#দেবী,২৯,৩০
লেখিকাঃ শবনম রাবাহ (স্রোতস্বিনী)
কপি করা সম্পুর্ণ নিষেধ।
২৯ঃ
সিরাজী মঞ্জিলে আজ আবারও মানুষজন এ ভড়ে গেছে। মেহমানে গিজ গিজ করছে।আসমা তার স্বামী সন্তানদের নিয়ে আজ সকালেই এসেছে। সামিয়ার সমবয়সী পারুল কে পেয়ে সামিয়া খুব খুশি।
বিকেল হতে না হতেই পাটায় হলুদ বাটার আওয়াজে যেন সুর ভাসছে। সামিয়ার জন্য গায়ে হলুদের আয়োজন করা হয়েছে। সামিয়া কে সকলেই হলুদ দিচ্ছে।রুহুল আর কাকন একসাথে হলুদ দিয়ে দিয়েছে সামিয়াকে। আর সামিয়া বসে আছে হলুদরানি সেজে।আর তার পাশেই আলেয়া,রোকেয়া, কাকন আর পারুল বসে আছে।
মালেকা সামিয়া কে হলুদ দিয়ে দেওয়ার সময় মেয়েকে জড়িয়ে কাদতে শুরু করেছে। বাড়ির ছোট মেয়েরা হলো মায়ের সবচেয়ে আদরের। এদের আদর ভালোবাসা,সখ,আল্লাদ মায়ের কাছেই বেশি। মালেকা আলেয়ার চেয়ে বেশি সামিয়া কেই ভালোবাসে। এই জন্যই বোধহয় হলুদ দিতে এসেই চোখের জলে ভাসিয়ে দিচ্ছে। মেয়েকে বিদায় দিতে যে ভীষণ কষ্ট হবে তার।
কাকন পাশেই বসে ছিল। মালেকার সামিয়াকে এভাবে জড়িয়ে ধরে কাদতে দেখে ভাবলো তার বাবা-মা বেচে থাকলে তার হলুদের দিন ও বোধহয় এভাবেই কাদতো। কাকনের মা ও তো কাকন কে অনেক ভালোবাসতো তবে সারাদিন বলতো ‘তুই বড় তাড়াতাড়ি হ তোকে তাড়াতাড়ি বাড়ি থেকে বিদেয় করবো। এত জ্বালাস কেন বাপু।’ কাকন মায়ের কথা মনে করে সেখান থেকে উঠে এলো। চোখের পানি যখন তখন বের হয়ে যেতে পারে।তবে এই সুখের সময় কাদতে চায় না কাকন।
কিছু কদম যাওয়ার পর কাকন নিজের পেটে ঠান্ডা কোনো কিছুর ছোয়া পেলো। কাকন পেটে হাত দিলো।তারপর হাতে দেখলো হলুদ লাগানো। কাকন এদিক ওদিক চেয়ে দেখলো রুহুল দুলাল সিরাজীর সাথে কথা বলছে। কাকন ভ্রু কুচকে তার দিকে তাকালে রুহুল মুচকি হেসে চোখ টিপ দিলো।
কাকন কক্ষে এসে কাপড় নিয়ে সোজা গোসলখানায় চলে গেলো । বেশ অনেকক্ষণ গোসল করার পর কক্ষে এসে চুল মুছতে লাগলো।
বিছানার ওপর একটি প্যাকেট দেখতে পেলো। উপড়ে লেখা ঢাকাই শাড়ি ঘর। কাকনের কেন যেন খুলতে ইচ্ছে করলো। খুলে দেখলো একটি লাল রঙের শাড়ি। কাকনের আর বুঝতে বাকি রইলো না এই ঢাকাই শাড়ি কে এনেছে। নিশ্চয় রুহুল সামিয়ার বিয়ে উপলক্ষে এই শাড়িটি এনেছে। কাকনের খুব পছন্দ হলো শাড়িটি। বিয়ের পর থেকেই স্বামীর থেকে এমন হুটহাট উপহার পেতে ভালোই লাগে কাকনের।
________________________
আজ বিয়ে তাই সকলেই তৈরি হচ্ছে। কাজ সেড়ে কাকন রুহুলের দেওয়া শাড়িটি পড়ছে। নতুন শাড়ি কুচি গুলো সুন্দর হচ্ছে না। বারবার এলোমেলো হয়ে যাচ্ছে। কাকন তবুও নিজেকে ঠিক করে শাড়ি পড়ে নিলো। আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে কাকন সুন্দর করে চুল গুলো খোপা করে নিলো। তারপর শাড়ির কুচি গুলো দেখলো সব ঠিকঠাক কিনা। কানে কিছুর স্পর্শ পেয়ে আয়নায় তাকিয়ে দেখলো কানের পিছে খোপায় একজোড়া রক্তজবা ফুল। কাকন ফুলে হাত দিয়ে পিছনে ফিরলো দেখলো রুহুল আলমারী থেকে পাঞ্জাবি বের করছে।
কাকন উৎসুকভাব বললো, “জবা ফুল জোড়া কি আপনি গুজে দিয়েছেন চুলে? ”
রুহুল পাঞ্জাবি পড়তে পড়তে বললো, ” কই না তো ”
–“মিথ্যে বলবেন না। আপনি ছাড়া তো কেউ নেই।”
–” কই আমি ব্যাতীত তো আপনার বর ও আছে। ”
–“আপনি সত্যিই অদ্ভুত। ”
–“আর আপনি বড্ড বোকা বিবিজান। আমি ব্যাতীত আপনার কেশে ফুল গুজে দেওয়ার সাধ্য কারো নেই।”
