#দেবী,০৩,০৪
লেখিকাঃ শবনম রাবাহ (স্রোতস্বিনী)
কপি করা সম্পুর্ন নিষেধ।
৩ঃ
জুম্মার নামাজ পর মসজিদের পাশেই পুরুষ মাদ্রাসার বড় হুজুর দ্বারা মিলাদ পড়ানো হলো। এক লম্বা মোনাজাত করে দুয়া পড়ানো হলো।মিলাদ এ মাদ্রাসার জন্য তোবারক এর ব্যবস্থা করা হয়েছে। যেগুলো ছেলেমেয়ে উভয়ের জন্য।মহিলাশালার জন্য যে তোবারক সেগুলো এখন চাকর লতিফ নিয়ে যাবে। দুলাল সিরাজী লতিফকে বলল,”সব ঠিক ঠাক মতো ফাতিমার হাতে দিবি। ”
লতিফ ফোকলা দাঁত বের করে হেসে হেসে স্বীকার করলো, “জি সিরাজী আব্বা।”
দুলাল সিরাজী চোখ মুখ খিচে বললো, “এই তর হাসি থামা। কথা কইলেই হাসোস যে কাম দিছি ঠিকঠাক করবি। এখুন যা। ”
–“আইচ্ছা। ”
দূর হতে রুহুল দেখছিল। এগিয়ে এসে শুধালো, “কি হয়েছে দাদাজান?”
–“ওই কিছু না। মহিলাশালায় ও তোবারক নিয়া যাইবো। তাই সবকিছু বুঝায়া দিলাম।”
–“ওহহ, লতিফ নিয়ে যেতে পারবি একলা?”
লতিফ আথা নিচু করে ফেললো। বলল,”একলা মানুষ এত গুলান একটু কষ্ট হইতো। কেউ সাথে গেলে উপুকার হইতো দাদাভাই।”
রুহুল বলল,”চল আমি নিয়ে যাবো সাথে। ”
–“আপনে? ”
–“হ্যাঁ আমি কেন সমস্যা? ”
–“আপনে কেন কাম করবেন?”
দুলাল সিরাজী বাধা দিয়ে বললো, “না রুহুল তুমি কেন দরকার হইলে অন্য কেউ যাইবো। তোমার এইসব কাম মানায় না। ”
–“না দাদাজান আমিই যাবো। কাজ করলে কেউ কখনো ছোট হয়ে যায় না। লতফ চল আমি যাচ্ছি তর সাথে। ”
এরপর রুহুল লতিফের সাথে চললো মহিলাশালার উদ্দেশ্যে।
__________________
মাথায় কাপড় দিয়ে মহিলাশালার প্রবেশদ্বারের কাছে অপেক্ষা করছে কাকন এবং ফাতিমা।মিনিট চারেক পরেই রুহুলের ডাক শুনতে পেলো ফাতিমা। ফাতিমা
মহিলাশালা থেকে বের হয়ে রুহলের সম্মুখে গেলো।
রুহুল ফাতিমাকে দেখেই বললো,” আপা, তোবারক গুলো নিয়ে যান। সবাইকে ভাগ করে দিয়ে দিবেন।”
ফাতিমা মাথার কাপড় ঠিক করতে করতে বললো, “জি,,আপনে চিন্তা কইরেন না।”
রুহুল এবার ভেবে বলল,”আপনি কি পারবেন একা একা। যদি না পারেন লতিফ আপনাকে পৌছে দিক?”
