দূর_দ্বীপবাসিনী,৩২,৩৩

0
569

#দূর_দ্বীপবাসিনী,৩২,৩৩
মুশফিকা রহমান মৈথি
#৩২তম_পর্ব

ফোন রিসিভ করতেই মুখের রঙ বিবর্ণ হয়ে গেলো চারুর। চোখ টলমল করতে লাগলো। ধপ করে মাটিতে বসে পড়লো সে। শ্রাবণ চায়ের কাপ রেখে তাড়াতাড়ি আগলে ধরলো চারুকে। অস্থির কন্ঠে বললো,
“কি হয়েছে চারুলতা?”
“বাবা আর নেই”

কথাটা স্নায়ুকোষে পৌছাতে সময় নিলো শ্রাবণের। কিছুমূহুর্ত তাকিয়ে রইলো চারুর দিকে। সিলেট থেকে আসার পর চারুর জোরাজোরিতে দু-তিন বার আহসান সাহেবের সাথে তার কথা হয়েছে। অথচ সেই আহসান সাহেব আজ নেই। শ্রাবণ শান্ত কন্ঠে বললো,
“কি বলছো? আর হঠাৎ করে কি হলো? ফোনটা কার ছিলো?”
“মা…মার ফোন ছিলো। আমা…আমাদের যে…যেতে হবে”

চারুর কন্ঠ কাঁপছে, কথাগুলো দলা পাকাচ্ছে। কান্নার দমকে কথাগুলো হয়ে গিয়েছে অস্পষ্ট। তাই বুঝা যাচ্ছে না। তার যেনো দুনিয়াটা মূহুর্তেই একশত আশি ডিগ্রি ঘুরে গিয়েছে। যে পিতার ভালোবাসার আচ্ছাদনে সে ছিলো সেই পিতা আজ নেই। অথচ তার শেষ মূহুর্তে ও তার পাশে থাকার ভাগ্যটুকু চারুর হলো না। চারু ক্ষনে ক্ষণে ডুকরে কেঁদে উঠছে। শ্রাবণ তাকে নিজের বক্ষস্থলে নিবিড়ভাবে জড়িয়ে রেখেছে। তার পুরুষালী হাতটি চারুর মাথায় আলতো করে বুলিয়ে দিচ্ছে। চারুকে শান্ত করার ব্যর্থ প্রচেষ্টা চালাচ্ছে সে। মন বিরবির করে বললো, “ইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন”।

