#দেবী,৪৪
লেখিকাঃ শবনম রাবাহ (স্রোতস্বিনী)
কপি করা সম্পুর্ণ নিষেধ।
শনিবার সকাল। ঢাকা কোলাহলপূর্ণ শহরে বাসে বসে আছে রুহুল। আজ কতদিন হলো তার প্রিয়তমা স্ত্রীকে দেখতে পারছে না। অভিমান হয়েছে তার প্রতি সে সত্য তবে ঢাকায় পা রাখার পর পর ই বুকে ভেতর চিন চিন ব্যাথা অনুভব হয়েছিল রুহুলের। রুহুল জানতো কাকনের ভেজা চোখ আর ব্যাকুল হৃদয় রুহুলের ছোয়া, রুহুলের কথার আশায় ছিল। হয়তো কাকন রুহুলকে ভালোবাসে না কিন্তু রুহুলের ভালবাসায় যে কাকন পাগলপ্রায়। রুহুল যদি এক পলক পিছে ফিরে তাকাতো তাহলে বোধহয় রুহুল নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারতো না। কাকনের অশ্রুসিক্ত নয়ন যে রুহুল কে কাবু করতে যথেষ্ট। যে নারীটিকে সে তার আম্মার পরে ভালোবাসে তাকে ফিরিয়ে দিতে পারতো না রুহুল। নিজেও ভাবেনি এবার ঢাকায় এতদিন থাকতে হবে। দুলাল সিরাজীর কথায় এখানে আসা টাই রুহুলের ভুল বলে মনে হচ্ছে। নিজের বুকের অসহ্য যন্ত্রণায় নিজেকেই জ্বলতে হচ্ছে তার।
তবে একটা জিনিস খুব ভাবায় রুহুলকে কাকন কি রুহুলকে মনে করে নাকি মনে করে না। বোধহয় মনে করে না। কারণ এখন রুহুলের মনে হয় কাকন রুহুলকে ভালোই বাসেনি কোনো দিন। তাইতো এমন করে। রুহুল বাসের জানালা খুলে সিটে মাথা এলিয়ে দিয়ে চোখ বুজে রাখলো। মনে মনে আওড়ালো,
“ভালোবাসা এত কষ্টের,বেদনাদায়ক আগে জানলে আমি কোনোদিন এত ভালোবাসতাম না। আর যারা জানে ভালোবাসা কতটা যন্ত্রণাদায়ক তারা বোধহয় দ্বিতীয়বার কাউকে ভালোবাসতে পারে না।”
রুহুল দু’বার প্রেমে পড়েছে। দু’বার ই কাকনের প্রেমেই পড়েছে। কাকন কি আদোও কখনো জানতে পারবে। বোধহয় পারবে আবার বোধহয় না। কাকন সেদিন জানতে পারবে যেদিন সে রুহুলকে ভালোবাসবে।রুহুল ভাবলো প্রথম রাতের কথাও কি কাকন ভুলে গেছে। রুহুল যে কাকনকে আবার সেই রক্তজবার রুপে দেখতে চায়। এজন্মে কি রুহুল কাকনকে সেই ভয়ংকর তেজস্বী রুপে দেখতে পারবে নাকি পারবে না।
বাসের ধাক্কায় রুহুল চোখ খুলে ফেললো। নির্দিষ্ট জায়গায় এসে গেছে। নামতে হবে এখন রুহুলের। রুহুল ব্যাগ বাক্স নিয়ে নেমে পড়লো বাস থেকে। আজ বিদেশি ক্রেতাদের সাথে বৈঠক আছে রুহুলের। সেখানেই যেতে হবে। কাজ হলেই বাঁচে রুহুল। না জানি কবে সিরাজপুরে যেতে পারবে রুহুল।
_________________________
বিকেলে কাকন চিন্তার জগত নিয়ে ব্যস্ত। পরশু বিলালের কক্ষ থেকে যে জিনিসটা নিয়েছে কাকন তা নিয়েই নিজের কক্ষে বসে আছে। দুনিয়ার কোনো কিছুর চিন্তা নেই মস্তিষ্ক জুড়ে আছে কেবল রুহুলের ভাবনা। সব সত্যি জানার পর রুহুল যদি ভুল বোঝে তখন কি হবে। আচ্ছা রুহুল কি তখন ও কাকনকে আগের মতো ভালোবাসবে নাকি ঘৃণা করবে। কাকন দুহাতে মাথা চেপে ধরলো। হাটুতে মুখ বুজে কাদতে শুরু করলো। রুহুলের তিরস্কার, রুহুলের ঘৃণা কি করে সহ্য করবে কাকন। বিবাহের আগে কাকনের আল্লাহর কাছে একটাই চাওয়া ছিল বিবাহের পর যেন সে রুহুলের সাথে ভালবাসায় না জড়িয়ে যায়। জীবনে প্রথম রুহুলকে শুভ্ররঙা পাঞ্জাবিতে দেখেই কাকন চমকে উঠেছিল।