#দূর_দ্বীপবাসিনী,৪০,৪১
মুশফিকা রহমান মৈথি
#৪০তম_পর্ব
কথাটা বুঝতে সময় লাগলো চারুর। কিছুক্ষণ চুপ রইলো, তারপর তার চোখ চলে গেলো শ্রাবণের দিকে। শ্রাবণ তখন বিছানায় বসে নিজের রাগ নিবারণে ব্যাস্ত। চিত্রা বলতে লাগলো,
“বুবু কি শুনছিস?”
চারু উত্তর দিলো না, তার চাহনী শ্রাবণের দিকে স্থির। ম্লান স্বরে বললো,
“কিভাবে জানলি?”
“পুলিশ এসেছিলো, ধ্রুব ভাই এর অনুরোধে তারা বাবার মৃত্যু তদন্ত করে। ফলে জানতে পারে, একটা গাড়ি ইচ্ছে করে বাবার উপর দিয়ে গিয়েছে। বুবু, বাবা মানুষটা কি এতো খারাপ ছিলো যে তাকে খু/ন করার প্রয়োজন?”
“তদন্ত কতদূর এগিয়েছে, গাড়ি টি কার জানা গেছে?”
“নাহ, সেটাই খুজে বের করছে তারা। গাড়িটির চালক বের হলেই কেস সলভ হয়ে যাবে”
চিত্রা কাঁদছে। তার কন্ঠ জড়িয়ে যাচ্ছে বারে বারে। কিন্তু চারু স্থির। স্বাভাবিক তার দেহভঙ্গিমা। যেনো কিছুই হয় নি। সে স্বাভাবিক কন্ঠে বললো,
“মা আর চাচীর দিকে খেয়াল রাখিস। কাঁদিস না, যা হবার তা তো হয়েই গেছে। এখন আসল কালপ্রিটকে ধরার পালা। চিন্তা করিস না। ইনশাআল্লাহ সে ধরা পড়বেই”
চারুর কথা বলতে ভালো লাগছে না। মাথাটা তীব্র যন্ত্রণায় ছেয়ে গেছে। সেই সাথে বক্ষস্থলে চরম চিনচিনে ব্যাথা। একটা নিকষকৃষ্ণ অভিশঙ্কা তা ভেতরটাকে তোলপাড় করছে। শ্রাবণ তো সেই রাতে তার সাথেই ছিলো। তবুও সূক্ষ্ণ সন্দেহ ডানা মেলছে। যে মানুষটা শুধু তাকে বিয়ে করার জন্য এতো কিছু করতে পারে, এতো ছলের জন্ম দিতে পারে, নিজের গায়ে ছোরাঘাত নিতে পারে; সেই মানুষটির পক্ষে অসম্ভব কিছুই না। চারু শান্ত মস্তিষ্কে সাজাতে লাগলো সকল কিছু। প্রথমত শ্রাবণ তাকে অজ্ঞাত প্রেমিকের নামে চিঠি পাঠাতে শুরু করলো, তার পিছু নিলো। এক অদৃশ্য বলয় তৈরি করলো তার আশেপাশে। নিজেকে অজ্ঞাত রেখেই তার প্রতি আবেগগুলো সে প্রকাশ করতো। কিন্তু এর মাঝে ঘটলো অঘটন, তার আবেগ মাত্রা ছাড়ালো। কলেজের ছেলেটিকে যখন নিষ্ঠুরের মতো মেরে হাসপাতালের আইসিউ তে ভর্তি করলো তখন এই অজ্ঞাত প্রেমিকের প্রতি আবেগটা মিয়ে গেলো চারুর। অজ্ঞাত প্রেমিক ক্ষান্ত হলো না। তার পাগলামি আরোও দ্বিগুণ উৎসাহে প্রকাশ পেতে থাকলো। এর মাঝে হুট করেই কিছুদিন লোকটির হদিস পাওয়া গেলো না, সেই ফাকে