দেবী,১৭,১৮

0
384

#দেবী,১৭,১৮
লেখিকাঃ শবনম রাবাহ (স্রোতস্বিনী)
কপি করা সম্পুর্ণ নিষেধ।
১৭ঃ

চারিদিকে ফজরের আজান শোনা যাচ্ছে। সুমধুর আজানের ধ্বনি। পৃথিবীতে বোধহয় আর কোনো কিছুর ধ্বনি এত মধুর নয়। পিটপিট করে চোখ খুললো কাকন। আবছা অন্ধকার এখনো চারিদিকে ছেয়ে আছে। খোলা আকাশের নিচে এভাবে শুয়ে ছিল তারা দুজন। গতরাতে চন্দ্রবিলাশ করেছে দুজন তারপর কখন ঘুমিয়েছে বুঝতেই পারে নি। রুহুলের বাম হাত এর উপর মাথা রাখা অবস্থায় আকাশের দিকে তাকিয়ে আছে কাকন। এত সুন্দর খোলা আকাশের নিচে প্রকৃতি অনুভব করা আগে হয় নি তার। আজ প্রথম এভাবে ঘোলা আকাশের নিচে সুখময় রাত্রিযাপন করেছে সে। ব্যাপারটা ভালোই লেগেছে কাকনের। নিজের গা থেকে রুহুলের হাতটা সন্তপর্ণে সরিয়ে উঠে বসে চুল গুলো খোপা করে নিলো। তারপর নিজ কক্ষে এসে জানালা খুলে দিলো।শাড়ি পাল্টে ওযু করে নামাজ পড়লো। নামাজ শেষে আলমারির উপর থেকে কুরআন শরীফ নামালো। আল্লাহর নাম নিয়ে নিজের সুমধুর কন্ঠে তা তিলাওয়াত করা শুরু করলো।

সূর্য এখনো পুরোপুরি উদয় হয় নি। তবে আলোর রেশ উপস্তিত হচ্ছে। সুমধুর কন্ঠ ভেসে আসছে রুহুলের কানে। চোখ খুলে কালকের ন্যায় আজকে বিবিজানের মুখ টি দেখতে পেলো না। তবে এত সুন্দর তিলাওয়াত শুনে মন ভরে গেলো। উঠে গিয়ে কাকনের কাছে বসলো। মাথায় কাপড় দিয়ে এত সুন্দর কুরআন তেলাওয়াত করা কাকন কে দেখে রুহুলের মনে হলো জান্নাতের হুরপরী যেন সয়ং তার কক্ষে এসেছে।

কাকন সুরা বাকারার ২য় রুকুতে থেমে কুরআন শরীফ বন্ধ করে নির্দিষ্ট স্থানে রাখলো। অগোছালো শাড়িটি গুছাতে লাগলো। রুহুল পিছন থেকে কাকন কে জড়িয়ে বললো, “আমি নিশ্চিত জীবনে কোনো নেকির কাজ করেছিলাম এই জন্য আল্লাহ জান্নাতের হুরকে পৃথিবীতেই আমার বিবিজান হিসেবে পাঠিয়েছেন।”

কাকনের এখন মনে হলো আজকে এক রুকু কম পড়ে রন্ধনশালায় চলে গেলেই ভালো হতো। রুহুলের এমন কথায় ভারি লজ্জা লাগে তার।
–” ছাড়ুন আমাকে,, আমায় রান্না চড়াতে হবে।”

–“উহু একটু পর। ”

–“আপনি নামাজ পড়েন না?”

–“পড়ি তো।এই সিরাজপুরে নামাজ পড়ে না এমন কেউ নেই।আর আমি এখন থেকে আরো বেশি বেশি পড়বো। আল্লাহর শুকরিয়া আদায় করতে হবে তো। এই যে এত সুন্দর বিবিজান দিয়েছেন আমাকে আল্লাহ তায়লা।”

কাকন রুহুলের কথায় হাসলো। রুহুলের আচরণ এ কাকনের মনে হয় লোকটার মধ্যে কোনো ভেজাল নেই। এখনো বাচ্চাদের মতো বাচ্চামো করে আর কাকন কে লজ্জা দিবে। কাকন নিজেকে ছাড়িয়ে নিয়ে বলল, “বেশ আপনি নামাজ পড়ে নিন। আমার কাজ আছে।”

রুহুল সম্মতি জানালো। কাকন দরজা খুলে রান্না ঘরের উদ্দেশ্যে চললো। দেখলো তার শাশুড়ী, ছোট শাশুড়ী এবং চাচি শাশুড়ী রয়েছে। কাকন তাদের কাছে গিয়ে বলল, “আমাকে কি কি করতে হবে?”
কাকনের কথায় সকলের দৃষ্টি ওরদিকে। মালেকা কিছু বলবে তার আগেই সুভা মুচকি হেসে বললো, “কিছুই করতে হবে না। তুমি আমার কাছে বসো। ”

কাকন শাশুড়িমার কথা মতো বসলো। সুভা কে দেখলেই কাকন অবাক হয়। যেখানে সিরাজী মঞ্জিলের সকলেই পাথরের মতো সেখানে তার শাশুড়ী মা তুলার মতো নরম। অন্যরা ক্রুদ্ধদৃষ্টিতে তাকায় আর সুভা সেখানে কোমল দৃষ্টিতে চায়। হয়তো আম্মা এরকম বলেই রুহুল ও মায়ের মতোই কোমল মনের হয়েছে।

মালেকা ঝাজালো স্বরে বললো, “রুহুলের বউ যাও সবজি গুলান কাটো। বইসা থাকলে তো আর শশুড় বাড়ি ভাত জুটবো না, কাম করো। ”

