দূর_দ্বীপবাসিনী,৩৬,৩৭

0
614

#দূর_দ্বীপবাসিনী,৩৬,৩৭
মুশফিকা রহমান মৈথি
#৩৬তম_পর্ব

চারুর কৌতুহল বাড়ছে। নিষিদ্ধ বস্তুর প্রতি অসীম কৌতুহল। এই পাল্লার পেছনে কি আছে তাকে জানতেই হবে। তখনই পায়ের শব্দ কানে আসে চারুর। চমকে উঠলো সে। পেছনে ফিরতেই দেখলো শ্রাবণ দাঁড়িয়ে আছে। তার তীর্যক দৃষ্টি দেখতে লাগলো চারুকে। চারুর মনে হলো সে চুরি করতে যেয়ে ধরা পড়ে গিয়েছে। গলা শুকিয়ে আসছে তার। কপালে জমতে লাগলো বিন্দু বিন্দু ঘাম। চারুর উদ্ভ্রান্ত নজর দেখে শ্রাবণ সন্দিহান কন্ঠে জিজ্ঞেস করলো,
“চমকে উঠেছিলে বুঝি?”
“আপনি এখন? আপনার তো রাতে আসার কথা ছিলো”
“অফিসে মন বসছিলো না। আর কাজ ও ছিলো না তেমন। কিন্তু তোমাকে এমন লাগছে কেনো? তুমি তো ঘামছো”
“গরম পড়েছো তাই! এজন্য হয়তো এমন দেখাচ্ছে। আপনি বসুন আমি গোসল করে আসছি। আসলে এতো সময় তো রান্নাঘরে ছিলাম৷ ঘেমে গিয়েছি”

ইতস্ততভাবে কথাটা বললো চারু। তার কথায় মৃদু হাসলো শ্রাবণ। কাধের অফিস ব্যাগটা রেখেই এগিয়ে গেলো চারুর দিকে। চারু কিছুটা ভড়কালো কিন্তু প্রকাশ করলো না। শ্রাবণ তার কোমড়খানা টেনে নিজের প্রশস্থ বুকের সাথে মেশালো। কপালে এলোমেলো চুলগুলো সরিয়ে বললো,
“ঘামেসিক্ত এই চারুলতাকেই যে বারংবার ভালোবাসতে ইচ্ছে হয়। তুমি জানো তোমাকে এখন পৃথিবীর সবচেয়ে সুন্দর নারীটি লাগছে। এই যে ঠোঁটের উপর জমায়িত তোমার বিন্দু বিন্দু ঘাম, আমার কাছে মুক্তোদানার মতো ঠেকছে”

শ্রাবণের আঙ্গুলের ঢগা ছুয়ে দিচ্ছে চারুর ঠোঁট। পরম আবেশে চোখ বুযে আসলো চারুলতা। শ্রাবণ কিঞ্চিত ঝুকলো। উষ্ণ পরশ ছোঁয়ালো চারুর পাতলা ঠোঁটে। মৃদু হেসে বললো,
“ভালোবাসি চারুলতা। তোমার প্রতি ভালোবাসাটা নেশার মতো ঠেকছে। প্রণয়ে গভীর উপত্যাকায় আমার পা টা যে পিছলেছিলো, এখনো উঠতে পারছি না। ডুবেই যাচ্ছি উত্তাল মাদকতায়”
“এই মাদকতাটা কি কেবল ভনিতা? নাকি সত্যি?”
“হঠাৎ এই প্রশ্ন?”
“আমার থেকে কিছু লুকাচ্ছেন না তো?”
“বিশ্বাস নেই আমার উপর”
“করতে তো ইচ্ছে হয়, ছাড়ুন। চেঞ্জ করে নিচে যান। খাবার রেডি”

চারুলতার কথাটা উটকো লাগলো। ঠিক ঠাহর করতে পারলো না শ্রাবণ। এক রাশ বিস্ময় নিয়ে অপলক নজরে তাকিয়ে থাকলো সে। চারুও কম নয়, নিজের সন্দেহগুলো সন্তপর্ণে আড়াল করে নিলো সে। প্রকাশ করলো না শ্রাবণের কাছে। মনে মনে স্থির করলো সে আলমারীর পেছনের দরজার রহস্য উদ্ধার করেই ছাড়বে। কি লুকাচ্ছে শ্রাবণ তার কাছে! কি এমন আছে যা প্রকাশ যাবে না নিজ স্ত্রীর কাছে_______