মনিরুল সাহেব নাহিয়ানের প্রস্তাব নিয়ে হাজির হলেন। সব ঠিক ই চলছিলো, চারুও অজ্ঞাত প্রেমিকের কথা ভুলতে বসেছিলো। কিন্তু অঘটন ঘটলো বিয়ের দিন। নাহিয়ানের গাড়ির দূর্ঘটনা, মা/রা গেলো নাহিয়ান। পরে অবশ্য সকল দোষটা আরিফের উপর বর্তানো হলো। আরিফ মূলত আর কেউ নয়, শ্রাবণের একজন বিশ্বস্ত লোক ছিলো। বিশ্বাসঘাতকতা এবং চারুর প্রতি অযাচিত লোভের দরুন তার এই পরিণতি। আশারাফ গণি, পুত্রশোকে পাগলপ্রায় হলেন, তিনি সকল কিছুর দোষ চাপালেন শ্রাবণের উপর। তিনি শ্রাবণকে মারার প্রচেষ্টা ও চালান। ব্যর্থ হবার কারণে চারুকে অ/প/হ/র/ণ করেন তিনি। গণি এবং আরিফ উভয় শ্রাবণের মাথা ব্যাথা হয়ে দাঁড়িয়েছিলো৷ ফলে একটা নিপুন পরিকল্পনায় দুটোকে গোড়া থেকে সে শেষ করে দিয়েছে। যদিও শ্রাবণ নিজ হাতে কখনোই কিছুই করে নি। “সাপ ও মরলো, লাঠিও ভাঙ্গলো না” এই প্রবাদ তার ক্ষেত্রে বেশ ভালো করেই খাটে। চারুর প্রতি এই পাগলামিটাই চারুর মনে সন্দেহের বীজ বুনেছে। সেদিন মনীর সাহেব তাকে মারতে উদ্ধত হয়েছিলেন। সেই সামান্য ভুলের জন্য ই কি তাকে জীবন হারাতে হলো! অসম্ভব মনে হলেও সন্দেহটা অবান্তর নয়। তবুও কেনো যেনো চারুর বিশ্বাস করতে ইচ্ছা করছে শ্রাবণ নির্দোষ, সে সত্যিই কোনো অন্যায় করে নি। অন্তত কাউকে খু/ন করার মতো অন্যায় সে করে নি।
চারু চোখ তুলে চাইলো শ্রাবণের দিকে। সে এখন শান্ত হয়ে বিছানায় গা এলিয়ে দিয়েছে। বড্ড বেশি অস্থিরতাকে দমানোর প্রচেষ্টা। প্রেয়সীকে আঘাত করতে পারছে না। তবে ক্রোধের আগ্নেয়গিরি তার মাঝে বিদ্যমান। সেই ক্রোধ সংবরণ ও করা তার পক্ষে কঠিন হয়ে দাঁড়িয়েছে। তাই কপালে মুষ্টিবদ্ধ হাত ঠেকিয়ে রেখেছে সে। চোখ বন্ধ, প্রগাঢ় নিঃশ্বাস ছাড়ছে সে। চারু কিছুসময় চুপ করে রইলো, তারপর নিস্তব্ধতা ভেঙ্গে বললো,
“চিত্রা ফোন করেছিলো”
চারুর কন্ঠ কর্ণপাত হতেই তড়াক করে উঠে বসলো শ্রাবণ। গম্ভীর কন্ঠে বললো,
“ও বাড়ির সবাই ঠিক আছে, আমি কিছু করি নি”
শ্রাবণের স্বগোতক্তিতে ঈষৎ অবাক হলো চারু, কিন্তু প্রকাশ করলো না। স্বাভাবিক কন্ঠে বললো,
“আসলে ও একটা খবর জানাতে ফোন করেছে। আজ ওদের বাড়ি নাকি পুলিশ এসেছিলো। অদ্ভুত একটা খবর তাদের দিলো, বড় চাচাকে নাকি খু/ন করা হয়েছে!”
