#দেবী,০১,০২
লেখিকাঃ শবনম রাবাহ (স্রোতস্বিনী)
কপি করা সম্পুর্ণ নিষেধ।
১ঃ
প্রবেশদ্বারের সম্মুখে বড় অক্ষরে লেখা ” সিরাজী মঞ্জিল”। ভিতরে বিশাল এক পুরনো মহল। প্রবেশ পথের ডান পাশে বিশাল ফাকা মাঠের মতো যা সবুজ ঘাসে আবৃত। আর বামপাশে বিশাল বাগান। বাগানের গাছ গুলো দেখেই বোঝা যাচ্ছে বেশ পুরনো। তবে তার মধ্যে রক্তজবা ফুল গুলো বেশি উকি দিচ্ছে।এই সিরাজী মঞ্জিলের ভিতরে যে কেউ প্রবেশ করতে পারে না। অনুমতি নেই বললেই চলে। তবে সাহায্য চেয়ে অনুমতি নিয়ে প্রবেশ করতে পারবে। বয়স ৭০ এর অধিক হবে। বৃদ্ধটি দাড়োয়ান কে বললেন সে সাহায্যের জন্য এসেছে। তাকে অনুমতি দেওয়া হলো। প্রবেশ করল সিরাজী মঞ্জিলে। একজন মহিলাকে বলল, “সিরাজী আব্বা বাড়ি আছেন নি?”
বয়স চল্লিশের বেশি হবে নাম সামিয়া। মহিলাটি বললো, “জি দাদাভাই তো আছে,কি দরকার?”
লোকটি মাথা নিচু করে বললো,”জমির ব্যাপারে কথা আছে। বইলেন করিম খাঁ আইছে। খুব দরকার।”
সামিয়া বললো,”দাড়ান, আমি দাদাভাই কে বলছি।”
________________
দোতলায় বাড়ান্দায় বেতের চেয়ারে বসে পত্রিকা পড়ছিলেন এক পুরুষ।
কালো ফ্রেমের চশমা, শুভ্র রঙা পাঞ্জাবি -পাজামা পরিহিত। চোখের নিচে কালো দাগ যেন কত রাত নিদ্রাহীন। মুখভর্তি সাদা-কালো মিশ্রিত চাপ দাড়ি তবে অধিকাংশই সাদা। মাথার চুলেও পাক ধরেছে বহু বছর। পাশেই টি-টেবিলে রাখা চা। চা প্রায় শেষের দিকে। মনোযোগ দিয়ে পড়ছে পত্রিকা।
সামিয়া ব্যাক্তিটির কাছে এসে বলল,” দাদাভাই, দাদাভাই, করিম খাঁ এসেছে। বললো জমির ব্যাপারে জরূরী কথা আছে।”
পত্রিকা সরালো। চশমা ঠিক করলো। ভারী কন্ঠে শোনা গেল চার শব্দ, ” ইন্তেজার কক্ষে বসতে বলো।”
প্রস্থান নিলেন সামিয়া। আর গিয়ে করিম খাঁকে
বলল, “আপনি আসুন আমার সঙ্গে।”
করিম খাঁ সামিয়াকে অনুসরণ করে গিয়ে বসলো এবং অপেক্ষা করতে থাকলো।
আগমন হলো উক্ত পুরুষটির। তাকে দেখে করীম খাঁ বললো- “আসসালামু আলাইকুম সিরাজী আব্বা।”
–“ওয়া আলাইকুমুস সালাম,, কি সাহায্য চাই বলুন?”
করিম খাঁ বললো,”আজ্ঞে,আমি আমার দখীন ভিটের পিছনের জমিখানা বেইচপার চাই,,,আপনি কিনলে আমার বড়ই উপকার হইতো।দলিল নিয়া আইছি।”
ভারী কন্ঠস্বরে বললো,”আপনার প্রিয় জমি সেচ্ছায় বিক্রি করবেন।নিশ্চয় কোনো কারণ আছে।”
করিমা খাঁ অপ্রস্তুত ভঙ্গিতে বলল, “না মানে আসলে হ্যাঁ সিরাজী আব্বা হে কথা ঠিক ই।”
–“শুনলাম মেয়েকে নাকি মেডিকেলে ভর্তি করাবেন।”
করিম খাঁ মেকি হাসি দিয়ে বলে উঠলো,” জি মাইয়ার স্বপ্ন ডাক্তার হবো তাই আর কি।”
–“ভালো, কত টাকা চাই?”
