দেবী,৫০

0
353

#দেবী,৫০
লেখিকাঃ শবনম রাবাহ (স্রোতস্বিনী)
কপি করা সম্পুর্ণ নিষেধ।

রুহুল এর এখন নিজের তকদিরের উপর রাগ হচ্ছে। জন্মের পর হতেই কেন তার সঙ্গেই সৃষ্টিকর্তা খেলছে।পিতার কথা মনে হতেই রুহুল তার আব্বার কক্ষে গেলো। এই লোকটা আজ কেন এভাবে পড়ে আছে। জীবনের সকল বিপদে রুহুল সবার আগে যার শক্ত হাতটি ভরসা স্বরুপ পেয়েছে তার নাম বিলাল সিরাজী। রুহুলের কাছে দুনিয়ায় তার আব্বা শ্রেষ্ঠ পুরুষ, শ্রেষ্ঠ বাবা আর তার আম্মার জন্য দুনিয়ার নিকৃষ্ট স্বামী।

রুহুল দেখলো বিলাল এর দুচোখ বেয়ে সেই আগের মতোই অনবরত পানি পড়ছে। রুহুল নিজের হাতে চোখ মুছে দিলো। বিলাল এর চেহারার দিকে পলকহীন ভাবে চেয়ে রইলো। তার আব্বার দুহাত আকড়ে ধরে বললো, “আমি কত বোকা তাই না আব্বা। আপনি আমার বিয়ের দিন থেকে অনবরত চোখের পানি ফেলছেন আমি ধরতেও পারি নি যে আপনার এই দশার জন্য আমার স্ত্রী দায়ী। আমি ভেবেছিলাম আপনি বোধহয় আমার বিবাহে আমার পাশে না থাকতে পেরে কাদছেন। কিন্তু আমি বুঝি নি আপনি আমার স্ত্রী কে দেখে কষ্টে কাদছেন, নিজের বংশের বিনাশের জন্য কাদছেন। আমি সত্যিই বোকা তাই না আব্বা।”

কিছুক্ষণ থেমে আবারো বললো, “কেন শেষ সময়ে এসে অনুশোচনায় কাদছেন যখন সময় থাকতে স্ত্রীদের কে সঠিক মর্যাদা দেননি। আম্মাদের সঙ্গে এমন না করলে আজ এখানে পড়ে থাকতেন না। আজকের এই অবস্থার জন্য আপনি নিজে দায়ী অথচ আমি অজান্তেই আপনাকে ছুয়ে প্রতিজ্ঞা করেছিলাম আপনার অপরাধীকে নিজ হাতে হত্যা করবো। কিন্তু আমি যে তাকে খুন করতে পারবো না আব্বা। আপনিই বলুন না নিজের বংশের ধংসকারীকে ভালোবাসা কি অন্যায়। তাকে খুন করতে পারবো না বরং আমি নিজেই খুন হবো তার হাতে। তার শাস্তি আমি দিতে পারবো না।আমায় ক্ষমা করে দেবেন। আপনাকে দেওয়া প্রতিজ্ঞা রাখতে পারলাম না। ক্ষমা করবেন। ”

রুহুল এবার হাত ছেড়ে দিলো। বিলালের বুকে মাথা রাখলো। দুনিয়ার কোনো বুকে রুহুল নিস্বার্থ ভালবাসা না পেলেও তার আব্বার বুক ছিল উন্মুক্ত সুখ। বিলাল সিরাজী এই পৃথিবীতে বোধহয় রুহুল কেই সবচেয়ে বেশি ভালো বেসেছে। অথচ রুহুল তার পিতার চেয়েও মাকে বেশি ভালোবাসতো। সুভা যে এক প্রকার বাধ্য হয়েই রুহুলকে বড় করেছে রুহুল জ্ঞান হওয়ার পর থেকেই বুঝেছিল। জীবনে মায়ের অবহেলা সবচেয়ে বেশি পেয়েছে রুহুল। অথচ ভাগ্য আজ আবার সেই একই জাতের, একই ঘরের দুই নারীর দ্বারাই কষ্ট লিখে রেখেছিল রুহুলের তকদিরে। নিজের পুর্বপুরুষদের করা পাপ এর সাজা রুহুল পাচ্ছে। আদোও কি মানুষের জীবনের চেয়ে বড় মান সম্মান হতে পারে।হয়তো সিরাজীদের কাছে মানুষের প্রাণের চেয়েও মান সম্মান বড়।

