দেবী,৩৭,৩৮

0
403

#দেবী,৩৭,৩৮
লেখিকাঃ শবনম রাবাহ (স্রোতস্বিনী)
কপি করা সম্পুর্ণ নিষেধ।
৩৭ঃ

পারিবারিক নানান বিষয়ে ঝামেলা থাকলেও রুহুল নামাজ বাদ দেয় নি। নামাজ পড়া প্রত্যেক মুসলমানের উপর ফরজ। তবে সিরাজপুরে বাধ্যতামূলক ভাবে নামাজ পড়তে হবে। রুহুল নামাজ পড়ে সিরাজী মঞ্জিলে এলো। এসে সোজা রন্ধন শালায় চলে গেলো।

রুহুল কে দেখে রানু বললো, ” দাদাভাই কিছু লাগবো?”
–“হ্যাঁ,একটি থালায় ভাত তরকারি বেড়ে দে। ”
–“ভোজন কক্ষে বহেন ওইখানেই সব দেই। ”

রুহুল চোখ গরম করে তাকাতেই রানু বললো,
“আ,আপনে একমিনিট দেন দাদাভাই।এহুনি দিতাছি।”

রানু তাড়াহুড়া করেই ভাত বেড়ে দিলো। রুহুল আর সময় অপচয় করলো না। বারা ভাত-তরকারি নিয়ে সোজা নিজের কক্ষে চলে গেলো।

রুহুল কাকনের জন্য খাবার নিয়ে এলো নিজের কক্ষে।নিজের ঘুমন্ত স্ত্রীর মুখ দেখলো। কাকনের ঘুমন্ত মুখ রুহুলের সবচেয়ে প্রিয়। রুহুল এক ধ্যানে সারাজীবন কাকন কে এমন ঘুমন্ত অবস্থায় দেখতে পারবে। রুহুল কাকন এর মাথায় হাত বুলিয়ে আস্তে করে ডাকলো, “বিবিজান!”

ওষুধ খাওয়াতে কাকন এর জ্বর এখন অনেক কমে গেছে। কাকন উঠে বসলো। রুহুল কাকনের কপালে একটা চুমু দিলো। গলায় আর কপালে হাত রেখে দেখলো জ্বর কমেছে কি না।রুহুল খাবার মাখিয়ে কাকনের মুখের কাছে নিয়ে বললো, “খেয়ে নিন বিবিজান। ”
–” আ,,আমি খাবো না। ”
–“খাবো না বললে তো হবে না,খেতে হবে। ”
–“আমার ক্ষিদে নেই।”
–“কিন্তু আমার আছে। ”
–“তাহলে আপনি খেয়ে নিন। এখনো খান নি কেন?”
–“আমার বিবিজান যেখানে না খেয়ে আছে সেখানে আমি খাই কি করে।”
–” আমার কথা বাদ দিন। আমার না খেলেও চলবে। আপনি খেয়ে নিন।”
–“আমার ভীষণ খুদা লেগেছে বিবিজান।”

কাকন রুহুলের দিকে অসহায় দৃষ্টিতে তাকালো বললো, ” আপনার তো ক্ষিদে সহ্য হয় না। আপনি তবুও খাচ্ছেন না কেন। আমি কি খাইয়ে দেবো?”
–“না আমি আপনাকে খাইয়ে দেবো। ”
–“কিন্তু আমার তো খেতে ইচ্ছে করছে না। ”
–” আর আপনি না খেলে আমি খাবো না। ”
রুহুলের এমন বাচ্চাসুলভ আচরণ গুলো দেখলে দুঃখের সময় ও কাকনের হাসি পায়। কাকন বললো,
–” বেশ আমি খাচ্ছি।”
–“হা করুন। আমি খাইয়ে দেবো। এখন থেকে আপনি অসুস্থ হলে আপনাকে খাইয়ে দেওয়া, গোসল করানো সকল দায়িত্ব আমার। এবার ফটাফট খেয়ে নিন। ”

কাকন ভাত গিলে বললো, ” এত কিছুর পর ও আমার যত্ন নিচ্ছেন।আমার জন্য আ..”
তার আগেই রুহুল বললো, “একটা কথা রাখবেন?”
–“কি? ”
–” যা হয়েছে সব ভুলে যান।মনে করবেন এটা একটা দুঃস্বপ্ন ছিল। আর আমার কাছে খারাপ সময় হলো দুঃস্বপ্নের মতো। রাতের পর যখন দিন হবে আপনার ঘুম ও ভেগে যাবে। তখন আর সেই দুঃস্বপ্ন থাকবে না।তাই দ্বিতীয়বার এবিষয়ে শুনতে চাই না।”

–“কিন্তু দুঃস্বপ্নের রেশ তো ঠিক ই থেকে যায়। ”
–“আপনার সকল দুস্বপ্ন আমাকে আপন করুক। আর আমার সকল সুস্বপ্ন গুলো আপনাকে ঘিরে হোক। আর আমার সকল স্বপ্ন পুরণ করতে হলে আপনাকে এগুলো ভুলে যেতে হবে। ”

–“আর আপনি কি ভুলে যেতে পারবেন? ”
রুহুল কাকনের মুখে আরেক লোকমা ভাত দিয়ে বললো, ” হ্যাঁ ভুলে গিয়েছি। কারণ এতে আপনার কোনো দোষ নেই। দোষ যদি কারো থেকে থাকে তাহলে সেটা মহীবুলের ছিল। আফসোস আপনার সাথে করা অন্যায়ের শাস্তি আমি তাকে দিতে পারলাম না। পারলে আমায় ক্ষমা করবেন বিবিজান আমি আপনাকে নিরাপত্তা দিতে পারি নি। আমার ভুলের জন্যই আপনাকে বিপদের মুখোমুখি হতে হয়েছিল। ”

কাকন মাথা নত করে বললো, ” আসলে কিছু কিছু মানুষ খারাপ কপাল নিয়েই পৃথিবীতে জন্মায়। আর তাদের মধ্যে আমি একজন।সব আমার কপালের দোষ”

রুহুল কাকনের মনমরা ভাব দূর করার জন্য বললো,
” আপনি কি সত্যিই খারাপ কপাল নিয়ে জন্মেছেন। ভেবে দেখুন যদি সত্যিই খারাপ কপাল নিয়ে জন্মাতেন তাহলে কি স্বামীর এত ভালোবাসা পেতেন। ”

–“উহু, তা ঠিক ই বলেছেন। আমি ভাগ্যবতী আপনার মতো স্বামী পেয়ে। এত ভালো কেন বাসেন আমায়? ”

