#দূর_দ্বীপবাসিনী,৩৪,৩৫
মুশফিকা রহমান মৈথি
#৩৪তম_পর্ব
চোখ টা কচলে চিপা সিড়ি দিয়ে নিচে নামলো সে। তখন ই দেখতে পেলো বসার ঘরে একটা লাশ আনা হয়েছে। রক্তস্নাত লাশটি আর কারোর নয় বরং মনীর সাহেবের। লাশটি সকালে ধ্রুব নিয়ে এসেছে। চিত্রা এক কোনায় মূর্তির ন্যায় বসে আসে। তার দৃষ্টি স্তব্ধ, দুঃখ বিষাদ কিছুই যেনো ছুতে পারছে না। চারু তার হাতখানা শক্ত করে ধরে আছে। মারুফা পাগলপ্রায় হয়ে বিলাপ করছে। জাহানারা ঠিক কিভাবে সান্ত্বনা দিবে জানা নেই। গত পরশু বিকালে নিজ স্বামীকে হারিয়েছে সে। পাড়ার সব লোক ভিড় করে বাড়িতে। দেড় দিনের ব্যাবধানে দুভাই একই ভাবে মারা গেছে ব্যাপারটা তাদের কাছে বিস্ময়ের জিনিস। কেউ সান্ত্বনা দিচ্ছে, তো কেউ জিজ্ঞেস করছে,
“তাদের কি কোনো শত্রুতা আছে?”
কারণ দুজনেরই মৃত্যু দূর্ঘটনা। প্রতিবেশীদের কারোর প্রশ্নে উত্তর দিলো না চারু। সে নিজের বোনের হাতখাতা শক্ত করে ধরে আছে। সে জানে এই মূহুর্তে চিত্রার তাকে প্রচন্ড প্রয়োজন।বাবা হারানোর শোক তো এখনো কাটে নি। গতরাতে চাচার সাথে মনোমালিন্য হয়েছে বটে তবে, তাকে এমন নিথর দেখতে হবে আশা করে নি।
শ্রাবণের মুখে আফসোসের কোনো রেখা দেখা গেলো না। সে অপলক দৃষ্টিতে দেখলো লাশটি। তার মুখভঙ্গি স্বাভাবিক, নির্বিকার। যেনো ব্যাপারটা তার জানা ছিলো। মনে মনে শুধু এতোটুকু বললো,
“পাপ, বাপকেও ছাড়ে না”
সে দাঁড়িয়ে থাকা অবস্থায় ধ্রুব তার পাশে দাঁড়ালো। লাশের দিকে এতোটাই মগ্ন হয়েছিলো সে ধ্রুবকে খেয়াল করে নি সে। ধ্রুব শান্ত কন্ঠে বললো,
“সকাল পাঁচটায় ফোন আসে। পুলিশ বলছিলো, মামার শরীরে এলকোহল পাওয়া গেছে, তাও মাত্রাছাড়ানো। তাদের মতে মামা মাতাল হয়ে রোডে চলে এসেছিলেন। তাই এক্সিডেন্ট হয়েছে। গাড়িটির হদিস পাওয়া যায় নি। কিন্তু আমার প্রশ্ন রাত তিনটে এতোই কি গাড়ির ভিড় হয়। এটা কি নিছক দূর্ঘটনা?”