কথাটি বলে রুহুলে কাকনের দিকে এগিয়ে এলো। শাড়ির আচল মাথায় দিয়ে দিলো। তারপর পা থেকে মাথা অব্দি দেখে বললো, “এবার আপনাকে দারুণ লাগছে। একদম আমার বিবিজান বিবিজান।”
রুহুলের কথায় কাকন মুচকি হাসলো। বলল,”আর আপনাকে আমার সাহেব সাহেব লাগছে।
______________________
সিরাজী মঞ্জিলের গেইটের কাছে বকুলদের চার চাকার গাড়ি থেমেছে। এমন গাড়ি সিরাজপুরের অনেক মানুষই আজ প্রথম দেখছে। দুলাল সিরাজী সোনার চেইন পরিয়ে বকুলকে নামিয়ে নিলো। রুহুল নিজে এগিয়ে যেয়ে বকুল কে মিস্টি মুখ করিয়ে নিয়ে এলো মঞ্জিলে। বকুলের সাথে ঢাকা শহরের অনেক আত্মীয় স্বজন আজ বরযাত্রী হয়ে এসেছে সিরাজী মঞ্জিলে।
রুহুল নিজ দায়িত্বে সকলের দেখা শোনা করছে। হেলাল-মহীবুল ও বেশ দৌড়াদৌড়ি করছে। করতেই হবে বাড়ির মেয়ের বিয়েতে দুলাল সিরাজী কোনো ত্রুটি রাখবেন না। বকুলের বাবাসহ সকলেই এমন আয়োজনে মুগ্ধ। বরযাত্রীরা এমন বড় বাড়ি দেখে প্রশংসা করছে।
সামিয়া নিজের কক্ষেই বসে আছে। একদম বকুলের মনের মতো করেই সাজানো হয়েছে। নীল শাড়ি আর সোনালি রঙের ঘোমটা দেয়া মাথায়। গা ভর্তি সোনার অলংকারে সামিয়ার মুখ জলজল করছে। সামিয়া যেন আজ একদম চুপচাপ স্বভাবের হয়ে গেছে। ভিতরে ভিতরে লজ্জা আর ভয় দুটোই ঘিরে রেখেছে।
বরযাত্রী হয়ে বকুলের বোন বিন্তিও এসেছে। সে সামিয়ার সাথে দেখা করতে চায় তাই তাকে সামিয়ার কাছে নিয়ে যাওয়া হলো। বিন্তি কক্ষে কাকন কে দেখেই রুহুলের কথা মনে করলো। এই জগতে বোধহয় বিন্তি একজন মানুষকেই হিংসে করে আর সে হলো কাকন।
বিন্তি কে দেখেই সামিয়ার কাছে বসতে দেওয়া হলো। বিন্তির সাথে সকলেই টুকিটাকি কথা ও বললো।
বিন্তি কাকন কে বললো, “তোতমাকে সুসুন্দর লাগছছে কাককন, নিনিশ্চয় রুরুহুল ভাভাই পপছন্দ ককরেছে।”
কাকন লাজুক হেসে বললো, “আপনাকেও অনেক সুন্দর দেখাছে বিন্তি আপা। ”
রোকেয়া বললো, “বারে আমার দাদাভাই এর বউ বইলা কথা সুন্দর না লাগলে কি চলে। ”
–“হ্যাঁহ্যাঁ ঠিঠিক ই ববলেছেন। রুরুহুল ভাই এর ববউ সুসুন্দর তো হহবেই। ”
আলেয়া বললো, ” দাদাভাই নিজে পছন্দ কইরা শাড়ি আইনা দিছে ভাবি রে। আইজ আর চোখ ফিরাইতে পারবো না তাই না ভাবিজান। ”
কক্ষে থাকা সকলেই হেসে দিলো।
বিন্তি আবারো বললো, “হ্যাঁ কাকাকন আআসলেই অঅনেক সুন্দদর ”
কাকন বললো, ” বিন্তি আপা আপনিও অনেক সুন্দর। এখানে আমরা সকলেই সুন্দর। আল্লাহ তায়লা সবাইকে সেই রুপেই তৈরি করেন যতটুকু রুপে তাকে সুন্দর লাগবে ।আল্লাহ নিজে মানুষ এর মুখের গঠন দেন। তাই দুনিয়ার সকল মানুষ ই সুন্দর।”
পারুল বললো, “হ্যাঁ এইডা আমিও শুনছি। বিন্তি আপা আপনে ও কিন্তু অনেক সুন্দরী।”
কাকন বললো, “হ্যাঁ, আর আপা অনেক শিক্ষিত। আবার অনেক সুন্দর মানুষের মুখ ও আঁকতে পারে। বিন্তি আপা সত্যিই আমার চেয়েও সুন্দর। ”
বিন্তি মনে মনে বললো, ” তোমার চেয়ে সুন্দর হলে বোধহয় আজ তোমার জায়গায় আমি থাকতাম।”
________________
যেহেতু সিরাজপুর থেকে ঢাকা অনেক দুরের পথ তাই তাড়াতাড়িই বিয়ে পড়ানো হলো। বিয়ে পড়ানোর সময় সামিয়া এক প্রকার হাউমাউ করেই কেদেছে।কাদতে কাদতে সামিয়ার দাত লেগে গিয়েছিল।বেশ অনেক্ক্ষণ পর সামিয়ার জ্ঞান ফেরে। জ্ঞান ফেরানোর পর ও সামিয়া অনেক কষ্টেই কবুল বলে। বোধহয় কবুল বলার মুহুর্ত টাই নারীদের জীবনে সবচেয়ে আতঙ্কের।