–“এই উত্তর টা আপনি সেদিন পাবেন যেদিন আপনি
ও আমায় ভালোবাসবেন। একদম মন থেকে।”
–” আপনিই বলুন না। ”
–“বলেছি তো!”
–“কি বলেছেন? ”
–“এই যে এই, উত্তর টা আপনি সেদিন পাবেন যেদিন আপনি আমায় ভালো বাসবেন। ”

কাকন রুহুলের মুখের দিকে চেয়ে মনে মনে বললো, ‘ভালো তো আপনাকে বাসি কিন্তু উত্তর তো পেলাম না। আপনি নিজে মুখেই বলুন না খুব জানতে ইচ্ছে করে।’

রুহুল নিজের মুখের ভাত খেয়ে হাসতে হাসতে বললো, ” আপনার সাহেব দেখতে ভালো সেটা সিরাজপুরের সকলেই জানে। এভাবে দেখলে নজর লেগে যাবে। শুনেছি সুন্দরী মেয়েদের নজর খারাপ হয়। ”

কাকন রুহুলের কথায় লজ্জা পেলো। তারপর রুহুলের বুকে মাথা রেখে বললো, ” এত ভালো বাসবেন না আমায়। নিজের মৃত্যুর সময় আপনাকে ছেড়ে যেতে কষ্ট হবে আমার। ”

–“আপনাকে বলেছি না যে মৃত্যুর কথা বলবেন না। ”
–” সেদিন রাতে আমার সত্যিই মনে হয়েছিল, যে সত্যিই বোধহয় আপনাকে আর দেখা হবে না। ”

–” চুপ আর এগুলো শুনতে চাই না আমি। বললাম তো ভুলে যান দুঃস্বপ্ন হিসেবে। আর আপনার মৃত্যু যেন কোনো দিনো আমার আগে না হয় বিবিজান। আমি সহ্য করতে পারবো না। ”

–“আমি জানি না আমার মৃত্যু কবে হবে । শুধু অনুরোধ করবো মৃত্যুর আগে অব্দি আমায় এইভাবেই ভালো বেসে যাবেন। আপনার ভালোবাসা আমার অভ্যাসে পরিণত হয়েছে। ”

–“আপনার মৃত্যুর পরেও আমি আপনাকে একই ভাবে ভালো বেসে যাবো। আমার হৃদয় আমার হৃদয়হরণি ব্যাতিত আর কোনো নারী হরণ করতে পারবে না। ”

–“যদি কেউ হরণ করে তাহলে সেটা যেন আমার মৃত্যুর পরে হয়। আমি আম্মার মতো শক্তিশালী ধৈর্যশীল নারী নই।আপনাকে অন্যকারো সাথে সহ্য করতে পারবো না”

–” আমার আম্মা সত্যিই ধৈর্যশীল বিবিজান। উনি আমার কাছে মহীয়সী নারী যিনি নিজের ভালোবাসার মানুষের জন্য নিজের সর্বস্ব ত্যাগ করেছিল। অথচ বিনিময়ে কেবল ঠকে গেছে। ”

–” আম্মা ঠকেছে?”
–” একটা কথা কি জানেন যারা নিস্বার্থ ভাবে ভালোবেসে যায় দিন শেষে তারাই ঠকে যায়। আমার আম্মাকেও বোধহয় খুব খারাপ ভাবে ঠকানো হয়েছিল”

-“আপনার কখনো প্রতিবাদ করেন নি, ঘৃণা জাগেনি ঠকানো ব্যক্তির প্রতি?”

–” নিজের জন্মদাতার সঙ্গে লড়াই করার সাধ্য আমার নেই। আর আমার আব্বা আমায় ভীষণ ভালোবেসেছে।নিজের সন্তানের প্রতি অবহেলা করেনি। উনি একজন ভালো পিতা, ভালো সন্তান, ভালো কর্তা ছিলেন তবে একজন ভালো স্বামী কোনোদিনো হতে পারেন নি। ”

–“শুধু সন্তান কে নয় সন্তান যে দেয় তাকেও ভালোবাসতে হয়।”

–” আমি ছোট থেকেই দেখতাম আমার আম্মা কাদছে। আম্মার চোখের পানি আমায় ভীষণ কষ্ট দিতো বিবিজান। সেদিন থেকেই ভেবে রেখেছিলেম আমার স্ত্রীর চোখে আমি কোনোদিন পানি আসতে দেবো না। আমি যেমন আমার আম্মার চোখের পানি দেখে সকলের অগোচরে কেদেছি আমি চাইনা আমার সন্তান কাদুক। এ বাড়িতে কোনোকিছুরই অভাব ছিল না তবে ছিল কেবল আমার আম্মার মুখের হাসির অভাব। ”

–” কখনো চেষ্টা করেন নি তার মুখের হাসি ফিরিয়ে দিতে। আম্মাকে তো অনেক ভালোবাসেন। ”

–” অনেক কিছু অজানা ছিল তো। তবে জানার পর হাসি ফিরিয়ে দেওয়া অসম্ভব হয়ে গিয়েছে। ”
___________________

আজ মরলে কাল দুদিন। গতপরশু রাতে মহীবুল খু’ন হয়েছিল। আজ ই তা দুদিন। সকলে ভুলে গেলেও জামাল সিরাজী ভোলে নি। ইশার নামাজ পড়ে আবারো কবর দেখতে এসেছে। দিন দুনিয়ায় বোধহয় জামাল সিরাজী এই একজন কেই ভালোবাসতো।
জামাল সিরাজী মহীবুলের কবরে হাত বুলিয়ে কাদলো। বার বার বললো, “বাজান, আমার বাপ। আর আইবি না। আমারে আব্বাজান কইয়া ডাকবি না।”

জামাল কাদতে কাদতে সেখানেই শুয়ে পড়লো। একজন পুরুষ যতটাই খারাপ হোক না কেন নিজের সন্তানদের কাছে সেরা বাবা হয়ে থাকে। দুনিয়ার প্রত্যেক টা বাবাই সেরা বাবা। জামাল নিজের ছেলেকে সাড়ে তিন হাত মাটির ঘরে রেখে প্রাসাদে কিভাবে থাকবে। জামাল কবরের পাশেই শুয়ে পড়লো ।

আকাশের চাঁদ টা আজ ঠিক তার মাথার উপরে। সেদিন ও বাবা ছেলে মিলে এই সময়ে নামাজ পড়ে সিরাজী মঞ্জিলে গিয়েছিল। রাতের খাবার খাওয়া, মদ খাওয়া একসাথেই করেছিল। অথচ আজ সেগুলো সব ই স্মৃতি হয়ে গেছে।
হঠাৎ জামাল পাশে কিছুর ছায়া দেখতে পেলো। জামাল নিজের বাম পাশে চেয়ে দেখলো দুলাল সিরাজী দাঁড়িয়ে আছে। দুলাল সিরাজীকে দেখে জামাল শোয়া থেকে উঠে বসলো।

