#দূর_দ্বীপবাসিনী,৪২,৪৩
মুশফিকা রহমান মৈথি
#৪২তম_পর্ব
নিচে যেতেই বাবাকে থমথমে মুখে দেখলো শ্রাবণ। কাওরান বাজার থানার ওসি ইন্সপেক্টর ইকবাল বসে আছে বসার ঘরে। শ্রাবণকে দেখতেই তার হাসি চওড়া হলো। এগিয়ে এসে বললো,
“ইউ আর আন্ডার এরেস্ট, মিস্টার জায়ান শাহরিয়ার। মনীরুল ইসলামের খু/নের দায়ে আপনাকে গ্রেফতার করছি। আমাদের কাছে যথেষ্ট প্রমা্ণ আছে যে আপনি ই এই খু/নের প্রধান সাসপেক্ট”
কথাটা মস্তিষ্কের কোষে পৌছাতে সময় নিলো শ্রাবণের। হতবাক চাহনীতে তাকিয়ে রইলো সে। সে খু/ন করে নি, কারণ সেরাতে সে চারুর সাথে ছিলো। একই ঘরে, একই বিছানায়। শ্রাবণ অস্থির ভাবে বললো,
“আমি কিছু করি নি, কোথাও ভুল হচ্ছে?”
“আমাদের ভুল ঠিক না হয় আমরাই বুঝে নিবো মিস্টার জায়ান, প্লিজ কো-ওপারেট”
“কিসের জোরে আমাকে থানায় নিয়ে যাচ্ছেন, না জেনে আমি কোথাও যাবো না”
“বেশ, মনীরুল সাহেব কে যে খু/ন করা হয়েছে তা নিশ্চয়ই জানেন। যে সিসি টিভি ফুটেজ আমরা পেয়েছি সেখানে স্পষ্ট আপনার সেক্রেটারি রাকিবকে দেখা যাচ্ছে, আর যে গাড়িতে এক্সিডেন্ট হয় সেটাও তার গাড়ি। আমরা প্রথমে তাকেই সন্দেহ করি। কিন্তু একটা সেক্রেটারি কারণ ছাড়া কেনো কাজটা করবে? তার সকল ফোন রেকর্ড আমরা চেক করি। সেখানে আপনার একটা রেকর্ডিং আমরা পেয়েছি। যেখানে আপনি তাকে ওর্ডার করছিলেন, যেনো মনীরুল সাহেব শেষ হয়ে যায়। আপনার সেক্রেটারিকেও আমরা এরেস্ট করেছি। এবার তো আমাদের সাথে যাবেন”
শ্রাবণের অস্থিরতা বাড়লো। নিজেকে বারংবার নির্দোষ প্রমাণ করতে চাবার আকুল প্রচেষ্টা চালাতে লাগলো সে। কিন্তু ইন্সপেক্টর ইকবাল তার সিদ্ধান্তে অনড়। তখন ই শ্রাবণের খেয়াল হলো তার পেছনে চারু দাঁড়িয়ে আছে। সে ছুটে গেলো তার কাছে। আকুল কন্ঠে বললো,
“চারুলতা, আমি কিছু করি নি। তোমার চাচাকে আমি সত্যি খু/ন করি নি। বিশ্বাস করো”
“করতে তো চেয়েছিলাম। কিন্তু ওই যে বলে, ঘরপোড়া গরু সিঁদুরে মেঘ দেখলেও ভয় পায়। আমি হলাম সেই ঘরপোড়া গরু। কিভাবে বিশ্বাস করি বলুন, কিভাবে পারলেন এতোটা নিষ্ঠুর হতে। এতোকাল যা অন্যায় করেছেন সব মেয়ে নিতাম, যদি বড় চাচাকে আপনি ছেড়ে দিতেন। সে তো শুধু আমাকে চড় মারতে গিয়েছিলো। আপনি সেটার বদলা এভাবে নিলেন”
“আমি কিছু করি নি, বিশ্বাস করো প্লিজ”
শ্রাবণের আকুল আবেদন কানে তুললো না চারু। নিষ্ঠুরের মতো হাত ছাড়িয়ে নিলো। অপ্রতীভ কন্ঠে বলল্
“আমাদের দেখা কোর্টে হবে”
মোস্তফা কামাল শক্ত মুর্তির ন্যায় দাঁড়িয়ে আছেন। নিজের ছেলেকে নিষ্ঠুরের মতো টেনে নিয়ে যাচ্ছে কিন্তু কিছুই করতে পারছে না সে। আইনের মানুষ হয়ে তো আইন ভাঙ্গতে পারে না। তবে সে দৃঢ় কন্ঠে বললেন,
“আমি তোমাকে ঠিক ছাড়িয়ে নিবো। যদি সত্যি তুমি নির্দোষ হও তবে কেউ তোমাকে আটকে রাখতে পারবে না”