যেখানে সকলের অনেক জোড়াজুড়িতে সামিয়া কবুল বলেছে অন্যদিকে বকুল সহজভাবেই কবুল বলেছে। বিয়ে শেষে মোনাজাত পড়ানো হয়। মিস্টি মুখ করা হলে সামিয়া আর বকুল কে পাশাপাশি বসানো হয়।
সামিয়া বকুলকে দেখেই চেয়ে রইলো।এভাবে তাকিয়ে থাকাতে সকলের হাসাহাসি তে চোখ ফেরালো বকুল। বকুল এর মামাতো ভাই নয়ন ঢাকা থেকে আসার সময় নিজের ক্যামেরা নিয়ে এসেছে। যা দিয়ে সামিয়া আর বকুলের এই সুন্দর মুহুর্তের কিছু ছবি ক্যামেরা বন্দি করলো।
রুহুলের সাথে নয়নের বেশ অনেকদিনের পরিচয়।বকুলের খাতিরেই পরিচয় হয়েছিল । তাই রুহুল জানালো তার আর কাকনের ও যেন একটা ফটো তুলে দেওয়া হয়। রুহুল ছেলেটিকে দাড় করিয়ে কাকন কে খুজতে গেলো। যেহেতু বাড়ি ভর্তি লোকজন তাই রুহুলের কাকন কে খুজতে অসুবিধেই হচ্ছে।
অনেক খোজাখুজির পর রন্ধনশালায় উকি দিয়ে রুহুল দেখলো কাকন সুভার সাথে পাতিলে ভড়ে খাবার বাড়ছে। বোধহয় এগুলো সামিয়ার শশুড় বাড়ি পাঠানো হবে। সিরাজী মঞ্জিলের নিয়ম হলো মেয়ে শশুড়বাড়ি পাঠানোর সময় হাড়ি ভড়ে ক্ষীর আর খাবার দিতে হবে।ফাকা হাতে কখনোই মেয়ে বিদায় করা যাবে না।
রন্ধনশালায় সচারাচর বাড়ির পুরুষেরা যায় না। দরজার কাছে রুহুলকে দেখেই দাদিমা হেসে বললেন,
” কিরে কাকন তর সুয়ামি দেখি তর খোজ করতে করতে রন্ধনশালায় অব্দি চইলা আসছে। ”
কাকন মাথা তুলে চেয়ে দেখলো সত্যিই রুহুল। কাকন আমতা আমতা করে বললো, ” কিছু বলবেন? ”
দাদিমা আবারও বললো, “কিছু কইবো মানে। সুয়ামি রান্ধন ঘরে আইসা খাড়াইছে যা দেখ কি কয়।
পাগলি মাইয়া বুদ্ধি নাই?”
রুহুল সুভার দিকে একবার চাইলো।তারপর মাথা নিচু করে বললো, “একটু এদিকে আসুন দরকার আছে।”
সুভা ছেলের কথায় মুখ চেপে হাসলো।বললো, “কাকন তুমি যাও।বাকি টুকু আমি সামলে নিতে পারবো। ”
কাকন মাথা নেড়ে রন্ধনশালা থেকে বেরিয়ে এলে রুহুল কাকনের হাত ধরে বললো, “চলুন।”
কাকন বললো, “এভাবে হাত ধরে কোথায় নিয়ে যাচ্ছেন। সবাই দেখছে তো ? ”
–“দেখলে দেখুক আমি তো আর পরনারীর হাত ধরিনি”
–“তবুও সবাই কি ভাববে? ”
–“যার যা ভাবার ভাবুক। ”
কথাটি বলেই রুহুল নয়নের কাছে গেলো। তারপর বললো, “আমি আর বিবিজান বাগানের গোলাপ গাছের পাশে দাড়াবো তুমি আমাদের একটা সুন্দর করে ছবি তুলে দেবে কেমন। পারবে তো নাকি? ”
রুহুলের কথায় নয়ন মুচকি হেসে বললো,”জি পারবো, সুন্দর ছবি তুলে দেওয়াই আমার কাজ রুহুল ভাই। ”
রুহুলের কথা মতো নয়ন ক্যামেরা নিয়ে বাগানে গেলো।হরেক রকমের ফুল গাছের মাঝে লাল গোলাপফুল গাছের সামনে দাঁড়িয়ে পড়লো রুহুল-কাকন। সাদা পাঞ্জাবি পরিহিত রুহুল আর লাল শাড়ি পরিহিত কাকন। রুহুল কাকনের কাধে হাত রেখে দুজন পাশাপাশি দাড়ালো। এভাবে পরপুরুষ এর সামনে রুহুল কাকনের কাধে হাত রেখেছে কাকন লজ্জায় মাথা নিচু করে ফেললো।
নয়ন ক্যামেরায় চোখ রেখেই বললো,”ভাবি, ভাইয়ের নিকটে দাড়ান আর একটু হেসে এদিকে তাকান।”
তবুও নয়নের কথায় কাকন নড়লো না।রুহুল নিজেই দূরত্ব ঘুচিয়ে কাকনের আরো নিকটে এলো। আর কাকন লাজুক হেসে ক্যামেরার দিকে চাইলো। এরপর সাদা- কালো রঙে ক্যামেরাবন্দী হয়ে গেলো
রুহুল-কাকন।
ছবি তোলা শেষে নয়ন বাগান থেকে বেড়িয়ে গেলে কাকনের কোমড় জড়িয়ে ধরে রুহুল বললো, “বলুন তো গোলাপ গাছের সাথে ফটো তুললাম কেন?”
–“কেন তুললেন?”
