#দূর_দ্বীপবাসিনী,৬,৭
মুশফিকা রহমান মৈথি
#৬ষ্ঠ_পর্ব
পায়ের শব্দ প্রবল হচ্ছে। হয়তো কাছে চলেছে এসেছে ছেলেগুলো। চারু কোনোমতে উঠেই ছুটলো। পায়ের শব্দ একেবারে কাছে চলে এসেছে। ঠিক তখনই এক জন মানুষের সাথে ধাক্কা খেলো চারু। টাল সামলাতে না পেরে পড়ে যেতে নিলেই এক জোড়া শীতল শক্ত হাত নিপুনভাবে সামলে নিলো তাকে। এক প্রবল পুরুষালী কড়া গন্ধ নাকে আসছে। ভয়ে চোখ মুখ খিঁচে বন্ধ করে নিলো চারু। তার শরীর ঈষৎ কাঁপছে। ভয়ে গলা শুকিয়ে আসছে। দম আটকানো অস্থিরতা ঘিরে ধরলো তাকে। কিয়ৎকাল নিস্তব্ধতাই হলো তার সঙ্গী।
“আপনি এভাবে ছুটছিলেন কেনো চারুলতা?”
সেই নিস্তব্ধতাকে ভেদ করে এক গম্ভীর কিন্তু অস্থির পুরুষালী কন্ঠ কর্ণপাত হলো চারুর। তড়াক গতিতে চোখ মেললো চারু। চোখ খুলতেই সামনে থাকা পুরুষের সাক্ষাত পেলো। মূহুর্তেই ভয়, অস্থিরতাগুলো স্বস্তির রুপ নিলো। কেনো নিলো জানা নেই, তবে এই ক্ষণ পরিচিত লোকটাকে দেখে আসন্ন বিপদে আশার আলো খুজে পেলো চারু। জড়ানো গলায় বললো,
“ওরা আমার পিছু নিয়েছে”
“কারা?”
অস্থির গলায় জানতে চাইলো শ্রাবণ। চারু কাপা হাতে আঙ্গুল তাক করলো পেছনে। দু-তিনটা ছেলে চারুর থেকে কিছু দূর আসতে থেমে গেলো। শ্রাবণের চোখ রাঙ্গানো কঠিন দৃষ্টিতে তাদের নেশাটা উবে গেল। ঘুরে পেছনে দৌড় দিলো তারা। চারু এখনো তার বাহুডোরে আটষাট হয়ে আবদ্ধ। শ্রাবণ স্বর নরম করার চেষ্টা করে জানালো,
“ভয় পাবের না চারুলতা, ওরা চলে গেছে”
চারু এখন ক্ষীন কাঁপছে। ভীত নজরে পেছনে তাকালো সে। শুণ্য গলিতে দুটো কুকুরকে ঘুরতে দেখে রুদ্ধশ্বাস ছাড়লো সে। হঠাৎ তটস্থ হলো নিজের অবস্থান। অস্বস্তিকর অবস্থার মুখোমুখি হবার পূর্বেই সরে এলো সে। নিজের ওড়নাটা ঠিক করতে করতে বললো,
“ধন্যবাদ”
“সে না হয় বুঝলাম, কিন্তু এতো রাতে এখানে কি করছিলেন আপনি? আর একটু হলেই তো একটা অঘটন ঘটে যেতো। জানেন না দিনকাল ভালো নয়”
শীতল কন্ঠে বলা কথায় রোষের হাতছানি ঠিক ই টের পেলো চারু। মিনমিনে স্বরে বললো,
“বান্ধবীর বাড়ি এসেছিলাম, সময়ের দিকে খেয়াল ছিলো না। রিক্সাও পাই নি। ভেবেছি হাটতে মোড়ে রিক্সা পাবো”
“পেয়েছেন কি? উল্টো তিনটা মাতালকে জুটিয়েছিলেন। ভাগ্যিস আমি ছিলাম”
হ্যা, ভাগ্যিস শ্রাবণ ছিলো। নয়তো কি হতো মা’বুদ ই জানেন। চারু কিছু বলার সাহস পেলো না। শ্রাবণের কন্ঠে অগ্নি ঝড়ছে, লোকটা এমন ভাবে ঝাড়াঝাড়ি করছে যেনো নিজের বিবাহিত স্ত্রীকে বকাঝকা করছে। কি অদ্ভুত অধিকারচর্চা!.. বেশ কিছুক্ষণ কড়া ভাবে শাসিয়ে কিঞ্চিত শান্ত হলো শ্রাবণ। নমনীয় স্বরে বললো,
