#দেবী,৪৭
লেখিকাঃ শবনম রাবাহ (স্রোতস্বিনী)
কপি করা সম্পুর্ন নিষেধ।
পরেরদিন সকালে দেবী ঠাকুমার ঘরে গেলো ওষুধ খাইয়ে দিতে।ডাকলো,
— ঠাম্মা,ও ঠাম্মা, তুমি কি ঘুমিয়ে আছো?”
কিন্তু কোনো উত্তর পেলো না। দেবী আবারও ডাকলো।
–“কি হলো কথা বলছো না কেন?”
দেবী এগিয়ে গেলো ঠাকুমার কাছে। কিন্তু যেয়ে দেখলো জ্ঞান নেই। দেবী চিৎকার করে ডাকলো, “মা,,বাবা!
কই গো তোমরা? দেখো ঠাম্মা কথা বলছে না। ”
দেবাশীষ আর মালতী দৌড়ে এলো। এসে দেখলো জ্ঞান হীন পড়ে আছে তার মা। তারা এভাবে দেখে থমকে গেলো। মালতী বললো,” আপনি তাড়াতাড়ি ডাক্তার নিয়ে আসুন।”
–“হ্যাঁ, হ্যাঁ আমি এক্ষুনি আসছি।”
কিছুক্ষণ পর পাড়ার ডাক্তার নিয়ে এলেন দেবাশীষ ঠাকুর। তিনি চোখ, মুখ, নাড়ি দেখে বললেন,
–“আপনার মায়ের অবস্থা ভালো না ঠাকুরবাবু। ওনার সময় ঘনিয়ে এসেছে।”
নিস্তব্ধ হয়ে গেলো তিনটি প্রাণ। তাদের সুখের সংসারে অশুভ ছায়ার আভির্ভাব হলো নাকি। কিছুক্ষণ পর চলে গেলেন ডাক্তার। দেবাশীষ ডাক্তারকে এগিয়ে দিয়ে আবার মায়ের কাছে আসলো।
দেবী তার মাকে জড়িয়ে ধরে কেদে দিলো। মালতী ও কাদছে। কিছুক্ষণ পর জ্ঞান ফিরলো। ঠাম্মা বলছে,
–“আমার সুভাষিরে আইনা দে,,সুভাষি, সুভাষি।”
মায়ের কথা শুনে দেবাশীষ জানালার কাছে মুখ করে দাড়ালেন। প্রচন্ড দমবন্ধকর জ্বালাপোড়া হচ্ছে বুকে। এক দিকে বোনের জন্য বেদনা অন্যদিকে মায়ের আর্তনাদ। দেবী মনে মনে পণ করলো যে করেই হোক এখন তার ঠাম্মার শেষ ইচ্ছে পুরণ করবেই সে। তার এখন একটাই কাজ তার বাবাকে রাজি করানো। সে জানে তার বাবা তার কথা কখনো ফেলবে না।
দাড়িয়ে ছিল দেবাশীষ । পিছন থেকে যেয়ে হাত জড়িয়ে ধরলো দেবী।
–“আজ হঠাৎ এভাবে হাত ধরলি দেবীমা ?”
— “বাবা আমার একটা জিনিস চাই কথা দাও দেবে।তুমি কিন্তু না করতে পারবে না।”
— “বল দেবীমা কি চাস তুই?”
