দূর_দ্বীপবাসিনী,২২,২৩

0
764

#দূর_দ্বীপবাসিনী,২২,২৩
মুশফিকা রহমান মৈথি
#২২তম_পর্ব

এর মাঝেই একটা হট্টগোল শুরু হলো। স্টেজ থেকে দূরে এন্ট্রি পথে কোলাহল শুরু হলো। সিকিউরিটি ধরলো একটা যুবককে, মানুষের মুখে মুখে কানে এলো,
“শ্রাবণকে ছুরি মারা হয়েছে”

কথাটা কর্ণকুহরে ঝংকার তুললো। স্নায়ুকোষ শিথিল হয়ে গেলো যেনো চারুর। ধাতস্থ হতে সময় নিলেও অসহনীয় চিনচিনে ব্যাথা অনুভব করতে সময় নিলো না। হৃদস্পন্দন অযাচিত কারণে বেড়ে গেলো চারুর। দম আটকে আসা চিনচিনে ব্যাথা হচ্ছে তার বুকের মধ্যখানে। পটের বিবির মতো বসে থাকাটা সম্ভব হলো না তার পক্ষে, ব্যস্ত হয়ে উঠে দাঁড়ালো। চিত্রা তার হাত চেপে ধরলো, উদ্বিগ্নতা তার মাঝেও অসীম। উত্তেজিত কন্ঠে বললো,
“বুবু, আমিও যাচ্ছি তোর সাথে”

চারু সময় নষ্ট করলো না, ছুটলো কোলাহলের দিকে। জাহানারা বেগমের মুখে ত্রাশের ছাপ, এ কেমন অলুক্ষণে কান্ড! বৌ ভাতের দিন তার জামাইকে ছু’রি মা’রা হয়েছে। নিজের মেয়ের এমন দূর্ভাগ্য কোনো মায়েরই সহ্য হয় না, না চাইতেও চোখ ভিজে আসছে। চারুকে পাগলপ্রায় হয়ে ছুটতে দেখে তিনিও পিছু নিলেন।

হট্টগোলটি স্টেজ থেকে দূরে মূল গেটের দিকে হচ্ছে। সকল মেহমানের ঝট লেগেছে সেখানে। ভিড় ঠেলে সেখানে উপস্থিত হলো চারু। উদ্বিগ্ন, চিন্তিত চোখজোড়া শ্রাবণকে খুজতে লাগলো। অবশেষে পেয়েও গেলো। রাকিব তাকে ধরে রেখেছে। পেটের কাছে ডান হাত চেপে ধরে আছে সে। ফিনকি দিয়ে র’ক্ত বের হচ্ছে। একটুর জন্য মাংস ভেদ করতে পারে নি। তার পূর্বেই রাকিব সতর্কতার সাথে সরিয়ে ফেলেছে শ্রাবণকে। আর সিকিউরিটি যুবককে ধরে ফেলেছে। এতো কড়া সিকিউরিটির মাঝেও যুবক ঢুকে পড়েছে সেখানে। স্বাভাবিক মেহমানের ন্যায় ফুলের তোঁড়া হাতে শুভকামনা দিতে এগিয়ে এসেছিলো সে। শ্রাবণ হাসি মুখে তোঁড়া গ্রহণ করতেই লুকানো হাতিয়ার দিয়ে প্রহার করলো। চারু ছুটে গেলো শ্রাবণের কাছে। কাঁপা স্বরে বললো,
“আপনি ঠিক আছেন তো?”
“আলহামদুলিল্লাহ, দেখো আমি ঠিক আছি”