মধ্যাহ্নের শেষ প্রহর। গরমের ভাপে উত্যক্ত ব্যাস্ত শহরের মানুষ। পিচ ঢালা রাস্তা থেকেও যেনো ভাপ উঠছে। এর মাঝে গুদামের পুরোনো পাখাটা নিজের মন্থর গতিতে ঘুরছে। এতে গরম কমার বদলে যেনো বাড়ছে। এই বিশ্রী গরমের মাঝে এক নাগারে হিসেব মিলাচ্ছে ধ্রুব। দুই মামার মৃত্যুর আজ মাসের অধিক গড়ালো। এখন এই সকল ব্যবসার দায়িত্ব শুধু তার উপর। মামীরা তো আর ব্যাবসা সামলাতে পারবেন না। তাদের দায়িত্ব ঘরের চার দেয়ালেই এতোকাল ছিলো। তাই এই বয়সে নতুন অভ্যাস করানোর মানে নেই। ধ্রুবের কাজ যেনো কমছেই না উলটো বাড়ছে। দুপুরে খেতে যাবার ও সনয় হয় নি। গুদামের নতুন কর্মচারী মদন বিনীত কন্ঠে বললো,
“ভাইজান খাইতে যাবেন না?”

মদনের কথায় মাথা তুললো ধ্রুব। মৃদু হেসে বললো,
“তুমি খেয়ে আসো, আমার জন্য এককাপ চা পাঠিয়ে দাও”
“এই গরমে চা খাইবেন?”
“সমস্যা নেই, অভ্যাস আছে। চা খেলে মাথা খোলে। হিসেবের জটিল প্যাঁচ। মাথা ফুরফুরে না হলে প্যাঁচ খুলবে না”
“আচ্ছা”

মদনের কণ্ঠে হতাশা। গরমে চা খাওয়াটা যেনো তার পছন্দ হলো না। মদন বাধ্য কর্মচারীর মতোই চলে গেলো। ঠিক তখনই একটা টিফিনবক্স হাতে এক রাশ জড়তা নিয়ে প্রবেশ করলো চিত্রা। চিত্রাকে মদন দেখতে দাঁত বের করে হাসলো। হাসির বিনিময়ে হাসি দেওয়া যেনো ফরজ কাজ। তাই চিত্রাও অমলিন হাসলো। ধ্রুব হিসেব কষতে ব্যাস্ত, চিত্রা জবুথবু হয়ে দাঁড়ালো টেবিলের পাশে। ধ্রুব মাথা না তুলেই বললো,
“কিও, চা এনে ফেলেছো এতো তাড়াতাড়ি?”
“চা না, খাবার এনেছি”

চিত্রার কন্ঠ কানে আসতে, তড়াক করে তাকালো ধ্রুব। সূঁচালো নজরে আপাদমস্তক চাইলো। চিত্রার জড়তার কারণ ধ্রুবের আচারণ। বিয়ের পর থেকে দায়সারা আচারণ তার। বাসর রাতেই জড়তাবিহীন কন্ঠে বলেছে,
“তুই আমার স্ত্রী, তোর সকল দায়িত্ব আমার। শুধু ভালোবাসাটা চাবি না। দিতে পারবো না। আমি হয়তো পৃথিবীর নিকৃষ্ট স্বামীর কাতারে পরবো। কিন্তু তবুও তোকে হৃদয়ে স্থান দেবার ইচ্ছে নেই। চারু আকুতি না করতে এই বিয়েতেও আমার মত ছিলো না”

