দেবী,৪২

0
319

#দেবী,৪২
লেখিকাঃ শবনম রাবাহ (স্রোতস্বিনী)
কপি করা সম্পুর্ণ নিষেধ।

অগ্রহায়ণ এর শুরু হয়েছে আজ কয়েকদিন। তবে যেদিন থেকে সুভার হত্যার পরিকল্পনার কথা কাকনের কানে গেছে সেদিন থেকেই যেন কাকনের মাথায় ঘুণপোকারা বাসা বেধেছে। না পারছে বের করতে আর না পারছে এদের জ্বালা সইতে। আজকাল রুহুলের দেখা খুব একটা পায় না কাকন। নতুন ফসল নিয়ে বেশ ব্যস্ত সময় কাটাতে হচ্ছে রুহুলকে। অনেক রাত করে বাড়ি ফেরে। রাতে কাকন এখন আর অপেক্ষা করে না। কারণ রাতে যতক্ষণ জেগে থাকে ততই পোকাগুলি হানা দেয় যেন।
রাত অনেক হয়েছে তবে অন্যদিনের তুলনায় কাকনের মন আজ ভীষণ খারাপ লাগছে সুভার জন্য। রাতে রন্ধন শালায় রানুর বলা কথায় সুভা কত সুন্দর করে হেসেছিল। এই হাসিটি কি তবে কাকন আর দেখতে পাবে না। কাকন কি করবে ভেবে পাচ্ছে না। দুলাল সিরাজী কে এখন বাধা দেওয়ার ক্ষমতা কাকনের নেই। অন্যদিকে রুহুল কেও বলতে পারবে না কারণ কাকন চায় না রুহুল দুলাল বা জামালকে নিজ হাতে হত্যা করুক। বিছানায় একাত ওকাত হতে হতেই চোখে ঘুম ঘুম অনুভব করছে আর তার সাথে তীব্র মাথা ব্যাথা।

রাত প্রায় ১২ টা ছুই ছুই। সকল কাজ সেরে রুহুল কক্ষে এলো। গ্রামে রাত ১২টা মানেই অর্ধেক ঘুম। রুহুলের সাথে ছিল জামাল সিরাজী। আজ গিয়েছিল অন্য গ্রামে এক বিশেষ কাজে। যেদিন তাড়াতাড়ি আসতে চায় সেদিন ই রুহুলের দেরি হয়ে যায়। রুহুল রাতের খাবার খেলো। খেয়ে কক্ষে যাওয়ার জন্য উঠলো। আজ রুহুল ভীষণ ক্লান্ত। তবে আজ সে কাকন কে সন্তান নেওয়ার কথা বলেই ছাড়বে। অনেক হয়েছে আর দেরি নয়। এবার সে বাবা হতে চায়। রুহুলের ধারণা এ বিষয়ে কাকনের সাথে আলোচনা করাটা সত্যিই উচিৎ।

কক্ষে একটি হারিকেন জালিয়ে শুয়ে আছে কাকন। রুহুল দরজা লাগিয়ে এগিয়ে পোশাক পালটে এগিয়ে গেলো বিছানায়। কাকনের পাশে শুয়ে কানের কাছে মুখ নিয়ে কাকন কে ডাকলো। কাকন কানে শুনছে ঠিক ই কিন্তু সাড়া দিতে ইচ্ছে করছে না। কাকন চুপচাপ চোখ বুজে শুয়ে রইলো।
রুহুল কানে চুমু দিলো। কাকনের গলায় মুখ ডুবে দিতেই কাকন বল প্রয়োগ করে রুহুল কে সরিয়ে দিলো। কাকনের এমন আচরণে রুহুলের রাগ উঠে গেলো। রেগে বললো, ” সমস্যা কি আপনার? এমন করলেন কেন? ”

–” ভাল্লাগছে না। আ..আমি ঘুমাব। ”
–“তো ঘুমাবেন বললেই হয় আমার আমার সাথে এমন আচরণ করতে পারেন না আপনি। ভুলে যাবেন না আমি আপনার স্বামী হই। ”
–“আপনি আকষ্মিক এভাবে এসেছেন তাই আসলে..”
–” আমি আপনার সাথে কখনো জোর-জবরদস্তি করি না। মুখে বললেই হতো এমন আচরণ না করে। ”

কাকন একহাতে মাথা চেপে ধরে উঠে বসলো। রুহুলের হাত ধরে বললো, ” আমি দুঃখিত আমার খুব মাথা..”