শ্রাবণের মুখে যন্ত্রণার ছাপ। ঠোঁট কামড়ে তীক্ষ্ণ ছুরিঘাতের যন্ত্রণাকে সহ্য করছে সে। চারু কৌতুহলের বশে পেছনে ফিরলো। সাতাশ-আঠাশ বছরের যুবক, ছিপছিপে গড়ণ, উচ্চতা শ্রাবনের মতো। ক্ষুদ্ধ চাহনীতে তাকিয়ে আছে তার এবং শ্রাবণের দিকে। তার চোখে চোখ পড়তেই চোখ সরিয়ে নিলো চারু। যুবকটিকে সে চিনে না, কিন্তু তার চাহনী ভয়ংকর। সিকিউরিটি মেরেই যাচ্ছে তাকে। কিন্তু তার চাহনী অটল। মুখে একটা শব্দ নেই। তবে কি এই মানুষটি সে, যাকে এতোকাল ভয় পেয়ে এসেছে চারু। এর মাঝেই মোস্তফা কামাল এবং পুলিশের আইজি আসে। যুবকটিকে পুলিশ ধরে নিয়ে যায়। যুবকটি তখনো চারুর দিকেই তাকিয়ে ছিলো অপলক দৃষ্টিতে। তার চোখে এক বেদনার সুপ্ত ছাপ ও ছিলো। কিন্তু চারুর নজর তার স্বামীর দিকে। মাথা নিচু করে কেঁদেই যাচ্ছে সে। শ্রাবণের প্রতি অনুভূতি গুলো এতোটা প্রবল হয়ে উঠেছে সে তার উপর একটা আঁচড় ও সহ্য হয় না চারুর। তার অনুভব হয় কেউ যেনো তার গলা চেপে ধরেছে। শ্রাবণ বা হাতে চারুর অশ্রু মুছে দিলো, ধীর কন্ঠে বললো,
“কাঁদে না চারুলতা, আমার কষ্ট হয়”

বলতে বলতেই রাকিবের উপর ঢলে পড়ে। অস্পষ্ট স্বরে চিৎকার করে উঠে চারু। না চাইতেও অনুষ্ঠানের সমাপ্তি ঘটে সেখানে____

ঘুমন্ত শ্রাবণের হাত ধরে বসে রয়েছে চারু। ঘুমের এবং ব্যাথার ঔষধ দেওয়া হয়েছে শ্রাবণকে। ফলে গভীর ঘুমে ডুবে আছে সে। পারিবারিক ডাক্তার এসেছেন, সেলাই করে দিয়েছেন ক্ষত স্থানে। ভাগ্যবশত ক্ষতটি গভীর নয়। চামড়ায় ছু’রির তীক্ষ্ণ অংশের আঘাতে চিড়ে গেছে। সুস্থ হতে তিন-চার দিন লাগবে। সেলাই না শুকানো অবধি পানি ছোঁয়া মানা। চারু অশ্রুসিক্ত চোখে তাকিয়ে আছে শ্রাবণের ঘুমন্ত মুখের দিকে৷ মুখটি ম্লান হয়ে আছে। যন্ত্রণার ক্ষীন ছাপ এখনো স্পষ্ট। চারুর কাজল লেপ্টে গেছে, গলে গলে চোখের নিচে জমা হয়েছে। নেত্রপল্লবে এখনো নোনাজল চিকচিক করছে। কিছুক্ষণ পূর্বে খুব কাঁদলেও এখন আর কাঁদছে না সে। তবুও নোনাজলের গতিপথটি শুকিয়ে কালচে দাগের মতো চোখের নিচে নিজেকে জাহির করছে। এখন রুমে কেউ নেই, সবাই নিচের বৈঠক ঘরে। আগামীকাল দ্বিরাগমনে যাবার কথা ছিলো তাদের। অথচ আজ কি হয়ে গেলো। যুবকটির পরিচয় এখনো জানা যায় নি। তবে মোস্তফা কামাল হুংকার ছেড়ে জানান দিয়েছেন উনার ছেলের শত্রুকে উনি ছেড়ে দিবেন না। লোকটির অনুভূতিগুলো শ্রাবণ কেন্দ্রিক, সেটা চারু এই দুদিনেই বুঝতে পেরেছে। কিন্তু সেই সাথে একটা ক্ষীন ভয় মনে উঁকি দিচ্ছে। এই ঘটনার জন্য চারুকে তো দোষী করা হবে না!