–“না, আমি একা না আমার লগে কাকন আছে। কিরে কাকন আয় বাইরে আয়।”
প্রবেশদ্বারের আড়াল থেকে বেরিয়ে এলো কাকন। পরপুরুষের সামনে এভাবে আসতে লজ্জা করছিল তার খুব। সদ্য ফোটা শাপলার মতো তার স্বচ্ছতা। মাথায় সাদা রঙের ওড়নায় ঘোমটা দেওয়া। মাথা নিচু করে বেরিয়ে এলো। কাকনের দিকে চোখ তুলতেই রুহুলের মনে যেন অন্যরকম শিহরণ বয়ে গেলো।সিরাজপুরে এই সুন্দর তরুণী ছিল আর সে জানতো না। এত কাছে থেকে এমন টানা টানা চোখ, অপরুপ গায়ের রঙ, সরু নাক, ঠোঁট দেখে রুহুলের বক্ষপিঞ্জরে ঝড় তুলে দিলো নিমিষেই। যেন হাতুড়ি দিয়ে কেউ হৃদপিণ্ড পে’টাচ্ছে রুহুল। তবে রুহুলের ঘোর কাটলো কাকনের হৃদয় শীতল করা কন্ঠে।
কাকন মাথা নিচু করে বললো,”আসসালামু আলাইকুম”
রুহুল ঢোক গিলে উত্তর নিলো,”ওয়ালাইকুম সালাম।” এত মধুর কন্ঠ কারো হয় মনে মনে ভাবলো রুহুল।
কাকন হাত এগিয়ে দিয়ে বললো, “এগুলো আমার হাতে দিন,,আমি নিয়ে যাচ্ছি।”
রুহুল কাকনের হাতে দিয়ে বললো,”হ্যাঁ নিয়ে যান আপনি।”
তোবারক নিয়ে মহিলাশালার ভিতরে চলে গেলো কাকন ও ফাতিমা। কিন্তু রুহুল ওদের যাওয়ার পানে চেয়েই রইলো।
রুহুলের সাথে থাকা লতিফ বলে উঠলো,”দাদাভাই , ওইডা হইলো কাকন এইখান কার সবচেয়ে ভালা আর সুন্দরী মাইয়া।”
–“মহিলাশালার সবার খীজ রাখিস বুঝি?”
লতিফ জিভে কামড় দিলো। বলল,”না, তা রাখমু কেন। সিরাজী আব্বা ওর হাতের পান খুব পছন্দ করে। খুব ভালা পান বানায় কাকন। মাঝে মইদ্দ্যে সিরাজী আব্বা আমারে পাঠায়া দেয় ওর হাতের পানের লিগা সেই সুবাদেই চিনি। ”
রুহুল ছোট করে বললো, “ওহ”
তবে লতিফ থামলো না। নিজের মতো করেই বলতে থাকলো, “তয় ওরে বেশি একখান দেহা যায় না। ফাতিমা আপার কাছে মেলা মাইনষে বিয়ার প্রস্তাব দেয় কিন্তু কাকন রাজি হয় না শুনছি।”
রুহুল এবার জিজ্ঞেস করলো, “কেন রাজি হয় না?”
–“কি যে হয়তো সুন্দরী দেইখা ড্যামাগ দেহায়। আবার হয়তো আরও ভালো পোলা চায়। আল্লাহ মালুম। তয় হে আমি যদি হইতাম আমিও প্রস্তাব দিতাম যদি রাজি হয়তো তাইলে ভালোই হয়তো হেহেহে।”
লতিফের শেষ কথা শুনে কেন যেন রাগ হলো রুহুলের। সে কিছু না বলে অগ্নিচোখে তাকালো লতিফের দিকে। লতিফ ভয় পেয়ে মাথা নিচু করে ফেললো। বাকি রাস্তা কেউ আর কথা বললো না।
_________________
পরের দিন নতুন দালানের কাজ দেখার জন্য আবার এলো দুলাল সিরাজী। সেখানেই দালানের কাছে দাড়িয়ে ছিল।
কাকন এসে হাসিমুখে সালাম দিলো,” আসলামু আলাইকুম সিরাজী আব্বা।”
কাকনকে দেখে দুলাল সিরাজীও হাসি দিয়ে বললো, “ওয়ালাইকুম আসসালাম,,শরীর কেমন আছে?”
