দেবী,২৭,২৮

0
351

#দেবী,২৭,২৮
লেখিকাঃ শবনম রাবাহ (স্রোতস্বিনী)
কপি করা সম্পুর্ণ নিষেধ।
২৭ঃ

কাকন সকালে সবার আগে সুভার কাছে গেলো। গিয়ে বললো, “আমি মহিলাশালায় যেতে চাই আম্মা। এগুলো সব ভুলে যেতে চাই তাই।তাই আপনার ছেলে নিষেধ করলেও আপনি আমায় যেতে দিবেন।”

সুভা কাকনের দিকে চেয়ে বললো, “বেশ ভুলে যেতে চাও এটা ভালো কথা। খোকা কে বোঝানোর দায়িত্ব আমার। ”

–“একটা কথা বলবেন আম্মা।ওই কক্ষে কি প্রায় ই লাশ আনা হয়। সিরাজীরা কি অনেক খুন করে?”

–“না আর কোনো খুন করা হবে না।আর না কোনো লাশ ওই কক্ষে আনা হবে। খোকার নিষেধ আর কাউ কে খুন করা হলে খোকা নিজে পুলিশ আনবে।”

–“ওনার উচিত ছিল অনেক আগেই পুলিশ জানানো। ”

–“এসব নিয়ে তোমার ভাবতে হবে না। তুমি যাও তৈরি হও। এসব নিয়ে ঘাটাঘাটি না করাই উত্তম তোমার। ”

সুভা ব্যাতিত কেউ ই রাজি ছিল না মহিলাশালায় কাকনের আসাতে। সুভা নিজে বলেছে কাকন কে যেন মহিলাশালায় দিয়ে আসা হয়। রুহুল মনে প্রাণে চাইছিল যেন কাকনকে যেন বাধা দেওয়া হয়। রুহুল বার বার বলেছিল না গেলে হয় না। কিন্তু কাকন তার কথায় দৃঢ় ছিল। রুহুলের কিছু অভিমান ও হয়েছে যা আসার পথেই কাকন বেশ বুঝেছিল। কিন্তু কাকনের কাছে মহিলাশালায় আসা টাই বেশি জরুরি।
___________________________

পাঁচদিন পর~
আজ পাঁচদিন হলো কাকন মহিলাশালায় এসেছে। এই ক’টা দিন কাকনের স্বাভাবিক ভাবেই কেটেছে।নিজেকে সেই আগের কাকনের মতোই অনুভব হয়েছে। এখানে কোনো জমিদার বাড়ির বউ আর না কোনো বাড়ির স্ত্রী মনে হয়েছে।তবে দিনশেষে ঘুমানোর সময় রুহুলের বুকের কথা মনে পড়েছে বারংবার। রুহুলের বুকে মাথা রেখে ঘুমানো যে কাকনের নিত্যদিনের অভ্যাসে পরিণত হয়েছে।সেই শক্ত বুকে ঘুমানোর মধ্যে যে শান্তি শিমুল তুলোর নরম বালিশেও সেই শান্তি পায় নি কাকন।

কাকন মাটির সিড়িতে বসে আছে। বার বার গেইটের দিকে তাকাচ্ছে। মনে হচ্ছে একটা বার যদি রুহুল আসে মন্দ কি। এই মানুষ টা যে বর্তমানে কাকনের সবচেয়ে কাছের। তবুও মুখফুটে বলার অধিকার যে মস্তিষ্ক যে দেয় না কাকন কে। হৃদয় ও মস্তিষ্কের কেন এত বিরোধিতা। শুনেছে ঢাকা গিয়েছে রুহুল তাই কাকন কে একটা বার দেখতে ও আসে নি । কাকনের ইচ্ছে করছে রুহুল কে এক পলক দেখার। রুহুল এর ভালোবাসা কাকনকে রুহুলের প্রতি আসক্ত করেছে। তবে মন টা উদাস কেন সিরাজী বংশেই রুহুলের জন্ম হলো।

ফাতিমা কাকনের কাছে এলো হাতে নিয়ে তেলের বোতল। ফাতিমা তেল এনে কাকনের হাতে দিলো। দুকদম ফেলেই শিড়ি বেয়ে বাড়ান্দায় ওঠা যায়। কাকন উপরের সিড়তে বসা ছিল।ফাতিমা নিচের সিড়িতে বসলো তারপর বললো, “আমারে একটু তেল দিয়া দে তো কাকন?”

কাকন হেসে তেলের বোতল টা নিলো। বললো, –“আসেন , বসেন আপা আমি দিয়ে দিচ্ছি।”

–“হুম তোর হাতে তো জাদু আছে। আমার মাথা ঠান্ডা হইয়া যায়। তা তর শাশুড়িরে তেল দিয়া দেস না? ”

–“না ওনাকে কখনোই আমি তেল দিয়ে দেই নি আপা। উনি নিজেই নিজের মাথায় তেল দেয় বোধহয়। ”

–“তাই কি তুই জোর কইরা দিয়া দিবি।তর শাশুড়ি বড় ভালা মানুষ কাকন।তার কথা মত চলিস,সম্মান দিবি। ”

–“ওই বাড়িতে উনিই তো আমার সবচেয়ে বেশি আপন আপা। তবে ওনার উপর জোর ঘাটাবার সাহস নেই।”

–“হুম এইডা ঠিক। তয় তর সুয়ামি কিন্তু তর শাশুড়ির মতো হইছে তর শাশুড়ি খুব সুন্দর গঠন এর। খালি গায়ের রঙ ভিন্ন। ”

–“জি আপা।আমার কাছে সাহেবের চোখ দুটি খুব প্রিয়। ওনার চোখ দুটিতে আমি আমার আসল ভালো বাসা খুজে পাই। এই চোখ জোড়া দেখলেই মনে হয় নয়ন জুড়ে আমার জন্য অফুরন্ত ভালোবাসা রয়েছে। ”

–“হুম বুঝলাম। তা একটা কথা ক দেহি?”
–“কি কথা আপা?”
–“এই কয়দিন এত মনমরা হয়া আছা কেন? ”
–“কই না তো। মন মরা হবো কেন।”
–“মিথ্যার কথা কইবি না কাকন আমি বুঝছি। তুই কি কোনো কিছু নিয়া দুশ্চিন্তায় আছা কাকন?”