“চলুন, বাড়ি পৌছে দেই। পাকনামি করবেন না। আমি মতামত শুনবো না”
কঠোরভাবে শেষ কথাটা বললো শ্রাবণ। চারু শুধু ঘাড় কাত করলো। চারুর চুপসে যাওয়া মুখখানি দেখে স্মিত হাসলো সে। মেয়েটির তেজটা ভয়ের চাদরে ঢাকা পড়েছে। তবে মেয়েটিকে সকল রুপেই ভালো লাগে তার, লাজুক লজ্জাবতী হোক বা তেজী সূর্যের প্রতীভ মুখশ্রী। কিংবা ভয়ে শিটিয়ে যাওয়া কিশোরীর সন্তস্ত্র চেহারা। সবকিছুই বড্ড ভালোলাগে। শ্রাবণ হাটতে শুরু করলে চারু আরোও একবার বিপাকে পড়লো। পা টেনে হাটতেও কুকড়ে যাচ্ছে। তখন ভয়ের দরুন টের না পেলেও এখন আচ্ছামত বুঝতে পারছে পা টা বাজেভাবে মচকেছে। শ্রাবণ কিছুদূর এগিয়ে গেলেও পুনরায় পিছিয়ে আসলো। ভ্রুকুঞ্চিত করে তীক্ষ্ণ স্বরে বললো,
“এতো বেপোরোয়া কেনো চারুলতা? তুমি সত্যি বড্ড নিষ্ঠুর”
কথাটা শেষ হবামাত্রই পাজাকোলে তুললো তাকে। শুণ্যে ভাসতে দেখে তড়িঘড়ি করে বললো,
“এ কি! কি করছেন?”
“চুপ, একটা কথা বললেই আছাড় দিবো। তখন পায়ের সাথে মাজাও যাবে। খোঁড়া বউ এ আমার সমস্যা নেই, কিন্তু আমার কোলে কোলেই ঘুরতে হবে। ভেবে দেইখো”
মূহুর্তেই রেগে গেলো চারু। লোকটির জোর খাটানোর ধরণ দেখেই তার আক্কেলগুড়ুম। অন্যসময় হলে দু-চার কথা শুনিয়ে দিতো। কিন্তু নিজের অসহায়ত্বের দিকে তাকিয়ে কিছু বলতে পারলো না। মুখ ফুলিয়ে অন্য দিকে চেয়ে রইলো সে। শ্রাবণ নিঃশব্দে হাসলো, তারপর চারুকে নিয়ে এগিয়ে গেলো গাড়ির দিকে।
চারু গাড়ির ফ্রন্ট সিটে বসে রয়েছে। অপেক্ষা শ্রাবণের আসার। সে ফার্মেসিতে গিয়েছে। স্প্রে, ব্যান্ডেজ কিনতে। তার মতে এখন ই প্রাথমিক চিকিৎসা করতে হবে। নয়তো ব্যাথা কমবে না। চারুর অস্থিরতা বাড়ছে। বাড়ি গেলে না জানি কিসের সম্মুখে পড়তে হবে কে জানে। বাবা দুবার ফোন করেছে অবশ্য৷ ভয়ে ফোন ধরে নি। এই শ্রাবণের বেশি বাড়াবাড়ি। এই বাড়াবাড়ির প্রয়োজনীয়তা ছিলো না। ঠিক তখনই তার সাইডের দরজাটা খুলে শ্রাবণ। বলা নেই কওয়া নেই হুট করেই পাটা হাটুতে উঠিয়ে নিলো। ঘটনার আকস্মিকতায় চারু বিমূঢ় দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো। লোকটি কোনো বিব্রতবোধ ছাড়াই তার পা টা নিজ হাটুর উপর রেখে স্প্রে লাগাতে লাগলো। পরম যত্নে পাটা ব্যান্ডেজ করে দিলো। তার শীতল হাতের স্পর্শে বাড়ে বাড়ে কেপে উঠছে। হৃদস্পন্দন বেড়ে যাচ্ছে ক্রমাগত। নিঃশ্বাস গাঢ় হচ্ছে। মাঝেই কোমল কন্ঠে বললো,
“ব্যাথা করছে?”
