ্চর্য, সাথে এক অব্যক্ত প্রশান্তি। এই ঘরে যখন আফিয়া তাকে রেখে অপরিচিত ঘরে, ক্ষীন পরিচিত মানুষটির সাথে চিরজীবন কাটানোর এক অস্বস্তিকর ভয় তাকে কাবু করছিলো। স্বামী নামক মানুষটির কাছে হৃদয় হারালেও তার কাছে নিজেকে সপে দেবার সাহসটি হচ্ছিলো তার। শ্রাবণেএ প্রগাঢ় স্পর্শেও সে খানিকটা দিশেহারা হয়ে উঠেছিলো। কিন্তু এখন হৃদয় শান্ত, অজানা ভয়টি আর নেই। বরং এক পাহাড় সমান সম্মান বুকে জেগে উঠলো। সে ভুল মানুষকে হৃদয় দেয় নি। শ্রাবণের ঠোঁটে এক নির্লিপ্ত হাসি। সে মোলায়েম স্বরে বললো,
“কি ভাবছো চারুলতা?”
“ভাবছি পুরুষ এমন ও হয়?”
“যে তোমাকে ভালোবাসে সেই পুরুষ এমন ই হয়। তোমার লাগেজ এসে পড়েছে। আমি ফ্রেশ হয়ে নিচ্ছি”
শ্রাবণ দাঁড়ালো না৷ চারুর মস্তিষ্কে শ্রাবণের কথাটা ঝংকার তুলছে বারেবারে। শ্যাম গালজোড়া গোধূলীর লালিমায় আরোও একবার রঞ্জিত হচ্ছে। হৃদয়ের ভেতরে এক অন্য অনুভূতি। এই অনুভূতির কি নাম! প্রণয়! প্রেম! নাকি ভালোবাসা!
মোস্তফা কামালের সম্মুখে দাঁড়িয়ে আছে রাকিব। ক্ষণে ক্ষণে কপাল মুছতে লাগলো সে। বারে বারে কপালে ঘাম জমছে। জিহবা দিয়ে ঠোঁট ভেজাচ্ছে। বুকে ধরফর শুরু হয়েছে, গলা শুকিয়ে আসছে মোস্তফা কামালের তীক্ষ্ণ চাহনীতে। ক্ষুদ্ধ, তীক্ষ্ণ চাহনী তার শরীরের ভেতর থেকে আত্মা টেনে বের করে আনার ক্ষমতা রাখে। রাকিব কাঁপা স্বরে বললো,
“স্যার, কেনো ঢেকেছিলেন যদি বলতেন৷ রাত হয়েছে, বাড়ি যেতে হবে”
মোস্তফা কামাল দৃষ্টি সরালো না বরং ৎঁট বাকিয়ে হাসলেন। হাতের কাছে থাকা পেপার ওয়েটটি ঘুরিয়ে তীক্ষ্ণ স্বরে বললেন,
“আমাদের গাড়ি বেড়িয়েছে দুপুর আড়াইটায়। তোমাদের গাড়ির পনেরো মিনিট পর বের হবার কথা ছিলো কারণ শ্রাবণের এক বন্ধুর আসতে দেরি হচ্ছিলো। তাহলে সেই গাড়িটা পাঁচটায় কেনো পৌছালো?”
রাকিব শুকনো ঢোক গিললো। মোস্তফা কামালকে বরাবর ই ভয় পায় সে। এমন জেরার সম্মুখীন হবে আশা করে নি। কপালের ঘামখানা মুছে আমতা আমতা করে বললো,
“আসলে স্যার..”
“চারুর কি/ড/ন্যাপার দের দুজন আ/ত্ম/হ/ত্যা করেছে। এর পেছনে শ্রাবণের হাত নেই তো?”