করিম খাঁ বললো, “৫০ হাজার টাকা দিলে দিয়া দিমু দলিল।”
–“আপনার জমি আমি ৫১ হাজার দিয়ে কিনবো কেননা আপনার মেয়েকে ডাক্তার বানানোর জন্যই বিক্রি করছেন আপনি।শুনে খুশি হয়েছি আমি।”
করিম খাঁর খুশিতে চোখ চিকচিক করে উঠলো। বলল, “সত্যিই,,আপনে ধন্য আব্বা। সত্যিই মহান।শুকরিয়া। তয় আপনে হুনলেন কেমনে?”
–”সিরাজপুরের প্রত্যেক টা পাতা পড়ার খবর ও ‘রুহুল সিরাজীর’ কানে সবার আগে আসে। সে যাইহোক আপনার চিন্তা উত্তম। মেয়েকে ডাক্তার বানাতে চান। বকুল, বকুল ৫১ হাজার টাকা নিয়ে আয়।”
শাল গায়ে দিয়ে বকুল নামের ভদ্রলোকটি এলো। টাকা দিলো করিমা খাঁকে। রুহুলের হাতে দলিল দিয়ে টাকা নিয়ে বিদায় হলো করিম খাঁ।
দলিল হাতে রুহুল নিজের একান্ত কক্ষে প্রবেশ করলো। গুপ্ত সিন্দুক খোলার পর দলিল রাখতে যাবে ওমনি দেখলো ভিতরে ছোট ছোট কাগজের টুকরো। হয়ত ইঁদুর কেটেছে। তাই সকল দরকারি কাগজ পত্র, দলিল বের করে পরিষ্কার করতে শুরু করলো। সব পরিষ্কার করে সিন্দুকে অনেকগুলো দলিলসহ সকল দরকারি কাগজ রেখে সিন্দুক তালাবদ্ধ করলো। সেখান থেকে প্রস্থান নেবে ওমনি চোখ গেলো নিচে পড়ে থাকা মুড়ানো কাগজে। রুহুল সিরাজী হাতে নিল। খুলে দেখবে ওমনি চিৎকার শুনতে পেলো। ভাংচুরের আওয়াজ ও হচ্ছে। তাই সে মুড়ানো বস্তুটি টেবিলের উপর রেখেই চলে গেলো।
বাইরে বেরিয়ে সে দেখলো ভাংচুর করছে মানসিক ভাবে ভারসাম্যহীন এক নারী। সামিয়া আর সাথে কাজের মহিলা নিলু দুজনে ধরে নিয়ে গেলো। উপরে দাঁড়িয়ে দেখছিল রুহুল সিরাজী।
সামিয়া রুহুলকে দেখে বললো,” চিন্তা করবেন না দাদাভাই, আমি শান্ত করে দিবো। ঠিক হয়ে যাবে।”
রুহুল মনে মনে ভাবতে লাগলো আদোও কি ঠিক হবে।ঠিক হবার হলে তো বহুবছর আগেই হতো।সে দীর্ঘশ্বাস ফেলে বেরিয়ে গেলো সিরাজী মঞ্জিল থেকে।
_________________
সারাদিনের ক্লান্তি শেষে রাতে যখন বিছানায় গা এলিয়ে দিলো রুহুল সিরাজী। হঠাৎ রুহুলের মনে পড়লো বিকেলের কথা। টেবিলের উপর রাখা মুড়ানো বস্তুটির। অন্ধকার কক্ষে টেবিলের কাছে গিয়ে বাতি জ্বালালো। চেয়ারে বসে টেবিলের উপর রাখা মুড়ানো বস্তুটি খুললো। খুলতেই চোখ আটকে গেলো রুহুলের। তার হৃদয়ের গতি যেন থমকে গেলো। তার দম বন্ধ হয়ে যাওয়ার উপক্রম হলো।চোখে পড়ল পেন্সিলে অঙ্কিত চিত্রে।মুখ থেকে অস্পষ্ট উচ্চারণ হলো “দেবী!”