দুলাল সিরাজী মহীবুলের কবরের কাছে দাড়িয়ে পশ্চিম মুখী হয়ে দুয়া করলেন।
তারপর জামাল সিরাজীর দিকে হাত বাড়িয়ে দিলেন।বললেন,” চলো আইজ আমরা একসাথে মঞ্জিলে যাই।”

জামাল অবাক হলো তার বাবার কথা আজ এত সুন্দর কেন লাগছে। জামাল সিরাজী উঠে দাড়ালো। তারপর তার বাবার সাথে হাটা শুরু করলেন।
দুলাল সিরাজী যেতে যেতে জামালের দিকে চেয়ে বললেন, “তুমি মহীর আব্বা আর আমি তোমার আব্বা। তোমার মহীর জন্য খারাপ লাগতাছে হেইডা আমি বুঝি। তুমি যখন বাপ হইয়া নিজের সন্তানের জন্য চোখের পানি ফালাইতাছো সেই চোখের পানি দেইখা তোমার বাপ হইয়া আমার কষ্ট হইতাছে। যাই ই হোইক আমিও তোমার আব্বা।”

জামাল কিছু বললো না। পাঞ্জাবীর হাতা দিয়ে চোখ মুছে নিরবে হাটতে লাগলেন।দুলাল সিরাজী আবারো বললো, ” তুমিও তো একজন বাপ। তোমারে যদি কইতাম তোমার দুই সন্তানের মধ্যে একজন রে খুন করতে তুমি কি হেইডা পারতা?”

–“আব্বাজান! ”
–” জানি পারতা না। কারণ একজন বাপ তার সকল সন্তান রেই সমান ভালোবাসে। আমিও আমার তিন সন্তান রে সমান ভালোবাসি। কিন্তু তুমি সারাজীবন ভাইবা গেছো আমি তোমারে ভালো বাসি নাই। ”

–“এইগুলা..”
–“দাড়াও আমি কথা শেষ করি। তুমি বিলাল এর লগে হিংসা করছো যে ওরেই সব দায়িত্ব দিমু। কিন্তু তুমি তো জানো আমাগো বংশের নিয়ম মতো বড় পোলারে কর্তা বানান লাগে। তাই ওরে বানাইছিলাম। তুমি কও তুমি কি সব সামলানোর যোগ্য আছিলা। আর বিলাল কি তোমারে ফালাইয়া দিতো?”
–“ন,,না। ”

–” তাইলে জাইনা রাখো রুহুল ও দিতো না। রুহুল আমাগো বংশের যোগ্য পোলা। ও তোমারে, তোমার পোলারেও ফাইলায়া দিতো না। তুমি নিজের ভুলে একমাত্র পোলারে হারাইলা।এহোন এই গোরস্থানে বইসা কান্দা লাভ নাই।তোমার জন্য তোমার পোলা মরছে।”

জামাল আবারো কাদতে শুরু করলো। দুলাল সিরাজী বললো, ” সারাজীবন কানলেও কিছু জিনিস ফিরা আইসে না। এইভাবে কাইন্দো না। বরং রুহুলের থিকা মাফ চাও। সব ঠিক কইরা নেও। নিজের ভুল স্বীকার করো। শেষ বয়সে রুহুল ই এখুন তোমার ভরসা। ”

–“যার জন্য আমার মহী মরছে তাগো আপন কইরা নিতে পারুম না আমি আব্বাজান। ”

–” তাইলে বুড়া কালে কার ভরসায় থাকবা। আমি মইরা গেলে কে দেখবো তোমায়। আইজ ই তুমি আমার সাথে যাইবা যাইয়া সব ঠিক কইরা নিবা। মনে রাইখো তোমার আব্বাজান তোমার ভালো চায়।”

জামাল আর কথা বাড়ালো না। চুপচাপ পা চালিয়ে যেতে লাগলো দুলাল সিরাজীর সাথে।
অন্যদিকে দুলাল সিরাজী মনে মনে ভীষণ খুশি হচ্ছে। রুহুল কে নিজের হাতে রাখতে, নিজের বংশের জমিদাড়ি রক্ষা করতে হলে শত্রুতা নয় বরং বন্ধুত্ব দিয়ে কাবু করতে হবে। শেষ বয়সে এসে একজন বাবা হয়ে দুলাল সিরাজী নিজের দুই পুত্র কে কষ্ট ভোগ করতে দেখতে পারেবে না। পুর্বপুরুদের নিয়ম অমান্য করা যে ভয়ংকর পাপ তার কাছে।
__________________

দরজায় ঢকঢক আওয়াজ। রুহুল বুঝলো কেউ এসেছে বোধহয়। রুহুল দরজা খুললো। দেখলো সামিয়া দাড়িয়ে আছে। সামিয়া বললো, “দাদাভাই, বড়াম্মা ডাকে আপনেরে। ”
রুহুল বললো, “আচ্ছা যাচ্ছি। তুই ওনার কাছে থাক। আমি তাড়াতাড়িই চলে আসবো। ”
–“জি দাদাভাই। ”

রুহুল নিজের কক্ষ থেকে সোজা সুভার কাছে গেলো। যেয়ে বললো, “ডেকেছেন আম্মা? ”
–“হ্যাঁ”
–” জী বলুন”
–” কাকন কে নিয়ে তুই সিরাজী মঞ্জিল থেকে দূরে
কোথাও চলে যা খোকা। ”

–” কেন?”
–“আমি বলছি তাই!”
–“বেশ তবে আপনাকেও আমার সাথে যেতে হবে।”
–“না আমি যাবো না। এই সিরাজী মঞ্জিল ছেড়ে কোথাও যাবো না আমি। ”

–” আর আপনাকে একা ফেলে যাওয়া আমার পক্ষে ও কোথাও যাওয়া অসম্ভব। ”

–” তুই বুঝতে কেন পারছিস না খোকা। এখানে থাকা তোদের জন্য নিরাপদ নয়।”

–” আর আমি না থাকলে এখানে আপনি নিরাপদ না।আর যেখানে আমার আম্মা, সেখানেই আমি।”

–” খোকা, আমি তোর আম্মা এই জন্যই বলছি চলে যা এখান থেকে। এখানে থাকলে কাকনের বিপদ। আমি চাই তোরা সুখে সংসার কর। ”

–” আমি কখনো আমার স্ত্রীর ক্ষতি হতে দেবো না। আর আমার স্ত্রী আমার কাছে যতটা আপন তারচেয়ে ও বেশি আপন আমার আম্মা। তাই আপনি যেদিন সিরাজী মঞ্জিল ত্যাগ করবেন সেদিন আমিও ত্যাগ করবো। তার আগে নয়। ”

