দেবী,১৫,১৬

0
386

#দেবী,১৫,১৬
লেখিকাঃ শবনম রাবাহ (স্রোতস্বিনী)
কপি করা সম্পুর্ণ নিষেধ।
১৫ঃ

বাইরে কাল বৈশাখী ঝড় শুরু হয়ে গেছে। বিকেল বেলায় যার আভাস পাওয়া গিয়েছিল তা এখন বাস্তব রুপধারণ করেছে। মুষলধারে বৃষ্টির সাথে প্রবলবেগে ঝড় হচ্ছে। হয়তো প্রকৃতিও আজ রুহুল-কাকনের ভালোবাসার প্রনয়ের সাক্ষী হতে চায়।

দরজার কাছে এসে ইচ্ছে করে ” উহুম উহুম” শব্দ করে কেশে উঠলো রুহুল। এতক্ষণ কাকন কে নিয়ে সামিয়া,আলেয়া,রোকেয়া আর পারুল বাসর ঘরে যে আড্ডায় মেতে ছিল রুহুলের আগমনী বার্তায় তা খতম হলো। রুহুলের গলার শব্দ শুনে কাকন সোজা হয়ে বসলো। রোকেয়া কাকনের মুখ বিরাট ঘোমটা টেনে ঢেকে দিলো। সকলেই মুখ চিপে হেসে বের হয়ে গেলো। দরজার বাইরে দাঁড়িয়ে ছিল রুহুল। বোনেরা বের হয়ে যাওয়ার পর রুহুল কক্ষে প্রবেশ করলো। দরজা আটকিয়ে দিয়ে খাটের কাছে আসলো। বড় ঘোমটা টেনে থাকা নববধু কে দেখলো। রুহুল কাকন এর কাছে বসলো। ঘোমটা তুলে ডান হাত দিয়ে কাকনের থুতনি উচু করে মুখপানে চেয়ে রইলো। কাকন লজ্জায় চোখ বন্ধ করে ফেললো। কাকনের লজ্জা মাখা মুখ রুহুল কে আরো পাগল করে দিলো। পলকহীন ভাবে চেয়ে রইলো কাকনের মুখশ্রীতে। না জানি কত দিনের তৃষ্ণা মেটাচ্ছে এই মুখ খানি দেখে। বেশ কিছুক্ষণ পর কাকন চোখ খুললো। চোখ খুলে রুহুল কে ওভাবে তাকিয়ে থাকতে দেখে আরো বেশি লজ্জা পেয়ে গেলো কাকন। তারপর নিজেকে ছাড়িয়ে কিছু টা দূরে সরে বসলো কাকন।

কাকনের সরে যাওয়াতে রুহুলের ঘোর কাটলো। হেসে বললো, “আসসালামু আলাইকুম বিবিজান।”

“বিবিজান” ডাক শুনেই কাকনের আবার সেই দিনের মতো হৃদয়ে ঘুর্ণিঝড় অনুভব হলো। কাপা কাপা কণ্ঠে বলল, “ও…ওয়ালাইকুম সালাম।”

রুহুল বলল, ” চলুন নামাজ পড়ে নেই। পড়তে আপত্তি নেই তো। ”
কাকন মাথা নেড়ে সম্মতি জানালো সে পড়বে।

দুজন দু রাকাত নফল নামাজ পড়ল। নামাজ শেষে কাকনের মনে হলো আলেয়া বলেছিল স্বামী কে সালাম করতে হবে।অথচ কাকন ভুলে গিয়েছে। রুহুল জায়নামাজ ভাজ করে আলনায় রাখার পর কাকনের কাছে দাড়ালো। কাকন ঝুকে রুহুল কে সালাম করতে পায়ে হাত দেবে ওমনি রুহুল পিছিয়ে গেলো। তারপর কাকন কে বললো,” সালাম করতে হবে না আপনার এই হাত আমার হৃদয় স্পর্শ করার জন্য পায়ের জন্য নয়।”

কাকন আর কিছু বললো না শুধু দৃষ্টি নিক্ষেপ করে রাখলো মেঝেতে। রুহুল আবারো বলল,”আমার কাছে আসুন বিবিজান, আপনাকে মন ভড়ে দুয়া করে দেই।”

তারপর কাকনের হাত ধরে বিছানায় পাশাপাশি বসলো।কাকনের মাথায় হাত রেখে দুয়া করলো।দুয়া করা শেষে উঠে দাড়ালো রুহুল। আলমারি খুলে একটা সুক্ষাকাজ করা ছোট কাঠের বাক্স কাকনের হাতে দিলো। দিয়ে বললো, “বাসর রাতে স্ত্রী কে উপহার দিতে হয়। এটা আপনার উপহার তবে আজ খুলবেন না এটা আপনি সেদিন খুলবেন যেদিন আপনি আমাকে মনেপ্রাণে জীবনঙ্গী হিসেবে ভালোবাসবেন।”

রুহুলের কথা শুনে কাকন রুহুলের মুখপানে তাকালো। রুহুল আবারো বললো,” এখন এটা ভাবতে হবে না যে আপনি তো আমার জন্য উপহার আনেননি। আমার জন্য জীবনের শ্রেষ্ঠ উপহার হলো আপনি সয়ং নিজে বিবিজান। ”

রুহুলের এত সুন্দর ভালোবাসার বহিঃপ্রকাশে মুগ্ধ হলো কাকন। এই মানুষ টা কত সুন্দর করে কাকন কে বুঝতে পারছে। কাকন রুহুলের মুখশ্রী পর্যবেক্ষণ করতে লাগলো।তারপর কাকন হাতে হাতে রাখা উপহার বাক্সের দিকে আঁখি নিবদ্ধ করলো।

রুহুল কাকনের হাতটা ধরে বললো, ” আমি কি আপনাকে বিশ্বাস করতে পারি বিবিজান? ভালো বাসার খুটি হলো বিশ্বাস। বিশ্বাস ছাড়া ভালোবাসা ভিত্তিহীন। নিজের সবটুকু দিয়ে কি আমাকে ভালোবাসার সুযোগ দেবেন,আমি সারা জীবন আপনাকে বিশ্বাস করতে চাই, সারাটি জীবন আপনাকে ভালোবেসে আকড়ে ধরে বাঁচতে চাই, আপনি কি আমাকে সেই সুযোগটি দেবেন বিবিজান?”

