দেবী,০৫,০৬

0
376

#দেবী,০৫,০৬
লেখিকাঃ শবনম রাবাহ (স্রোতস্বিনী)
কপি করা সম্পুর্ণ নিষেধ।
৫ঃ

নববর্ষের শুরুতে বাঙালীরা নানা আনন্দে মেতে উঠে। প্রতিবছরের ন্যায় এবছর ও সিরাজপুরে মেলার আয়োজন করা হয়েছে। গ্রাম্য মেলা মানেই আনন্দের শেষ নেই। গ্রামবাংলার মানুষ নানা ভাবে আনন্দে মেতে উঠে। মেলার পরিচালনা করে থাকে সিরাজীরা নিজে। বিভিন্ন গ্রাম-গঞ্জ থেকে দোকানিরা আসে তাদের পণ্য বিক্রি করে। লাভবান ও হয়। সেই সাথে সিরাজপুরবাসী ও মেলা উপভোগ করে।

বিকেলে সবাই ওরা মেলার উদ্দেশ্যে বের হল। সিরাজী মহিলা পাঠশালা থেকে ১০ মিনিটের পথ। মেলা বসেছে গ্রামের হাটের বিপরীতে ফাকা মাঠে। গ্রামের সবচেয়ে বড় মাঠ। চারিদিকে মানুষের গিজগিজ।হরেক রকম খাবার, নাগরদোলা, চরকি, যাত্রাপালা প্রভৃতি রয়েছে।

মেলায় পৌছে কাকন অবাক হলো একেই তো হরেক রকমের জিনিসপত্র তার ওপর এতো ভিড়।তবে কেমন যেন অসস্তি লাগছে তার। সে এতো মানুষের মধ্যে কখনো থাকে নি। কাকন বিরক্তিতে বলল,”এত ভিড় রিতা আপা, এই জন্য আমি আসতে চাই নি।”

ফুল কাকনকে ধমক দিয়ে বললো,” কাকন তুই একটু চুপ থাকবি। সব সময় বেশি কথা কস।এমনিতেই আপা আসতে দিতে চাইলো না। তার উপর তুই বেশি কথা বলছিস।”

রিতা বললো, ” শোন কাকন বছরে একবারই মেলা হয়। গত বছর তো দুর্ঘটনার জন্য মেলা হয় নাই। এইবার আমি সেইরকম ঘুরুম।”
ফুল বলল,” ঠিক কইছা। চল নাগরদোলা চড়ি।”
আরেকজন বললো,”না আগে আমরা চুড়ি আর ফিতা দেখি। দেখ কত রকমের।”
ফুল বলল,” ঠিক আছে তাই হইবো।”
রিতা এবার বাধ সাধলো,”না আগে কিছু খাইয়া নেই। কত্ত রকমের খাওয়ার জিনিস। আচার দেইখা জিব্বাই পানির বন্যা বইতাছে।”
ফুল বললো,” তর খালি খাই খাই। আচারে একদিন আছাড় খাবি দেখিস তুই।”
নুপুর বললো, ” তোরা যা, ওই যে সোহাগ। আমি একটু চিঠি টা দিয়ে আসি।কাকন তুই আমার সাথে চল।”
বলেই কাকন এর হাত ধরে নিয়ে গেলো।

সবাই হেসে দিলো। ভিড়ের মধ্যেই এগোতে লাগলো
সবাই। আর অন্যদিকে নুপুরের সাথে যাচ্ছে কাকন। সবচেয়ে শান্তশিষ্ট সরল মেয়ে কাকন। চুপচাপ মূর্তির ন্যায় নুপুরকে অনুসরণ করছে। ভিড়ের মধ্যে বাজে ছেলেরা ধাক্কা দিতে চাচ্ছে তাই কাকন ভয়ে নুপুরের হাত আরো জড়িয়ে নিলো।
নুপুর কাকনের হাতের দিকে চেয়ে বলল,” এইভাবে ধরে আসস কেন? হাত ছাড় কাকন আর তাড়াতাড়ি হাটতো । দেখ ওই যে সোহাগ দাড়িয়ে আছে। ” বলেই কাকন এর হাত ছেড়ে দিলো।

বেচারি কাকন নুপুরের সাথে সাথে যাওয়ার চেস্টা করলো।দেখলো নুপুর কথা বলছে সোহাগের সাথে। একটু দূরে দাড়িয়ে থাকলো কাকন। নাগরদোলার দিকে তাকালো। কিছুক্ষণ পর দেখলো নুপুর আর সোহাগ কোথাও যাচ্ছে। কাকন ও যেতে চাইলো কিন্তু কিছু দূর এগিয়ে ভিড়ের মধ্যে কিভাবে যেন হারিয়ে গেলো। কাকন চারিদিকে চোখ বুলালো কিন্তু ফলাফল শুন্য। কাকন “নুপুর আপা” বলে ডাকতে থাকলো। কিন্তু এই ভিড়ে কেউ শুনছে না তার কথা। তারপর কাকন সবাইকে খুজতে লাগলো কিন্তু ভিড়ের মধ্যে তাদের কেও পেলো না। কাকনের খুব ভয় হতে লাগলো। তবুও খুজতে লাগলো কিন্তু ব্যর্থ হলো। এদিকে সন্ধ্যা হয়ে আসছে তার মাগরিবের নামাজ পড়তে হবে। কোনো উপায় না পেয়ে তাই সে পাঠশালার উদ্যেশ্যে রওনা হলো।