–” জি ভালো,, এই নিন আপনার পান। ”
দুলাল হাত বাড়িয়ে বললো,”হ্যাঁ দেও,, মাঝে মইদ্দ্যে মনে হয় তোমার পানের ভিতরই আমার জান। এত মজা আর কারো পানে কেন যে পাই না। এই কয়ডা দিন খুব খায়তে মন চাইছে।”
কাকন মুচকি হাসলো। তারপর বললো,” এই যে এখন সুস্থ হয়েছি এখন থেকে রোজ দিবো ।”
দুলাল পান মুখে দিয়ে বললো, “হ্যাঁ, যাও এখুন ভেতরে যাও, এইখানে মেলা পরপুরুষ আছে তোমার মতো রুপোবতীর না থাকাই ভালো।”
কাকন মাথা নেড়ে প্রস্থান নিলো। দুলাল সিরাজী পান চিবোতে চিবোতে প্রশংসা করল। এই মেয়েটাকে তার খুব পছন্দ। যেমন সুন্দর তেমন নম্র। কোনো ভালো পরিবারের মেয়ে হলে সে নিশ্চিত তার বংশের বউ করতেন। কিন্তু তার বংশের যে মান আছে। এভাবে কাকনকে ঘরে তুললে সিরাজী মঞ্জিলের মান যদি নষ্ট হয় এই সংকোচবোধ কাজ করে তার মনে।
_____________________
কাকন কিছুটা দূরে আসার পর রুহুলের চাচাতো ভাই মহীবুল কাকন এর সামনে দাড়ালো বললো, “আরে কাকনমতী যে,,কি অবস্থা। আহারে শরীর এর কি অবস্থা হইছে।”
কাকন আস্তে বললো, “রাস্তা ছাড়ুন।”
মহীবুল নিজের বুকে হাত রেখে বললো, ” ইশ কত্ত দিন পর তোমার কন্ঠডা হুনলাম। পরাণ ডা ভইরা গেলো।”
হঠাৎ শোনা গেলো এক ভারী গম্ভীর কন্ঠ “মহী,,কি করছিস ওখানে?”
মহীবুল পিছনে ঘুরে দেখলো রুহুল দাঁড়িয়ে আছে। রুহুলকে দেখে মহীবুল বললো,”দ,দা,দাদাভাই, কই কিছুই না,, আমি যাই ” বলে চলে গেলো।
মহীবুল চলে গেলে রুহুল কাকনের মুখোমুখি এসে দাড়ালো। কাকন রুহুলের দিকে একবার তাকায় নি।
রুহুল বললো, “শুনলাম আপনার হাতের পান নাকি সবার সেরা।”
কাকন নিশ্চুপ।
রুহুল আবার বললো,”কি হলো চুপ করে আছেন কেন?”
কাকন এবারো কিছু বললো না। বরং ভিতরে চলে গেলো।
রুহুল মনে মনে অবাক হলো। ভাবলো মেয়ের সাহস আছে। এখানকার পুরুষেরা যেখানে রুহুল সিরাজীর কথার উত্তর না দেওয়ার সাহস নেই সেখানে এই মেয়ে দিব্যি কেটে পড়লো। এমন অবজ্ঞা যে কথার উত্তর দেওয়া তো দূর একবার তাকালোও না।
________________________
কাকন ঘরে ঢুকতে না ঢুকতেই মহিলাশালার দুটো মেয়ে ফুল আর রিতা এলো। তারা দূর থেকে দেখছিল রুহুল আর কাকনকে।
ফুল এসে বলল,” কিরে কাকন তর সাথে রুহুল সিরাজী কি কথা কইলো?”