শ্রাবণকে নিয়ে যাওয়া হলো। চারু অপলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো পুলিশের ভ্যানটির দিকে। শ্রাবণ অসহায়ের মতো চারুর দিকে সাহায্যের জন্য তাকিয়ে ছিলো। কিন্তু চারু নিস্প্রভ আচারণ তাকে ভেতর থেকে চূর্ণবিচূর্ণ করে দিলো। সে সত্যি ই কিছুই করে নি। পুলিশ কখনোই শ্রাবণ অবধি আসতো না। কিন্তু ধ্রুবের সন্দেহ আজ শ্রাবণকে এই পর্যায়ে এনেছে। ধ্রুব সেই দোকানের মালিককে কিছু টাকা দিয়ে সিসিটিভি ফুটেজটি নেয়। খুব খুতিয়ে খুতিয়ে দেখে ওখানে কোনো ক্লু আছে কি না। অবশেষে পেয়েও যায়। ভিডিও এর একপাশে রাকিবের অবয়ব দেখা যায়। ধ্রুব এবং চিত্রা সেটা পুলিশকে জানায়। পুলিশ ততদিনে গাড়ির মালিকের খোঁজ নেয়, গাড়িটি রাকিবের নামে রেজিস্টার করা। কিন্তু গোল বাধে রাকিব যখন বলে, গাড়িটি চুরি গেছে। রাকিবের কাছে সেটার প্রমাণ ও ছিলো। তখন পুলিশ রাকিবের ফোন রেকর্ড বের করে। তার ল্যাপটপ এখন পুলিশের হেফাজতে। সেখান থেকেই শ্রাবনের রেকর্ডিং পাওয়া যায়। তখন পুলিশ নিশ্চিত হয় কে এই কান্ডের মূলে। ধ্রুব এবং চিত্রা পুলিশের এই ব্যাপারটা চারুকে ফোনে জানায়। চারুর মনে হয়েছিলো কেউ তার কানে যেনো গরম লোহা ঢেলে দিয়েছে। বিশ্বাস আবারো ভেঙ্গে যাবার অনুভূতি হয় তার। তাই শ্রাবণকে যে পুলিশ ধরতে আসবে জানা ছিলো চারুর। হ্যা, শ্রাবণ মনীরুল সাহেবকে শেষ করে দেবার কথাটা বলে ঠিকই, কিন্তু সেটা কোন প্রেক্ষিতে সেটা পুলিশের কাছে স্পষ্ট নয়। শ্রাবণ যখন জানতে পারে মনীরুল সাহেব ই দায়ী আহসান সাহেবের মৃত্যুর পেছনে এবং সে সম্পদের লোভে সব করেছে তখন তার রাগ নিয়ন্ত্রণ হারায়। রাকিবকে ফোন কে সে ওর্ডার দেয় ঠিকই। কিন্তু রাকিব সেটা করার আগেই মনীরুল সাহেব মারা যান। রাকিব সেখানে উপস্থিত ঠিক ছিলো। তবে তা মনীরুল সাহেবের মৃত্যুর পর। রাকিব বারংবার পুলিশকে বলা সত্ত্বেও তারা বিশ্বাস করছে না। কারণ প্রমাণ প্রধান। যদিও রাকিবের ল্যাপটপ থেকে তেমন কিছুই পায় নি পুলিশ। আগামী রবিবার তাদের কোর্টে চালান করা হবে।
বিগত আধা ঘন্টা যাবৎ শ্রাবণকে জেরা করা হচ্ছে। কাওরান বাজার থানায় বর্তমানে নতুন ইন্সপেক্টর জয়েন করেছে। সে শ্রাবণের অতি পরিচিত একজন, ফররুখ আহমেদ। সে তাকে রিমান্ডে নেবার পারমিশন আনিয়েছে। ইকবাল এবং সে একই সাথে এই কেসে আছে। কিন্তু শ্রাবণ মৌন, তাকে হাজার প্রশ্ন উত্তর করা হলেও সে তার মৌনতা ভাঙ্গে নি। চারুর মুখ ফি্রিয়ে নেওয়াটা যেনো সহ্য করতে পারছে না সে। বারবার চারুর ঘৃ/ণায় জড়ানো দৃষ্টি তার চোখের সামনে ভাসছে। একটা সময় ফররুখ বিরক্ত হয়ে যায়। জেরা থামিয়ে দেয়। ইকবালকে ডেকে বলে,
“এ মুখ খুলবে না, আমাদের এভিডেন্স তো স্ট্রং?”