একরাশ আশা ভরা বুকটা মূহুর্তে চূর্ণবিচূর্ণ হয়ে গেলো চিত্রার। ক্রুর অপমানে হৃদয় নীল হয়ে উঠলো। এতোকাল না পাবার কষ্ট তাকে ব্যথিত করতো! কিন্তু এটা কেমন শাস্তি? যেখানে মানুষটি সম্পূর্ণ তার অথচ তার হৃদয়েই অন্য কেউ। চারুর উপর কিঞ্চিত রাগ হলো। কেনো করলো সে আকুতি? চিত্রা তো বলে নি ধ্রুব ছাড়া তার জীবন অচল। এই রাতের পর থেকে বিনা কাজে ধ্রুবের সম্মুখে সে আসে না। না পারা হিসেববিজ্ঞান ও চরম নিষ্ঠুরভাবে একা একা পড়ে। আজ ও আসতো না, কিন্তু নিজের মা -চাচীর বাড়াবাড়ি। তাদের ভাগ্নে তথা জামাই যে না খেয়ে কাজ করছে। সেজন্য মেয়ের হাতে খাবার পাঠালো। ধ্রুব মুখে একটা বিরক্তির শব্দ করলো। তারপর আবার কাজে মনোনিয়োগ করলো। চিত্রাও কম নয়। সে অপমানিত হতে নারাজ। হিনহিনে কন্ঠে বললো,
“মা আর চাচী জোর করে পাঠালো। তাই খেতে হবে। তাদের কড়া আদেশ যেনো খালি বক্স নিয়েই বাসায় যাই”
“তুই মানা করতে পারিস নি?”
“করেছি”
“মিথ্যা, যে মেয়ে সুযোগ পেলেই আমার পিছু পিছু ঘুরঘুর করে সে কি না মানা করবে? হাসালি। কি প্রমাণ করতে চাস বলতো? খুব ভালোবাসিস আমায়? খুব যত্ন করিস! আসলে সব ঢং। যদি এমন হতো তাহলে বিয়ের আগেই মানা করতি। আমার গলায় ঝুলতি না”
“ধ্রুব ভাই”

চিত্রা টলমল চোখে থাকিয়ে রইলো। চরম অপমানে চোখে বিষাদ সিন্ধু ভিড় করেছে। এই বুঝি উত্তাল ঢেউ এ ভেসে যাবে সব। চিত্রার চোখের দিকে তাকিয়ে তাচ্ছিল্যের হাসি হাসলো ধ্রুব। তারপর বললো,
“কাঁদবি না, ইংরেজিতে একটা কথা আছে ক্রোকোডাইলস টিয়ার। তোর চোখের পানিও আমার কাছে সেটাই”
“তা তো হবেই, তোমার কাছে তো তোমার চারুই সবকিছু। আচ্ছা ধ্রুব ভাই আমাকে মানুষ মনে হয় না তোমার? তোমার মনে হয় আমার আত্মসম্মান নেই? আমি না এতোও গিদর নই। আম্মাকে মানা করেছি। কে জানতো বুবু যেয়ে তোমার হাত পা ধরবে। আচ্ছা, আমি তো আমার ভালোবাসা নিয়ে তোমার দরজায় কড়া নাড়ি নি। তাহলে আমার ভালোবাসাকে অপমান করার অধিকার পাও কোথায়? আমি তো তোমার ভালোবাসাকে কখনো অসম্মান করি নি তাহলে আমাকে অপমান কেনো করো তুমি? এসব দেখানো ভালোবাসা চিত্রা বাসে না। নেহাৎ মা জোর করে পাঠিয়েছে নয়তো তোমার সামনেও আসতাম না। এই থাকলো খাবার। খেলে খাও নয়তো বুড়িগঙ্গায় ডুব দাও”

বলেই সজোরে টিফিন বক্স রেখে হন হন করে বেড়িয়ে গেলো চিত্রা। অপমানে, ক্রোধে, বিষাদে গা কাঁপছে তার। খুব কান্না পাচ্ছে। কিন্তু ধ্রুবের সামনে কাঁদবে না সে। পাষাণের সামনে অহেতুক ছোট হয়ে লাভ নেই। এদিকে চা নিয়ে প্রবেশ করলো মদন। হাসি মুখে বললো,
“ভাইজান চা”

ধ্রুব রাগান্বিত দৃষ্টি প্রয়োগ করলো তার উপর। যার অর্থ মদন বুঝলো না। তারপর উত্তপ্ত চায়ে ঠোঁট ছোয়ালো ধ্রুব। কি বিশ্রী চা! বিরক্তিতে ভ্রু কুচকে আসলো। বুঝলো না চায়ের স্বাদ এতো বিস্বাদ কেনো!!!