“না না স্যার, শ্রাবণ স্যার আমার সামনেই ছিলো। আসলে স্যার, উনার epilepsy(মৃগীরোগ) এট্যাক হয়েছিলো, তাই…”
কথাটি শোনামাত্রই হাত থেমে যায় মোস্তফা কামালের। চোখে মুখে ক্ষীণ উদ্বিগ্নতা ভেসে উঠে। ব্যাস্ত স্বরে জিজ্ঞেস করে,
“হঠাৎ? ও কি ওর মেডিসিন নিচ্ছে না? আমাকে ফোন করো নি কেনো? কি হলো চুপ করে আছো কেনো?”
রাকিব দীর্ঘশ্বা ফেলে বলে,
“স্যার আপনাদের গাড়িটি বের হবার পর পর একটি ফোন আসে স্যারের মোবাইলে। ফোনে কথা বলার পর পর ই বেশ ঘাবড়ে যান তিনি। যেমন টা চারু ম্যাডামের নিখোঁজ হবার পর হয়েছিলো। একটা সময় উনার কাঁপুনী শুরু হয়। প্রতিবারের মতো তাকে ইঞ্জেকশন দেই। ঘন্টা খানেক পর উনি ঠিক হন। তার শরীর তখনও কাঁপছিলো। আমি আপনাকে ফোন করতে চেয়েছিলাম। কিন্তু স্যার শুনেন নি। উনি আমাকে ধমকিয়ে বারণ করায় আমি জানাই নি। স্যার স্বাভাবিক হবার পর ই আমরা বের হয়েছি। তাই দেরি হয়েছে। চারু ম্যাডামের প্রতি স্যারের আকর্ষণ বর্ণনাতীত। উনি এতো অসুস্থতার মাঝেও বিয়ের ওখানে যান। কারণ তিনি চারু ম্যাডামকে কষ্ট দিতে চান না। তবে স্যার এই মৃ/ত্যুতে স্যারের কোনো হাত নেই। আমি সাক্ষী”
“বুঝেছি, তুমি যেতে পারো”
রাকিব দাঁড়ালো না। বুকে ফু দয়ে বেড়িয়ে গেলো। শ্রাবণের এই রোগটি অতি পুরোনো। শ্রাবণের মা ইশরার মৃত্যুর পর থেকেই তার মৃগীরোগটি শুরু হয়। নিজ চোখে মায়ের মৃত্যু কোনো সন্তান ই সহ্য করতে পারে না। শ্রাবণ ও পারে নি। ফলে খুব ঘাবড়িয়ে গেলেই তার মৃগীব্যাড়াম হয়। খিঁচুনী দিতে শুরু করে শরীর। সঠিক সময়ে ঔষধ না পুস করা হলে তার মৃত্যু ও হতে পারে। মোস্তফা সাহেব দীর্ঘশ্বাস ফেলেন। তিনি কখনো এতো দূর্বল একজন ছেলে চান নি, কিন্তু ছেলেটা তার থেকে একেবারেই বিপরীত হয়েছে। সে যেমন মনের দিক থেকে দূর্বল, শারিরীক দিক থেকেও দূর্বল। সারা দুনিয়া যে শ্রাবণকে চেনে সে তো খোলস মাত্র। ভেতরের শ্রাবণটি একেবারেই আলাদা। এখনো সেই কাবু শিশু, যে কিনা মায়ের আঁচল বুকে জড়িয়ে ঘুমায়_________