ঢাকা মেডিক্যালের করিডোরে দাঁড়িয়ে আছে চারু। জাহানারার আর্তনাদ শোনা যাচ্ছে। সাথে আযানের ধ্বনিও কানে আসছে। চারু কাঁদছে না। সে স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। মাথায় ওড়নাটা দিয়ে, শান্ত দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে মায়ের দিকে। তার আঁখিজোড়া ফুলে গেছে এতো সময় কাঁদার জন্য, নাকের ডগাটা রক্তিম বর্ণ ধারণ করেছে। নেত্রপল্লবে এখনো নোনাজলের উপস্থিতি স্পষ্ট। মর্গে রাখা হয়েছে আহসান সাহেবের লাশ। যতটুকু পুলিশের থেকে জানা গেছে ঘটনাটা সড়ক দূর্ঘটনা। আহসান সাহেব রাস্তা পারাপার করছিলেন, তখন ই একটা ট্রাক বেসামাল হয়ে তাকে ধাক্কা মারে। বয়সের কারণে জায়গায় তার মৃত্যু হয়। কে জানতো এমন কিছু হবে। বাবা তো আজ প্রতিদিনের মতোই বের হয়েছিলো। কে জানতো এমনটা হবে! এক্সিডেন্ট হয়েছে কাওরানবাজারের এখানে। সাথে সাথে হাসপাতালে আনা হয়। সড়ক দূর্ঘটনা বলে পুলিশ ও আসে। জায়গায় মৃত ঘোষণা করা হয় আহসান সাহেব কে। বাসায় ফোন আসে তার একঘন্টা পর, জাহানারা সংবাদ টি নিতে পারে না। চিত্রা এবং মারুফা চেষ্টা করেও তাকে সামলাতে পারে না। লাশ টি এখনো চারুদের দেওয়া হয় নি, কিছু নিয়মকানুন আছে। ধ্রুব সেটাই করছে। শ্রাবণ ও মর্গেই গেছে। মর্গের দ্বিতীয় সারিতে লাশটি রাখা। শ্রাবণ গভীর নয়নে দেখলো আহসান সাহেবকে। কি অমায়িক মুখশ্রী! শ্রাবণের এখনো মনে আছে সেই রাতের কথা, যখন মনীর সাহেবের উপর রাগ করে সে চারুকে বিয়ের আবদার করেছিলো। আহসান সাহেব মোটেই রাজী ছিলেন না। একটা সময় সে শ্রাবণকে একাকীত্বে ডাকে। আহসান সাহেবের কোমলতার মাঝেও যে একজন রাসভারী মানুষের নিবাস সেটা সেই ক্ষণে টের পেয়েছিলো শ্রাবণ। আহসান সাহেব শীতল কন্ঠে গম্ভীর স্বরে বলেছিলেন,
“শ্রাবণ, মানুষ চিনতে আমার ভুল হয় না কোনোকালে। তোমাকেও চিনতে ভুল হয় নি, তোমার মাঝে চারুকে কেন্দ্র করে এক অসীম পাগলামী আছে। যা তুমি আড়াল করে রাখো ঠিকই, কিন্তু সেটা আমার কাছে প্রকাশ পেয়েছে। পাগলামীটা এতোটাই গভীর যে তুমি তোমার বাবাকে দিয়ে থানায় ফোন করিওছো। আমার মেয়েকে মাত্র কয়েক ঘন্টায় বাড়ি নিয়ে এসেছো। ভাইজানের কথায় চারুকে বিয়ে করতেও পাগলামী শুরু করেছো। ব্যাপারটা পিতা হিসেবে আমার কাছে খুব ভালোলাগলেও, ভয় হচ্ছে। ভয় হচ্ছে তুমি পাগলামীর ভেতর আমার মেয়েকেই না কষ্ট দাও। আমার মেয়ে হয়তো কোনো রাজার রাজকন্যা নয়। কিন্তু চারু আমার যক্ষের ধন, আমার সারাজীবনের জমাপুঞ্জি। আমার মেয়ের প্রতি আমার ভালোবাসাকে পরিমাপক যন্ত্র দিয়ে মাপার ক্ষমতা পরম করুনাময় ব্যাতীত কারোর নেই। যদি তোমার কোনো কাজে আমার মেয়ের ক্ষতি হয়, আমি এক মূহুর্ত সময় নিবো না ওকে আমার কাছে নিয়ে আসতে। আমার মেয়েকে অনেক কিছু সইতে হয়েছে। আর না।”
“আপনি নিশ্চিন্তে থাকবেন আংকেল, আমি চারুলতাকে নিজের থেকে বেশি ভালোবাসি। সর্বস্ব দিয়ে ওকে আগলে রাখবো। কখনো কষ্ট ছুতেও দিবো না। ভরসা রাখতে পারেন। চারুলতার আঁধার জীবনে প্রদীপের মতো থাকবো আমি”
“প্রদীপের নিচেই সবথেকে বেশি অন্ধকার, জানো তো?”
“জানি, আমার তাতে আফসোস নেই। আমার আলোটুকু নাহয় ওকেই দিলাম, আপনি অমত করবেন না আংকেল। চারুলতাকে এখানে রাখা সম্ভব নয়। বান থেকে কথার বানে হৃদয় খন্ডিত বেশি হয়”

শ্রাবণের কথায় সেদিন আর অমত করে নি। সেদিনের কথোপকথন এখনো মাথায় গেঁথে আছে শ্রাবণের। খুব কম মানুষকে সম্মান করে সে, আহসান সাহেব তাদের একজন। মাঝে মাঝে শ্রাবণের আফসোস হয়, চারুলতার মতো তার পরিবারটিও যদি এমন হতো। এমন পরিবার যেখানে তার মা এবং বাবার স্নেহের আচ্ছাদনে থাকতো সে। কিন্তু ভুল, এমন কিছুই হলো না। আজ চারুলতার কষ্টটা অনুভব করতে পারছে সে। সেও তো তার প্রিয় মানুষটিকে হারিয়েছিলো বাল্যকালে। শ্রাবণ খেয়াল করলো তার গালটা ভেজা। কত বছর পর কেঁদেছে হিসেব নেই!!