সুভা কিছু বলবে তার আগেই কাকন শাশুড়ী কে চুপ থাকতে ইশারা করলো। বটি দিয়ে সবজি কাটতে শুরু করলো। সুভাও আর নতুন বউ এর সামনে কথা কাটাকাটি করতে চাইলো না। আর কাকন যেহেতু সেচ্ছায় সম্মতি জানালো থাক সে কাজে বাধা দেবে না।

মহীবুলের মা কাকন কে চেয়ে চেয়ে দেখছে। পীরায় বসে রুটি বেলছে সে। সম্পর্কে ছোট বিধায় দুই জা এর উপর কথা বলার সাহস হয় না। নিরবে সব কিছু পর্যবেক্ষণ করে। কাকন কে তার ভীষণ ভালো লাগে। কি সুন্দর মেয়েটি। মনে প্রাণে মহীবুলের জন্য এমন একটি বউ চাইল সে।

মহীবুলের মা রুটি বানানো শেষে মুচকি হেসে কাকনের কাজে হাতে হাতে সাহায্য করতে শুরু করলো।
কাকন কাজ করছে আর মহীবুলের মা’র সঙ্গে কথা বলছে। সমজি কাটা প্রায় শেষ এর দিকে। মালেকা এখন রান্না করবে। সুভা বিলালের জন্য দুধ গরম করলো। তাকে যে এখন দুধ খাইয়ে ওষুদ দিতে হবে। কাকন সুভা কে বললো, “আম্মা, যদি কিছু মনে না করেন আমি নিয়ে যাই দুধ?”

সুভাসহ সকলেই কাকনের মুখপানে চেয়ে রইলো। যেন কাকন কোনো ঘোর অন্যায় করে ফেলেছে। কাকন মুখ ছোট করে মাথা নিচু করে ফেললো। সুভা দুধ এর বাটি টা কাকনের দিকে এগিয়ে দিলো। বাটি দেখে কাকন মুখ তুলে চাইলো। মুচকি হেসে বাটি টা হাতে নিলো। তারপর সুভার সাথে বিলালের কাছে গেলো।

সুভার কাকন কে মনে ধরেছে। সুভা সবসময় এরকম সুন্দর সরল মনের বৌমা চেয়েছে। হয়তো আল্লাহ তায়ালা ওর দুয়া কবুল করেছেন। আর তার চেয়ে বেশি কাকন কে দেখলেই মনের হয় কাকন যেন নিজের কেউ। কাকন কে প্রথম দেখেই মনে হয়েছিল তার নিজের সন্তান যেন তার সামনে। জড়িয়ে নেওয়ার পর অদ্ভুত গন্ধ পেয়েছিল। কাকনের গায়ের রঙ টাও সুভার মতো সুন্দর। সে জানে তার মতো সুন্দর বলেই কাকন কে এতিম হওয়া সত্ত্বেও সবাই মেনে নিয়েছে।

সুভা কক্ষে যেয়ে বিলালের বালিশের উপর আরেকটা বালিশ দিয়ে উচু করে দিলো। চামচ দিয়ে দুধ খাওয়াবে এখন বিলাল কে। কাকন শাশুড়িমার দেখানো মতো চামচে দুধ নিয়ে খাইয়ে দিলো। ধীরে ধীরে তা গিললো বিলাল সিরাজী। যতক্ষণ দুধ দেওয়া হলো ততক্ষণ বিলাল সিরাজী অশ্রু ঝড়ালো। বিলাল সিরাজীর এমন কান্না দেখে কাকনের মায়া হচ্ছে খুব। সুভা এমন অবস্থা দেখে আবারো অবাক হলো। কারন বিলাল সিরাজী আবারো কাদছে। কিছু বলার ও চেষ্টা করে কিন্তু বিলাল সিরাজী ব্যর্থ হয় সে।
কাকন বিলাল সিরাজীর চোখ মুছে দিয়ে বললো, “আব্বা আমি কাকন। আমাকে চিনেছেন। আমি আপনার বড় ছেলের বউ। আপনি কাদছেন কেন। বলুন না কোথায় কষ্ট হচ্ছে, কথা বলুন আব্বা?”

সুভা কাকনের কাধে হাত রেখে বললো,” তোমার আব্বা কথা বলতে পারবে না কোনোদিনো কাকন। আদোও সুস্থ হবে কি না তার ও নিশ্চয়তা নেই। তবে তোমাকে প্রথম দিন দেখার পর থেকেই কিছুটা উন্নতি হয়েছে।আজ দু দিন হলো সে কাদে আগে কাদতো না।তবে এটুকু বুঝেছি তোমাকে রুহুলের স্ত্রী হিসেবে পছন্দ করেছে সে। সে যে কাদছে এটা নাকি ভালো লক্ষ্মণ। ডাক্তার বলেছে এটা সুলুক্ষ্মণ।”

রুহুল বিলালের মুখ মুছে দিতে দিতে বললো,”জানেন আম্মা আমি ওনাকে প্রথম মহিলাশালায় দেখেছিলাম। আর সেদিন রক্তাক্ত অবস্থায়। অথচ আজ ওনার এই অবস্থা। উনি বোধহয় অনেক ভালো মানুষ ছিলেন তাই না। আচ্ছা তাহলে এমন হলো কেন? ”

সুভা স্বামীর দিকে এক দৃষ্টিতে চেয়ে বললো, “ভালো মানুষ ছিল, আসলেই ভালো ছিল। সে বাদ দাও তুমি খোকার কাছে যাও যেয়ে দেখো কিছু লাগবে কি না। ”