কাকন মনে মনে বললো, “কিছু কথা এমন থাকে আপা যা কাউকে বলা যায় না”।
তবে মুখ ফুটে বললো, “তেমন কিছুই নয়। অনেক সুখে আছি আমি সেখানে। অনেক সুখে। দুয়া করবেন এই সুখ যেন আমি হারিয়ে না ফেলি। ”

ফাতিমা বললেন,”তুই সারাজীবন সুখে থাকবি। আমার দুয়া সব সময় তোর সাথে আছে। ”
_______________________

দুলাল সিরাজী নিজে আজ মহিলাশালায় এসেছে কাকন কে নিতে। যেহেতু রুহুল কাজের ব্যস্ততায় আছে। আর ঢাকায় একটা ফ্যাক্টরি দিচ্ছে তাই সেখানেই থাকতে হচ্ছে রুহুলের। মহীবুল আর হেলাল এর ওপর সিরাজপুরের দায়িত্ব। তার উপর সাতদিন পর সামিয়ার বিয়ে। সেই সাথে আবারো মেহমান আসা শুরু করেছে সিরাজী মঞ্জিলে। কাকন বাড়ির বড় বউ সেই সুবাদে কাকন কে আজ সিরাজী মঞ্জিলে থাকতেই হবে। তাই দুলাল সিরাজী কাকন কে নিতে এসেছে। দুলাল সিরাজী কে দেখেই কাকন উঠে দাড়ালো তারপর সালাম দিলো।

দুলাল সিরাজী কে ফাতিমা বসতে দিলো। কাকন কে বললো পান বানিয়ে আনতে আর শরবত দিতে। সেই কথা অনুযায়ী কাকন পান আর শরবত এনে দিলো দুলাল সিরাজী কে।

দুলাল সিরাজী পান মুখে দিতে দিতে বললেন,” যাও কাকন তুমি তয়ার হইয়া আইসো। আমি ততক্ষণে এইখানে বসি। ”

কাকন দুলাল সিরাজীর কথায় মাথা নেড়ে কক্ষে চলে গেলো। আবার এই চিরচেনা ঘর, আপন মানুষ গুলো কে ছেড়ে চলে যেতে হবে। না জানি আবার কবে আসতে পারবে। এই ঘরটায় কাকন সবচেয়ে বেশি শান্তি পায়। কাকন নিজের সব জিনিস কাপড়ের ব্যাগে ভড়লো। তারপর সকলের থেকে বিদায় নিয়ে চললো সিরাজী মঞ্জিলের উদ্দেশ্যে। গেইটের কাছে সব মেয়েরা দাঁড়িয়ে আছে।কাকনের ভিতরেও কেমন কষ্ট লাগছে। তবুও নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করে হাসি মুখে গেইট দিয়ে বের হলো। ফাতিমা বরাবরের ন্যায় আজ ও কাকন কে বিদায় দেওয়ার সময় নিজের চোখ ভিজালেন।

কাকন মুচকি হেসে গরুর গাড়িতে উঠবে এমন সময় একটা ফেলে যাওয়া জিনিসটার কথা মনে পড়লো কাকনের।
দুলাল সিরাজীর দিকে চেয়ে বলল, “দাদাজান আসলে আমার একটা দরকারি জিনিস ফেলে রেখে এসেছি। আমি যেয়ে নিয়ে আসি। ”

দুলাল সিরাজী পানের পেচকী ফেলে বললেন,”আচ্ছা দরকারি জিনিস যেহেতু যাও তাড়াতাড়ি নিয়া আইসো।”

কাকন দৌড়ে মহিলাশালার কক্ষটিতে গেলেন। নিজের জং ধরা ট্রাঙ্কটি খুলে কাপড়ে মুড়িয়ে রাখা জিনিসটা ব্যাগে তুলে নিলো। এটিই যে এখন ভীষণ দরকার এখন কাকনের। তারপর আবারো বেরিয়ে এলো কক্ষ থেকে। গরুর গাড়িতে চড়ে কাকন চললো শশুড় বাড়ি।

গরুর গাড়ি চলতে চলতে পৌছাল বকুল তলা।কাকনের চোখ গেলো বকুলতলার সেই বকুল গাছটিতে। এই জায়গা টা দেখলেই কাকনের খুব ভয় করে। কাকনের মনে হয় এই বকুলতলা ওর জন্য নরক। যেখানে ওর সর্বদা বিপদ হবে। বৈশাখের শুরুতেও তো এই বকুলতলায় সকলে কাকন আর রুহুল কে কত বাজে মন্তব্য করেছিল। কিন্তু মান -সম্মান খোয়ানোর ভয়ে দুলাল সিরাজী বিয়েই দিয়ে দিল কাকনের। কই একটা বার কাকনের মতামত জানতে চাইলো না। কাকনের ও তো মতামতের দরকার ছিল।মঞ্জিলে কাকন সুখেই আছে তবে সেদিন মতামত নেওয়া অপরিহার্য ছিল।

নানা ভাবনার মাঝেই কাকন সিরাজী মঞ্জিলে পৌছালো। প্রহরী মাথা নত করে গেইট খুলে দিলো।
কাকন ও অন্দরমহলে চলে গেলো।
______________________