মাঠের পথ ছেড়ে খানিক টা এগিয়ে এসেছে। চারিদিকে মাগরিবের আজান দিচ্ছে। কাকন বকুলতলা এসে পৌছালো। হঠাৎ তার অন্যরকম লাগলো। সে কেন যেন বকুল গাছ টার দিকে তাকিয়ে রইলো। আজানের আওয়াজ শুনতে পেলে হঠাৎ তার ভয় বেড়ে গেলো। সে এদিক ওদিক তাকিয়ে দেখলো কেউ নেই একদম ফাকা ফাকা লাগছে তার ।সে জোরে জোরে শ্বাস নিলো। সামনেই মসজিদ হয়তো সবাই নামাজে গেছে। ডান দিকে গেলে মহিলা পাঠশালা। আর বাম দিকে নদী আর নদীর পাশে এখানে এলাকার বখাটেরা গুলি (আফিমের তৈরি করা মাদক) খায়, জুয়া খেলে,নেশাপান করে । যা সে ফাতিমা আপার থেকে শুনেছিল।
কিছুটা দূরে সে দেখলো কয়েকজন বসে জুয়া খেলছে। কাকন ওদের দেখে দ্রুতপায়ে এগোতে লাগলো। কিন্তু ওদের চোখ ফাকি দিতে পারলো না।
–“কিরে সন্দাবেলা বুরকা পড়া পরী কই থিকা আইলো”
–“চল যাইয়া দেহি। হ চল যাই। রাইতে সবাই মেলায় যাত্রা দেখবো আর আমরা ওর লগে যাত্রা করুম। -“হাহাহা তার আগে চল পরী ধরি।” এগুলা বলেই ৪-৫ জন কাকনের দিকে আসতে শুরু করলো।

কাকন দেখলো ওর দিকে এগিয়ে আসছে কাকন ভয়ে দৌড় দিলো। কিন্তু তারা কাকন কে ঘিরে ধরল।
–“আরে কই যাও মাইয়া। তোমার লগে আইজ আকাশের চাঁদ দেখুম। ”

আরেকজন বললো, “উহু খালি চাঁদ কেন রাইতের আকাশে সূর্য ও দেখমু আজকা।” বলেই হো হো করে হেসে উঠলো সবাই।

কাকন ভয়ে বললো, ” দেখুন আমাকে যেতে দিন। আমি কিন্তু লোক ডাকবো।”

–“ডাকবা ডাকো দেখি কেডায় আসে। হোহোহো”
তারপর কাকনের হাত ধরে ফেললো।কাকন ভয়ে হাত ছাড়ানোর চেষ্টা করলো। চিৎকার করতে থাকলো। কিন্তু তার আগেই বখাটে গুলো ওকে টেনে নিয়ে যেতে লাগলো।কাকন আরো জোরে জোড়ে চিৎকার করতে শুরু করলো।এক জন কাকন কে পাজাকোলে নিলো।আরেক জন মুখ চেপে ধরলো।
কাকনকে নদীর পাশ দিয়ে নিয়ে যেতে লাগলো। কাকন বুঝতে পারলো তাকে জঙ্গলের ভিতর নিয়ে যাওয়া হচ্ছে এবং কি জন্য নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। কাকন ছোটার জন্য প্রাণপণ চেষ্টা করছে।চিৎকার ও করছে।কিন্তু কেবল ‘উউম উম’ শোনা যাচ্ছে। জঙ্গলের ভিতর প্রবেশ করলো বখাটে গুলো। নির্জন জায়গায় এনে কাকন কে ফেলে দিলো।কাকন মনে মনে আল্লাহ কে ডাকতে শুরু করলো। কাকন কে ফেলে দিলে কাকন উঠে দৌড়াতে লাগলো। তার মনে কেবল একটাই চিন্তা তাকে বাচতে হবে। কাকন জঙ্গলে ছুটছে। তার চোখ বেয়ে জল গড়িয়ে পড়ছে। বেশ খানিক দূর যেতেই কোনো এক শিকড়ের সাথে পা বেজে পড়ে গেলো কাকন।পড়ে যেয়ে হাটুতে আর হাতে ব্যাথা পেলো।তবুও দুই হাতে ভর করে উঠে দাড়ালো। কিন্তু শ’য়’তা’ন গুলো ঠিক ই ধরে ফেললো। তারপর বললো, — “মা** তুই আমাগো দোড় করায়লি। ভাবছিলাম তরে খাইয়া ছাইড়া দিমু কিন্তু তুই হেইডাও পাবি না। ওই ওরে ধর। ”
কাকন এই কথা শুনার পর এক চিৎকার
করলো,” বাঁচাও।”
সাথে সাথেই একজন কাকনের মুখ চেপে ধরলো। তারপর আরেকজন ২ হাত ধরে ফেললো। এবার কাকনের নিকাব খোলার জন্য হাত বাড়ালো।

কাকন কাদছে আর ভাবছে আদোও কি তার শেষ রক্ষা হবে। বারবার দুয়া ইউনুস পড়তে লাগলো।
__________________