–“কারণ গোলাপ ফুল হলো ভালোবাসার প্রতীক।আর আপনি আমার ভালোবাসা, ভালোবাসার বিবিজান।”
–” বাহ দারুণ তো। আর আমি আজ জানলাম!”
–“হুম, তবে আরেকটা কথা কি জানেন ছবিটি কেন তুললাম ?”
–“কেন তুলেছেন?”
–“এই ছবি টা অনেক বড় করে বাধিয়ে রাখবো আমি। আর আমাদের নাতি-নাতনি দের দেখাবো।”
–“হাহাহা, আগে আপনি বাবা তাও হোন তারপর দেখা যাবে। ”
–“বাবা ও হবো, দাদা ও হবো। সব হবো। ”
____________________
সামিয়ার এখন বিদায়ের পালা। সামিয়া খুব কাদছে। এই প্রথম বাড়ি ছেড়ে কোথাও যাচ্ছে এত দুরের পথ কেদে কেটে নাজেহাল দশা। সেই সাথে সিরাজী মঞ্জিলের প্রতিটি সদস্য কাদছে। রুহুল ও ছোট বোনের বিদায় দিতে কষ্ট পাচ্ছে। দুলাল সিরাজী বকুলের হাতে সামিয়া কে তুলে দিলেন।
রুহুল বকুলের হাত ধরে বললো, “সামিয়া বুড়ি আমাদের অনেক আদরের। ওকে কোনোদিন কষ্ট দিস না। বিশ্বাস করে তোর হাতে তুলে দিলাম। ”
বকুল বললো, ” মাথায় করে রাখবো তোর বোনকে।”
সন্ধ্যা হয়ে আসছে অনেক দুরের পথ। রজনীগন্ধা আর গোলাপ ফুল মিশ্রিত চার চাকার সজ্জিত গাড়িতে উঠে বসলো বকুল। সামিয়াকে গাড়িতে উঠিয়ে দিলো রুহুল আর দুলাল সিরাজী। কিছুক্ষণের মধ্যেই গাড়িটি রওনা হলো ঢাকার উদ্দেশ্যে।
বাড়ির অর্ধেক মেহমান যেন নেই বললেই চলে।বাকিরা সকলেই যার যার মতো অন্দরমহলে ঢুকলো। মালেকা মেয়ে বিদেয় দিয়ে আবারো কান্না কাটি করছে। সকলের ই মন টা খারাপ লাগছে।
কাকন দেখলো রুহুল ও কিছুটা মন উদাস করে আছে তাই কাকন এগিয়ে গেলো রুহুলের দিকে। কাকন রুহুলের হাত ধরে বললো,”কষ্ট হচ্ছে আপনার?”
রুহুল বললো, “না, আসলে কাজের চাপে বোধহয় মাথা টা একটু ধরেছে আর কি। মাথা টিপে দিতে পারবেন? ”
–“বেশ কক্ষে চলুন আপনার মাথায় তেল মালিশ করে দেই। আশাকরি আপনার আরাম লাগবে। ”
–“হুম। ”
রুহুল আর কাকন সিড়ি বেয়ে উপরে চললো। দোতলায় সিড়ির শেষ ধাপে কাকনের খালি পায়ে কেমন যেন ভেজা ভেজা লাগলো। কাকন নিচে তাকিয়ে দেখলো লাল তরল। কাকন ঘাবড়ে যেয়ে রুহুল কে ঘামচে ধরলো। রুহুল ভ্রু কুচকে জিজ্ঞেস করলো, ” কি হলো?”
পরক্ষণেই নিচে তাকিয়ে দেখলো রক্ত। রুহুল রক্তের গতিপথ অনুসরণ করে দেখলো উপর থেকে আসছে। তারমানে তিনতলা থেকে আসছে এই রক্ত।
রুহুল কাকন কে ছেড়ে দিয়ে সিড়ি বেয়ে দ্রুত উপরে চলে গেলো। কাকন ও ভয়ে ভয়ে তিনতলায় গেলো।সিড়ি বেয়ে উপরে উঠে যা দেখলো তা দেখে উচ্চস্বরে চিৎকার করে রুহুল কে জড়িয়ে ধরলো কাকন। রুহুল নিস্তব্ধ হয়ে গেছে যেন। কাকনের সারা শরীর কাপছে।তিন তলায় লাশ পড়ে আছে। কাকন এমন লাশ দেখে ভয়ে রুহুলের বুকে মুখ গুজে রেখেছে।
চলবে….