চারুর কথায় খুব একটা ভাবান্তর হলো না শ্রাবণের। সে গলার টাইটা খুলতে খুলতে বললো,
“দুঃখজনক সংবাদ”
“ওরা গাড়িটির খোঁজ পেয়েছে, চালকের খোঁজ পেলেই কেস সলভ”
“খুব ভালো কথা, তাড়াতাড়ি খোঁজ পাক এই কামনা করি”
শ্রাবণের নির্লিপ্ত কথাগুলো বড্ড উটকো শোনাচ্ছে। তার কথার ধরণে দুটো ব্যাপারে নিশ্চিত হওয়া যায়, এক, শ্রাবণ এই খু/নের কোথাও জড়িত নয়, অহেতুক সন্দেহ করছে চারু। দ্বিতীয়ত শ্রাবণ এতোই গভীর জলের মাছ যে সে ধরা ছোয়ার বাহিরে। চারু কিছু বললো না। শুধু সরু নয়নে দেখে গেলো শ্রাবণকে। মনে মনে সেও চায় যেনো শ্রাবণ নির্দোষ হয়। যতই হোক, মানুষটাকে আজও বিশ্বাস করতে ইচ্ছে হয়। হৃদয়ের আঙ্গিনায় যে প্রণয়ের ফুলটি ছিলো, মূর্ছা গেলেও সেটা যে এখনো জীবন্ত। শুধু অদৃশ্য দেয়াল তৈরি হয়েছে দুজনের মাঝে। যা প্রচন্ড শক্ত, যা ভেঙ্গে গুড়িয়ে দেবার সাহস হচ্ছে না চারুর____________________
*******
নিগূঢ় রাত, ঠান্ডা পরিবেশ। আলোবিহীন ঘরে মায়াবী আলো আঁধার খেলা তৈরি হয়েছে। বাহিরের বাগানের লাইটের সরু আলো রেখা প্রবেশ করছে ঘরে। এসির তাপমাত্রা বাইশ ডিগ্রী। গলা অবধি কম্বল টানা শ্রাবণের। তার ঘুম গাঢ়, হঠাৎ অনুভূত হলো তার গলায় তীক্ষ্ণ, ধারালো কিছু কেউ ধরে আছে। ঘুম গাঢ় হলেও তার ইন্দ্রিয়গুলো সজাগ। চট করে চোখ খুললো সে। মুখের উপর মায়াবী মুখশ্রী। কপালে ঘাম, ঠোঁটের কোনে বিষাদের রেখা। হাতে তার মাখন কাটার ছুরি। শ্রাবণ ভড়কালো না। বরং বা হাতে মানুষটির অবিন্যস্ত চুলগুলো গুজে দিলো কানের পেছনে, মুচকি হেসে বললো,
“মাখন কাটার ছুরি দিয়ে স্বামীকে ব/ধ করতে চাও দূর দ্বীপবাসিনী?”
চারু নড়লো না, দৃঢ়তা তার মাঝে পরিলক্ষিত হলো। কাঁপা স্বরে বলল,
“আপনি ই মেরেছেন চাচাকে, তাই না? সত্যি করে বলুন”
“যদি বলি হ্যা, কি করবে?”
শ্রাবণের ঠোঁটে বিচিত্র হাসি, হাসিটা বিচিত্র নয় শুধু ভয়ংকর ও বটে। চারুর বুকে তীব্র যন্ত্রণা অনুভূত হলো, সত্য জিনিসটা এতোটা বিষাক্ত এই ভয়ানক ব্যাপারটা আজ উপলব্ধি করলো সে। চোখ জ্বলছে, দম বন্ধ যন্ত্রণা। কিন্তু সেই সাথে প্রচন্ড ক্রোধে মাথা নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। ছাই চাপা আগুনটা দপ করে জ্বলে উঠেছে যেনো। ছু/রিটা শ্রাবণের ন/লি বরাবর ঠেসে ধরে বললো,
“আরিফ ঠিক বলেছিলো, আপনার মতো জা/নো/য়া/রে/র বাঁ/চা/র অধিকার নেই। ইচ্ছে করছে”
“এই ছু/রি দিয়ে আমার গ/লা কেঁ/টে ফেলতে তাই তো? কিন্তু একটু পাশে তাকিয়ে দেখো তো চারুলতা, আসলেই কি আমাকে মা/র/তে পারবে?”