বৈঠক ঘরে সবার মুখ থমথমে। আজকে অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনাটি বাজে প্রভাব ফেলেছে মোস্তফা কামালের উপর। তার ছেলের সাথে ঘটে যাওয়া ঘটনাগুলো একের পর এক সাজালে যা বের হচ্ছে তা হলো কেউ শ্রাবণ এবং চারুর ক্ষতি চায়। কিন্তু সেই আজানা মানুষটি কে? গণিকে সামিন নজর বন্দীতে রেখেছে, তবে এই শত্রুটি কে! যদিও তার শত্রুর অভাব নেই। কম আসামীকে শাস্তি দেয় নি সে। তবে কি তার শত্রু আজ এর মাঝেই শান্তা বেগম ফট করে বলে উঠলেন,
“নজর লাগলো না কি আল্লাহ জানেন! ছেলেটার সাথে কি হচ্ছে বুঝতে পারছি না। একবার তার দূর্ঘটনা, এখন এই আক্রমণ। বলি কি দুটো খাশি এতিম খানায় দান করলে হয় না? যদি বালা মুসিবত গুলো যায়। আর ঘরে দোয়া পড়াই, আমার মনে হয় এতে সব ঝামেলার অন্ত হবে”
“আজাইরা কথা বলিস না শান্তা, আমি এটাই বুঝে পাচ্ছি না ওই ছেলেটা এই কাজটা করলো কেনো। রিমান্ডে নেওয়া হয়েছে নাকি ছেলেটাকে। অথচ এখনো কোনো স্বীকারোক্তি দেয় নি। আমার এদিকে চিন্তায় মাথা ফেটে যাচ্ছে আর তুই বাজে বকছিস”

তীক্ষ্ণ স্বরে কথাটি বলেন মোস্তফা সাহেব। শান্তা বেগম ঝাড়ি খেয়ে চুপসে গেলেন। কি বলতে গিয়েছিলেন মনে পড়ছে না। সে তো ভালোর জন্যই বলেছিলো। অথচ ঘরভর্তি লোকের সামনে ভাইজান তাকে বকে বসলেন। এর মাঝেই জাহানারা বেগম সাহস নিয়ে বলে উঠলেন,
“ভাই সাহেব, শান্তা আপা ভুল বলে নাই। যতই হোক ছেলে মেয়ে দুটো আমাদের। এগুলো আস্থার ব্যাপার। নজর কখন কার লাগে, আমি বলি কি শুনেছি জানের সদকা দিলে বালা মুসিবত কেটে যায়। ছেলে মেয়ে দুটোর জন্য যদি সেটা দেবার প্রয়োজন হয় ক্ষতি কি?”
“আমি বুঝতে পেরেছি আপা, কিন্তু আমি এসবে মানি না। তবুও ইচ্ছে হলে শান্তা দিতে পারে। আমি আসলে ভাবছি, এতো সিকিউরিটির মধ্যে ছু’রি নিয়ে ওই ছেলে ঢুকলো কিভাবে! যাক গে, এখন চিন্তা করবেন না! ওই ছেলে ধরা খেয়েছে যখন মুখ খুলবেই। আপনারা বরং এবার বাড়ির জন্য রওনা দেন। রাত হয়েছে। আর ওরা নাহয় ও বাড়ি শ্রাবণ সুস্থ হলেই যাবে। আমি রাকিব কে বলছি গাড়ি বের করতে”

আহসান সাহেব সম্মতি প্রকাশ করলেন। জাহানারা উপরে গেলো মেয়েকে আরোও একটিবার দেখতে। চারু এখনো সেই পোশাকেই বসে আছে। জাহানারা মেয়ের মাথায় হাত বুলিয়ে বললো,
“মা রে, কাঁদিস না। সব উপর ওয়ালার খেলা। আমরা তো তার হাতের পুতুল মাত্র। উনি যেভাবে ঠিক করে রেখেছেন সেভাবেই হবে”

চারু মাকে জড়িয়ে আবার কেঁদে উঠলো। হু হু করে কাঁদছে সে। প্রিয়জন হারাবার ভয় তাকে যেনো আষ্টেপৃষ্টে ধরে আছে। জাহানারা তার মাথায় চুমু দিয়ে বললো,
“আসি মা, নিজের খেয়াল রাখিস”