রিতা বললো,” হ্যাঁ রে বল না! ”
কাকন দুজনকেই বললো,” কিছু না।”
ফুল বললো,”বাহ রে তরে রুহুল সিরাজীর কথা সবার আগে আমিই তরে কইছিলাম আর তুই কিনা আমারেই কইবি না। ”
কাকন বিরক্তিকর মুখ নিয়ে বলল,”সত্যি কিছু না।”
রিতা এবার বললো,” শোন যদি তরে কিছু কয় আমাদের কিন্তু কইবি । ”
কাকন হ্যাঁ জানালো।
___________________
সিরাজী মঞ্জিলের বসার ঘরে বসেছে জরুরী বৈঠক।সেখানে দুলাল,জামাল, রুহুল, হেলাল, মহীবুল, আর জামালের বিশ্বস্ত লোক হাবিবুল্লাহ। বেশ কিছুক্ষণ আলোচনা চললো। এরপর দুলাল সিরাজী বললো, “হেলাল মেলার কাম কতদুর”?
হেলাল দাদার উদ্দেশ্যে বললো,” দাদাজান, মেলার কাম প্রায় শেষের দিক।”
দুলাল সিরাজী বললো,” হ্যাঁ শেষ হওয়া চাই। ১ তারিখে হালখাতা টা শেষ হোইক। ৩রা বৈশাখ থিকা মেলা শুরু করার কথা কইবা। এই দায়িত্ব তোমারে দিলাম।”
হেলাল বললো, ” জি দাদাজান সব হইবো।”
দুলাল সিরাজী এবার মহীবুলকে বললো,”মহী, তুই খেয়াল রাখবি মেলায় জানি কোন ঝামেলা না হয়। সব দোকানিরা জানি হাসিমুখে সিরাজপুর থিকা যায়। ”
মহীবুল বললো,”জি দাদাজান আপনে কোন চিন্তা কইরেন না ”
দুলাল সিরাজী বললো,” চিন্তা কি আর সাধে করি তোমাগো আমার কোনো ভরসা নাই। রুহুলরেই দিতাম তয় রুহুল সেইদিন আবার আমলাপাড়া শহরে যাইবো ব্যবসার কামে। ৩রা বৈশাখ মাল দিতে যাইবো রুহুল ওইখান থিকা আসতে আসতে দেরি হইতে পারে। মহী সব কাম জানি ঠিক মতো করা হয়।”
মহীবুল মনে মনে গালি দিলো সে মোটেও রুহুলের গুণগান পছন্দ করে না। মুখে মিথ্যে হাসি দিয়ে বলল, “সব ঠিক মতো করমু দাদাজান,,ভুল ধরার ও সুযোগই দিমু না আপনারে।”
মহীবুলের কালো মুখ রুহুল খেয়াল করলো। রুহুল কিছু বললো না সে জানে এগুলো নতুন নয়। সব দায়িত্ব যেদিন রুহুলের কাধে দেওয়া হবে তখন নতুন কুরুক্ষেত্র অপেক্ষা কিরছে তার জন্য নিশ্চিত। এগুলোর জন্যই বিশ্ববিদ্যালয়ের পিড়া চুকিয়ে বিদেশ চলে যেতে চেয়েছিল রুহুল। সে চায় না নিজের আপন মানুষের সাথে শত্রুতা করতে। শত্রু যখন নিজ গৃহে থাকে সেই শত্রুকে পরাস্ত করা খুব কঠিন
চলবে,,,,,,,,,
শবনম রাবাহ ✍️
#দেবী
লেখিকাঃ শবনম রাবাহ (স্রোতস্বিনী)
কপি করা সম্পুর্ন নিষেধ।
৪ঃ
আজ বাংলা বছরের প্রথম দিন। আর আজকে আয়োজন করা হয়েছিল হালখাতা যা বহুবছর আগে থেকেই বাংলা বছরের প্রথম দিন বাঙালিরা পালন করে থাকে। সিরাজী বংশের পুর্বপুরুষরাও হালখাতার আয়োজন করতো। তাই আজও ১লা বৈশাখ এ হালখাতার আয়োজন করেছিল। দুলাল সিরাজীর পক্ষ থেকে মুলত আজকে হালখাতা উপলক্ষে সকল কৃষকদের এবং তার থেকে ঋণ নেওয়া ব্যক্তিদের, বিভিন্ন ব্যবসায়ীদের আমন্ত্রণ জানানো হয়েছিল। হালখাতার সকল কাজ সেরে সকলে খেতে বসেছে।
