#দূর_দ্বীপবাসিনী
#অন্তিম_পর্ব (প্রথম অংশ)
মুশফিকা রহমান মৈথি
তীক্ষ্ণ স্বরে বিরক্ত হয় শ্রাবণ। চোখ সরিয়ে নিয়ে যায় শিকের দিকে। সেদিকে দেখতেই হৃদয়ে চিনচিনে ব্যাথা অনুভূত হয়। কাঁপা স্বরে বলে,
“চারুলতা, তুমি এসেছো?”
এলোমেলো পায়ে ছুটে এলো সে শিকের কাছে। বিষন্নতায় ঘেরা চোখ গুলো মন ভরে দেখলো ধূসর শাড়ি পরিহিত নারীকে। খোঁপা করে রেখেছে চুলগুলো, চোখগুলো বসে গেছে। শ্যাম মুখখানায় অব্যক্ত বিষাদ হাতছানি দিচ্ছে। কয়দিন ঘুমায় নি হয়তো হিসেব নেই। হয়তো কান্নাকাটি করেছিলো খুব। তবুও স্নিগ্ধ লাগছে তার দূর দ্বীপবাসিনীকে। আবেগপ্রবণ কন্ঠে বললো,
“চারুলতা, কেমন আছো? আমি অপেক্ষায় ছিলাম তোমার”
চারু উত্তর দিলো না। কোর্টে মানুষটির দিকে তাকাতে পারছিলো না সে। ঘৃণার আচ্ছাদনে মৃতপ্রায় ভালোবাসাটা হাহাকার করছিলো। সকালে মোস্তফা কামালের ফোন এসেছিলো। তখন শ্রাবণের খিঁচুনীর কথাটা জানতে পারে৷ পারলো না নিজেকে আটকে রাখতে। সকলের অগোচরে ঠিক ই আসলো এই পাগল মানুষটাকে দেখতে। চারু শিকের ভেতর তার ডানহাতটা গলিয়ে দিলো। ছুলো শ্রাবণের মুর্ছা যাওয়া মুখ। সৌন্দর্য্যগুলো সব যেনো কর্পূরের ন্যায় উড়ে গেছে। চুলগুলো কপালের সামনে অবিন্যস্ত হয়ে পড়ে আছে পরিচর্যাহীন। চারু অনুভব করলো তার চোখ ভিজে এসেছে। বেসামাল কষ্ট হচ্ছে বক্ষস্থলে। শ্রাবণ চোখ বুজে নিলো। দুহাতে চারুর হাতটা চেপে ধরলো। নাক ঘষলো কিছু সময়। কতদিন এই স্পর্শ পায় না তার জানা নেই। আজ যেনো দুঃখী ছেলেটার সুখের দিন। এভাবে কেটে গেলো কিছু সময়। শ্রাবণ তার দূর দ্বীপবাসিনীর হাতে গাল ঠেকিয়ে দাঁড়িয়ে রয়েছে। চারু কাঁপা স্বরে বললো,
“আমাদের গল্পটা এমন না হলেও
পারতো, কি হতো! যদি আর পাঁচ টা গল্পের মতো সাধারণ হতো! কি হতো! যদি এতো লুকোচুরি না থাকতো! কি হতো! যদি গল্পটা দমবন্ধ ভালোবাসার না হতো! কেনো এমনটা হলো বলুন তো!”