নিগূঢ় রাত, এসির শীতলতায় শীতল ঘর। শ্রাবণ ঘুমে মগ্ন। এদিকে চারু লেপ্টে আসে তার বুকে। কিন্তু চোখ জোড়া এক করতে পারছে না। উঁকি দিয়ে দেখলো শ্রাবণ কি সত্যি ঘুমে? হাত দিয়ে দু একবার পরীক্ষা করলো। না সত্যি ঘুমে। চুপিসারে উঠে বসলো সে। খুব ধীরে পা বাড়ালো আলমারীর দিকে। নিস্তব্ধতায় পায়ের আওয়াজ ও জোরে শোনায়। তাই টিপে টিপেই আগালো। একটা চিকন ছুরি দিয়ে আলমারীর তৃতীয় পাল্লাটা খুলার চেষ্টা করলো। এই বুদ্ধি চিত্রার, চারুর মনে আছে একবার তার টেবিলের নিচের থাকের চাবিটি হারিয়ে গেছিলো। তখন চিত্রাই এই চোরাই বুদ্ধি কাজে লাগিয়ে খুলেছিলো সেই থাক। এখন চারুও তাও করবে। ঘামছে সে, বুক কাঁপছে। ধরা পড়ার ভয়। কেনো এই ভয় জানে না। ক্ষণে ক্ষণে দেখছে শ্রাবণ ঘুমাচ্ছে কি না। অবশেষে মিনিট পচিশ পর পাল্লা খুলতে পারলো সে। পাল্লা খুলতেই চরম বিস্ময় জড়ো হলো তার চোখে। পাল্লাটি সম্পূর্ণ ফাকা। বরং একটা মানুষ প্রবেশ করতে পারবে এমন জায়গা সেখানে। এবং পেছনে কোনো কাঠ নেই। বরং সেই কাঠের দরজা যার সামান্য অংশ দেখেছিলো আলমারীর পেছনে। দরজাটি মোচড় লক দেওয়া। কাঁপা হাতে সেই দরজার লক মোচড় দিতেই খুলে গেলো তা। চারু এগিয়ে গেলো রহস্যের দিকে। নিগুঢ় অন্ধকার। কৃষ্ণ শব্দটি যেনো এর ই প্রতিরুপ। একটা ঘর কিন্তু সেখানে কি অন্ধকারের প্রকটতায় দেখতে পাচ্ছে না চারু। বিশ্রী গুমোট গন্ধ। নাক চেপে ধরলো সে। চাউ বা হাত বাড়ালো দেওয়ালে। কিছুসময় বাদে একটা সুইচ বোর্ড পেলো। সব সুইচ জ্বালাতেই আলোকিত হলো রুম। অন্ধকার মূহুর্তেই উবে গেলো। কিন্তু অন্ধকার উবে যেতেই বিস্মিত হলো চারু। সারা ঘর জুড়ে তার ছবি। গোটা গোটা হাতে লেখা
“আমার দূর দ্বীপবাসিনী” প্রতিটা ওয়ালে লাল রঙ্গের লেখা। ময়লা রুমে ধুলো জমেছে অথচ সেখানে কেবল তার ছবি। বিভিন্ন মূহুর্তের। এক কোনায় অন্য মানুষের ছবি যা অচেনা চারুর। কিছু সাজানো শিশি, কিছু রক্তে মোড়ানো কাপড়। চারুর সারা গা ছমছম করছে। শীতলতা হিম হয়ে গেছে হাত পা। মনের অনিচ্ছায় এগুলো সে। টেবিলের উপর স্তুপে জমানো রঙ্গিন চিরকুট। তাতে সেই হাতের লেখা। তার পাশেই শায়িত কিছু রক্তাক্ত অস্ত্র, হকিস্টিক, লাঠি। চারুর মাথা ঘুরাচ্ছে। বিশ্রী গন্ধে বমি পাচ্ছে। তার মাঝেই শীতল কন্ঠ কানে এলো,
“তুমি সব জেনেই গেলে দূর দ্বীপবাসিনী…….