মনে পড়ে গেলো সেই ভয়ংকর অতীত যা তার হৃদপিন্ড ক্ষতবিক্ষত করেছিল বহু বছর আগে। যা সে ভুলে ও ভুলে যেতে পারছে না আজ ও। দিনে সকল ব্যস্ততায় মনে না পড়লেও তার ক্ষতবিক্ষত হৃদপিণ্ড তে রাতের আধারে ব্যাথা অনুভব হয়। ‘দেবী’ সে যে তার হৃদয় পথের স্বচ্ছ আকাশে একরাশ কালো মেঘ ছড়িয়ে হারিয়ে গিয়েছিল নিমিষেই।
__________________
অতীতঃ-
এক বয়স্ক মহিলা লাঠিতে ভড় করে দাঁড়িয়ে আছে। অনুরোধের সুরে বলছে,” দাদা রে, তুই থাইকা যা,, যাইস না। তর দাদাজানে কত্ত কইরা কইতাছে যাইস না। বড়গো কতা হুনা লাগে মানিক আমার।”
বলিষ্ঠ দেহের লম্বা উজ্জ্বল শ্যাম বর্ণের সুপুরুষ যার নাম রুহুল সিরাজী। দাদিমার অনুরোধ কে অবজ্ঞা করে বলল,”না দাদিমা, আমাকে যেতেই হবে। গত মাসেই চলে যেতাম যদি মতি ওর বোনের বিয়েতে আটকিয়ে না রাখতো। আক্কাস যদি গন্ডগোল শুরু করে এই ভয়ে মতি আমাকে যেতে দেয়নি। তা না হলে চলেই যেতাম।”
দাদিমা মাথায় হাত বুলাতে বুলাতে বললো,”বিদেশ যাইয়া হুদাই এত্ত লেখাপড়া কইরা কি হইবো। তর দাদাজান কি পড়ছে। হে কি সব সামালায় তাছে না?”
রুহুল দাদির হাত মাথা থেকে সরিয়ে দুহাতের মুঠোয় নিয়ে বললো,” আবার শুরু করলেন আপনি। গত মাসে যে কেন ওই আক্কাসের সাথে ঝামেলা করলাম। না করলেই ভালো হতো। অন্তত এতদিন বিদেশে শান্তিতে থাকতাম।”
অমায়িক হাসি দিয়ে এক কিশোরী কন্যা। বলে উঠলো,”দাদাভাই,আপনে যে মা’ইর ডা দিছেন ওই আক্কাসরে। ও আর কোনোদিন কোনো মাইয়ার হাত ধরবো না। আর মিতারে তো বিয়া ও করবার চাইছিল। আপনি ভালো পোলা খুইজা বিয়া দিয়া দিলেন। এখুন তো আরো কষ্টে পাগল হইয়া গেছে। হিহিহি।”
দাদিমা এবার রেগে বললো,” এই সামিয়া, চপ তুই ছেড়ি। খালি ফটর ফটর। মানিক আমার, তুই পাগলামি বাদ দে। তর ছুটো দুইডা ভাই আছে ওরা তো তর মতো লেখাপড়া করবার চায় না। ওরা কিন্তু আমার কথা শুনে। আর তর দাদাজানের নিষেধ অমান্য করলে কি হবো জানোসই তো। ”
রুহুল এবার জোড়ালো কন্ঠে বলল,” না দাদিমা আমাকে যেতেই হবে। দাদাজান কে বুঝান না আপনারা। আমার অনেক স্বপ্ন আছ..
রুহুলের পুরো কথা সম্পুর্ণ করার সুযোগ না
দিয়েই একজন বললেন,, ” তোমারে বাধা দেওয়ার লোক এখুনো জীবিত। ‘দুলাল সিরাজী’ এখনো মরে নাই। সে যখন কইছে তুমি যাইবা না তার মানে তুমি কোথাও যাইবা না।”
মাথা নিচু করে দাড়িয়ে আছে সবাই। কারো সাহস নেই কথা বলার। কারণ স্বয়ং দুলাল সিরাজী সামনে দাড়িয়ে। সবাই ভয় পেলেও রুহুল পেলো না। সে বললো,”কিন্তু দাদাজান আপনি আমায় কথা দিয়ে…”
দুলাল সিরাজী রুহুলের দিকে তাকিয়ে বললো,”চুপ কুনু কথা না,,আমি যখন কইছি তার মানে যাইবা না। এইডাই আমার শেষ সিদ্ধান্ত। ”
–“কিন্তু দাদাজান..”