লাশ নিয়ে আসা হলো রাত নয়টায়। মনীর সাহেব এককোনায় বসে আছেন। আজকে সবচেয়ে অস্বাভাবিক কাজ করেছেন তিনি। চুপচাপ এক কোনায় বসে আছেন। পাড়ার লোকেরা খবর পেয়ে ছুটে এসেছেন। গোসলের ব্যাবস্থা পাড়ার মসজিদে করা হলো। শ্রাবণ এবং ধ্রুব দায়িত্ব নিয়ে কাজটা করলো। জাহানারাকে ঘুমের ঔষধ দেওয়া হয়েছে। আকস্মিক মৃত্যু মেনে নিতে কষ্ট হচ্ছে তার, মানসিক অবস্থা খুব ই নড়বড়ে। চারু চুপ করে বসে রয়েছে। চিত্রা থেমে থেমে নিঃশব্দে কাঁদছে। আহসান সাহেব মানুষটাকে কেন্দ্র করেই সবার সুখময় স্মৃতি, ফলে তার মৃত্যুতে পরিবারের প্রতিটি মানুষ ই ব্যথিত। গোসল শেষে লাশ রাখা হলো বাড়ির সম্মুখ দ্বারে। আগরবাতির গন্ধ থাকে আসছে। চারু সিলিং এর দিকে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রয়েছে। কত অভিমান ই না করেছিলো। আজ আফসোস হচ্ছে, সেই অভিমান গুলো না করলে কি হতো!

আহসান সাহেবের জানাযা হলো সকাল দশটায়। জানাযাতে জমায়েত হতো অজস্র মানুষ। পরিবার, পরিজন অনেকেই। লাশ নেবার সময় চারু আবার ভেঙ্গে পড়লো। বাবার লাশ জড়িয়ে ডুকরে কাঁদলো। শ্রাবণ কোনোমতে তাকে সামলালো। কবর দেবার পর যখন বাসায় ফিরলো ছেলেরা তখন বাসায় ঢুকতেই অপরিচিত পাঁচজন পুরুষের সাথে দেখা হলো তাদের। শ্রাবণ বিনয়ের সাথে বললো,
“আপনারা কারা?”
“আমরা ব্যাংকের মানুষ। আসলে আহসান সাহেবের একটা লোন ছিলো। সেই বিষয়েই কথা বলতে এসেছি”

লোনের কথা শুনতেই মনীর সাহেবের গলা শুকিয়ে আছে। তিনি শুকনো কন্ঠে শুধান,
“কত টাকা লোন?”
“জ্বী বেশী না, বিশ লাখ টাকা। এখন তো তিনি নেই, লোনটা আপনাদের ব্যাবসার উপর। তাই সেটা নিয়েই কথা বলতে এসেছিলাম”

ধ্রুব তখন শীতল কন্ঠে বলে,
“আমি আগামীকাল আসবো, বুঝেন ই তো মরা বাড়ি। আপনারা বরং আসুন”

ব্যাংকের তারা একে অপরের মুখ চাওয়াচাওয়ি করে। একজন ফট করে বলে,
“দেখুন, সমস্যা নেই। তবে যা ডিসিশন নিবেন তাড়াতাড়ি নিবেন”

ব্যাংকের তারা বেরিয়ে যেতেই মনীর সাহেব বলে উঠলেন,
“এতো বড় লোন ও আমাকে না জানিয়ে কিভাবে নিলো?”
“হয়তো প্রয়োজন ছিলো?”
“কিসের প্রয়োজন? জাহানারা তুমি জানতে এই লোনের কথা? বিশ লাখ টাকা কি ছোট কোনো টাকা। এতো বড় অংকের টাকা আমার ভাই নিয়েছে অথচ আমি ই জানি না। কি অদ্ভুত! কি হলো জাহানারা?”