কাকন নিরুত্তর। এত সুন্দর করে রুহুল তাকে ভালোবাসার প্রস্তাব টি দেবে সে তা ভাবতেও পারে নি।এর চেয়ে সুন্দর প্রস্তাব কি দুনিয়ায় আদোও দ্বিতীয় টি হতে পারে। জানা নেই কাকনের। কাকনের চিরশত্রু ব’দজাত অনুভুতিরা যেন বার বার ওসকাচ্ছে কাকনকে রুহুলের ডাকে সাড়া দিতে।

–“কি হলো বিবিজান দেবেন না সুযোগ?”
কাকন দৃষ্টিনত রেখেই বলল,”জ,,জি দিলাম সুযোগ।”

রুহুল কাকন এর সম্মতিতে খুশি হয়ে হাতটি ধরে চুমু খাবে ওমনি লজ্জায় দূরে চলে গেলো কাকন। কাকনের সারা অঙ্গে যেন শুরশুরি অনুভব হলো।এই শীতল বাতাসেও হাত পায়ের তালু ঘামচে যেন । রুহুল হেসে কাকন কে কাছে নিয়ে এসে বিছানায় নিজের বুকে জড়িয়ে নিতে চাইলেই লজ্জায় রাঙা হয়ে গেলো কাকন। কাকন নিজেকে ছাড়াতে চেষ্টা করলো। রুহুল আরো শক্ত করে জড়িয়ে ধরলো কাকন কে। তারপর বললো,”বিবিজান যতই নিজেকে আমার থেকে ছাড়াতে চান না কেন, আমি কিন্তু ছাড়বো না। নিজের বুকে যখন একবার জড়িয়ে ধরেছি আপনাকে, সারা জীবনেও এই বুক থেকে আপনার নিস্তার নেই।”

রুহুলের মধুময় কথায় কাকন নুইয়ে পড়লো তার অর্ধাঙ্গের বুকে। রুহুল কাকন কে বুকে নিয়ে আধশোয়া ভাবে জড়িয়ে ধরলো।এবার কাকনের গায়ের গয়না গুলো খুলে দিতে দিতে বললো, ” আজ আমি আপনাকে আমার বুকে নিয়ে ঘুমাবো। এই কয়দিন আমার বিবিজানের চিন্তায় রাতের ঘুম হারাম হয়ে গিয়েছিল। আজ সুখের নিদ্রা চাই আমার। আর আজকের রাত টা তোলা রইলো। আমার হক আমি সঠিক সময় আদায় করবো। আর সেই সুন্দর মুহুর্তের ইন্তেজার করতে পারবেন তো আপনি?”

কিছুক্ষণ পর ছোট্ট উত্তর দিলো কাকন,”হুম”

–“শুধুই হুম। অসন্তুষ্ট হলেন নাকি বিবিজান?

–”ন,.না”

–” ধন্যবাদ বিবিজান। আপনার এই কিশোরী মন অনেক কিছু আশা করতে পারে। আর অনেকেই অনেক কিছু বলেছে হয়তো আপনাকে। কিন্তু আমি জানি এখন আপনার ঘুমের প্রয়োজন। একটা কথা মনে রাখবেন যে যা ই বলুক আপনি শুধু আমাকেই মানবেন। বাকি সব আমি মানিয়ে নেবো।”

রুহুলের কথা এবং আচরণে কাকনের মনের এক চাপাকষ্ট দূর হয়ে গেলো।রুহুলের প্রতি আরো ভালোলাগা জন্মালো। অহেতুক চিন্তা করেছে কাকন এতদিন। অতপর রুহুল তার স্ত্রীকে আরও কাছে টেনে যখন কপালে চুমু দিলো। স্বামীর অধরের এর ছোয়াতে আবারো সর্বাঙ্গে কাপতে শুরু করলো কাকনের। রুহুল গালে কাকনের চুমু দিলো। এবার রুহুলের নিশ্বাস লাগলো কাকনের গলার কাছে ঠিক তখন ই রুহুলের শিমুল ফুল রঙা বউ স্থির হয়ে গেলো। স্রীর কাপা থেমে যখন শান্ত হয়ে গেলো তখন রুহুল তাকিয়ে দেখলো তার বিবিজান অচেতন হয়ে গেছে । বাদামি ঠোঁট জোড়া আপনা আপনি ঠোঁট প্রসস্থ হলো রুহুলের, নিরব হাসি দিলো। রুহুল তো কেবল চুম্বন দিতে চেয়েছিল।এইটুকুতেই ভয়ে তার বিবিজান কুপকাত। সে তো বলেছেই সঠিক সময়ে হক আদায় করবে। এই সামান্য সোহাগেই তার বিবিজান প্রচন্ড ভয় পেয়েছে। ভেবে হাসতে হাসতে বুকে আরো শক্ত করে জড়িয়ে ধরলো কাকন কে। কালবৈশাখীর ভয়াবহ প্রলয়ে সুখের ঘুমে ঘুমিয়ে পড়লো নব কপোত-কপোতী।
____________________