মনীরুল সাহেব এর মাঝেও নিজেকে আটকাতে পারলেন না। সকলের অগোচরে হিনহিনে স্বরে বললেন,
“এসব দোয়ায় কিছু হবে না, তোমার মেয়েই অলুক্ষনে। নয়তো পোলাটার এতো কিছু হয়। যেদিন থেকে এই মেয়ে হইছে আমাদের ঘরেও একটা অভাব হাত পা গজাইছে। এখন এই ছেলের জানের ঝুকি।”
“ভাইজান কই থামবেন?”
“আমাকে থামালেও সত্যি চাঁপা থাকবে না আহসান। তোমার মেয়ের ঘাড়ে জ্বীনের আছড় আছে”

আহসান সাহেব রুদ্রমূর্তি ধারণ করলেন। ক্রোধাগ্নি দৃষ্টি প্রয়োগ করে বললেন,
“আর একটা কথা বললে আমি ভুলে যাবো আপনি আমার ভাই”

মনীরুল সাহেব এবার থামলেন। তার মুখ থমথমে হয়ে গেলো। ভাইকে রাগতে দেখেছে হাতে গোনা মূহুর্তে। আজকের ক্ষণ ও মনে হয় তেমন ই কিছু। এর মাঝে রাকিবের কানে কথাগুলো এড়ালো না। শ্রাবণ এখন ঘুমন্ত এইটা মনীরুল সাহেবের ভাগ্য, সজাগ থাকলে উনার মুখের হয়তো এই কথাগুলোই শেষ বাক্য হতো_______

শ্রাবণের জ্ঞান ফিরলো ঘন্টা দুয়েক পড়ে। চোখি খুলতেই সিলিং নজর গেলো তার। রক্তক্ষরণে কখন ঢলে পড়েছে খেয়াল নেই। জ্ঞান ফিরতেই পেটের কাছের ক্ষত জানান দিলো সে এখনো আছে। তাই হিস করে কপাল কুঞ্চিত হয়ে এলো শ্রাবণের৷ হঠাৎ হাতে ভার অনুভব হলো। বা দিকে মাথা ঘুরাতেই নজরে পড়লো তার চারুলতার ঘুমন্ত মুখখানা। ম্লান নির্জীব মুখ, ক্লান্তি চোখের কোনায় ভর দিয়েছে। মেয়েটা বড্ড ভয় পেয়েছিলো। শ্রাবণ হাত নাড়াতেই তড়াক করে উঠে বসলো সে। ব্যাস্ত গলায় বললো,
“এখন কেমন লাগছে আপনার?”
“খুব ব্যাথা করছে”
“কোথায়?”

উদ্বিগ্নতা বাড়লো চারুর। তার চিন্তিত নজর ব্যাথার উৎস খুজতে ব্যাস্ত। তখন শ্রাবণ বা হাত দিয়ে বুকের মধ্যখানে হাত রেখে বললো,
“এখানে বড্ড ব্যাথা করছে, এক অদ্ভুত শুণ্যতা। একটু বুকে আসবে চারুলতা?……..

চলবে

মুশফিকা রহমান মৈথি

#দূর_দ্বীপবাসিনী
#২৩তম_পর্ব

উদ্বিগ্নতা বাড়লো চারুর। তার চিন্তিত নজর ব্যাথার উৎস খুজতে ব্যাস্ত। তখন শ্রাবণ বা হাত দিয়ে বুকের মধ্যখানে হাত রেখে বললো,
“এখানে বড্ড ব্যাথা করছে, এক অদ্ভুত শুণ্যতা। একটু বুকে আসবে চারুলতা?”