চলবে

মুশফিকা রহমান মৈথি

#দূর_দ্বীপবাসিনী (কপি করা নিষিদ্ধ)
#৩৭তম_পর্ব

চারুর মাথা ঘুরাচ্ছে। বিশ্রী গন্ধে বমি পাচ্ছে। তার মাঝেই শীতল কন্ঠ কানে এলো,
“তুমি সব জেনেই গেলে দূর দ্বীপবাসিনী, অবশেষে লুকোচুরি খেলাটা শেষ হলো”

শীতল কন্ঠটি কর্ণপাত হতেই শিরদাঁড়া বেয়ে হিমস্রোত বয়ে গেলো। তীব্র যন্ত্রণায় বুক ধরে এলো। যন্ত্রণা অন্ধ বিশ্বাসের ঘড়া ভাঙ্গার। যন্ত্রণা প্রণয়ের মানুষটি হঠাৎ অপরিচিত হয়ে উঠার। বিষাদসিন্ধু তার বক্ষস্থলে উত্তাল ঢেউ তুলছে। কিন্তু এর মাঝে নিকষকৃষ্ণ ভয়টা তার মস্তিষ্ককে সতর্কবাণী প্রদান করছে। সেও ধরা পড়েই গেলো। কি করবে শ্রাবণ তার সাথে! একরাশ বিষাদ এবং বিস্মিয় নিয়ে পেছনে ফিরলো চারু। শ্রাবণ শীতল দৃষ্টিতে তার দিকে তাকিয়ে আছে। নীলাভ চোখের এই দৃষ্টি বড্ড ভয়ানক ঠেকলো চারুর কাছে। অবিশ্বাস্য কন্ঠে বললো,
“কেনো? কেনো এতো মিথ্যের জাল বোনা হলো?

চোখ থেকে গড়িয়ে পড়লো নোনাজোল। তার শুষ্ক ঠোঁটটা চেপে ধরলো দাঁত দিয়ে। আজ অচেনা শ্রাবণকে দেখছে সে। এতোদিনের বিশ্বাস ভাঙার কষ্ট টা এতোটা প্রবল জানা ছিলো না চারুর। কি অদ্ভুত! যার থেকে এতোকাল নিজেকে বাঁচাতে চাইতো তার বুকেই কিনা নিরাপদ আশ্রয় খুজেছিলো সে। শ্রাবণ দীঘির মতো শান্ত চোখজোড়া এখনো শীতল, কিন্তু এই শীতলতা ভয়ংকর। ঠিক যেনো ধাঁধালো কোনো ছুরি। বারবার ভেতরটা চূর্ণবিচূর্ণ হচ্ছে, এটা কি সেই শ্রাবণ যাকে সে ভালোবেসেছিলো! এটা কি সেই! এতো অপরিচিত কেনো লাগছে তাকে! কেনো এই সুন্দর মানুষটির মুখোশের আড়ালের মানুষটাকে কদাকার লাগছে!

*******

রাত ঠিক কটা বাজে হিসেব নেই ধ্রুবের। কাজ শেষ করতে করতে এতোটা রাত হবে তার জানা ছিলো না। ক্লান্ত শরীরটা নিয়ে বাড়ির সামনে দাঁড়াতেই স্মরণ হলো সবাই হয়তো ঘুমে। তাই কলিংবেল বাজিয়ে ঘুম থেকে জাগানোর মানে নেই। সবসময় একটা এক্সট্রা চাবি তার কাছে থাকেই। সেটা দিয়েই খুব সাবধানতার সাথে মেইট কেঁচিগেটটা খুললো। গোল বাধলো মেইন গেট খোঁলার সময়। বাড়ি পুরোনো তাই লকের সিস্টেম ও আদিম কালের। ভেতর থেকে খুলতে হয়। অনেক ভাবার পর ও যখন বুঝে উঠতে পারছিলো না কি করা উচিত তখনই গেটটা খুলে গেলো। ধ্রুব ভেবেছিলো হয়তো চিত্রা কাজটা করেছে। কিন্তু তাকে ভুল প্রমাণিত করে মারুফা দরজা খুললো। ইতস্তত কন্ঠে ধ্রুব শুধালো,
“মামী এখনো জেগে আসেন?”
“তুই ফিরলি না বলে জেগে ছিলাম। আয় হাত মুখ ধুয়ে খেতে আয়। দুপুরে খেয়েছিলি? চিত্রাটাকে বলেছিলাম যেনো বসে থেকে তোকে খাবার খাওয়ায়ে আসে। মেয়েটা কথাই শুনে না”
“থাক না মামী, আমি ওকে চলে যেতে বলেছিলাম”