অন্যদিকে মাল খেয়ে টাল হয়ে আছে বকুল আর রুহুলের বোন স্বামীরা। বিদেশি মদ খেয়ে অবস্থা বেহাল। দরজার কাছেই নাক ডেকে ঘূমোচ্ছে লতিফ। যার জন্য প্রচুর বিরক্ত লাগছে বকুলের। যেন কোনো ষাড় হাম্বা হাম্বা করছে ঘুমের ঘোরে। আর আবোল তাবোল বকে যাচ্ছে দুই দুলাভাই। আর দুজনের ই বকাবকির কারণ হলো নিজেদের স্ত্রী। মুখে যা আসছে দুজনেই বলে যাচ্ছে। অন্যদিকে বকুল নেশার ঘোরে বার বার সামিয়ার হাস্যজ্জল চেহারা দেখতে পাচ্ছে। কানের কাছে খালি বারবার ভাসছে সামিয়ার হাসির ধ্বনি। ইচ্ছে করছে সামিয়া কে কাছে টেনে নিতে।আজ সারাদিনে একবারের জন্যও সামিয়া তার সামনে আসে নি। মুখোমুখি হলেও বকুলকে উপেক্ষা করে গেছে সামিয়া। যার জন্য বেশ রাগ লেগেছিল বকুলের।জীবনের প্রথম কোনো নারীকে ভালো লেগেছে আর সেই নারী কি না অবজ্ঞা করে বকুলকে। বকুল আবারো দেখলো সামিয়া হাসছে। বকুল উঠে দাড়ালো সামিয়া কে ধরে হাসি থামাবে।কিন্তু ধরতেই পারছে না। চেয়ারে মাথা দিয়ে মেঝেতে বসে আছে দুই দুলাভাই। তাদের ডিঙিয়ে দরজার খুললো।সে এখন সামিয়ার ঘরে যাবে।

ঢুলতে ঢুলতে সামিয়ার দরজা খুলে প্রবেশ করলো বকুল। হারিকেন জ্বালানো আছে টেবিলের উপর। বিছানায় হাত পা গুটিয়ে ঘুমিয়ে আছে সামিয়া। বিদ্যুৎ চমকাচ্ছে আর সেই আলোর রেশ পড়ছে সামিয়ার মুখশ্রীতে। সেই সৌন্দর্যে আরও মুগ্ধ হলো বকুল। টেবিলের উপর রাখা নিভু নিভু হারিকেনের আলোয় সামিয়াকে একদম কাছে থেকে পরখ করলো বকুল। এলোমেলো চুলে ঘুমন্ত প্রেয়সী কে দেখে আরো তাড়াতাড়ি আপন করার বাসনা জেগে উঠলো মনের কোণে। সামিয়াকে ছুয়ে দিতে ইচ্ছে করছে বারবার।কিন্তু নিজের দ্বারা যেন কোনো অন্যায় যেন ঘটে না যায় এই ভয়ে প্রস্থান নিতে চাইলো। সামিয়ার গায়ের কাথা টা ঠিক করে দিয়ে কানের কাছে যেয়ে বললো, “ভালোবাসি সামিয়ারানি।”
আস্তে করে দরজা চাপিয়ে দিয়ে আবার ও নিজের ঘরে এলো বকুল। লতিফসহ বাকি দুজন কে ডাকলো। কেউ সাড়া দিলো না অগত্যা বকুল ঘরের আলো নিভিয়ে বিছানায় উপুড় হয়ে শুয়ে পড়লো।
____________________________

সকালে ঘুম ভাঙলো রুহলের আগে। আজ বহুদিন পর রুহুলের শান্তির ঘুম হয়েছে।চোখ খুলে বুকে তার বিবিজান কে আবিষ্কার করল রুহুল। রুহুল এক ভাবে তাকিয়ে রইলো তার অর্ধাঙ্গিনীর দিকে। ঘুমন্ত অবস্থায় একদম বাচ্চা বাচ্চা লাগছে। কিছু একটা ভাবলো ভেবে হাসিতে তার ঠোঁট আরো প্রসারিত হলো। কিছুটা জোরেই হাসলো রুহুল। হাসির ধ্বনিতে কাকন নড়েচড়ে উঠল। একটু পর কাকন ও জেগে উঠলো। কাকনের মাথা কেমন যেন ভার ভার লাগছে। নিজেকে রুহুলের বুকে থাকতে দেখে চমকালো। তারপর রাতের কথা মনে পড়তেই লজ্জায় সে তার স্বামীর থেকে সরে আসতেই রুহুল আরো কাছে টেনে নিলো।
–“ঘুম কেমন হলো বিবিজান?”
–” ভা,,,ভালো।”

রুহুল কাকন এর মুখে পড়া চুল গুলো কানের পিছনে দিয়ে দিলো। তখনি দরজায় কারো করাঘাতের শব্দ পেলো।
–“দাদাভাই,ভাবিজান এখন উঠেন। দাদিমা তাড়াতাড়ি উঠতে কইলো”

রুহুল কাকন কে ছেড়ে দিলো। কাকন বিছানা থেকে নেমে নিজেকে ঠিক করে মাথায় কাপড় দিলো। তারপর রুহুল দরজা খুলে দিলো। দরজা খুলে বাইরে ছোট বোন দের দেখতে পেলো রুহুল। একপলক কাকন কে দেখে বাইরে বেড়িয়ে গেলো রুহুল। বিছানার কাছে দাড়িয়েই ছিল কাকন। কাকন এর কাছে এসে সকলেই মুখ চিপে হাসতে লাগলো।আলেয়া বললো, ” কি গো ভাবিজান, রাইতে ঘুম কেমন হইলো আমাদের বাড়িতে।”

রোকেয়া হেসে বলল,” কি যে কও না আপা,,দাদাভাই কি আর ঘুমাইতে দিছে যে ঘুমাইবো।”

–“হাহাহা,,ঠিক কইছোস,,”

পারুল এবার বলে উঠল,”তোমাদের মজা নেওয়া হইলে ভাবিজানরে তৈরি কইরা বাইরে নিয়া চলো নানিমা কিন্তু তাড়াতাড়ি নিয়া যাইতে কইছে।”