কিন্তু রুহুল কাকনের কথা শুনলো না। হাত ছাড়িয়ে নিয়ে বললো,”আফসোস আপনি আমায় কখনো বুঝলেন না। মাঝে মাঝে মনে হয় বুঝেও অবুঝের মতো আচরণ করেন।অবশ্য ভুলটা আমার ই আপনার নয়। ”

রুহুল বিছানা ছেড়ে উঠে সোজা বাড়ান্দায় চলে গেলো। খোলা বাড়ান্দায় কিনারে দাড়িয়ে পড়লো। রুহুল কাকনের সাথে খারাপ আচরণ করতে চায় না। কক্ষে থাকলে রাগের মাথায় অনর্থক কিছু ঘটিয়ে ফেলতে ও পারে রুহুল যা নিজেও চায় না। রুহুল কাকনের এমন আচরণ মেনে নেওয়ার মতো পুরুষ নয়। যতই ভালোবাসুক স্বামীর সাথে এমন আচরণ করা অন্যায় বলে মনে হলো রুহুলের। রুহুলের মতো স্বামীকে বল প্রয়োগ করে সড়িয়ে দেওয়ার কারণ খুজে পায় না।

রুহুল বাড়ান্দায় চলে যাওয়ার পর কাকন বিছানা থেকে নেমে বাড়ান্দার দিকে পা বাড়ালো। অতিরিক্ত চিন্তায় মস্তিষ্ক বিকল হয়ে গেছে কাকনের এমনটিই মনে হচ্ছে কাকনের। কাকন রুহুলের কাছে গিয়ে কথা বলার আগেই রুহুল বললো, “কক্ষে যান আমি এখন আর কোনো কথা শুনতে চাই না। ”

কাকন রুহুলের দিকে এগিয়ে বললো, “আমি আ..”

রুহুল উচ্চস্বরে ধমকে বললো, ” আমি বললাম তো কোনো কথা শুনতে চাই না।”

এই প্রথম রুহুল এমন উচ্চস্বরে কথা বললো কাকনের সাথে। কাকনের হৃদয় যেন চূর্ণ বিচুর্ণ হয়ে গেলো মুহুর্তেই। কাকন রুহুলের দিকে চেয়ে চোখ নামিয়ে নিলো। কক্ষে এসে বিছানায় মুখ বুজে কাদতে শুরু করলো। রুহুলের এমন আচরণ কাকন নিতে পারবে না। বিয়ের পর থেকেই রুহুল যে ভালোবাসা আদর দিয়েছে একটু অবহেলা ও সহ্য কুরতে পারার শক্তি তৈরি হয়নি কাকনের। কাকন কাদতে কাদতে হেচকি উঠে গেলো।

অপরদিকে রুহুল আকাশের দিকে একমনে তাকিয়ে আছে। স্বামী হিসেবে তার নিজস্ব চাহিদা থাকতেই পারে। এত ভালোবাসে কাকনকে কিন্তু রুহুলের আজ মনে হচ্ছে কাকন বোধহয় রুহুলকে ভালোবাসে না এত ভালোবাসার পর ও যে স্ত্রী এমন আচরণ করে সে আর যাইহোক ভালোবাসতে পারে না। রুহুল মনে মনে ভেবে নিলো আজকের পর থকে নিজে থেকে আর কাকনের কাছে যাবে না। যতই কষ্ট হোক নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করবে। তবুও যাবে না। নানা চিন্তা করতে করতেই রুহুল বাড়ান্দায় রাখা বেতের চেয়ারে বসে পড়লো।

রাত শেষে সুর্যের আলোয় চাঁদের অবসান ঘটলো। রুহুল চোখ খুললে রোদের আলো সোজা চোখে এসে পড়ল। রুহুল হাত ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখল ৫টা বাজে। মাত্র ৪ ঘন্টা ঘুম হয়েছে। রুহুল চেয়ার ছেড়ে উঠে কক্ষে গেলো। ঘুমিয়ে থাকা কাকনের নিষ্পাপ সরল মুখখানা ছুয়ে দিতে ইচ্ছে করছে কিন্তু রুহুল তা করবে না। হাতে গামছা আর শার্ট নিয়ে সোজা বেরিয়ে গেলো কক্ষ থেকে।
_______________________