#দেবী
লেখিকাঃ শবনম রাবাহ (স্রোতস্বিনী)
কপি করা সম্পুর্ণ নিষেধ।
৩০ঃ
সিরাজী মঞ্জিলের এক মেয়েকে শশুড় বাড়ি বিদায় দিতে না দিতেই আরেক ছেলের রক্তের ধারা বয়ে যাচ্ছে সিরাজী মঞ্জিলে। কাকন যখন চিৎকার করে কাকনের চিৎকারে সকলেই প্রায় তিনতলায় এসেছিল। তারপর হেলাল কে এভাবে মৃত দেখে যেন সকলেই থমকে গেলো। এটা কি থেকে কি হয়ে গেলো। বিকেল অব্দি যে ছেলে দিব্যি কাজ কর্ম করে বেড়ালো এখন সে নৃশংস হত্যার শিকার কিভাবে মেনে নেবে সকলে।
মালেকা হেলাল কে পড়ে থাকতে দেখে ছুটে গেলো হেলালের দিকে। হেলাল কে ধরে বিলাপ কান্না শুরু করে দিয়েছে। মালেকা রুহুল কে দেখে বলছে,” তুই ই খুন করছিস। তুই আর তোর বউ মিলা খুন করছিস” সাথে নানা কটু কথা বলা শুরু করলো। ওর সাথে সকলেই কাদতে শুরু করে দিয়েছে।
মালেকার কথা শুনে কেউ কোনো প্রতিক্রিয়া করল না।কারণ সকলেই জানে মালেকা রুহুল কে অপছন্দ করে এবং রুহুল যে একাজ করবে না সকলের ই জানা। রুহুল নিরব হয়ে কেবল মালেকার কথা শুনলো। কাকন স্বামীর অধীনেই রইলো।
সুভাও হেলালের এমন মৃত্যু দেখে কাদছে। সে তো হেলাল কে কোনোদিনো রুহুলের থেকে কম ভালোবাসে নি। কি নির্মম মৃত্যু। সুভা চিন্তিত ভাবে রুহুলের দিকে তাকালো। তার স্বামীর পর হেলাল। আচ্ছা বিলালের কোনো পাপের শাস্তি এভাবে দেওয়া হচ্ছে নাতো। না তার খোকার এমন কিছু হলে সুভা মানতে পারবে না।
দুলাল সিরাজী হতভম্ব। বাড়িতে এত মেহমান থাকা সত্বেও কেউ কিভাবে খুন করতে পারলো। একদম নিখুত ভাবে হত্যা। দুলাল সিরাজী রক্তের দিকে তাকিয়ে থাকলো। তার বংশের রক্ত আজ সকলের পায়ের নিচে। সকলের পায়েই এই রক্ত লেগেছে। তার বংশের বিনাশ কি তাহলে অতি নিকটে।
জামাল আর মহীবুল একে অপরের দিকে তাকাচ্ছে।
তারা বার বার ভাবছে কে খুন করলো এভাবে হেলাল কে। তারা নিজেরাই তো হেলাল কে হত্যা করার পরিকল্পনা করেছিল অথচ আজ হেলাল অন্য কারো শিকার হয়ে গেলো। এতগুলো প্রহরী আছে গেইটের কাছে। তার ওপর বাড়ি ভর্তি মেহমান। বাইরের কেউ খুন করে গেলো অথচ কেউ ধরতে পারলো না।
রুহুল দুলাল সিরাজীর কাছেই দাড়িয়ে আছে। কাকন রুহুলের কাছে এলো। এসে রুহুলের হাতটা শক্ত করে ধরলো। রুহুল বরাবরই সাহসী সহজে ভেঙে পড়ে না তবে নিজের ছোট ভাই এর এমন অবস্থা দেখে নিশ্চুপ হয়ে গেছে, কথা বলার ভাষা নেই তার। এই সেই হেলাল যে ছোটবেলায় তার দাদাভাই এর কাছে বায়না করতো। রুহুলের গলা দিয়ে যেন কথা বের হচ্ছে না। হাজার হলেও নিজের ভাই এর এমন মৃত্যু প্রচুর ভাবাচ্ছে।
মৃত্যুর খবর পেয়ে পুলিশ এসেছে। পুলিশ কিছু জিজ্ঞাসা বাদ করে জানালো হেলালের লাশ মর্গে নিয়ে যাওয়া হবে এবং দেখা হবে কিভাবে মৃত্যু হয়েছে। কিছুক্ষণ পর হেলালের লাশ নিয়ে যাওয়া হলো থানায়। রুহুল,দুলাল আর মহীবুল যাবে সাথে।
লাশের সাথে রুহুলের যাওয়া দেখে মালেকা বললেন, “তুই কেন যাস রুহুল, তর তো আনন্দের দিন। সব সম্পত্তি তুই পাবি। তুই খুনি আমার পোলার। আমার পোলা, আমার হেলাল। দে ফিরায়া দে আমার হেলাল রে। আমি জানি তুইই খুন করছা আমার হেলাল রে। ”
এমন কথায় রুহুলের সাহস যেন আরো হারিয়ে গেলো। সে নিজের ভা কে কিভাবে খুন করতে পারে। রুহুল এক পলক মালেকা কে দেখে চলে গেলো থানায়।
কাকন মালেকার কাছে বসে বললো, “আপনার কোথাও ভুল হচ্ছে ছোট আম্মা। আমরা দুজন একসাথে যখন দোতলায় আসি। রক্ত দেখে তিনতলায় এসে দেখি ছোটভাই এর এমন অবস্থা। উনি কি জন্য নিজের ছোট ভাই কে মারবে। ”
–“চপ ফকিন্নি তুই আর তর সুয়ামি কাউ রে বিশ্বাস করি না আমি। আমার নাড়ি ছেড়া ধন রে আল্লাহ তুমি উঠাইয়া নিলা কেন। আল্লাহ ফিরাইয়া দেও। ”
কথা বলতে বলতেই মালেকা জ্ঞান হারালো।
কাকন মালেকাকে আকড়ে ধরলো।কয়েকজন মহিলার সাহায্য নিয়ে মালেকা কে নিচে নামিয়ে আনলো।