কাকন সিরাজী মঞ্জিলে এসে সকলের সঙ্গে কথা বললো। আলেয়া রোকেয়া আবারো এসেছে। ননদ গুলো কাকন কে পেয়েই জড়িয়ে নিলো। সামিয়া তো নিজের কাছেই কাকনকে বসিয়ে দিলো। কাকন হাতের ব্যাগ টা রানুর কাছে দিলো আর বললো ব্যাগ টা যেন স্বযত্নে কাকনের কক্ষে রাখা হয়। রানু ব্যাগ নিয়ে কাকনের কক্ষে রাখতে গেলো।

বসার ঘরে বেশ কিছুক্ষণ কাকন ননদ দের সাথে কথা বললো। আলেয়া গর্ভধারণ করেছে। পাঁচ মাসে পেট বড় হয়েছে। এটা তিন নাম্বার সন্তান। আলেয়ার আরো দুটো সন্তান আছে। কাকন বেশ খুশি হয়ে আলেয়ার ছোটমেয়ে কে কোলে নিয়ে আদর করতে লাগল। আর বড়ছেলেটা রোকেয়ার ছেলেকে নিয়ে খেলাধুলা করছে।

বাচ্চা কোলে কাকনকে দেখে দাদিমার বংশধরের কথা মনে পড়লো। কাকনের কাছে যেয়ে বসলেন। তারপর
বললো, “তর মনে হয় পোলাইপান ভাল্লাগে তাই না?”

কাকন মুচকি হেসে বললো, ” ভীষণ ভালো লাগে দাদিমা। দেখুন না কি সুন্দর০ মিস্টি মেয়ে। ”

দাদিমা রোকেয়াকে ইশারা করলেন কাকনের কোলে থেকে বাচ্চা টা নিয়ে নিতে। রোকেয়া এক প্রকার জোর করেই নিলো। কাকন বাধা দিতে চাইলে দাদিমা হাত ধরে রাখলেন। বললো, “পরের পোলাপান এমন ডাই হইবো। তুই কিছুক্ষণ রাখতে পারবি তারপর যার তা হেতিই নিয়া নিবো। তার জন্য তর কি করা লাগবো? ”

আকস্মিক এমন ঘটনায় কাকন হকচকিয়ে গেলো। বললো, “মা,,মানে, কি করতে হবে দাদিমা? ”

–“মানে খুব সহজ, তুই নিজে তর কোল ভইড়া পোলাপান নে। যখন খুশি আদর করবার পারবি, কোলেও নিবার পারবি। কি নিবি তো পোলাপান? ”

দাদিমার কথায় কাকন মাথা নিচু করে ফেললো। বললো,”দাদিমা, আসলে আমি মানে উনি তো..”

দাদিমা কিছুটা রাগান্বিত হয়ে বললেন, “কিসের আসল নকল,,তরে তো আগেও কইছি আমার মানিকের ঘরে তাড়াতাড়ি পোলাপান চাই। কিন্তু তুই আমার কথা শুনতাছোস না। আমি আজ স্পষ্টভাবে কইয়া দিলাম সামিয়ার বিয়া পার হইয়া গেলেই জানি সুখবরডা পাই।”

সকলের সামনে এমন ঝাজালো কথায় কাকন মাথা নিচু করে ফেললো। বাচ্চা তার ভালো লাগে কিন্তু বাচ্চা তো রুহুল এখনি চায় না। রুহুল বলেছে কাকন বাচ্চা নেওয়ার জন্য উপযুক্ত নয়। তারপর ও কেন বারবার এগুলো শুনতে হয় কাকন কে।

দাদিমা যেন রেগেই বসারঘর ত্যাগ করলেন। এমন অবস্থায় বসার ঘরে পিন পিন নিরবতা। কাকন ঠিক ই মন খারাপ করে মাথা নিচু করে বসে রইলো। একচুল ও নড়লো না সে।

আলেয়া কাকনের কাছে বসে বললো, “ভাবিজান তুমি কিছু মনে কইরো না। দাদিমা তো এমন ই।”

কাকন আলেয়ার দিকে মুখ ফুলিয়ে বললো, ” আমি ওনাকে বলেছিলাম বাচ্চার কথা। উনি বলেছে আমার ১৮ বছর হলে বাচ্চা নেবে। উনি শিক্ষিত মানুষ উনি নাকি বই এ পড়েছে অল্প বয়সে বাচ্চা হলে মায়ের মৃত্যুর ঝুকি থাকে। আর উনি আমাকে হারানোর ভয়ে এখনি বাচ্চা চায় না। এতে আমার কি দোষ আপা। ”

কাকনের কথায় আলেয়া-রোকেয়া হেসে দিলো। রোকেয়া বাচ্চা টিকে কাকনের কোলে দিয়ে বললো, “বাহ আমাদের দাদাভাই দেখি বউ হারানোর ভয়ে বাচ্চাই নিতাছে না। এত মহব্বত হাহ। ”

কাকন এবার লজ্জা পেলো। আলেয়া বললো, “হুম আমার দাদাভাই আসলেই বউ পাগল হইয়া গেছে। বউ এর জন্য এত ভয় যে বাপ হইতাছে না।”

সামিয়া কাকনের গলা জড়িয়ে ধরে বললো, ” আরে ভাবিজান মঞ্জিলে নাই দেইখা দাদাভাই সেই যে ঢাকা গেছে আর আসতাছেই না।”

আলেয়া বললো, “ক্যান গো ভাবি আমারা ভাই ডারে এত কষ্ট দেও। জানোই তো তোমারে ছাড়া কিচ্ছু বোঝে না। আর যাও না জানি কইয়া দিলাম।”

কাকন হেসে বললো, “কেবল তো শুরু, আরো অনেক কষ্ট দেবো তোমার ভাই কে। একটিবারের জন্য ও আমায় দেখতে যায় নি মহিলাশালায়। তোমরা বসো আমি আম্মার সাথে কথা বলে আসি। ”
কথাটি বলেই কাকন উঠে পড়লো। এখন সে সুভা কে খুজছে। সুভার সাথে দেখা করতে ইচ্ছে করছে। কিন্তু রন্ধনশালায় নেই। তাই ভাবলো কক্ষে যেয়ে হাত মুখ ধুয়ে এসে সুভার কাছে যাবে।
_______________________