গুদামঘরে বসে আছে রুহুল। সেই যে ভোরে বেরিয়েছে একবারের জন্য ও যায় নি সিরাজী মঞ্জিলে। সকালে সুভা লতিফকে দিয়ে রুহুলের জন্য খাবার পাঠিয়ে দিয়েছিল। যা খেয়ে নিজের কাজ চালিয়ে যাচ্ছে রুহুল।
দুলাল সিরাজী কাজের তদারকির বাহানায় এলো রুহুলের কাছে। রুহুলের হিসাবের খাতায় লেখালেখি করছিল। দুলাল সিরাজী এগিয়ে গিয়ে বললো, ” কাম সব ঠিক ঠাক তো রুহুল।”

রুহুল কাজ করতে করতেই উত্তর দিলো,”জি দাদাজান”
—“আমি চাইতাছি এইবার ফসল তুমি নিজ দায়িত্বে ঢাকা নিয়া যাও কিন্তু নিজ দেশের মানুষের কাছে না বেইচা বিদেশে বেচো।সেইদিন শুনলাম বিদেশেও নাকি এগুলা পাঠাইলে অনেক লাভবান হওয়া যায়। আমি চাই তুমি যাইয়া সেই ব্যবস্থা করে আইসো।”

রুহুল বললো, “আগে আমাদের সিরাজপুরের মানুষের ভাগ তারপর বিদেশে পাঠানোর কথা ভেবে দেখবো”

–“হ্যাঁ কিন্তু আল্লাহর রহমতে এইবার অনেক ফসল হইছে আমাগো সকল জমিতে। তাই তুমি অবশিষ্ট গুলা নিয়া যাও। দরকার হইলে দু’একটা কর্মচারী ও নিও সাথে । ”
–“সকল কাজ কেন আমাকেই দেখতে হবে। এইবার অন্তত চাচাজান কে পাঠান। আর ঢাকায় আমাদের লোক আছেই। দরকার হলে বকুলকে বললে বকুল নিজেও সাহায্য করবে।”

–” এই কাম তো অনেক দিনের ব্যাপার। জামাল পারবো না। একমাত্র তুমিই পারবা। তুমি যদি যাও তোমার বোনদের শশুড় বাড়িতেও দাওয়াত দিয়া আসলা শীতের জন্য। আর এই কাম গুলা ও কইরা আসলা
এক কামে দুই কাম হইল মন্দ কি। নাহয় সেইখানে থাকলা দু’এক সপ্তাহ। ”

–“কিন্তু দাদাজান সবে অগ্রহায়ণ পড়েছে। মাহিফিল তো পৌষের শুরুতে হবে। আপনি চাচাজান কেই পাঠান।”

–“সে হইবো কিন্তু ওইখানে কাম কাজ আছে কিছু। কারখানার কাম বাদ বাকি গুলা সাইরা আসবা। সেই সাথে ফসল বিক্রির কাম ও কইরা আসবা।”

রুহলের দুলাল সিরাজীর কথায় বিরক্ত লাগছে। তবে রুহুল জানে তার দাদা ঢাকায় না পাঠিয়ে ছাড়বে না। রুহুল বললো, “ঠিক আছে যাবো।”
দুলাল হেসে বললো, ” আচ্ছা আমি তাইলে আসি।কাল ই তোমার যাওয়ার ব্যবস্থা কইরা দিমু।”

দুলাল সিরাজী মনে মনে বেজায় খুশি তার সকল ছক পুর্ন হতে চলেছে। রুহুলের আসার আগেই সুভার খেল খতম করবে।সুভার করা অপমানের বদলা নিয়েই ছাড়বে।
রুহুল খাতা বন্ধ করে দুহাতে মাথা চেপে দাড়িয়ে গেলো। জানালার কাছে দাড়ালো। এখান থেকে সিরাজপুরের উপর দিয়ে বহমান নদীটা দেখা যায়। রুহুল নদীর দিকে তাকিয়ে মনে মনে কাকনের কথা ভাবলো। রুহুলের ধারণা ও চলে গেলে কাকন ভালো থাকবে। আর এ কদিন রুহুল ও কাকন উপেক্ষা করতে পারবে। হৃদয়ের সাথে লড়াই করে সিদ্ধান্ত নিলো রুহুল থাকবে না সিরাজপুরে। ঢাকা চলে গেলে এই অগ্রহায়ণ মাসে আর সিরাজপুরের মাটিতে পা রাখবে না।
___________________