কাকনের সামনে কাদছে, আসমা,দাদিমা, আলেয়া,রোকেয়া সকলেই। তবে মালেকার জন্য সবচেয়ে বেশি কষ্ট হচ্ছে। ভাগ্য কত নিষ্ঠুর। বিকেল অব্দি যে মা মেয়েকে নতুন ঠিকানায় পাঠানোর আনন্দে ছিল বিকেলেই সেই মা ছেলেকে শেষ ঠিকানায় পাঠানোর যন্ত্রণায় তাপড়াচ্ছে।
মালেকা কাদছে আর বার বার সুভা,রুহুল এদের কে দোষারপ করে বিলাপ করছে। কাকন এর রাগ লাগছে কেন রুহুলকে দোষারপ করা হচ্ছে। রুহুল তো একজন প্রকৃত রক্ষক যে কারো ক্ষতি করতে পারবে না।
সুভা এগুলো সহ্য করতে পারলো না। কাদতে কাদতে সেখান থেকে উঠে এলো। কাকন ও চোখের পানি মুছে সুভাকে অনুসরণ করলো। কাকন দেখল সুভা বিলাল সিরাজীর পায়ের কাছে বসে কাদছে। নানা কথা বলছে।
সুভা কাদতে কাদতে বলছে,”আপনার ছোট ছেলে হেলাল আর নেই।ওকে হত্যা করা হয়েছে। আর দোষ দেওয়া হচ্ছে আপনার খোকা কে। এখনো কি উঠবেন না। প্রতিবাদ করবেন না আপনি। ”
সুভা দুহাত দয়ে মুখ ঢেকে আবারো বললো, “সারাটা জীবন আমার খোকা সবার জন্য ভেবে গেলো অথচ আজ মালেকা আমার খোকা কে দোষ দিচ্ছে। আপনার পাপের শাস্তি কেন আমার খোকা পাবে। এগুলো আপনাদের করা কুকর্মের ফল। কেউ না জানলেও আমি ঠিক ই জানি। আমার রুহুলের কিছু হলে আমি এই সিরাজী মঞ্জিল জ্বালিয়ে দেবো।”
কাকন সুভার কাছে যাওয়ার আর সাহস পেলো না। দূর থেকে এগুলো শুনেই চলে গেলো।
_________________________
অনেক রাত অব্দি সকলেই বসে আছে। দুলাল, জামাল,মহীবুল,রুহুল এলো অনেক রাতে ।রুহুল কে কেমন বিদ্ধস্ত দেখাচ্ছে। কাকন এগিয়ে গেলো রুহুলের দিকে। বলল,” ঠিক আছেন আপনি। পানি দেবো। ”
রুহুল কিছুই বললো না। নিরবে সিড়ি বেয়ে উপরে উঠতে লাগলো,কাকন ও সাথে সাথে গেলো। কক্ষে যেয়ে দু হাতে নিজের মাথা ধরে মাথা নিচু করে বসে থাকল রুহুল। কাকন এগিয়ে এসে পানি দিলো। রুহুল এক নিশ্বাসে সবটুকু পানি খেয়ে নিলো।তারপর গায়ের পাঞ্জাবি ছুড়ে ফেললো। জোরে জোরে নিশ্বাস নিতে শুরু করলো।
কাকন রুহুলের পাশে বসে রুহুল কে জড়িয়ে ধরে পিঠে হাত বুলাতে শুরু করলো। বললো, “এমন করবেন না। কষ্ট হলে কাদুন তবুও এমন ভিতরে কষ্ট জমিয়ে রাখবেন না।”
রুহুল ও কাকন কে আগলে ধরলো।শক্ত করে ধরে বললো, “আপনার ও কি মনে হয় আমি হেলাল কে খুন করেছি। ছোট আম্মা কিভাবে বাড়িভর্তি লোকের সামনে কথাটি বলতে পারলো। জানেন মহীবুল ও দাদাজানকে বলেছে আমি নাকি হেলাল কে অপছন্দ করতাম। এগুলো তে আমার হাত আছে। ”
কাকন রুহুলের দুগালে হাত রেখে বলল, “পুরো দুনিয়া বললেও আমি বিশ্বাস করি না আপনি খুন করেছেন।আমি নিজেই তো আপনার সাথে ছিলাম লাশ দেখার পর আপনার সেই রুপ কেউ না দেখলেও আমি দেখেছি। আপনি ও বাকিদের মতোই কষ্ট পাচ্ছেন।।”
রুহুল নিজের হাত দুটো কাকনের সামনে তুলে ধরলো। বললো, “এই হাত দুটো দিয়ে হেলাল কে কোলে রেখেছি। হাটা শিখিয়েছি আমি। ওকে আমি কিভাবে খুন করবো বলুন বিবিজান। ”
–” আমি জানি আপনার এই হাত দুটো পবিত্র যা কেবল আগলে রাখতে জানে। কখনো কারো ক্ষতি করতে পারবে না। ওরা যে যা ই বলুক আপনি যে সৎ সেটা সকলেই অবগত। ”
–” আমার আজকে আবারও অসহায় লাগছে বিবিজান। যেমনটি আব্বাকে রক্তাক্ত অবস্থায় দেখে লেগেছিল। আব্বা বেঁচে থেকেও মৃত আর হেলাল সত্যিই মৃত। ”
–” শান্ত হোন এভাবে ভেঙে পড়বেন না।আসুন আমার কোলে মাথা রাখুন আমি আপনার মাথায় হাত বুলিয়ে দেই।”
রুহুল কাকনের কোলে মাথা রাখলো। কাকন রুহুলের মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছে। রুহুল বললো,
–“আমি সন্তান হয়ে আব্বাকে রক্ষা করতে পারি নি,,
বড়ভাই হয়ে ছোটভাই কে রক্ষা করতে পারলাম না।আমি সত্যিই অক্ষম।এখন মনে হচ্ছে সিরাজী মঞ্জিলের কর্তা হওয়ার যোগ্যতা নেই আমার। ”
–“আপনি অক্ষম নন। আর আপনার তো এতে কোনো হাত নেই। আপনি ছোট আম্মার কথায় এভাবে মন খারাপ করে থাকবেন না। উনি পুত্রশোকে দিশেহারা হয়ে এমন বলেছে।আমি তো আপনাকে বিশ্বাস করি।”