সামিয়া কাকনের মাথার কাপড় টা ফেলে চুল এলোমেলো করে দিয়ে গালটা টেনে বললো, “হইছে আপারা তোমরা এখন আমার ভাবিজানরে এত প্রশ্ন করা বন্ধ করো।আর এই যে ভাবি ডুব দিয়া এই লাল শাড়ি ডা পড়তে কইছে দাদিমা, পইড়া তাড়াতাড়ি চলো আমাগো লগে।”

কাকন কে নিয়ে গোসলখানা দেখিয়ে দিলো সামিয়া। কাকন গোসল করে শাড়ি পড়ে তৈরি হয়ে নিলো ।তারপর ননদদের সাথে বের হলো । সবাই মিলে কাকন কে বসার ঘরে নিয়ে গেলো । সেখানে দাদিশাশুড়িসহ অনেক মহিলাকেই দেখলো কাকন। সবাইকে হাসিমুখে সালাম দিলো। কাকনের আগমনে খুশি হয়ে দাদিমা বললো, ” আরে নাতবউ আয় তুই আমার কাছে আয়। তরে পাকঘরে আমি নিয়া যামু। নিয়ম অনুযায়ী সক্কলের জন্য যে ভাত রান্দা হইবো তুই ওই ভাত নিজে ভাত বাইড়া দিবি,আর কাইল থিকা তুই রানবি ভাত ।”

কাকন মাথার আচল ঠিক করে বললো,”জি দাদিমা।”

দাদিমার হাত ধরে কাকন রন্ধনশালায় পা রাখলো।প্রথম রন্ধনশালায় ঢুকে আবারো অবাক হলো কাকন এত বড় রান্নাঘর কাকন আগে দেখে নি। হেশেল অনেক বড়। রান্নাঘরের হাড়ি দেখেই বুঝতে পারল এগুলো বেশ পুরোনো।
নিয়ম অনুসারে বড় থালায় ভাত বেড়ে দিলো কাকন। সেই ভাত রানু ভোজনকক্ষে নিয়ে গেলো। রান্নাঘরে বসেই মহিলা দের খাওয়ার নিয়ম।আর পুরুষেরা ভোজন কক্ষে খায়। সে নিয়ম অনুযায়ী সকল মহিলাদের সাথে খেতে বসলো কাকন।

আসমা কাকন কে বললো,”শোনো বউ এই বাড়ির বড় বউ হইছো দায়িত্ব কিন্তু বেশি তোমার। আর আইজকা দেরি কইরা উঠছো ঠিক আছে,, কাইল থিকা সকাল সকাল উঠবা। এই মঞ্জিলের বউগো কিন্তু ফজরের পর ঘুমানের নিয়ম নাই। ”

সুভা আসমা কে থামিয়ে বললো,” আসমা তুমি ওকে আজই এগুলো বলো না। ধীরে ধীরে আমিই আমার ছেলের বউ কে আমার মতো করে গুছিয়ে নিবো।”

মালেকা বরাবরই সতীন কে ছোট করার সুযোগ খোজে। এই সযোগে বলে উঠলো,” আসমা তো ঠিক ই কইছে আপা,আপনে পোলাবউ রে এহোন থিকাই তো ঠিক করবেন। আদরে মাথায় তুললে কিন্তু পরে আবার মাথা থিকা নামাইতে পারবেন না।”

–“আমার ছেলের বউকে সংসারী করে তোলার দায়িত্ব আমার। আমি কারো মতামত চাই না মালেকা। আর আজ দেরি করে উঠেছে বলে আমি মনে করি না। নতুন জায়গায় এসে মানিয়ে নিতে সময় লাগে। তাই আজকের দিনে এগুলো বলা বন্ধ করো।তাছ….”

দাদিমা সকলের উদ্দেশ্য বললেন,”হইছে সক্কলেই চুপ করো এহোন। বাড়ি ভর্তি মেহমান কি ভাববো কও দেহি,চুপচাপ খাইয়া দুপুরের লিগা তয়ার হও সবাই।”

এতক্ষণ নিরব হয়ে সব শুনছিল কাকন। বিয়ের পরের দিন ই এভাবে তাকে নিয়ে ছোট খাটো কথা কাটা কাটি তে তার ভীষণ খারাপ লাগলো। অচেনা জায়গা রাতে দেরি করে ঘুমিয়েছ তাই এমন হয়েছে। আমনে মনে পণ করলো কাকন সে আর কোনোদিন ও দেরি করবে না। কারণ এ বাড়ি তো আর মহিলাশালা নয়। সত্যিই সিরাজী মঞ্জিলের বাইরে এক ভিতরে আরেক। দীর্ঘশ্বাস ছাড়লো কাকন।

চলবে…….
#দেবী
#শবনম_রাবাহ
#দেবী
লেখিকাঃ শবনম রাবাহ (স্রোতস্বিনী)
কপি করা সম্পুর্ণ নিষেধ।
১৬ঃ

দুপুরে সিরাজী মঞ্জিলের ফাকা জায়গায় বৌভাতের আয়োজন করা হয়েছে। শত শত মানুষ কে খাওয়ানো হচ্ছে। সকল আত্মীয়স্বজন, ব্যবসার সঙ্গী সহ কয়েক হাজার মানুষকে খাওয়ানো হচ্ছে। বহুবছর পর এমন ভাবে খেয়ে সিরাজপুর বাসী খুব ই সন্তষ্ট। দুলাল সিরাজী এগুলো পর্যবেক্ষণ করছে। আর রুহুল, মহীবুল, হেলাল, ওরা সব কিছু হাতে হাতে সামলাচ্ছে। এত মানুষের খাওয়ার আয়োজনে চাকর চাকরানিদের ও নাজেহাল অবস্থা। বার ছোটাছুটি করতে হচ্ছে।