নিজের ব্যাগ থেকে কাপড় বের করার সময় ই চারু খেয়াল করলো, তার সেই লুকায়িত বাক্সটি তার ব্যাগে পুরে দিয়েছে চিত্রা। বাহিরে তালা মারার কারণে হয়তো ভেতরে কি আছে তা দেখতে পায় নি।খুললে হয়তো দেখতে পেলো, হরেক রকম চিরকুট, যা পাগল প্রেমিক তার দূর দ্বীপবাসিনীকে লিখেছিলো। চারুর ভেতরটা ঈষৎ কেঁপে উঠলো। তার বিয়ে হয়ে গেলো অথচ এখনো সেই প্রেমিক কিছুই কিরে নি। করে নি বলাটা ঠিক নয়। সে কি করছে না করছে সেটাই তো জানে না চারু। সে যে কে তাই তো অজানা তার। চারু চায় না এই লোকটার ছায়া ও পরুক তার এবং শ্রাবনের নতুন জীবনে। যে অধ্যায় সে ছেড়ে এসেছে সেই অধ্যায়ে আবার পা রাখতে চায় না সে। পুড়িয়ে দিবে এই চিঠিগুলো। রাখবে না একটা চিহ্ন ও। সে মুক্ত, মুক্ত সেই দমবন্ধ ভালোবাসার বেড়াজাল থেকে। এখন শুধু একটা মানুষের ভালোবাসা সে পেতে চায়, সেই মানুষটি কেবল শ্রাবণ। যে ভালোবাসায় প্রশান্তি আছে, আছে এক দন্ড মুক্তির মাতাল গন্ধ। এই ভালোবাসার জলসমুদ্রে সে ডুবতেও রাজী। এর মধ্যেই ওয়াশরুমের দরজা খোলার শব্দ পায় চারু। সাথে সাথে আড়াল করে ফেলে বাক্সটি। শ্রাবণ চুল মুছতে মুছতে বেড়িয়ে আসে। টাওয়াল রাখতে রাখতে বলে,
“যাও, ফ্রেশ হয়ে নাও। আজ অনেক ধকল গেছে”
চারু বাক্সটি নিজের ব্যাগে লুকিয়ে চুএ যায় বাথরুমে। কিন্তু তার এই কাজটি নজর এড়ালো না শ্রাবণের। সে তীক্ষ্ণ চাহনীতে দেখলো ব্যাগের ভেতরে উঁকি দেওয়া বাক্সটি।
????
নিস্তব্ধ রাত। চারু ঘুমে কাঁদা। রুপালী চন্দ্ররেখা তার শ্যাম বদনে খেলা করছে। বারান্দায় নিভু আলোতে দাঁড়িয়ে আছে শ্রাবণ। হাতে একটা বেনসনের নতুন সিগারেট। আগুন জ্বালাতেই ক্ষণিকের জন্য আলোকিত হলো সেই বারান্দা। সেই আলোতে চকচক করে উঠলো চারু চিরকুটের বাক্স। শ্রাবণ নির্লিপ্ত চিত্তে সুখটান দিলো তার সিগারেটে। আকাশ থেকে নজর সরিয়ে একটিবার দেখলো সেই বাক্সটিকে। তারপর পেছনে ফিরে দেখে নিলো তার ঘুমন্ত চারুলতাকে। চারুলতার ঘুমন্ত চেহারা দেখতেই ঠোঁট বেকে হাসলো সে। দুর্বোধ্য হাসি। তারপর বললো,
“যা তোমায় ভয় দেখায়, এমন কিছুই আমি তোমার আশেপাশে রাখবো না চারুলতা। তোমাকে ঘিরে থাকবে আমার দূর্ভেদ্য ভালোবাসা। তুমি চাইলেও সেই ভালোবাসা থেকে মুক্তি নেই তোমার”
সকাল ১১টা,
ইন্সপেক্টর সামিনের কাছে এসে পৌছালো একটি খাদি খাম। খামটি ওলোটপাল্ট করে এক নজর দেখলো সামিন। তারপর খুলতেই তার মুখোভাব বদলে গেলো। ভ্রুযুগল এক বিন্দুতে মিলিত হলো। চাহনী হলো সন্দিহান। অস্পষ্ট স্বরে বলে উঠলো,
“ওহ শিট…….