–“চুপ করো। আসরের সালাত কায়েম কইরা তুমি আমার সাথে মহিলাশালায় যাইবা। নতুন ঘর খারা করছি। সামনে জুম্মায় মিলাদ দিমু। তুমি সাথে যাইবা কোন টালবাহানা শুনবার চাই না।”
রুহুল এর বলার কোনো কিছু নেই আর। নিরুপায় হয়ে বললো,”জি দাদাজান।”
_________________
বিকেলে মহিলাশালায় প্রবেশ করলো দুলাল
সিরাজী ও রুহুল সিরাজী।
রাজমিস্ত্রীরা তাদের দেখে বললো,”আসসালামু আলাইকুম সিরাজী আব্বা, রুহুল সাব কেমন আছেন”
দুলাল সালামের উত্তর নিলেন,”ওয়া আলাইকুমুস সালাম।”
রুহুল বললো,”ভালো, তোমাদের কাজ কত দূর?”
–”জি কেবল তো শুরু ধীরে ধীরে শেষ হইবো।”
দুলাল কাজ দেখে বললেন,”ঠিক আছে,,,তয় এই বছরের মধ্যেই কাম শেষ চাই।”
–”জি সিরাজী আব্বা আপনে চিন্তা করিয়েন না।”
দুলাল সিরাজী এবার একজন নারী কে ডাকলেন,
“ফাতিমা, ফাতিমা”
দুলালের ডাকে ফাতিমা দ্রুত হাজির হলো। বলল,”জি, আসলামু আলাইকুম সিরাজী আব্বা।”
দুলাল বলল,” হু, কি অবস্থা তোমার?”
–“জি আব্বা ভালো। ”
–“কাকন রে যাইয়া কও আমার জন্য পান আনাই তে। কয়দিন হইলো ওর হাতের পান খাই না। ও কি সুস্থ হয় নাই।”
ফাতিমা মাথা নেড়ে বললেন,”জি না, মাইয়াডার জ্বর সারে নাই তয় কমছে।”
দুলাল বললেন, ” ওহ ঠিক আছে। বেধি হইলে একখান ডাক্তার দেহাইয়ো। ”
–”জি” বলে চলে গেলো ফাতিমা।
রুহুল বাম বাশের পুরোনো দালান টায় চোখ বুলালো। এক দীর্ঘশ্বাস ছাড়লো। বললো,” দাদাজান, একটা কথা ছিল। আবার নতুন করে দালান দিচ্ছেন কেন?”
দুলাল বললো,”সিরাজপুরের ভালোর জন্য আমি সবই করতে পারি। গ্রামের মাইয়াগো শিক্ষার প্রয়োজন। ওরা যে ঘর গুলাতে থাকে ওইগুলা মজবুত না। তাই ওগো জন্যে নতুন কইরা দালান করতাছি। তুমি যে কয়দিন পারো আমার লগে এইখানে আসবা।”
রুহুল দাদার কথায় সম্মতি জানালো আর বললো, “জি দাদাজান। কিন্তু বামপাশের দালান এর কাজ কি আর কোনোদিনও হবে না?”