“মোটামুটি”
তখন ই মোস্তফা কামাল উপস্থিত হয় নামী উকিল শাহাদাত হোসেনকে নিয়ে হাজির হলো। ফররুখ মোস্তফাকে ভালো করেই চিনে। সে তাচ্ছিল্যের হাসি হেসে বলল,
“স্যার, যত চেষ্টা করুন লাভ হবে না”
“দেখাই যাক”
উকিলের আসায় কয়েদির সাথে কথা বলার সময় দেয় ইকবাল এবং ফররুখ। মোস্তফা কামাল শ্রাবণকে বলে,
“তুমি আমার কাছ থেকে লুকিও না কিছু, সত্যি করে বলো তো এই খু/নটা কি করেছিলে?”
“চারুলতা আসলো না, ও কোথায়?”
“এখন কি চারুকে নিয়ে ভাববার সময় শ্রাবণ?”
“ও আমাকে একবার দেখতে আসলো না, ও কি এসব বিশ্বাস করে নিয়েছে?”
ছেলের এমন উত্তরে মেজাজ তিরিক্ষি হয়ে উঠে মোস্তফার। সে তীব্র কন্ঠে বলে,
“তোমাকে প্রথমেই বলেছিলাম, এই মেয়েটাকে এতো ভালোবেসো না। এতো পাগল হয়ো না। তুমি শুনো নি। সে তো তোমাকে ধরে আনার পর ই ও বাড়ি চলে গেছে। তোমার বিরুদ্ধে সে বয়ান ও দিবে। সাক্ষী সে তোমার বিরুদ্ধে। তোমার সব কিছু তো তার জানা। বুঝতে পারছো, কি হবে?”
“চারুলতা আমার সাথে এমন করবে না, ও তো আমাকে ভালোবাসে”
শ্রাবণ উম্মাদের মতো এক কথাই আওড়ালো। মোস্তফা কামাল দীর্ঘশ্বাস ফেললেন। ছেলে সত্যি উম্মাদ হয়ে গেছে। সে রাকিবের সাথে কথা বললেন, রাকিব তাদের এমন কিছু জানালো যার অপেক্ষাই তারা করছিলো। কিন্তু সময় লাগবে এটা প্রমাণ করতে। ততদিন এমন কিছু করতে হবে যেনো শ্রাবণ সুরক্ষিত থাকে। মোস্তফা কামাল উঠে দাঁড়ালেন। তার যাবার সময় হয়ে গিয়েছে। যাবার সময় ছেলেটার মাথায় একবার হাত বুলালো মোস্তফা কামাল। এতো বছরে এই প্রথম সে তার ছেলের মাথায় হাত বুলিয়েছে। কতগুলো বছর কেটে গেছে। কিন্তু শ্রাবণের মাঝে সেই অনুভূতি নেই। সে এক দৃষ্টিতে মাটির দিকে তাকিয়ে আছে। এতোটা নিষ্ঠুর কেনো তার দূর দ্বীপবাসিনী? কেনো?