সিরাজী মঞ্জিলের রীতি অনুযায়ী পুরুষেরা ভোজন কক্ষে বসে খায়। আর নারীরা রান্নাঘরের মেঝেতে খাওয়ার নিয়ম যদিও যথেষ্ট বড় রন্ধনশালা। সেখানে খেতে কারো অসুবিধা হয়না। তিন বেলায় এভাবে খাওয়ার নিয়ম। খাওয়ার টেবিলে বসে খাচ্ছে সকলে।টেবিল ভর্তি নানা রকম এর খাবার।
জামাল খেতে খেতে দুলাল সিরাজোকে বললো, “আব্বা,,কইতেছিলেম যে এইবার তো সব দিক দিয়াই লাভবান হইতাছেন। আশা করি এইবার আমাগো জমি গুলাতে ফলন ভালো হইবো। আর আম,লিচু,কাঠল বাগানে অনেক ফল আইছে। আপনি যদি কিছু মনে না করেন এইবার এগুলা দেখভালের দায়িত্ব আমি, হেলাল আর মহী নিমু।”
দুলাল সিরাজী ভাতের দিকে তাকিয়ে বললো, “খাওয়ার সময় বেশি কথা কওয়া আমার পছন্দ না। চুপচাপ খাও।সময় আসলে কমুনে কারে দায়িত্ব দিমু।”
হেলাল চাচার পক্ষ নিয়ে বললো, ” দাদাজান! চাচাজান যখন কইতাছে দেন দায়িত্ব। আমরা তো আছিই সাহায্য করুম।”
দুলাল হেলালের চোখে চোখ রেখে বললো, ” খুব ভালো কইরাই জানা আছে কেডা কত সাগায্য করতে পারো। তাই মুখ ডা খুলবার চাই না।”
দুলালের কথা শুনে তিনজনেরই মুখ চুপসে গেলো।
রুহুল শুধু নিরবে খেয়ে যাচ্ছে। কারন সে অকারণে এগুলোতে জড়াতে চায় না। তার সবই জানা। তার চাচা, ভাইরা যে দেখভালের নামে চুরি করে টাকা হাতিয়ে নেবে জানা আছে তার।আর সেই টাকা কি কাজে ব্যয় করবে সেটাও জানা।
অন্যদিকে রন্ধিনশালায় সকল মহিলারা খাবার খাচ্ছে। সবাই গোস্ত, পোলাও, কোরমা আর ইলিশ ভাজি খাচ্ছে। আর একমাত্র সুভা যে কি-না মাছ ভাত খাচ্ছে। এজন্য তার জা আর সতীন মুখ চিপে হাসছে। সুভা গোস্ত-পোলাও খেতে পারে না। তার সাধারণ ভাত-রুটি তেই শান্তি। এ নিয়ে সিরাজী মঞ্জিলে নানা কথা শুনেছে সে। তার শাশুড়ী মা কিছু না বললেও সতীন থেকে নানা টিটকারি শুনতে হতো। সিরাজী মঞ্জিলের বউ হয়ে ও পোলাও-গোস্ত পাতে নেয় না এজন্য বলা হতো বাবার বাড়ি পোলাও-গোস্ত চোখে দেখেনি সুভা। অবশ্য সকলের বাপের বাড়ি থেকে সব কিছু আসলেও রুহুলের নানাবাড়ি অর্থাৎ সুভার বাপের বাড়ি থেকে আজ অব্দি কিছুই আসতে দেখে নি কেউ। গরীব, ফকিন্নিসহ কম কথা শুনতে হয়নি সুভা কে। তবে সুভা নিরব থাকে। কেমন যেন অনুভূতিহীন এক মানবী সে।
সবার খাওয়ার মাঝেই সামিয়া হঠাৎ এক কথা বলে উঠলো,” দাদিমা, ও দাদিমা!”