–” এখানে থাকলে তুই কোনোদিনো সুখী হতে পারবি না। তুই বিদেশ যেতে চেয়েছিলি না। আমার সব গহনা, মুদ্রা সব তোকে দিয়ে দেবো। চলে যা এই সিরাজপুর থেকে। দূরে কোথাও চলে গিয়ে সুখেব সংসার কর। আমি তোর মুখের হাসি দেখতে চাই খোকা। ”

রুহুল মায়ের কথা শুনে হেসে দিল। বললো,”আমি তো হাসি আম্মা। অনেক সুখেই আছি। ”

–” তুই যতই হাসিস আমি সব বুঝি। আমি তোর আম্মা। তোকে গর্ভে রেখেছি। তোর হাসির আড়ালের অভিমান ও আমি বুঝি। আমার সামনে মিথ্যে হাসির অভিনয় করে গেছিস সারাজীবন। আজ তোর হাসি আবার হারিয়ে যাক মা হয়ে তা চাইবো না। ”

রুহুল সুভার চোখে চোখ রেখে বললো, “আমি কাদলে তো আমার আম্মা আমার চোখ মুছে দিতে আসতো না। তাই আমি মিথ্যে হাসি দিতাম। তবে আমি এখন অনেক খুশি।কারণ আমি আমার সুখের মানুষ খুজে পেয়েছি। ”

–” এই জন্যই তো বলছি চলে যা খোকা এই সিরাজপুর থেকে। দূরে অজানা কোথাও চলে যা। ”
–“বললাম তো আপনি আমার সাথে গেলে তবেই
আমি যাবো। তার আগে না। খেয়ে ঘুমাবেন।”

রুহুল আর দাড়ালো না। চলে গেল নিজের মতো। সুভা রুহুলের যাওয়ার পর মেঝেতে বসে কাদতে শুরু করলো। বললো, ” সিরাজপুর থেকে না গেলে যে তুই কোনোদিনো সুখী হতে পারবি না খোকা। আমার মন কু ডাকছে। তোর কষ্ট সহ্য হচ্ছে না আমার। ”

চলবে…..

#দেবী
লেখিকাঃ শবনম রাবাহ (স্রোতস্বিনী)
কপি করা সম্পুর্ণ নিষেধ।
৩৮ঃ

কেটে গেছে দু সপ্তাহ। দুলাল সিরাজী বসার ঘরে মঞ্জিলের সকল সদস্যদের ডাকলেন। সামিয়া, সুভা, মালেকা, জামাল,জামালের স্ত্রী, রুহুল, কাকন সকলেই আছে। দুলাল সিরাজী সকলের দিকে চাইলেন। দেখলেন কাকন মাথায় কাপড় দিয়ে চুপ করে দাঁড়িয়ে আছে সুভার নিকটে। আর কাকনের পাশে সামিয়া।
দুলাল সিরাজী বললেন, “সামিয়া তুমি রুহুলের বউরে নিয়া ঘরে যাও। এইখানে তোমাগো না থাকলেও চলবো। তোমরা ঘরে গিয়া গপ্পো করা গা।”

সামিয়া বুঝলো হয়তো এমন কিছু কথা যা সামিয়াকে বলা যাবে না। সামিয়া কাকন নিয়ে বসার ঘর থেকে বেরয়ে এলো। দুলাল সিরাজীর বড়দের নিয়ে করা বৈঠকে সামিয়াকে কোনোদিনো থাকতে দেয়নি। তাই এটা নতুন কিছু না সামিয়ার কাছে। তবে কাকনের কাছে বিষয়টি পছন্দ হলো না। তারা দুজন থাকলে কি এমন হতো। আর কাকন আসতেও চাইনি কিন্তু সামিয়ার জোড়াজুড়িতে বসার ঘরে গিয়েছিল।কাকন সিড়ির কাছে এসে পাশে তাকিয়ে দেখলো সামিয়া নেই। তাহলে কি সামিয়া এখনো সেখানে। কাকন এগিয়ে গেলো সামিয়ার কাছে । দেখলো পর্দার আড়ালে দরজার কাছে সামিয়া আড়ি পেতে দাড়িয়ে আছে। কাকন কিছু বলবে সামিয়া কাকনের মুখ চেপে ধরে বললো, “আস্তে ভাবিজান কথা কইয়েন না। শুনলে দাদাজান চেইতা যাইবো। চুপ কইরা কান খাড়া কইরা শুনেন কি কথা কইতাছে তারা। ”
–“কিন্তু এভাবে আড়ি পেতে এভাবে বড়দের কথা শোনা ঠিক না।”
–“চুপ, আপনে এইখানে দাড়ান। কি জানি কইতাছে।”
সামিয়ার প্ররোচনায় কাকন ও দাঁড়িয়ে গেলো। শুনতে পেলো ভিতরের বলা কথা গুলো।

দুলাল সিরাজী সকলের উদ্দেশ্যে বললেন, “আমি একটা সিদ্ধান্ত নিছি। যেইডা তোমাগো কইবার চাই।
তয় তার আগে পারিবারিক কিছু কথা কওয়া দরকার।”

সকলেই দুলাল সিরাজীর মুখপানে তাকালো। হঠাৎ কি সিদ্ধান্ত নিতে পারে উনি আর কিসেরই বা কথা।

রুহুল বললো, ” কি সিদ্ধান্ত নিয়েছেন দাদাজান?”

দুলাল সিরাজী বললেন,”জামাল তুমি জানি কি কইতে চাইছিলা তুমি তাইলে এখুন কও। ”

জামাল নিজের মন কে অবাধ্য করে বললো, “আমি মাফ চাই বড়ভাবি, রুহুল তুই ও মাফ কইরা দিস। আমি আমার ভুল বুঝবার পারছি। কাম ডা ঠিক করে নাই মহী। আর আমি এখুন একটা শান্তিপুর্ণ পরিবার চাই আমাগো। সবাই মিলামিশা থাকবার চাই মঞ্জিলে। আর আব্বাজান ও তাই চায়। ”

রুহুল এবং সুভা দুজনের বুঝতে বাকি নেই এটা কার শেখানো। তবে জামাল আজ বেশ কয়েকদিন হলো আগের মত করে না। রুহুল মায়ের দিকে চাইলো। সুভা চোখ দিয়ে ইশারা করলো রুহুল কে মেনে নিতে বললো। কারণ সুভার হাতেই জামাল তার প্রাণপ্রিয় পুত্র হারিয়েছে আর এটাই ছিল জামালের শাস্তি। রুহুল বললো,”ক্ষমা চাইতে হবে না। আমরা ক্ষমা করে দিয়েছি।”