এবার কিঞ্চিত ভয় পেলো চারু। ভীত নজরে পাশে তাকালো। তাকাতেই হীম বয়ে গেলো শিরদাঁড়ায়। মেঝেতে লুটিয়ে আছে চারটে লা/শ। প্রতিটি রক্তস্নাত, বিশ্রীভাবে থেতেল গেছে। কালো রক্তে ভেসে যাচ্ছে মাঝে। সাদা কাপড়ের নিচের মানুষগুলো আর কেউ নয়, জাহানারা, মারুফা, চিত্রা এবং ধ্রুব। চারটা মুখশ্রী দেখতেই লাফিয়ে উঠলো চারু। তরতর করে ঘামছে সে। তার গলা কাঠ হয়ে গেছে। প্রচন্ড শীতলতায় ও তার ঘা ভিজে গেছে। চুলের গোড়ায় ঘাম জমছে। এলোমেলো নজর ফেরালো চারপাশে। না সব কিছু শান্ত, শ্রাবণ পাশ ফিরে ঘুমাচ্ছে। মেঝেতে কিছুই নেই। স্বপ্ন ছিলো সব, বিশ্রী বাজে স্বপ্ন। চারুর বুক কাঁপছে। জোরে জোরে নিঃশ্বাস নিচ্ছে সে। সময় লাগলো নিজেকে শান্ত করতে। তারপর হাত বাড়িয়ে পাশে রাখা পানির বোতল থেকে পানি খেলো সে। কতটা ত্রাশ বুকে জমলে এতো ভয়ানক স্বপ্ন দেখতে পারে কেউ। চারু বাথরুমে গিয়ে চোখে মুখে পানি দিলো। নিজেকে শান্ত করলো জোর করে। তারপর শুয়ে পড়লো সে। চোখ বুঝতেই অনুভব করলো একজোড়া শীতল হাত তার কোমড় চেপে ধরেছে। কিছু বুঝার আগেই অনুভব করলো তার কাঁধ ভিজে যাচ্ছে শীতল জলে, তবে কি শ্রাবণ কাঁদছে……………
চলবে
মুশফিকা রহমান মৈথি
#দূর_দ্বীপবাসিনী
#৪১তম_পর্ব
কতটা ত্রাশ বুকে জমলে এতো ভয়ানক স্বপ্ন দেখতে পারে কেউ। চারু বাথরুমে গিয়ে চোখে মুখে পানি দিলো। নিজেকে শান্ত করলো জোর করে। তারপর শুয়ে পড়লো সে। চোখ বুঝতেই অনুভব করলো একজোড়া শীতল হাত তার কোমড় চেপে ধরেছে। কিছু বুঝার আগেই অনুভব করলো তার কাঁধ ভিজে যাচ্ছে শীতল জলে, তবে কি শ্রাবণ কাঁদছে! চারুকে নিবিড়ভাবে জড়িয়ে ধরে রেখেছে সে, তার প্রগাঢ় নিঃশ্বাস ভেদ করছে চারুর সুতির কামিজটি। তটস্থ চারু জড়ো হয়ে রয়েছে। শ্রাবণের এমন স্পর্শ কতকাল পর পেলো সে। হয়তো হাতে গোনা কিছুদিন, কিন্তু চারুর কাছে তার ক্রোশ বছর। নিস্তব্ধতা ঘরে, সেই নিস্তব্ধতা কানের কাছে এসে বলছে,
“আর কত? আর কত?”
নিস্তব্ধতা ভাঙলো শ্রাবণের কাঁপা স্বরে, প্রচন্ড আকুলতা সেই কন্ঠে। ধীর স্বরে বললো,
“চারুলতা আমি বড্ড অসহায়, বাহিরে একটা শক্ত মানুষ হলেও ভেতরটা আমার ভঙ্গুর জং ধরা একটা প্রাসাদ। যার মাঝে কারোর বসবাস নেই। আমি সেই অবহেলায় থাকা বিশ্রী পরগাছাটার মতো, যে শুধু কিছু একটা আঁকড়ে বাঁচতে চায়। আঁধার জীবনে সেই বাঁচার উদ্দেশ্যটি ছিলে তুমি। জানো চারুলতা, আমি না কখনো পরিবার কি সেটা বুঝি নি। সাত বছরের বাচ্চাকে শেখানো হয়েছে কি করে একা একা শু লেস বাধতে হয়, কি করে খেলতে গেলে ব্যাথা পেলে সেখানে একা একা ডেটল দিতে হয়, কি করে নিজের টিফিন নিজেই বানিয়ে নিতে হয়, কি করে জীবনের সব প্রতিকুলতার মাঝেও টিকে থাকতে হয়। জানো, আমার