সিড়ি বেয়ে উপরে উঠছিল কাকন। কিন্তু দেখলো হেলাল তিনতলা থেকে নামছে। কাকন কিছুটা অবাক হলো তিনতলায় হেলাল কেন গিয়েছিল। আবার কি কোনো লাশ রাখতে। কিন্তু সুভা যে বললো আর কোনো লাশ ওই কক্ষে রাখা হবে না। এটা রুহুলের নিষেধ।

কাকন হেলালের পথ আটকে ধরলো। বললো, “আপনি তিনতলায় গিয়েছিলেন ছোটভাই। দাদাজান তো বলেছিল সেখানে যাওয়া নিষেধ। ”

হেলাল আমতা আমতা করে বললো, ” না মানে তিনতলার সামনের ঘরে বড় বড় হাড়ি পাতিল আছে যেগুলা সামিয়ার বিয়ার সময় রান্দার কাজে লাগবো তাই দেখতে গেছিলাম আছে কি না।”

–” ওহহ ওইখানে আছে কি সব?”
–“হ্যাঁ আছে তো। আমি যাই রানু রে ডাইকা ওগুলা নামাই।”

–” রানু কে লাগবে না চলুন আমি আপনাকে সাহায্য করবো চলুন।”

–“না না তোমার কাম করা লাগবো না ভাবিমা। আমরা তো আছিই।আমি থাকতে তুমি কেন কাম করবা। ”

–“হ্যাঁ হ্যাঁ ঠিক ই বলেছেন। আপনিই তো আছেন। এই বাড়িতে আপনাকে আমি আমার নিজের ভাই মনে করি। আপনি কি আমাকে আপনার বোনের জায়গা দিতে পারবেন না ছোট ভাই। ”

কাকনের এহেন কথায় হেলাল ভড়কে গেলো। রুহুলের স্ত্রীকে বোনের জায়গা দেবে হেলাল যা তার কাছে হাস্যকর। তবে বললো, “হুম মনে করি। তুমি যাও ভাবিমা। কেবল আসলা মঞ্জিলে যাও, বিশ্রাম নেও।

কাকন হেসে বললো,” ঠিক আছে।”
কথাটি বলে কাকন চলে যাবে তখন ই দেখলো মহীবুল নামছে। মহীবুল কে দেখেই কাকন আন্দাজ করলো হাড়ির জন্য যায় নি তারা।কাকন নিজ কক্ষের দিকে গেলো কারন মহীবুল লোকটাকে কাকনের পছন্দ নয়।

মহীবুল তিনতলা থেকে নেমে হেলাল কে নিয়ে নিচে নামলো। তারপর হেলালের কক্ষে গিয়ে বিছানায় পা তুলে দিয়ে বসে বললো,, ” কেডায় যে এই কাম ডা করলো। বা* আমাগো ঘাড়েই সব চাপায় এই বুইড়া। ”

হেলাল বিরক্তিকর মুখ বানিয়ে বললো, “ঠিক কইছা মহী ভাল্লাগে না আর এত কাম।তুই ঘরডা ভালো কইরা তালা লাগাইছা তো। না জানি কেডায় ওই ঘরে গেছিলো।”

মহীবুল সিগারেট ধরিয়ে টান মারলো। বললো, “কেডায় আর যাইবো তর বাপের বড় বউ ছাড়া। ”

হেলাল তাচ্ছিল্যের সাথে বললো, ” হ,,বেছারির জন্য মায়াই হয় বুঝলি মহী। চোক্ষের সামনে লাশ দেইখাও কিছুই করতে পারে নাই,হাহাহা।”

–“তয় যা ই কস রে হেলাল ওইরাতের ঘটনা জানে না।আর সবচেয়ে বড় ভাগ্য কি জানোস?”

–“কি?”
–” ওইরাতে রুহুল আছিল না। তা না হইলে সিরাজী মঞ্জিলে ভয়াবহ আগুন জ্বলতো।”

— “তাইলে সবার আগে বুইড়া সিরাজী রে জ্বালান লাগতো। ইশ ওই মালডা যদি বাইচা থাকতো ভাই, কসম আমি না খাইয়া ছাড়তাম না।”

মহীবুল হুহা করে হেসে বললো, “শা’লা তুই তো দেহি আমার থিকাও বড় লু’ইচ্চা। জাত দেহোস না। ”

হেলাল বললো, “তর থিকাই শেখা শা’লা। কম তো আর যাস নাই জীবনে অন্ধকার গলিতে। ওইখানে মনেহয় খুব জাত দেখছা তুই। ”

–” যামুই তো। আমি তো আর রুহুল সিরাজী না যে কবে বউ হইবো আর সেই আশায় জীবন পার করমু।”

–“দাদাভাই বুঝলি ভাবিমা রে অনেক ভালোবাসে।দেহোস না বোইনেরা ভাবিজান কয়। আর আমাগো দুই ভাই রে ভাবিমা কইতে কইছে। বা* ওইরম মা’ল রে ভাবিমা কইতে ও রাগ লাগে শা’লা ****।”

–” একটা কথা শুইনা রাখ আমি তোর ভাই এর মতো হমু না। তোর ভাই তো সুন্দরী বউ এর আঁচল ধইরা থাকে। আমার বউ সুন্দরী হইলেও আমি বা* ঘরেও খামু বাইরে ও খামু। ”

হেলাল আফসোস এর স্বরে বললো,”চাইলে সব ই খাইতে পারমু জীবনে। কিন্তু যদি ওইডারে রে খাইতে পারতাম কাম হইতো। রাইতের আলোতে পা দুইডা চিকচিক করতেছিল। ”

মহীবুল সিগারেট ফেলে বললো,”নাম জানি কি আছিল”

–“কি জানি নাম,, ওহ হ্যাঁ ‘দেবী’। ”

#চলবে…….