একজন কাকনের মুখ চেপে ধরলো। তারপর আরেকজন ২ হাত ধরে ফেললো। এবার কাকনের নিকাব খোলার জন্য হাত বাড়ালো।
যেই কাকনের বোরকার নিকাব খুলবে ওমনি কেউ একজন হাত ধরে মুচড়ে ফেললো।
কাকন ভয়ে চোখ বন্ধ করেছিল। কিন্তু দুটি শব্দ শুনে চোখ খুললো,”রুহুল সুরাজী”
কাকন চোখ খুলে একজন পুরুষের অবয়ব দেখতে পেলো। সন্ধাবেলা আবছা আলোয় কাকন চিনতে পারলো এটা দুলাল সিরাজীর নাতি যাকে সে মহিলা শালায় দেখেছিল।
বখাটের দলের একজন বলে উঠলো,”রুহুল সিরাজী আপনে,,, মা..মাফ কইরা দেন আমাগো। বুঝবার পারি নাই আর হইবো না।”
মুখ এ ঘুষি মারলেন রুহুল। বললো,”লজ্জা করে না তোদের। একটা মেয়েকে নিয়ে এসে জোর করছিস। সিরাজপুরে মেয়েদের কে জোর করা বের করবো আজকে। আজ তোদের কেউ বাঁচাতে পারবে না।”

তারপর সব গুলা কে মারতে শুরু করলো।থাপ্পড়, ঘুসি,লাথি সব গুলো মা’রতে লাগলো। জঙ্গলের গাছের ডাল দিয়ে ইচ্ছেমতো পিটালো। ওরা রুহুল কে ধাক্কা দিয়ে মাটিতে ফেলে দিলো তারপর প্রাণ নিয়ে পালালো।
রুহুল চিৎকার করে বললো,” তোদের মুখ ও যেন এই সিরাজপুরে না দেখি। যদি দেখি জ্যান্ত পু’তে ফেলবো”।

রুহুল দেখতে পেলো একটি মেয়ে মাটিতে বসে ফুপাচ্ছে।তারপর মেয়েটির দিকে তাকালো। নিকাবের আড়ালে চোখ দুটি চেনা চেনা লাগছে।
রুহুল কাকনের উদ্দেশ্য বললো, “আর আপনি একা একা কি করছিলেন? আর একটু দেরি হলে কি হতো ভেবে দেখেছেন। ভাগ্যিস আপনার চিৎকার শুনেছিলাম কিন্তু এসে যে এভাবে দেখবো ভাবিনি। নদীর পাশে দিয়ে কি করছিলেন। জানেন না নদীর পাশে সন্ধ্যার পর নিরাপদ নয়। কে আপনি? ”

কাকন ক্লান্ত স্বরে বলল,” আমি,,, আমি কাকন। আমি মহিলাশালায় থাকি। মেলায় গিয়েছিলাম আপাদের সাথে। ওদের হারিয়ে ফেলেছি মেলায় তাই একা একা চলে এসেছি। আর ওই লোকগুলো জোড় করে আমায় এখানে নিয়ে এসেছে।” বলেই কাদতে শুরু করলো।

রুহুল কাকনকে চিনতে পারলো। ওর ভিষণ রাগ লাগলো। তবুও রাগ দমন করে বললো, ” কান্না থামান। আর কখনো এভাবে বেড়োবেন না। আর যারা আপনাকে দেখে রাখতে পারে না তাদের সাথে কেন এসেছেন। আজ যদি আপনার ক্ষতি হয়ে যেতো ভাবুন কি হতো? ”

কাকন চুপ করে রইলো। তারপর চোখের জল মুছার চেষ্টা করলো।
রুহুল বলল,” চলুন আপনাকে এগিয়ে দেই। এই অন্ধকারে না জানি আবার কোন বিপদ বাধাবেন।”

তারপর চুপ চাপ দুজন এগোতে থাকলো। কাকন ওর নিকাব ঠিক করলো। বোরকা ঝাড়লো। রুহুল ও গায়ের জামায় লেগে থাকা ময়লা ঝাড়তে ঝাড়তে এগোলো।

মসজিদে নামাজ পড়ে আক্কাস দুজন লোক নিয়ে বের হচ্ছিল।যেহেতু ওদের নদীর পথে দিয়ে বাড়ি যেতে হয় তাই ওরা সেদিকে যাচ্ছিল। জঙ্গলের ভিতর থেকে রুহুল-কাকন কে দেখে থেমে গেলো তিনজন।
–“আরে ওইডা রুহুল বাজান না।মাইয়া নিয়া জঙ্গলে কি করতেছিলো। ”
–“হ রুহুল সিরাজী ই তো। তয় মাইয়া কেডা?”

মুখোমুখি সবাইকে দেখে থমকে যায় কাকন-রুহুল। আক্কাসের সাথে থাকা একজন বলে উঠলো,
–“তোমরা দুইজন জঙ্গলে কি করতে ছিলা?”

রুহুল এমন প্রশ্নে বললো,”চাচা আসলে….”

এতক্ষণ আক্কাস চুপ ছিল তবে এবার আক্কাস বলে উঠলো,”আসল নকল থামাও সিরাজী সাব। কও যে সইন্ধ্যা বেলা ফুর্তি করতে গেছিলাম জঙ্গলে।”

রুহুল গালি দিতে যেয়েও দিলো না। বললো,”মুখ সামলে কথা বল আক্কাসের বা’চ্চা। তর জিভ টেনে ছিড়ে দিবো আমি।”

–“হ আমি খারাপ আর তুমি তো সাধু মানুষের বাচ্চা।তা মাইয়া নিয়া জঙ্গলে গেছিলা সাধু কাম করতে নাকি। আর আপনারা চুপ কইরা আছেন কেন। সিরাজী মঞ্জিলের পোলা বইলা চুপ।আর আমার বেলায় কি মাইর আর অপমান ডা না করলো এই গেরাম বাসী।”

–“চুপ মিথ্যা কথা এগুলো সব মিথ্যা। আপনারা যা ভাবছেন তা না আম..”