রুহুল পিতার বুকে মাথা রেখেই বললো, “এতটা পাপ কেন করলেন আব্বা। শুধু আমার আম্মাকে নয়, আমাকেও ঠকালেন আপনি। কি করে এতটা পাপ করতে পারলেন আব্বা। আজীবন আপনার জন্য আমার আম্মা দুচোখের পানি ফেলে গেছে। আপনার জন্য দাদাজান এত পাপ করতে সক্ষম হয়েছে। আর আপনি সন্তান হয়েও পিতার পাপকে প্রশ্রয় দিয়েছেন। আপনি কেন আমার মতো হলেন না। অন্তত আমার জীবনটা আর দশটা স্বাভাবিক সন্তানের মতো হতো যেখানে সেই সন্তান শেষ বয়সে বাবা-মা নিয়ে সুখে শান্তিতে থাকতে পারে। কিন্তু আপনাদের দুজনের দুরকম মানসিকতার জন্যই আজ আমি নিঃস্ব অনুভব করছি।আপনারা দুজনেই আমার সাথে অন্যায় করেছেন।আপনাদের কাউকেই ক্ষমা করবো না আমি।”

রুহুল বুকে থেকে মাথা তুললো। পিতার চোখের পানি মুছে দিলো। বিলালের ঠোঁট চোখ কাপছে। চোখ লাল হয়ে গেছে। রুহুল পিতার করুন দশা দেখে বললো, “সত্যি আমার স্ত্রী আপনাকে জীবিত থেকেও মৃত বানিয়ে দিয়েছে।কতটা ব্যার্থ আজ আপনি বাবা হিসেবে, এক পিতার সন্তান হিসেবে। আমার স্ত্রীর করা অন্যায়ের জন্য তাকে কি আদোও শাস্তি দিতে পারব আমি বলুন। তার জানমাল রক্ষা করার দায়িত্ব তো সয়ং আল্লাহ আমায় দিয়েছেন। তিনি যে আমার স্ত্রী, আমার জান্নাতের সাথি, আমার অর্ধাঙ্গিনী, আমার বিবিজান।”

রুহুল পিতার মাথায় হাত বুলিয়ে উঠে দাড়ালো। বেড়িয়ে গেল পিতার কক্ষের বাইরে। বিলালের সেই ক্রন্দন রত চোখ বেয়ে পানি পড়তেই থাকলো। বিলাল বোধহয় আজ সুস্থ থাকলে রুহুলের কিছুটা কষ্ট লাঘব করতো। প্রথম সন্তান রুহুল তার অতি আদরের ছিল।বিলাল মনে মনে বলছে,”আমায় ক্ষমা করিস খোকা। আমায় ক্ষমা করিস। ”
__________________________

–“সিরাজী আব্বাগো লাশ ধুইয়া কাফনান শেষ।এখুন কি আর কিছু করমু? ”
সাজুর কথা শুনে রুহুল বললো, “তার পাশে বর্তমানে যেসব প্রহরীরা আছে তাদের ওযু করে কুরআন নিয়ে পড়তে বল। সকালে মাদ্রাসা থেকে হাফেজদের নিয়ে আসবে তারা জোহর অব্দি কুরআন খতম দেবে। ”
সাজু বললো, “জি তাই হইবো। তা জানাজা কহুন?”

–“জোহরের পর জানাজা দাও। আর ফজরের পরেই যেন আশেপাশের এলাকায় ও যেন জানিয়ে দেওয়া হয় দাদাজান আর নেই। ”
–“সে তো দেওন লাগবই। সিরাজী আব্বারে মহব্বত করা মানষের অভাব নাই।তাই দেশ বিদেশ থিকা মানুষ আইবো।বাইরের খোলস ডা তো ভালা আছিল তার। ”

রুহুল আর কিছু বললো না। সাজু আবারো বললো,
” ভাবিমারে কি করবেন এখুন। ওনারে মাফ কইরা দিবেন নাকি সাজা দিবেন?”
–“আমি ওনার বাবাকে খুন করেছিলাম,আমার পরিবার তার মাকে খুন করেছে অতপর সে একা আমার স্বজনদের হত্যা করেছে হিসেব বরাবর। আর কি সাজা দেবো বল?”