জাহানারা ম্লান কন্ঠে বললো,
“আসলে ভাইজান, উনি এই লোনটা চারুর পড়াশোনার জন্য নিছিলেন। আপনাকে বললে আপনি চেঁচাবেন তাই বলেন নি। চারুর বিয়ে, পড়াশোনা, আর একটা ছোট জমি ও চারুর নামে কিনেছিলো। উনি ইন্টারেস্ট ও দিতেন সময় করে। আমাদের ভাগের টাকা থেকেই দিতেন”
“বাহ বাহ! বলি মেয়ে কি তোমার একা নাকি? আমার নাই? এই মাইয়ার জন্য ভাইয়ের কাছ থেকে লুকাইলো। কি জামানা আসলো জাহানারা। এখন এই লোন কে দেবে? তুমি? কি হলো বলো? এই বিশলাখ কে দিবে?”

মনীরুল সাহেবের কন্ঠের রেশ বাড়লো। চারু মুখ খিচিয়ে শুনছে তীক্ষ্ণ কথা। জাহানারা কখনোই এসব ব্যাপারে কথা বলে না, আজ যেনো বাধ্য হলো,
“ভাইজান, এই ব্যাবসা তো আপনার একা না। উনারও আছে। তাহলে আজ এই কথা কেনো উঠছে?”
“ওর ছিলো, আমার ভাই আজকে নাই। ভুলে যাই ও না জাহানারা তুমি আর তোমার মেয়ে পাইবা চার অংশ। তোমার স্বামী তো আর সম্পত্তি ভাগ করে দেয় নি। এখন এই সব আমার”
“ভাইজান……”
“এটা তোমার স্বামীর ভাবা উচিত ছিলো যখন নিজেরটা গোছাচ্ছিলো”

শ্রাবণ তীর্যক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো মনীরুল সাহেবের দিকে। এই মানুষটি কি সে, যে ভাইয়ের মৃত্যুর আক্ষেপ করছিলো! কি অদ্ভুত না মানুষ! বেগুনী কাগজের বেলাতেই তাদের রুপ বোঝা যায়। জাহানারা আঁচলে মুখ ঢেকে কাঁদছেন। এবার মুখ খুললো চারু,
“বড় চাচা, আমি যতদূর জানি এই ব্যাবসা আমার বাবার হাতে গড়া। অথচ আপনি আমাদের ই সেই ভাগ দিতে চান না। শুধু আমার বাবা আপনাকে না জানিয়ে একটা ঋণ করেছে তাই। আমার যতদূর মনে পড়ে আপনিও একবার এমন একটা ঋণে জড়িয়েছিলেন। সেটা আমার বাবাই দিয়েছিলো। সেটা ব্যাবসার লোন ছিলো না তাই না। যাক গে, যদি আমি আর আমার মা চার অংশ ই পাই, সেটাই আমাদের দিন। আমরা না হয় তা নিয়েই থাকি। একা মার বেশ লাগবে না”

চারু কথা যেনো সহ্য হলো না মনীর সাহেবের। অকথ্য ভাষা বের হলো মুখ থেকে। তার হাত উঠলো শুন্যে। ঠিক তখনই……………

চলবে

মুশফিকা রহমান মৈথি

#দূর_দ্বীপবাসিনী
#৩৩তম_পর্ব

চারু কথা যেনো সহ্য হলো না মনীর সাহেবের। অকথ্য ভাষা বের হলো মুখ থেকে। তার হাত উঠলো শুন্যে। ঠিক তখনই শক্ত পুরুষালী হাত শক্ত ভাবে আটকে দিলো মনীর সাহেবের হাত। চারু স্থির দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো নিজের স্বামীর দিকে। মনীর সাহেব ঘাড় ঘুরিয়ে পাশে তাকাতেই মুখোমুখি হলেন প্রজ্বলিত শ্রাবণের অগ্নিদৃষ্টির। শ্রাবণের শান্ত চোখে জ্বলন্ত অগ্নিকুন্ডু মনীর সাহেবের ভেতরে ত্রাশের সৃষ্টি করলো। শুকনো ঢোক গিললেন তিনি। শ্রাবণের শক্ত হাতের চাপে যেনো হাড়গুলো গুড়ো হয়ে যাচ্ছে তার। উপস্থিত সবার শ্রাবণের এমন রুদ্ররুপ বড্ড অচেনা। শ্রাবণ কিছু মূহুর্ত বাদে ছেড়ে দিলো মনীর সাহেবের হাত। ঝাঁঝালো কিন্তু শান্ত স্বরে বললো,
“লোন যেহেতু আমার শ্বশুর করেছেন এবং আমার স্ত্রীর জন্য করেছেন সেটা না হয় আমি ই শোধ করবো। তবে চাচার স্মরণে থাকা উচিত যে তার বয়স হয়েছে, আর চারুলতার স্বামী এখানেই উপস্থিত। আমার স্ত্রীর গায়ে কেউ হাত তুলবে আর আমি সেটা সহ্য করবো। এটা ভাবাটা ঠিক নয়। আশাকরি কথাটা মনে থাকবে”