#দেবী
লেখিকাঃ শবনম রাবাহ (স্রোতস্বিনী)
কপি করা সম্পুর্ণ নিষেধ।
২৮ঃ

“অভিমান” যা কেবল আপন মানুষের সাথেই করা হয়। তবে কিছু কিছু ক্ষেত্রে অভিমান করা ব্যাক্তিই এতে বেশি ভোগে। যেমনটি ঘটছে রুহুলের সাথে। রুহুলের মনে তীব্র অভিমান হয়েছে। এত ভালোবাসার পরেও কাকন কেন তার সাথে এমন করে। তবে সেই অভিমানে রুহুলের চিন্তা হচ্ছে তার এমন অভিমান দেখে যদি বিবিজান কাদে তাহলে যে বিবিজানের তুলনায় তার নিজেরই অধিক বেদনা হবে। রুহুল নিজেও মনে করে কাকন অল্প বয়সী। জ্ঞান বুদ্ধি কম তাই হয়তো এমন করে। কিন্তু কাকনের চেয়েও অল্প বয়সী মেয়েরাও সংসার করছে। বাচ্চা কাচ্চাও হয়েছে কারো কারো। অথচ কাকন সর্বদা রুহুল এর ভালোবাসা উপেক্ষা করে। এত বার বললো, ‘থেকে যান মঞ্জিলে, যাবেন না মহিলাশালায়।’ কিন্তু তার বিবিজান যে নিজের কথায় অনড়। সেই রুহুলের ভালোবাসার সুযোগ নিয়ে মহিলাশালায় গেলো। তাও সাতদিন থাকবে। রুহুল ও মনে মনে পণ করলো যা ই হোক না কেন সে তার বিবিজানের সাথে আজ কথা বলবে না। সেও উপেক্ষা করে চলবে।

ট্রেনের জানালা দিয়ে প্রকৃতি দেখছে রুহুল। দমকা হাওয়া রুহুলের চুল গুলো উড়িয়ে দিচ্ছে বারংবার। তবে মনের গহীনে জমেছে তীব্র অভিমান। কেন তার বিবিজান বোঝে না সে যে রুহুলের অভ্যাস হয়ে গেছে। আর প্রত্যেক টা মানুষ অভ্যাসের দাস। তাই তো রুহুল কাকনের কাছে নিরুপায়।
_______________________

জামালের কক্ষে বসে আছে দুলাল সিরাজী। সাথে আছে মহীবুল। মহীবুল জামাল সিরাজীর কাছেই বসে আছে। জামাল আর মহীবুল দুজনেই মাথা নত করে আছে।

দুলাল সিরাজীর কথার উপর কথা এই সিরাজপুরে কারো বলার সাহস নেই। লোকটা যতটা দয়ালু তার চেয়েও ভয়ংকর হতে পারে। তবে বাইরের লোকজন তার এই ভয়াবহতা বোধহয় জানে না।

দুলাল সিরাজী গলা ঝেড়ে কেশে উঠলেন। যা জামাল আর মহীবুলের হৃদগতি আরো বাড়িয়ে দিলো। জামাল যেন এখনি ঘামতে শুরু করে দিয়েছে। হাত ভাঙার আসল বিষয়টি যদি তার আব্বাজান জানে তাহলে লজ্জাজনক ব্যাপার হয়ে যাবে। তবে আর কি কারন আছে যার কারনে জামালের কক্ষেই দুলাল এলো।

দুলাল সিরাজী দুজনের দিকেই চাইলেন।তারপর বললেন,” সামিয়ার বিয়ার আগেই হাত ডা তো ভাংলা। তয় পা তো ঠিক আছে। হাইটা কি গুদামঘরে যাওয়া যায় না। কত কাম পইড়া থাকে।”

জামাল মাথা নিচু করে বললো, “আসলে আব্বাজান, আমার হাতডা খুব ব্যাদনা করে তাই যাইতাছি না।ভাবছি যে একবারে সামিয়ার বিয়ার শেষেই যামু। ”

–“বিয়া কি তোমার যে তুমি বিয়ার পর যাইবা। ”

–” না আব্বাজান আমার বিয়া হইবো কেন।আর আমি কইলাম তো যামু। মহী তো দেখাশুনা করতাছেই। ”

–“কাম চোরা স্বভাব আর গেলো না তোমার। এই জন্যই আইজ তোমার এই দুর্গতি। তাইলে আসল কথা কই? ”

আসল কথা শুনে জামাল মহীবুল একে অপরের দিকে চাইলো।এখন আবার কি বলবে।

দুলাল সিরাজী জামালের ভাঙা হাত ধরলেন। আলতো করে হাত ছোয়ালো তারপর বললো, “হবীবুল্লাহ রে কেন পাঠাইছিলা তোমরা ওইদিন? ”

জামাল সিরাজীর যেন জান যায় যায় অবস্থা। বললো, “আ আব্বা আমরা পাঠামু মানে সেইদিন তো রুহুলের সামনে কই…”

–“এই চপ শু*****চ্চা, একটা মিছা কথা কইবি তো তোর এই সিরাজী মঞ্জিলে শেষ দিন হইবো।”

মহীবুল দুলাল সিরাজীর হাত ধরে বললো, “দাদাজান আমরা জানি আপনে আমাগোই সন্দেহ করেন সবকিছুতেই। কিন্তু এইবারে আমাগো হাত নাই। আর হাবিবুল্লাহ তো আমাগো লোক ই আছিল।”

–“হাবিবুল্লাহ তোর বাপের চামচা আছিল। তোর বাপের ইশারা ছাড়া নড়েও না।তাইলে তগো কমু না কারে কমু”