“আমি কি করে জানবো বলো? আমি তো তখন আমার বউটিকে ঘুম পাড়াতে ব্যাস্ত ছিলাম। আসলে আমার বুকে না লেপ্টে থাকলে চারুলতা ঘুম আসে না”
নির্বিকার চিত্তে কথাটা বলে শ্রাবণ। এক চিলতে সূক্ষ্ণ প্রশান্তির হাসি তার ঠোঁটের কোনে। ধ্রুবের চোখের দৃষ্টি ক্ষিপ্ত, সে পারছে না শ্রাবণকে খুবলে মাটি চাপা দিতে। শ্রাবণ সেখান থেকে সরে এলো। ধ্রুব মানুষটিকে কোনোকালেই তার পছন্দ নয়। সবচেয়ে রাগ হয় যখন চরম ভালোবাসা নিয়ে সে তার চারুলতার দিকে তাকে। শ্রাবণের ইচ্ছে করে ক্ষিপ্র বাঘের মতো আক্রমণ করতে। কিন্তু নিজের শ্যালক বিধায় নিজেকে সামলায় সে। তবে এখন মনে হচ্ছে ধ্রুব ইচ্ছে করেই তার পেছনে লাগছে। হয়তো তাকে সন্দেহ করছে। শ্রাবণ কিছু একটা ভাবলো, তারপর বাঁকা হাসলো সে। এই ধ্রুব নামক পথের কাঁটাটিকে সরাতে পারলে কোনো বাঁধাই থাকবে না তার। নিজের মস্তিষ্কে জমতে থাকা জটিল পরিকল্পনার কথা ভাবতেই মন প্রসন্ন হয়ে উঠলো।
পাশাপাশি কবর দেওয়া হলো দুই ভাইকে। শ্রাবণ নিজ হাতে নামিয়েছে মনীর সাহেবের লাশ। লাশটি নামাবার বেলায় ঘৃণা হচ্ছিলো তার। একটা মানুষকে এতো সম্মান দেওয়া হচ্ছে যা তার প্রাপ্য নয়। এই মানুষটি শুধু কিছু সম্পত্তির জন্য নিজের ভাইকে পঙ্গু করতে চেয়েছিলো। কি লাভ টা হলো! যার জন্য এতো খারাপ কিছু করলো তার পাশেই চিরঘুমে যেতে হচ্ছে। আহসান সাহেবের মৃত্যু যে কোনো দূর্ঘটনা নয় সেটা বুঝতে বাকি ছিলো না শ্রাবণের৷ কিন্তু প্রমাণের অবকাশ ও ছিলো না৷ চারুলতা ভেঙ্গে পড়ায় তাকে এ নিয়ে কোনো কথা বলতে পারছিলো না সে। কিন্তু মনীর সাহেব যখন সম্পত্তি নিয়ে বাড়াবাড়ি শুরু করলেন নিজেকে শান্ত রাখতে পারলো না শ্রাবণ। অবশেষে রাকিবকে লাগালো সে কাজে। রাকিব তার শুধু বিশ্বস্ত মানুষ তাই নয়। তার সকল পাপের হিসেব এই মানুষটার কাছে। রাকিব খুব ভালো হ্যাকার ও। গণির একাউন্ট হ্যাক করে বিশ হাজার টাকার অনলাইন হেরফের ও রাকিব ই করিয়ে ছিলো। রাকিব আহসান সাহেবের দূর্ঘটনাস্থলের সিসি ক্যামেরার ফুটেজ বের করে। সেখান থেকে ট্রাকের নাম্বার। অবশেষে অতি কষ্টে তারা ট্রাকের ড্রাইভারের সাথে কথা বলে। অনেক টর্চারের পর সেই ড্রাইভার স্বীকার করে সব। তখন ই এই ব্যাপারটা জানতে পারে শ্রাবণ। ব্যাপারটা চারুলতাকে জানাতে যেয়েও জানাতে পারে না। নির্ঘুম রাতে চারুলতাকে বুকে নিয়েই দীর্ঘশ্বাসে কাটাতে হয় তার। একজন ভাই এতোটা ক্রুড় হতে পারে জানা ছিলো না শ্রাবণের। রাতে একবার উঠে গিয়েছিলো সে, যে তার চারুলতাকে কষ্ট দিয়ে তাকে মে/রে ফেলতে ইচ্ছে হচ্ছিলো। চারুলতা তাকে আটকে দেয়। এজন্যই তার মাথায় একটা জিনিস আসছে না, মনীর সাহেবকে কে হ/ত্যা করলো? মনীর সাহেব কি অজান্তেই কারোর ক্ষতি করেছে!