*****
সময় নদীর স্রোতের মতো। রবিবার দেখতে দেখতে চলে এলো। রাকিব এবং শ্রাবণকে কোর্টে উঠানো হলো। যখন কাঠগড়ায় দাঁড়ালো তখন তার চোখ খুঁজলো চারুকে। প্রেয়সীকে দেখতে না পাবার উচাটন তাকে অস্থির করে তুলেছে। অসহায় চোখজোঁড়া খুঁজতে লাগলো শুধু চারুলতা। অবশেষে পেয়েও গেলো। একটা ধূসর রঙ্গের শাড়ি পরিহিতা রমনী কোর্টের শেষ ভাগে বসে রয়েছে। তার শুষ্ক চুলগুলো খোঁপায় বাধা। চোখে কালি পড়েছে। উদাস নয়নে তাকিয়ে আসে সে। শ্রাবণ অনুভব করলো তার বক্ষস্থলে চিনচিনে ব্যাথা করছে। এই ব্যাথার কারণটা কি? তার প্রেয়সীর চোখে ঘৃ/ণা, অবিশ্বাস যেনো তীক্ষ্ণ বিষাক্ত ছুরির আঘাতের মতো লাগছে। হৃদয়টা ক্ষতবিক্ষত করে দিচ্ছে। কোর্টের কার্যক্রম শুরু হলো, প্রতিপক্ষের উকিল শ্রাবণের বিরুদ্ধে আরোপ লাগালো অনেক। শ্রাবণের সাথে সেদিনের ঝগড়ার সাক্ষী দিলো চিত্রা এবং ধ্রুব। একটা সময় চারুকেও ডাকা হলো কাঠগড়ায়। তাকে জিজ্ঞেস করা হলো,
“মিসেস ফাতেমা তুজ জোহরা, আপনার এবং জনাব জায়ান শাহরিয়ার এর বিয়ের সময়কাল কতো?”
“মাস চারেক”
“আপনার স্বামীকে আপনি এই কয় মাসে ঠিক কত টুকু চিনেন? আপনার কি ধারণা আপনার স্বামীর পক্ষে এই খুন সম্ভব?”
চারু এক পলক তাকালো শ্রাবণের দিকে। শ্রাবণের অসহায় নিভু চোখজোড়া প্রতীক্ষায় আছে প্রিয়তমার উত্তরের। উত্তরটি কতটা জরুরী চারু জানে! আজ তার সাক্ষীর উপর শ্রাবণের ভবিষ্যৎ। চারু নীরব থাকলো বেশ কিছু সময়। শ্রাবণের চোখের দিকে স্থির থাকলো তার দৃষ্টি। শ্রাবণের উৎকন্ঠা যেনো অনুভব করলো সে। তারপর দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললো,
……………………
চলবে
মুশফিকা রহমান মৈথি
#দূর_দ্বীপবাসিনী
#৪৩তম_পর্ব
চারু নীরব থাকলো বেশ কিছু সময়। শ্রাবণের চোখের দিকে স্থির থাকলো তার দৃষ্টি। শ্রাবণের উৎকন্ঠা যেনো অনুভব করলো সে। তারপর দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললো,
“তার পক্ষে অসম্ভব কিছুই না। আমার জন্য সে সব করতে পারে। প্রচন্ড ভালোবাসেন কিনা আমায়, সেদিন সত্যি বড় চাচা মাত্রা ছাড়িয়েছিলেন। লোনের জন্য বেশ চোটপাট ও করেন। ফলে শ্রাবণ বেশ চটেও ছিলেন। হয়তো সেকারণেই সে রাকিবকে এমন কিছু করতে বলেছিলেন”
“সে কি এমন কিছু করেছে, যে আপনার এমন টা মনে হলো?”
“জ্বী, আমাকে একটা ছেলে কলেজে বেশ যন্ত্রণা করতো। শুধু তাই নয়, ক্ষমতার জোরে আমার সাথে মিসবিহেভ ও করেছিলো। শ্রাবণ তাকে খুব মেরেছিলেন। আইসিউ অবধি পাঠিয়ে দিয়েছিলেন। আমাকে যারা কিডন্যাপ করেছিলো তারাও এই পৃথিবীতে নেই। খুব অদ্ভুত ভাবে তাদের মৃ/ত্যু হয়। বুঝতেই পারছেন!”