আক্কাস বাকি দুজনকে বললো,”হ আমরা তো সত্য মিথ্যা বুঝি না তাই না। যাও কেউ সিরাজী আব্বা রে ডাক দেও।হেতি নিজে আইসা দেখুক হের বংশের কুকির্তী।”

একটু পর উপস্থিত হলো দুলাল সিরাজীসহ কয়েকজন মুরুব্বী এগিয়ে এলো। দুলাল জিজ্ঞেস করলো, ” কি হইছে কি এইখানে?”
আক্কাস হেসে বললো,”সিরাজী আব্বা,,আপনের বড় নাতি মাইয়া নিয়া ধরা পড়ছে।”
দুলাল আক্কাস কে ধমকে বলল,” মুখ সামলায় কথা কইবি আক্কাস। আমার নাতি তর মতোন না। সে এইকাম করতেই পারে না। ”

–” হ আমি তো খারাপ ই। কিন্তু আমরা নিজে চোক্ষে দেখছি। আরে পঞ্চায়েতের সদস্য সহ আরও অনেকেই আছিলো। ”

রুহুল তার দাদার কাছে যেয়ে বলল,” দাদাজান ওনারা যা ভাবছ সব মিথ্যা। আমি শুধু ওনাকে এগিয়ে দিত….”

আক্কাস কথা থামিয়ে দিয়ে বললো,” আরে রাখো মিয়া,,,ধরা পইড়া সব্বাই এমন করে। এখন দেখবার চাই সিরাজী আব্বা কি বিচার করে। নিজের রক্ত বইলা কি ছাড় দিবো নাকি। ”

দুলাল এবার সকলের উদ্দেশ্যে বলল,”আমার নাতির উপর আমার বিশ্বাস আছে। কিন্তু যদি আমার নাতি খারাপ কাম করে আমিই এর বিচার করমু। তোমরা কেউ স্বচোক্ষে খারাপ কাম করতে দেখছেন?”

আক্কাসের সাথে থাকা পাচজনেই মাথা নিচু করে ফেললো। কিন্তু আক্কাস দমবার পাত্র নয়। সে প্রতিশোধ নেওয়ার সু্যোগ হাত ছাড়া করবে না। তাই আবারো বললো, “জঙ্গলে পোলা মাইয়া কেন যায় হুনি? এই সিরাজপুরের মেলা মানুষ মা’গ* নিয়া জঙ্গলে গেছে। সেইডা সক্কলেরি জানা। আর একটু আগে আমরা তিনজন স্বচোক্ষে ওগো কাপড় ঝাড়তে ঝাড়তে আইতে দেখছি।এর চেয়ে আর কি শুনবার চান সিরাজী আব্বা। এই যে এনারা সাতেই আছিলো আমার। ”

আক্কাসের কথার সাথে বাকিজন সম্মতি জানালো। দুলাল সিরাজী তার বংশের মান মর্যাদা নষ্ট হতে দেবে না। আর তাছাড়া সিরাজপুরে তার আলাদা সম্মান আছে। দুলাল সিরাজী বলল,”আচ্ছা তগো কথা মাইনা নিলাম দুইজন জঙ্গল থিকা বাহির হইছে। কিন্তু খারাপ কাম করতে গেছিলো সেইডা কেমনে মনে করলা। আগে সব দেখবা তারপর কথা কইবা। রুহুল যখন কইছে তাইলে হেইডাই সত্য। আর কুনু কথা শুনবার চাই না। ”

দুলাল সিরাজীর কথা শুনে কেউ আর কিচ্ছু বললো না। আক্কাস তবুও কিছু বলতে চাইলে দুলাল সিরাজী জোর করে দমিয়ে দিলো।এরপর সবাই যার যার মতো চলে যেতে লাগলো। ওইখানে রইলো কেবল দুলাল, রুহুল আর কাকন।
দুলাল সিরাজী কাকনকে জিজ্ঞেস করলো, “তুমি ওইখানে কেন গেছিলা কাকন?”
কাকন মাথা নিচু করে কাদছে । তার অত্যন্ত লজ্জা লাগছে আর কান্নাও পাচ্ছে সেসব কথা বলতে। রুহুল কাকনের অবস্থা বুঝে বলল,”আসলে উনি রাস্তা হারিয়ে গিয়েছিল। তারপর কিছু কুকুরের তাড়া খেয়ে জঙ্গলের ভিতর ঢুকে গিয়েছিল। আমি ওপাশ দিয়েই আসছিলাম মেয়ে মানুষের চিৎকার শুনে ভাবলাম কি না কি বিপদ তাই গিয়েছিলাম। গিয়ে দেখি উনি বাচ্চাদের মতো কাদছে। আমি বললাম কি হয়েছে?উনি কি বলল জানেন দাদাজান?
-“কি কইলো?”
–“বললো যে আমি হারিয়ে গেছি। আমি শুনে এগিয়ে দিতে চাইলাম। তবে জঙ্গল থেকে বের হতেই এই দশা হলো। ”

দুলাল সিরাজীর বিশ্বাস হলো রুহুলের কথা। কাকনের দিকে চেয়ে হাসলো যেন কোনো কৌতুক শুনেছে। তবে কাকন অবাক হলো কেউ কি করে এত গুছিয়ে মিথ্যে বলতে পারে। আর তাছাড়া সে কি এতটাও ছোট নাকি যে পথ হারিয়ে ফেলবে। আশ্চর্য।