কবর দেওয়া শেষে বাড়ি ফিরলো ধ্রুব এবং শ্রাবণ। মেঘকুঞ্জ এখন নিস্তব্ধতা, খালি খালি লাগছে এই বাড়িটা। চিত্রা এখনো বসার ঘরের এক কোনের পিলারে মাথা ঠেকিয়ে বসে আছে। মনীর সাহেব যাবার বেলায় একবার আর্তনাদ করে উঠেছিলো। বাবাকে যেতে দিবে না সে। বাবা যেমন ই হোক, সব মেয়েদের কাছেই অত্যন্ত প্রিয় ব্যাক্তি। তাদের জন্য অগাধ ভালোবাসা পরম করুনাময় মনে দিয়েই পাঠান। লাশ নিয়ে যাবার পর আবার শান্ত হয়ে গেলো চিত্রা। চঞ্চল মেয়েটিকে এমন শান্ত দেখতে ভালো লাগছে না ধ্রুবের। এদিকে মারুফা কাঁদতে কাঁদতে বললো,
“জাহানারা, আমাদের কি হবে! চারুর তো অন্তুত বিয়ে হয়ে গেছে। আর চিত্রাটা তো এখনো ছোট। আমি কিভাবে পারবো বলতো?”
“আপা, সব হয়ে যাবে। আমাদের হাতে তপ কিছু নাই বলেন। সামান্য মানুষ আমরা। আল্লাহ ই ভালো জানেন। একেবারে নিঃস্ব হয়ে গেলাম আমরা”
জাহানারাকে জড়িয়ে ডুকরে উঠলো মারুফা। কষ্টগুলো লাগাম ছাড়া হয়ে উঠেছে। এটাই হয়তো হয়, কেউ তার ভালোবাসার মানুষের জন্য কাঁদছে তো অন্যজন নিজের সন্তানের অদূর, অজানা
অনিশ্চিত ভবিষ্যতের জন্য কাঁদছে। কিন্তু তারা কাঁদছে। ভাগ করে নিচ্ছে কষ্টগুলো। শ্রাবণ এগিয়ে গেলো চিত্রার কাছে। পরম স্নেহে মাথায় বুলালো হাত। চিত্রা আবার হাউমাউ করে কেঁদে উঠলো,
“শ্রাবণ ভাই আমি অনাথ হয়ে গেলাম। আমি অনাথ হয়ে গেলাম”
“পৃথিবী খুব নিষ্ঠুর জায়গা চিত্রা। আজ তুমি আর চারুলতা এই নিঃস্বতাকে সইছো, আমি তা বহু বছর আগে সয়েছি। আমি জানি অনুভূতিটা কেমন! কেঁদো না, কাঁদলে মানুষ ফিরে না। তোমার বুবুকেই দেখো, সেও সয়ে গেছে। তুমি ও সয়ে যাবে। এটাই যে নিয়ম। মানুষগুলো চলে যায়, থেকে যায় স্মৃতি। ভাল মন্দ স্মৃতি।”
শ্রাবণের কথায় চিত্রার ভাবান্তর হলো না। সে তার বুবুকে জড়িয়ে কাঁদছে। শ্রাবণ উঠে দাঁড়ালো। কান্না ছোঁয়াচে রোগ। তার মতো মানুষকেও প্রভাবিত করে। সেটাই করেছে। তাইতো একটা খারাপ লোকের জন্যও তার হৃদয় ব্যাথিত হচ্ছে। চারু চিত্রাকে আগলে রেখেছে। মেয়েটা সত্যি পারে। তার যে কষ্ট হচ্ছে না তা নয়। কষ্ট হচ্ছে, কিন্তু সেটাকে সে আড়াল করে রেখেছে। তার তীব্র যন্ত্রণাকে আড়াল করে আগলে ধরেছে নিজের ছোট বোনকে। ধ্রুব নির্বাক দর্শক, সে দেখে যাচ্ছে এই দুঃখবিলাস। তার মনীর সাহেবের জন্য কষ্ট লাগছে না। কিন্তু কষ্ট লাগছে চিত্রার জন্য। মেয়েটার প্রতি একটা মায়া জন্মেছে! মায়ার নাম অজানা! অজানাই থাকুক।
দেখতে দেখতে সাত দিন পেরিয়ে গেছে। দুই ভাইয়ের জন্য মিলাদ দেওয়া হয়েছে পাড়ার মসজিদে৷ বিশজন অনাথ বাচ্চাদের খাওয়ানো হয়েছে। কোরয়ান খতম দিয়ে তাদের জান্নাতবাসের দোয়াও করা হয়েছে। চারু এবং চিত্রা বাবাশোক থেকে বের হতে না পারলেও নিজেদের সামলে নিয়েছে। এই সাতদিন শ্রাবণ এই বাড়ি থেকেই সব কাজ করেছে। ধ্রুব ও তাকে সর্বক্ষণ চোখে চোখে রেখেছে। চিত্রার সাথেও দু এক বার কথা হয়েছে ধ্রুবের। এই তো গতকালের কথা, মেয়েটা বহুদিন পর ছাদে গিয়েছিলো। মুখখানা শুকনো, সৌন্দর্য যেনো মূর্ছা গেছে। ধ্রুবের মনে হলো একটা মূর্ছানো ফুল দেখছে। ধ্রুব নিজ থেকে কথা বলতে গেলো। এই কদিন মেয়েটার সাথে কথা হয় নি তার। ধ্রুবকে দেখে ম্লান হাসলো সে। ধ্রুব তখন জিজ্ঞেস করলো,
“তুই ভালো আছিস?”