চারু দুপাশে মাথা নেড়ে “না” জানালো। শ্রাবণ একটু থেমে বললো,
“একটু ব্যাথা করবে। আংকেলকে বলবো, কালকে ডাক্তার দেখাতে। এখন তো রাত হয়ে গেছে। মচকেছে তো, ভাঙ্গে নি। তাই হাসপাতালে নিচ্ছি না। কিন্তু ক দিন রেস্ট নিও। লাফালাফির প্রয়োজনীয়তা নেই”
চারু খেয়াল করলো, আপনি নামক সম্বোধনটা কোথায় যেনো উড়ে গেলো। তুমিতে চলে এসেছে। চারু কিঞ্চিত অস্বস্তি বোধ করলো। মিনিয়ে বললো,
“বাড়ি যাবো”
শ্রাবণ যত্নে ব্যান্ডেজ করে দিলো। ব্যাথাটা কমেছে কিঞ্চিত। শ্রাবণ এবার পা টা তুলে খুব সাবধানে রাখলো। তারপর দরজাটা দিয়ে, ড্রাইভিং সিটে বসলো। তারপর স্টার্ট দিলো গাড়ি। পিচের রাস্তা চিরে কালো নীলাম্বরীর নিচে চললো গাড়ি।
???
শ্রাবণকে চারুর সাথে দেখে বাড়ির সবাই এর চক্ষুচরাগ গাছ। আহসান সাহেবের ভ্রু কুঞ্চিত হয়ে এলো। জাহানারা হতভম্ব হয়ে গেলো দৃশ্যটি দেখে। যতই বিবাহ ঠিক হোক না কেনো! মেয়ে একজন ছেলের কোলে করে বাড়ি ফিরেছে দৃশ্যটি দৃষ্টিকটু। ধ্রুব চোয়াল শক্ত করে চেয়ে রইলো শ্রাবণের দিকে। এদিকে মনিরুল সাহেবের মুখে প্রসন্নতা। গদগদ কন্ঠে বললেন,
“এ কি! শ্রাবণ বাবা তুমি এখানে? কি হয়েছে চারু মায়ের”
শ্রাবণ নমনীয় কন্ঠে বললো,
“ভেতরে আসবো বড় চাচা? ওর পা মচকে গেছে। ওকে শোয়ানো প্রয়োজন”
জাহানারা বিচলিত হয়ে উঠলো,
“এ মা, কিভাবে হলো? আসো আসো! একেবারে ওর রুমেই নিয়ে আসো!”
চারুকে তার বিছানায় শোয়ানো হলো। শ্রাবণ সবকিছু খুলে বললো। আহসান সাহেব সব শুনে কৃতিজ্ঞতা প্রকাশ করলেন। মনিরুল সাহেব আয়োজন শুরু করলো আপ্পায়নের। প্রথমে না করলেও বাধ্য হয়ে খেতে বসতে হলো। শ্রাবণকে নিয়ে দহরমমহরম দেখে চারুর চাচাতো বোন চিত্রা একটু গুতা দিয়ে বললো,
“বুবু, দুলাভাই তো একেবারে হিরো! কি সুন্দর হিরোদের মতো তোকে বাঁচালো”
“থামবি তুই”
“ভুল বললাম নাকি! তোদের না বেশ মানায়। আমি তো যখন দেখলাম ভাই কোলে করে তোকে সদর দিয়ে ঢুকছেন, শিস বাজাতে ইচ্ছে করছিলো। মায়ের হাতে মার খাবো বিধায় দমে গেলাম। কি মধুর সিন”
চারু চোখ রাঙ্গালো চিত্রাকে। কিন্তু কিসের কি! সে বরাবর ই ইঁচড়েপাকা। চারু যতটা শান্ত সে ততটাই চঞ্চল। দেখতেও চারুর সাথে মিল নেই। অসম্ভব সুন্দরীদের কাতারে পড়ে সে। তবে বড্ড বেশি বকে। চারু কড়া কন্ঠে বললো,