চলবে
মুশফিকা রহমান মৈথি
#দূর_দ্বীপবাসিনী
#১৯তম_পর্ব
সকাল ১১টা,
ইন্সপেক্টর সামিনের কাছে এসে পৌছালো একটি খাদি খাম। খামটি ওলোটপাল্ট করে এক নজর দেখলো সামিন। তারপর খুলতেই তার মুখোভাব বদলে গেলো। ভ্রুযুগল এক বিন্দুতে মিলিত হলো। চাহনী হলো সন্দিহান। অস্পষ্ট স্বরে বলে উঠলো,
“ওহ শিট, এতো বড় একটা জিনিস কিভাবে মিস করলাম”
এর মাঝেই সাব ইন্সপেক্টর আজাদ এর আগমণ ঘটে। সে ব্যাস্ত গতিতে রুমে ঢুকলো সে। আজাদের আগমণ দেখেই সামিন খামটি এবং তার ভেতরের কাগজটি ড্রয়ারের ভেতরে রেখে দিলো। তারপর স্বাভাবিক কন্ঠে বললো,
“কি হয়েছে আজাদ, তোমাকে এমন দেখাচ্ছে কেনো?”
“স্যার, ফোরেন্সিক রিপোর্ট চলে এসেছে”
“তাহলে কি নাজমুল এবং করিমের মৃত্যু খু’ন?”
“না, স্যার। সু’ই’সা’ই’ড। পিওর সু’ই’সা’ইড। রিপোর্ট থেকে আমার চান্দি গরম হয়ে গেলো। আমি ডাক্তারের সাথেও কথা বললাম। উনি জানালো ওনাদের কোনো ভুল হয় নি। কিন্তু এটা কি সম্ভব স্যার? এরা দুজন নাকি সু’ই’সাইড করেছে। মানা যায়? ঘরে কোনো ফিঙ্গার প্রিন্টের ‘ফ’ ও নেই। ছু’রিতে শুধু ওদের আঙ্গুলের ছাপ ই পাওয়া গেছে। ব্যাপারটা আমার কাছে তো ভৌতুক লাগছে”
সামিন আজাদের কথা শুনে শব্দ করে হেসে উঠলো। দুর্বোধ্য সেই হাসি। আজাদ তার হাসি দেখেই থেমে গেলো। সামিন টেবিলের উপরের পেপারওয়েটটি হাতে নিতে নিতে বললো,
“মানুষের থেকে ভৌতুক ব্যাপার আর কি হতে পারে। এটা সু’ই’সাই’ড নয় আজাদ, ঠান্ডা মস্তিষ্কের শীতল ভাবে নিয়ন্ত্রিত খু’ন। আচ্ছা মৃ’ত্যুর সময়টা বলো তো”
“স্যার আমরা যখন লাশ পেয়েছি তার থেকে আনুমানিক চৌদ্দ বা পনেরো ঘন্টা পূর্বে হয়েছে। কিন্তু স্যার আপনি শিওর কিভাবে হচ্ছেন স্যার এটা মা’র্ডা’র?”
“আমার হাতে টুরুপের এক্কা এসেছে। মাঝে মাঝে একটু রিস্ক নিতে হয় আজাদ, নয়তো এই ঠান্ডা মস্তিষ্কের ক্রিমিনালদের ধরা কঠিন হয়েছে যায়। চলো, জিপ বের করো। আমাদের বের হতে হবে”
“কোথায় স্যার?”
“আছে একটা স্থান, চলোই না”
বলেই সামিন তার মানিব্যাগটা পকেটে পুড়লো। আজাদ ও কোনো প্রশ্ন ছাড়াই হাটলো সামিনের পেছনে। গন্তব্য গনি সাহেবের বাড়ি_____
????