কাকন কিছু বললো না।দুলাল সিরাজী আর রুহুল দুজন মিলে কাকনকে মহিলাশালা অব্দি পৌছে দিলো। প্রবেশদ্বারের কাছে এসে কাকনকে দুলাল সিরাজী বলল,”একা একা আর বাহির হইয়ো না। দিনকাল ভালা না। এই যে পথ হারাইয়া গেছিলা, কুত্তা দেইখা ভয় পাউ, তারপর বিপদে পড়লা রুহুল আমি না থাকলে তোমার ঝামেলা হইবো। আর যাইয়ো না কেমন।”

–“জি সিরাজী আব্বা। আসছি”
–“আচ্ছা যাও। ”

চলবে,,,,,,,,,,

শবনম রাবাহ ✍️

#দেবী
লেখিকাঃ শবনম রাবাহ (স্রোতস্বিনী)
কপি করা সম্পুর্ণ নিষেধ।
৬ঃ

কেটে গেছে দুইদিন। সেদিনের পর থেকে কাকনের মনে আতঙ্কের সৃষ্টি হয়েছে।একেই তো সেই ভয় আর দ্বিতীয়ত আক্কাসের কথা শুনে। আক্কাস সিরাজপুরে নোংরা কথা ছড়ানো শুরু করেছে কাকন আর রুহুলের নামে। ফাতিমা গতকাল নিজ কানে শুনে এসেছে। ফাতিমার চিন্তাও কাকনকে নিয়েই। রুহুল বড় ঘরের ছেলে তার কিছু হবে না কিন্তু কাকনের সব বদনাম হবে। কাকন সেদিন ফাতিমাকে সব ঘটনা খুলে বলেছিল।ফাতিমা নুপুরের গালে দুটো চড় মেরেছিল এমন করার জন্য। কাকনের ও ফুল, নুপুরদের প্রতি রাগ অভিমান থাকলেও কেটে গেছে। সেদিনের ঘটনায় ফাতিমা নিজেও ভয় পেয়েছিল। কাকন চেষ্টা করছে সেগুলো ভুলে যেতে।
তবে কাকন দু’দিন হলো ঘর থেকে কম বের হচ্ছে। কারণ কাকন লক্ষ্ম করছে রুহুল আজ দুদিন হলো দালান দেখার জন্য মহিলাশালায় আসছে। তাছাড়া সেদিন কাকনের নামে মিথ্যে গল্পটাও ওর পছন্দ হয়নি। কাকন বরাবরই কুকুর ভালোবাসে। আজ অব্দি কোনোদিন কুকুর দেখে ভয় পেয়েছে বলে ওর মনে পড়লো না।

আর সেদিনের ঘটনার পর আক্কাস যে কথা রটাচ্ছে কাকন ঠিক করে রেখেছে দুলাল সিরাজী মহিলাশালায় আসলে ও সব বলবে। এমন নোংরা মিথ্যে মন্তব্য মেনে নেওয়ার মতো মেয়ে কাকন নয়।

রুহুল কাজ শেষে মহিলাশালা থেকে বেড়িয়ে গেলো। সে অবাক হচ্ছে এই প্রথম তার এই সিরাজপুরে মন টিকছে। আর সেই সাথে অবাধ্য ইচ্ছেও। কিন্তু রুহুল জানে এই ইচ্ছে পুরণ হবার নয়। আবার হতেও পারে। কিন্তু পুরনো জখমের কথা ভেবে সায় দিতে ইচ্ছে করে না। তবে সে এক মোহে পড়ে গেছে, ভয়ংকর মোহ।
______________

দুলাল সিরাজী চালের আড়তে বসে ছিল। হাবিবুল্লাহ জানালো আক্কাস এসেছে।যদিও দুলাল সিরাজী নিজেই আক্কাসকে নিয়ে আসতে বলেছিল তাই সে অনুমতি দিলো আক্কাসকে। আক্কাস এসে সালাম দিলো।
দুলাল সিরাজী সালামের উত্তর নিলো।

আক্কাস জিজ্ঞেস করলো “তা আমারে এইভাবে ধইরা নিয়া আসার মানে কি?”
–“তুই নিজেই ভাইবা দেখ তারপর নিজে মুখে ক?”

আক্কাস ঢোক গিললো। হাজার হলেও সমাজের উঁচু শ্রেণির লোকদের সাথে বুঝে শুনে কথা বলতে হয়। তবুও বলল, “আপনে তো আমার কথা বিশ্বাস করবেন না কইয়া কি লাভ?”
–“করি কি করি না পরে দেখমু।তাই ক?”
–“আপনের বড় নাতি রুহুল তো মহিলাশালায় দিনরাত এহুন ঘুরঘুর করে। আপনে সেদিন বিশ্বাস করলেন না। আমি সচোক্ষে দেখছিলাম দুজন রে আইসতে।”

দুলাল সিরাজী আক্কাসের চুল টেনে ধরে বললো, “এই জন্য তুই আমার নাতির নামে মিথ্যা বদনাম ছড়াবি। তর জিভ খুইলা ফালামু। আমার নাতির নামে উত্তরপাড়ার দিক ভইরা গেছে যে মাইয়া নিয়া গেছিলো জঙ্গলে। তরে আইজই শেষ করুম।”