–“জি আম্মা” বলেই কাকন শাশুড়ির কক্ষে থেকে বেরিয়ে নিজ কক্ষে যাবে তখনি মুখোমুখি হলো মহীবুল। মহীবুল এর চেহারা দেখে কেমন যেন লাগছে। পা থেকে মাথা অব্দি কাকন কে নজর দিলো মহীবুল । কাকনের বেশ অসস্থি লাগলো মহীবুলের এমন নজরে। কাকন পাশ কাটিয়ে যাবে ওমনি মহীবুল পথ আটকালো। কাকন ভয় পেয়ে গেলো। এভাবে এই লোক কেন আবার পথ আটকাচ্ছে। মহিলাশালায় গেলে ও কাকন কে জ্বালাতো, শুধু কাকন কে না আরো মেয়েদের কেও বাজে নজর দিতো। কাকন মাথা নিচু করে বললো, “দেখুন আমার সঙ্গে সভ্য আচরণ করুন। আমি কিন্তু এখন আপনার বড় ভাই এর স্ত্রী অর্থাৎ ভাবিমা হই। তাই আমাকে যেতে দিন। ”

মহীবুল কাকনের মুখ এর দিকে চেয়ে বললো, “উহু। ভাবিমা না ভাবিজান।ঠিক আছে যান কক্ষে যান।”

কাকন যেন হাফ ছেড়ে বাচলো। দৌড়ে নিজ কক্ষে যেয়ে দরজা আটকে দিলো। রুহুল বিছানায় শুয়ে ছিল। কাকন কে এভাবে দৌড়ে আসতে দেখে সন্দেহ লাগলো। কাকন এর নিকট যেয়ে বললো,
–“কি হয়েছে বিবিজান এভাবে দৌড়ে এলেন যে? ”

কাকন ভয়ে রুহুল কে জড়িয়ে ধরলো যেন রুহুল পালিয়ে যাবে। কাকন ফুপাতে ফুপাতে বললো, “আপনার চাচাতো ভাই আমার দিকে কেমন করে যেন তাকায়। আমার খুব ভয় করে ওনাকে দেখলে। ”

কাকনের কথা শোনা মাত্রই রুহুলের যেন শিরা উপশিরায় রক্ত উত্তপ্ত হয়ে গেলো। নিজের স্ত্রীর প্রতি কুদৃষ্টি দেওয়া স্বামী হয়ে রুহুল তা মেনে নেবে না। রুহুল কাকন কে বিছানায় বসিয়ে পানি দিলো। কাকন এক ঢোকে গিললো। রুহুল পাশে বসে কপালে চুমু দয়ে বলল, “ভয় পাবেন না বিবিজান। আপনার দিকে মহীবুল আর বাজে নজরে তাকাবে না।কারণ আমার বিবিজানের প্রতি যারা কুদৃষ্টি দেবে তারা তাদের দৃষ্টি শক্তি হারাবে। ”

–“না দয়া করে এমন করবেন না। আমি সবে দু’দিন হলো এসেছি।আমি চাই না আমার জন্য কোনো অশান্তি হোক।দোহাই লাগে আপনি কাউকে কিছু বলবেন না।”

রুহুল কাকনের দুগালে হাত রেখে বললো, ” এতে আপনার কোনো দোষ নেই বিবিজান। তবে আমি বেচে থাকতে আপনার প্রতি কেউ কুদৃষ্টি দেবে সেটা আমি মেনে নেবো না।”
রুহুল কাকন শক্ত করে জড়িয়ে রাখলো নিজের সাথে। হঠাৎ ই বাহিরে লোকজনের চেচামেচির আওয়াজ শুনতে পেলো। রুহুল কাকন কে ছেড়ে উঠে দাড়ালো। কাকন ও নিজেকে ঠিক করে স্বামীর সাথে কক্ষ থেকে বেরোলো।
রুহুল অন্দরমহল থেকে বাইরে বেরিয়ে এলো। তার সাথেই দুলাল সিরাজী, জামাল, মহীবুল, হেলাল বের হলো।
কাকন দাদিমার সাথে অন্দরমহলের দরজার কাছে দাড়িয়ে রইলো। সাথে বাকিরাও দাড়ালো সঠিক ঘটনা জানার জন্য।

দুলাল সিরাজী সকলের উদ্দেশ্যে বললেন, “কি হইছে তোমরা সক্কলে এইখানে কেন? ”

–“নদীর পানিতে হাবিবুল্লাহর লাশ ভাইসা উটছে সিরাজী আব্বা জলদি আহেন।”

আৎকে উঠলো সকলেই। হাবিবুল্লাহর লাশ নদীতে ভেসে উঠছে কে ফেলে রেখেছে। জামালের মনে আতঙ্কের সৃষ্টি হলো। হেলাল, মহীবুল একে অপেরের দিকে চাইলো। দুজনের ই মুখে ভয়ের ছাপ স্পষ্ট। রুহুল সহ সকলেই চললো লাশ এর কাছে।

সিরাজী মঞ্জিলের সকল মহিলারাও আতঙ্কিত হলো। কে মেরে ফেলেছে হাবিবুল্লাহ কে। কাকনের ও মন উদাস হয়ে গেলো মৃত্যুর খবর শোনার পর এটা ভেবে না জানি পরিবারের মানুষজনের কতটা খারাপ লাগছে।

দাদিমা বসার ঘরে বসে মনমরা হয়ে বললো, “হবি তো আমাগো বাড়ি থিকাই বড় হইলো। আহারে পোলাডারে কেডায় যে মারলো। খুব ভালো আছিলো। আহারে ছুডো মাইয়া ডার কপাল পুরলো।”

মহীবুলের মা আফসোসের সুরে বললো,” ঠিক ই কইছেন আম্মা। কত কবিরাজ দেহাইয়া মাইডা হইছে আহারে বাপের আদর আর পাইবো না। ”

কাকনের ছোট মেয়েটার কথা শুনে খুব খারাপ লাগলো। মেয়েরা যে বাবার অতি আদরের হয়। অথচ মেয়েটা পিতৃহীন হয়ে গেলো।নিজের বাবার কথা মনে করে একফোটা চোখের নোনাজল ফেলল কাকন।
_______________________