বারান্দার এক কোনে নীল শাড়ি পড়ে দাঁড়িয়ে আছে চারু। মৃদু বাতাসে খোলা কোঁকড়াচুলো উড়ছে আপন উম্মাদনায়। চারু একবার তাদের বাঁধা দেবার চেষ্টা করলো কিন্তু শেষমেষ দিলো না। শূন্য দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে পশ্চিম গগনে। সেখানে বসেছে মন খারাপের মেলা। মেঘমেদুর গগণ এখন ই হয়তো কেঁদে দিবে৷ মনটা চারুর ও ভালো নেই। নতুন ঘরে মনটা বসছে না। চিত্রার ফটফট কথা, মায়ের চিন্তা, বাবার আদর, বড়চাচার ঠেস দেওয়া কথা আর ধ্রুবের আকস্মিক কাজকর্ম। এই বাড়িতে কিছুই নেই। এতো বড় বাড়িতে মানুষ মাত্র ছয়জন। দুজন কাজের মানুষ, একজন ছোটা, একজন সারাদিন থাকে। শ্রাবণের ফুপু মানুষটিকে খুব ভালো লেগেছে চারুর। কেমন একটা মা মা ভাব, চারুকে আদর ও করেন তিনি। কিছু জিজ্ঞেস করলেই হাসি মুখে উত্তর দেন। কিন্তু আফিয়াটা জানে কেমন গোমরামুখো। চারু চেয়েছিলো তার সাথে ভাব করতে কিন্তু সেটা হয় নি। আর সবথেকে ভয় হয় মোস্তফা কামালকে দেখলে। লোকটাকে দেখলেই চারুর ভেতরটা শুকিয়ে যায়। আজ সকালের কথাই ধরা যাক, শ্বশুরবাড়িতে প্রথম দিন বিধায় সকালের নাস্তা নিজ ইচ্ছেতেই চারু বানিয়েছিলো। শান্তা বেগম বেশ ক বার বারণ করেছিলো। কিন্তু চারু শুনে নি, নিজের পরিবারের জন্য কিছু করতে আপত্তি কিসের! তাই সবার জন্য নিজ উদ্যোগেই নাস্তা বানিয়েছিলো সে। ভেবেছিলো শ্বশুরবাড়ির সকলের পছন্দ হবে। কিন্তু শ্রাবণ ব্যাতীত কেউ সেই নাস্তা ছুয়েও দেখলো না। এ বাড়িতে নাকি পরোটা খাওয়া হয় না, শুকনো পাউরুটির উপর দামী বিদেশী জ্যাম এবং বাটার দিয়ে খান তারা। শ্বশুরমশাই এর দুধ চায়ে সমস্যা হয়, এসিডিটির জন্য তিনি খান গ্রীণ টি। চারুর এই বড়লোকদের খাবার অভ্যাসটা জানা ছিলো না। তাদের বাসায় তো তেলে ভাজা পরোটা, আলুভাজি আর ডিম পোচ দিয়েই সকলের উদরপূর্তি হতো। শুক্রবার হলে ভুনা খিঁচুড়ি আর মুরগী মাংস। এখানের নিয়মগুলো আলাদা। যখন সারা সকালের কষ্টকে পায়ে ঠেলে দিলো সবাই মন খারাপ হওয়াটা খুব স্বাভাবিক। মুখে প্রকাশ না করলেও তখন আকাশ পাতাল ভেঙ্গে কান্না পাচ্ছিলো চারুর। কেউ না বুঝলেও শ্রাবণের চোখ এড়ায় নি চারুর মুর্ছা যাওয়া মুখশ্রী। উজ্জ্বল মুখখানায় আষাঢ়ের মেঘ জমেছিলো যেনো। শ্রাবণ তাই গোগ্রাসে গিলতে শুরু করে নাস্তা। কিন্তু যতই হোক, এক জন তো সকলের খাবার খেতে পারে না। শ্রাবণের দেখাদেখি শান্তা বেগম ও মুখে তুলেছিলেন সেই খাবার৷ আনোয়ার সাহেব ও একটি পরোটার অর্ধেক মুখ রক্ষার্থে খেয়েছিলেন। কিন্তু মোস্তফা কামাল তার স্বাস্থ্যের ব্যাপারে খুব সচেতন, তিনি একবার বলেছেন এই নাস্তা খাবেন না তাই খান নি। খাওয়া শেষে ঘরে আসতেই শ্রাবণ তাকে বুঝানোর চেষ্টা করলো। তার মন ভালো করার হাজারো বুদ্ধি যেনো লোকটির কাছে আছে। চারুর মন ক্ষণিকের জন্য ভালো হলেও একটা শুন্যতা থেকেই গেলো। নিজ পরিবারকে ছেড়ে আসার শুন্যতা বারংবার হাতছানি দিচ্ছে। তাও খোলা বারান্দায় উদাসীন হয়ে দাঁড়য়ে আছে সে। এর মাঝেই একজোড়া শীতল হাত তাকে নিবিড় ভাবে আকঁড়ে ধরে। আকস্মিক স্পর্শে কেঁপে উঠে চারু। পেছনে ফেরার পূর্বেই কানে মোলায়েম পুরুষালি কন্ঠ পৌছায়,
“এখনো মন খারাপ চারুলতা?”