রুহুলের মনে কাকন কে একপলক দেখার প্রবল ইচ্ছে জেগেছে। না জানি কত সুন্দর লাগছে তার বিবিজান কে। কিন্তু কাজের ব্যস্ততায় সকাল এর পর আর দেখাই মেলে নি । তাই মনে মনে সিদ্ধান্ত নিলো দাদাজান যতই কথা শুনাক সুযোগ পেলেই ফুড়ুৎ করে গিয়ে এক পলক দেখেই চলে আসবে।
___________________

কাকন সকল মহিলাদের সঙ্গে বসে আছে অন্দরমহলের বসার ঘরে। তাকে আজকে আবারও আরেকদফা সাজানো হয়েছে। এরকম সাজে তার দম বন্ধ হয়ে আসছে। একেই তো এত ভারী গয়নাগাটি, তার ওপর ভারী শাড়ি, গ্রীষ্মের গরম সব মিলিয়ে দম বন্ধকর অবস্থা। সবাই সিরাজী মঞ্জিলের নতুন বউ দেখতে এসেছে। সকলেই কাকনের রুপ দেখে মুগ্ধ হলো। কাকনের রূপের প্রশংসা করছে। কাকনের কথাবার্তা আর নমনীয়তায় সকলেই মনে-প্রাণে কাকন কে পছন্দ করলো এ যেন রুহুলের জন্য যোগ্য বিবাহিতা স্ত্রী।
কিছুক্ষণ পর উপস্থিত হলো ফাতিমাসহ কাকনের মহিলাশালার সকল মেয়েরা। কাকন উঠে জড়িয়ে ধরলো ফাতিমাকে। ফাতিমাসহ সকলেই আজ এক অন্য কাকন কে দেখলো। কে বলবে এই সেই মহিলাশালার কাকন। একদম সিরাজী মঞ্জিলের গিন্নীদের মতো লাগছে।
কাকন ফাতিমাকে জড়িয়ে ধরেই কেদে দিলো।এক দিনের ব্যবধানে দুজনেরি মনে হলো যেন একযুগ পর দেখা। ফাতিমা বললো,” কাকন,মা আমার কান্দে না,,দেখ আমি তো চইলা আইছি। তুই কি এইখানে কষ্টে আছা যে কান্দোস,,থাম মা আমার।”

ফুল কাকনের কাধে হাত রেখে বললো,”কাকন কান্না থামা,,তরে দেখার জন্যই তো আইছি আমরা। দেখি চোখ মোছ।”

রিতা হাসতে হাসতে কাকন কে জড়িয়ে ধরে বলল,”বাহ রে কাকন তরে একদম রানীর মতো লাগতাছে।”

কাকন চোখ মুছলো।হেসে দিলো রিতার কথায়। তারপর কাকন সকলের সাথেই কথা বললো।

–“হইছে এখন সক্কলে বইসেন ভবির কাছে। কান্নাকাটি বন্ধ করেন।” সামিয়ার কথায় সকলে বসলো। ফাতিমা সিরাজী মঞ্জিলের মহিলাদের সালাম দিলো।

ফাতিমা দুলাল সিরাজীর স্ত্রীকে সালাম করে পায়ের কাছে বসেই বললেন,” আম্মা,,আইজ কি কাকন রে আমার লগে নিয়া যাইতে পারুম আমি, আপনে অনুমতি দিলে নিয়া যাইতাম? ”

দাদিমা বললো, “না যেহেতু নিয়ম মতো সুয়ামির ও যাওয়া লাগে রুহুল তো যাইতে পারবো না মহিলাশালায়। আরও মাইয়ারা থাকে ওইখানে আমার নাতি আর নাতি বউ রে পাঠামু না।”

মন খারাপ হয়ে গেলো ফাতিমা আর কাকনের। ফাতিমা বুঝতে পারলো সে চাইলেও আর কখনো মুখ ফুটে কাকন কে নিজের কাছে নিয়ে যাওয়ার কথা বলতে পারবে না। মুখে মিথ্যে হাসি টেনে বললো,”জি সিরাজী আম্মা,,,আপনে যা কইবেন তাই হইবো।”

কাকনের খুব বলতে ইচ্ছে করছে আমি যাবো।দয়া করে আমাকে যেতে দিন দাদিমা। কিন্তু মনের কথা জিভ অব্দি টানতে পারলো না কাকন। নববধুর মুখ ফুটে কিছু বলা যে বেমানান।
_____________________

সামিয়া সিড়ি বেয়ে নিজের কক্ষে যাচ্ছিলো। বকুল সামিয়ার হাত ধরে একপ্রকার জোর করেই নিজের কক্ষে নিয়ে গেলো। সামিয়া ভয় পেয়ে গেলো বললো,
–“আ,,আপনি দরজা আটকাইলেন কেন?”

–” কাল থেকে আমাকে এভাবে এড়িয়ে যাচ্ছো কেন তুমি,,তুমি বোঝো না কতটা চাই আমি তোমাকে?”

বকুলের এমন কথায় ভড়কে গেলো সামিয়া।
–“দেখেন ভাই দরজা খোলেন, এইভাবে আমারে নিয়া এক কক্ষে আছেন লোক জানাজানি হইলেই কেলেংকারী হইয়া যাইবো। আর তাছাড়া দাদাজান জানলে আপনের নিজের ই বিপদ।”

–“হোক বিপদ। আমি কিছুই ভয় পাই না।” বলেই সামিয়ার হাত ধরলো। তারপর আবার ও বললো,”আমি তোমাকে ভালোবাসি সামিয়া, বিবাহ করতে চাই। ভয় নাই আমি রুহুলকে বলেছি আমার মনের কথা। আশা করি ওর পক্ষ থেকে কোনো আপত্তি নাই। আজ আমি চলে যাবো কিন্তু যাওয়ার আগে তোমায় নিজের মনের কথা বলে গেলাম যাতে তোমার হৃদয়ে অন্য কাউকে জায়গা না দিতে পারো। আজ চলে যাবো ঠিক ই কিন্তু আল্লাহ তায়লা ভাগ্যে রাখলে আগামীবার যখন আসবো আব্বা-আম্মা কে নিয়ে আসবো আর তোমার আমার বিয়ে ঠিক করে তারপর ই যাবো। শুধু বলবো অপেক্ষা করতে পারবে তো আমার জন্য?”