–“তুমি পিশিমাকে ঠাম্মার কাছে এনে দাও না বাবা।”
–“অসম্ভব। আমি ওর মুখ ও দেখতে চাই না। তার চেয়ে বড় কথা আমি চাই না ওর ওই অশুভ ছায়া আবার আমাদের জীবনে পড়ুক। তুই ওর নাম ও মুখে আনবি না। নিশ্চিত মা তোকে বলেছে ওর কথা তাই না। ”
–“বাবা তুমি কথা দিয়েছ আমি যা চাইবো তাই দেবে। ঠাম্মার শেষ ইচ্ছেটা পুরন করো না বাবা। হতে পারে ঠাম্মা সুস্থ হয়ে উঠলো। আর ঠাকুর না করুক ঠাম্মা যদি বেচে না থাকে তোমার সারাজীবন আফসোস থেকে যাবে তুমি ঠাম্মার শেষ ইচ্ছেটা পুরণ করতে পারো নি। ”
মালতীও বললেন,” হ্যাঁ দেবীর বাবা আপনি একটা বার সব অভিমান ভেঙে যান না সুভাষির কাছে। ও হয়তো নিজের অপরাধ বোধের জন্য আসেনি কিন্তু আপনি আর রাগ করে থাকবেন না। দয়া করে মার শেষ ইচ্ছে টা পুরণ করুন।”
দেবাশীষ বেশ কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকলো মায়ের মুখপানে। দেবীর মাথায় হাত রেখে বললো, “বেশ আমি কাল ই যাবো সিরাজপুরে। নিয়ে আসবো সুভাষিকে।”
_____________________
পরের দিন সকালের খাওয়া শেষে সিরাজপুরের উদ্দেশ্যে তৈরি হলেন দেবাশীষ ঠাকুর । মায়ের কক্ষে প্রবেশ করে মাকে প্রণাম করে উঠোনে আসলেন। তার পর রওনা দেওয়ার উদ্দেগ নিলেন,
দেবী বাবাকে বললো,” বাবা মন ভার করে থাকবে না কিন্তু। আমার বিশ্বাস পিশিমা তোমাকে পেয়ে ভিষণ খুশি হবে। আর ঠাম্মা যখন তোমার সাথে পিশিমা কে দেখবে সত্যিই অবাক হবে সাথে খুশিও হবে দেখে নিও।আমাদের পরিবার আবার আগের মতো সুখী হবে। আমরা আবার সবাই মিলে হাসবো।”
দেবাশীষ মৃদু হেসে বললো,” আমার দেবীমা যখন বলেছে তখন সেটাই হবে। আমি চললাম দেবীমা।মালতী আমি আসছি।”
তারপর মেয়েকে বুকে নিয়ে মাথায় হাত বুলিয়ে দিলো।আবারো বললো,”এই প্রথম তোকে ছেড়ে কোথাও যাচ্ছি। কেনো যেনো বুকের ভিতর কেমন করছে। নিজের খেয়াল রাখিস দেবীমা। তোর মা আর ঠাম্মার দায়িত্ব কিন্তু তোর উপর দিয়ে গেলাম।”
–“তুমি একদম চিন্তা করো না বাবা। তোমায় কথা দিলাম আমি মা-ঠাম্মা দুজন কেই দেখে রাখবো। আর সাবধানে যেও তুমি। আমি কিন্তু তোমাদের জন্য অপেক্ষা করবো। ”
মেয়ের কপালে চুমো দিয়ে বিদায় নিলেন দেবাশীষ ঠাকুর।
______________
কিন্তু তিনদিন হয়ে যায় দেবাশীষ এর কোনো খোজ নেই। বাবার অনুপস্থিতিতে দেবী তার মা এবং ঠাম্মার দুজনের ই খেয়াল রাখছে। মাকে ও তেমন কাজ করতে দেয় না। তবে তার মন কু ডাকছে। মালতী ও দেবী দুজনেই অপেক্ষার প্রহর গুনতে থাকে। ৪র্থ দিবসে সকালে মালতী স্বামীর জন্য মানত করে পুজো দিয়ে প্রসাদ দিতে শাশুরির কক্ষে যায়। যেয়ে যা দেখে তার জন্য মোটেও প্রস্তুত ছিল না।
মালতী ডাকে,” মা,, উঠুন প্রসাদ টুকু খেয়ে নিন।” আবারো ডাকে, “মা ওমা,,কি হলো।” শাশুড়ির হাত ধরে যখন তুলতে যাবে ঠিক তখনি মালতী কথা বলার শক্তি যেন সেকেন্ডে হারিয়ে ফেলে। তার শাশুড়ি মা যে আর নেই। চিৎকার দেয় মালতী, “দেবী!”
দেবী রান্না ঘরে লুচি বানাচ্ছিল। মায়ের ডাকে ঠাম্মার ঘরে এসে ঠাম্মার মৃতদেহ দেখে হতভাগ হয়ে যায় সে। ঠাম্মাকে জড়িয়ে চিৎকার করে কেদে দেয় সে। সে যে আর দিদিভাই ডাক কোনোদিনো শুনতে পাবে না।
বাবার জন্য রাত অব্দি অপেক্ষা করে তারা। কিন্তু আজ ও তার বাবা আসে না। কিন্তু মৃতদেহ রাখা যাবে না বিধায় আত্মীয় স্বজনরা মিলে দেবীর ঠাম্মার দেহ পুড়িয়ে দেয়। দূর থেকে পাথরের মতো সব দেখছিল দেবী। তার মনে একটাই কষ্ট হয় সে তার বাবাকে দেওয়া কথা রাখতে পারলো না। নিজের ঠাম্মার খেয়াল রাখতে পারলো না। বাবা আসলে কি উত্তর দেবে সে?