জামাল আর কিছুই বললো না। নিরব দর্শকের মতো কথা শুনলো দুলাল সিরাজীর। অবশ্য তার আর এখন বলার মতো কিছুই নেই। নিজেকে এখন নিস্ব মনে হয় জামালের।

দুলাল সিরাজী পান চিবোতে চিবোতে বললেন,”আমি গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত নিছি। বিলালের পোলা হেলাল নাই, মহী ও নিজের করা ভুলের জন্য দুনিয়া ত্যাগ করলো। এহুন রুহুল ই আমাগো বংশের একমাত্র পোলা। তাই আমি চাই আমার বংশ বাড়ুক। বংশের নিয়ম মতো সব কাম সহি সালামত চলুক তাই আমি সকল দায়িত্ব রুহুল রে দিবার চাই। আশা করি তোমাগো আপত্তি নাই।”

রুহুল জানতো খুব শীঘ্রই তার দাদাজান তাকে এগুলো বলবে।কিন্তু এত দ্রুত জানা ছিল না। দাদিমা খুশিতে গদগদ হয়ে বললো,”এইডা আপনে ঠিক সিদ্ধান্ত নিছেন বিলালের আব্বা। আমাগো কারো আপত্তি নাই।”

কিন্তু সুভা বলল, ” আমার আপত্তি আছে।”
–“কেন তোমার কিসের আপত্তি?”
–“আমার খোকা এই সকল দায়িত্ব নিতে পারবে না। এই সম্পত্তি, এই বংশে হাজারো মানুষের অভিশাপ আছে। কখনো কাউকে সুখী হতে দেয় না। আমি আমার খোকা কে কখনোই এগুলোতে জড়াতে দেবো না।”

দুলাল সিরাজী ক্ষিপ্ত হয়ে বললেন, “রুহুল না নিলে কেডায় নিবো। ও ব্যতীত কি কেউ আছে এই মঞ্জিলে যে দায়ীত্ব নিবো। মহীরে তো খুন করছো তুমি। ”

–“কেউ নেই সে আপনার ব্যাপার কিন্তু আমি চাই না আমার খোকা এই সকল দায়িত্ব নিক। ”

দাদিমা বললো, ” এই বড়বউ তুই চুপ কর কইতাছি। শশুড় এর মুহে মুহে কথা কইতাছা ব্যাদ্দপ বউ। আমার মানিক এই সব দায়িত্ব নিবো। তুই ওর মাথায় পোকা ঢুকাস না জানি কইয়া দিলাম। ”

–” ছেলের মাথায় পোকা ঢুকানোর অভ্যাস আপনাদের ছিল আম্মা। আমার নেই আর না কোনোদিন হবে। ”
–“তুই কি কইবার চাস হ্যাঁ? ”
–“আমি অতীত মনে করতে চাই না আম্মা। তবে চাইলে আপনারা নিজেদের অতীত মনে করতে পারেন?
–“মুখে খই ফুটছে দেহি, ত..”

রুহুল এতক্ষণ মা-দাদির কথা কাটাকাটিতে বিরক্ত হয়ে উচ্চস্বরে বলল, “সবাই থামুন। আমি সব দায়িত্ব নেবো। সিরাজপুর পরিচালনার দায়িত্ব আমি নেবো।”

–“কিন্তু খোকা”
–“কোনো কিন্তু না আম্মা, দাদাজান ঠিক ই বলেছেন এখন তো আর কেউ নেই। কে নেবে সকল ভাড় আর এমনিতেও আমার ঘাড়েই সব আসতো। তাই আমার আপত্তি নেই দাদাজান। ”

দুলাল সিরাজী খুশি হয়ে বললেন, “আলহামদুলিল্লাহ। মহীবুলের চল্লিশা শেষ হওয়ার পর ই সব আয়োজন শুরু করমু। সারা সিরাজপুরে উৎসব এর ব্যবস্থা কইরা তোমারে সিরাজপুরের কর্তা বানাইয়া দিমু। আইজ আমার বড় আনন্দের দিন। ”

মালেকা ও খুশি হলো। হয়তো একটা সময় নিজের ছেলেকে দেখতে চেয়েছিল। কিন্তু ভাগ্যের পরিহাসে আজ নেই। কিন্তু হাসি নেই কেবল সুভা আর জামালের মুখে। জামাল কোনোদিন ও রুহুল কে এই আসনে দেখতে চায় নি। অন্যদিকে সুভা চায় না রুহুল তার আব্বার পরে এই দায়িত্ব নিক। বিলালের পর রুহুলের খারাপ দশা দেখা মাত্রই সে মারা যাবে। এত কিছু আর তার সহ্য হবে না।

রুহুল মেকি হাসি টেনে বসে আছে। সম্পত্তির প্রতি তার কোনোকালেই লোভ ছিল না আর না আছে। তবে রুহুল এই দায়িত্ব নিতে চায় কারণ রুহুলের ধারণা হয়তো এই দায়িত্ব নেওয়ার পর শত্রুর আক্রমণ তার উপর ই হবে।সেও দেখতে চায় কে তার বংশের শত্রু। কেননা রুহুল তাকে নিজ হাতে খুন করবে।
____________________

পরের দিন সকাল বেলা কাকন রন্ধনশালায় কাজ করছে।রানুর শরীর খারাপ হওয়াতে তড়িপার উপর কাজের চাপ বেশি।রানু বেশি একটা কাজ করে না। কাকনের মায়া হয় তাই কাকন সেচ্ছায় কাজে হাত লাগিয়েছে। সকলের জন্যই রান্না করছে সুভা আর কাকন সেগুলো বাটিতে বেড়ে বেড়ে সাহায্য করছে। এত গুলো দিনে কাকন বেশ স্বাভাবিক হয়ে উঠেছে। বাইরের দাগ গুলো নেই তবে মনের দাগ গুলো ঠিক ই স্পষ্ট। কাকন এখন হাসি খুশিই থাকার চেষ্টা করে। রুহুলের একপ্রকার হুমকি, কাকন কে সর্বদা হাসি খুশি থাকতে বলেছে। কাকন এর পাশেই সামিয়া রয়েছে। মালেকাও এখন আর কাকন কে আগের মতো ঝাঝালো কথা শুনায় না। তবে দাদিমা আগের মতোই আছে। সিরাজী মঞ্জিলের পাক্কা গিন্নি বলে কথা।

মহীবুলের মা বাড়ির সব কাজ ই করে। সবার সাথেই কম বেশি কথা বলে। কেবল কাকন আর সুভার সাথে সাভাবিক ব্যবহার করে না। এমন কি ভালো ভাবে কথাও বলে না। মহীবুলের মায়ের পাতে কাকন ভাত বেড়ে দিতে চাইলে বললো,” লাগবো না আমি নিজেই নিবার পারমু। ”

কাকন এর হাত থেমে গেলো। সুভা বললো, “জাহানারা তুমি এমন আচরণ করছো কেন। এখনো কি তুমি আমার আর কাকনের উপর রেগে আছো?”