দুপুরের ঘটনায় বেশ বিব্রতবোধ করছে ধ্রুব। এমন আচারণ তাকে শোভা পায় না। তখন মাথাটা গরম ছিলো বিধায় চেতে উঠেছিলো। কিন্তু পরেই অনুভব হলো কাজটা ভালো হয় নি। সে যেমন চারুকে ভালোবাসে, চিত্রা তেমন তাকে ভালোবাসে। ভালোবাসায় তো জোর হয় না, হৃদয় তো লাগাম ছাড়া উত্তাল বায়ুর ন্যায়। কখন কোথায় আটকে যায় ঠিক নেই। ধ্রুব হাত মুখ ধুয়ে খেয়ে নিলো। খাবার শেষে ঘরে প্রবেশ করতেই তার চোখ ছানাবড়া। চিত্রার একটা সুতোও ঘরে নেই। ঘরটা একেবারে চিত্রাশূন্য। ব্যাপারটা প্রথমে তাকে ভাবালেও, পরে বেশি আমলে নিলো না। একটা পর্যায়ে কিঞ্চিত খুশি ই হলো, চিত্রা নিজেই তার জীবন থেকে সরে গেছে_______

**********
নিস্তব্ধ ঘর। পিনপতন নীরবতা। চারুর অশ্রুসিক্ত বেদনায় আচ্ছাদিত আখি দেখছে শ্রাবণকে। অপর দিকে শ্রাবণ ও দাঁড়িয়ে আছে তার থেকে দু হাত দূরত্বে। সে মাথা চুলকাচ্ছে। চোর পুলিশের খেলা আজ শেষ। তারপর নিজের অস্থিরতা ঈষৎ কমিয়ে কিছুটা এগিয়ে আসতে যেতেই চারু পিছিয়ে গেলো। যে নয়নজোড়ায় এক সময় ভালোবাসা ছিলো সেই নয়নজোড়ায় ঘৃণার রেখা দেখতে পেলো শ্রাবণ। মূহুর্তেই আরোও বিচলিত হয়ে উঠলো সে। হাত কামড়ে নিজেকে শান্ত করার চেষ্টা করলো সে। তাকে কেনো যেনো অস্থির লাগলে, খানিকটা অপ্রকৃতস্থও। চারুর হৃদয়ে হাজার প্রশ্ন ভিড় করলো। বিশ্বাস ভঙ্গের হাহাকার স্পষ্ট তার চোখজোড়ায়। শ্রাবণ নিজেকে স্বাভাবিক রেখে বললো,
“আমি তোমাকে ভালোবাসি চারুলতা, এছাড়া যে কোনো উপায় ছিলো না!”

শ্রাবণ যে কথায় একটা সময় হৃদয় উৎফুল্ল হয়ে উঠতো, আজ সেই কথায় ক্ষিপ্ত হয়ে উঠলো চারু। ক্ষিপ্র গতিতে এগিয়ে গেলো শ্রাবণের কাছে, তার কলার চেপে বললো,
“কোন ভালোবাসার কথা বলছেন? মিথ্যে, প্রতারণাকে! আমার বিশ্বাস নিয়ে খেলাকে ভালোবাসা বলছেন? শুনে রাখুন তবে নোংরা, বিশ্রী আপনার ভালোবাসা। আমি ভয় পাই, ভয় পাই আপনার এই ভালোবাসাকে। ঘৃণা করি। আরিফ ঠিক বলেছিলো, আপনি একটা জা’নো’য়া’র”
“কিন্তু আমি তো তোমার জন্য সব করেছি”
“আমার জন্য? সত্যি?”
“হ্যা, আমি তোমার জন্য করেছি সব। আজ অবধি করেছি শুধু তোমার জন্য। ওই গণিকে জেলে পাঠানো, আরিফকে ধরিয়ে দেওয়া, নাজমুল, করিমকে সরানো, তোমার ক্ষতি করতে চাওয়া সকল নোংরা হাত কে আমি সরিয়ে দিয়েছি”