সাজু মাথা নিচু করে মিনমিনিয়ে বললো, “প্রতিশোধ এর হিসাবের দিক দিয়া বরাবর কিন্তু প্রেমের হিসাবের দিক দিয়া কি আদোও বরাবর? ”

–“আমি তাকে আমার হৃদয়ের সম্পুর্ন ভালোবাসা দিয়েছিলাম, সেই হিসেবে বরাবর নয়। মৃত্যুর বদলে মৃত্যু উপহার দিলো সে, কিন্তু ভালোবাসার বদলে ভালোবাসা কেন দিলো না সে?”

সাজু নির্বাক বনে গেলো। এই প্রশ্নের উত্তর যে নেই।
রুহুল ফোস করে হেসে উঠলো। বললো, ” নারীর ঘৃণা যখন এত সহজে পাওয়া যায় তবে ভালোবাসা পেতে এত কাঠখড় পোড়াতে হয় কেন। নারীর মত বড় ছলনাময়ী এই জগৎ আর কেহ নাই।”

রুহুল চলে যেতে নিলে সাজু পিছন বললো, “আরেকটা কথা আছিল, সিরাজপুর বাসী থিকা ভাবিমারে কেমনে বাইচাইবেন?”
–“শুধু কি সিরাজপুর বাসী নাকি অন্যদের কথাও বলছিস। সে আমায় এমন এক জায়গায় দাড় করয়েছে যে কোন পথ বেছে নেবো বুঝতে পারছি না।”

–“সিরাজী আব্বারে খুন করছে সে, মঞ্জিলে যারা ছিল সকলেই শুইনা ফালাইছে। সকাল হইলেই তার উপর হামলা হইবো। না সে মঞ্জিলে টিকতে পারব আর না বাইরে।আপনে কিছু না কইলেও বাকিরা ছাড়বো না।”

রুহুলের হৃদয় ছেত করে উঠলো। সত্যিই তো সিরাজপুর বাসি দেবীকে ছাড়বে না।রুহুল বললো, “তবে তাদের কে জানিয়ে দেবে কেন খুন করেছে। ”

–“ভাবিমা হিন্দু এইডা যদি জাইনা যায় অবস্থা ভয়াবহ হইয়া যাইবো সিরাজী সাব। ”
রুহুল ক্ষিপ্ত হয়ে বললো, “সে হিন্দু ছিল এখন আর নেই। আমার স্ত্রী এখন মুসলমান। ”
–“এইডা তো আর মানুষ বুঝব না।”
–“তাহলে কারো বুঝার দরকার নেই। তার গায়ে যেন এক আচ ও না লাগে।তোর দলের লোক গুলো কে অন্দরমহল পাহারা দেওয়ার জন্য খবর দে। বাইরের কেউ যেন অন্দরমহলে ঢুকতেও না পারে। ”

–“আচ্ছা তাই হইবো। আপনের কক্ষে তারে রাইখেন আর কইবেন দরজা জানি খোলে না।”
–“তাকে বললে কি আর আমার কথা শুনবে। আমি তার বাবার হত্যাকারী। আমি নিশ্চিত সে আমায় হত্যার পরিকল্পনা করছে।”
–“না, আপনেরে খুন সে করতে পারব না। আমি তার চোখে আপনার জন্য ভালোবাসা দেখছি।”
–“ভালোবাসা কি চোখে ভাসে, সে তো হৃদয় হতে নির্গত হয়। তার মাঝে আমার জন্য এক চিমটি ভালোবাসা ছিল না যা ছিল তা প্রতিশোধ এর তৃষ্ণা। ”
–“তাইলে সেই তৃষ্ণা ভালোবাসা দিয়া মিটায়া নেন।”
–“এখন সেটা অসম্ভব। আমি তাকে অসীম ভালোবাসা দিয়েছি কিন্তু সে আমার মাঝে কেবল একজন হত্যাকারীকে খুজে পেয়েছে। আমার ভালোবাসা বোধহয় সে উপলব্ধি করতেই পারে নি। আজ উচ্চস্বরে বললো আমার ভালবাসা মিথ্যে ছিল। এ কথা শোনার আগে মৃত্যু কেন হলো না আমার। ”
____________________

ফজরের আজান দেবে কিছুক্ষণ পর। এখন অন্তত হাতমুখ ধুয়ে ওজু করে নিতে হবে। কিন্তু রুহুলের মনে চলছে অন্যকিছু। রুহুল বসার ঘরে গেলো। সুভা এখনো বসার ঘরে বসে আছে। রুহুল বসার ঘরে ঢুকে হাতুড়িটা হাতে নিলো।সুভা রুহুল কে দেখেই ডাকলো,”খোকা!”