তারপর মহিলাশালায় রুহুলের বেহায়ার মতো তাকিয়ে থাকা দেখে কাকন মনে মনে শ’খানেক গালিও দিয়েছিল। মনে মনে ভেবেছিল এটা আদোও সিরাজী বংশের বড় সন্তান তো। তবে রুহুলের সেই হৃদয়হরণীর অপবাদ টা কাকনের মনে ভয়ংকর ঝড় তুলে দিয়েছিল। না চাইতেও ভালো লাগা শুরু হয়েছিল কাকনের। বাসর রাত থেকে শুরু করে প্রতিটি রাতে কাকন স্বামীহিসেবে শ্রেষ্ঠ মানুষকে কে আবিষ্কার করেছে। স্বামীরুপে একজন বন্ধু,একজন সহযোগী, এক খোলা বইকে আবিষ্কার করেছে। এই সিরাজপুর, এই সিরাজপুরের মানুষ, এই সিরাজী মঞ্জিলের প্রত্যেকে সদস্যকে ঘৃণা করলেও রুহুলকে ঘৃণা করার শক্তি,ক্ষমতা নেই কাকনের। করবে কি করে সে তো ভালোবাসে রুহুলকে। ভালোবাসার মানুষকে এক আঘাত করলে তার চেয়েও হাজারগুণ কষ্ট যে নিজে অনুভব করবে কাকন।
কাকনের দরজায় কড়াঘাতের শব্দে কাকন চোখ মুছে উঠে দাড়ালো। আয়নার সামনে দাড়িয়ে আবারও চোখ মুছলো। আয়নায় হাসার অভিনয় করলো যখন নিজের মনে হলো হ্যাঁ তাকে এখন স্বাভাবিক লাগছে তখন দরজার দিকে এগিয়ে গেলো। টেবিলে রাখা জগ থেকে এক গ্লাস পানি পান করে গলা ভিজিয়ে নিলো। তারপর মৃদু হেসে দরজা খুলে দিলো। দরজার বাইরে দাঁড়িয়ে আছে রানু। রানু বললো, “ভাবিজান দাদিআম্মায় ডাকে আপনেরে।”
কাকন বললো, “আসছি আমি তুমি যাও।”
–“আইচ্ছা।”
রানু চলে গেলে কাকন ঢোক গিলে কক্ষ থেকে বেরিয়ে এলো। নিচে নেমে দাদিমার কাছে গেলো। দেখলো একজন মহিলা নিচে বসে আছে। আর সুভাসহ সকলেই আরাম কেদারায় বসে আছে। হরেক রকমের শাড়ি আর শাল নিয়ে এসেছে। কাকন কে দেখে দাদিমা বললো, ” নাতবউ এইদিকে আয়। তুই এই শালডা নে। আমার খুব পছন্দ হইছে। আর এই লাল-খয়েরি শাড়িডাও তুই রাখ। তোর প্রিয় রঙ তো লাল তাই না। ধর এইগুলা তুই মাহফিলের দিন পড়বি। ”
কাকন চুপচাপ হাতে নিলো। এগুলোর প্রতি বিন্দুমাত্র আগ্রহ নেই। বললো, “দাদিমা আমি রেখে আসি। ”
–“হ্যাঁ যা রাইখা আয়।”
কাকন চলে যাচ্ছিল কানে আসলো দুলাল আর জামালের কথা। ওরা বলাবলি করছে, “অনেক বড় বড় হুজুর, মাওলানা আসবো। সব কিছু ঠিক হওয়া চাই।”
ওদের দেখেই কাকনের মনে হলো আজ শনিবার। কাকন জোরে জোরে শ্বাস নিয়ে কক্ষে চলে গেলো। হাতের দিকে চেয়ে দেখলো একটি লাল-খয়েরী রঙের শাড়ি। আর তার সাথে সোনালি রঙের শাল। এত দামি পোশাক, ভালো আহার সবই তো পাচ্ছে এই মঞ্জিলে তবে আজকের পর বোধহয় কেউ আর এত আদর, এত স্নেহ, এসম্মান করবে না। সত্যিটা জানার পর কি আদোও কেউ কাকন কে এত ভালোবাসবে। উহু মৃত্যুর মুখে ফেলে দেবে কাকন কে। আর সেই সাথে সিরাজপুরের মানুষ যারা সিরাজী মঞ্জিলের মানুষ বিশেষ করে দুলাল সিরাজীকে তারা ফেরেস্তা মনে করে সেই ফেরেস্তার জন্য কাকনকে জ্যান্ত পুতে ফেলতে দ্বিতীয়বার ভাববে না। কাকন নিজ কক্ষে চলে গেলো। কাকন শাল আর শাড়িটি হাতে নিয়ে কাঠের আলমারি খুললো। তারপর আলগোছে আলমারিতে রেখে দিলো।