–“আহ জ্বালাস না কি কইবি ক?”
–” আমি পরশু দিন মেলায় যামু। আপনি একটু দাদাজানরে বুঝাইয়া কইয়েন যে আমারে জানি যাওয়ার অনুমতি দেয়।”
–“সিরাজী বাড়ির মাইয়া-বউগো পর পুরুষের সামনে যাওয়া তর দাদাজানের পছন্দ করে না। সে রাজি হইবো না।”
–“আপনি কইলেই হইবো। ”
–“কইলাম তোপছন্দ করে না। তয় তর দাদাজান অনুমতি দিলে যাইস। তর দাদাজান রে কইস।”
–” দাদাজান রে কওয়ার সাহস আমার নাই।এইজন্যই তো আপনারে কইলাম।আপনি কইলেই কাম হবো।”
দাদিমা খাওয়ায় মন দিয়ে বললেন,”আমি পারুম না। বুড়া কালে সুয়ামির মাই’র খাইবার চাই না।”
সামিয়া বললো, “ঠিক আছে কইতে হইবো না। দাদাভাইরে কইলে কাম হইতে পারে।”
এরপর সামিয়া সুভার উদ্দেশ্য বলল,” বড়াম্মা তুমি দাদাভাই রে একটু কইয়ো তো। আমি মেলায় যামু ” আহ্লাদী সুরে বললো সামিয়া।
সুভা মুচকি হেসে বললো, “বেশ আমি খোকাকে বলবো যেন আমার সামিয়া বুড়িমকে নিয়ে যায়। এখন খেয়ে নে দেখি।”
সামিয়া সুভাকে জড়িয়ে ধরে বললো,”বড়াম্মা তুমি খুব ভালো।”
সতীনের প্রতি নিজের মেয়ের দরদ দেখে মুখ কালো করলো মালেকা। সে আর যাই হোক সুভা কে পছন্দ করে না। সে এই বাড়িতে বড় ছেলের বউ হয়ে এসেছিল ঠিকই কিন্তু বড় বউ এর অধিকার পায়নি। তাকে বলাই হয়নি তার স্বামী বিবাহিত ছিল। বিয়ের পর জেনেছে। সেই থেকে সুভার প্রতি ঘৃণা। এই জন্যই তো রুহুল পেটে থাকতে সে সুভাকে শিড়ি থেকে ফেলে দিয়েছিল। কিন্তু ভাগ্যজোড়ে বেচে যায় সুভা। সাথে রুহুলও। কিন্তু হারিয়ে ফেলে মা হওয়ার ক্ষমতা। সেই এক পুত্র রুহুলকে নিয়েই সুভার বাস সিরাজী মঞ্জিলে।
______________________
সকলেই যার যার কক্ষে। সুভা রুহুলের কাছে গেলেন। দরজার কাছে দাড়িয়ে ছেলের বই পড়ার দৃশ্য দেখলেন। ইংরেজি এক মোটা বই। ছেলে তার বই প্রেমী। বিভিন্ন বই পড়তে পছন্দ করেন। লন্ডনে যেয়ে শেষ একটা লেখাপড়া করতে চেয়েছিল। কিন্তু তার বাবার দুর্ঘটনায় যাওয়া হলো না। আর যাও যেতে চেয়েছিল দুলাল সিরাজী যেতে দেবেন না। দীর্ঘশ্বাস ছাড়লেন সুভা।
কারো ছায়া দেখে পিছনে ফিরলেন রুহুল।মাকে দেখে বললো,”ভিতরে আসেন আম্মা,দাঁড়িয়ে আছেন কেন?”