–“আমারে মাফ কইরা দেন সিরাজী আব্বা। তয় এইডা সত্য কসম আপনের নাতি ওই মহিলাশালায় ঘুরঘুর করতাছে ইদানীং। ওই মাইয়ারে মনে হয় পছন্দ করে। তয় আমি আর কাউরে কমু না। মাফ কইরা দেন। ”

দুলাল সিরাজী ছেড়ে দিলো তবে বলল,”আর যদি শুনি তর জান থাকব না। বিদায় হ”

আক্কাস জুতা হাতে নিয়ে দৌড়ে পালালো। লাগবে না শোধ নেওয়া। নিজে বাঁচলে বাপের নাম। তবে দুলাল সিরাজী নিজের দাড়িতে হাত বুলাতে লাগলো। মাথায় তার নতুন চিন্তা ঢুকে গেলো।
______________________

রাতে সবাই খাওয়ার শেষে উঠে গেলে দুলাল সিরাজী রুহুলকে বসে থাকতে বললেন। সবাই চলে গেলে দুলাল সিরাজী খেতে খেতেই বললেন, “তোমার লগে জরুরী কথা আছে?”
–“জি কি কথা দাদাজান?”
–“কিছু কি শুনছো?”
–“কি শুনবো? ”
–“গেরামে আক্কাস কি শুরু করছে তোমার নামে! ”

রুহুল শুনেছে সাজুর থেকে। তবে না জানার ভান করে বলল,”কি কিরছে?”
–“সেইদিনের ঘটনা নিয়া আমার কাছে বিচার দিছিলো আমি বিচার করি নাই দেইখা যা না তাই কইতাছে সিরাজপুরে।”
রুহুল হাসলো। বলল,”ও নিজেও ভালো করে জানে আমি কেমন। প্রতিশোধ এর জন্য এমন করছে!”

–“কিন্তু সিরাজপুরে আমার সম্মান আছে। সবাই যখুন শুনব তখুন বিশ্বাস করবো। আমার একটা মান আছে তাই তোমারে বিয়া দিবার চাই কুনু ভালো মাইয়া দিয়া!”

রুহুল স্পষ্ট ভাবে বলল,” না, আমি বিয়ে করবো না।”

দুলাল সিরাজী হাসলো। বললো” তাইলে কি আমি আক্কাস এর জন্য অন্য কুনু ব্যবস্থা নিমু?”
–“না, কোনো ভাবেই না। এটা পাপ ছেড়ে দেন!”
–“কিন্তু? ”
–“কোনো কিন্তু না দাদাজান। অনেক রাত হয়েছে আমি আমার কক্ষে গেলাম।
–“আচ্ছা। শুনো আগেই যাইয়ো না। কথা আছে! ”
–“আবার কি কথা? ”
–“তা তুমি এত ঘনঘন মহিলাশালায় যায়তাছো কেন?”
–“ওই এমনি কাজ দেখতে! ”
–“শুধু কাম দেখতে?”
–“হ্যাঁ আপনিই তো বলেছেন আমি যেন দেখাশুনা করি”

দুলাল সিরাজী রুহুলের কথায় বলল,”আমি তোমার বাপের ও বাপ। বুইঝা কথা কইয়ো রুহুল। ”

রুহুল স্বাভাবিক ভাবেই বলল,” কি বুঝবো?”
–“সত্যিই কি বুঝার কিছু নাই।”
–“কি থাকবে?”
–“কাকন রে কি তুমি পছন্দ করো?”

এই কথা শুনে রুহুল চলে যেতে চাইলো। দুলাল সিরাজী পুণরায় বলল,”ওরে কি চাও তুমি?”

–“পছন্দ করেই বা কি আর চাইলেই বা কি। আপনারাতো আর মেনে নেবেন না। বংশপরিচয়ই তো আপনাদের কাছে সব।”

–“হুম মাইয়া সুন্দর কিন্তু বংশ পরিচয় সবার আগে দরকার। সে যাইক তুমি আর যাইয়ো না। ”
-” কেন ভয় পাচ্ছেন যদি কিছু করি?”
–“পাই আবার পাই না। কারণ তুমি আমার বাধ্য আবার অবাধ্য ও!”

রুহুল এবার বের হতে উদ্যত হলো। তবে যাওয়ার পথে আবার ফিরলো। দুলাল সিরাজীর মুখোমুখি হয়ে বলল, “মেয়েটার নামে বদনাম হচ্ছে। আক্কাসকে বুঝিয়ে বলে দেন। আমি চাই না আমার ব্যক্তিগত শত্রুতার জন্য অন্য কেউ কষ্ট পাক। ”

রুহুল আর দাড়ালো না। সোজা চলে গেলো ভোজনকক্ষ ছেড়ে। দুলাল সিরাজীর খুশিতে চোখ চিকচিক করছে। রুহুলের চোখে স্পষ্ট কাকনের জন্য ভালো লাগা দেখতে পারছে দুলাল সিরাজী। কিন্তু এতিম মেয়েকে জমিদার বাড়ির বউ করা যে শোভা পায় না। সে কি করবে ভাবতে লাগলো।

সে রাতে দুলাল সিরাজীর ভালো ঘুম হলো না। সে অনেক চিন্তার পর সিদ্ধান্ত নিলো কাকনের সাথেই রুহুলের বিয়ে দিবে। বাকা হাসলো দুলাল সিরাজী।
_____________________

পরেরদিন বসারঘরে সবাইকে ডাকা হলো। বাড়ির ছোট বড় সবাই উপস্থিত সেখানে। গলা কেশে পরিষ্কার করে নিলো দুলাল সিরাজী। তারপর বললো, “আমি তুমাগো সবার উদ্দেশ্যে একটা জরুরী কথা কইবার চাই। ”

–“হ্যাঁ কন শুনি!”
–“আমি রুহুলের জন্য মাইয়া পছন্দ করছি। ওরে বিয়া দিবার চাই আমি!”