বিকেল গড়িয়ে সন্ধ্যা রুহুলের আসার নাম নেই।কাকনের মন খারাপ হয়ে আছে। রাতের ঘটনা বার বার আহত করছে কাকনের মনকে। দুপুরে রুহুল আসে নি বিধায় কাকন ও দুপুরে খায় নি। অপরাধবোধ যেন কুড়ে কুড়ে খাচ্ছে কাকনকে। সারাদিন যত যাই করুক রুহুলের বুকে যে স্বর্গীয় সুখ পায় কাকন তা সে অস্বীকার করতে পারবে না। আর সেই সুখ পেতে হলে যে কাকনকে রুহুলের প্রয়োজন। কাকন দুধ গরম করে বিলালের জন্য নিয়ে গেলো। সুভা দুধ ঠান্ডা করতে দিয়ে কাকনের দিকে তাকালো। কাকনের মন উদাস দেখে সুভা বললো,”কি ব্যাপার মন খারাপ করে আছো কেন কাকন?”

কাকন মিথ্যে হেসে বললো “কই না তো আম্মা।”

সুভা বিলালের মুখে দুধ ঢালতে ঢালতে বললো, “আল্লাহ জিহবা দ্বারা মিথ্যা বলার ক্ষমতা দিয়েছেন চক্ষু দ্বারা নয়। মানুষের চোখ কখনো মিথ্যে বলে না।”

কাকন মাথা নত করে ফেললো। সুভা আবারো বললো, ” আম্মা বলেই যখন ডাকো লুকাচ্ছো কেন? নির্দিধায় বলো কি হয়েছে। ”
কাকন সুভা কে জড়িয়ে ধরে কেদে দিল। সুভা হেসে বললো, ” খোকার সাথে কি কিছু হয়েছে?”

কাকন মাথা দিয়ে স্বীকার করলো হয়েছে। সুভা বললো, “কাদে না। স্বামী-স্ত্রীর মাঝে ঝগড়া,মান- অভিমান ভালোবাসা গাঢ় করে। কেননা মান-অভিমান হলেই বুঝা যায় ভালোবাসার মানুষ টা কত মুল্যবান।এবার বলো দেখি কি হয়েছে? ”

কাকন চোখের পানি মুছে বললো, “ওনার কোনো দোষ ছিল না আম্মা। আমিই ওনার ভালোবাসার অবমাননা করেছি। তবে ইচ্ছে করে করি নি। ”
–“আমার খোকা ভালোবাসার পিয়াসী। একটু ভালোবাসা দিও সব ভুলে যাবে। ”
–“ওনার ওমন গম্ভীর মুখ আমার সহ্য হয় না আম্মা। জানেন উনি প্রথমবার আমার সাথে এমন ভাবে রেগে কথা বলেছেন। আমার খুব কষ্ট হচ্ছে আম্মা।”

–“আমার খোকার ভালোবাসা যেমন গাঢ় রাগ তার চেয়েও ভয়ংকর। আমার খোকাটা এমন শান্ত শিষ্ট, গম্ভীর ছিল না। সময় ও পরিস্থিতি ওকে এমন করে দিয়েছে। সময় থাকতে স্বামীকে নিজের করে নেও কাকন। সময় দ্বিতীয় বার ফিরে আসবে না।”

–“জি আম্মা আমি তাই করবো। ”
–“হুম। ওষুধ গুলো গুড়ো দেও।”

কাকন ওষুধ গুড়ো করে সুভাকে দিলো তারপর বলল,”আমার আপনার সাথে কিছু কথা আছে আম্মা”

সুভা ওষুধ মেশাতে মেশাতে বললো, ” হ্যাঁ বলো।”

–“আপনার ছেলের জীবনে, আপনার জীবনে কিসের কষ্ট ছিল, কিসের অভিমান আপনার নিজের সন্তানের সাথে আম্মা?”

সুভার হাত থেমে গেলো। সুভা কাকনের দিকে চেয়ে বললো,”সেটা তোমার না জানলেও চলবে? ”

–“ঠিক আছে। তবে দাদাজান এর সাথে আপনার এমন শত্রুতা কেন?”
–“কে বলেছে তোমায় আমার আব্বার সাথে শত্রুতা? ”

–“সিরাজী মঞ্জিলে আমিও থাকি আম্মা। অনেক কিছুই কানে আসে, চোখে দেখি তবে আমি জবানে নিয়ে আসি না । আজ জানতে চাইছি বলবেন না আমায়? ”

–“যা জানো না তা তোমার জানতে হবে না। কিছু অজানা না জানাই ভালো। সেগুলো জানতে নেই।”

–“আর আমি যদি বলি আপনার বেচে থাকার জন্য আপনাকে বলতে হবে আমায়?”
–“মরে তো সেদিন ই গিয়েছি যেদিন পৃথিবীতে নতুন সুভার জন্ম হয়েছিল। নতুন করে মরার ভয় পাই না।”

–“আম্মা আপনি আম..”