_________________
সিরাজী মঞ্জিলের প্রতিটি সদস্য রাতে খাওয়ার কিছুক্ষণ পর দুধ খায়। আর এই দায়িত্বটি থাকে মালেকার। কাকন তার পরিকল্পনা মতো সেচ্ছায় রন্ধনশালায় গেলো।গিয়ে মালেকার উদ্দেশ্যে বললো, “ছোট আম্মা আমায় দিন আজ আমি দুধ গরম করবো।”
–“না কাকন তোমার করা লাগবো না। আমি ই তো রোজই করি। আমার অসুবিধা হইবো না। ”
–“দিন না আমি তো কিছুই করি না। শুধু আজকেই আজকেই করবো। আজকের পর আর কোনো আবদার করবো না আপনার কাছে ছোট আম্মা।”
মালেকা বললো,”এইভাবে কইতাছো কেন কাকন? ”
–“না এমনি। আজকে একটু শখ হলো তো তাই। ”
–“ঠিক আছে তাইলে তুমি গরম কইরা সকলের গ্লাসে ঢাইলা দেও। আমি নিয়া যাইয়া দিয়া আসমু নি।”
মালেকা রন্ধনশালা থেকে বেরিয়ে গেলো। কাকন রন্ধনশালার দরজার কাছে উঁকি দিয়ে দেখলো কেউ আছে কি না। না কেউ নেই। কাকন আচলের গিট খুললো। কাকন পরশু রাতে বিলালের কক্ষের টেবিলে ইঁদুরসহ পোকা মাকড়ের উপদ্রব কমানোর গাছের শিকড় দেখেছিল। নারকেলের শুকনো খোশার সাথে এটা ঘরের জানালার কাছে জ্বালিয়ে দিলে পশু-পাখি, পোকামাকড় আসে না। আর আশ্চর্য করা বিষয় হলো কোনো মানুষ খেলে সে দুর্বল হয়ে পড়বে। শরীরে শক্তি পাবে না আর বেশি মাত্রায় খেলে মৃত্যুও হতে পারে। পরশু এটা দেখেছিল যা দেখেই কাকনেরর মস্তিষ্ক সচল হয়ে গিয়েছিল। এটা দিয়েই কাকন তার কাজ পরিপূর্ণ করবে। জামাল আর দুলাল সিরাজীর গ্লাসেই মেশালো কাকন। আর কাউকে দেবে না কারণ কাকন পিছন থেকে নয় সম্মুখে শাস্তি দেবে অপরাধীদের।
কাকন জামাল আর দুলাল সিরাজীর টা নিজে নিয়ে গেলো বসার ঘরে। অন্যদিকে মালেকা নিজেও খুশি হলো আর বাকিদের কেও দিয়ে দিলো। দুলাল আর জামাল যখন পান করল কাকন তখন তৃপ্তির নিশ্বাস ফেললো। কারণ এটি খাওয়া মাত্রই শরীর দুর্বল হয়ে পরবে তারা কক্ষে যেতে পারবে না অন্যদিকে বাড়ির সদস্যরা মনে করবে তারা মাহফিল নিয়ে হয়তো আলোচনা করছে। কেউ টের ও পাবে না তাদের দুর্বলতার কথা। তাই বসার ঘরেই রাত কাটাতে হবে জামাল আর দুলাল সিরাজী কে।
______________________
রাত বাড়ছে বাইরের আবহাওয়া ভালো না। ঝড় হওয়ার আগে যেমন প্রকৃতিতে সুন্দর বাতাস বয় ঠিক তেমনই হচ্ছে। বাতাসের গতি যেন অনেক আজ। জানালার দরজা বার বার আওয়াজ করছে, সাদা পর্দা গুলো উড়ছে। কাকন হারিকেন হাতে নিয়ে জানালা আটকাতে যেয়ে চোখ পড়লো বাগানের গোলাপ ফুল গাছের দিকে। রুহুল বলেছিল গোলাপ ফুল ভালোবাসার প্রতীক। কাকনের মনে প্রশ্ন জাগলো তাহলে ঘৃণার প্রতীক কি হতে পারে?