সুভা বললো, “তোর সাথে একটা কথা বলতে এলাম।”
রুহুল বই বন্ধ করে বলল,”জি আম্মা বলুন।”
–” কাল সামিয়াকে একটু মেলায় নিয়ে যাস তো খোকা। মেয়েটা বড্ড বায়না করেছে”
–“কিন্তু আম্মা আপনি তো জানেন দাদাজান মেলায় সামিয়াকে নিয়ে যাওয়াতে সম্মতি দিবেন না। আর আমিও মেয়েদের এভাবে পরপুরুষ এর সামনে ঘুরাঘুরি পছন্দ করিনা। মেলায় অনেক বাজে মানুষ জন ও থাকবে। তাই এই বিষয় টা আমি মানতে পারবো না। ক্ষমা করবেন।”
সুভা মেকি হেসে বলল,”এই সিরাজী বংশের নিয়ম কত অদ্ভুত। মেয়েদের ১০ ক্লাস এর বেশি পড়ানো যাবে না। ছেলেদের সাথে বসে মেয়েদের খাওয়া যাবে না। আমার বাড়িতে এমন নিয়ম ছিল না। দম বন্ধ হয়ে আসে এমন নিয়মে। আগে জানলে কখনোই এই সিরাজী মঞ্জিলে বউ হয়ে আসতাম না।”
রুহুল উঠে মায়ের কাছে দাড়ালো। বললো,”আম্মা এটা আমাদের বংশ পরম্পরায় চলে আসছে। এই নিয়ম মানতে হবে। তাই দয়া করে এভাবে বলবেন না। আর পারলে অতীত ভুলে যান।”
সুভা রুহুলের চোখের দিকে অসহায়ের মতো চেয়ে বললো,” চাইলেই কি সব ভুলে যাওয়া যায়? ”
রুহুল কিছুক্ষণ চুপ থাকলো তারপর বললো,
” অনেক রাত হয়েছে আম্মা।আব্বার কাছে যান। একা আছেন উনি। আর সামিয়াকে বলবেন আমি কাল গিয়ে মেলার পরিবেশ পর্যবেক্ষণ করবো তারপর যদি মনে হয় নিয়ে যাবো।”
সুভা ছেলের দিকে একবার তাকালো। তারপর চলে গেলো।
________________
মহিলাশালায় রিতা, ফুল, নুপুর পাশাপাশি শুয়ে আছে। ফাতিমা আর কাকন পাশাপাশি। রিতা আর ফুল প্রায় জোর করে ফাতিমাকে একদম কিনারে দিয়েছে। কারন আজ সকল মেয়েরা মিলে পরিকল্পনা করবে। মেলায় যাওয়ার পরিকল্পনা।
রিতা বললো, ” শোন, কাল আমরা ফাতিমা আপা রে কমু মেলায় যাওয়ার কথা। যদি যায়তে না দেয় সবাই মিলা পা ধরমু।”
ফুল বললো,” কিন্তু তাতেও যদি রাজি না হয়। তখন কি করমু?”