দুলাল বামপাশে চেয়ে বললো,” না, যে কাজের জন্য এত বড় দুর্ঘটনা হইলো হেইডা আর করমু না।”
রুহুল দাদাজানকে বললো,” সব ই আল্লাহর ইচ্ছা, তবে সামনের মাসে আবার শহরে হাসপাতাল থেকে ডাক্তার আনবো আমি।”
–“হ্যাঁ,, আনিও। তুমি কাম গুলা দেইখা বাদ মাগরিব আইসো। আমি যাই হাজীরে দেইখা আসি। হে তো বিছনায় পইড়া গেছে। বড্ড ভালো মানুষ আছিলো। আমি যাই।”
রুহুল সায় জানালো।চেয়ে রইলো অসমাপ্ত দালানের দিকে।
চলবে,,,,,,,,,,
শবনম রাবাহ ✍️
#দেবী
লেখিকাঃ শবনম রাবাহ (স্রোতস্বিনী)
কপি করা সম্পুর্ন নিষেধ
২ঃ
বহুদিন পর এই মহিলাশালায় এসেছিল রুহুল। এখানেই প্রায় সন্ধ্যা হয়ে গেছে। তাই রুহুল বাড়ির উদ্দেশ্যে বের হলো। রাস্তায় দেখা হলো আক্কাস আলীর সাথে। রুহুল দেখেও চলে যেতে চাইলো কিন্তু আক্কাস পথ আটকিয়ে বললো, ” দাড়াও মিয়া, কাম ডা তুমি ঠিক করলা না। মানলাম তুমি সিরাজী বংশের পোলা কিন্তু তাই বইলা আমার পছন্দ করা মাইয়ারে অন্য জায়গায় বিয়া দিয়া ঠিক করলা না। আমি মিতুরে ভালোবাসতাম। আমার গায়ে হাত তুলছো, গেরামের পঞ্চায়েতের সামনে অপমান করছো তাও কিছু কই নাই কিন্তু ওরে অন্য শহরে বিয়া দিয়া কামডা ঠিক করলা না রুহুল সিরাজী।”
রুহুল গম্ভীর ভাবে চোখে চোখ রাখলো।বললো,”ভুলে যেও না কার সাথে কথা বলছো। আর নিজের বয়স দেখেছো। মিতুর বয়স ১৪ আর তোমার বয়স ৩৮। লজ্জা করে না ওই বয়সি মেয়েকে বিয়ে করতে চাও। আর তারচেয়েও বড় কথা তোমার চরিত্র সম্পর্কে আমরা সিরাজপুর বাসীরা সবাই অবগত।”
আক্কাস বললো, ” হের, ওইগুলা বাদ দেও। পুরুষ মানুষ একটু আকটু ওগুলা কইরাই থাকে। তাই বইলা কি বিয়া দেওন যাইতো না। পুরুষ মানুষের বয়স কুনু বিষয় হইল।”
রুহুল বাকা হেসে বললো, ” তুমি পুরুষ নও বলেই তো এখনো বিয়ে হয়নি।পুরুষ হলে তো অনেক আগেই বিয়ে করতে।” বলেই আক্কাসকে এড়িয়ে চলে গেলো রুহুল।
আক্কাস রুহুলের যাওয়ার পানে চেয়ে রইলো তারপর বললো,”রুহুল সিরাজী তর তেল কমাইয়া ছাড়মু আমি। সব কিছুর প্রতিশোধ নিয়াই ছাড়ুম।”
আক্কাস আলী গ্রামের মধ্যবিত্ত শ্রেণির লোকদের মধ্যেই পড়ে তাদের পরিবার। ১৪ বছর বয়সি মিতুকে বিরক্ত করতো। বিয়ে করতে চাইতো। অনেক বার বিচার করা হলেও আক্কাস থেমে থাকেনি। মেয়েটাকে সেদিন হাত টেনে ধরেছিল বিদ্যালয় থেকে আসার সময়। সেটা দেখার পর রুহুল আক্কাসকে মা’র দিয়েছিল।পঞ্চায়েতে বিচার করা হয়েছিল। আক্কাসকে নানাভাবে অপমান করা হয় গ্রামবাসীর সামনে।
____________________
সিরাজী মহিলাশালার অন্দর কক্ষে এক পঞ্চাদশী কন্যা বিছানায় কাথা গায়ে জড়িয়ে শুয়ে আছে। ফাতিমা বিছানার কাছে যেয়ে ডাকলো, “কাকন, এই কাকন তর জ্বর ঠিক হইছে? ”