চারুর সাক্ষীতে সারা কোর্টে নিস্তব্ধতা বিরাজমান হলো। কারোর মুখে একটা শব্দও নেই। চারু খুব শীতল কন্ঠে তার সাক্ষী দিলো। একটিবারো অপর পাশের মানুষটির দিকে চাইলো না। তাকালে হয়তো দেখতে পেতো সে অসহায়ের মতো তার দিকে তাকিয়ে আছে। শ্রাবণের সকল কার্যের বর্ণনা চারু দিচ্ছে, এতে শ্রাবণের বিরুদ্ধে কেস আরোও শক্ত হচ্ছে। ফলে তার এই জাল থেকে বের হওয়া অসম্ভব। কিন্তু তার যেনো এতে কোনো আফসোস নেই। আফসোস চারু তাকে ঘৃণা করে, আফসোস তার দূর দ্বীপবাসিনীকে হয়তো আর কখনোই চোখের দেখা দেখতে পাবে না। এতো নিষ্ঠুর কেনো হলো তার প্রেয়সী! তাদের সম্পর্কের সেই উষ্ণতা কোথায় হারিয়ে গেলো। বিপক্ষের উকিল কোর্টে চিৎকার করে বললো,
“ইউর ওনার, এই মানুষটি এই জা/নো/য়া/র। একজন মানসিক বিকারগ্রস্থ মানুষ৷ তার পক্ষে কাউকে খু/ন করা কোনো বড় ব্যাপার না। একজন ক্রিমিনালকে আমরা যদি বাহিরে ছেড়ে দেই সে আমাদের জন্য ক্ষতিকর৷ তাই আমার রিকুয়েষ্ট এই জায়ার শাহরিয়ারকে কঠিন থেকে কঠিনতর শাস্তি দেওয়া হোক। দ্যাটস অল মাই লর্ড”
“অবজেকশন, আমার মক্কেলকে তার পক্ষের যুক্তি না রাখতে দিয়ে এভাবে শুলে চড়ানোটা আদালতের কার্যক্রমকে সম্পূর্ণভাবে প্রশ্নের সম্মুখীন করে। আমার মক্কেলের পক্ষে কিছু বলার সুযোগ চাচ্ছি ইউর ওনার”
বিপক্ষের উকিলের কথার বিপরীতে শাহাদাত হোসেন কথাটা বলে উঠে। বিচারক গম্ভীর কন্ঠে বলে,
“ইউ মে প্রসিড”
“থ্যাংক উ, আমার মক্কেলের একটা ফোন রেকর্ডিং এর উপর তাকে এই খু/নের মুখ্যম আসামী বানানো হয়েছে। কিন্তু আমি যদি বলি এই ফোন রেকর্ডিং এর কোনো ভিত্তি নেই। মনীরুল ইসলামকে কেউ বি/ভ/ৎ/স/তার সাথে খু/ন করেছে। কিন্তু সেটা যে আমার মক্কেল তার কোনো প্রমাণ কি আছে? কোনো আই উইটনেস। না নেই, সেই সময় রাকিব সাহেবের উপস্থিতিটা একটা কাকতালীয় ব্যাপার। আর যে ফোন রেকর্ডিং এর ভিত্তিতে তাকে গ্রেফতার করা হয়েছে সেটা তো একটা ছোট এক্সপ্রেশন ছিলো। একজনে শ্বশুর মারা গেছেন, তার লাশ দাফনের কিছু সময় বাদেই তার স্ত্রীকে ঘর থেকে বের করার কথা, মারা কথা আসলে একজন স্বামীর রাগার কথা। আমরা রাগের বসে অনেক কিছুই বলি, করি। উপরন্তু আমার মক্কেল একজন মানসিকভাবে অসুস্থ মানুষ। সুতরাং তার এমনটা হওয়া খুব স্বাভাবিক। এখানে আমার মক্কেল জায়ান শাহরিয়ার এর মেডিকেল হিস্টোরি আছে। রিপোর্ট দেখলেই আপনি বুঝতে পারবেন সে কতোটা মানসিক ভাবে বিপর্যস্ত। সাত বছর বয়সে মা হারানোর ট্রমা তাকে মানসিকভাবে ভেঙে ফেলে। ছোট বেলা থেকেই সে সাইকিয়াট্রিস্ট আবদুর রহমানের প্যাশেন্ট। আমার মক্কেল সম্পূর্ণ রাগের বশেই এই শেষ করার কথাটা বলেছিলেন”