প্রতিত্তরে চিত্রা বললো,
“ফুপা মারা যাবার সময় তুমি কি সেটা বুঝেছিলে? মানে বাবা নামক ছাদটা আর মাথার উপর নেই! কাউকে বাবা বলার নেই! বুঝতে পেরেছিলে?”
“নাহ, ছোট ছিলাম অনেক। মাকে জড়িয়ে ধরে বুঝার চেষ্টা করেছিলাম।”
“অহ”
“তবে কি জানিস, বাপ যেমন ই হোক! কষ্টটা একই। এখন হয়তো বিষাদ টা প্রখর। একটা সময় ম্লান হয়ে যাবে। একেবারে মিশবে না। ক্ষণে ক্ষণে স্মরণ হবে। বড় মামা যখন আমাকে অনাথ বলতো। আমার তখন বাবার কথা মনে মরতো”
“কি অদ্ভুত না বলো! একটা সময় আমি ভাবতাম তোমার দুঃখ ভাগ করে দিবো। কিন্তু এভাবে আল্লাহ সেটাকে উপলদ্ধি করাবেন বুঝি নি”
ধ্রুব আর কোনো কথা বলতে পারলো না। শুধু একরাশ ব্যাথিত নজরে চিত্রাকে দেখিতে লাগলো। এই কদিনে কতটা বদলে গেছে সে। চারু শান্ত মেয়ে, তাই তার বদল চোখে পড়ছে না। কিন্তু চিত্রারটা প্রবলভাবে চোখে বাধছে। ধ্রুব আর দাঁড়ায় নি। হনহন করে চলে এলো নিচে। তারপর থেকে আজ অবধি এখনো কথা হয় নি তার সাথে। মিলাদের কাজ করে ক্লান্ত শরীরে মেঘকুঞ্জে ফিরলো ধ্রুব। বাসায় ঢুকতেই দেখলো বসার ঘরে জটলা। জাহানারা এবং মারুফা বসে রয়েছে। এখন তারাই সব সিদ্ধান্তের মুল। তাদের সিদ্ধান্তেই চলছে সংসার। কারণ কর্তারা নেই। ধ্রুব প্রবেশ করতেই মারুফা তাকে ডাকে। সোফার পেছনে শ্রাবণ এবং চারুও দাঁড়িয়ে আছে। ধ্রুব স্বাভাবিক ভাবেই বলে,
“বলুন বড়মামী”
মারুফা কিছুক্ষণ চুপ রইলো। তারপর ঈষৎ বিব্রতভাবে বললো,
“একটা আবদার করবো, রাখবি বাপ?”
“তোমাদের আবদার আমি রাখবো না। কি বলো মামী! তোমরা তো আমার পরিবার, আমার মায়ের মতো”
“তাহলে চিত্রাটাকে বিয়ে কর…………
চলবে
মুশফিকা রহমান মৈথি
#দূর_দ্বীপবাসিনী (কপি করা নিষিদ্ধ)
#৩৫তম_পর্ব
মারুফা কিছুক্ষণ চুপ রইলো। তারপর ঈষৎ বিব্রতভাবে বললো,
“একটা আবদার করবো, রাখবি বাপ?”