কাকন নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করলো। আর ভাবলে চলবে না তাকে। হৃদয়ের সকল ভাবনা ভুলে মস্তিষ্ক কেই বেছে নিলো কাকন। তারপর কাঠের আলমারী খুলে একটা শাড়ি বের করলো। শাড়িটির নিচেই চোখে পড়লো ছোট একটি বাক্স। কাকন হাতে নিতেই পরক্ষণে মনে পড়লো বাসর রাতের কথা। হ্যাঁ এটাতো রুহুল দিয়েছিল কাকন কে বাসররাতের উপহার হিসেবে। রুহুল বলেছিল যেদিন কাকন রুহুলকে ভালোবাসবে সেদিন যেন কাকন খোলে। কাকন বাক্সটা খুলতে চাইলো কিন্তু দেওয়াল ঘড়ির দিকে চেয়ে আর খুললো না। বাক্সটা রেখে দিল আবারো। হাতের শাড়িটির দিকে মনোযোগ দিলো। শাড়িটি সুন্দর করে গোছানো। বাইরে থেকে দেখে বোঝা দায় যে ভিতরে কিছু আছে। সেই শাড়িটির ভেতরে কাপড়ে মুড়িয়ে রাখা একটা লোহার ভাড়ি বস্তু। কাকন তা বের করলো। আজ প্রথম বারের মতো কাকনের হাত কাপছে। পরিনতি কতটা ভয়ংকর হবে জানা নেই। কাকন তাদের যুগল ছবিটির দিকে তাকালো। রুহুলের হাসিমুখের দিকে চেয়ে বললো, “আমার ভালোবাসা উপলব্ধি করা ব্যতীত দুনিয়ার সকল কাজে সার্থক আপনি। আর ব্যার্থ আমি যে আপনার ভালবাসার উপসংহারে আমি থাকবো না।”
কাকন কক্ষ ত্যাগ করে সিড়ি দিয়ে নিচে নামছে। প্রতিটা পদক্ষেপ যেন বলছিল আরেক ধাপ করে এগিয়ে যাচ্ছে কাকন নিজের লক্ষে। কাকন সর্বপ্রথম সুভার কক্ষে গেলো। প্রহরী দরজার কাছে বসে ঝিমুচ্ছে।কাকন আস্তে করে দরজা খুললো কারণ দরজা ভেতর থেকে লাগানো থাকে না।কাকন ধীরে ধীরে এগিয়ে গেলো বিলালের কাছে। আজ কাকন বিলালকে রাতে ঘুমের ওষুধ দেয় নি। কাকন বিলালের চোখের পানি মুছলো।কানের কাছে মুখ নিয়ে কিছু একটা বললো। কারণ আজকের পর আর বিলাল চোখের পানি ফেলবে না। বিলালের সব কষ্ট কাকন আজ শেষ করে দেবে।
সেখানে থেকেই কাকন বসার ঘরে গেলো যেখানে চোখ বুজে বসে জামাল আর দুলাল। কাকন বসার ঘরের দরজা ভেতর থেকে লাগিয়ে দিল। ওদেরকে হুশ থাকতে মৃত্যু যন্ত্রণা দিতে চায় কাকন। শিকড় মেশানোর ফলে দুর্বলতা ঘিরে ধরেছে তাদের। আজ রাত আর কক্ষে যায়নি। ঘুমন্ত অবস্থায় খুন করলে কাকনের তৃষ্ণার্ত হৃদয় যে শান্তি পাবে না। তারা পরিপুর্ণ ভাবে ঘুমায় নি কাকন জানে ওরা হুশে আছে। তাই খুব সাবধানতার সাথে কাকন এগিয়ে গেলো ওদের নিকট। আচলের নিচে থেকে বস্তুটি বের করলো ।বস্তুটি হলো হাতুড়ি একপাশে গোলাকার প্রকৃতির আরেক পাশে ধারালো যা দিয়ে খুব সহজেই ইট বা দেওয়াল ভাঙা হয়। এটা দিয়ে যদি কোথাও আঘাত করা হয় আদোও কি তা ঠিক থাকবে বোধহয় না। কারণ চূর্ণবিচূর্ণ হয়ে যাবে মুহুর্তেই।