শ্রাবণের তীক্ষ্ণ স্বর মনীর সাহেবকে হতভম্ব করে দিলো। ফ্যালফ্যাল নয়নে তিনি তাকিয়ে রইলেন শ্রাবণের দিকে। চারুর অবাক দৃষ্টি চোখে পড়তেই শ্রাবণ নরম গলায় বললো,
“মা কে ঘরে যাও। আমি আসছি একটু”

চারু মাথা মৃদু দুলিয়ে জাহানারাকে নিয়ে ভেতরে চলে গেলো। মারুফাও চিত্রাকে ইশারা করলো ভেতরে যেতে৷ মনীর সাহেব গজগজ করছেন রাগে। একটা হাটুর বয়সী ছেলে তাকে শাসালো ব্যাপারটা হজম হচ্ছে না তার। ধ্রুব সরু দৃষ্টিতে তাকিয়ে রয়েছে শ্রাবণের দিকে। শান্ত দীঘির মতো শ্রাবণ আজ ঝড়ের মতো উত্তাল হয়ে উঠেছে। ব্যাপারটা তাকে বিনোদন দিলো ঠিক, আবার কৌতুহলী ও করে তুললো। শ্রাবণের আগাম কদম কি? কি করবে সে? বেশ কৌতুহল জমেছে ধ্রুব এর মনে। সত্যি বলতে সে চায় যেনো শ্রাবণ নিজের নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলে, সে চায় যেনো শ্রাবণ একটা ভুল করে। ফলে চারুর সম্মুখে তার ভালো মানুষের মুখোশ টা খুলে পড়ে।

জাহানারা ঘরে এসে বিছানায় বসলো। ক্ষণে ক্ষণে ঢুকরে কেঁদে উঠছেন তিনি। গত কাল ও মানুষটা ছিলো অথচ আজ নেই। চিত্রা চারুর পাশে দঁড়িয়ে আছে। চারুর নির্বিকার মুখশ্রীতে লজ্জা লাগছে তার। বাবা এমন কিছু করবেন ভাবে নি সে। ইতস্ততভাবে বললো,
“বাবার কথায় কিছু মনে করিস না বুবু। বাবাকে তো দেখেই আসছিস। সে এমন ই”
“চিত্রা বিপদে মানুষকে চেনা যায় জানিস তো। আমি ভেবেছিলাম বাবা নেই, তাতে কি বড় চাচা তো আছেন। তিনি তো বাবার মতোই। কিন্তু চাচা আমার চিন্তা পুরো বদলে দিলো। টাকার অংকটা বড়, কিন্তু এতোটাই কি বড় যে সদ্য বিবধা ভাইয়ের বউ এবং বাবা হারানো মেয়েটিকে সম্পত্তির হিসেব বুঝাচ্ছেন। চাচা কখনোই বদলাবেন না চিত্রা৷ আমি সেটা আশা ও করি না।”

চিত্রা থেমে গেলো। মাঝে মাঝে বাবার উপর খুব মেজাজ খারাপ হয় তার৷ কিন্তু নিজের বাবা বলে দমে যেতে হয়। আজকের এমন একটা কাজ বাবা না করলেও পারতেন। বুবুর জখম টা তাজা, অথচ এর উপর ই বাবাকে মরিচ লবণ ছিটাতে হলো। চিত্রা দাঁড়িয়ে থাকলো না। বেরিয়ে গেলো ঘর থেকে। বের হতেই ধাক্কা খেলো ধ্রুবের সাথে। ধ্রুব চিন্তিত কন্ঠে বললো,
“ব্যাথা পেলি নাকি?”
“নাহ, ঠিক আছি”