সামিয়ার যেন মাথা শুন্য শুন্য লাগছে। লোকটা তাকে এত করে চায়। ইচ্ছে তো করছে সায় দিতে কিন্তু দাদাজান আর ভাইদের ভয়ে বলার সাহস পাচ্ছে না সামিয়া।

বকুল আবারো বলল,”তোমার উপর নির্ভর করছে আগামীতে আমার এ বাড়িতে আসা। তোমার মতামত শুধু একবার জানাও বিশ্বাস করো সবাইকে মানিয়ে নেবো”
বকুলের চোখে অসীম ভালোবাসা দেখে দিধায় পড়লো সামিয়া।কিন্তু বকুল যে ওর উত্তরের অপেক্ষা করছে। এ কয়দিনে তো সামিয়ার ও বকুল কে ভালো লেগেছে।সামিয়া মাথা নিচু করেই মাথা উপর-নিচ করে সম্মতি জানালো। বকুল মুচকি হেসে সামিয়াকে আলিঙ্গন করতে চাইলো ওমনি সামিয়া দৌড়ে দরজা খুলে পালালো।

বকুলের আজ নিজেকে পরিপুর্ণ মনে হচ্ছে। এবার শুধু বাবা-মাকে রাজি করানোর পালা। তারপর প্রস্তাব দেবে দুলাল সিরাজীর কাছে। তারপর সামিয়া কে সে নিজের রাজ্যে নিয়ে যাবে। এখন রুহুলের সাথে দেখা করে রওনা হতে হবে। ট্রেন ছাড়বে ছয়টায়। বকুল রুহুলের সাথে দেখা করে বিদায় নেবে সিরাজপুর থেকে । কিন্তু তবুও মন টা খারাপ ই লাগছে প্রেয়সী কে ছেড়ে যাওয়ার বেদনায়।এসেছিল বন্ধুর বিয়ে খেতে উল্টো নিজের বিয়ের সানাই বাজাতে ইচ্ছে করছে।
__________________________

ফাতিমাসহ সকলে খাওয়া দাওয়া করে কাকনের থেকে বিদায় নিতে এলো। কবে আবার কাকনের সাথে দেখা হবে তার তো নিশ্চয়তা নেই। বুকে পাথর চাপা দিয়ে বিদায় নিতেই হবে। কাকন চাইলেও ফাতিমা কে নিজের কাছে রাখতে পারবে না। ফাতিমা কাকন এর থেকে বিদায় নিয়ে চলে গেলো।

ফাতিমা সহ সকলে সিরাজী মঞ্জিলের গেইট অতিক্রম করবে তখন রুহুল এসে ডাক দিলো ফাতিমাকে।রুহুল সালাম দিয়ে সভ্য আচরণ করলো। রুহুলের কথা এবং আচরণে ফাতিমার মনে কিছুটা সুখ অনুভব হলো এটা ভেবে যে রুহুল তার কাকন কে ভালো রাখবে। যখন খুশি তখন হয়তো কাকন কে দেখতে আসতে পারবে না কিন্তু কাকন সুখে থাকলে দূর হতেই ফাতিমার শান্তি। ফাতিমাসহ সকলে চলে গেলো মহিলাশালার উদ্দেশ্যে।

কাকন বসে আছে আর যারা কাকন কে দেখতে আসছে তাদের কে কাকন পান বানিয়ে দিচ্ছে। এটা একপ্রকার নিয়ম বলা যায়। বয়স্ক মহিলারা কাকন কে নানা প্রশ্ন করছে আর কাকন উত্তর দিচ্ছে। আর যাওয়ার আগে হাতে করে একটা পান নিয়ে যাচ্ছে।

রুহুল অন্দরমহলে প্রবেশ করেই বিব্রতবোধ করলো। এত মেয়ে মানুষের ভীড়ে সত্যি তার অসস্তি লাগলো। তবুও বিবিজান কে এক পলক না দেখলে যে তার হৃদয়ের ব্যাকুলতা কমবে না। কষ্টে বসার ঘরে যাওয়ার জন্য উদ্যত হলো। দরজার কাছে দাড়িয়েই কাকনের হাসিমাখা মুখ দেখে আবারো তার হৃদয়ে সুখের পায়রা উড়তে শুরু করলো। সিদুর রঙা শাড়ি তে আবারো বউ এর সাজে রূপবতী কাকন এর উপর চোখ ফেরানো দায় হলো রুহুলের।পলকহীন ভাবে তাকিয়েই রইলো যেন এক ঘোরে চলে গেছে সে। সকল মেয়েরা উচ্চস্বরে হেসে দিলো রুহুলের এভাবে তাকিয়ে দেখে। কাকন ঘর ভর্তি মানুষের সামনে খুব লজ্জা পেলো। তার স্বামীর এরকম আচরণ করে। যেন সবসময় কাকনকে লজ্জায় ফেলতে প্রস্তুত থাকে।

সকলের হাসিতে রুহুল থতমত খেয়ে গেলো।
রুহুলের দাদিমা বলে উঠলো, “কি রে মানিক, মাইয়া গো মধ্যে কেন তুই, যা বাইরে যা। বউ দেহার জন্য সারারাইত পইড়া আছে “।

আরেকদফা হাসির ধ্বনি বাজতে শুরু করলো। কাকনের এখন মাটি ফাক করে ঢুকে যেতে ইচ্ছে করছে। রুহুল সকলের সামনে লজ্জাবোধ করলো। লজ্জায় মাথা চুলকিয়ে চলে গেলো বাইরের উদ্দেশ্যে।