শ্রাবণের কন্ঠে আকুলতার আভাস পেলো চারু, সেই সাথে ফুটন্ত হাসনাহেনার সুতীব্র গন্ধের ন্যায় ঘোর মাদকতা। অম্লান হাসিটুকুতেও স্নিগ্ধতার রেশ, যেনো গাঢ় ক্লান্তির অবসান ঘটিয়ে ঘুম থেকে উঠেছে সে। শ্রাবণের দৃষ্টি অনড়, সে প্রতীক্ষায় আছে প্রিয়তমার সম্মতির। শ্রাবণের প্রবল আকুতিকে ফিরাতে পারলো না চারু। বাধ্য মেয়ের মতো তার বুকে মাথা রাখলো। শ্রাবণের বুক চিরে দীর্ঘশ্বাস বেড়িয়ে গেলো। প্রশান্তির দীর্ঘশ্বাস। সব কষ্টগুলো কর্পুরের ন্যায় উবে গেলো। চোখ বুঝে ডানহাত চলে গেলো প্রিয়তমার কোকড়ানো চুলে। নাক ঘষলো পরম আদরে, বেলীফুলের ন্যায় এক মিষ্টি ঘ্রাণ নাকে এলো। গন্ধটা মাদকতার মতো লাগে শ্রাবণের কাছে। শ্রাবণের মনে হয় তার প্রিয়তমার সর্বোত্র যেনো মাদকতা, উম্মাদনা যা তার রক্তে মিশে গেছে। ভালোবাসা তো আজকের নয়, বহু প্রতীক্ষার ফল, যে প্রতীক্ষা সে করেছে চরম ধৈর্য্য নিয়ে। অন্যদিকে, চারুর দৃষ্টি শ্রাবণের পেটের কাছে সাদা ব্যান্ডেজ লাগানো অংশে। না চাইতেও নয়নজোড়া ঝাপসা হয়ে এলো, অদূর ভবিষ্যতের না হওয়া ঘটনা ভাবতেই বুক চেপে এলো। আরোও নিবিড় হয়ে লেপ্টে রইলো চারু, যেনো মানুষটাকে ছেড়ে দিলেই কোথাও পালিয়ে যাবে। হাতখানা বুকে স্থির। মুখখানা লুকিয়ে আছে সুঠাম বুকে। শ্রাবণের লোমশ বুকখানা ভিজে গেলো নোনাজলের স্পর্শে, নিঃশব্দে প্রেয়সী কাঁদছে। ক্ষণে ক্ষণে কেঁপে উঠছে তার শরীর। শ্রাবণের অনুভূতি অসাড় নয়, সে বুঝতে পারছে কিন্তু কিছু বলছে না। বরং তার ঠোঁটের কোনায় হাসি লেপ্টে আসে। হাসিটি যেনো বিস্তৃত হলো। মাথায় বিলি কাঁটছে অনায়সে। একটা সময় ধীর হলো বিলি কাটা, মানব মানবী ঘনিষ্ট আলিঙ্গনেই গভীর নিদ্রায় ঢলে পড়লো। বহু ক্লান্তির পর প্রাপ্ত নিবৃত্ত নিদ্রা__________

********
বাহিরে হর্ণের তীক্ষ্ণ আওয়াজ কানে আসলো ধ্রুবের। টেবিলে বসে কাজ করছিলো সে, সামনে রোজা আসছে। তাই বাজারে চাহিদা বেড়েছে। তাই কাজের চাপ ও বেড়েছে। হর্ণের তীক্ষ্ণতায় তার মুখে বিরক্তির ছাপ ভেসে উঠলো, হিসেব টা নষ্ট হয়ে গেলো। আবার নতুন করে করতে হবে। কলমটা রেখে চোখ গেলো ঘড়িতে। রাত বারোটা বাজে। মেয়ের শ্বশুরবাড়ি থেকে এতোটা পড়ে আসবে এমন পরিবার তার মামার নয়। ধ্রুব সদর দরজা খুলতে গেলো। দরজা খুলতেই বিদ্যুতের মতো প্রবেশ করলেন মনীরুল সাহেব। তার মুখ ক্রোধ এবং অপমানে রক্তিম হয়ে আছে। মনীরুল সাহেবের মুখোপানে ঠিক নজর দিলো না ধ্রুব। ধ্রুবের নজর গেলো ছোট মামীর ম্লান, শুকনো মুখখানার দিকে। কৌতহলী কন্ঠে জিজ্ঞেস করলো,
“ছোট মামীর কি শরীরটা ভালো নেই?”