নুপুর বললো,”আরে কাকনরে দিয়া কওয়ামু। ফাতিমা আপা কাকনরে অনেক ভালোবাসে। কাকন কইলেই রাজি হইবো। ”
রিতা মুখ ফুলিয়ে বললো,” কিন্তু কাকন তো বাইরে বের হওয়া পছন্দই করে না। সারাদিন খালি এই মহিলাশালার ঘরেই থাকে।”
ফুল বললো,”আরে রিতা চিন্তা করিস না সব আমার উপর ছাইড়া দে। কাকন রে জোর কইরা কওয়ামু।”
নুপুর লজ্জামাখা মুখ নিয়ে বললো,” ইশ মেলায় গেলে সোহাগ এর লগে অবেক কথা কইতে পারুম।এই মিস্ত্রী গুলার জন্য আপা বাহির হইতে দেয় না কথাও হয় না। তার লগে কতদিন কথা হয় না আমার । ”
রিতা নুপুরকে লজ্জা দেওয়ার জন্য বললো, ” আহারে সুহাগ ভাই এর নাইকা রে,, পিরিত দেইখা বাচি না।আপা জানলে পিরিত বাইর হইবো নে।”
নুপুর বললো, “তুই সব সময় বেশি কথা কস। শুধু চিঠি টা দিমু। তাই মেলায় যাওয়া খুব দরকার।”
ফুল বলল,”আইচ্ছা দিস,, কিন্তু কেউ জানি টের না পায়। তাইলে অবস্থা খারাপ। ”
হঠাৎ ফাতিমা বলে উঠলো,” কিরে তোরা কি শুরু করছা। ঘুমা কইতাছি। ফজরের সময় না উঠলে মাইর দিমু, এখন ঘুমা।”
ফাতিমার কথা শুনে চুপ হয়ে গেলো সবাই। তারপর ঘুমিয়ে পড়লো।
_______________
পরেরদিন ফুল,রিতা,নুপুর সাথে আরো ১০-১২ জন কিশোরী মেয়েরা মিলে মেলায় যাওয়ার কথা বলবে। কাকন কেও জোর করে সাথে নিয়েছে। ফাতিমার কাছে গেলো সকলে।
–“ফাতিমা আপা,,আমরা সবাই মেলায় যাইতে চাই।”
ফাতিমা স্পষ্ট ভাবে বলল,” না ,,ওইখানে যাওয়া যাইবো না। পরপুরুষ আছে অনেক। আর তাছাড়া অত ভিড়ে কোনো অঘটন ঘটলে। এত গুলা যুবতী মাইয়া যাওয়া ঠিক হইবো না।”
সবাই মিলে হুড়মুড়িয়ে ফাতিমার পায়ে পড়লো।
ফুল বললো,” না কইরেন না আপা,,একটু ঘুইরা ই চইলা আসমু। ”
–“হ্যাঁ আপা যাবো আর আসবো।” (সবাই বলে উঠলো)
ফাতিমা এবার বললো,”বেশ যাবি যাইস।কিন্তু সবাই বোরকা পড়বি, মাগরিবের আগেই চইলা আসবি আর কেউ কারো হাত ছাড়া যাবে না।”
সবাই খুশিতে বলে উঠল,” ঠিক আছে আপা।”
একপাশে দাড়িয়ে ছিল কাকন ফাতিমা কাকন কে ডাকলো,” কাকন!”
কাকন ফাতিমার ডাকে সাড়া দিয়ে বলল,”জি আপা”
–” কাছে আয় তুই মা। সারাদিন তো মহিলাশালায় থাকস। কাল তৈরি হয়ে থাকিস মেলায় যাবি ওগো সাথে।”
কাকন বললো,”না, আপা আমি যাবো না।”
রিতা কাকনের হাত চেপে বললো,”চুপ তুই ও যাবি। আপা আপনে চিন্তা কইরেন না। ও যাইবো।”
নুপুর সায় দিল,” হ্যাঁ রে কাকন তুই যাবি। কোনো বাহানা করবি না।”
ফাতিমা এবার বললো,” যা ওরা যখন কইতাছে। আর তোরা কাকন রে দেইখা রাখিস । ও তো আর তগো মত চালাক না। বোকা সোকা মাইয়া আমার। ওর হাত
কিন্তু ছাড়বি না।”
ফুল বললো,”জি আপা,,কোনো চিন্তা কইরেন না। ”
কাকনের কোনো ইচ্ছে নেই মেলায় যাওয়ার। তআর মন কি ডাকছে কিন্তু এখন না গেলেও উপায় নেই।
চলবে….,,
শবনম রাবাহ ✍️