“তোমাদের আবদার আমি রাখবো না। কি বলো মামী! তোমরা তো আমার পরিবার, আমার মায়ের মতো”
“তাহলে চিত্রাটাকে বিয়ে কর, আমার এই আবদারটুকু রাখ। অনেক ভেবেছি, চিত্রার বয়স আঠারোর কোঠায়। তোর মামাও নেই। আমি একা মানুষ কি করে সব করবো, দিনকাল ও ভালো নয়। তোকে ছোটবেলা থেকে দেখে আসছি। চিত্রার জন্য তোর থেকে ভালো পাত্র পাওয়া অসম্ভব। তাই আবদারটা রাখ বাবা, তুই চিত্রাকে বিয়ে কর”
ধ্রুব হতভম্ব, হতবিহ্বল দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো মারুফার দিকে। এমন কোনো আবদার বড় মামী করবে কল্পনাতেও আসে নি তার। তার তটস্থ মুখশ্রী দেখে জাহানারা বললো,
“দেখ বাবা, আমরা জানি তুই বিয়ের জন্য প্রস্তুত নস। কিন্তু আমাদের ও হাত বাধা। চিত্রার বিয়েটা যোগ্য এবং ভালো পাত্রের সাথে হলে আমরাও ঝাড়া হাত পা হয়ে যাই। তোর সাথে চিত্রার বিয়ে হয়ে ঘরের মেয়ে ঘরেই থাকবে। আমাদের চিন্তাও থাকবে না। আমাদের বিশ্বাস তুই আমাদের চিত্রাকে সুখে রাখবি”
“কিন্তু মামী”
“দেখ, আজ তোর ছোট মামা বেঁচে থাকলে তিনিও এটাই বলতেন। আমরা তোর উপর জোর করতে চাই না। ভেবে দেখ, আমিরা তোদের দুজনের সুখ ই চাই”
“আমার আর চিত্রার বয়সের পার্থক্যটা কি প্রকট নয়?”
“বয়সটা কখনোই সম্পর্কের বাঁধা হয় না ধ্রুব। আমার আর তোর মামার বয়সের পার্থক্যটা পনেরো বছর। অথচ তোর মামা আমাকে আজ পর্যন্ত অসম্মান করেন নি। সম্পর্ক তো মনের জোরে হয়। এখানে বয়সের কি কাজ। চিত্রা ছেলেমানুষ, কিন্তু তোর জন্য অযোগ্য নয় দেখিস”
ধ্রুব কথা বাড়ালো না। সে মলিন কন্ঠে বলে,
“আমাকে একটু সময় দিবেন মামী। আসলে এমন কিছু তো কখনো ভাবী নি। তাই আর কি”
“আমাদের তাড়া নেই। তুই সময় নে”
জাহানারার কথায় ম্লান হাসলো ধ্রুব। তারপর উঠে দাঁড়ালো সে। তখন ই তার চোখ পড়ে শ্রাবণের প্রজ্জ্বলিত মুখশ্রীতে। তার বাঁকা হাসি চোখ এড়ায় না ধ্রুবের। সরু দৃষ্টিতে কিছুসময় তার দিকে তাকিয়ে থাকে সে। তারপর হনহন করে নিজের কক্ষের দিকে পা বাড়ায়। মারুফা চিন্তিত কন্ঠে বলে,
“ধ্রুব রাজি হবে?”