শ্রাবণের কথাগুলো কর্ণপাত হতেই বলে হলো কেউ গরম লোহা কানে গেথে দিচ্ছে। চারু পা অসার হয়ে গেলো। ধপ করে বসে পড়লো সে। তার মস্তিষ্ক কাজ করছে না। শূন্যতা ভর করেছে যেনো। চারুর মনে হলো তার হৃদয়কে কেউ ধারালো ছুরি দিয়ে আঘাত করছে। রক্তক্ষরণ হচ্ছে ভেতরে। হৃদয়ের কোনায় ফুটে থাকা ভালোবাসার ফুলটি বাঁচার আকুল আবেদন করছে। অস্পষ্ট স্বরে বললো,
“কেনো? করলেন?”

শ্রাবণ হাটু গেড়ে বসলো, আকুল কন্ঠে বললো,
“চারুলতা বিশ্বাস করো, আমার দোষ নেই। আমি কি করবো বলো, ওই আশরাফ গণি ভেবেছিলো ওর ছেলের মৃত্যুর জন্য আমি দায়ি। যা মিথ্যে, আমি নাহিয়ানকে মা’রতে বলি না। আরিফ কাজটা করেছে। ও আমার উপর শোধ তুলতে তোমাকে কি’ড’ন্যা’প করেছিলো। ওই নাজমুল আর করিম তোমার ক্ষতি করতে চেয়েছিলো। আমার হাতে কোনো অপশন ছিলো না। তাই আমি ওদের পিছু নেই, ওদের আড্ডা বের করি। ওদের খাবারে বিপুল সম্মোহনী মেডিসিন মিলিয়ে দিয়েছিলাম। ফলে ওদের মস্তিষ্ক অচল হয়ে যায়। ওই ড্রা’গের একটা মজা সেটা রক্তে মিলে যায়। আমি শুধু ওদের বলেছি তারা নিজেরাই নিজেদের শত্রু। এখন ওরা এতে সু’ই’সা’ই’ড করে এতে আমার দোষ নেই। আর আরিফ, ও তো ব্লাকমেইল করছিলো, তোমার উপর ওর লোভ ছিলো। কি করবো বলো, এক তীরে দুটো পাখি মেরেছি। কিন্তু বিশ্বাস করো চারুলতা, আমি এমন কিছুই করি নি যে তুমি আমায় ঘৃণা করবে। আমি তো শুধু ভালোবেসেছি”
“ছিঃ”

চারু মুখ ফিরিয়ে নিলো, শ্রাবণ দু হাত দিয়ে তার মুখ নিজের পানে করবার চেষ্টা করতে লাগলো। আকুল কন্ঠে বললো,
“আচ্ছা, সরি। আর হবে না এরকম, প্লিজ আমার থেকে মুখ ফিরিয়ে নিও না। আমি যে তোমাকে ছাড়া থাকতে পারবো না”
“ছাড়ুন আমাকে”