সকলের মুখেই হাসির দেখা মিললো। রুহুল অবাক হলো ওর অনুমতি ব্যতীত বিয়ের সিদ্ধান্ত। রুহুল কিছু বলার আগেই দুলাল সিরাজীর স্ত্রী বলল,”তাই সত্য। আমার মানিকের বিয়া তা মাইয়া কোন বংশের, কোন গেরামের?”
–“মাইয়া মহিলাশালার। সে যথেষ্ট সুন্দরী। বাপ-মা নাই এতিম। ওর নাম কাকন। ”

সকলেই অবাক হলো এবার সাথে রুহুল ও। দাদাজান কাকনের সাথে বিয়ে দেবে ওর বিশ্বাস হচ্ছে না। একটা এতিম মেয়ে মঞ্জিলের বউ হবে এতে জামাল প্রতিবাদ করে বলল, “কিন্তু আব্বা একটা এতিম মাইয়া এই মঞ্জিলের বউ হইবো এইডা কেমনে মানমু আমরা কন দেহি?”

–“আহ জামাল আমি যখুন কইছি তাই হইবো। কাকন যথেষ্ট ভালো মাইয়া।আর আক্কাস কি করতাছে সেইডা তো শুনছোই। ওইদিন বকুলতলায় অনেকজনই আছিল সিরাজপুরের।আমাগো সামনে কিছু না কইলেও আড়ালে বদনাম করতাছে। তাই এই সিদ্ধান্ত নিলাম। ”

দুলালের স্ত্রী বলল,”আপনের মাথা ঠিক আছে তো। আপনের মতো মানুষ ওমন মাইয়া ঘরে আনবেন?”
–“হ ঠিক আছে। আর এইডাই আমার শেষ সিদ্ধান্ত। যার আপত্তি আছে হেতি বিয়াতে না গেলেও হইবো। ”

রুহুল নিরুত্তর বসে আছে। যেন কোনো ভাবান্তর নেই। ওর মনে অন্যরকম সুখ অনুভব হচ্ছে। তবে এই বিষয়ে আক্কাসকে ধন্যবাদ দিতে ইচ্ছে করছে। হেলাল, মহীবুল সেদিনের ঘটনা শুনেছে এবং ভাবছে যে দুলাল সিরাজী মান সম্মানের ভয়ে একাজ করছে। কারণ দুলাল সিরাজী নিজের মানের জন্য যে কি কি করতে পারে সব ওদের জানা। হেলাল মহীবুল দুজনেই দুজনের দিকে তাকালো। ওরা এর ভিতরের বিষয় জানতে চাচ্ছে।

দুলাল সিরাজীর স্ত্রী বলল,”ওইসব মানমু না। আপনে আরো মাইয়া দেখবেন। যদি দেহেন তাইলে.. ”
–“থামো, কাকনই এই মঞ্জিলে রুহুলের বউ হইবো। ”
–“কিন্তু? ”
–“কুনু কিন্তু না। এইডা আমার শেষ ফয়সালা। ”

এরপর রুহুলের মায়ের দিকে চেয়ে বললো, “বড় বউমা তোমার আপত্তি নাই তো?”

সুভা রুহুলকে পরখ করলো। ভাবলো রুহুলের বিয়ের কথা চলছে অথচ রুহুল চুপচাপ কি করে। রুহুল কি তবে পছন্দ করেছে। অতপর সুভা বলল,”খোকা যদি রাজি থাকে আমার আপত্তি নেই।”

দুলাল সিরাজী বললো, “সে চিন্তা কইরো তোমার পোলা ও রাজি হইবো। আমি সব সিদ্ধান্ত নিয়া নিছি। সাতদিনের মধ্যেই বিয়া হইবো। ”

–“এত তাড়াতাড়ি কেন সিরাজী সাব!”
–“এমনেই। জৈষ্ঠ্য মাসে আমাগো বংশে বিয়ার নিয়ম নাই। তাই এই বৈশাখেই হইবো। আর সাতদিন পরেই হইবো। ”

–“ঠিক আছে। তয় আমি কাইল মাইয়া দেখবার যামু। যদি আমার পছন্দ হয় তাইলেই বিয়া হইবো কইয়া দিলাম”
–“তুমি নিশ্চিত থাকো বিলালের আম্মা,, তুমাগো সক্কলেরই পছন্দ হইবো। ”

সামিয়া বলে উঠলো, “দাদাভাই এর বিয়া আল্লাহ গো। আমার খুব খুশি লাগতাছে। আমি সেই মজা করমু।”

সামিয়ার কথায় সবাই হাসলো। সেই সাথে রুহুল ও। তার হৃদয়ে যে প্রণয়ের পায়রা উড়ছে।
_____________________

বিকেলের শেষ সময়ে দুলাল সিরাজী মহিলাশালায় উপস্থিত হল। ফাতিমাকে ডাকলো। ফাতিমা তার সামনে গেলেই বললো, “একখান প্রস্তাব আছে ফাতিমা?”