–“দা,,দাদাজান আপনে হুদাই আমাগো সন্দেহ করতাছেন। আমরা নিশ্চিত এইডা এমন কেউ করছে যারা আপনের ক্ষতি চায়। তাই না আব্বাজান! ”

জামাল ছেলের সাথে সায় মিলিয়ে বললো, “জি জি আব্বাজান। মহী ঠিক কইতাছে।”

দুলাল সিরাজী দাড়িতে হাত বুলাতে বুলাতে বললো, “হাবিবুল্লাহ রে কি তোরা কাউ রে খুন করতে পাঠাইছিলি। মিছা কথা কইবি না।”

–“আ,,আমরা কেন খুন করবার পাঠামু। আপনে তো হজ্জে যাওয়ার আগেই কইছেন আপনি বাঁইচা থাকতে জানি আমরা আর কোনো খুন না করি। আমরা তো আর আপনেক অমান্য করমু না তাই না আব্বাজান। ”

–“তাইলে যে হাবিবুল্লাহর বউ যে কইলো হেলাল নিজে হাবিবুল্লাহর লগে রাইতে দেহা করবার গেছিলো।এইডা যদি পুলিশ জানে সিরাজী মঞ্জিলেই দোষ আসবো।”

মহীবুল আবারো বললো, “ওইডা আসলে আব্বার জন্য মদ আনার জন্য দাদাজান। বিশ্বাস করেন কছম আপনের আমরা হাবিবুল্লাহরে অন্য কামে পাঠাই নাই। ”

–“ঠিক আছে তরে বিশ্বাস করলাম। কিন্তু হাবিবুল্লাহর বউ আইজ ও থানায় গেছিলো। যদি আমার বংশের মান নষ্ট হয় তগো আমি জ্যান্ত গারমু। কথাডা মাথায় রাখিস।ভুইলা যাস না হাবিবুল্লাহ আমাগো অতীতের সাক্ষী। ও মরনের আগে যদি কিছু ফাশ কইরা যায় আমাগো মান নষ্ট হইতে পারে। আর সিরাজী মঞ্জিলের মান সম্মান আমার কাছে সবার আগে।” কথাটি বলেই দুলাল সিরাজী বেড়িয়ে গেলেন।

দুইজন ই যেন হাফ ছেড়ে বাঁচলো। জামাল কপালের ঘাম মুছে বললো, ” রুহুল ছাড়া হাবিবুল্লাহ রে কেউ মারে নাই মহী এইডা আমি নিশ্চিত। কিন্তু রুহুলের নাম কইলে রুহুলের তো কিছুই হইবো উল্টা আব্বাজান আমাগোই দোষ দিবো। ”

মহীবুল বললো,”আমার ও ওরেই সন্দেহ। কিন্তু আবার ভাবতাছি ও করলে এত চুপ কেন? ”

–“হয়তো ওর অন্য মতলম আছে!”

–“আব্বা, আমি আগেই কইছিলাম রুহুল জানলে তিনজনরেই শেষ করবো। হাবিবুল্লাহ যদি মরার আগে নাম কইয়া যাইয়া থাকে তাইলে আমরা শেষ।”

— “হেলালের গবর মাথার এই বুদ্ধিডা শুইনাই বিপদ হইলো। মাঝখান থিকা হাবিবুল্লাহ রে হারাইলাম। ”

–“সা’লা বিলালের পয়দা ডারে খুন করবার মন চাইতাছে। ওই হেলাল আবুল্লার কথা হুইনা হাবিবুল্লাহ রে পাঠানো ডাই ভুল হইছিল তা না হইলে অন্তত আমাগো নিজের লোক থাকতো।”

জামাল শয়তানি হেসে বললো, “সবুর কর সুযোগ বুইঝাই হেলাল রে খুন করমু। আর দোষ দিমু রুহুলের ঘাড়ে। আব্বাজান তখন খুনি রুহুলরে তো আর কর্তা বানাইতে পারবো না তরেই সিরাজী মঞ্জিলের কর্তা বানাইবো। রাজত্ব করমু আমরা। ”
__________________________

আজ একসপ্তাহ পর রুহুল ঢাকা থেকে সিরাজপুরে এসেছে। সব কাজ সেড়ে সে ভীষণ ক্লান্ত। সিরাজী মঞ্জিলে আসার পর সকলেই রুহুল কে ঘিরে রেখেছে। মুল কারণ সকলের জন্য রুহুল উপহার নিয়ে এসেছে।সামিয়ার বিয়ে উপলক্ষে বেশির ভাগ কেনাকাটা রুহুল ঢাকা থেকেই করেছে। নতুন পোশাক পাওয়ার আনন্দ সকলের ই আছে। তাই সকলেই বসার ঘরে অধীর আগ্রহে নিজেদের উপহার দেখছে। আর রুহুল যার যার উপহার তার তার হাতে দিচ্ছে।

কাকন রন্ধনশালায় কাজ করছিল। রুহুল এসেছে শুনে কাকনের যেন আনন্দ রাখার জায়গা নেই। কতদিন পর আবার সেই প্রিয় মুখটার দেখা পাবে কাকন। আর দুনিয়ার শ্রেষ্ঠ শব্দ ‘বিবিজান ‘ যা রুহুলের মুখে থকে শুনবে কাকন।

কাকন তাড়াতাড়ি করে উঠবে তখনি মালেকা ঝাজালো গলায় বললো,”আগে কাম সারো তার পর যাও। রুহুল তো আর চইলা যাইতাছে না। সাতদিন তো মহিলাশালায় যাইয়া গায়ে হাওয়া বাতাস লাগাইয়া আইছো। তাও কাম ফাকি দেওয়ার ধান্দা। ”

কাকন মাথা নিচু করে ফেললো। বললো, “আমি কাজ ফাকি দেওয়ার জন্য যেতে চাই নি ছোটআম্মা। আসলে উনি অনেক দুরের পথ পাড়ি দিয়ে এসেছেন ক্লান্ত হয়েছে হয়তো তাই ভাবলাম শরবত করে নিয়ে যাই।”