জাহানারা উত্তর দিলো না, বরং আঁচলখানা মুখ চেপে চোখের পানি ছেড়ে নিলো। চিত্রা দ্রুত পানে এক গ্লাস পানি নিয়ে এলো। চাচীর দিকে এগিয়ে দিতেই তিনি দু চুমুক খেয়েই রেখে দিলো। এবার কপাল কুঞ্চিত হলো ধ্রুবের। তীব্র কন্ঠে বললো,
“কি হয়েছে আমাকে কেউ বলবে?”
“কি আর হবে, চারু বিবধা হতে গিয়েছিলো”

ফট করেই কথাটা বললেন মনীরুল সাহেব। কথাটি মস্তিষ্কের স্নায়ুকোষে পৌছাতে সময় নিলো ধ্রুবের। ফ্যালফ্যাল নজরে তাকিয়ে রইলো সে মনীরুল সাহেবের দিকে। লোকটির কি সত্যি বোধশক্তি কম? কি কথা কিভাবে বলতে হয় তার কি সত্যি জানা নেই? ধ্রুব পাত্তা দিলো না তাকে। সে চিত্রার দিকে তাকিয়ে বললো,
“ও বাড়ি কি হয়েছে?”

চিত্রা বিস্তারিত ঘটনা খুলে বললো ধ্রুবকে। ধ্রুব সর্বপ্রথম একটা প্রশ্ন ই করলো,
“চারু ঠিক আছে?”
“হ্যা, বুবুর কিছু হয় নি। শ্রাবণ ভাই ও ঠিক আছেন। চার পাঁচ দিনে সেলাই শুকিয়ে যাবে”

ধ্রুব শুনলো কিন্তু কিছু বললো না, তবে একটা ব্যাপার তাকে ভাবাচ্ছে খুব। এই সকল ঘটনাগুলো কি শুধু কাকতালীয় নাকি কোনো শীতল মস্তিষ্কের পরিকল্পিত ষড়যন্ত্র। যে কেবল ই শ্রাবণ এবং চারুকে ঘিরে তার পরিকল্পনা করছে। চিত্রা খেয়াল করলো ধ্রুবের ঠোঁটের কোনায় এক অদ্ভুত হাসি। হাসিটি দূর্বোধ্য ঠেকলো তার কাছে। সে একবার জিজ্ঞেস করতে চাইলো “ধ্রুব ভাই তুমি হাসছো কেনো?” কিন্তু জিজ্ঞেস করতে পারলো না। বাড়ির মেয়ের বিপদের মাঝে এমন একটা প্রশ্ন শুধু ধ্রুবকে অপ্রস্তুত ই করবে না, বরং হাজারো প্রশ্নের সম্মুখীন করবে। চিত্রা ছোট একটা নিঃশ্বাস গোপন করলো। পা বাড়ালো নিজ ঘরে। আজকের ঘটনাগুলো বড্ড এলোমেলো, তার ছোট মস্তিষ্কে বিশ্রী প্রভাব ফেলছে। এখন যদি নিশ্চিন্তে ঘুমানো যেনো কাজে দিবে, সামনের সপ্তাহে হিসাববিজ্ঞান পরীক্ষা। বুবুর বিয়ের ঠেলায় পড়াশোনা শিকেয় তুলে দিয়েছিলো সে। যা মোটেই ঠিক নয়। ধ্রুব ভাই হিসাববিজ্ঞানে পটু কিন্তু সে তো দেবদাস মানুষ। দেবদাসেরা নাকি হিসেবে বরাবরই ই ভুল করে, তাই চিত্রা দ্বিধায় ভুগছে মানুষটার কাছে পড়তে যাবে কি না! মুখ থেকে অপষ্ট বিরক্তির আওয়াজ করে উঠলো সে। তারপর বিছানায় শরীরটা এলিয়ে দিলো সে। তবে মাথায় এতোকিছুর মাঝেও একটা প্রশ্ন ঘুরপাক খাচ্ছিলো, তা হলো ধ্রুব ভাই হাসছিলো কেনো?