সকালে নদীর পাশে দিয়ে যাওয়ার সময় কানু মুন্সি লাশ দেখতে পায়। নদীতে যে পি’চাশ আছে সেটা সকলের ই জানা। লাশ দেখে ভয়ে চিৎকার করে ওঠে। লোকজন চিৎকার শুনে এসে দেখে কানু মুন্সি অজ্ঞান হয়ে পড়ে আছে। তার পরেই চোখ যায় লাশে।ধীরে ধীরে আরো মানুষ জরো হয়ে যায়। কয়েকজন মিলে লাশ তুলে আনে। তারপর হবীবুল্লাহ কে দেখে সকলেই ভয় পায়। নৃশংস ভাবে হত্যা করে হয়েছে। তার পরিবার কে খবর দেওয়া হয়। সেই সাথে কিছু লোক যায় সিরাজী মঞ্জিলে।

লাশের পাশে বসে বিলাপ করছে হাবিবুল্লাহর স্ত্রী, মা। আর পাঁচ বছরের মেয়েটি নিরব হয়ে আছে। সে কি আদোও পিতা হারানোর বেদনা বোঝে,হয়তো না।

দুলাল সিরাজী সহ সকলেই লাশ এর কাছে গেলো।এতক্ষণে পুলিশ ও চলে এসেছে। পুলিশ ভালো করে পর্যবেক্ষণ করে দেখলো মাথায় আঘাতের চিহ্ন। গায়ের অনেক জায়গায় কোপানো হয়েছে।হাতেও ও ভয়াবহ আঘাত করা হয়েছে। রুহুল লাশ দেখে বুঝে উঠতে পারছে না এভাবে কেন হাবিবুল্লাহ কে খুন করা হলো।রুহুল পুলিশ কে তদন্ত করার জন্য জোর দিলো।

দুলাল সিরাজী হাবিবুল্লাহ কে দুয়া ইউনুস পড়ে ছোট শ্বাস ছাড়লেন। হাবিবুল্লাহ সিরাজী মঞ্জিলের বিশ্বস্ত চাকর ছিল। ছোট থেকেই সিরাজী মঞ্জিলে কাজ করেছে । অথচ আজ মৃত অবস্থায় পড়ে আছে। জামাল লাশ দেখেই যেন কেপে উঠলো। এ কি ভয়ানক মৃত্যু। জামাল সিরাজীর বহু গোপন কাজ হাবিবুল্লাহ কে দিয়ে করিয়েছে। সেই সুবাদে অনেক কিছুই হাবিবুল্লাহ জানে। মা’রার আগে যদি কেউ জেনে যেয়ে থাকে তাহলে জামাল কে নাকানিচুবানি খেতে হবে তা নিশ্চিত ।

অন্যদিকে লাশ দেখেই হেলাল মহীবুলের হাত শক্ত করে ধরে ফেললো। গত দু’দিন পাগলের মতো সিরাজপুরে হাবিবুল্লাহ কে খুজেছে। অথচ আজ হাবিবুল্লাহর লাশ নদীতে ভেসে উঠেছে। তারা তো হাবিবুল্লাহ কে পাঠিয়েছিল নিজ স্বার্থ হাসিল করতে অথচ হবিবুল্লাহ লাশ হয়ে ফিরে এলো। সবকিছুই তো ঠিক ঠাক ছিল তাহলে হাবিবুল্লাহ কে মারলো টা কে?”

চলবে…..
#দেবী
#শবনম_রাবাহ

#দেবী
লেখিকাঃ শবনম রাবাহ (স্রোতস্বিনী)
কপি করা সম্পুর্ণ নিষেধ।
১৮ঃ

সময়, জোয়ার এবং জীবন কখনো কারো জন্য অপেক্ষা করে না। কেটে গেছে সাত দিন। এই সাত দিনে কাকন যেন পরিপূর্ণ সংসারী হয়ে উঠেছে। সংসারের প্রায় সকল কাজেই সাহায্য করে।যতই দু-তিনটে কাজের লোক থাকুক ঘরের বউ কাজ না করলে বউ কে কথা শুনতেই হয়। তবে এই ক’দিনে কাকন রুহুলের প্রতি দুর্বল হয়ে উঠেছে। স্বামীর যত্ন, ভালোবাসা, আচরণ সব কিছুতেই মুগ্ধ হয়েছে কাকন।লোকটাকে এখন বেশ ভালোই লাগে কাকনে।

আকাশে আজ সুর্যের দেখা নেই। হয়তো আজ মন খারাপ তাই এমন কালো মুখে ছেয়ে আছে ধরণীর বুকে। হয়তো বৃষ্টি হবে আবার নাও হতে পারে এ যেন প্রকৃতির খেলা মানুষকে জালানোর। দেখে মনে হয় বৃষ্টি হবে অথচ হয় না।

কাকনকে শাশুড়ি মা ছাদে শুকনো মরিচ, হলুদ আর জামা কাপড় তুলতে পাঠালেন। রানু কে সাথে নিয়ে কাকন চললো সেগুলো তুলতে।

যাওয়ার পথে রানু কাকন কে বললো, “ভাবিজান একখান কতা কই?

–” হ্যাঁ বলো, কথা বলতে কি অনুমতি লাগে নাকি ”

–“ই মানে আপনে গায়ে কি বাইটা দেন যার লিগা আপনে এত সুন্দর ”

রানুর কথায় কাকন হেসে দিলো। বললো,” কিছু বেটে দিলে বুঝি মানুষ সুন্দর হয়”

–“হ্যাঁ হয় তো আমি পত্যেক সপ্তা হলুদ বাইটা মুহে দেই। তাও সুন্দর হই না। সুন্দর হইলে আমারো একখান বিয়া হইতো ”

–” হাহাহা, তোমার বুঝি বিয়ে করার সখ হয়েছে খুব?”