শাহাদাতের পেশ করা মেডিকেল ফাইলটিতে চোখ বুলাতে লাগলো বিচারক। শাহাদাত কিছুক্ষণ থেমে আবার বললো,
“ইউর অনার আমি মিসেস ফাতেমা তুজ জোহরাকে কিছু প্রশ্ন করতে চাই”
“অনুমতি দেওয়া হল”
চারু স্থির কাঠগড়ায় দাঁড়িয়ে আছে। শাহাদাত তার কাছে বললো,
“আপনার একটু আগে বলেছিলেন, মিস্টার জায়ান শাহরিয়ার আপনার জন্য একজন কলেজ স্টুডেন্টকে মেরেছিলো। সেটার কোনো প্রমাণ কি আছে?”
“জ্বী না। তবে শ্রাবণ আমাকে নিজে বলেছে সেটা”
“ওহ, বেশ। আর আমার কি/ড/ন্যা/পার এর ব্যাপারটা আপনি বলেছিলেন তাদের নাকি শ্রাবণ সাহেব মেরেছে। তার কি প্রমাণ আছে?”
“জ্বী না”
“এটাও নিশ্চয়ই শ্রাবণ সাহেব ই বলেছে”
চারু উত্তর দিলো না। ফলে শাহাদাত এবার তীব্র স্বরে বললো,
“দেখুন ফাতেমা তুজ জোহরা, একজন মানসিক রোগীর সাথে থাকা সহজ নয়৷ তারা এক এক সময় এক এক কথা বলে। সেটা সত্য এটা কিন্তু নয়”
এবার শাহাদাত একটা ফাইল পেশ করে। তারপর বলে,
“এই ফাইল অনুযায়ী যে কলেজ স্টুডেন্ট এর কথা বলা হচ্ছে তার ডিটেইলস আছে। রাজনৈতিক কারণে সে একটা মারামারির মাঝে পড়ে, যেখানে আমার মক্কেলের কোনো হাত নেই। তার বয়ান ও এখানে আছে। আর যে কি/ড/ন্যা/পের কথা বলা হচ্ছে তারা পুলিশের ভয়ে আ/ত্ম/হ/ত্যা করেছিলো। এখানে থানার ওসি সামিনকে আমি সাক্ষী হিসেবে ডাকতে চাই।”
“অনুমতি দেওয়া হলো”
কাঠগড়া থেকে চারু নেমে যায়। সে একটি বারও শ্রাবণের দিকে তাকালো না। কেনো যেনো ওই নীলাভ চোখের দিকে তাকানোর সাহস হলো না। শ্রাবণ মূর্তির মতো দাঁড়িয়ে রইলো। তাকে পাগল সাব্যস্ত কেনো করা হচ্ছে সেটা বুঝতে বাকি রইলো না। বাবা, শেষ পর্যন্ত তাকে বাঁচানোর জন্য তাকে মানসিক রোগী বানাচ্ছে। অবশ্য এগুলো কিছুই মিথ্যে নয়। সে সত্যি একজন সাইকিয়াট্রিস্টের আন্ডারে ছিলো ছোটবেলায়। কিন্তু যখন বাবাকে আ/ত্ম/হ/ত্যা করার হুমকি দিয়েছিলো, মোস্তফা তাকে জোর করে নি। পাগল ছেলে তার চলবে, কিন্তু যে ছেলেকে বাঁচাতে এতো কিছু সেই ছেলেকে হারাতে নারাজ সে।
ইন্সপেক্টর সামিন কাঠগড়ায় আসে। শপথ গ্রহণের পর শাহাদাত তাকে প্রশ্ন করে,
“সামিন সাহেব, মিসেস ফাতেমা তুজ জোহরা কি/ড/ন্যা/পিং কেস টা তো আপনি হ্যান্ডেল করেছিলেন! তাই না?”