তখন ই শ্রাবণ বলে উঠে,
“চাচী চিন্তা করবেন না, চারুলতাও দরকার হলে একবার ধ্রুবের সাথে কথা বলবে। আপনারা তো তার পরিবার। তাই আপনাদের ফিরিয়ে দেবার প্রশ্নই উঠে না”
জাহানারাও সম্মতি দেয়। ধ্রুবের উপর চাপিয়ে দেওয়াটা অন্যায় হবে। তবে তার বিশ্বাস ধ্রুব তাদের ফিরিয়ে দিবে না।
নীলাম্বরীতে আজ চাঁদ নেই। ধূসর কালো মেঘের আড়ালে ঘাপটি মেরে আছে চাঁদটি। গাঢ় নয়নে নীলাম্বরীর দিকে চেয়ে আছে ধ্রুব। চুলগুলো কপালের সামনে অবিন্যস্ত হয়ে লেপ্টে আছে। থমথমে রাত। নিগূঢ় আঁধার গ্রাস করছে রাস্তার কোনার সোডিয়াম লাইটটি। প্রকৃতিও যেনো তার মতো থমকে গেছে। দ্বন্দ চলছে হৃদতের ভেতর। মামীদের আবদার ফেলে দেবার মতো সাহস তার নেই, কিন্তু চিত্রাকে বিয়ে করাটাও সম্ভব নয়। যে হৃদয় জুড়ে চারুর বিস্তার সেই হৃদয়ে অন্য কাউকে কিভাবে স্থান দিবে। চারু হয়তো কখনোই তার হবে না। কিন্তু তাকে এখনো নিঃস্বার্থ ভাবে ভালোবেসে আসছে ধ্রুব। চিত্রাকে সে বিয়ে করলেও কখনো ভালোবাসতে পারবে কি না অনিশ্চিত। এটা কি ঠকানো নয়! চিত্রাকে ঠকাতেও বিবেক বাঁধা দিচ্ছে। বিরক্তিতে মন ছেয়ে যাচ্ছে তার। তাই তো একের পর এক নিকোটিনে পুড়া সিগারেট উড়াতে লাগলো সে। পোড়া হৃদয়ের যন্ত্রণা নিকোটিনের ধোঁয়ায় উড়াচ্ছে ধ্রুব। ঠিক সেই সময় চিকন নারী কানে এলো। সাথে সাথেই সিগারেটটি ছুঁড়ে দিলো অদূরে। পেছনে ফিরতেই এক রাশ বিষাদ জমলো হৃদয়ে। চারু দাঁড়িয়ে আছে। সংকোচ নিয়ে সে বললো,
“একটু কথা বলা যাবে ধ্রুব ভাই?”
ধ্রুব ধীর কন্ঠে বললো,
“বল, কি বলবি”
“আসলে অনধিকার চর্চা হবে। তবুও বোনটি তো আমার। তাই অনধিকার চর্চাটা করতেই হচ্ছে। আমি জানি তুমি কি নিয়ে চিন্তিত। কারণ তুমি তোমার প্রেয়সীকে ভুলতে পারছো না। তাই চিত্রাকে নিজের জীবনে স্থান দিতে পারছো না। তবে কি জানো, অতীতকে আকড়ে বাঁচাটা বুদ্ধিমানের নয়। প্রতিটা মানুষের একটা অতীত থাকেই। আমার ও৷ তো অতীত ছিলো। কিন্তু দেখো আমি আমার অতীতের জাল থেকে বেড়য়ে এসেছি। সত্যি বলতে আমি না খুব সুখী জানো। শ্রাবণের ভালোবাসার আচ্ছাদনে আমার জীবন যেনো নতুন রুপ নিয়েছে। বেরঙ্গ জীবনটা রঙ্গিন হয়ে উঠেছে। আর আমি জানি চিত্রা তোমাকে ভালোবাসে। তোমার তিক্ত প্রণয়ের জখম চিত্রার স্নিগ্ধ ভালোবাসায় ঠিক সেরে উঠবে। দেখো, তোমার জীবনেও পূর্ণতা আসবে। এই বিয়েতে অমত করো না ধ্রুব ভাই”
এতোক্ষণ চুপ করে চারুর কথাগুলো শুনছিলো ধ্রুব। হঠাৎ কি ভেবে বলে উঠলো,
“চিত্রাকে বিয়ে করলে তুই খুশী হবি?”