শ্রাবণ উত্তর দিলো না। শুধু ফ্যালফ্যাল করে চেয়ে রইলো তার প্রেয়সীর দিকে। নিজের সাফাই গাইতে বলে উঠলো,
“আমি তো সব লুকিয়ে রেখেছিলার চারুলতা, আমি তোমাকে একটা সুন্দর পৃথিবীতে রাখতে চেয়েছিলাম। তোমার বাবাকে কথা দিয়েছিলাম, তোমার জীবনে আলো হয়ে থাকবো। আমার সারাটাজীবন ই অন্ধকার চারুলতা। তবুও তোমাকে আমি রঙ্গিন পৃথিবী দিতে চেয়েছি”
“এভাবে নিষ্ঠুরতার সাথে? মানুষকে মেরে? আমি তো এমন বিশ্রী ভালোবাসা চাই নি শ্রাবণ। কেনো করলেন এমন! গল্পটা অন্যভাবেও শুধু হতেও পারতো”
শ্রাবণ চুপ করে আছে। চারু চোখ মুছে নিলো। এর মাঝে পলাশ হাক দিলো,
“সময় আর পাঁচমিনিট। তাড়াতাড়ি কথা বলেন”
চারু নাক টেনে নিলো। আঁচল দিয়ে মুখ মুছে নিলো। দৃঢ় স্বরে বললো,
“হয়তো এটা আমাদের শেষ দেখা, আফসোস টা সারাজীবন থাকবে। কেনো আমাদের গল্পটা অন্যরকম হলো না! কেনো ভালোবাসাটা স্বচ্ছ হলো না! এই বিশ্রী ভালোবাসা তো আমি চাই নি”
“আমার ভালোবাসা বিশ্রী ছিলো, দমবন্ধকর ছিলো কিন্তু নিষ্ঠুর ছিলো না। আমি নিজেকে উজার করেছি তোমার জন্য৷ অথচ দেনা পাওনায় আমার ঝুলিতে শুধু তোমার ঘৃ/ণা, অবিশ্বাস আর অবহেলাই জুটলো৷ মা বলেছিলো এই রঙধনুর পৃথিবীটা মেকি। আমি বিশ্বাস করতাম না। কারণ আমার পৃথিবীটা তুমি। চারুলতা, আমায় একা করে দিও না। আমি হয়তো এই একাকীত্ব নিতে পারবো না। আমার এই ভালোবাসাও তখন তোমাকে আষ্টেপৃষ্টে থাকবে না। চারুলতা, আমায় একা করে দিও না”
আকুল কন্ঠে কথাটা বললো শ্রাবণ। তার চোখজোড়ায় উত্তাল বিষাদ সিন্ধুর ঢেউ। এখনই বাধ ভেঙ্গে ভাসিয়ে দিবে সব। চারু শিকে মাথা ঠেকালো। শ্রাবণ দুহাতে তার মুখশ্রী আগলে ধরে অনুনয়ের স্বরে বলে,
“আমি ম/রে যাবো চারুলতা। আমাকে শূণ্য করে দিও না”
চারু উত্তর দিলো না। শুধু নিঃশব্দে বিষাদসিন্ধু মুক্তি দিলো। মানুষটাকে ছেড়ে যাবার কথা ভাবতেই চূর্ণ বিচূর্ণ হয়ে যাচ্ছে ভেতরটা। সারাক্ষণ একটি দ্বন্দ চলছে, ভালো খারাপের দ্বন্দ৷ সেদিন হয়তো সে কাঠগড়ায় শ্রাবণের বিরুদ্ধে সাক্ষী দিতো না, যদি বড় চাচী তার হাত ধরে আকুল অনুনয় করতেন। চাচীকে ফিরিয়ে দিতে পারে নি চারু। পরিবার, ভালোবাসার মাঝে পিসছে সে প্রতিটা মূহুর্ত। অস্বীকার তো করতে পারছে না শ্রাবণের পক্ষে সব সম্ভব। একটা ছোট নিঃশ্বাস সন্তপর্ণে গোপন করে বললো,
“আমাকে যেতে হবে শ্রাবণ। আমার সময় শেষ। যদি আপনি নির্দোষ হন, আমাদের দেখা হবে ইনশাআল্লাহ”
“চারুলতা, যেও না”
চারু ঘুরে দাঁড়ালো। চোখ মুছে নিলো। শীতল পা জোড়া বাড়ালো সে। পেছন থেকে আকুল ডাক কানে আসছে। পাগলের মতো চিৎকার করছে সে, “চারুলতা যেও না, প্লিজ। আমি কিছু করি না। আমার ভয় করছে। আমার ভয় করছে”
চারু দাঁড়ালো না। কারণ তার সময় শেষ। ডুকরে কেঁদে উঠলো সে। সে নিরুপায়। সত্যি নিরুপায়। জেল থেকে বার হতেই মুখোমুখি হলো মোস্তফা কামালের সাথে। চারু নজর এড়িয়ে যেতে নিলেই তিনি গম্ভীর কন্ঠে বলে,
“তোমার কাছে কথা আছে, গাড়িতে বসতে পারবে?”