–” তোমার শরবত করা লাগবো না। তুমি তোমার কাম করো। রানু রে কইলেই দিয়া দিবো। ”

কাকন আর টু শব্দ করলো না তবে ঠিকই রুহুলের কাছে যেতে ইচ্ছে করলো। কাকন নিরবে নিজের কাজ করতে থাকলো।

মালেকার কথামত রানু রুহুল কে শরবত দিতে গেলো। বসার ঘরে রুহুল বসে আছে আর সকলের জন্য আনা পোশাক দিচ্ছে। রুহুলের বেহায়া চোখ দুটি বার বার তার বিবিজান কে খুজছে। এসেছে বেশ অনেক্ক্ষণ কাকন কি একটি বার আসতে পারছে না। রানু কে দিয়ে শরবত পাঠানো হলো তার জন্য। রুহুল ভাবলো এত অবেহেলা কেন রুহুলের প্রতি। শুনেছে নিশ্চয় রুহুল এসেছে তাও কেন এত অবজ্ঞা। রুহুলের অভিমান যেন আরো কয়েকগুণ বেড়ে গেলো। সে শরবত পান করলো না।
_____________________

কাকন তখন ও কাজ করছিল সুভা রন্ধনশালায় কাকন কে দেখতে পেয়েই চেতে গেলেন। বললো, “তুমি এখনো এখানে কি করছো কাকন। খোকা এসেছে শোনোনি তুমি যাও এক্ষুনি খোকার কাছে যাও। ”

কাকন বললো, “আম্মা আসলে ছোট আম্মা বললো সব কাজ করে তারপর যেতে তাই আর কি।”

–“সে বলবে আর তোমাকে করতে হবে। আমার খোকা এসেছে সেই কখন অথচ তুমি এখনো এগুলো নিয়ে পড়ে আছো। কেন বাড়িতে কি কাজের লোকের অভাব নাকি যে স্বামীর কাছে যাওয়ার ফুরসৎ নেই তোমার।”

মালেকা বললেন, “শোনেন আপা আমার মাইয়ার বিয়া তাই মেলা কাম-কাজ। এই জন্য কাকন বউ রে কইছি কাম করতে। কামের মিয়া ও তো কাম করতাছে।আর তাছাড়া বাড়ির বউ কাম তো করবোই।”

–‘”হ্যা কাজ করবে তবে স্বামীর কাজ সবার আগে।”
সুভা কাকন কে ধমকের শুরে বললো, ” কাকন এখনো এখানে কি করছো। জলদি হাত ধুয়ে খোকার কাছে যাও। আর খোকা কে খেতে দাও। ”

সুভার এমন ধমকানো কথায় কাকনের একটুও কষ্ট লাগে নি। বরং সে খুশিই হয়েছে সে তো চাচ্ছিল রুহুলের কাছে যেতে। কাকন তাড়াতাড়ি হাত ধুয়ে ছুটলো রুহুলের জন্য।

কাকন বসার ঘরে গেলো। কাকন কে দেখেই ননদেরা মুখ চিপে হাসলো। কাকন রুহুলের পাশে গিয়ে বললো, “আসুন খেতে বসবেন। ক্ষুধা লেখেছে নিশ্চয়ই। ”

রুহুল অভিমানে একবারো কাকনের দিকে তাকালো না।বিনাবাক্যে সরাসরি ভোজনকক্ষে চলে গেলো। কাকন রুহুলের যাওয়ার পানে চাইলো। ভাবলো হয়তো অনেক ক্ষুধা পেয়েছে তাই এভাবে চলে গেছে। কাকন খাবার গরম করে বিশাল বড় খাবার টেবিলে সব পদের খাবার রাখলো।রুহুল নিজের মতো করেই খেয়ে নিলো।

কাকন বার বার এটা সেটা জিজ্ঞেস করছে কিন্তু রুহুল হুম,হা এভাবে উত্তর দিচ্ছে। বিষয়টা কাকনের সুবিধা লাগছে না। রুহুল তো এমন করে না। কোনো মতো খেয়ে রুহুল উঠে গেলো। রুহুলের এমন আচরণে তো কাকন অভ্যস্ত নয়। বুকের ভেতর ব্যাথা অনুভব হচ্ছে কাকনের।

কাকন ও রুহুলের পিছন পিছন গেলো। রুহুল কক্ষে যেয়ে হাতের ঘড়িটি খুলে টেবিলের উপর রাখলো। গায়ের শার্ট টা খুলছে। কাকন রুহুলের পাশে গিয়ে বললো, “আপনি এমন করছেন কেন।”
রুহুল কিছু না বলে নিজের কাজে ব্যাস্ত।

কাকন আবারও বললো, “কি হলো কথা বলছেন না কেন। আর এমনই বা করছেন কেন? ”

রুহুল এক পলক কাকনের দিকে চেয়ে কক্ষ থেকে বেরোবে ওমনি কাকন পিছন থেকে রুহুল কে জড়িয়ে ধরলো। রুহুলের পিঠে কাকনের মাথা ঠেকলো। রুহুল কাকনের হাত দুটো ছাড়িয়ে নিতে চাচ্ছে। কিন্তু মন তো বলছে বিবিজান কে বুকে টেনে নে কিন্তু রুহুলের অভিমানে সে নারাজ এত দ্রুত কাছে টেনে নিতে। রুহুল কাকনের হাত ছাড়িয়ে নিলো।