ধ্রুব ভেতরের ঘরে সামান্য উঁকি দিয়ে বললো,
“চারুর কাছে থাক। বেচারি ছোট মামার বিয়োগ নিতে পারছে না।”
“জানি কিন্তু তার কাছে থাকতেও লজ্জা করছে বড়”
“দোষ বড় মামার, তোর তো নয়। তাহলে কিসের লজ্জা। আর ছোট মানুষ, ছোট এর মতো থাক। এতো লজ্জা গায়ে লাগাতে হবে না”

ধ্রুবের দিকে কিছুক্ষণ নির্বিকার চিত্তে তাকিয়ে রইলো চিত্রা। মনের ভেতর জমে থাকা অভিমানের ঝড়টা যেনো কমে এসেছে। কৃতজ্ঞ নজরে চাইলো সে, মানুষটার প্রতি সুপ্ত ভালোবাসাটা যেনো মনের গহীনেই লুকিয়ে রাখলো। তপ্ত নিঃশ্বাস ফেলে বললো,
“তুমি যাবে না ভেতরে?”
“আমার কাজ নেই এখানে। যখন কাজ হবে, ঠিক ই চারুর কাছে যাবো। তোর বলতে হবে না”

কথাটার মর্মার্থ ঠিক বুঝলো না। কিন্তু সে কিছু বললো ও না। পুনরায় প্রশ্ন করলে ধ্রুব সেই ভুবন ভুলানো হাসি দিবে। তখন বুকে চিনচিনে ব্যাথা হবে। এর থেকে চুপ থাকাই শ্রেয়_______

শ্রাবণের মুখ থমথমে, মস্তিষ্ক ভার হয়ে আসছে। মাথার উপর সৃষ্টির ঊষালগ্নে লাগালো ফ্যানটা ঘুরছে। তার মোচড় মোচড় শব্দ কানে আসে প্রবলভাবে। নিস্তব্দ রাতে শব্দটা যেনো আরোও তীক্ষ্ণ এবং বিরক্তিকর লাগছে। ও বাড়িতে যাওয়া হয় নি তাদের। তাই আজ ও চারুর সাথে শ্রাবণের এ বাড়িতেই থাকতে হচ্ছে। প্রকৃতি যেনো স্তব্ধ। শ্রাবণের ভেতরেও একটা স্তব্ধতা কাজ করছে। কিন্তু সেই স্তব্ধতাকে সন্তপর্ণে আঁড়াল করে রেখেছে। নিজের প্রসস্থ বুকে নিবিড় ভাবে লেপ্টে আছে চারু। চারুর ঘুমন্ত মুখের দিকে এক অপলক তাকালো সে। তারপর তাকে খুব সাবধানে পাশে শুইয়ে নিজে উঠে পড়তে গেলো। তখন বাহু টেনে ধরলো চারু। ঘুমঘুম কন্ঠে বললো,
“ঘুমান নি?”
“ঘুম আসছে না”
“কেনো?”
“এমনি”

চারু কিছুক্ষণ চুপ করে রইলো৷ তারপর ম্লান কন্ঠে বললেন,
“টাকার কথা ভাবছেন? অংক টা একটু বেশি বড় তাই না?”
“তোমাকে কে বললো আমি টাকার কথা ভাবছি?”
“কেউ বলে নি, এটা কি স্বাভাবিক নয়? আপনি বড় গলায় তখন লোন পরিশোধের কথাটা না বললেই পারতেন। একটা উপায় বেড়িয়ে যেতো”
“আর আমার চারুলতাকে অপদস্ত হতে দেখতাম?”

শ্রাবণের প্রশ্নের উত্তর দিলো না চারু। শ্রাবণ তখন তার মুখকে আলতো করে ধরলো। কপালে গভীর চুম্বন একে বললো,
“তোমাকে কেউ বাজে কথা বলবে আমার যে সহ্য হয় না চারুলতা। হোক না তোমার চাচা, তাও তার অধিকার নেই আমার চারুলতাকে অপমান করার৷ আমি এতোটাও অকর্মণ্য নই। টাকা নিয়ে চিন্তা করো না। একটা ব্যাবস্থা ঠিক করে নিবো”