“আপনি কখন এলেন?”
“যখন তুমি আকাশের কাছে অভিযোগ করছিলে”
“আমি অভিযোগ করছিলাম, আপনি বুঝলেন কিভাবে?”
“আমি যে তোমার হৃদয়ে যে রোজ আনাগোনা”
শ্রাবণের সুগাঢ় কন্ঠে মাথা নামিয়ে নেয় চারু। লজ্জায় তার শ্যাম গাল হয়ে উঠলো রক্তিম। এভাবে হুটহাট কেউ কথা বলে। বুকের ভেতর কেমন এক অব্যক্ত অনুভূতি হয়। দম আটকে আসা অনুভূতি। শ্রাবণের হাতের বেস্টনী আরোও নিবিড় হলো। চারুর হাত ঠেকলো তার সুঠাম বুকে। বা হাতে মৃদু উড়ন্ত চুল গুলো গুজে দিলো শ্রাবণ। ধীর গলায় বললো,
“আর কত দিন লজ্জা পাবে চারুলতা, আমার কাজে তো ধরা দিতেই হবে”
কথাটা ঘোর লাগানো। চারুর কর্ণকুহরে ঝংকার তুললো যেনো। সে অবাক নজরে তাকালো শ্রাবণের দিকে। শ্রাবণ এবার তাকে ছেড়ে দিল। ঠোঁটের কোনায় এক স্নিগ্ধ হাসি। হাসিটা বুকে লাগছে যেনো। তখন ই চারুর ফোন বেজে ওঠে। গগনপানের নজর সরিয়ে ভেতরের দিকে তাকালো সে। কয়েকবার বেজে থেমে গেলে চারুর নজর আবারো যায় গগণের দিকে। কয়েকমূহুর্ত বাদে পুনোরায় ফোনটি বেজে উঠে। তাই না চাইতেও বারান্দা তজেকে সরে আস্তে হয় চারুর। ফোন স্ক্রিনে “প্রাইভেট নাম্বার” টি দেখে ভ্রু কুঞ্চিত হলো চারুর। কিছু একটা ভেবে ফোনটি ধরে সে। কিন্তু ওপর পাশ থেকে কোনো শব্দ কানে আসে না। চারুর বারবার “হ্যালো” “হ্যালো” বলতে থাকে। কিন্তু ওপর পাশের ব্যাক্তি যেনো মৌনতা ধারণ করেছে। এক পর্যায়ে বিরক্তি নিয়ে ফোনটা কেঁটে দেয় চারু।
“কার ফোন ছিলো”
“জানি না, কেউ কথা বললো না”
কথাটা শুনতেই শ্রাবণের ভ্রু কুচকে এলো। হাত বাড়িয়ে বললো,
“দাও তো দেখি”
চারু ফোনটা শ্রাবণের হাতে দিলো। তার কপালে চিন্তার ভাঁজ ভেসে উঠলো। হুট করেই বললো,
“ওই মানুষটা ফোন দিলো না তো?”