“এতোই ভালো লেগেছে যখন বিয়ে করে নে না। আপদ ঘাড় থেকে নামুক”
“হাহ! আমি যে অন্য আপদের ঘাড়ে উঠতে চাই গো। তোমার আপদ দুলাভাই ই থাক”
বলেই হাসতে হাসতে বেড়িয়ে গেলো সে। চারু ফোঁস করে নিঃশ্বাস ছাড়লো। অবশেষে মস্তিষ্ক মুক্তি পেলো। কিন্তু যা ভাবলো তা হলো না! বরং নতুন এক চিন্তা মন এবং মস্তিষ্কে চড়ে বসলো। শ্রাবণমুখর এক চিন্তা________
☘☘☘☘
নিগূঢ় রাত নিজ রুমের টেবিলের উপর হাত জোড়ো করে বসে রয়েছে ধ্রুব। মেজাজটা বশে নেই। শ্রাবণকে নিয়ে অতিআদিক্ষেতা সহ্য হচ্ছে না। বড় মামা কি না জোরপূর্বক তাকে বাড়িতে রেখে দিলেন। আর ওই বেহায়া খেয়ে দেয়ে থেকেও গেলো। খাবার টেবিলে বসতে যেয়েও উঠে আসলো সে। বড় মামা তীক্ষ্ণ স্বরে বললেন,
“তুমি পরে বসো”
কথাটা আতে লাগায় রাগ করে খেতেই গেলো না সে। প্রতিরাতের ন্যায় নিজের অভিযোগগুলো যখন ডাইরির পাতায় লিখতে ব্যাস্ত তখন ই নারী কন্ঠ কানে এলো,
“কি লেখো ধ্রুব ভাই?”
চমকে উঠলো ধ্রুব। তাড়াতাড়ি ডাইরি বন্ধ করে দিলো সে। পেছনে ফিরতেই মেজাজ খারাপ হয়ে উঠলো, খেকিয়ে বললো,
“তুই এখানে?”
চিত্রা হাতের প্লেটটা এগিয়ে দিয়ে বললো,
“তোমার ডাইরি পড়ার ইচ্ছে আমার নেই। মা বললো তোমাকে খাবার দিতে তাই আসলাম। তখন মুখ ফুলিয়ে যে ঘরে ঢুকেছো আমি কিন্তু দেখেছি”
চিত্রার ত্যাড়া কথায় বিরক্ত হলো ধ্রুব। খপ করে প্লেটটা নিয়ে বললো,
“এবার যা বের হ, আর নক না করে ঘরে আসবি না। ধামড়া ছেলের ঘরে ঢুকতে লজ্জা লাগে না? যা বের হ”
চিত্রার উজ্জ্বল মুখখানা নিভে যায়। অপ্রতীভ স্বরে শুধায়,
“আচ্ছা, আমি তো বুবুর থেকেও সুন্দর। তাহলে বুবুর প্রতি ভালোবাসা আর আমার প্রতি অবজ্ঞা কেনো………
চলবে
মুশফিকা রহমান মৈথি
#দূর_দ্বীপবাসিনী
#৭ম_পর্ব
চিত্রার উজ্জ্বল মুখখানা নিভে যায়। নিষ্প্রভ স্বরে শুধায়,
“আচ্ছা, আমি তো বুবুর থেকেও সুন্দর। তাহলে বুবুর প্রতি ভালোবাসা আর আমার প্রতি অবজ্ঞা কেনো? এতো ভেদাভেদ কেনো আমাদের মাঝে?”
কিয়ৎকাল চুপ করে রইলো ধ্রুব। চিত্রা তার মুখপানে তাকিয়ে রইলো উত্তরের অপেক্ষায়। মূহুর্তবাদে মলিন কন্ঠে উত্তর দিলো,
“আমার হৃদয় যে সৌন্দর্যে মজে না চিত্রা, এই বাহ্যিক সৌন্দর্য দিয়ে কি করবো?”