অন্দরমহল থেকে বের হওয়ার পথেই বকুলের সাথে দেখা হলো রুহুলের।বকুল বন্ধু কে আলিঙ্গন করে বললো ” রুহুল আজ আমাকে চলে যেতে হবে, বিবাহিত জীবন সুখের হোক তোদের, আমি চললাম”

রুহুল খেয়াল করলো বকুল মনমরা হয়ে আছে। তার আর বুঝতে বাকি রইলো না কেন হাসি খুশি বন্ধু বকুলের এমন দশা। তবুও বন্ধুর চলে যাওয়ার কথা শুনে মন টা ভীষণ খারাপ হলো রুহুলের। এইতো সেদিন এলো অথচ আজ ই চলে যেতে হবে। রুহুল হাত ধরে বললো, ” সাবধানে যাস আর মাঝে মাঝে চিঠি লিখিস। খুব মনে পড়বে তোর কথা ”

–” সে তো অবশ্যই দেবো। আজ তাহলে আসি। ”

রুহুল বকুল কে এগিয়ে দিতে চাইলো। বকুল না করা সত্ত্বেও নিজে উদ্দ্যেগে নিজেদের গাড়িতে করে এগিয়ে দিতে চাইলো। বকুল সিরাজী মঞ্জিলের গেইটের কাছে যেয়ে একবার পিছে তাকালো। চারদিকে চোখ বুলালো হয়তো শেষবারের জন্য সামিয়া কে দেখতে পাবে কিন্তু সে ব্যার্থ হলো সামিয়া নেই।
রুহুল এর ডাকে উঠে পড়লো গাড়িতে। ছাউনিহীন গাড়িতে চড়ে চললো স্টেশনের পথে। গাড়িতে পিনপিন নিরবতা। বকুলের মন মরা অবস্থায় করুনা হলো রুহুলের। কিন্তু দাদাজান এর অনুমতি ব্যাতিত রুহুল সামিয়া কে বকুলের হাতেও তুলে দিতে পারবে না। বিয়ের ঝামেলা শেষে দাদাজান কে জানাতেই হবে।এখন বন্ধুকে শান্তনা তো দেওয়া যেতেই পারে। রুহুল গাড়ি স্টেশনে থামলে দুজনেই নামলো। রুহুল এবার বকুল কে বললো, “মন মরা হয়ে থাকিস না তোকে বড্ড অচেনা লাগছে। আমি আমার বন্ধু বকুল ছাড়া অন্য কারো সাথে বোন বিয়ে দেবো না। ”

রুহুলের কথায় খুশিতে গদ গদ করে উঠলো বকুল।যেন গুপ্তধন খুজে পেয়েছে।বকুল বললো,
–“সা’লা সারাজীবন আমাকে তুই সা’লা বলেছিস অথচ আজ দেখ তুই ই আমার সা’লা হলি ”

–“সম্মান দিয়ে কথা বল সম্পর্কে আমি তোর অনেক বড়। ”

–“তুই আমার বন্ধু বন্ধুই থাকবি”
ট্রেন চলে এসেছে তাই বকুল চললো নিজ যাত্রায় আর রুহুল হেসে বিদায় জানালো বন্ধু কে।

কিছুদুর আসার পর কেউ পিছন থেকে রুহুলকে জাপ্টে ধরলো। রুহুল দেখলো এটা আর কেউ নয় বকুল। বকুল হাপাতে হাপাতে বললো, “ধন্যবাদ বন্ধু তোর এই ঋণ কোনোদিন ভুলবো না। খুব শীঘ্রই মা-বাবা কে নিয়ে আসবো। ”

রুহুল বললো, ” বন্ধুকে ধন্যবাদ দেওয়া শিখে গেছিস বাহ। যাহ তোর ট্রেন ছেড়েছে। ”
বকুল হেসে দৌড়ে চলন্ত ট্রেনে উঠে গেলো। দরজায় দাড়িয়ে হাত নেড়ে বিদায় জানালো। রুহুল ও বিদায় দিয়ে গাড়ি নিয়ে চললো সিরাজী মঞ্জিলের উদ্দেশ্যে।

হয়তো ভাগ্যে থাকলে আবারও দেখা হবে হাসিমুখ নিয়ে রুহুলের সাথে।
__________________________

সারাদিনের ধকলে কাকন বেশ ক্লান্ত। সাথে মন টাও খারাপ করছে বিয়ের আগে শুনেছিল বৌভাতের দিন মেয়েরা নিজ বাড়িতে যায় অথচ আজ কাকনের নিজ বাড়ি নেই বলে কাছের মানুষদের কাছে যেতে পারলো না। মন মরা হয়েই সকল গয়না খুলছিল কাকন। দরজা লাগানোর আওয়াজে পিছনে তাকালো। দেখলো রুহুল এসেছে। আবারো লজ্জা এসে ঘিরে ধরলো কাকন কে। মাথার আচল ঠিক করে নিরবে অলংকার খুলে গয়নার বাক্সে রাখলো।রুহুল এসে কাকনের পাশে বসতেই কেপে উঠলো। রুহুল কাকনের দিকে অগ্রসর হলো। কাকন যত পিছাতে লাগলো রুহুল ততই আরো নিকটে যেতে শুরু করলো। কাকন উঠে যাবে ওমনি রুহুল কাকনকে হাত ধরে নিজের কোলে বসালো। কাধে নিজের থুতনি রেখে বললো, “আমাকে দেখলেই এত দূরে সরে যান কেন বিবিজান।বোঝেন না কেন আপনাকে একপলক দেখার তৃষ্ণায় আমি কাতর
হয়ে থাকি।”