চারু নিজেকে ছাড়ানোর চেষ্টা করলো, রাগে, ক্রোধে সে কাঁপছে রীতিমতো। শ্রাবণের প্রতি নীল ভালোবাসা ধূসর ঘৃণার রুপ নিয়েছে। চূর্ণবিচূর্ণ হয়ে যাচ্ছে হৃদয়। শ্রাবণ আরোও অস্থির হয়ে উঠছে। কিছুক্ষণ পূর্বের ভয়ানক চোখ অসহায়ের ন্যায় আকুতি করছে চারুর কাছে। শ্রাবণের শক্তির কাছে চারু নস্যি। প্রবল শক্তিতে নিজের বাহু বেষ্টনীতে আটকে রেখেছে সে নিজের চারুকে। যেনো ছেড়ে দিয়ে হারিয়ে যাবে তার দূর দ্বীপবাসিনী। চার একটা পর্যায়ে কামড় বসিয়ে দেয় শ্রাবণের হাতে। দাঁতের ধারে ব্যাথায় সামান্য নড়ে উঠে শ্রাবণ তবুও ছাড়তে চায় না সে। চারু ভেবেছিলো শ্রাবণ তাকে ছেড়ে দিবে, কিন্তু কামড়ে রক্তাক্ত হবার পর ও পরম স্নেহে তাকে আকড়ে ধরে। একটা সময় চারু ক্ষান্ত হয়। চুপ করে বসে থাকে সে। কিংকর্তব্যবিমুঢ় সে, ঠিক ভুলের হিসেব যেনো মিলছে না। শুধু এটুকু জানে সে শ্রাবণের সাথে এক মূহুর্ত থাকা তার পক্ষে সম্ভব নয়। চারুর চোয়াল শক্ত হয়ে গেলো। নিজের শরীরের সকল শক্তি দিয়ে ধাক্কা পারলো সে শ্রাবণকে। শ্রাবণ অবাক নয়নে চেয়ে রইলো চারুর দিকে। চারুর মুখ লাল।হয়ে আছে, তার শান্ত দীঘির মতো চোখে আগুন জ্বলছে। বিশ্বাসঘাতকতার নির্মম সত্যিটা সে যেনো নিতে পারছে না। শ্রাবণ আকুল কন্ঠে বলে,
“ভুলে যাও সবকিছু চারুলতা। আমি তোমাকে সুখে মুড়িয়ে রাখবো। যেমনটা ছিলে। আমি যা করেছি শুধু তোমার জন্য করেছি”
“চাই না আমার এই বিশ্রী জঘন্য ভালোবাসা। যে সম্পর্কের ভিত্তি ই মিথ্যে, সে সম্পর্কে থাকা সম্ভব নয়। আমার মুক্তি চাই”
“আমি যদি তোমার জীবনে আলো হতে পারি, তাহলে তুমি কেনো আমার জীবনের আঁধারগুলো বিলীন করতে পারবে না?”

নরম কন্ঠে কথাটা বলে শ্রাবণ। তার চাহনীতে বিষাদ জমেছে। প্রেয়সীর ঘৃণা তাকে ভেতরতে হাজারবার খু/ন করছে। চারু উত্তর দিলো না। চোখের জল মুছে নিলো সে। ভেতরটা আজ শূণ্য, সকল স্বপ্নের স্বর্ণালী ভুবনটা তাশের ঘরের ন্যায় চুরমার হয়ে গিয়েছে। সে এক মূহুর্ত দাঁড়ালো না। বদ্ধ ঘর থেকে বেড়িয়ে এলো। নিজের সকল জিনিস গোছাতে লাগলো। চিৎকার করে কাঁদতে ইচ্ছে করছে। কিন্তু কাঁদতে পারছে না। দম বন্ধ লাগছে। যখন ব্যাগ গুছিয়ে বের হবে তখন শীতল কন্ঠ কানে আসলো,
“তুমি কোথাও যাবে না।”

চারু ভয় পেলেও প্রকাশ করলো না। তীব্র বিদ্রুপের সহিত বললো,
“ভয় দেখাচ্ছেন?”
“হ্যা, দেখাচ্ছি। আমাকে জা’নো’য়ার হতে বাধ্য করো না চারু”
“এবার কি আমার উপর অত্যাচার করবেন? মে/রে ফেলবেন আমায়?”

ক্ষুদ্ধ কন্ঠে চারু প্রশ্ন করলো। শ্রাবণ প্রত্যুত্তরে বিচিত্র হাসি হাসলো। খানিকটা এগিয়ে আসলো সে। চারুর চোখে চোখ রেখে বললো,
“তোমাকে কষ্ট দেবার কথা স্বপ্নেও ভাবি না আমি। তবে তুমি তো একা নও চারুলতা। তোমাকে ঘিরে যে অনেকে। এখন ভেবে দেখো। আমার কাছে থাকবে কি না?”

চলবে

মুশফিকা রহমান মৈথি

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here