মহীবুলের মা হেসে বললো, ” আমি কি এই বাড়ির কোনো মানুষ নাহি যে রাগ করুম। আমি তো এই বাড়ির দাসি। দাসি গো রাগ করুনের অধিকার নাই বড়ভাবি।”

মালেকা মহীবুলের মায়ের থালায় ভাত দিয়ে বললো,
” মহীর মা তুই এইভাবে কস কেন। আমরা কি তরে কোনোদিন কম মনে করছি। তুই কেন দাসি হবি। এই বাড়তে আমরা ও যা তুই ও তা। এইভাবে কইতে নাই।”

–” তো কিভাবে কমু কন ছোটভাবি? ”

সুভা বললো, “আমি একজন মা হয়ে তোমার ছেলেকে খু’ন করেছি আমি জানি আমি অন্যায় করেছি। ভেবে দেখো তো তোমার মেয়ের সাথে যদি কেউ জোর জবরদস্তি করতো আর তুমি সেই অবস্থায় কি করতে। মা হয়ে, একজন নারী হয়ে আরেকজন নারীর ইজ্জত হরণ করতে দিতে পারতে তুমি? ”

মহীর মা নিরুত্তর।সে মাথা নিচু করে ফেললো। মহীবুল যে সত্যিই ভয়ংকর অন্যায় করেছিল।

কাকন মহিবুলের মায়ের পা ধরেব ললো, “আমার মা নেই চাচি আম্মা। তবে এ বাড়িতে আমার তিনটি মা। আপনি আমায় রোকেয়া আপার মতোই ভালোবাসেন সে আমি জানি। আমায় আম্মার পর আপনিই সংসার কি তা বুঝিয়েছেন। আমায় কি ক্ষমা করা যায় না।আমার জন্য যা হারিয়েছেন তা হয়তো ফিরিয়ে দিতে পারবো না তবে আপনার আরেকটি সন্তান হয়ে ঠিকই থাকতে পারবো। আমায় ক্ষমা করে দিন না। ”

মহীবুলের মা কাকন কে জড়িয়ে ধরলো।কাদতে কাদতে বললো, ” আমার কোন রাগ নাই,, দুঃখ নাই কিন্তু আমার একটাই শোক আমার পোলা কেন রুহুলের মতো হইল না। আমার সন্তান হইয়া কেন আমারে রুহুলের মত নিজ আম্মারে ভালোবাসলো না।ওর বাপ না হয় পাপি, অনেক পাপ করছে আমি কি পাপ করছিলাম যার জন্য পুত্র দিয়াও সুখ পাইলাম না ”

সুভা মহীবুলের মায়ের চোখের পানি মুছে দিয়ে বললো ” এই দুনিয়ায় খোকার মতো সন্তান একটাই দিয়েছেন আমাকে আল্লাহ। তবে খোকা তোমার গর্ভে হলেই বোধহয় ভালো হতো। অন্তত এতকিছু ওর সহ্য করতে হতো না। আর তুমিও সুপুত্র পেতে।”

কাকন সুভার দিকে তাকালো। তার স্বামীর বেদনা আজ্ও অজানা তার কাছে। সুভা যে কাকনের নানা অজানা কথার বাক্স। সুভার থেকে কি কাকন আদোও সব জানতে পারবে।
____________________

সামিয়া কাকনের কাছেই বসে আছে । সামিয়ার আজকাল কোনো কাজ নেই বললেই চলে।পাচ ওয়াক্ত নামাজ আর এই ঘর থেকে সেই ঘর। রুহুল এর কথা মতো কাকনের মন ভালো রাখার জন্যই সামিয়া তার দুষ্ট মিষ্টি কথা শুনিয়ে কাকন কে হাসায়।বেশির ভাগ সময় ই কাকনের সাথে পাড় করে। কাকন এর ও খুব ভালো লাগে। এর মাঝে রানু এসে বললো, ” সামিয়া বুবু তোমার সুয়ামি আইছে। তাড়াতাড়ি আহো।”

রানুর কথা শুনে কাকন খুশি হয়ে হাসলেও হাসি নেই সামিয়ার মুখে। আশ্চর্য হয়ে গেছে সামিয়া। কোনো খবর নেই বার্তা নেই হুট করে চলে এলো।সামিয়ার বুক ধুকবুক করছে সে সামনে যাবে কি করে। বকুলের কাছে গেলেই চিঠিতে দেওয়া হুমকি গুলো বাস্তব রূপ ধারণ করবে। আর সেই সাথে নানা কথা শুনতে হবে।
সামিয়া রানু কে বললো, “তুই যা আমি যামু না।”

–“কেন, দাদিআম্মা আমারে পাঠাইলো আপনেরে ডাকতে। আইসেন হেই রাজধানী থিকা আইছে। ”

সামিয়া বললো, “এই তুই যা তো। নাইলে মাইর দিমু। ”
রানু মাইরের কথা শুনেই চলে গেল।

কাকন বললো, ” তুমি যাও, উনি হয়তো তোমার অপেক্ষা করছে। তাই তোমার যাওয়া উচিত। ”

সামিয়া ফ্যাকাশে মুখ নিয়ে কাকনের দিকে চেয়ে বললো, ” ভাবিজান আমি যামু না ”
–“কেন?”