চারু কথা বাড়ালো না। চট করে শ্রাবণের বুকে মুখ গুজলো। কেনো যেনো খুব কান্না পাচ্ছে। এই প্রশস্থ বুকে সব উজার করে কাঁদতে ইচ্ছে করছে। শ্রাবণ অনড় ভাবে বসে রইলো। বা হাত গুজে দিলো চারুলতার অবিন্যস্ত চুলে। বিলি কেঁটে দিতে দিতে বললো,
“ঘুমিয়ে পড়ো। রাত হয়েছে”

মনীর সাহেবের মন আজ খারাপ। মনের থেকে মেজাজ বেশি খারাপ। শ্রাবণের অপমান টা সহ্য হয় নি তার। বাসায় গেলেও সকলের হেয় দৃষ্টি সহ্য করতে হচ্ছে। মেয়ে বউ এর হেয় দৃষ্টি দেখলেই বিরক্ত লাগছে তার। আরে তোরা কি ইনকাম করিস নাকি! যে চোখ রাঙ্গাস! সেই কারণে দুপুরের পর যে বের হয়েছে তার ঘরমুখো হন নি তিনি। কিছু পুরান বন্ধুও জুটলো সেই উছিলাতে বন্ধুদের আড্ডাতেও একবার ঢু মেরে এলেন তিনি। গলা অবধি গিল্লেন বাংলা ম’দ। এর পর কোনো মতে উঠে দাঁড়ালেন। মনে সুখের অন্ত নেই। অবশেষে ভাই নামক কাটাটা সরেছে। কি চমৎকার হয়েছে সেই পরিকল্পনা। সবার কাছে নিছক দূর্ঘটনা। আসলে এমন কিছু করতেন না মনীর সাহেব। কিন্তু ভাইকে বিশ্বাস হচ্ছিলো না। সন্দেহ হচ্ছিলো সব সম্পত্তি না ভাগিয়ে নেন। যদিও পরিকল্পনাটি শুধু ছিলো তাকে অক্ষম করা। মরে যাবেন ভাবেন নি। আজ বাসায় যেতেই সকলকে বলবেন তোমাদের এতো আপত্তি বেড়িয়ে যাও আমার বাড়ি থেকে। মারুফা কখনোই স্বামীর উপর কথা বলে নি। সুতা রাং সে আপত্তি করবে না। আর জাহানারা তো মাটির মানুষ। চিত্রাকে চ/ড় থা/প্প/ড় দিয়ে বসিয়ে দিতে পারবেন। আর বাকি রইলো চারু। এই চারুটাই বেশি যন্ত্রণা দিচ্ছে। মেয়েটার সর্ব্দা যন্ত্রণাদায়ক। আজ তার জন্য ই আহসান এতো গুলো লোন করেছে। আরে মেয়েই তো, স্বর্ণের চামচে খাওয়ালেও সে মেয়ে ই থাকবে। ভাবতে ভাবতে এলোমেলো পায়ে এগুচ্ছেন মনীর সাহেব। মাঝে মাঝে গুনগুন করে উঠছেন। হঠাৎ তার মনে হলো তার পেছনে কেউ আছে, ঢুলুঢুলু চোখে পেছনে চাইলেন ও। কিন্তু কাউকে নজরে পড়লো না৷ মনের ভুল ভেবে পা বাড়ালেন মনীর সাহেব। কিন্তু তার পূর্বেই একটা গাড়ি তাকে সজোরে ধাক্কা দিয়ে মিশে গেলো অন্ধকারে। নিথর শরীরটা পড়ে রইলো রাস্তার একপাশে।

সকালে শ্রাবণের ঘুম ভাঙ্গলো চাপা আর্তনাদে। ভ্রু কুঞ্চিত হয়ে গেলো তার। গরমের উত্তাপে কাল ঘুমটা ভালো হয় নি। শেষ রাতে ঘুমিয়েছিলো সে। ঘুম থেকে উঠতেই চারুকে পাশে পেলো না। বলে ভ্রু কুঞ্চন আরোও ঘন হলো। চোখ টা কচলে চিপা সিড়ি দিয়ে নিচে নামলো সে। তখন ই দেখতে পেলো বসার ঘরে একটা লাশ আনা হয়েছে। রক্তস্নাত লাশটি আর কারোর নয় বরং মনীর সাহেবের………

চলবে

মুশফিকা রহমান মৈথি

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here