“জ্বী”
“আমাদের একটু বিস্তারিত বলা যাবে?”
“জ্বী, আশরাফ গণি অর্থাৎ মিস্টার জায়ানের বিজনেস রাইভাল চারু ম্যাডামকে অ/প/হ/র/ণ করেন। এবং তাকে একটা পুরোনো ফ্যাক্টরিতে আটকে রাখে। এই কাছে আরিফ, জায়ানের আগের স্টাফ এবং চারু ম্যাডামের সহপাঠী, নাজমুল এবং করিম নামক দুজন চাঁদাবাজ জড়িত ছিলো। তারাই এগুলো করে। নাজমুল এবং করিম গণি সাহেবের ভয়ে সু/ই/সা/ই/ড করে, আরিফ মিস্টার শ্রাবণকে মারতেও চায়। আমরা তাকে গ্রেফতার করি। কিন্তু সে পুলিশকে ধোকা দিয়ে পালিয়ে যায়। তারপর সে চারু ম্যাডাম এবং শ্রাবণ সাহেবের উপর হামলাও করে। একপর্যায়ে সে আহত হয়। এখন সে বারডেমে ভর্তি, এখনো জ্ঞান ফিরে নি। হয়তো ফিরবে ও না। আর আশরাফ গণি তাকে পালাতে সাহায্য করায় তাকেও আমরা জেলে পুড়ি। এখন সে পাঁচ বছরের সশ্রম জেল খাটছে”
“ধন্যবাদ”
সামিন কাঠগড়া থেকে নেমে গেলে শাহাদাত বলে,
“ইউর অনার, আমার মক্কেলের উপর দেওয়া সকল অপরাধ বেবুনিয়াদ। আমার মক্কেল মানসিক ভাবে অসুস্থ। তবে সে কোনো ক্রাইম করে নি। একটা কল রেকর্ডিং কখনোই একটা প্রমাণ হতে পারে না। একটা খু/ন কোনো ফাজলামি নয়। কোর্টের কাছে আমার অনুরোধ, পুলিশ এই কেসের পুর্ণ তদন্ত করুক। এবং আসল খুনীকে খুঁজে বের করুক”
আদালতের সময় সীমা শেষ হয়ে যায় সেই মূহুর্তে। আগামী শুনানির তারিখ পড়ে। কোর্ট ততদিন শ্রাবণ এবং রাকিবকে স্পেশাল নজরে রাখে। বিশেষ করে শ্রাবণকে। তাকে স্পেশাল সেলে পাঠানো হয়। যখন পুলিশ তাকে নিয়ে যাচ্ছিলো তখন মোস্তফার সাথে তার দেখা হয়। মোস্তফা নীরব দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে ছেলের দিকে। তারপর ধীর স্বরে বলে,
“অল্প কিছুদিন অপেক্ষা করো। আমি তোমাকে ঠিক ছাড়িয়ে নিবো”
শ্রাবণ উত্তর দেয় না। মাথা নিচু করে চলে যায়। তার এসবে কিছু যায় আসছে না। তার হৃদয়ের বেদনার কারণ অন্যকিছু। তার প্রেয়সী একটি বার ও তার দিকে তাকালো না। হনহন করে চলে গেলো মুখ ফিরিয়ে। এমনটা কেনো হয়! কেনো হয় এমন!