রুহুল মায়ের ডাক শুনলো তবে আজ সাড়া দিলো না।চলে আসতে নিলেই সুভা রুহুলের হাত টেনে ধরলো। সুভা রুহুলের গালে হাত রেখে বললো, “আমায় ক্ষমা করে দিস খোকা। আমি পারলাম না একজন প্রকৃত মা হতে। আমার প্রতি রাগ-অভিমান রাখিস না আর।”

–“আমার আপনার প্রতি কোনো অভিমান নেই আম্মা। আপনার উপর রাগ করা আমার কাছে মহাপাপ।”

–“আমি সারাজীবন তোকে উপেক্ষা করেছি। তোর বাবা বংশের জন্য তোকে কষ্ট দিয়েছি। ক্ষমা কর আমায়।আমি তোকে জীবনের কাল মনে করতাম। ”

রুহুল তার আম্মার রক্তিম মুখের দিকে চেয়ে হাসি দিলো। বললো,”আপনি কিভাবে কথা বলেন সেভাবে কথা বলতাম যেন আপনি আমায় ভালোবাসেন। আমি কিভাবে চললে খুশি হবেন সেভাবে চলতাম। আপনি শিক্ষিত বলে নিজেও শিক্ষিত হই কেবল আপনি খুশি হবেন বলে। জানেন আম্মা, চাচিজান-ছোটাম্মা যখন হেলাল, মহীদের আদর করতো আমার খুব হিংসে হতো। ওদের কিছু থাকুক আর না থাকুক মায়ের আদর ছিল। কিন্তু আমার সব থেকে ও কিছুই ছিল না। আমার তৃষ্ণার্ত হৃদয় আপনার ভালোবাসা আদর চেয়ে এসেছে আজীবন।কিন্তু আপনি সেগুলো দেন নি। আমায় এ মঞ্জিলের প্রত্যেক সদস্য ভালোবেসেছে কিন্তু আপনি আমায় কেবল ঘৃণা করে গেছেন।ক্ষমার পরিবর্তে কি আমার সেই সময় গুলো ফিরিয়ে দিতে পারবেন?”

–“না সময় কি আর ফিরিয়ে দেওয়া যায়। আর আমি তোকে কখনো ঘৃণা করিনি খোকা। ”
–“ভালোও তো বাসেননি কোনোদিন। আমার আব্বা যেমন ই হোক একটা কথা মনে রাখবেন আমার আব্বা পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ পিতা ছিল।কিন্তু আফসোস আমি আপনাকে পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ আম্মা বলতে পারবো না।”
–“খোকা, এতটা রাগ পুষে রাখিস না মনে? ”
–“আমি আপনার উপর রাগ করে নেই।সকল কিছুই আমার ভাগ্য। ভাগ্য আমায় বারবার মনে করিয়ে দিচ্ছে এই পৃথিবীতে সুখ নামক বস্তু আমার জন্য নয়। এই পৃথিবীতে ভালোবাসা আমার জন্য নয়।”

–“ভালোবাসা সবার জন্য। দেখিস খোকা সব ঠিক হয়ে যাবে। তোর ভাগ্য ও ভালো হবে। দেবী তোকে অনেক ভালোবাসে। ওকে নিয়ে চলে যা দূরে কোথাও।তোকে আর কষ্ট সহ্য করতে হবে না।জানি তোর কষ্ট হচ্ছে।”

কথাটি বলেই সুভা রুহুলকে জড়িয়ে ধরলো।রুহুল পাথরের মতো বললো,” আজ আমার সত্যি খুব কষ্ট হচ্ছে আম্মা। উনি আমায় ঘৃণা করে এই কথাটি কি করে বলতে পারল। আমি যে অনেক বড় অন্যায় করেছি আম্মা। সত্যিই সেদিন আপনার ঘৃণা ভরা মুখ দেখে যতোটা কষ্ট না হয়েছে তার চেয়ে বেশি কষ্ট হচ্ছে। এমন কেন হচ্ছে আম্মা।আমার বুকের বা পাশ টায় অসম্ভব যন্ত্রণা কেন হচ্ছে। শ্বাস নিতে পারছি না। ”

–“প্রেম জিনিসটা বড্ড যন্ত্রণার খোকা। যখন আসে এক সমুদ্র সুখ নিয়ে আসে আর যখন হারিয়ে যায় সেই সুখ বিরহ রুপে প্রতিনিয়ত হৃদয়ে রক্তক্ষরণ করে।”