“আমার অন্তরটা যে অসুন্দর সেই খোঁজ পেলে কিভাবে? কখনো তো অন্তরের খোঁজ নিতেই চাও নি”
চিত্রা বিদ্রুপের স্বরে বললো কথাটা। সুন্দর পুতুলের মুখে ছেয়ে আসলো নীল বেদনায়। বেদনা মনের মানুষের কাছে মূল্য না পাওয়ার। সেই কিশোরী বয়সে পা দেবার পর থেকেই একজন পুরুষকেই মন দিয়ে বসেছে সে। চিত্রার নিষ্পাপ হৃদয়ের আহবান গুলোকে নিছক আবেগ বলেই অবজ্ঞা করে এসেছে ধ্রুব। কিন্তু কিশোরী চিত্রা থেমে যায় নি, ভালোবাসার মানুষটির জন্য একটু বেহায়া হলে ক্ষতি কি! ভালোবাসা তো মাঝে মাঝে বেহায়াই হয়, আত্মসম্মানের এতো পরোয়া করলে কি ভালোবাসা হয়? তার মতে প্রেম এবং আত্মসম্মান কখনোই এক সাথে চলতে পারে না। একটাকে বিজর্সণ দিতেই হয়। তাই নিজের আত্মসম্মানকে বিসর্জন দিয়েই সে ভালোবাসছে ধ্রুবকে। নানা ভাবে শতবার বুঝানোর প্রচেষ্টা করেছে সে। অথচ ফলাফল শূন্য, ধ্রুবের অবজ্ঞাই পেয়ে এসেছে সে। এইকারণটাও তার জানা, ধ্রুবের মনোমন্দিরে যে তার ঠায় নেই, সেখানে শুধু একজন নারী নিজের সম্পূর্ণ বিস্তার নিয়ে রাজত্ব করছে। মাঝে মাঝে চারুর প্রতি বড্ড হিংসে হয় চিত্রার। যে মানুষটির মনে ধ্রুবের প্রতি এক বিন্দু প্রণয়ের ছিটাও নেই সেই মানুষটিকে নিয়েই ধ্রুব এর সকল ভাবনা। ধ্রুবের নেত্র শুধু তাকেই দেখে। এই চাহনী কেউ না বুঝলেও চিত্রা ঠিক ই বুঝে। তাইতো যে বুবুকে এতোটা ভালোবাসে সে, সেই বুবুকেই হিংসে করে তখন। পরে নিজেকেই গালমন্দ করে সে। ছোট একটা নিঃশ্বাস গোপন করলো চিত্রা। ধীর স্বরে বললো,
“খেয়ে নিও, আমি আসছি”
দরজার দিকে পা বাড়িয়েও থেমে গেলো সে। পেছনে ফিরে বললো,
“আমি চাই এবার বুবুর বিয়েটা হোক, আর তা শ্রাবণ ভাই এর সাথেই হোক”
“চারুর বিয়ে হয়ে গেলেও আমার হৃদয়ে তার স্থান অক্ষুন্ন থাকবে। সেখানে তোর ঠায় হবে না ইহজীবনেও”
রুঢ় স্বরে কথাটা বললো ধ্রুব। চিত্রা ম্লান হাসি হাসলো, হয়তো নিজের উপর ই বিদ্রুপের হাসি হাসছে। “পাথরে যে ফুল ফুটে না”— কথাটা জানা স্বত্তেও ব্যার্থ প্রচেষ্টা। চিত্রা চলে গেলো। ধ্রুব দরজাটা আটকিয়ে দিলো। মেয়েটা বুঝতে চায় না। এতোটা রুঢ় সে হতে চায় না। চিত্রা কতোটা জেদি তার ধারণা ভালো করেই আছে ধ্রুব এর। বড় মামা জানলে তার পিঠ আর পিঠ থাকবে না। একজন এতিম, পরগাছার সাথে কেউ নিজ মেয়ের বিয়ে দিতে চায় না। তেমনটা হলে কি চারুর প্রতি ভালোবাসা ব্যক্ত করতো না ধ্রুব? করতো ঠিক। শুধু নিজের অবস্থানের কথা মনে আসলেই থেমে যায় সে। ফলে ভালোবাসাটা মনের অন্দরমহলেই সঙ্গোপনে আটকে রেখেছে। চারুর সম্মুখে ভুলবশতও আনে নি। বুক চিরে দীর্ঘশ্বাস বের হলো ধ্রুবের। ভালোবাসাটা লাগাম ছাড়া হচ্ছে। যদি সত্যি চারুর বিয়ে হয়ে যায় কিভাবে থাকবে সে! প্রথম ভালোবাসা ভুলে থাকা কি এতোই সহজ! রক্ত মাংসের হৃদয়টা অবুঝ, সব জেনেও বুঝতে চায় না________