“খুব, আমি জানি তুমি চিত্রাকে কখনো কষ্ট দিবে না”
ধ্রুব তপ্ত নিঃশ্বাস ছাড়লো। সেই দীর্ঘশ্বাসে ছিলো এক রাশ বেদনা। যা প্রশস্থ বক্ষস্থলে সন্তপর্ণে আড়াল করে রেখেছিলো সে। চারু আর কথা বাড়ালো না। পা বাড়ালো নিচের দিকে। আর ধ্রুব শুণ্য দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো কৃষ্ণ নীলাম্বরীর ধূসর মেঘের দিকে।
চিত্রা এবং ধ্রুবের বিয়েটা পারিবারিকভাবে হলো। কোনো আয়োজন নেই, কোনো আড়ম্বরতার চিহ্ন নেই। পরিবারের পাঁচ ছয় জনের মাঝেই বিয়ে। মসজিদে খুরমা দিয়ে বিয়ে, চিত্রার পক্ষে সাক্ষী ছিলো শ্রাবণ। আর ধ্রুবের পক্ষের সাক্ষী তার বন্ধুমহলের দুজন। চিত্রাকে সাজিয়েছিলো চারু নিজ হাতে। খুব সাধারণ সাজে মেয়েটিকে অসম্ভব সুন্দর লাগছিলো। হরিণটানা চোখে গাঢ় কাজল দিয়ে দিয়েছিলো। চুলগুলো খোপা করে বেলীফুলের মালা গুজে দিয়েছিলো। পাতলা ঠোঁটজোড়ায় ছিলো কড়া রঙ্গের লিপস্টিক। আর ধ্রুব পড়েছিলো একটা সাদা পাঞ্জাবী। বিয়ের পর যখন পাশাপাশি বসানো হয়েছিলো বর বউ কে তখন সকলের মুখে একটা কথাই ছিলো এমন জোড়া অতুলনীয়। শত বিষাদের মাঝেও চিত্রার বিয়েটা যেনো একটা সুখের লহর এনে দিয়েছিলো। বাবা মৃত্যুর শোকটা এখনো হৃদয়ের প্রকোষ্ঠে লুকায়িত। কিন্তু এর মাঝেও মনটা ভালো চারুর। মা এবং চাচীর চিন্তাটা তো অন্তত কাটলো। সিড়ির এক কোনায় দাঁড়িয়ে ছিলো সে তখন ই অনুভব হলো কেউ তার খোপায় পুড়ে দিলো একটা শুভ্র বেলীফুলের মালা। ঈষৎ চমকে উঠলেও মানুষটি কে সেটা অজানা নয় চারুর। তার কড়া পুরুষালী গন্ধ নাকে আসতেই অন্যরকম মাদকতা কাজ করলো। বলিষ্ঠ হাতে তাকে পেছন থেকে জড়িয়ে বললো,
“তুমি খুশী তো চারুলতা?”
“খুব, এর শ্রেয় কিন্তু আপনার ও আছে। চিত্রার সাথে ধ্রুব ভাইয়ের বিয়ের কথাটা তো আপনি ই তুলেছিলেন”
“দুটো তৃষ্ণার্ত হৃদয়কে মিলিয়ে দিয়েছি, এতে আবার কি ক্রেডিট! যতই হোক, তাদের দুলাভাই বলে কথা! আমার ও কিছু দায়িত্ব আছে”
“এবার নিশ্চিন্তে ও বাড়ি যেতে পারবো। দেখতে দেখতে একমাস হয়ে গেছে। এই এক মাসে কতো কিছু হয়ে গেলো। বাবার মৃত্য, চাচার মৃত্য, চিত্রার বিয়ে কতোগুলো ঘটনা”
“এটাকে জীবন বলে চারুলতা”
বলে তার কাঁধে থুতনি ঠেকালো শ্রাবণ। চারু তার হাতজোড়াকে নিবিড়ভাবে আকড়ে ধরলো। পরম প্রশান্তিতে বুঝলো চোখজোড়া। মানুষটা পাশে আছে বলেই নিজেকে সামলাতে পেরেছে সে। নয়তো বিষাদের স্রোতে হারিয়ে যেতো হয়তো___________
অবশেষে এক মাস পর নিজ বাসায় ফিরলো শ্রাবণ এবং চারু। মোস্তফা সাহেবের দেখা মিললো না। তিনি চট্টগ্রামে গিয়েছেন কাজে। শান্তা একটু অসুস্থ হয়ে পড়েছে। বয়স টাও তো কম না। আফিয়া একটু ঠেস মেরে কথা বলতে চাইলো, কিন্তু শ্রাবণের তীর্যক নজরে এড়িয়ে গেলো সে। বিয়ের পর নিজ বাড়িতে এতো লম্বা সময়ের জন্য এই প্রথম থেকেছে চারু। তাই এবাড়িতে একটা থমথমে পরিবেশ। শান্তা বিছানায় শুয়ে আছে। চারুকে দেখেই স্মিত হাসলো। ভাঙ্গা কন্ঠে বললো,
“ও বাঈর সবাই কেমন আছে মা?”