–“আমার আব্বার পাপের শাস্তি বোধহয় আমি পাচ্ছি তাই না আম্মা। আমার বংশের করা কুকর্মের শাস্তিও আমি পেলাম। আমি তো জেনে পাপ করিনি। ”

–“অন্যের প্রিয় মানুষের ক্ষতি করতে চাইলে নিজের প্রিয় জিনিসের ক্ষতি হয়। তোর সাথে তাই ই হয়েছে। তবে আমি বলবো ভুলে যা সব।দেবীর কাছে যা। সব ঠিক করে নে আগের মতো। ”

–“আমি কোন মুখ নিয়ে ওনার কাছে যাবো। আমি আর বাচতে চাই না আম্মা।ওনার ঘৃণা নিয়ে আমার বাচার ইচ্ছে নেই।তার শেষ ইচ্ছে না হয় উনি পুরণ করুক।”

–“না খোকা তুই এমন টা করিস না। এখনো ভোরের আলো ফোটে নি। তুই দেবী কে নিয়ে দূরে কোথাও চলে যা। দরকার হলে হরিপুর চলে যা সেই জায়গার খোজ কেউ জানবে না।”

–“না আম্মা তা হয় না। উনি আমাকে আর চায় না। ওনার মাকে কথা দিয়েছিল খুনিদের শাস্তি দেবে। আমি নিশ্চিত উনি আমায় হত্যা করে তারপর ই শান্ত হবে।তাই আমি চাই ওনার হাতে মৃত্যু হোক আমার। ”

–“না খোকা এমন টা করিস না। আমি তোর মৃত্যু সহ্য করতে পারবো না।”
–“হাহ,সারাজীবন যখন অবহেলা কষ্ট দিয়ে গেছেন ওগুলো আপনার সহ্য হয়েছে আম্মা। আজ কেন আমার মৃত্যু সহ্য হবে না। আলবাদ হবে।”

রুহুল রক্তাক্ত হাতুড়ি টি নিজের হাতে নিল।বললো, “একটা কথা মনে রাখবেন আম্মা মায়ের ভালোবাসা একটা সন্তানের সবচেয়ে বড় সম্পদ। আমি জমিদার বংশে জন্মেও অনেক বড় ভিখারি ছিলাম। ”
____________________

দরজায় করাঘাতের শব্দে দেবীর ঘুম ভেঙে গেলো। বুকের ভেতর ঝড় তুলে দিয়েছে এই শব্দ। দেবী জানে দরজার এমন করে কেবল রুহুল ই কড়া নাড়ে। ঘন্টা খানেক হবে চোখ লেগে গিয়েছিল দেবীর। দেবী চোখ মুখ মুছে মন কে শক্ত করলো। দরজা খুলে দিয়ে জানালার কাছে এসে মুখ ঘুরিয়ে রাখলো। রুহুল কক্ষে ঢুকে দেবীর পিছন দেখতে পেলো কেবল। রুহুল এগিয়ে গেলো দেবীর দিকে। দেবীর পিছনে দাড়িয়ে গেলো। তারপর হাতুড়ি টি এগিয়ে দিলো কাকনের দিকে। কাকন অবাক হয়ে গেলো। রুহুল বললো, “আপনার মাকে দেওয় কথাটা আজ পুরন করতে পারেন ‘দেবী’। ”

রুহুলের মুখে ‘দেবী’ ডাক শুনে দেবীর হৃদয় থেকে যেন রক্তক্ষরণ শুরু হলো। যে রুহুল আজ অব্দি বিবিজান ব্যাতিত অন্যনামে ডাকেনি সে আজ দেবী বলছে।

রুহুল আবারো বললো,”আমার আব্বাকে ছুয়ে প্রতিজ্ঞা করেছিলাম তার অপরাধীকে নিজ হাতে হত্যা করবো। অন্যদিকে আপনিও আপনার মায়ের কাছে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ । তাই আমার মনে হয় আমাকে খুন করলেই আপনি আপনার কথা রাখতে পারবেন।আমি পাপ করেছিলাম, অন্যায় করেছিলাম, খুন করেছিলাম আপনার বাবাকে। আপনি চাইলেই আমায় শাস্তি দিতে পারেন। ”