কাকন তীব্র ঘৃণায় নিজের সর্বশক্তি প্রয়োগ করে হাতে থাকা হাতুড়ি টি দিয়ে দুলাল সিরাজীর মাথার পিছনে আঘাত করলো।
দুলাল সিরাজী ঘর কাপানো চিৎকার করে উঠলো।দুলাল সিরাজীর আওয়াজে চোখ খুলে তাকালো জামাল। জামাল চোখ খুলে দ্রুত দাড়িয়ে গেলো। তবে জামাল ঠিক ভাবে দাড়াতে পারছে না। শরীর ঢুলছে আর সেই সাথে মাথা ও ঘুরোচ্ছে। দুলাল সিরাজী মুহুর্তেই রক্তে ডুব দিয়ে উঠলো।
এরপর কাকন তেড়ে এসে জামালের মাথায় একটা বারি দিলো। রক্তাক্ত মাথা নিয়ে মেঝেতে বসে পড়লো জামাল। বাপ-বেটা মিলে মাথার যন্ত্রণায় ছটফট করছে। ‘আল্লাহ আল্লাহ’ বলে বাচাও বাচাও করছে। তাদের চিৎকারে সকলের কাচা ঘুম উবে গেলো।সকলে ছুটে এলো বসার ঘরের দিকে। প্রহরী, কাজের লোক সহ সকলেই দরজা ধাক্কাছে কিন্তু খুলতে ব্যার্থ হচ্ছে। পুরোনো জামানার দরজা সহজে ভাঙার নয়।
পাঁচ মিনিট অতিক্রম হয়েছে। কাকন দুলাল সিরাজীর মাথায় অনবরত আঘাত করতেই থাকলো আর সেই সাথে জামাল সিরাজী কেও। ধারালো লোহার হাতুড়ির আঘাতে মাথার অবস্থা ভয়াবহ। জামালকে হ’ত্যা করার পর কাকন থেমে গেলো কিন্তু দুলাল সিরাজীকে থামানোর নাম নেই। কাকন অনবরত হিংস্র বাঘিনীর মতো মাথায় আঘাত করতেই থাকলো। দুলাল সিরাজীর যে মৃত্যু হয়ে গেছে কাকনের যেন হুশ নেই। কাকন থামছে না, বার বার মাথায় বারি মা’রছে আর পাগলের মতো হাসছে।
কাকন দুহাত দিয়ে আবারও হাতুড়ি উঁচু করলো কিন্তু মারতে পারলো না তার হাত থেকে হাতুড়ি পড়ে গেলো নিমিষেই ।দরজার কাছে দাড়িয়ে আছে স্বয়ং রুহুল।
___________________
রুহুল কে দেখে কাকনের মনে বিন্দু মাত্র কষ্ট হচ্ছে না। বরং কাকনের ভালোবাসা যে আজ ঘৃণায় রুপান্তরিত হয়েছে। মনে পড়ছে দুলাল আর জামালের বলা শেষ কথাটা। মঞ্জিলের সকলেই বসারঘরে ঢুকলো। সকলেই স্তব্ধ হয়ে গেছে এ তারা কাকে দেখছে স্বয়ং কাকন। কাকন কি করে দুলাল সিরাজী কে হত্যা করতে পারলো। বাড়ির কাজের লোক, প্রহরীরা সকলেই হতভম্ব হয়ে দাঁড়িয়ে আছে তবে কেউই যেন এগোতে পারছে না লাশের দিকে। দুজনের মাথা থেকে লাল রক্ত টগবগ করে বেরোচ্ছে। মাথার অবস্থা এতটা নৃশংস যে কেউ দেখলে আত্মা কেপে উঠবে। কান, নাক, মুখ, মাথা দিয়ে অনবরত রক্ত বের হচ্ছে। কাকনের পড়নে আসমানি রঙা শাড়িটিও এখন রক্তে রাঙা। চোখ মুখ, চুল, সর্বাঙ্গে অজস্র রক্তের ফোটা। কাকন পলকহীন ভাবে রুহুলের দিকে চেয়ে আছে।