একদিকে বাবার চিন্তা অন্যদিকে ঠাম্মার পরলোকগমন দেবী কে সম্পুর্ন ভেঙে দিয়েছিল। পার হয় আরও সাতদিন। তাদের হাসিখুশি পরিবার টায় যেন কেউ বিষ ঢেলে দিয়েছিল। সাতদিন পর দেবী সিদ্ধান্ত নেয় সে সিরাজপুরে যাবে। সে তার মাকে জানায়। তার মা প্রথমে আপত্তি করলেও শেষে মেয়ের জেদে রাজি হয়। আসার সময় রঞ্জিত করুণ চোখে তাকিয়ে থাকে দেবীর পানে। দেবী সে চোখের ভাষা বুঝে নি তবে মায়া হয়েছিল। প্রথমবারের মতো এক অন্যরকম আবেগ কাজ করছিল দেবীর মনে।
তারপর সেই দিন আসে যেদিন তারা প্রথম সিরাজপুরের মাটিতে পা রাখে। ট্রেন থেকে নেমে সবার আগে চোখে পড়ে একটা লেখা,” বিধর্মীদের জন্য সিরাজপুর নয়। এদেশ আল্লাহর,এ দেশ রাসুলের।”
এ সহ আরো অনেক আরবি লেখা থাকে কিন্তু দেবী পড়তে অক্ষম ছিল। গরুর গাড়িতে উঠার আগে জানায় বিলাল সিরাজীর বাড়ি যাবে। তবে সেই লোক জানায় আগে মুখ ঢাকতে হবে বোরকা পরিধান করতে হবে তারপর উঠতে দেবে। কিন্তু হিন্দু হওয়া তে তারা বোরকা নিয়ে আসে নি। তাই গায়ের পোশাক দিয়েই নিজেদের ঢেকে নিতে হয়েছিল।কেবল চোখজোড়া দেখা যাচ্ছিলো। গরুর গাড়ির ভিতরে বসে ছিল দেবী। তার ভিতরে চিন্তার ঝড় বয়ে যাচ্ছে। তবুও সে নিরব থাকে। ছাউনি থেকে প্রথম উকি দিয়ে সে দেখে বকুলতলার সেই বকুল গাছ টি।সেখানেই তারা নামে। আশেপাশের লোকজন আড়চোখে দেখা শুরু করে তাদের। অপরুপা সুন্দরী দুই নারীকে দেখে অনেকেই কুনজরে তাকাচ্ছিল। আর সেই সাথে বোরকাহীন নারীও সিরাজপুরের রাস্তায় প্রথম দেখছিল। দেবী কে তার মা মাথায় আরো ভালো ভাবে ঘোমটা দিয়ে দেয় ওড়না দিয়ে। তারপর মেয়েকে নিজের সাথে আকড়ে রাখে। দেবী না বুঝলেও মালতী সেইসব চোখের ভাষা ঠিক ই বুঝেছিল।
অবশেষে তারা পৌছায় সিরাজী মঞ্জিলের সামনে।
সিরাজি মঞ্জিলের বাইরে দাঁড়িয়ে থাকে মা মেয়ে। মালতী মুখের কাপড় সড়ালে হিন্দু বেশে দেখে অবাক হয় প্রহরীরা। বলে, “সিরাজপুরে হিন্দু মানুষ,,কই থিকা আইছেন? ”
মালতী বললো,” জি এটা কি বিলাল সিরাজীর বাড়ি। আমরা ওনার স্ত্রী সুভাষিণীর বাড়ির লোক।”
প্রহরী বলে,” কিহ ঠাট্টা করতাছেন নাকি। বড় আম্মার বাড়ির লোক। তাও আবার হিন্দু। দূর হন কইতাছি।”
দেবী মায়ের পিছন থেকে বলে,”শুনুন না দাদা,,মা সত্যিই বলছে আমাদের একটা বার যেতে দিন না।”
প্রহরী মালতীকে বলে,” ঘোমটার তলে এই মাইয়া কিডায়?”