চারুর কন্ঠে ভয়। শ্রাবণ কিছুসময় চুপ করে থাকলো। নাম্বারটা রেজিস্ট্রার করা। তাই বোঝাও যাচ্ছে না নাম্বারটি কার। শ্রাবণ চারুর মুখ আলতো হাতে স্পর্শ করে বলে,
“আমি দেখছি চিন্তা করো না”
শ্রাবণের কথাটাও আশ্বস্ত করতে পারলো না চারুকে। তার চোখ মুখে ভয়ের ছাপ স্পষ্ট। শ্রাবণ ফোনটা রাখলো, তারপর চারুর ধ্যান ঘোরানোর জন্য বললো,
“আচ্ছা তোমার কি পছন্দ সাগর নাকি পাহাড়?”
“ঝর্ণা”
আনমনেই বলে উঠলো চারু। তারপর জিজ্ঞেস করলো,
“কেনো?”
“হানিমুনে যেতে হবে যে ম্যাডাম! তৈরি থাকুন। সকল লজ্জার সমাপ্তি ঘটাবো”
“ধ্যাত”
বলেই চারু ঘর ছাড়লো। শ্রাবণ হো হো করে হাসতে লাগলো। চারুর ঘর ছাড়ার পর শ্রাবণের চোখ গেলো চারুর ফোনের দিকে। ফোনটা কে করেছে! বড্ড ভাবাচ্ছে শ্রাবণ কে।
???
শান্তা বেগমের রুমে নক দিলো চারু। শান্তা বেগম তখন কিছু ছবির গায়ে হাত বুলাচ্ছিলো। চারুকে দেখেই নিপুন ভাবে চোখ মুছে নিলো সে। তারপর বললো,
“আসো বউ মা”
“ফুপি ডেকেছিলেন?”
“হ্যা, ওই কালকের বউ ভাতের শাড়ি আর গয়নাগুলো বুঝিয়ে দিতাম”
শান্তা বেগম ছবির এলব্যামটা কোল থেকে নামিয়ে রাখলেন। তারপর আলমারি থেকে একটা শাড়ি এবং গহনার বাক্স বের করলেন। তারপর চারুর হাতে উঠিয়ে দিলেন সেগুলো,
“আজ আমার দায়িত্ব শেষ হলো বুঝলে চারু মা? ভাবিকে দেওয়া কথাটা আজ রাখতে পারলাম। ভাবীর খুব ইচ্ছে ছিলো শ্রাবণের ধুমধাম করে বিয়ে দিবেন। কিন্তু হলো না। এই যে শাড়িটা দেখছো তোমার শাশুড়ি মায়ের ছিলো। সে মারা যাবার পর থেকে আমি স্বযত্নে রেখেছি, আজ আমার দায়িত্ব শেষ। এখন তুমি এগুলো সামলে রেখো”
“এতো গহনা তো আমি পড়ি না ফুপু”
“জানি, তবুও এগুলো তোমার। আমার দায়িত্ব শেষ এখন থেকে সামলে রেখো কেমন”
চারু স্মিত হেসে আগলে নিলো জিনিস গুলো। তারপর বললো,
“আপনি কিছু খাবেন ফুপু?”
“পাক্কা গিন্নি, না গো। তুমি বিশ্রাম নেও”
“আচ্ছা”
চারু উঠে চলে যেতে নিলেও থেমে যায়। পেছনে ঘুরে আমতা আমরা করে বলে,
“একটা প্রশ্ন করবো?”
“হ্যা করো”
“মা মারা গেছেন কিভাবে?”
প্রশ্নটা শুনতেই চমকে উঠলেন শান্তা বেগম……
চলবে
মুশফিকা রহমান মৈথি