মা খুব আদর করতেন আমাকে। সে সর্বদা বলতেন, এই পৃথিবী খুব বর্বর, এই বর্বর পৃথিবী তোমাকে কখনোই বুঝবে না। আমাদের জন্য এই পৃথিবী না। আমাদের পৃথিবীটা এতো জটিল না। আমি বুঝতাম না, কিন্তু সময়ের সাথে ঠিক বুঝেছি। কেউ আপন নয়, আমার নিজের বাবা ই আমাকে ঘৃণা করে। এই বিশ্রী জীবনে ঊষার কুসুম প্রভাতের ন্যায় আগমন ঘটে তোমার। তোমার মিষ্টি হাসিটা আমার জীবনের লক্ষ্য হয়। আমি তোমাকে আঘাত করতে চাই না। শুধু এই বর্বর পৃথিবী থেকে বাঁচাতে চাই। চারুলতা, বড্ড ভালোবাসি তোমায়। আমি তোমায় ছাড়া নিজেকে কল্পনাও করতে পারি না। তুমি আমাকে ঘৃণা করো না চারুলতা। বড্ড অসহায় লাগে নিজেকে। বড্ড অসহায় লাগে”
শ্রাবণের কন্ঠ দলা পাকিয়ে যাচ্ছে। বিষন্নতা, অন্তর্বেদনা মূহুর্তেই স্পর্শ করলো চারুকে। এক চিনচিনে ব্যথা অনুভূত হলো তার। শ্রাবণ নিবিড়ভাবে জড়িয়ে ধরে রেখেছে তাকে, যেনো ছেড়ে দিলেই হারিয়ে যাবে তার চারুলতা। চারুর নিস্তব্ধতা আরো আঘাত হানছে তার হৃদয়ে। শ্রাবণ আকুল কন্ঠে বলে উঠলো,
“মানছি তোমায় ঠকিয়েছি, চারুলতা। মানছি হয়তো আমার জন্য তোমার মনে ভয় তৈরি হয়েছে। আমার ভালোবাসাটা তোমাকে আধারে টেনে নিয়ে যায়। সব দোষ মাথা পেতে নিচ্ছি চারুলতা, তবুও অন্যায় আবদার করবো। আমাকে ঘৃণা করো না। আমার জীবনটা আর পাঁচটা মানুষের মতো নয় চারুলতা। আমি একবার ভালোবাসার মানুষটিকে হারিয়েছি, আবার হারাতে পারবো না। শূন্যতা কতটা ভয়ানক তোমার ধারণা নেই। তুমি আমার জীবনে সেই আলোর কিরণের মতো যাকে পাবার জন্য আমি মরিয়া হয়ে ছিলাম। আমি তোমার ক্ষতি কখনো হতে দেই নি। হ্যা, আমি মানুষটা ভালো না। আমার মন তোমার মতো স্নিগ্ধ নয়। আমি খুব খারাপ, কিন্তু আমি তোমার জন্য ভালো হতেও রাজি। আমি কখনো এমন জটিল খেলা খেলবো না, কারোর ক্ষতি করবো না। শুধু একটা সুযোগ দাও”
চারু অনুভব করলো তার গাল ভিজে এসেছে। অশ্রু ছোঁয়াচে জানতো, কিন্তু এতোটা জানা ছিলো না। চারু পাশ ফিরলো। দুহাতে আলতো করে আগলে ধরলো শ্রাবণের মুখশ্রী। খোঁচা খোঁচা দাঁড়িতে ভরে গেছে মুখ, চোখের নিচে গাঢ় কালি। বেদনাছন্ন তার মুখ, অশ্রুসিক্ত চোখজোড়া। চারু নিজেকে শক্ত রাখতে পারলো না। হৃদয়ের প্রকোষ্টে জমায়িত ভালোবাসাটা ঘৃণাকে যুদ্ধে হারিয়ে দিলো। পরাজিত হলো এতোদিনের ভয়, ত্রাশ, ঘৃণা। কাঁপা স্বরে বললো,
“আমার সময় লাগবে”
“সময় নাও চারুলতা, আমি অপেক্ষা করবো। তুমি তো জানো আমার ধৈর্য্য কতো বেশি। তুমি যে আমার দূর দ্বীপবাসিনী। তোমার জন্য আমি সারাটাজীবন অপেক্ষা করতে রাজি”