–“আমার মেয়ে। হাত জোর করছি দাদা শুধু একটা বার যেতে দিন। অথবা সুভাষীনি কে বলুন মালতী বৌদি এসেছে। দেখবেন ও ঠিক ই আসবে।”
–” মাথা খারাপ হইছে নি। যান দূর হন এইখান থিকা। সিরাজী আব্বা জানলে চাকরি থাকবো না। ঘাড় ধাক্কা দিবার চাইতাছি না। আপনেগো ছোয়া ও পাপ।”
এমন কথায় নিরুপায় হয়ে দেবী তার মাকে নিয়ে খানিকটা দূরে দাঁড়িয়ে থাকে। কিছুক্ষণ পর সেখানেই সে প্রথম দেখে রুহুল সিরাজীকে। জিপ গাড়িতে আসছিল। পড়নে শুভ্ররঙা পাঞ্জাবিতে দেখে। রুহুল যখন গাড়ি থেকে নামে রুহুলকে দেখে অবাক হয় দেবী। কেননা রুহুলের চোখ দুটো অবিকল তার বাবা দেবাশীষ ঠাকুরের মতো ।দেবী অবাক হয়ে চেয়েছিল রুহুলের পানে। প্রহরীর মুখে প্রথম শুনেছিল সেই হৃদয় প্রলয়ঙ্কারীর নাম, “আসসালামু আলাইকুম, রুহুল সিরাজী সাব !”
_____________________
দিন পেরিয়ে রাত হয় তারা অপেক্ষা করতে থাকে শুধুমাত্র একবার দেখা করার আশায়। আবারও প্রহরীর কাছে যায় দেবী। আবারও ফিরিয়ে দেওয়া হয়। তার মনে সন্দেহ হয় তার পিশিমা আদোও এখানে থাকে কি না। আর তার বাবা যদি এখানে এসে থাকে তাহলে হয়তো তার বাবা কেও ঢুকতে দেওয়া হয় নি।
দেবী অবাক হয়ে মাকে বলে, “মা একটা জিনিস ভেবে দেখেছো আমরা হিন্দু বলে আমাদের প্রবেশ করতে দিলেন না। বাবা যদি এখানে এসে থাকে তবে বাবা কেও হয়তো দেয়নি। তার চেয়ে বরং আমরা আশে পাশে খোজ করি যে বাবাকে কেউ দেখেছিল কি না।”
–“তুই ঠিক বলেছিস দেবী। আমার মন কু ডাকছে
তোর বাবার কোনো বেপদ হলো না তো।”
–“না মা কিচ্ছু হয়নি। তুমি আসো আমার সাথে।”
মা আর মেয়ে অনেক খানি পথ পাড় করলো। ঘোমটা দিয়ে হাটতে কষ্ট হচ্ছিল দেবীর। তবুও মা মেয়ে হাটলো। কিছু পথ যাওয়ার পর মালতী চা’য়ের দোকান দেখতে পেলো।এগিয়ে যেয়ে বললো, ” দাদা শুনছেন।বলছিলেম যে আপনারা কেউ আমার স্বামীকে দেখেছেন লম্বা চশমা পড়া।পড়নে বাদামী ধুতি আর সাদা কুর্তি ছিল।”
চাওয়ালা ফারুক মালতীর বেশ পোশাক চেয়ে চেয়ে দেখলো।বললো, “হ হিন্দু লোক। ১০-১২ আগে হয়তো আইছিল এক লোক। আমারে তো সিরাজী বাড়ির কথা কইলো। আমি কইলাম। তয় তারপর আর দেহি নাই।”
–“সত্যিই এসেছিল উনি।ওনাকে এখন কোথায় খুজবো। আমাদের সিরাজী মঞ্জিলে ঢুকতে দিচ্ছে না।”
— “সিরাজী মঞ্জিলে তো বিধর্মীদের ঢোকা নিষেধ। আর তাছাড়া এইখানেও ঘুইরেন না। আপনেগো ছায়া ভালা না। চইলা যান গা। রাইত হইয়া গেছে।”
চা ওয়ালার কথা শুনে ওদের দুশ্চিন্তা আরো বেড়ে গেলো। মা-মেয়ে উদ্দেশ্যহীন পথিকের মতো এখানে ওখানে খোজ করতে লাগলো। রাত এর অন্ধকারে দুজন এসে পোছালো বকুলতলার দিকে। সেখান দিয়ে যাচ্ছিল চারজন পুরুষ।
দেবী বললো, “মা ওই দেখো ওইখানে দাদারা আসছে। ওনাদের কাছে গিয়ে বলো না বাবার কথা।”
মালতী দেবীকে সাথে করে নিয়ে লোক গুলোর সামনে যায়। মালতী কে দেখে একজন বললো, ” কি চাই?”