–“হ হইছেই তো। জামাই এর আদর সুহাগ পামু। আচ্ছা দাদাভাই যে আপনেরে হারাদিন চোক্কে হারায় আপনারে মনে হয় মেলা আদর সুহাগ করে।”

রানুর কথায় কাকন কেশে উঠলো। এখন সে কি বলবে। রানু তো তার দুর্বল জায়গায় কথা ছুড়ে মারলো।এ বিষয় টা শুনলেই তার ভীষণ লজ্জা লাগে। কাকন চোখ বড় বড় করে বললো, “যাও তোমায় সাহায্য করতে আমার সাথে যেতে হবে না তুমি আম্মাদের কাছে যেয়ে সাহায্য করো।”

কাকনের ওমন কথা শুনে রানু কিছুটা ভয় পেলো তবে অবাক হলো। তার মনে হলো সয়ং সুভা তার দিকে এভাবে রেগে তাকাচ্ছে। তাই বললো, “ভাবিজান আপনে যেমনে তাকাইলেন জানেন বড়াম্মাও এমনেই তাকায় রাইগা গেলে। খোদার কসম আপনারে পুরাই বড়াম্মার মতো লাগলো। হাহাহাহা”।

রানুর কথায় ভড়কে গেলো কাকন।এর সাথে কথা বলাই বেকার। কিছু না বলে ছাদের দরজা দিয়ে ছাদে গেলো। শুকনো মরিচ আর হলুদ গুলো সুন্দর করে বাশের ডালায় রাখলো। রানুর হাতে দুটো ডালা দিয়ে নিজে সব জামা কাপড় রাখলো।রানু ডালা নিয়ে আগেই নেমে পড়লো। ছাদ থেকে নামবে ওমনি কাকনের কানে কান্নার শব্দ এলো। মনে হচ্ছে কেউ ফুপিয়ে ফুপিয়ে কাদছে। কাকন শব্দ অনুসরণ করে বিপরীতে যেয়ে দেখলো সামিয়া হাটু ভাজ করে মুখ গুজে বসে আছে। হাসি খুশি সামিয়া কে কান্নারত অবস্থায় দেখে আৎকে উঠলো কাকন।

কাকন এগিয়ে সামিয়ার মাথায় হাত রাখলো। সামিয়া মুখ তুলে কাকন কে দেখেই চোখ মুখ মুছে ফেললো। কাকন সামিয়ার কাছে বসে বললো,” সামিয়া কি হয়েছে তোমার কাদছো কেন?”

সামিয়ার চোখের জলের বাধ যেন ভেঙে গেলো। কাকন কে জড়িয়ে কেদে ফেললো।
কাকন সামিয়ার পিঠে হাত বুলাতে বুলাতে বললো,”শান্ত হও এভাবে কাদছো কেন,বলো কি হয়েছে, কেউ কি বকেছে তোমায়?”

–“ভাবিজান আমার খুব কষ্ট হইতাছে।”

-“কেন কি জন্য তোমার কষ্ট হচ্ছে?

-” আমার ওনারে খুব দেখতে ইচ্ছা করতাছে।”

–“কাকে দেখতে ইচ্ছে করছে? ”

–দাদাভাই এর শহুরে বন্ধু বকুল। ওনারে আমি ভালোবাইসা ফালাইছি ভাবিজান।এখন আমার ভালো লাগতাছে না কিচ্ছু।”

–“কিহ এ তুমি কি বলছো সবাই জানলে কি হবে ভেবে দেখেছো। বাড়িতে অশান্তি হবে, আর দাদাজান তো ভীষণ রাগ করবে।”

–“আমি জানি তো সেইটা। উনিও কইছে উনি আমারে ভালোবাসে। আমারে বিয়া করবো। কিন্তু আইজ আমার ওনার কথা খুব মনে পড়তাছে। আমি তারে ছাড়া বাচমু না ভাবিজান। ”

সামিয়ার মুখে এমন কথা শুনে কাকন কিছু বলার ভাষা হারিয়ে গেলো। কিন্তু তবুও সামিয়া কে শান্ত করতে বললো,”বেশ সে যখন বলেছে হয়তো সত্যিই তোমায় বিবাহ করবে,তাহলে কান্না করার কি দরকার?”

–“হুম, কিন্তু আমার ভালো লাগতাছে না। যাওয়ার আগে একটা বার দেখতেও পারি নাই। শুধু শুনলাম দাদাভাই নাকি ওনারে এগিয়ে দিতে গেছিলো। তুমি একটু জিগাও না যে উনি কিছু বলছে কি না?

–“আমি কিভাবে বলবো ওনাকে আর পরপুরুষ এর কথা শুনে যদি উনি রেগে যান।”

–“না তোমার উপর রাগবো না। আমরা সবাই জানি দাদাভাই তোমারে চোখে হারায়। হাত জোর কইরা কই ভাবিজান তুমি দাদাভাই রে বুঝাও ওনার লগে বিয়া দিতে।”

কাকন এখন বেশ দিধায় পড়ে গেলো। রুহুল কে কি আদোও বলা যাবে। হাজার হোক বড় ভাই হয়ে তো ছোট বোনের এগুলো মেনে নাও নিতে পারে।তবে সামিয়ার মুখে হাসি ফুটানোর জন্য বলতেই হবে রুহুলকে। কাকন সামিয়ার চোখ মুছে নিজের সাথে করে ছাদ থেকে নেমে এলো। সামিয়া কে কক্ষে নিয়ে গিয়ে পানি দিলো। তারপর বললো, “আমি তোমার দাদাভাই কে বলতে পারি তবে একটা শর্ত আছে? ”

— “কি শর্ত?”