শ্রাবণের ঘরে আঁধার, এসির তাপমাত্রা বাইশের কোঠায়। চারু লেপ্টে আছে তার বক্ষস্থলে। এলোমেলো চুল গুলো বিছিয়ে তাকে তার পিঠে। কম্বল খানা নাক অবধি টেনে রেখেছে সে। এসিতে ঘুমাবার অভ্যেস তার নেই, কিন্তু শ্রাবনের ঘরে দুদিন থেকেই বুঝে গেছে লোকটি এসি ব্যাতীত থাকতে পারে না। চারুর ঘনিষ্ট ভাবে লেপ্টে আছে শ্রাবণের বুকের সাথে, তার শরীরের উষ্ণতা সে তার ভালো লাগে। এদিকে সকাল হয়েছে বহুসময় পেরিয়েছে। কিন্তু পর্দার ফাঁকে আলো ঢুকতে পারছে না। থাই গ্লাসের ভাঙ্গা অংশে গতরাতে টেপ জুড়ে দিয়েছিলো চারু। এই কালো ট্যাপের অংশটাকেই অপলক দৃষ্টিতে দেখছে শ্রাবণ, ঘুম ভেঙ্গেছে অনেক সময় পেরিয়েছে। কিন্তু প্রেয়সীর ঘুমে যেনো ব্যাঘাত না ঘটে তাই অনড় ভাবেই শুয়ে আছে। প্রেয়সীর ঘুমন্ত মুখখানা দেখে অযাচিত লোভ হচ্ছে। তার চিকন গোলাপের ন্যায় ঠোঁটজোড়াকে ছুয়ে দেবার এক নিষিদ্ধ মোহ তাকে কাবু করছে ঠিকই, কিন্তু প্রেয়সীর ঘুমে ব্যাঘাত ঘটাতে চায় না সে। যতই হোক সেও পুরুষ, কামনার চাহিদা তার মাঝেও আছে। কিন্তু সেই চাহিদাকে মস্তিষ্কে ভারী হতে দিচ্ছে না শ্রাবণ পাছে চারুর মনে আর এতোকালের জমানো প্রতিচ্ছবিগুলো মিছে হয়ে যায়। আর তো কিছুদিন, সে জানে চারু তাকে মনে ঠায় দিয়েছে। একদিন হয়তো নিজেই তার কাছে সমর্পিত হবে। সেদিন হয়তো এই বাধা, দ্বিধা থাকবে না, তখন চারুকে ভালোবাসার চাদরে মুড়িয়ে রাখবে সে। এর মাঝেই দরজায় জানোয়ারের মতো প্রহার করে কেউ। বিরক্তিতে কুঞ্চিত হয়ে উঠে কপাল। চারু ঘুমাচ্ছে অথচ বাড়ির কারোর শান্তি নেই। দরজার আওয়াজে তিড়িক করে উঠে বসে চারু। খানিকটা চমকে উঠে বলে,
“কি হয়েছে? কি হয়েছে?”

দরজার ওপাশ থেকে ছোটা কাজের মেয়ে শিরিনের কন্ঠ কানে আসে,
“ভাবী, উইঠে গেলে খালুজানে আপনারে আর ভাইজানরে ডাকছে”
“আসছি”

চারু চোখ কচলায়, তারপর শ্রাবণকে জিজ্ঞেস করে,
“কখন উঠেছেন?”
“ঘন্টা দুয়েক হবে”
“আমাকে ডাকেন নি কেনো? ইশ! কি বেঘুরে ঘুমাচ্ছিলাম”
“সেজন্য ই ডাকি নি, তোমার ঘুম যে অনেক দামী আমার কাছে। কিন্তু এই শিরিন টা বুঝলে হয়”
“না, না ঠিক ই আছে। আমার ই আক্কেল কম। ঘরের বউ কি না ঘুমোচ্ছে বেলা অবধি। কি বিশ্রী! আপনি অপেক্ষা করুন আমি আপনার গা মুছিয়ে দিচ্ছি। তারপর একসাথে নিচে যাবো”

আধ ঘন্টার মাঝে শ্রাবনের ড্রেসিং করিয়ে চারু এবং শ্রাবণ নিচে গেলো। মোস্তফা সাহেব তখন খবর কাগজ পড়ছিলেন। টেবিলে নাস্তা দেওয়া হয়েছে। সে ছেলের জন্য অপেক্ষা করছিলেন। শ্রাবণ আসতেই তিনি মোলায়েম স্বরে বললেন,
“শরীর কেমন লাগছে এখন?”
“জ্বী আলহামদুলিল্লাহ ভালো, আপনি এখনো খান নি?”
“তোমার জন্য অপেক্ষা করছিলাম”
“ওহ”