দাদিমা চিৎকার করে নিজের স্বামী পুত্রের দিকে এগিয়ে গেলো। সিরাজী মঞ্জিলে চতুর্থ বারের মতো মরা কান্নার রোল পড়ে গেলো। ভয়ে লাশ গুলো স্পর্শ করতে পারছে না কেউ। জামালের স্ত্রী স্বামীর পা ধরে কাদছে। শেষ সময় টুকু স্বামীর ভালোবাসা নিয়ে কাটানোর সৌভাগ্য টুকু তার হলো না। মালেকা আশ্চর্য তবে তার মাথায় অন্য কিছু চলছে কাকন কি জন্য এই কাজ করলো।
রুহুল ঠিক আগের মতোই পলকহীন ভাবে কাকনের দিকে চেয়ে আছে। তার নিষ্পাপ, পবিত্র বিবিজান কি করে তার চাচাজান, দাদাজানকে হত্যা করতে পারলো। বর্তমানে তারা আর যাই হোক কাকনের তো কোনো ক্ষতি করতো না রুহুল নিশ্চিত ছিল। তবে কেন কাকন এমনটা করলো। জামাল, দুলাল দুজনেই তো নিজেদের শুধরে নিয়েছিল তবে কেন কাকন এমন করলো।
সুভা এগিয়ে কাকনের কাছে গেলো। কাকনকে প্রথম দেখায় নিজের মেয়ে হিসেবে গ্রহণ করেছিল। সেই মেয়ে কি করে এইকাজ করলো আর কেনই বা করলো সুভা ভেবে পাচ্ছে না। সকলে থমকে গেছে যেন। সুভা এগিয়ে যেয়ে কাকন কে বললো,”কাকন, এই কাকন তুমি এটা কি করলে। ওনাদের হত্যা করলে কেন করলে বলো। কথা বলছো না কেন? ”
দাদিমা নানা অশ্রাব্য গালিগালাজ করছে কাকন কে। নানা অভিশাপ দিচ্ছে। কাকন কে নিজের লাঠি দ্বারা কয়েকটি বারি ও দিলো। কিন্তু কাকন জড় পাথরের মতো চুপ করে থাকলো। যেন ব্যাথা ওকে স্পর্শ ও করতে পারছে না। জামালের স্ত্রীসহ সকলেই কাদছে।
কাকনের কোনো হুশ নেই। কারণ কাকনের কানে দুলাল সিরাজীর বলা শেষ কথাটি বার বার যেন প্রতিধ্বনিত হচ্ছে । কি করে হতে পারে এমন টা। তবে কি কাকন ভুল জেনে এসেছে আজ অব্দি।
সুভা আবারো কাদতে কাদতে কাকনের হাত ধরলো।হাত ঝাকিয়ে আবারো জিজ্ঞেস করলো, ” কাকন, উত্তর দিচ্ছো না কেন? ওনাদের কেন হত্যা করলে বলো কাকন? ওনারা তোমার কী ক্ষতি করেছিল? চুপ করে থেকো না উত্তর দাও কাকন? ”
কাকন তীব্র ক্রোধে সুভাকে ধাক্কা দিয়ে সড়িয়ে দিলো।উচ্চস্বরে বললো, “আমি কাকন নই, আমি কাকন নই। আমার নাম দেবীশ্বরী ঠাকুর। আমার নাম ‘দেবী’।”
চলবে……