কাকন কাথা থেকে মুখ বের করলো। জিহবা দ্বারা ঠোঁট ভিজিয়ে আস্তে আস্তে বললো,”জি আপা, আগের চেয়ে ভালো।”
ফাতিমা কাকনের কপালে হাত দিয়ে তাপ দেখলো। তারপর বললো,” সিরাজী আব্বা আজকেও তর কথা জিগাইলো। তর হাতের পান তার এত ভালো লাগে যে তর এত কদর করে।”
কাকন উচ্চস্বরে হাসি দিলো,”হাহাহা,,”
ফাতিমা অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলো “হাসোস কেন,, জ্বর এর ঘোরে কি পাগল হইলি নাকি? ”
কাকন ফাতিমার দিকে চেয়ে বললো,” খুশি তে, এই যে উনি আমার খোজ নিচ্ছে, শুনে অনেক ভালো লাগলো আপা,,অনেক ভালো।”
ফাতিমা কাকনের গাল আলতো করে টেনে বলল,
” পাগলি একখান মাইয়া, হইছে এখন জলদি ওঠ, খায়া নে। দুপুরেও খাস নাই।”
–“আচ্ছা খাবো তবে একটু পর।”
–“তর একটু মানে ম্যালা দেরি। ওঠ এক্ষুনি উঠবি”
কাকন উঠে বসলো জ্বরে শরীর খুব ব্যাথা। বসন্তকাল শেষের দিকে। তবুও কোকিলের ডাক শুনতে পেলো কাকন। ডাকটা শুনতেই কাকন ও উচ্চারণ করলো, “কুউউ”
_______________________
সিরাজী মঞ্জিল এর নিচ তলায় একটি কক্ষে বিছানায় শুয়ে আছে বিলাল সিরাজী। সম্পর্কে দুলাল সিরাজীর জেষ্ঠ্য পুত্র এবং রুহুল সিরাজীর আব্বা।
রুহুল তার বাবার কক্ষে প্রবেশ করলো। বাবার হাত স্পর্শ করে বললো,” আপনি কবে ভালো হবেন আব্বা? এভাবে শুধু চেয়ে চেয়ে দেখেন, আমাদের সাথে কি কথা বলতে ইচ্ছে করে না। আম্মা, ছোট আম্মা আপনার জন্য আর কত অপেক্ষা করবে আব্বা।আপনি কি আর আগের মতো হবেন না, আমার সাথে দাবা খেলবেন না,,পাঞ্জা লড়বেন না , বলবেন না খোকা চল আজ দুজন দৌড় দিয়া দেখি কে জেতে। এই বাড়িতে আপনাকে যদি এভাবে দেখি আমার আর থাকতে ইচ্ছে করে না।সত্যি বলছি এই বার গেলে আমি আর আসবো না।”
রুহুলের মা সুভা রুহুলের কাধে হাত রেখে বললো, “খোকা!”
রুহুল জবাব দিলো,” জি আম্মা,বলেন!”
সুভা জলসিক্ত নয়নে বললো,”তুই ও আমাকে ছেড়ে চলে যাবি? তুই ছাড়া তো আমার কেউ নেই।”
রুহুল মায়ের দিকে ফিরে বললো, ” কাদবেন না আম্মা।আমি আপনাকে কখনো ছাড়বো না।আমি যেখানেই থাকি আমি আপনাতেই থাকব।আর আব্বা ও ভালো হবে। আবার আগের মতো হবে। আগামী সপ্তাহে ডাক্তার নিয়ে আসবো আমি।”
দরজার কাছে এসে ডাক পড়লো রুহুলের। রুহুলের ছোটভাই হেলাল এলো। তবে আপন নয় সৎভাই তার বাবার দ্বিতীয় পক্ষের ছেলে।
হেলাল বললো, ” দাদাভাই, দাদাজান ডাকে আপনারে।”
রুহুল উঠে দাঁড়িয়ে বললো,”যা আমি আসছি।”
তারপর সুভাকে বলল,” আম্মা আমি যাচ্ছি। আর কান্না থামান। আমি ডাক্তার আনবো শহর থেকে। নিশ্চয়ই আব্বা ভালো হবে।”
রুহুল চলে গেলো তবে সুভার কান্না থামলো না। স্বামীর দিকে চেয়ে মনে মনে আওড়ালো আদোও ভালো হবে তো।
____________________
বসার ঘরে বসে আছে দুলাল সিরাজী। রুহুল দাদার কাছে গিয়ে বললো,”দাদাজান ডেকেছেন?”