–“তুমি আর কখনো কাদবে না। আমি আমার হাসি খুশি ননদ টাকে দেখতে চাই”

সামিয়া খুশিতে হেসে কাকনকে জড়িয়ে ধরলো।বললো,
–“তুমি খুব খুব খুব ভালো ভাবিজান,আমি আর কোনোদিনো কানমু না।”
_____________________

আজ রুহুলের কথামত বসার ঘরে বসে আছে দুলাল সিরাজী, জামাল,হেলাল আর মহীবুল। সাথে আছে হিসাবের খাতা। যাকে যে দায়িত্ব দেওয়া হয় মাসের শেষে সেই হিসাব দিতে হবে। আর আজকের এই বৈঠকের আহবায়ক স্বয়ং রুহুল নিজে।
রুহুল নিজের হিসাবের খাতা নিয়ে উপস্থিত হলো। সকলের কাছে থেকে খাতা নিলো। রাতের নিরিবিলিতে সে সকল হিসেব মিলাবে।

রুহুল একপলক জামাল, হেলাল আর মহীবুল কে দেখলো।তার চাচাজান যে দিন দিন অধপতনে যাচ্ছে।আর ছোট ভাই দুটো তারা তো আরো। তবে সে তো ভাই দুটো কে কম ভালোবাসে না। সর্বদা মনে করে তারা আপন তিন ভাই এবং তিন বোন। অথচ রুহুল কে যে দু’ভাই সহ্য করতে পারে না তা রুহুল ভালো ভাবেই জানে। দুলাল সিরাজী কেশে উঠলেন। বললেন, “কও রুহুল কি জন্য জরুরি তলপ তোমার? ”

রুহুল বললো, -“দাদাজান পুলিশ এখনো বের করতে পারে নি হাবিবুল্লাহ কে কে মেরেছে?”

–” হ্যাঁ সে তো আমরা সক্কলেই শুনছি। তয় আমিও লোক লাগাইছি কে এই কামডা করলো “?

রুহুল দুই ভাই এর দিকে চেয়ে বললো, “তোরা কেউ জানিস হাবিবুল্লাহ সেদিন কোথায় গিয়েছিল?”

মহীবুল, জামাল, হেলাল তিনজন যেন এই ভয় টাই পেয়েছিল। হেলাল আমতা আমতা করে বললো,”আমরা কেমনে জানমু দাদাভাই। আমরা তো মঞ্জিলেই আছিলাম,আপনের বিয়ার কামে ব্যস্ত হইয়া।”

রুহুল এবার ভ্রুকুচকে জিজ্ঞাসা করলো, “ওহহ তাহলে আমি যে সাজুর থেকে শুনলাম তোরা আমার বিয়ের দিন থেকে হাবিবুল্লাহ কে খুজেছিস এটা কি মিথ্যা”

জামাল ঘামতে শুরু করলো। ইদানীং অল্প চিন্তাতেই তার শরীর ঘামে। কেপে ওঠে হৃদপিণ্ড সহ সারা শরীর। জামাল বললো, “বাপ রুহুল তুই তোর ভাই গো সন্দেহ করতাছা। আমিই ওগো কইছিলাম খুজতে। পায় নাই দেইখা খোজ লাগাইছিলাম তয় আমরা কেমনে জনতাম যে মইরা গেছে গা। ”

–“সেটা তো আমাদের ও জানানো যেতো। গোপনে কেন খুজেছিলেন চাচাজান?”

জামাল বললো,”কারন আমরা চাই নাই তর বিয়াতে অশান্তি হোইক। আব্বাজান ও চিন্তা করতো তাই আরকি।”

রুহুল স্পষ্ট ভাবে বললো,”আমিও বিশ্বাস করি যে নিজেদের বিশ্বস্ত চাকরকে হত্যার মতো পাপ আপনারা করবেন না। তবে যে এই নিকৃষ্ট কাজ করে থাকুক না কেন আমি রুহুল সিরাজী তাদের ছাড়বো না”
রুহুলের হুশিয়ারি বার্তায় যেন কেপে উঠলো তারা।

রুহুল দুলাল সিরাজীর কাছে বসলেন তারপর বললো, “দাদাজান আমার একটা প্রস্তাব আছে। হাবিবুল্লাহ বরাবরই আমাদের লোক ছিল। তার আয়ের উৎসও তাই সিরাজী মঞ্জিলই ছিল। ঘরে তার মা,স্ত্রী এবং ছোট একটি সন্তানও আছে। আমি চাচ্ছিলাম তাদের ভরণপোষণের দায়িত্ব নিতে। আল্লাহর রহমতে আমাদের কোনোকিছুর অভাব নেই। তাই তাদের যাবতীয় খরচ যদি সিরাজী মঞ্জিল বহন করে?” বলেই রুহুল দাদাজানের মুখপানে চেয়ে রইলো।

রুহুলের প্রস্তাব দুলাল সিরাজীর ভীষণ পছন্দ হলো।হ্যাঁ রুহুল তো ঠিক ই বলেছে। তার ই আগে ভাবা উচিৎ ছিল।দুলাল সিরাজী খুশি হয়ে বললেন,”উত্তম প্রস্তাব এইডা। আমারই এইডা ভাবা উচিৎ আছিল। তুমিই আমার সিরাজী বংশের যোগ্য পাত্র এই জন্যই এত সুবুদ্ধি তোমার।”

রুহুলের প্রশংসা শুনে বাকি তিনজনের মুখে যেন আধার নেমে এলো। সর্বদা রুহুলই দুলাল সিরাজীর কাছে প্রিয় পাত্র আর তারা চেয়ে চেয়ে দেখে যায়।