********
শ্রাবণকে রাখা হয়েছে একটা বদ্ধ কামড়ায়। যার উপরে একটা ছোট জানালা। সেটা দিয়ে সূর্যের আলো আসে খুব কম। স্যাতসেতে একটা ঘর। দেয়ালের চুন খসে পরসে। এক কোনায় বাথরুমের ব্যাবস্থা। মাটিতেই ঘুমায় সে। ময়লা শার্ট বদলানো হয় নি শ্রাবণের। খাওয়া দাওয়া খুব বিশ্রী। শক্ত রুটি আর পাতলা ডাল। রুটি চাবাতেও ইচ্ছে হয় না। তিনদিন কেটে গেছে এই বদ্ধ ঘরে সে আছে। সে অপেক্ষায় আছে কবে তার মুক্তি হবে। সে জানে তার মুক্তি হবে। কিন্তু কি রুপে জানা নেই! মাঝে মাঝে ভাবে, হয়তো মা তাকে নিতে আসবে। এইতো সকালের কথা, ঘুম থেকে উঠতেই দেখলো তার মা ইশরা এক কোনায় বসে আছে। সেই ধূসর শাড়ি, সেই সাজ। সেই নীলাভ চোখ, অপ্রতীভ একটা হাসি। তাকে দেখতেই বললো,
“শ্রাবণ, সোনা তোমার কষ্ট হচ্ছে?”
শ্রাবণ মাথা নাড়ায়। বলে,
“খুব কষ্ট হয় মা। বুকের মধ্যখানে হাহাকার করে। শুণ্যতা চারপাশে। আমার কেউ নেই। তুমিও স্বার্থপর, ছেড়ে গেলে”
“আমি তো যেতে চাই নি সোনা। আমি ত জানতাম এই বর্বর পৃথিবী আমাদের নয়। এরা শুধু আমাদের ব্যবহার ই করে যাবে। বিনিময়ে কিচ্ছু দিবে না। খুব বাজে। আমি তোমায় নিয়ে যেতে চেয়েছিলাম। কিন্তু সে আমাকে দিলো না। তোমার বাবা তোমাকে আটকে রাখলো। লাভ কি হলো বলো? আমাকেও সবাই ভুল বুঝতো জানো। আমাকেও সবাই পাগল ভাবতো। খারাপ ভালোর পাল্লায় ফেলতো। আমি জানতাম তো, তোমার সাথেও এমন হবে। তাই তো নিতে এলাম, যাবে?”
শ্রাবণ উত্তর দেয় না। অবাক চোখে তাকিয়ে থাকে মার দিকে। সে চলে গেলে তার দূর দ্বীপবাসিনীর কি হবে! কে আগলে রাখবে তাকে। এই পৃথিবী যে বর্বর। শ্রাবণের উত্তর না পেয়ে ইশরা ম্লান হাসে। তারপর হাওয়ায় মিলিয়ে যায়। আর তখন ই ঘুম ভেঙ্গে যায় শ্রাবণের। অসম্ভব উত্তেজনায় আবারও খিঁচুনি উঠে। তার সেলের বাহিরের পাহারাদার কন্সটেবল পলাশ ছুটে যায়। ডাক্তার আসে, থানায় থাকা মোস্তফা কামালের একটা লোক বাড়ি ফোন দেয়। কামাল তাকে ইঞ্জেকশনের নাম বলে। সেই ইঞ্জেকশন দেওয়া হয় শ্রাবণকে৷ মোস্তফা শ্রাবণকে হাসপাতালে নেবার আর্জি দেয়। কিন্তু ইন্সপেক্টর ইকরাম সেটা খারিজ করে। ফলে সেলেই থাকতে হচ্ছে শ্রাবণকে।
উদাস নয়নে ছোট সেই জানালার দিকে তাকিয়ে আছে সে। আচ্ছ! মার সাথে যেতে চাইলে কি হতো! এই অসম্ভব কষ্ট থেকে কি মুক্তি পাওয়া যেত! তখনই কন্সটেবল পলাশ তীক্ষ্ণ স্বরে বলে,
“তোমার সাথে দেখা করতে এসেছে”
তীক্ষ্ণ স্বরে বিরক্ত হয় শ্রাবণ। চোখ সরিয়ে নিয়ে যায় শিকের দিকে। সেদিকে দেখতেই হৃদয়ে চিনচিনে ব্যাথা অনুভূত হয়। কাঁপা স্বরে বলে,
“চারুলতা, তুমি এসেছো?……….
চলবে
মুশফিকা রহমান মৈথি