****
চারুর ঘুম ভাঙ্গলো খুব ভোরে। পায়ের ব্যাথাটা কম। গোসল সেরেই মাথার কাছের জানালাটা খুলে দিলো। ভেজা চুল নিয়ে বসে আছে সে জানালার কাছে। রোদে চুল শুকাতে ভালোই লাগে। সাথে কানে আসছে বাহিরের কোলাহল। মোড়ের দোকানে মানুষের ভিড় দেখা গেলো। পুরান ঢাকার সকালের নাস্তা সারা ঢাকাতেই বিখ্যাত। চারু আনমনেই তার চুলে বিলি কাটছিলো। এমন সময় দরজায় টোকা পড়লো। তাড়াহুড়ো করে ওড়না ঠিক করলো সে। ধীর গলায় বললো,
“আসো”
চারুকে অবাক করে শ্রাবণ ঢুকলো ঘরে। শ্রাবনকে দেখে দৃষ্টি সরিয়ে নিলো চারু। নীলাভ চোখের পানে চেয়ে থাকা যায় না। এক অজানা টান অনুভুতি হয়, বড্ড বিচিত্র টান। শ্রাবণ এই প্রথম চারুর ঘরে প্রবেশ করেছে, ছোট একটি ঘর। তাতে একটি সিঙ্গেল বিছানা, একটা আলমারী, একটা ছোট টেবিল এবং একটি ড্রেসিং টেবিল। বেশ এটেসেটে ঢোকানো হয়েছে সব আসবাবপত্র। তবে শ্রাবণের দৃষ্টি কাড়লো দেয়ালের অতি চমৎকার আকাউঁকি। অবাক কন্ঠে শ্রাবণ জিজ্ঞেস করলো,
“এই ড্রয়িং তোমার করা?”
চারু লজ্জামিশ্রিত কন্ঠে উত্তর দিলো,
“হু”
“তুমি অনেক সুন্দর আঁকো, তা কি জানো”
চারু মাথা নাড়লো, হ্যা সে জানে। শ্রাবণ একটা চেয়ার টেনে চারুর সামনে বসলো। মোলায়েম স্বরে বললো,
“পায়ে কি ব্যাথা কমেছে?”
“জ্বী”
“সকালে নাস্তা করেছো?”
“জ্বী”
“ঔষধ খেয়েছো?”
“জ্বী”
“আমাকে তোমার ভালো লাগে?”
“জ্বী, জ্বী?”
খানিকটা অপ্রস্তুত হয়ে পড়লো চারু। লজ্জায় শ্যাম গালজোড়া লাল হয়ে উঠলো। শ্রাবণ শব্দ করে হেসে ফেললো চারুর লজ্জায় রাঙ্গা মুখশ্রী দেখে। কোনো মতে হাসি থামিয়ে বললো,
“এতো জ্বী বলছিলে যে হুট করে দুষ্টুমি করতে মন চাইলো। তাড়া নেই চারুলতা। তুমি সময় নাও, শেষমেষ তুমি আমার ই হবে। আজ উঠছি। রাতে ফোন করবো। বড় চাচা তোমার নম্বর দিয়েছে। ফোনটা ধরো। আসি”
বলেই উঠে দাঁড়ায় শ্রাবণ। তখন পেছন থেকে চারুর ধীর স্বর কর্ণপাত হয়,
“সাবধানে থাকবেন”
চারুর কথাটা শ্রাবণের হৃদয়ে এক অজানা শান্তির লহর বয়ে আনে। পেছনে ফিরে বলে,
“তুমি চিন্তা করো না চারুলতা, আমি সাবধানে থাকবো”
“আমি কোনো চিন্তা করছি না। ভদ্রতার খাতিরে বলেছি”
“আমি জানি, তবুও ভালো লাগলো। কারণ, থাক কারণটা উঠানোই থাক। অন্য কখনো বলবো”