দুলাল সিরাজী আবারো বললো, “মহি আর হেলাল কাইল ই যাবি তোরা দুইজন হাবিবুল্লাহর বাড়ি।তাগো যা যা লাগে সব দেওয়া হইবো। আর হাতে নগদ কিছু টাকা পয়শাও দিয়া আইসিস।”

হেলাল আর মহীবুল দাদার কথায় সম্মতি জানালো।

অন্যদিকে রুহুল ভাবছে সে তো এই প্রশংসার যোগ্য না। কারণ হাবিবুল্লাহর পরিবারের দায়ভার নিতে বলেছে গতরাতে তার বিবিজান। সে নিজেও প্রশংসিত তার বিবিজানের এত সুন্দর চিন্তাভাবনা করার জন্য। বিবিজান না বললে বোধহয় হাবিবুল্লাহর পরিবারে দুর্ভোগ নেমে আসতো। ভাগ্যিস বুদ্ধিটা দিয়েছল।তবে মাথায় একটা চিন্তা বারংবার ঘুরপাক খাচ্ছে হাবিবুল্লাহ কে মা’রলো টা কে?
____________________________

কাকন রাতের খাবার তৈরি করছে। সে এখন বেশ সংসারী হয়ে গেছে। বলা যায় শাশুড়ীর সাথে তাল মিলিয়ে সব কাজ করে।
সামিয়া খুশি হয়ে হেশেলের কাছে বসলো। সেখানেই রুটি ভাজছে কাকন। আর বাকিরা অন্য কাজ করছে। সবাই মিলে রুহুল, মহীবুল,হেলাল এদের ছোট বেলার গল্প বলা বলি করছে আর কাকন শুনে হাসছে। তার বেশ মজা লাগছে এগুলো শুনতে। দাদিমার সাথে রুহুলের ছোটবেলায় করা খুনশুটি গুলো বেশি বিনোদন দিচ্ছে কাকনকে। সামিয়া কাকন কে বললো,”ভাবিজান আপনে ছোটবেলায় কেমন আছিলেন, কি কি দুষ্টামি করছেন?”

কাকনের হাত এর খুন্তি যেন থেমে গেলো। সকলে কাকনের উত্তরের আশায়।কাকন যে চুলোয় রুটি দিয়েছে তার খেয়াল ই নেই।আসলেই তো দুষ্টুর মহারানি ছিল সে। মায়ের হাতে কত মা’র খেতে হয়েছে। অথচ আজ মা নেই। সে তার জগতে বিচরণ করতে ব্যস্ত। সামিয়ার ধাক্কায় হুশ ফিরলো।কাকন রুটি নামিয়ে মাথা নত করে আবার কাজে মন দিলো।

মালেকা উৎসুকভাবে বললো,”কি গো রুহুলের বউ ধ্যান ধইরা রইলা কেন। আমরাও শুনি তুমি কেমন আছিলা। আচ্ছা তোমার বাপ মা কি করতো গো?”

কাকন এক পলক মালেকার দিকে চাইলো। সুভা বুঝতে পারলো কাকন এর হয়তো মন নষ্ট হয়ে গেছে। সুভা বললো, “থাক মালেকা ওকে এগুলো বলো না। মেয়েটা অল্প বয়সে বাপ মা হারা হয়েছে।ওর মনের অবস্থা ভিন্ন।”

মালেকা বলল,” হুম হেইডাই তো জানবার চাই রুহুলের বউ কেমনে হইলো এতিম।”

কাকন ছোট নিশ্বাস ত্যাগ করে বললো, “আমি এতিম ছিলাম তবে এখন আর এতিম নই আমি ছোটআম্মা। আমার চার টা মা আছে। ফাতিমা আপা, আম্মা, আপনি আর চাচিআম্মা আমার চারজন মা। আব্বা ও আছে। দাদা-দাদি, ভাই-বোন ও আছে।তাই আর এখন আমি এতিম নই। ”

কাকনের কথা সকলের ই হৃদয় স্পর্শ করলো। মালেকারও বেশ মায়া হলো। দাদিমা মালেকা কে স্পষ্ট ভাবে বললেল, “আইজকার পর নাতবউ রে কেউ আর এতিম কইবো না।আর যে ওরে এতিম কইবো মনে কইরো সিরাজী আম্মার সাথে লাগতে আইছো ”

দাদিমা কাকনের কাছে যেয়ে বললো,” তুই এতিম না। আমরা সক্কলেই আছি তাই না। তুই মন মরা কইরা থাকিস না ঠিক আছে নাতবউ। ”

সামিয়া মুখ ছোট করে বললো, “ভাবিজান আমি বুঝি নাই যে আপনার মন খারাপ হইবো। আমারে মাফ কইরা দেন।”

কাকন মিছে হেসে বললো, “তোমার কোনো দোষ নেই।আর আমার মন খারাপ ও হয় নি। তুমি আমার ছোট বেলা সম্পর্কে শুনবে?”

সকলেই উৎসুক হয়ে চাইলো কাকনের পানে। যেন সকলেই জানতে চায়।

কাকন বললো,”আমার বাবা-মায়ের একমাত্র মেয়ে ছিলাম আমি। বাবার চোখের মনি। আর মাও অনেক আদর করতো। বাবা-মা’র আদর ভালোবাসায় সারাদিন আনন্দে কেটে যেত। আমার সই ছিল ওদের সাথে কত খেলেছি। সাড়ে ১৩ বছর জীবনে আনন্দের কোনো অভাব ছিল না। কিন্তু তারপর ই সেই ভয়াবহ ঝড় জীবন থেকে সব আনন্দ কেড়ে নিয়ে গেলো। বাবা -মা আমাকে ছেড়ে চলে গেলো না ফেরার দেশে।যখন আমার হুশ হলো তখন আমি মহিলাশালায়। আমাকে কখন মহিলাশালায় আনা হয় আমার মনেই নেই।আমি নাকি ওই যে নিমতলির পানিতে ভেসে ছিলাম। হয়তো পানির সাথে ভেসে এসেছিলাম। কিন্তু সেই ঝড় আমার সব কিছু ভাসিয়ে নিয়ে গিয়েছিল, যা হয়তো আর কোনো দিন ফিরে আসবে না।”