চারু প্রথমে মানা করতে চাইলেও পারলো না। এই প্রথম মোস্তফা কামাল তার সাথে সরাসরি কথা বলছে। অন্য সময়গুলোতে তিনি সর্বদা তাকে এড়িয়ে যায়। জেলের এক কোনায় রাখা সাদা গাড়িতে যেয়ে বসে চারু। মোস্তফা ও তার পাশে বসা। চারু নির্লিপ্ত স্বরে বললো,
“বলুন, কি বলবেন?”
“তুমি শ্রাবণের স্ত্রী৷ তার সম্পর্কে জানার সম্পূর্ণ অধিকার তোমার আছে। তোমার মনে প্রশ্ন জাগে না, মানুষটা এমন কেনো? স্বাভাবিক না কেনো?”
“জাগে, কিন্তু উত্তর কোথায় পাবো?”
“কোর্টে যখন তাকে মানসিক ভারসাম্যহীন প্রমাণে আমরা ব্যাস্ত তখন নিশ্চয়ই তোমার মনে প্রশ্ন জমেছিলো!”
চারু উত্তর দিলো না। মোস্তফা কামাল দৃষ্টি সরিয়ে নিলো জানালার বাহিরে। তার কন্ঠ নরম হলো। গম্ভীর কন্ঠটা কোথায় হারিয়ে গেলো। তিনি বলতে শুরু করলেন,
“আমার আর ইশরার বিয়েটা খুব অদ্ভুত ছিলো। একটা তার্কিশ মেয়ের সাথে একটা বাঙ্গালীর বিয়ে ব্যাপারটা অদ্ভুত। খুব অদ্ভুত। কিন্তু আমাদের বিয়েটা হয়। একটা শান্ত শিষ্ট অর্ধ বাঙ্গালী, অর্ধ তার্কিশ মেয়ের সাথে। ওকে যখন প্রথম দেখেছিলাম ওর নীলাভ চোখের প্রেমে পড়েছিলাম। ওর বাবা ছিলো একটা ক্রি/মি/না/ল। টাকার লোভে মেয়েকে বেঁচে দিতেও দুবার ভাবে নি। সেখান থেকে ওর সাথে আমার দেখা। একজন অবিবাহিত পুরুষের সাথে একজন অবিবাহিত নারীর সহবাস সমাজ তো ভালো চোখে দেখতো না। সেকারণে আমি ওকে বিয়ে করি। আমার বাসায় আসার পর ও ইশরা চুপচাপ থাকতো। মানুষের প্রতি একটা ভয় জন্ম নেয় ওর বুকে। আমি প্রথমে ব্যাপারটা ভাবতাম ট্রমার জন্য এমন। ছেলেবেলাটা তো স্বাভাবিক ছিলো না। কিন্তু ধীরে ধীরে বিরক্ত জন্মালো। ওর অস্বাভাবিক আচারণ, ভীতি, পাগলামি নিয়ে পারছিলাম না। বাসার সবাই বললো, বাচ্চা নিলে ও স্বাভাবিক হবে। আমিও সেটাই করলাম। তখন এই মানসিক রোগটা নেহাত অজুহাত মনে হতো। আমি ভেবেছিলাম সব ঠিক হয়ে যাবে। ভুল ছিলাম। আমাদের কোল আলো করে শ্রাবণ আসে। অবস্থা আরোও খারাপ হতে থাকে। ইশরার মাঝে ভয়ের মাত্রা বাড়ে। তার কাছে মনে হতো তার বিরুদ্ধে পৃথিবী। একটা সময় সে আমাকেও নিজের শত্রু ভাবতে লাগলো। শ্রাবণকে আগলে রাখতে শুরু করলো। তার মনে হতো, আমি তার বাবার মতো শ্রাবণকে অত্যাচার করবো। অবশ্য আমার রাগী, গম্ভীর স্বভাবের ও কৃতিত্ব ছিলো। আমি আমার কোর্ট কাচেরিতে ব্যাস্ত হয়ে পড়লাম। ইশরার দিকে আমার খেয়াল ই থাকলো না। এদিকে ছেলেটাও আমার মা ঘেষা হলো। একদিন রাতে এসে দেখি শ্রাবণের শরীর খুব খারাপ। বমি করে অবস্থা খারাপ। ডাক্তার বললো, তাকে ডেট অভার ঔষধ খাওয়ানো হচ্ছে প্রতিদিন। আমার বুঝতে বাকি রইলো না, এটা কার কাজ! ইশরা ধীরে ধীরে শ্রাবণকে মেরে ফেলার চেষ্টা করছে। আমি ইশরাকে মানসিক ডাক্তার দেখাতে