সুভা কাকনের কথা থামিয়ে দিয়ে বললো, “এখন আসতে পারো। তোমায় দরকার নেই এখন এই কক্ষে।আর খোকার সাথে সব ঠিক করে নিও। আমার খোকার কষ্ট কিন্তু আমি মেনে নেবো না।”

সুভার কথায় কাকন বেরিয়ে গেলো। সর্বদা কাকনের হিসেব গড়মিল হয়ে যায় কেন। ভাবে এক হয়ে যায় আরেক। সব পরিকল্পনা যেন বিফলে যাচ্ছে কাকনের।
_______________________

বিকলে রুহুল নামাজ পড়ে সবে মসজিদ থেকে বেরিয়েছে। আজ দুপুরেও মঞ্জিলে যায়নি রুহুল। তবে পথিমধ্যে সাজুকে রুহুলের দিকে অগ্রসর হতে দেখে অবাক হলো। সাজু মুলত সিরাজপুরে ঘুরে বেড়ায় আর গোপন খবর এনে দেয়। সাজুর ও কিছু লোক আছে যারা সাজু কে খবর দেয়। সাজু কে দেখে রুহুল
বললো, ” কি ব্যাপার সাজু কিছু বলবি?

সাজু লাজুক হেসে বললো, “ইয়ে মানে খুব দরকারি একখান কথা কইতাম সিরাজী সাব!”
রুহুল বললো, “হ্যাঁ বল তাহলে।”
–“কেমনে যে কই! ”
–“গোপন কোনো কথা?তাহলে চল অন্য কোথাও যাই।”
–“আজ্ঞে না গোপন না। অন্য বিষয়ে? ”
–“কি বিষয়ে? ”
–” আমার তো বাপ মাও কেউ নাই। আপন কইতে আপনেরাই আছেন। আম্মাও আপনেগো বাড়ি কাম করতো হেতি ও মইরা গেছে ১০ বছর।তাই অবিভাবক হিসেবে আপনেরেই কই। আমার মহিলাশালার একখান মাইয়া রে খুব পছন্দ হইছে। ”

রুহুল হেসে বললো, ” পছন্দ নাকি খুব পছন্দ?”

সাজু হেসে মাথা চুলকে বললো,”বিয়া করবার চাই।”
–“বেশ আমি কথা বলবো ফাতিমাআপার সাথে।”
–“কথা কইবেন খালি।আমি কিন্তু বিয়ার কথা কইছি।”

–“আমি যখন বলেছি তখন আমি ব্যাপারটা দেখবো। তবে মেয়েটার মতামত দরকার। সে রাজি হলেই বিয়ে!”

–“আসলে ভাবি মারে আনার সময় মাইডারে দেখছি। আমার খুব ভাল্লাগছে।”
–“ঠিক আছে আমি ফাতিমা আপার সাথে কথা বলে সব জেনে নেবো এবং তারপর তোকেও জানাবো।”

রুহুল যাওয়ার জন্য পা বাড়ালো। কিন্তু সাজু হাত ধরে ফেললো। মিনতির সুরে বললো, ” আমি হাত ধইরা কই মাইয়াডার লগে বিয়া দিয়া দেন। জীবনের প্রথম কাউরে ভাল্লাগছে সত্যি কইতাছি আমি ওরে ভালো রাখুম। মাইয়া রাজি না হইলেও আমি বিয়া করবার চাই।”

–“হাত ছাড় সাজু। তুই ওকে বিবাহ করতে চাস এটি উত্তম প্রস্তাব। তবে একজন মেয়ের মতামত জানা বেশি দরকার। কারণ আমি একজন কে কথা দিয়েছি মহিলাশালার মেয়েদের বিয়ের আগে মতামত নেবো।”

–“কিন্তু আমি যে..”
–“আর কোনো কথা নয় সাজু। তুই তোর কাজে যা।”