কিন্তু কাকন ও হাল ছাড়ছে না। কাকন রুহুলের সামনে যেয়ে আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে ধরলো রুহুল কে। বললো,
” আমার ভুল হয়ে থাকলে ক্ষমা করে দিন। আমি সত্যিই বুঝতে পারি নি আপনি এত অভিমান করবেন। সেদিন রাতে তো বলেছিলেন যেতে দেবেন। কিন্তু সকালে নিষেধ করলেন ওই সময় আমার খুব ফাতিমা আপার কাছে যাওয়ার ইচ্ছে ছিল। এজন্যই তো গিয়েছিলাম।কিন্তু তাই বলে এত অভিমান। আপনার এই অভিমান ভরা মুখ আমায় ভীষণ কষ্ট দিচ্ছে। আমি নিতে পারছি না এই কষ্ট। দয়া করে কথা বলুন আমার সাথে। ”

রুহুল নিজের বুকে গরম তরল কিছুর অনুভব করলো। যা রুহুলের হৃদয়ের অভিমান গলিয়ে দিল নিমিষেই। রুহুল কাকনের থুতনি উচু করে চোখের জল মুছিয়ে দিয়ে বললো, “আমি আপনার উপর কোনো অভিমান করে নেই। আমার কাজ আছে তাই যেতে হবে। ”

–“আপনি মিথ্যে বলছেন আপনি যে বেশ অভিমান করেছেন সে আমি বুঝেছি।”

–“ওহহ এত কিছু বুঝে গেছেন তাই বা। আর আমি সেই কখন এসেছি একবারো দেখতে আসা উচিত এটা বোঝেন নি। এখন দয়া করে এটা বলবেন না যে আপনি জানতেন ই না আমি এসেছি।”

–” আমি সত্যি বলছি আমি আসতে চেয়েছিলাম কিন্তু কাজের জন্য আসতে পারি নি। ”

–“হুহ, আপনার কাছে আমি ব্যতীত সব কিছুই আগে। সেটা এখন আমার বেশ বোঝা হয়ে গেছে। ”

কাকন রুহুলের এমন কথায় আবারো কেদে দিল। বললো, “সত্যি বলছি আর কোনোদিন এমন করবো না।আপনার এই এমন রূপ আমি গ্রহণ করতে পারছি না। আমার সত্যি সত্যি খুব কষ্ট হচ্ছে। ”

— “আমার একটু অভিমান আপনার সহ্য হয় না। আর আপনি যেন অভিমান না করেন সে জন্য সব করি। অথচ আপনি কি আমায় বোঝেন না নাকি বুঝেও না বুঝার ভান করেন। ”

–“আমি সব ই বুঝি। আপনি যে আমায় এত ভালোবাসেন সেটা তো বুঝি। কিন্তু ওইদিন রাতে আমার
মন ভালো ছিল না তাই গিয়েছিলাম। আর কাজের চাপে আপনি আসার পর দেখা করতে পারি নি। ”

–“কেন আপনি না সেদিন বললেন মহিলাশায় যাওয়ার জন্য মন খারাপ। তাহলে কি মিথ্যে বলেছিলেন?”

কাকন থেমে গেলো। কি বলবে সে এখন। কাকন মাথা নিচু করে বললো, ” এটা আপনাকে বলতে পারবো না। শুধু এটুকু জেনে রাখুন ভয় পেয়েছিলাম কোনো কারনে তাই মহিলাশালায় গিয়েছিলাম।”

— “এই রুহুল সিরাজী এখনো জীবিত আছে। আমি থাকতেও কিসের ভয় আপনার হ্যাঁ ?”

কাকন রুহুলের এই কথায় হেসে দিলো।যা দেখে রুহুল বললো, “আশ্চর্য হাসছেন কেন এভাবে। আমি কি কোনো কৌতুক শুনিয়েছি নাকি মজা করছি? ”

–“না আপনি তো অভিমান করেছিলেন। আপনার অভিমান এখন গায়েব এই জন্য খুশিতে হাসলাম। ”

রুহুল ভ্রুকুচকে বলল,”আপনি কি জানেন আপনি বড্ড বেশি দুষ্ট। আপনার এই ভোলাবালা মিস্টি চেহারার আড়ালে যে দুষ্টু রুপ আছে সেটাকি লোকে জানে। ”

কাকন লাজুক হেসে বললো, “উহু এটা কেবল আমার সিরাজী সাহেব জানেন। ”

রুহুল কাকন কে কাছে টেনে বললো, “বাহ দাদিমার মতো করে আমায় ডাকা শিখে গেছেন দেখছি।”

–“হুম এখন দাদিমার মতো সংসারীও হতে চাই।”

–“আমি চাই আমার বিবিজান সংসারী হোক।তবে আপনি আর কখনো মহিলাশালায় এতদিন থাকবেন না। এই ঘরটাকে আমার অন্ধকার কবর মনে হয় যেখানে এক অন্যরকম কষ্ট অনুভব করি আমি। ”

–“বললাম তো ভুল হয়ে গেছে। আর কখনো বেশিদিন থাকবো না। ক্ষমা করে দিন না। ”

–“বেশ ক্ষমা করতে পারি তবে এক শর্তে।”

–“কি শর্ত? ”

–“শর্তটা হলো এখন আমার বিবিজানকে তার স্বামীর সেবা করতে হবে। ”

–“এত রাতে গোসল করিয়ে দিতে হবে। ঠান্ডা লেগে যায় যদি আপনার। আজ বাদে কাল বিয়ের অনুষ্ঠান।”

রুহুল কাকনের দিকে ঝুকে কানের কাছে মুখ নিয়ে বলল, “উহু এই সেবা নয় সেদিন আপনি যে সেবা ভেবেছিলেন আজ সেই সেবা করতে হবে। ”

–“মা..মানে? ”

–“মানে ওইটাই যেটা আপনি বুঝেছেন। ”

–“,আমার কাজ আছে, আমি যাই।”

রুহুল কাকনের হাত ধরে ফেললো। কাছে টেনে
বললো, “স্বামীর কাজের চেয়ে বড় কোনো কাজ নেই।”

চলবে…..

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here