লাগলাম। কয়েকমাস ভালো থাকলো অবশ্য। আমার মনে হলো আমাদের তিনজনের পরিবারটা হয়তো আবার স্বাভাবিক হয়ে উঠলো। কিন্তু ভুল ছিলাম আবারো আমি, এক গোধুলীর বিকালে, আমি বাড়ি ফিরলাম তাড়াতাড়ি। হঠাৎ, দেখলাম সাত বছরের শ্রাবণটাকে নিয়ে ছাদের কর্ণিশে দাঁড়িয়ে আছে ইশরা। আমি পাগলের মতো ছুটে গেলাম। আমি যেতেই দেখলাম ইশরা হাসলে। অপ্রকৃতস্থ, বিচিত্র হাসি। তীক্ষ্ণ স্বরে বললো,
“মোস্তফা, তোমার পৃথিবী ভালো না। আমি আমার ছেলেকে নিয়ে চলে যেতে চাই”
আমি কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে তাকিয়ে রইলাম। জানি না কি হলো তখন, শুধু শ্রাবণকে বাঁচাতেই ছুটলাম। দৌড়ে শ্রাবণকে আগলে ধরতেই দেখলাম, মাটিতে নিথর ইশরা পড়ে আছে। তার মাথার পেছন থেকে রক্ত বের হচ্ছে। আমি নিচে যেতে যেতে অনেক দেরি হয়ে গেলো। আমার সাত বছরের শ্রাবণটা মায়ের বুকে শুয়ে তাকে ডাকলো, সাড়া পেলো না। মৃ/তরা তো সাড়া দেয় না। আমার ছেলেটা এখনো ভুলতে পারে নি সেই ঘটনা। তার ধারণা আমি নিজ হাতে মেরেছি তার মাকে। কারণ আমি চাইলে হয়তো ইশরাকে বাঁচাতে পারতাম। কিন্তু তাকে বাঁচাই নি”
মোস্তফা সাহেবের কন্ঠ দলা পাকিয়ে যাচ্ছে। ক্ষমতাবান মানুষটাকে বড্ড অসহায় লাগলো চারুর কাছে। তার থেকে বড় অসহায় লাগলো নিজেকে। যে মানুষটাকে ভালোবাসার দাবী সে করেছে তাকেই বুঝতে পারলো না। এতোটা কষ্ট নিজের ভেতরে লুকিয়ে রেখেছে অথচ এগুলো কিছুই চারু জানে না। সে শুধু ভালোবাসা নিয়েই গেলো, বিনিময়ে সত্যি শ্রাবণের ঝুলি ফাঁকা। হঠাৎ তার মনে হলো, শান্তা বেগম তার শ্বাশুড়ির মৃত্যুর বর্ণনাটা অন্যরকম দিয়েছিলো। সে সন্দিহান কন্ঠে বললো,
“ফুপি তো অন্য কিছু বলেছিলো”
“এই পৃথিবীর সবাই সেটাই জানে, রোগে মারা গেছে আমার ইশরা। আসলে একজন জজের ওয়াইফ আ/ত্ম/হ/ত্যা করেছে, কথাটা বাহিরে গেলে ভালো হতো না। আমি এবং আমার পরিবার আলোচনার মধ্যমনি হতাম। সব থেকে বেশি আঘাত পেতে হতো শ্রাবণ কে। ওকে আমি স্বাভাবিক জীবন দিতে চেয়েছিলাম। কিন্তু ছেলেটাও তার মার মতোই হলো, ট্রমার স্বীকার। হাই আইকিউ হলেও মানুষটা হলো অন্যরকম। আমার আধারে মোড়া ছেলেটার জীবনে তুমি এলে, আলো হয়ে। তোমাকে অব্যক্তরুপে ভালোবাসতে লাগলো সে। তোমাকে আগলে রাখতে লাগলো। তোমার আশেপাশের খারাপ মানুষদের সরাতে লাগলো। এক দমবন্ধ জালে তোমাকে আটকে রাখতে লাগলো। আমি জানি আমার ছেলেটা খুব খারাপ। কিন্তু তার কেন্দ্র তুমি, আর পৃথিবীটা ঘোরে তোমাকে ঘিরে। আজ আমি তোমাকে এই কথাগুলো বললাম, কারণ তোমার পরিবার তোমাকে শ্রাবণের বিরুদ্ধে ব্যাবহার করছে। তারা জানে শ্রাবণের দূর্বলতা তুমি। তোমার চাচার মৃত্যু খুব কষ্টকর ব্যাপার। কিন্তু সত্যিটা তো তোমার অজানা”
“কোন সত্যি?”