বলেই উষ্ণ ঠোঁট ছুঁয়ে দিলো চারুর কপাল। আবেশে চোখ বুঝে নিলো চারু। চোখ থেকে গড়িয়ে পড়লো অশ্রুরেখা। স্পর্শ গাঢ় হলো, নিবিড়ভাবে আলিঙ্গনে মিশে রইলো সে শ্রাবণের প্রকান্ড বুকে। কিছু আবছা চিন্তা এখনো হানা দিচ্ছে। বিশ্বাস কি আবারো করবে! বুঝতে পারছে না চারু। শ্রাবণের বুক চিরে দীর্ঘশ্বাস বের হলো। চারুলতাকে আবারো পাবার উৎফুল্লতা পরিলক্ষিত হলো।
*****
সকাল সকাল চা হাতে ঘরে প্রবেশ করলো চিত্রা। ধ্রুব তখন ল্যাপটপে কিছু কাজ করছিলো। চিত্রা ভেবেছিলো হয়তো সে ঘুমোচ্ছে। চুপচাপ চা দিয়েই বের হয়ে যাবে। তাদের সম্পর্কটা বেশ অদ্ভুত, একই বিছানায় ঘুমায় অথচ দূরত্ব ক্রোশ মাইলের। মাঝে মাঝে চিত্রার মনে হয় তাদের এই বর্ডারের দূরত্ব হয়তো কখনোই ঘুচবে না। অবশ্য হৃদয় এখন আর লোভ করে না। আছে তো ভালোই। ধ্রুবের পুরো ধ্যান ল্যাপটপের ভেতর। মনোযোগ দিয়ে দেখছে সে কিছু একটা। চিত্রা তাই পা টিপে টিপে এসে চায়ের কাপটা রেখেই পা বাড়ালো যাবার জন্য। তখন ই খপ করে ধরলো ধ্রুব হাতটা। ধীর কন্ঠে বললো,
“চোরের মতো পালাচ্ছিস কেনো?”
“হাত ছাড়ো, আর পালাতে যাবো কেনো শুনি? চা দেওয়া কাজ ছিলো। কাজ শেষ, এখন নিজের ঘরে যাবো”
“এই ঘরটা কি পরের ঘর”
“হাসালে, মানুষটাই তো আমার না। ঘর দিয়ে কি করবো?”
“তোর কথাগুলো খুব ধারালো, জানিস তো?”
“জানি, কুৎসিত মানুষের কথা ধারালোই হয়”
“কে বলেছে কুৎসিত তোকে?”
“যার মন অসুন্দর সে তো কুৎসিত ই হয়, তাই না? হাতটা ছাড়ো”
“যদি না ছাড়ি?”
চিত্রা প্রত্যুত্তরে শান্ত থাকে, এই হেয়ালি খেলা তার পছন্দ নয়। দৃষ্টি সরিয়ে নেয় সে। ধ্রুব অপলক নজরে তাকিয়ে তাকে মেয়েটির দিকে। মাথায় খোঁপা করা, আলগা হয়ে গেছে তা। সালোয়ার কামিজের ওড়না পরিপাটি নেই। ফর্সা মুখখানা লাল হয়ে আছে অভিমানে। ঠোঁটের উপর জমেছে কিছু ঘামের মুক্তদানা। অসম্ভব সুন্দর লাগছে মেয়েটিকে। আজকাল কেনো যেনো মেয়েটিকে দেখতে খুব ভালো লাগে। নেশাগ্রস্থের মতো লাগে নিজেকে। মেয়েটি ধারালো কথাগুলোও মনে প্রশান্তির বর্ষণ করে। চিত্রার ভালোবাসাটাকে একদিন আবেগ বলে ঠেলে দিয়েছিলো সে। আজ সেই আবেগটাকেই জীবনন্ত করতে ইচ্ছে হয় ধ্রুবের। ধ্রুব নিঃশব্দে হাসলো। তারপর পাশের টুলটা এগিয়ে বললো,
“বয়”
“আমার কাজ আছে”
ধ্রুব জোর করে বসালো তাকে। তারপর ল্যাপটপটা ঘোরালো তার দিকে। একটা ভিডিও চলছে। ধ্রুবের কন্ঠে গাম্ভীর্য আনলো, তারপর বললো,
“মামার দূর্ঘটনার ভিডিও। এই যে গাড়িটি দেখা যাচ্ছে। এই গাড়ির খোঁজ পেয়েছি। পুলিশের উপর বসে থাকলে তো হবে না। খু/নীকে বের করতে হবে। গাড়িটির এক পুরানো গ্যারেজে পেলাম। কেউ বাজে ভাবে দূর্ঘটনা ঘটিয়ে তা বিক্রি করে দিয়েছে। মালিকের সন্ধান ও পাওয়া গেছে। পুলিশ গেছে জিজ্ঞাসাবাদে। আমি শুধু দেখছিলাম কিছু বাদ গেছে কি না। আর পেয়েও গেলাম। কিছু দেখতে পারছিস?”