–“আমি গেলেই উনি আমায় ঝাড়বো। ওনারে চিঠির উত্তর দেই নাই আর তাছাড়া আমার শরম করতাছে।”

কাকন হাসলো হেসে বললো, “বিশ্বাস রাখো কিছুই বলবে না। এতদিন পর এসেছে তোমায় বরং অনেক আদর সোহাগ করবে দেখে নিও।”

সামিয়া লাজুক হেসে বললো, “ধ্যাৎ কিসব যে কও না ভাবিজান। ”
–“হুম ঠিক ই বলি আমি বুঝেছো। ”

তবুও সামিয়া নড়লো না। তারপর কাকন সামিয়াকে ধাক্কা দিয়ে বললো,”কি হলো যাও।”

সামিয়া বিছানা থেকে নামলো। আয়নার সামনে যেয়ে চুল আচড়ে মাথায় শাড়ির আচল দিয়ে ঠিকঠাক হয়ে নিলো। তারপর কাকনের কাছে এসে দাঁত কেলিয়ে হেসে বললো, “একটা জিনিস বুঝলাম ভাবিজান। ”

কাকন বললো, “কি জিনিস?”
–“এই যে দাদাভাই অনেকদিন পর ঢাকা থিকা আসলে তোমায় অনেক আদর-সুহাগ করে। এই জন্যই জানো।”

বলেই ভো দৌড় দিলো সামিয়া। কাকনের চোখ লজ্জায় বেড়িয়ে আসার উপক্রম। নিজের উপর ই রাগ লাগলো কাকনের। কেন যে সে মুখফুটে সত্যি কথাটি বলতে গেলো। আর এই সামিয়া এত কিছু বোঝে কি করে।
আর কোনো কথাই বলবে না কাকন।
_________________________

বকুলকে রানু সামিয়ার কক্ষ দেখিয়ে দিয়েছিল। তাই বকুল সামিয়ার কক্ষেই অপেক্ষা করছে। সামিয়ার নিজের কক্ষেই যাওয়ার সময় কেমন যেন অসস্তি লাগছে। তার সাথে লজ্জা তো আছেই। দড়জার সামনে দাড়িয়ে ভাবছে যাবে কি যাবে না। সামিয়া হালকা দড়জা খুলে উকি দিলো দেখার জন্য বকুল কোথায় কিন্তু দেখলো যে বকুল নেই। এর ই মধ্যে কেউ সামিয়ার সামনে ছেড়ে দেওয়া চুলের বেণি ধরে টেনে কক্ষে নিয়ে এলো। নিয়ে এসেই দরজা আটকিয়ে দিলো। আকষ্মিকভাবে এমন ঘটনায় হচকচিয়ে গেলো সামিয়া। বকুল সামিয়ার সামনে দাড়িয়ে নিজের দুহাত বুকের সাথে ভাজ করে রেখে বললো, ” এখন কি করবো বলো তো দেখি,কি শাস্তি দেওয়া যায় তোমায়?”

–“কি,,কিসের শাস্তি হ্যাঁ? ”
–” কিসের শাস্তি তাই না। দু’দুটো চিঠি লিখেছিলাম উত্তর পায় নি তার শাস্তি। আমার ঘুম হারাম করে রেখে এতদিন সিরাজপুরে সুখে থাকার শাস্তি।”

সামিয়া খাটে বসে বললো,”আসলে আমি ব্যস্ত আছিলাম তাই লিখতে পারি নাই। ”
–“তা কি এমন কাজে ব্যস্ত ছিলে শুনি?”

সামিয়া কি বলবে এখন। পরীক্ষার বাহানা দিলেও কথা শুনতে হবে তাই বুদ্ধি খাটিয়ে বললো,
–” কত কিছু ঘইটা গেলো আমাগো মঞ্জিলে তাই। ”

বকুল ও বিছানায় বসে বললো, “হুম সেই তো ঘটেছে। সেই জন্য এবারের মতো মাফ করলাম তোমায়।”

সামিয়া খুশি হয়ে বললো, “ধন্যবাদ।”
বকুল সামিয়ার অতি নিকটে গেলো। শান্তস্বরে বললো, –“সামিয়ারানি ”
সামিয়া উত্তর দিলো, “জি ”

বকুল সামিয়ার হাতের দিকে চেয়ে বললো, “তোমার ওই কোমল হাত দুটো একটু ধরি? ”
–“হুম”
–“তোমার হাতে একটু চুম্বন দেই?”
সামিয়া লজ্জা পেলো। তবে মুখে বললো, “হুম ”
বকুল হাত মুখের কাছে নিয়ে একটা চুমু দিলো। তারপর সামিয়ার আরো কাছে বসলো। তারপর বললো,
” তোমায় একটু জড়িয়ে ধরি? ”

সামিয়া বকুলের মতলব বেশ বুঝলো। সে এখন এখান থেকে কেটে পড়লে বাচে। সামিয়া নিজের হাত ছাড়িয়ে নিয়ে বললো, ” উহু, সড়েন দেখি আপনে অনেক ক্লান্ত হইয়া আছেন। আপনের জন্য পানি নিয়া আসি।”

বকুল সামিয়ার হাত ধরে নিজের বুকের সাথ মিশিয়ে নিলো। তারপর বললো, ” আমার বুকের তৃষ্ণা আগে মিটিয়ে দাও। পানির তৃষ্ণা না মেটালেও চলবে।”
______________________

সিরাজী মঞ্জিল কেমন শুনশান লাগে আজকাল। হালকা শীত এর ছোয়া পাওয়া যায় প্রকৃতিতে । শীত না আসতেই শীতের রিক্ততা যেন সব সিরাজী মঞ্জিলের পরিবেশের উপর পড়েছে। সারাদিন বাড়িতে কতজন মাতিয়ে রাখতো। বাড়িতে এখন কেবল কাকন, মালেকা, সুভা, মহীবুলের মা, দাদীমা ব্যতীত কেউ থাকবে না।

জামাল ও ছেলের শোকে কেমন ছন্নছাড়া হয়ে আছে। বাড়িতে ঢুকলেই মহীবুলের জন্য মনে কষ্ট হয়। জামাল অনুভব করে তাকে মহীবুল আব্বা আব্বা বলে ডাকছে। মহঈবুলের ঘরে দিনে একবার হলেও যায় জামাল। নিজ হাতে সব কিছু নিজের মতো করে গুছিয়ে রাখে।

রুহুল নিজের সকল কর্ম সেড়ে কেবল সিরাজী মঞ্জিলে এলো। রুহুল জামালকে মহীবুলের ঘর থেকে বের হতে দেখে থেমে গেলো। জামালের এমন করুন চেহারা দেখে রুহুলের খুব খারাপ লাগলো। লোকটার প্রতি ভীষণ ক্ষোভ জমেছিল রুহুলের মনে তবে এখন আর নেই। কারণ পুত্রশোকে জামালের এমন করুণ দশা দেখে রুহুলের নিজের ই মায়া হয়। একটা সময় জামাল ও রুহুল কে ভীষণ ভালোবাসতো। কিন্তু সম্পদের লোভের তাড়নায় রুহুল কে নিজের ছেলের শত্রু মনে করতে শুরু করে। এমনকি হেলাল কে ও রুহুলের শত্রুতে পরিনত করে।
রুহুল কে সামনে দেখে জামাল কিছুটা অসস্তিবোধ করলো। রুহুলকে পাশ কাটিয়ে চলে যেতে চাইলো। রুহুল ডাকলো, “চাচাজান।”

জামালের পা থেমে গেলো। রুহুল জামালের কাছে গিয়ে বললো, ” আমায় ক্ষমা করবেন চাচাজান। ”