রাহুল সাজুর কথা ফাতিমাকে ঠিক ই বলবে তবে। কাকনের বলা একটি কথা কানে ভাসছে মেয়েদের বিবাহের আগে মতামত নেবেন। রুহুলের মনে সন্দেহের জগৎ তৈরি হয়ে গেছে। এত কিছুর পর ও কাকনের মন জয় করতে কি ব্যার্থ। রুহুলের ও রাগ হয়, এমন অনেক কথা জেদ থাকে যা সে কাকনের প্রতি করতে পারে না। কারণ একটাই সে কাকন কে ভালোবাসে। হ্যাঁ কাকনের প্রতি ভালোবাসা টা বিবাহ ঠিক হওয়ার পরে হয়েছে। কিন্তু মোহ সে তো অবেলায় হয়েছিল।
___________________

রাতে রুহুল আর দুলাল সিরাজী একসাথে বাড়ি ফিরলো। দুলাল সিরাজী যত তাড়াতাড়ি হয় সুভাকে হত্যা করতে চায়। পরিকল্পনা করলো কাল ই রুহুল কে ঢাকা পাঠিয়ে দেবে এবং সে নিশ্চিত এইবার আর রুহুল পৌষের আগে ফিরে আসতে পারবে না। নিজের লোক দিয়ে ঢাকায় রুহুলের জন্য কাজের পাহাড় জমিয়ে রেখেছে দুলাল সিরাজী।

রুহুল মঞ্জিলের গেইট দিয়ে ঢুকে সোজা নিজের বাড়ান্দার দিকে তাকালো। যত রাগ অভিমান ই হোক কাকন কে ছাড়া রুহুলের অচল লাগে।
দুলাল সিরাজী বললেন, ” রুহুল কাল বিকেলের ট্রেনে যাইবা নাকি সকালের? ”
রুহুল উত্তর দিলো, “সকালের।”
–“ঠিক আছে রাইতেই ব্যাগ গুছাইয়া নিও।”
–“জি দাদাজান। ”

রুহুল নিজের কক্ষে গেলো। গায়ের শার্ট টা খুলতে না খুলতেই কাকন হাজির। কাকন হাতে শরবত এনে রুহুলের সামনে ধরলো কিন্তু রুহুল নিলো না। বরং আলমারি খুলে নিজের তুলে রাখা পোশাক গুলো এক এক করে বের করে বিছানায় রাখলো। একমাত্র ঢাকায় গেলেই রুহুল পাঞ্জাবি পড়ে না। শার্টপ্যান্ট পড়ে চলে যায় আর সেগুলোই সাথে নেয়। ব্যাগে যখন পোশাক গুলো ভরলো কাকন তখন মুখ খুললো,”আপনি কি কোথাও যাবেন?”

রুহুল কোনো কথা বললো না। কাকন আবার ও জিজ্ঞেস করলো, “কি হলো বলুন না কোথায় যাবেন? ”

রুহুল আস্তে করে বললো, “ঢাকা।”
ঢাকা শব্দটা শোনা মাত্রই কাকনের হাতের গ্লাস টা নিচে পড়ে গেলো। মেঝেতে স্টিলের গ্লাস পড়ায় ঝনঝন শব্দ হলো। রুহুল গ্লাসের দিকে চেয়ে আবার নিজের কাজ করলো। কাকন কাপাকাপা কন্ঠে বললো, ” দয়া করে ঢাকা যাবেন না। আমি হাত জোর করে বলছি। আমি আর কখনো এমন আচরণ করবো না।”

রুহুল বললো,”আমি আপনার আচরণের জন্য যাচ্ছি না। ব্যবসায়িক কাজে যাচ্ছি দাদাজানের আদেশ।”

‘দাদাজানের আদেশ’ শব্দটা শুনেই কাকন বুঝলো কেন রুহুল কে পাঠানো হচ্ছে। কাকন বললো, “হোক আদেশ আপনি যাবেন না। উনি আম..”

রুহুল আর কোনো কথা শুনলো না। টেবিলের কাছের চেয়ারে ব্যাগ টি রেখে কক্ষ থেকে সোজা বেরিয়ে গেলো। কাকন রুহুলের যাওয়ার পানে চেয়ে থাকলো।আঁখিভরা পানি নিয়ে একভাবে তাকিয়ে থাকলো দরজার দিকে। মাথার ঘুণপোকারা যেন তাড়া করতে শুরু করলো কাকন কে। কাকনের মন-মস্তিষ্কের যুদ্ধে মস্তিষ্ক জিতে গেলো । প্রায় মিনিট পাঁচেক পরে কাকন বললো, “ভুল করলেন, বড় ভুল করলেন সিরাজী সাহেব। হয়তো এসে আপনার আম্মাকে পাবেন আর
না হয় আপনার বিবিজান কে। ”

চলবে….

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here