কাকনের হৃদযন্ত্র যেন দৌড় প্রতিযোগিতা দিয়েছে। থামার নাম ই নেই। কাকনের এমন অস্থিরতা দেখে রুহুল ছেড়ে দিলো। গ্লাসে রাখা পানি ঠকঠক করে পান করলো কাকন। কাকনের এমন ভীতুরুপ দেখে রুহুল ঘর কাপানো হাসি দিলো। হেসে হেসে বললো,”আপনার বয়স কত বিবিজান? ”

–“প,,পনেরো বছর সাত মাস।”

–” সংসার করার জন্য এতটাও ছোট নন আপনি।আপনার বয়সের মেয়েরা জননী হয়ে গেছে আর আপনি আমাকে দেখলেই ঘেমে একাকার হয়ে যান,,কাপাকাপি শুরু করে দেন এটা কিন্তু বেমানান। আমাকে কি এখনো গ্রহণ করতে পারেন নি? ”

কাকন দৃষ্টি নত রেখেই বললো, “আমি গ্রহণ করেছি”

–“তাহলে আমাকে দেখলেই এত জড়তা কেন সৃষ্টি হয় আপনার ”

— “জা..জানি না আমি”

রুহুল খেয়াল করলো কাকনের নাকে বিন্দু বিন্দু ঘাম জমেছে। মায়াবতীর মতো লাগছে।গরমে এমন পোশাকে সত্যি সকলেই নাজেহাল। রুহুল কাকন নিয়ে বিছানায় বসলো। নাকে জমা ঘাম গুলো রুমাল দিয়ে মুছে দিলো। মাথার কাপড় ফেলে খোপা খুলে দিলো। রুহুল কাকন কে বললো, “শাড়ি টা খুলুন বিবিজান ”

রুহুলের কথায় কাকনের চোখ বেড়িয়ে আশার দশা। –“মা,,মানে”

–“মানে আপনি এই শাড়িটি পরিবর্তন করে সুতি শাড়ি পড়ে আসুন।আপনাকে ক্লান্ত দেখাচ্ছে। আজ রাতে আপনার সাথে চন্দ্রবিলাশ করবো। “।
কাকন যেন হাফ ছেড়ে বাঁচলো। রুহুলের কথা মতো সুতি শাড়ি পড়লো কাকন। রুহুল কাকনের হাত ধরে নিজের বিশাল বাড়ান্দায় নিয়ে গেলো। ঘর থেকে একটা মাদুর নিয়ে পাতলো বাড়ান্দার মাঝ বরাবর। কাকন কে বসিয়ে কাকনের কোলে মাথা রাখলো।

দুজনেই আকাশের চাঁদ দেখতে ব্যস্ত। রুহুল বললো,
–” জানেন বিবিজান এই ক’দিন রোজ রাতে এই বাড়ান্দায় সময় পার করেছি। আর আপনার জন্য অপেক্ষার প্রহর গুনেছি, আপনার কি আমার কথা মনে হয়েছে?”

কাকন চাঁদের দিকে তাকিয়ে আনমেই মুখ ফুটে সত্যি কথা বললো, “না আমি তো আমি বিয়েই করতে চাই নি তাই মনেও হয়নি”। বলার পর কাকনের হুশ হল এ সে কি বলে ফেললো।

রুহুল ভ্রুকুচকে বললো,”কেন আমি বুঝি খুব কুৎসিত, আপনার মতো রুপোবতীর সাথে বেমানান? ”

–“আপনি যথেষ্ট সুন্দর দেখতে।” বলেই জিভ কামড়ালো কাকন। লজ্জা লাগলো নিজ মুখে স্বামীর সৌন্দর্যের কথা বলে।

রুহুল কাকনের মুখ পানে চেয়ে লজ্জামাখা মুখ দেখলো।কাকনের হাত নিজের হাতে মুষ্টিবদ্ধ করে বললো,”তাহলে বিয়ে করতে চান নি কেন?

–“আসলে আমি কোনোদিন ও বিয়ে করতে চাই নি। আমি সেবিকা হতে চেয়েছিলাম।”

–“বাহ উত্তম চিন্তা।
–“জি”

দুজনেই চন্দ্রবিলাশে ব্যস্ত। কিছুক্ষণ পর রুহুল নেশালো সুরে বললো, “বিবিজান”
–“হুম ”

রুহুল চাঁদের দিকে তাকিয়ে আবারো বললো, “ওই যে আকাশের চাঁদ টা দেখছেন ওই চাঁদ আর আমার বিবিজান দুজনেই এক। তাদের কোনো শাখা নেই। চাঁদ যেমন রাতের অন্ধকারে আলোর ছোয়া নিয়ে আসে আপনিও আমার বিষাদময় অন্ধকার জীবনে আলো নিয়ে এসেছেন। কখনো ছেড়ে যাবেন না তো আমাকে। আমি আবারো অন্ধকারে হারিয়ে যাবো।”

রুহুল যখন কথা গুলো বলছিল কাকন রুহুলের দিকে তাকিয়ে ছিল। নিজের কোলে মাথা রেখে শুয়ে থাকা স্বামীর জীবনে কিসের বিষাদ ছিল।

কাকন আরেক হাত দিয়ে রুহুলের মাথায় হাত রাখলো। এই প্রথম মন থেকে রুহুল কে স্পর্শ করলো কাকন। একদিনেই লোকটার প্রতি যেন কাকন দুর্বল হয়ে পেড়েছে। একেই বোধহয় হালাল সম্পর্কের হালাল ভালোবাসা বলে।
___________________

ধরণীর বুকে যেমন আজ সুন্দর চাঁদ ভেসে আছে ঠিক তেমনি একজন মানুষ সিরাজপুরের নদীতে ভেসে আছে লাশ হয়ে। হয়তো সকালে সবার আগে চোখে পড়বে জেলেদের। তারপর, তারপর কি হবে??

চলবে…….
#দেবী
#শবনম_রাবাহ

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here