— আজ্ঞে আমার স্বামীর খোজ করছিলেম। কপালে চন্দনের টিপ। গায়ে সাদা কুর্তি আর বাদামি ধুতি ছিল। ১১দিন আগে এখানে এসেছিল।চা ওয়ালা বললেন উনি নাকি দেকেছিলেন।আপনাদের দেখে ভদ্রলোক মনে হচ্ছে।বলছিলেম যে আপনারা একটু সাহায্য করুন না।”
চারজনের মাঝে একজন বলে উঠলো, “দেব ঠাকুর এর বাড়ির লোক নাকি আপনেরা। আর সাথে এই খোলসে ঢাকা মাইয়া কিডায়?”
–“আজ্ঞে হ্যাঁ আমরা হরিপুর থেকে আসছি। সাথে আমার মেয়ে ‘দেবী’। সহায় হোন দাদা। ”
–“হাহাহা”, করে চারজন হেসে উঠলো। ওদের বিশ্রি হাসির ঝলক দেখে ভয় পেয়ে গেলো দেবী আর মালতী।
একজন বলে উঠে, “হেলাল রে এই বেটিই কয় কি,,নেউলের কাছে মুরগির খোজ করতে আইছে।”
হেলাল হেসে বলে,” হাহাহা চাচাজান,, হে আর কইতে। মহী রে তুই চাইয়া আছা কেন খোলস খান তুলা কর আমিও দেহি। মায়ের রঙ ই যে টাটকা না জানি মাইয়া কি । ইশ পাও দুইখান দেখ টুসটুস করতাছে। ”
মালতী মেয়েকে জড়িত ধরে বললো, “ছি, কারা আপনারা। এগুলা কি বলছেন।”
জামাল বলে,” আরে আমি কইতাছি খাড়ান। আপনে যাগো কাছে আপনের সুয়ামির খোজ করতাছেন তারাই কিছুদিন আগে আপনের সুয়ামিরে খুন করছে।”
দেবী বাবার কথা শুনে কেদে দেয়। বাক রুদ্ধ হয়ে গেলো। এ কি শুনলো সে। মালতী নিজের কানকে অবিশ্বাস করতে ইচ্ছে করলো। তার সারা শরীর কাপছে।মালতী চিৎকার করে বলে,” মিথ্যে বলছেন।”
–“মিছা কইয়া কি লাভ। সত্য কইলাম।”
–“দেবী মা চল থানায় যাবো এক্ষুনি আমরা।”
মালতী মেয়েকে নিয়ে পা বাড়ালো ওমনি জামালের বিশ্বস্ত চাকর হাবিবুল্লাহ মালতীর হাত ধরে ফেলে।বলে,
“সাব, এই মা-বেটিরে যাইতে দিয়েন না। এরা পুলিশের কাছে গেলে সমস্যা বাইজা যাইবো। আর আপনের আব্বার কানে গেলেও সমস্যা হইবো। আপনারা মুখ পাতলামি কইরা সব কইয়া দিলেন। তার চেয়ে এই দুইডারে সাথে নিয়া চলেন। ওইখানেই খালাস করুম নে।”
মালতী হাত ছাড়াতে লাগলো। হবি কে ধাক্কা দিয়ে দেবীকে নিয়ে পালানোর জন্য দেবীর হাত ধরে দৌড় দিল।মহীবুল গালি দিয়ে বললো,”ধর শা’লীগো”
মা মেয়ে বকুলতলা থেকে দৌড়াতে লাগলো। নদীর পাশের পথ দিয়ে যাচ্ছিল দুজন। কিন্তু দূর থেকে কিছু একটা এসে বিধলো মালতীর পিঠে। সঙ্গে সঙ্গে মাটির উপর পড়ে গেলো মালতীর দেহ। দেবী “মা” বলে চিৎকার করলো। মায়ের কাছে বসে মাকে ডাকতে লাগল,” মা,ও মা”। পিঠে হাত দিতেই হাতে তরল কিছুর ছোয়া লাগলো। দেবীর আর বুঝতে বাকি রইলো না এ তার মায়ের রক্ত। দেবী মায়ের মাথায় হাত বুলাতে লাগলো। বললো,”মা কথা বলো মা তোমার কিচ্ছু হবেনা। ও মা চুপ করে থেকো না। ”