চিত্রা অনেকক্ষণ তাকিয়ে রইলো ভিডিওটিতে। কয়েক মূহুর্ত বাদে তার চোখ বড় বড় হয়ে গেলো। কাঁপা স্বরে বললো,
“উনি এখানে কি করছে?”
“এটা তো আমারো প্রশ্ন”
*****
গোধুলিলগ্ন। বারান্দার এক কর্ণারে ক্যাকটাসে ফুটন্ত ফুলটির দিকে গভীর নয়নে তাকিয়ে আছে চারু। এই সময়টা তার অতিপ্রিয়। নীলাম্বরীর কোনে রক্তিম আভা, কোমল সূর্যের কিরণ। পৃথিবীটিকে যেনো আরোও বেশী মায়াবী লাগে চারুর। মৃদু বাতাস কানের কাছে গুনগুন করে। মেঘেরা তুলোর ন্যায় ভাসে আকাশে। জ্যৈষ্ঠের গরমের মাঝেও এই সময়টা যেনো শান্তি বয়ে যায়। ব্যাস্ত শহরে লাগামহীন ব্যস্ততায় এক টুকরো শান্তি। এখন এককাপ কফি পেলে মন্দ হতো না। তখন ই এককাপ ধোঁয়া তোলা কফি তার সামনে এসে রাখে শ্রাবণ। চারু অমলিন হাসি হেসে কাপটি নেয়। মৃদু কন্ঠে বলে,
“আপনি কিভাবে বুঝলেন এখন আমার কফি খেতে ইচ্ছে করছিলো”
“আমি যে তোমার মন পড়তে পারি চারুলতা”
চারু উত্তর দিলো না, দৃষ্টি সরিয়ে নিলো অদূরে। শ্রাবণ ভাবলো তার চারুলতার কাছে আবদার করবে, ক্ষমা চাবার জন্য। তখন ই বাড়ির কাজের মেয়ে ছুটে এলো। দরজায় টোকা না দিয়েই লতিকা হন্তদন্ত হয়ে ঢুকলো। এতে প্রচন্ড বিরক্ত হলো শ্রাবণ। কড়া কন্ঠে বললো,
“কি হলো, ম্যানারস নেই নাকি! এভাবে কে ঘরে ঢুকে?”
“মাফ করবেন ভাইজান, আসলে ঘটনাই এমন ঘটছে। আমি ভয়ে ছুটে আসছি”
“কি হয়েছে?”
“পুলিশ আইছে নিচে, আপনেরে খোঁজে”
লতিকার কথাটায় বেশ বিস্মিত হলো শ্রাবণ। কিন্তু চারুর ভ্রুক্ষেপ নেই। সে আয়েশ করে কাপে চুমুক দিচ্ছে। যেনো ঘটনাটা তার আগ থেকেই জানা।
নিচে যেতেই বাবাকে থমথমে মুখে দেখলো শ্রাবণ। কাওরান বাজার থানার ওসি ইন্সপেক্টর ইকবাল বসে আছে বসার ঘরে। শ্রাবণকে দেখতেই তার হাসি চওড়া হলো। এগিয়ে এসে বললো,
“ইউ আর আন্ডার এরেস্ট, মিস্টার জায়ান শাহরিয়ার। মনীরুল ইসলামের খু/নের দায়ে আপনাকে গ্রেফতার করছি………
চলবে
মুশফিকা রহমান মৈথি