রুহুল উঠে বসলো।কাকনের হাত দুটো ধরে বললো, “সত্যিই আমাকে বিশ্বাস করেন। সারাজীবন এভাবেই বিশ্বাস করবেন তো আমায়,আজীবন পাশে থাকবেন তো আমার? ”
–“আমি শুধু আপনাকেই বিশ্বাস করি আজীবন করবো। মৃত্যুর আগ অব্দি আমি আপনার পাশেই থাকবো।”
______________________
ফজর নামাজের পরেই হেলালের লাশ সিরাজী মঞ্জিলে নিয়ে আসা হয়। নৃশংস ভাবে মাথায় আঘাত করে খুন করা হয়েছে। তবে খুনে একটি জিনিস মিল পাওয়া গেছে সেটি হলো হাবিবুল্লাহর মাথায় যেভাবে মারা হয়েছিল একই ভাবে হেলালের মাথায় ও তেমন ভাবে আঘাত করা হয়েছে। একবার নয় বার বার। মাথায় বার বার আঘাত করার পর খুব দ্রুত মৃত্যুবরণ করেছে।
তবে শরীরের রক্ত নেই বললেই চলে।
লাশ ধোয়ানোর পর সাদা কাফনে মুড়িয়ে খাটিয়ায় শুয়িয়ে রাখা হয়েছে হেলাল কে। পুরো সিরাজপুর বাসীর ঢল পড়েছে যেন সিরাজী মঞ্জিলে। যেখানে আজ বোন কে আনার জন্য ঢাকা যেত সেখানে লাশ হয়ে কবরে যেতে হবে।সকলেই এমন মৃত্যতে শোকাহত।
সিরাজপুরের মাদ্রাসা থেকে এসেছে সকল হুজুরেরা।সকলে সুমধুর সুরে কুরআন তিলাওত করছে যা হেলালের নামে দেওয়া হবে। কুরআন পড়া শেষে মোনাজাত করে দুয়া পড়ানো হবে।
হেলালের লাশ দেখে কেবল কষ্ট হচ্ছে না মহীবুল আর জামালের।একদিন একদিন হেলাল হয়তো মহীবুল অথবা জামালের হাতেই মৃত্যু বরণ করতো কিন্তু আজ অন্য কেউ খুন করেছে। মহীবুল এর মনে কোনো রকম না লাগলেও জামালের মনে অন্য আতঙ্ক সৃষ্টি হলো।
সে তার নিজের মুখ যেন দেখতে পারছে হেলালের জায়গায়। জামাল কেমন যেন কেপে উঠলো।
জামালের মনে আতঙ্ক হাবিবুল্লাহ মরলো আর আজ হেলাল দুজন ই তো তাদের দলের ছিল। একই ভাবে এমন ভাবে হত্যা জামালের খুব ভয় করছে জীবনে তো আর কম কুকর্ম করেনি সে।
অন্যদিকে মহীবুল পৈশাচিক আনন্দ লাগছে। হেলালের মা এমনিতেও বার বার রুহুল কে দোষারোপ করছে। এখন মালেকার কানে আরো বিষ ঢালতে পারলেই কাজ। আর যেহেতু রুহুল ই সবার আগে লাশের কাছে ছিল সিরাজপুর বাসীকে যদি একবার রুহুলের নামে খুনি প্রমাণ করা যায় তাহলে সব কিছু মহীর।
____________________
খবর পেয়েই বকুলের পরিবারেই সবাই সিরাজপুরে এসেছে। সামিয়া হেলালের খাট ধরেই বার বার কাদছে। বকুল শক্ত করে ধরে রেখেছে সামিয়া কে। এভাবে সামিয়া কে কাদতে দেখে বকুলের খুব কষ্ট হচ্ছে। কাল নতুন জীবনের সুচনা হয়েছিল মেয়েটার আর আজ কাদছে এভাবে। সামিয়া বকুলকে ছাড়িয়ে নিজের মাকে দেখে মায়ের কোলে ঢলে পড়লো।মালেকাও মেয়েকে বুকে নিয়ে বিলাপ করে কাদতে শুরু করলো।
তবে এত কিছুর মাঝেও আরেকটি নিষ্পাপ মনের ঠিক ই কষ্ট হচ্ছে। সে হলো পারুল। এইতো বাড়ি থেকে আসার আগেও আসমা বলেছিল এবার গেলে তোর আর হেলালের বিয়ের ব্যাপারে আব্বাজান এর সাথে কথা বলবো। অথচ হেলাল মৃত্যুপুরী তে চলে গেলো। পারুল তো ছোট থেকেই জানতো তার মা তাকে সিরাজী মঞ্জিলে বিয়ে দিতো। তাই মনে মনে হেলাল কে ভালোবেসেছে। ছোট থেকেই হেলালের প্রতি তার অন্য্রকম অনুভূতি ছিল। অথচ তার ভালোবাসা পুর্ণতা পেলো না। চিৎকার করে কাদতেও পারছে না।
জোহরের আযানের আগেই খাটিয়া কাধে তুলে নিয়ে গেলো হেলালকে মসজিদের উদ্দেশ্যে। কালিমা শাহাদত পড়তে পড়তে খাটিয়া তুলে নিলো কাধে। রুহুলের মনে হচ্ছে এই ভার বোধহয় সে সহ্য করতে পারবে না। বড়ভাই হয়ে ছোট ভাই এর খাটিয়া কাধে নেওয়া এত কষ্টের। হেলালের খাটিয়া যখন সিরাজী মঞ্জিলের গেইট থেকে বের করলো সেই সাথে বের হলো একজনের দীর্ঘশ্বাস।
_____________________
কাকন জোহর নামাজ পড়ার জন্য সিড়ি বেয়ে উপরে উঠলো। নিজ কক্ষে যাবে তখন কান্নার আওয়াজ পেলো। উপরে তাকিয়ে দেখলো পারুল বসে কাদছে।
কাকন ছুটে গেলো। গিয়ে বললো, ” পারুল তুমি এখানে এভাবে বসে আছো কেন?