“তোমার চাচাকে খু’ন আমার ছেলে করে নি। বরং তিনি খুন হয়েছেন নিজের দোষে। এক মিনিট”
মোস্তফা কামাল তার মোবাইলে একটা ভিডিও দেখালো। সেটা ভালো করে দেখাতেই হতভম্ব হয়ে গেলো চারু। কাঁপা স্বরে বললো,
“এটাও সম্ভব?”
*******
চারু ফিরলো বিকেলের দিকে। সূর্য তখন পশ্চিমে ঢলে পড়েছে। ক্লান্ত শরীরে বাড়িতে ফিরলো সে। শরীরটা যেনো কেমন করছে, মাথাটা ঘুরছে। অসার লাগছে শরীরটা। মন ই যদি খারাপ থাকে তাহলে শরীরের কি দোষ। তাও মনের বিরুদ্ধে নিজেকে ঠেলে নিলো সে। চিত্রার মুখোমুখি হলো সিড়িতে। চিত্রা চিন্তিত স্বরে বললো,
“কোথায় গিয়েছিলে বুবু? তোকে তো ক্লামত লাগছে”
“একটু পানি দিবি”
“দাঁড়া”
চিত্রা পানি আনতেই দেখে চারুর অসার শরীর লুটিয়ে পড়েছে মেঝেতে। পানির গ্লাসটা রেখেই ছুটে আসে সে। জাহানারা এবং মারুফাও ছুটে আসে। সবাই ডাকতে থাকে,
“চারু, কি হলো মা?”
কিন্তু চারুর হুশ নেই, লুটিয়ে আছে সে মেঝেতে________
*******
পাড়ার কোনার ডাক্তার এলো বাসায়। অনেকক্ষণ পরীক্ষা করলো, অনেক প্রশ্ন ও করলো। অবশেষে বাহিরে এসে বললো,
“অভিনন্দন, চারু মা মা হতে চলেছে। আগামীকাল হাসপাতালে একটা প্রেগ্ন্যাসি টেস্ট করে নিয়েন। তবে আমার ধারণা তার দু-আড়াই মাস চলে। মিষ্টি চাই জাহানারা আফা”
যে কথা শুনে খুশিতে আত্মহারা হবার কথা ছিলো সেই কথা শুনে সবার মুখ গম্ভীর হয়ে গেলো। এক দুশ্চিন্তা ভর করলো সবার মাঝে। এখন কি হবে! এই প্রশ্ন তাদের উদ্বিগ্ন করে তুললো। ভেতরে বসে থাকা চারুর বুকে উথাল-পাতাল করতে লাগলো। ইশ! শ্রাবণ যদি এই কথাটা শুনতে পেতো। আজ সারা পৃথিবী মাথায় করতো সে। হু হু করে উঠলো বুকটা। কেনো এমন হল! কেনো বুঝলো না সে শ্রাবণকে!
*******
গোধূলী লগ্ন, ছাঁদের এক কোনে দাঁড়িয়ে আছে চারু। ব্যস্ত শহরের ক্লান্ত আকাশে তাকিয়ে আছে সে। চুল থেকে পানি পড়ছে সে দিকে খেয়াল নেই তার। এদিকে আঁচল টা উড়ছে মুক্ত সমীরে। সন্তপর্ণে একটা দীর্ঘশ্বাস গোপন করলো সে। তখন ই আগমণ ঘটলো ধ্রুবের,
“কি ভাবলি! বাচ্চাটাকে রাখবি?”