–“জি কি প্রস্তাব? ”
–“আমি কাকন রে বিয়া করাইতে চাই।”
–“মানে? ”
–” আমার নাতি রুহুলের লগে ওর বিয়া দিবার চাই! তোমার কোনো আপত্তি নাই তো”

ফাতিমা যেন অবাকের চরম সীমানায়। একটা এতিম মেয়েকে সিরাজী মঞ্জিলের বউ করাবে ফাতিমা ভাবতেই পারছে না। ফাতিমা বলল,”কিন্তু সিরাজী আব্বা আপনেরা এত বড় মানুষ ওরে বউ করতে চান। আপনাগো বাড়ির বউ হওয়া ওর শোভা পায় না!”

–“সেইডা নিয়া তুমি ভাইবো না। আর রুহুল কেমন পোলা তুমি নিজেও জানো। সেদিনের ঘটনা যদি জাইনা থাকো আশাকরি বাধা দিবা না। আর তুমি রাজি না হইলেও বিয়া হইবো। কাকনের দায়িত্ব তোমার তাই তোমারেই কইলাম। ”
–“জি কিন্তু সবাই রাজি তো! ”
–“হ সবাই রাজি।আর আমি চাই সাতদিনের মধ্যেই মিয়া করাইতে।
–“এত তাড়াতাড়ি? ”
–“হুম, আর শুনো কাইল আমার মঞ্জিলের ঝি-বউরা আইতে পারে ওরে দেখার জন্য। কাকন রে তয়ার কইরা রাইখো। আর বিয়ার সব দায়িত্ব খরচ আমাগোই। তুমি খালি দেখবাল করবা। আমি চললাম।”

দুলাল সিরাজী চলে গেলো। তবে ফাতিমার মনে প্রথমে আতঙ্ক কাজ করলেও এখন ভালো লাগছে। রুহুল নিশ্চিন্তে সুযোগ্য পাত্র বিয়ে দেওয়া যায়। আর না দিয়েও উপায় কি কাকনের নামে যে বদনাম ছড়াচ্ছে তাতে ভালো বিয়ে নাও হতে পারে। মহিলাশালায় আরও কত মেয়ে আছে। এসব ভাবনা ভেবে ফাতিমা নিজ কাজে মন দিলো।

বিয়ের কথা শুনে কাকনের মাথায় যেন বাজ পড়লো। সে কিছুতেই বিয়ে করবে না। কাকনের কান্না থামছেই না। সন্ধ্যার পর ফাতিমা কাকনের কাছে এলো। বলল,”হইছে আর কত কানবি। ”
–“আমি বিয়ে করবো না আপা। ”
–“তুই বিয়া করবি না কইলেই কি হইবো নাকি। বিয়া সবারই করা লাগব।আর সে যেইডা কইছে সেইডা অমান্য করার সাহস নাই আমার। ”
–“সবাই করলেও আমি করব না।”

ফুল, রিতা, নুপুর ওরাও কাকনকে বুঝাতে শুরু করলো। বলল,”দেখ কাকন তুই বুঝার চেষ্টা কর। তারা কিন্তু মানুষ মন্দ না। যথেষ্ট ভালো।”
–“আমি জানি তারা ভালো কিন্তু আমি বিয়ে করব না”

ফাতিমা এবার ক্ষীপ্ত হয়ে বললো, “তুই বিয়া না করলে তুই কই থাকবি। আমাগো পেটের ভাত, গায়ের পোশাক সব সিরাজীরা দেয়। অন্তত এইডা তো ভাব। আর ওই আক্কাস তর নামে যেগুলা ছড়াইছে কেউ তরে বিয়া করবো এইগুলা শুনলে। তার চেয়ে রুহুল সাবরেই বিয়া কর। রানির হালে থাকবি। ”

কাকন শুধু ফাতিমার কথা শুনছে। ফুল বলল,”রাজি হইয়া যা কাকন। আপা ঠিকই কইছে। রাজি ছাড়া গতি নাই আর রুহুল সিরাজী সিরাজপুর সেরা পোলা। তরে ভালো রাখবো। ”

নুপুর বলল,”আমাগো মাফ কর। ওইদিন যদি তরে না হারাইতাম এত কিছু হইতোই না। তয় বিয়াতে রাজি হইলে তরই সুখ।”

কাকন সকলের কথা শুনে মাথা নিচু করে ফেললো। যে যাই বলুক সে বিয়ে করতে চায় না। তার যে খুব সাধ সে সেবিকা হবে।
ফাতিমা কাকনের মাথায় হাত বুলিয়ে দিলো। বললো, “মা রে মাইয়া মানুষ হইলো ফুলের মতো যতদিন গাছে থাকব, সুবাদ ছড়াইবো ততদিনই দাম। সময় শেষে ফুল যেমন পইড়া থাকে মাইয়া মানুষ ও তাই। তখন কুনু দাম নাই। তাই তর উচিৎ বিয়া ডা করা। রুহুল সিরাজী তরে সুখে রাখবো দেখিস। ”

কাকন ফাতিমাকে জড়িয়ে ধরে কেদে দিলো। মেয়ে হয়ে জন্ম নেওয়াটা তার কাছে পাপ মনে হচ্ছে। কেন যে গিয়েছিল সেদিন মেলায় ভাবতেই আফসোস করছে। বারবার বলছে আমি বিয়ে করতে চাই না আপা। আমায় রেখে দেন আপনার কাছে।
___________

একদিকে কাকনের বেদনা অন্যদিকে রুহুলের হাসি।

চলবে,,,,,,,,,

শবনম রাবাহ ✍️

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here