সকলেই কাকনের কথা শুনে স্তব্ধ। এই টুকু বয়সে কতটা কষ্ট সয়েছে কাকন। কাকনের চোখ দিয়ে ধারা বইছে। কাকন হাতের উল্টো পিঠ দিয়ে মুছে মুখে হাসি টানলো তারপর আবার রুটি ভাজতে শুরু করলো।
অথচ সকলেই নিরব হয়ে গেলো কাকনের কথায়। আর কাকন এমন ভাব করলো যেন কিছুই হয় নি। কেউ আর কথা বাড়ালো না চুপ চাপ কাজ করে গেলো।
___________________________

রাতে সব কাজ শেষে কাকন কক্ষে গেলো। দেখলো রুহুল চেয়ারে বসে খাতায় লেখালেখি করছে। কাকন রুহুলের কাছে দাড়ালো। মুখ ফুটে সামিয়ার কথা টা বলতে চায় কিন্তু বলতে পারছে না।
রুহুল হিসেব করছিল। কাকন কে দেখে চোখ খাতায় নিবদ্ধ রেখেই বললো, “কিছু বলবেন বিবিজান? ”

কাকন এর কথা যেন গলায় আটকে গেলো। রুহুল আন্দাজ করে বললো, “ভয় নেই যা ইচ্ছে বলতে পারেন”

কাকন আমতা আমতা করে বললো, ” আসলে সামিয়া মানে আপনার…”

কাকন এর কথা শুনে রুহুল খাতা বন্ধ করে রাখলো। তারপর কাকনের কোমড় জড়িয়ে নিজের কোলে বসিয়ে বললো, “সামিয়া আমার কি হুম?”

কাকন এর আবারো কাপা-কাপি শুরু হয়ে গেলো। তবুও বললো,”আসলে বিয়েতে আপনার যে একটা শহুরে বন্ধু এসেছিল তাকে সামিয়া বিয়ে করতে চায়।”

রুহুল কাকনের কাধে ধুতনি রেখে না জানার ভান করে বললো,”ওহ আচ্ছা, তো আমার কি করতে হবে?”

–“সামিয়া বললো আপনি চাইলেই ওদের বিয়ে হবে। দাদাজানসহ সকলেই আপনার কথা শোনে।জানেন সামিয়া আজ অনেক কেদেছিল আমার ভীষণ মায়া লেগেছে। আপনি ওর ইচ্ছে টা পুরণ করুন না।”

রুহুল কাধে শব্দ করে চুমু খেয়ে বললো, “ভেবে দেখবো”

–” ন..না ভেবে দেখা যাবে না। সামিয়া আমায় বলেছে আপনাকে রাজি করাতে হবে।যেন আপনিও বাড়ির সকলকে রাজি করাতে পারেন। ”

রুহুল কাকনকে কোলে তুলে নিয়ে বিছানায় শুইয়ে দিলো। নিজে আধশোয়া হয়ে কাকনের গালে হাত রেখে বললো, “আমার আদরের ছোটবোন সামিয়া। ওর ভালো মন্দ দেখার বিষয় আমার। আমি চাই বকুল ওর পরিবার কে নিয়ে আসুক। আমি কখনো যেচে বোন দিতে যাবো না। বকুল যদি ওর পরিবার কে নিয়ে আসে তাহলে আমার কোনো আপত্তি নেই। ”

কাকন রুহুলের উত্তরে খুশি হলো। বললো,”বেশ আমি সামিয়া কে বলবো অপেক্ষা করতে।”

রুহুল হেসে নাকে নাক ঘেঁষে বললো,”হুম”।
কিন্তু রুহুলের হাসি গায়েব হয়ে গেলো। সে ভালো ভাবে খেয়াল করলো কাকনের চোখ লাল হয়ে আছে যা থেকে স্পষ্ট বোঝা যায় কাকন কেদেছে।

রুহুল চোখে হাত রেখে বললো, “আপনি কেদেছিলেন বিবিজান?”

কাকন এই কথা শুনে অপ্রস্তুত হয়ে গেলো।
রুহুল আবারো বললো,”কি হলো বলুন বিবিজান?”

–“না মানে আসলে আমার বাবা-মার কথা মনে হয়েছিল। অনেক দিন হলো ফাতিমা আপা কেও দেখি না। ওদের কথা খুব মনে পড়ছিল। আর আমার মহিলাশালায় যেতে ইচ্ছে করছিল। ”

রুহুল কাকনের হাত নিজের হাতের মুষ্টিতে নিয়ে বলল,”আগামী কাল সকালে আপনাকে মহিলাশালায় দিয়ে আসবো সারাদিন থাকবেন সেখানে। এবার খুশি তো ।”

কাকন প্রচন্ড খুশি হয়ে গেলো। ২৮টা দাত বের করে হেসে মাথা নেড়ে জানালো সে খুব খুশি।

রুহুল কাকনের চোখে চুমু খেয়ে কাকনকে বুকে নিয়ে শুয়ে পড়লো। তারপর বললো, “আপনার সকল ইচ্ছে শুধু একবার আমাকে জানাবেন বিবিজান। সেই ইচ্ছে গুলো পুরণ করার দায়িত্ব আমার। আপনার মুখের হাসি আমি সব চাইতে বেশি ভালোবাসি বিবিজান।”

চলবে….
#দেবী
#শবনম_রাবাহ

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here