সবাই খাওয়া শুরু করলে মোস্তফা সাহেব বললেন,
“সামিনের ফোন এসেছিলো, ছেলেটার নাম ঠিকানা জোগাড় করেছে নাকি ওরা। ছেলেটার নাম আরিফ, থাকে মগবাজারে। আগে কলেজে পড়ে, ইনফ্যাক্ট তোমার এবং চারুর কলেজেই। রাজনীতি করে নাকি। বুঝলাম না এই ছেলেটা কেনো তোমার উপর আক্রমণ করেছে। ছেলেটা এখন রিমান্ডে। কিন্তু এখনো মুখ খুলে নি। বেদম মার খেয়েও মুখ চেপে বসে আছে”

ছেলেটা চারুর কলেজে পড়ে শুনে কিছুটা চিন্তিত হয়ে উঠলো চারু। ছেলেটাকে আগে কখনোই দেখেনি সে। তবুও ছেলেটা এমন একটা সাংঘাতিক কাজ কেনো করবে। শ্রাবণ নির্বিকার ভঙ্গিতে বললো,
“বাদ দিন বাবা, যা হয়েছে ভুলে যান। আমি ঠিক আছি, আর ও এখন জেলে। এটাই শান্তির ব্যাপার”
“ঠিক বলেছো, আচ্ছা আমি ভাবছিলাম তোমাদের কোথাও ঘুরতে পাঠাবো। এই ক দিনে কম তো ধকল গেলো না। কেনো না কোথাও ঘুরে আসো। তোমার শরীর সুস্থ হোক, হাওয়া বদল হলে তোমাদের ভালো লাগবে”
“বেশ, যেমনটা আপনি ভালো মনে করেন। কি বলো চারু”

চারু উদাসিন চিত্তে পানির দিকে তাকিয়ে ছিলো। শ্রাবণ হালকা ধাক্কা দিতেই অন্যমনস্ক চিন্তা থেকে বেড়িয়ে এলো সে। চমকানো স্বরে বললো,
“জ্বী?”
“কি ভাবছো?”
“না, না কিছু না”
“তাহলে ঘুরতে যাওয়া ফাইনাল?”

চারু ছোট করে “হু” বললো। কিন্তু তার ভাবনা ঘুরপাক খাচ্ছে সেই আরিফ নামক ব্যাক্তিটির প্রতিই। কিসের শত্রুতা এই আরিফের শ্রাবণের সাথে____

******

সামিন নিজ কেবিনে এসে চেয়ারে সজোরে লাথি মারলো, একেই গরমে শরীর তাপ ছাড়ছে উপরন্তু এই আরিফকে প্রশ্ন করতে করতে সে ক্লান্ত। কোনো ভাবেই সে মুখ খুললো না, শান্ত দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো সে। পাঁচদিনের রিমান্ড শেষ হয়েছে অথচ একটা তথ্য ও পেলো না সে। মুখ থেকে র’ক্ত গড়িয়ে পড়ছে। সারা দেহে মারের ছাপ, অথচ মুখে টু শব্দ নেই। ছেলেটার সমস্যা কোথায় বুঝতে পারছে না। একবার শুধু বলেছে,
“ইশ! একটু জন্য হা’রা’মীটা বেঁচে গেলো”

বড্ড অপ্রকৃতস্থ ঠেকলো সামিনের কাছে। আগামীকাল তাকে কোর্টে চালান করা হবে। এদিকে মোস্তফা কামাল একেবারে কোমড় বেঁধে নেমেছে, সে মোটেই এই আরিফকে ছুটতে দিবে না। একটা স্বাভাবিক মানুষ নিজের জীবনের ঝুঁকি এভাবে নিবে না নিশ্চয়ই। এর মাঝেই ঝড়ের মত ছুটে এসেছে আজাদ। ভয়ার্ত কন্ঠে বললো সে,
“স্যার আরিফ পালিয়েছে…………

চলবে

মুশফিকা রহমান মৈথি

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here