কথাটা শুনতেই চমকে উঠলো চারু। রাগে তার কপালের শিরা ফুলে উঠলো৷ প্রতিবাদী কন্ঠে বললো,
“আমার বাচ্চাকে আমি মারবো কেনো?”
“আমি তা বলি নি, চারু সিঙ্গেল মাদার হওয়া চারটা খানে কথা না”
“কে বলেছে! আমি সিঙ্গেল মাদার হবো! শ্রাবণ আগামীকাল ছাড়া পাবেন। আর পাঁচটা বাচ্চার মতো আমার বাচ্চাও বেড়ে উঠবে”
“কি বলছিস তুই, ও একটা খু/নী”
“আমার শ্রাবণ শুধু প্রেমিক। ও খু/ন করে নি। সেটা কালকেই প্রমাণ হবে। মানুষটা আমাকে ভালোবেসেই সব করেছে। অথচ আমি ই তাকে বিশ্বাস করি নি। আচ্ছা আমরা এমন কেনো ধ্রুব ভাই? ভালোবাসার প্রতিদান দিতে পারি না। আমি আসলেই শ্রাবণের ভালোবাসার যোগ্য নই”
ধ্রুব কি উত্তর দিবে বুঝতে পারছে না। কি উত্তর দিবে চারুকে। চারু পেটটাকে আগলে কাঁদছে। নিজেকে বেশ অপরাধী লাগছে। চারুর ভালো করতে যেয়ে তার সবথেকে বড় ক্ষতিটাই করে দিলো দিলো। ছাঁদের এক কোনায় দাঁড়িয়ে থাকা চিত্রার কর্ণপাত হলো কথাগুলো। যে বুবুকে এতোটা ভালোবেসেছে, সেই বুবুকে এভাবে ভেঙ্গে পড়তে দেখতে ভালো লাগছে না তার। কেনো যেনো, মন থেকে চাইলো সে যেনো সব ঠিক হয়ে যায়। বাবার সত্যিকারের খু/নী শাস্তি পায়। আর বুবু যেনো সুখী হয়। ধ্রুব চলে যাবার পর ও চারু সেখানেই দাঁড়িয়ে রইলো। খুব শূণ্য লাগছে নিজেকে। এতো শূণ্যতার কারণ সে জানে কিন্তু নিরুপায় সে___________
********
সকালে ঘুম ভাঙ্গলো ধরফরিয়ে। অশান্তি লাগছে চারুর। একটা দুঃস্বপ্ন দেখেছে। দেখলো শ্রাবণ আর সে একটা পাহাড়ে চূড়োয় দাঁড়িয়ে আছে। হঠাৎ শ্রাবণ তাকে বললো,
“আমি আর পারছি না চারুলতা। আমি হেরে গেছি। ভালো থেকো আমার দূর দ্বীপবাসিনী। এবার সত্যি দূরে চলে যাচ্ছি”
বলেই হাত ছেড়ে দিলো, আর পড়ে গেলো সুগাঢ় উপত্যাকার মরণ ফাঁদে। স্বপ্নটা দেখতেই লাফিয়ে উঠলো চারু। মনটা কু ডাকছে। কপাল জুড়ে ঘামের কনা, গলা শুকিয়ে এসেছে। হাত বাড়িয়ে পানি নিতেই ফোনটা বেজে উঠলো। এক রাশ বিরক্তি নিয়ে রিসিভ করলো সে। রিসিভ করতেই একটা পুরুষালী কন্ঠ শুনতে পেলো। উদ্বিগ্ন কন্ঠে বলল,
“হ্যালো, আপনি কি মিস্টার জায়ান শাহরিয়ারের স্ত্রী ফাতেমা তুজ জোহরা বলছেন”
“জ্বী বলুন”
“জায়ান শাহরিয়ার শ্রাবণ আ’ত্ম’হ’ত্যা করার চেষ্টা করেছেন..………
চলবে