দুলাল সিরাজী বললেন,”হ্যাঁ, রুহুল,,কতকাল আর আমি এগুলা দেখমু। ভাবছিলাম তোমার আব্বার হাতে সব দিমু কিন্তু তার আগেই তোমার আব্বা শয্যাশায়ী হয়া গেলো। আমার বংশে তুমি ছাড়া আর কোনো যোগ্য ব্যক্তিরে দেখি না। আমি চাই তুমি সামনের শীতে সকল দায়িত্ব কাধে নেও।”
রুহুল বাধা দিয়ে বলল,”দাদাজান আমি এগুলো চাই না। আমি আমার মতো নিজে কিছু করতে চাই।”
–“যেইডা আছে হেইডা কইরা কি হইবো। বিদেশ যাওয়ার কথা বাদ দেও। তোমার আম্মার কথাডাও ভাইবো। তার শেষ আশা ভরসা কিন্তু তুমি। ”
রুহুল কিছুক্ষণ নিরব থাকলো। ভাবলো তার আর এখন কোনো রাস্তা নেই। বড় ছেলে হওয়াতে তাকেই এখম সকল দায়-দায়িত্ব নিতে হবে। এছাড়া সেই তার আম্মার শেষ ভরসা। তাই বললো, “আপনি যা বলবেন তাই হবে দাদাজান।”
দুলাল নিশ্চিন্তে বললো,”আমি জানতাম তুমি রাজি হইবা। তোমার উপর আমার আস্থা সবচেয়ে বেশি রুহুল। সিরাজী বংশে তোমার মতো বিবেক বুদ্ধি সম্পুন্ন পোলা আর নাই।”
রুহুল বললো,” নিশ্চিন্তে থাকুন আপনার আস্থা বিফল হবে না দাদাজান।”
________________
সিরাজপুর জেলার সবচেয়ে ধনি ব্যক্তি দুলাল সিরাজী কারণ সে এখানকার পুর্বের জমিদার বংশের। পুর্বপুরুষদের আমলে অনেক বড় জমিদারি ছিল তাদের। ইংরেজ আমলে পশ্চিম বাংলায় বাণিজ্য করতো। সেখানেও গিড়েছিল নিজেদের রাজত্ব।কিন্তু পশ্চিম বাংলার লোকেরা বেইমানি করেছিল।পশ্চিম বাংলায় তাদের গড়া সবকিছু আত্মসাৎ করে নিয়েছিল। দুলাল সিরাজীর বাবা জহুরুল সিরাজী এ নিয়ে খুব আফসোস করতেন যদিও নিজ দেশের সব আছে তবুও সে আফসোস করতেন। সিরাজীপুরে তাদের বংশীয় জমিদারিত্ব আজও টিকে আছে। সিরাজপুরে মুলত তাকেই সিরাজী আব্বা বলে সম্ভোধন করা হয় যাকে সিরাজী বংশের প্রধান হিসেবে দায়িত্ব দেওয়া হয়। পুর্ব পুরুষদের যুগ থেকেই চলে আসছে। দুলাল সিরাজীর ২ ছেলে ১ মেয়ে। বড় ছেলে বিলাল সিরাজী। তার সন্তান রুহুল সিরাজী আর প্রথম স্ত্রী সুভা। বিলালের ২য় স্ত্রী মালেকা তার ১ ছেলে ২ মেয়ে। রুহুল এর সৎ ভাই বোন এর নাম হেলাল,বোনেরা আলেয়া, সামিয়া। আলেয়ার বিয়ে হয়েছে। স্বামী সরকারি চাকরি করে। তাই ঢাকায় থাকে। অন্যদিকে রুহুলের চাচা জামাল সিরাজীও ২টা বিয়ে করেছিল কিন্তু এখন কেবল একজন স্ত্রীই আছে। প্রথমজন মা’রা গিয়েছিল। জামালের প্রথম পক্ষের কোনো সন্তান নেই। বিয়ের ৬মাস পরেই স্ত্রী মা’রা যায়। ২য় পক্ষে স্ত্রী জাহানার একছেলে এক মেয়ে আছে । মেয়ে রোকেয়ার বিয়ে হয়েছে। স্বামী নিয়ে শশূড় বাড়ি থাকে। জামালের একমাত্র ছেলে মহীবুল। হেলাল আর মহীবুল সমবয়সী।