“ভালো ফুপু, আসলে এতো কিছু হয়ে গেলো। তাই আসতে পারলাম না”
“আরে এসব ভেবো না। আমরা এতোটাও আদিম যুগের নই। আসলে আফিয়া তো বাচ্চা, বুঝে না। আর আমিও অসুস্থ হয়ে পড়লাম তাই, কিছু মনে করো না তুমি”
“না না, ও তো ছোট মানুষ। কি মনে করবো বলুন। আপনি বিশ্রাম নিন। আমি ফল কেটে পাঠাচ্ছি”
বলেই নিজ রুমের দিকে পা বাড়ালো চারু। শ্রাবণ পোশাক বদলেই রওনা দিলো অফিসের জন্য। অনেক দিন অফিস যাওয়া হয় না। এখন নিশ্চিন্ত সে। ধ্রুব নিজ সংসার নিয়ে ব্যাস্ত। সুতরাং তার চিন্তার কারণ নেই। শ্রাবণ চলে গেলে চারু তার কাজে ব্যাস্ত হয়ে পড়ে৷
বিকালের প্রহর, সকলের খাওয়া শেষ। ক্লান্ত চারু নিজ রুমে আসতে গা এলিয়ে দিলো সে। শান্তা বেগম অসুস্থ হওয়ায় কাজ বেড়ে গেছে, একা হাতেই তাকে করতে হয়েছে। এখন গোসল সেরে একটা শান্তির ঘুম দিবে সে। ও বাড়িতে ফোন দেওয়া হয় নি। এক বার ফোন দিলে ভালো হতো। অন্যমনস্ক হয়ে চুলের কাটাটা খুলতেই সেই হাত ফসকে পড়ে গেলো। ছিটকে গিয়ে আলমারীর পেছনে যেয়ে পড়লো। কাটাটি তার অতি পছন্দের। ফলে কিঞ্চিত ব্যাস্ত হয়ে গেলো কাটাটি বের করতে। ভারী আলমারী না সরালে কাটা বের করা সম্ভব নয়। ফলে কাজের লোককে ডাকলো চারু। তার সহায়তায় ই আলমারীটি কিঞ্চিত সামলে আগালো সে। কাটাটি সামনেই ছিলো ফলে তার বের করতে ঝামেলা হলো না। কিন্তু এর সাথেই নজরে পড়লো খুব ই অদ্ভুত একটি জিনিস। আলমারীর তৃতীয় পাল্লার পেছনে দেয়ালটায় একটা দরজার মতো কিছু। অবাক কন্ঠে শুধালো কাজের লোককে,
“চাচা, এই দরজাটা কিসের?”
“আমি জানি না মা, এটা তো শ্রাবণ বাবার ঘর। উনি ই জানেন”
চারুর কৌতুহল বাড়লো। কিন্তু প্রকাশ করলো না সে। কাজের লোক চলে গেলে কিছুসময় চুপ করে বসে রইলো। তার পর খুজতে লাগলো আলমারীর চাবির গুচ্ছ। কিন্তু আলমারীর চাবির গুচ্ছে পাল্লার চাবি টি নেই। চারুর কৌতুহল বাড়ছে। নিষিদ্ধ বস্তুর প্রতি অসীম কৌতুহল। এই পাল্লার পেছনে কি আছে তাকে জানতেই হবে, তখনই…….
চলবে
মুশফিকা রহমান মৈথি