পারুল কাকন কে জড়িয়ে ধরে বললো, “আমারেও মাইরা ফালাও ভাবিজান আমি বাঁচতে চাই না।”
–“কেন পারুল, তুমি একথা বলছো কেন?”
–“ওনারে ছাড়া কেমনে বাঁচমু আমি আমি বাঁচতে চাই না। আমারে মাইরা ফালাও ভাবিজান। আমি যে ওনারে অনেক অনেক ভালোবাসি। ”
কাকন বুঝলো পারুলের মনের অবস্থা। কাকন পারুলের চোখের পানি মুছে দিয়ে বললো, “এই দুনিয়ায় কেউ ই চিরস্থায়ী নয় পারুল। ছোটভাই এর আয়ু শেষ তাই এভাবে মৃত্যু হলো। এভাবে কাদলে ওনার আত্মার কষ্ট হবে। এখন আমরা যদি কিছু করেতে পারি তাহলে সেটা হলো ওনার আত্মার শান্তির জন্য দুয়া করা। চলো নামাজ পড়বে আমার সাথে। ওনার জন্য দুয়া করবে।”
পারুল কাকনের কথায় সম্মতি জানিয়ে ওজু করে নামাজ পড়ে নিলো কাকনের সাথে। দুজনেই হাত তুলে আল্লাহর দরবারে মনের কথা বললো দুজনেই কাদলো।
মোনাজাত শেষে পারুল জায়নামাযে সিজদারত অবস্থায় আবারো কাদলো।
কাকনের পারুলের কান্না দেখে মায়া হলো। ভাবলো ভালোবাসার মানুষকে হারানোর বেদনা কি খুব কষ্টের।কাকনে রুহুলের হাস্যজ্বল মুখটি ভেসে উঠলো। রুহুলের কথা মনে করেই কাকনের শরীরের লোম দাঁড়িয়ে গেলো। না সে কখনোই রুহুল কে হারাতে পারবে না। রুহুল কেও যদি কেউ তার থেকে কেড়ে নেয় তাহলে কিভাবে থাকবে কাকন।
__________________________
লাশ দাফন করে সকলেই আবার সিরাজী মঞ্জিলে এলো। মালেকা আগের মতো কাদতে দেখে রুহুল সাহস সঞ্চয় করে মালেকার কাছে গিয়ে ডাকলো,”ছোটআম্মা!”
মালেকা ক্ষিপ্ত হয়ে বললো, “এই নামে ডাকবি না আমারে। তুই খুন করছা আমার হেলাল রে। আমার একমাত্র পোলা। ”
দাদিমা কাদতে কাদতে বললো, “তোর কেন মনে হয় মানিক এই কাম করছে। ও তো হেলাল রে ভালো বাসতো। হুশে কথা ক মালেকা। ”
–“না ও কোনো দিন ও আমার হেলালরে ভালোবাসে নাই। ও আর ওর আম্মা মিলা এই সব সিরাজী মঞ্জিলের কর্তা হওয়ার জন্য করছে। ”
–“তোর মাথা এহন ঠিক নাই। বাড়ি ভর্তি লোকের সামনে এগুলা কইস না মালেকা। ”
–“কেন কমু না কেন এই মঞ্জিলের কেউ আমার হেলাল রে ভালোবাসে নাই। বিলাল সিরাজী নিজেও নিজের ছোট পোলারে কাছে টাইনা নেয় নাই। সবাই খালি রুহুল রুহুলই করছে। নাই আমার হেলাল আর নাই।সবাই খুশি তো এহন। ”
এত কিছু আর রুহুলের সহ্য হলো না। পায়ের কাছে বসে হাত দুটো ধরে বললো, “ছোট আম্মা হেলাল আমার ভাই। আমার আপন ভাই। ওকে আমি কিভাবে খুন করব বলেন। আপনি কি অস্বীকার করতে পারেন যে আলেয়া, হেলাল আর সামিয়াকে আমি ভালোবাসিনি।”
–“তুই খুন করস নাই তাইলে কে খুন করল। আমার হেলালের তো আর কোনো শত্রু নাই।”
–” আমি জানি না কেন খুন করেছে।তবে যে ই আমার আব্বার এই অবস্থা করেছে, আর আমার ভাই কে খুন করেছে তাদের কাউ কেই আমি ছাড়বো না ছোটআম্মা। নিজে তাদের সাজা দেবো আজ আপনাকে ছুয়ে আবারো প্রতিজ্ঞা করলাম আমি।”
মালেকা রুহুলকে জড়িয়ে ধরে কাদলো। রুহুল কাকন কে ইশারা করলো মালেকা কে খাইয়ে দিতে। কাকন জোর করে দু লোকমা ভাত খাইয়ে দিলো মালেকা কে।
রুহুল উঠে কক্ষে যেতে চাইলো।তবে মহীবুল আর জামালের দিকে চেয়ে থামলো। তারপর মহীবুলের সামনে দাড়িয়ে বললো, ” আমার ভাই কে আমি খুন করি নি। ছোট আম্মার কানে বিষ ঢালা বন্ধ কর। ”
মহীবুল অবাক হয়ে গেলো। রুহুল কিভাবে জানলো।
চলবে……..