______________________
সিরাজপুরে গ্রামে বিদ্যালয়, মাদ্রাসা, মসজিদ, হাসপাতাল সবকিছুতেই সিরাজীদের কৃতিত্ব। ছেলেমেয়েদের আলাদা শিক্ষার ব্যবস্থা। পুরুষদের জন্য সিরাজী পাঠশালা। আর মেয়েদের জন্য সিরাজী মহিলা পাঠশালা। সেখানে কেবল মহিলারা পড়ে। আর সেখানেই এতিম মেয়েদের জন্য থাকার ব্যবস্থা ও আছে সেটা হলো সিরাজী মহিলাশালা। সকল খরচ বহন করে সিরাজী পরিবার। আর যাদের পরিবার আছে তারা সেখানে পড়াশোনা করতে পারে কিন্তু পরিবারের সঙ্গেই থাকে। আশেপাশের গ্রাম-গঞ্জের এতিম ছেলেমেয়েরা সুযোগ পায় সেখানে থাকার।
ফজর নামাজ পড়ে কুরআন পড়ছে পঞ্চদশী কন্যা কাকন। সমুধুর কন্ঠ যেন হৃদয় শীতল হয়ে যায়।
ফাতিমা কাছে এসে বলল,”কাকন, ও কাকন ,,তর শরীর ভালো হইছে।”
কাকন কুরআন পড়া শেষে বললো,” জি আপা,
আলহামদুলিল্লাহ আগের চেয়ে অনেক ভালো।”
–“যাইক শুকরয়া আল্লাহ তরে সুস্থ করছে। শুন আইজ তো মিলাদ আছে জুম্মার নামাজ পর। তোবারক বিলাইবো মনে হয়।”
–“কিসের মিলাদ আপা?”
–“আরে নতুন দালান খাড়া করছে দুয়া না পড়াইলে কি হয়। আগের বার যত বড় অঘটন ঘইটা গেলো। এইবার কারটা ভালো ভালোই হইলে হলো।”
কাকন কুরআন বন্ধ করতে করতে বললো, “আল্লাহর উপর বিশ্বাস রাখেন আপা। আমার মন থেকে বলছে সব ভালো হবে।”
ফাতিমা হেসে বললো,” হুম তাই যেন হয়। তয় তোবারক দেওয়ার সময় তরে কিন্তু আমার সাথে থাকতে হইবো।”
–“আচ্ছা থাকবো আপা।”
‘কাকন’ নাম সুন্দর না হলেও তার রূপ এবং গুণ অনন্য। বাবা-মা ছাড়া কাকন অন্যান্য এতিম মেয়েদের মতোই এই মহিলাশালায় থাকে। দুনিয়ায় আপন বলতে কাকন কেবল ফাতিমাকেই চেনে। নিমতলির পানিতে যখন জ্ঞানহীন অবস্থায় পড়ে ছিল তখন কিছুলোক উদ্ধার করে হাসপাতালে ভর্তি করে। তারপর কাকন কে সিরাজপুরের মহিলাশালায় দিয়ে গিয়েছিল। পিতা-মাতাহীন কাকন এর মহিলাশালাই ঠিকানা।
ফাতিমা চলে গেলে কাকন ঘরের জানালার কাছে গিয়ে বসলো। এটা তার সবচেয়ে প্রিয় জায়গা মেখান থেকে চোখ দিলে কেবল সবুজ আর সবুজ দেখা যায়। সবুজ শ্যামল প্রকৃতি দেখতে কাকনের বেশ ভালো লাগে। কাকন তাকিয়ে রইলো আকাশে উড়ন্ত পাখির দিকে কি সুন্দর উড়ছে। কাকন ভাবলো সে যদি পাখি হতো কতই না ভালো হতো। মানুষ হয়ে জন্মানোর চেয়ে পাখি হয়ে জন্মানো ভালো। অন্তত মুক্ত আকাশে উড়তে পারতো। যেখানে খুশি ঘুরে বেড়াতো। ইশ জীবনে একবার যদি পাখি হওয়ার সাধ পুরণ হতো?
চলবে……..
শবনম রাবাহ ✍️