কিন্তু জামাল উত্তর দিল না।রুহুল আবারো বললো,
–“আমি আপনার গায়ে হাত তুলেছিলাম সেদিন। তার জন্য আমি দুঃখিত। আপনি আমার স্ত্রীর গায়ে হাত তুলেছেন স্বামী হয়ে এটা আমি মেনে নিতে পারি নি তাই সেদিন আপনার হাতেও আঘাত করেছিলাম। আমি হাত জোর করে বলছি আমায় ক্ষমা করে দেন।”

জামাল বললেন, “হাহ, কপালে লাত্থি দিয়া পায়ে সালাম করতে আইছো রুহুল। দরকার নাই ক্ষমা চাওনের।”

–“দরকার হলে তাই করবো চাচাজন। আপনি ভালো করেই জানেন আমার যখন রাগ হয় তখন আমি রুদ্রমূর্তি হয়ে যাই আর যখন ভালো থাকি তখন সবচেয়ে শান্তশিষ্ট হয়েই থাকি। সেদিন আমার স্ত্রীকে যেগুলো বলেছিলেন আমি সব চাচি আম্মার থেকে শুনেছিলাম।আর সেই সাথে চাচি আম্মার উপর করা নির্যাতন ও আমায় রাগিয়ে দিয়েছিল। প্রচন্ড রাগে আপনার গায়ে হাত তুলেছিলাম।”

–” দুইদিনের বউ এর জন্য তুমি নিজের চাচার গায়ে হাত তুলছো রুহুল। ভুইলা গেছিলা যে আমি তোমার চাচা হই।”

–” চাচা কখনো নিজ ভাইপোর স্ত্রীর গায়ে হাত তোলে না। ভুল আপনার ও হয়েছে আমার ও হয়েছে। আগের মতো করে কি সব হতে পারে না চাচাজান। ”

–“আমার মন মেজাজ ভালা নাই রুহুল। আমি এগুলা বিষয় কথা কইবার চাই না। ”

–” আপনার মনের অবস্থা আমি বুঝি। কারণ এই বাড়ির প্রত্যেক টা সদস্য জানে আপনি মহীকে কত টা ভালোবাসতেন।তবে আপনাকে আগের মতো দেখতে চাই আমরা সকলে। আপনাকে স্বাভাবিক হতে হবে।”

জামাল রুহুলের দিকে চেয়ে বললো,” একটা কাম করবা রুহুল? ”
–“জি বলুন চাচাজান! ”

–” আমারে আমার মহীর কাছে পাঠাইয়া দেও। আমার আর ভাল্লগতাছে না। আমি আর এই মঞ্জিল এত কিছু চাই না।আমার বুক খা খা করে,মহীর কথা মনে পড়ে।”

–“এটা তো সম্ভব নয়। আপনাকে তো চাচি আম্মার জন্য বাচতে হবে। সারাজীবন তার সাথে অন্যায় করে গেছেন।শেষ সময় টা তার সাথে ভালোভাবে থাকুন।”

–“কেন সম্ভব না আমি আর বাচবার চাই না। তর আম্মায় মহীরে খুন করার আগে আমায় করলো না কেন।আমার প্রশ্রয়েই আমার মহী ওই পাপ করতে গেছিলো। আমি তো তোর শত্রু খুন কর আমারে।”

–“আপনারা তো কম অন্যায় করেন নি। আমি চাইলেই সব দাদাজানের কাছে বলে দিতে পারতাম কিন্তু আপনাদের ছাড়া এই মঞ্জিলে থাকা আমার জন্য অসম্ভব। আপনাদের যে সারাজীবন আপন ভেবে এসেছি অথচ আপনারা সারাজীবন পর ভেবেই গেলেন। আপনি কোনোদিনো আমার শত্রু ছিলেন না। আর না আছেন। আপনি আমার আরেক আব্বা। ”

জামাল হু হু করে কেদে উঠলো। বললেন, ” আব্বা ঠিক ই কইসে সব আমার পাপের ফসল। তুই আমাগো ফালাইয়া দিতি না। ঠকাইতিও না। আমার জন্য আইজ আমি পুত্রহারা। আমার করা সব পাপের জন্য আইজ আমি নিস্ব। তোর ক্ষতি করতে চাইয়া নিজের ক্ষতি কইরা ফালাইলাম। ”

–“পাপ পাপ কেও ছাড়ে না, আর পাপিকেও ছাড়ে না। আল্লাহর কাছে ক্ষমা চেয়ে নিন। আগের মতো সব ঠিক করে নিন। আসুন না আমরা একটা সুন্দর পরিবার গড়ি। আমার নিজেরও এত অশান্তি ভালো লাগে না। ”

জামাল নিজের চোখ মুছে বললো, “হ তাই করমু। আমি ভালো হইয়া যামু। আর পাপ করমু না। আল্লাহর কাছে ক্ষমা চাইয়া হেদায়েত চামু। ”

রুহুল জামালের হাত ধরে বলল,” চাচাজান সবার আগে নিজের স্ত্রীর কাছে ক্ষমা চান। নিজের স্ত্রীর কাছে যে পুরুষ উত্তম সেই উত্তম পুরুষ। আপনি সবচেয়ে বেশি অন্যায় করেছেন নিজের স্ত্রীর সাথে। ”

–“হুম মহীর মা রে আর কষ্ট দিমু না।আমি এক্ষুণি যামু ওর কাছে। সব ঠিক কইরা নিমু। ”

জামাল চলে গেলো। তবে রুহুলের খুব ভালো লাগলো। অবশেষে মনে হচ্ছে এখন থেকে আর কোনো অশান্তি হবে না। সব ঠিক হয়ে যাবে সিরাজী মঞ্জিলে ।

রুহুল কক্ষে গেলো দেখলো কাকন উল্টো দিক হয়ে বিছানায় রাখা শুকনো কাপড় ভাজ করছে। রুহুল পিছন থেকে যেয়ে কাকন কে শক্ত করে জড়িয়ে ধরলো। কাকনের হৃদগতি মুহুর্তেই বেড়ে গেলো তবে কিছু বললো না। নিজের মতো কাজ করে গেলো। রুহুলের এই স্পর্শ গুলো যে কাকনের সর্বাঙ্গে সবচেয়ে চেনা, সবচেয়ে প্রিয়।

রুহুল কাকনের কোনো কথা সাড়াশব্দ পেলো না। কাকনের ঘাড়ে চুমু দিয়ে বললো, “এত কাছে আছি
তবু আপনার সাড়া নাহি পাই। শেষ নিশ্বাস অব্দি আমি কেবল আপনার ভালোবাসা চাই।”

চলবে…

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here