শ্রাবণ বেড়িয়ে গেলো। চারু তার যাবার পানে তাকিয়ে রইলো। লোকটা অদ্ভূত, আগুন্তকের মতো মনের অন্দরমহলে ঢুকে পড়েছে। আর চারুর সুসজ্জিত চিন্তাভাবনাগুলোকে কেমন এলোমেলো করে দিলো। নাহিয়ানের শোকে মূর্ছা যাওয়া চারুর মনকে পুনরায় জীবিত করার প্রচেষ্টা করছে যেনো সে। এক সপ্তাহ আগেও নাহিয়ানের চিন্তা মন মস্তিষ্ক ঘিরে ছিলো। অথচ এখন চিন্তাগুলো শ্রাবণমুখর হয়ে উঠেছে। মাথা ঝাকালো চারু, এমন চিন্তাকে প্রশ্রয় দিবে না সে। যেই ভবিষ্যতের কোনো নিশ্চয়তা নেই, সেই ভবিষ্যত নিয়ে ভাবা বোকার কাজ, আরোও একবার সেই শোকের সম্মুখীন হতে চায় না সে। আরোও একবার নিজের জন্য কারোর জীবনের গতিপথের ইতি টানাতে চায় না চারু। চারুর প্রজ্জ্বলিত সকালটা কেমন উদাসীন হয়ে উঠলো। কালো মেঘ ছেয়ে আসলো মনের প্রাঙ্গনে। এই তো বৃষ্টি থামবে, আর ভেসে যাবে আশার বীজগুলো_____
শ্রাবণ বাসায় এসে পৌছালো ঠিক দশটা নাগাদ। বাসায় প্রবেশ করতেই শান্তার সাথে দেখা হলো তার। শান্তার মুখ থমথমে, ভয়ে পাংশুটে হয়ে আছে। শ্রাবণকে দেখেই ছুটে এলো সে। শান্তার উদ্বিগ্ন চেহারা নজরে পড়তেই বিস্মিত কন্ঠে প্রশ্ন করলো শ্রাবণ,
“কি হয়েছে ফুপু?”
“ভাইজান আসছেন, বৈঠক ঘরে বসে আসেন”
“কখন আসছে বাবা?”
“কাল রাতেই। তুমি সময় নষ্ট করো না। তিনি খুব রেগে আসেন”
শ্রাবণ কিয়ৎকাল স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে রইলো। মোস্তফা কামালের সাথে শ্রাবণের সম্পর্কটা ঠিক কেমন তা বর্ণনা করা কঠিন। তারা একে অন্যের সাথে তো থাকে কিন্তু কোথাও একটা বিরুপভাব রয়েছে। এই ফাটলটা তৈরি হয়েছে শ্রাবণের মা রুপার মৃত্যুর পর থেকে। বাবা ছেলের উষ্ণ সম্পর্কটা কেমন যেনো শীতল হয়ে গেছে। শ্রাবণ বাবাকে অসম্মান করে না ঠিক, কিন্তু খুব একটা পছন্দও করে না। বাবার প্রতি তার আচারণ অতি বিচিত্র। শ্রাবন মস্তিষ্কে কথাগুলো সাজালো। তারপর পা বাড়ালো বৈঠকঘরের দিকে।
বৈঠক ঘরে ওকালতির বই খুলে বসে রয়েছেন মোস্তফা কামাল। তার হাতে মোটা চুরুট, চোখে সোনালী ফ্রেমের চশমা। মোস্তফা কামাল পেশায় জজ কোর্টের বিচারক। তার ভাব ই বড় বিচিত্র। এই শহরে তার বেশ দাপট। আজ অবধি কত কত মানুষকে কলমের খোঁচায় শুলে চড়িয়েছেন হিসেব নেই। কিন্তু তার হৃদয় কাঁপে না। বরং তার যদি মনে হয় কেউ দোষী, তাকে শাস্তি না দিলে তার শান্তি হয় না। তিনি চান তার ছেলেও তার মতো হোক, কঠোর বজ্রহৃদয়। সেখানেই বাধে গোল। শ্রাবণের সাথে বাবার এই ব্যাপার গুলোই মিলে না। শ্রাবণ দরজা ঠেলে ভেতরে প্রবেশ করে। ধীর গলায় বলে,
“বাবা আসবো?”
মোস্তফা কামাল বই থেকে মুখ তুলেন, তার চাহনী শীতল। চোয়াল শক্ত। রাশভারী কন্ঠে বললেন,
“এতো বড় সিদ্ধান্ত নেবার সময় আমার অনুমতির প্রয়োজন হয় নি তোমার, অথচ ঘরে প্রবেশ করতে আদিক্ষেতা দেখাচ্ছো…………
চলবে
মুশফিকা রহমান মৈথি