মালতী মেয়ের হাত ধরে বলে,”দ দ দেবী,,! ”
–” হ্যাঁ মা এই যে আমি। ”
–“তোকে দিব্বি দিলাম পালা।তোকে বাঁচতে হবে। পুলিশের কাছে যেয়ে আমার আর তোর বাবার খুনিদের শাস্তি দিতে হবে। কথা দে ওই সিরাজী মঞ্জিলের কাউকে ছাড়বি না। সবাই কেই অন্যায়ের শাস্তি দিবি।তাহলেই তোর বাবার আর আমার আত্মা শান্তি পাবে।”
দেবী কাদতে কাদতে বলে,” তোমায় কথা দিলাম মা পুলিশের কাছে যেয়ে শাস্তি চাইবো। তোমার কিচ্ছু হবে না মা। কিচ্ছু হবে না । তুমি ওঠো মা।”
মাকে জড়িয়ে ধরে আবারো চিৎকার করে কেদে উঠলো। দেবী মাকে উঠানোর চেষ্টা করলো। কিন্তু ব্যর্থ হলো। মালতীও শেষ নিশ্বাস ত্যাগ করলো। দেবী মাকে ডাকতে লাগলো কিন্তু কোনো সাড়া পেলো না। সে নিজেও নিশ্চুপ হয়ে গেলো। হঠাৎ দেবী কারো পায়ের শব্দ শুনতে পেলো। সে ঘুরে দেখলো তীর-ধনুক হাতে এক বয়স্ক ব্যক্তিকে। তার সাথেই আরেকজন ব্যক্তি। ধনুক হাতে যে ব্যক্তি সেটি ছিলো দুলাল সিরাজী। আর পাশেই বিলাল সিরাজী। মশালের আলোয় স্পষ্ট দেখলো সে দুজনের মুখ। পিছনে হেলাল, জামাল, মহীবুল আর হাবিবুল্লাহ। তার দিকেই এগিয়ে আসছে তারা। শেষ বার মায়ের মুখ দেখে নদীর পাশেই ঘন জঙ্গলের দিকে পা চালালো দেবী। জঙ্গলে অন্ধকারে দিশেহারা হয়ে ছূটতে থাকলো।
দুলাল জামাল কে থাপ্পড় মেরে বলে,”ওই মাইয়ারে ধইরা আন যা। তাড়াতাড়ি। আবার নতুন এক লাশ এর ব্যবস্থা করা লাগবো।
–” জি আব্বাজান। এই চল জঙ্গলে ঢুকি।”
জঙ্গলে অনেকক্ষণ খুজলো তারা।গালি দিয়ে বললো,
–” মা** কই গেলো।”
হেলাল বলে,”বাম দিকে আমি আর হবি যাই। আপনেরা এইদিকটা খোজেন চাচাজান।”
অনেকক্ষণ খুজলো তারা। মহী আর জামাল দেবীকে খুজতে খুজতে দেবীর প্রায় কাছে চলে গেলো।
দেবী ভয়ে দু হাতে নিজের নাক মুখ চেপে ধরেছিল।আর উপওয়ালার কাছে প্রার্থনা করছিল। প্রায় কাছাকাছি চলে এসেছিল তারা।ঠিক তখনি কেউ ডাক দিয়েছিল।
–” চাচাজান, মহী চইলা আসো। খা** নাই জঙ্গলে। দাদাজান খেইপা গেছে। লাশ সরান লাগবো রাইতেই।”
জামাল মহীকে বলে,” হেলাল ঠিকই কইছে জঙ্গলে নাই। আর থাকলেও জঙ্গলের জানো’য়া’রেরা ওরে খাইয়া দিবো। দিনের বেলা আবার খুজমু নি।”
তারপর চারজন ই জঙ্গল থেকে বেরিয়ে এলো।শুধু জঙ্গলে ঝোপঝাড় এর আড়ালে দমবন্ধকর অবস্থায় পড়ে থাকে সদ্য অনাথ হওয়া ‘দেবী’।
চলবে…….