দেবী রুহুলের কথা শুনেই যেন শ্বাস আটকে গেলো। হ্যাঁ এটা ঠিক দেবী শাস্তি দিতে চায় কিন্তু তাই বলে রুহুল কে হত্যা করার শক্তি নেই তার মাঝে।দেবী ঢোক গিলে চোখ বুজে বললো, “অন্যায় যখন করেছেন শাস্তি পেতেই হবে। আমার বাবা-মায়ের খুনিদের ক্ষমা নেই।”

–“আপনার হাতে খুন হতে আমার কোনো আপত্তি নেই।তবে এটুকু বলবো আমায় কিছু মুহুর্ত সময় দিন। আজ দাদাজানের দাফন না হওয়া অব্দি সময় দিন।”
–“দিলাম সময়। ”
–“একটা শেষ ইচ্ছে পুরণ করবেন? ”
–“না। ”
–“করতেই হবে!”
–“বললাম তো পারবো না!”
–“দয়া করে আমি না আসা অব্দি এই কক্ষ থেকে বের হবেন না। আপনার উপর হামলা হতে পারে।”
–“হলে হবে! ”
–“আপনার বড় বিপদ হতে পারে। এই কয়েক মাসে যদি একবার ও মনে হয়ে থাকে আমি আপনাকে ভালো বেসেছি তবে আপনি এই কক্ষ থেকে বের হবেন না। ”
–” আমি আপনার কথা শুনতে পারবো না। ”
–“আজ শুনতে হবে। কেননা আমি জীবিত অবস্থায় আপনাকে কেউ আঘাত করবে এ আমি সহ্য করতে পারবো না। তাই দয়া করে এই কক্ষের বাইরে বেরোবেন না। আমি আসার পর আমায় যে সাজা দেবেন মাথা পেতে নেবো।”
–“শাস্তি আমি দিয়েই ছাড়বো। ”
–“আপনার শাস্তি আমি উপহার হিসেবে গ্রহণ করবো। ”

কথা গুলো বলার সময় দেবী একটা বার ও রুহুলের দিকে তাকায়নি। জানালার দিকেই মুখ করেই ছিল। রুহুল ও একটাবার তার বিবিজানের মুখ দেখতে পায় নি। রুহুল হাতুড়ি টা টেবিলের উপর আওয়াজ করে রাখলো। দেবীর শরীর কেপে উঠলো সেই আওয়াজে। রুহুল ঢাকা থেকে আসার পর আর পোশাক পরিবর্তন করে নি। সেগুলো খুলে সাদা পাঞ্জাবি আর সাদা পাজামা পড়ে নিলো। আলমারি খুলে একটা টুপি মাথায় দিয়ে নিলো। দরজার কাছে যেয়ে আবারও দেবীর দিকে একটা বার তাকালো। রুহুলের তৃষ্ণার্ত চোখ একবার দেবীর মুখ দর্শন চায়। আর তৃষ্ণার্ত হৃদয় একটি বার দেবীকে নিজের বক্ষে জড়িয়ে ধরতে চায় শক্ত করে। যেন হাজার বছর ধরে অনুভব করতে পারছে না তার বিবিজানেন ছোয়া, গন্ধ, আলিঙ্গন। রুহুল ফোস করে নিশ্বাস ফেলে কক্ষ ত্যাগ করলো।

রুহুল চলে যাওয়ার পর দেবী কান্নায় ভেঙে পড়লো। এত কঠোর ভাবে প্রথমবারের মত দেবী রুহুলের সঙ্গে কথা বলেছে। দেবীর পরিকল্পনা ছিল রুহুল জানলে বোধহয় দেবীকে খুন করবে। তখন সব দুঃখ চুকে যাবে কিন্তু যখন জানলো রুহুল তার বাবার হত্যাকারী দেবী নিজের কান কেও বিশ্বাস কর‍তে পারলো না। রুহুলের মত সুপুরুষ তার বাবার হত্যাকারী এটা কি করে সম্ভব। নিজের ভালোবাসার মানুষকে হত্যা করা মানে নিজের ভালোবাসাকে হত্যা করা। এত কিছুর পর যে তাদের একসাথে সংসার সম্ভব নয় তাও দেবী জানে। দেবী জানালার শিক আকড়ে ধরে কাদলো। বেশ কিছুক্ষণ পর দেবীর চোখে সেই লাল গোলাপ গাছ টা পড়লো।তারপর দেবীর মনে পড়ে গেলো রুহুলের দেওয়া বাসর রাতের উপহারের কথা। দেবী দ্রুত এগিয়ে গেলো আলমারি খুলে সেই বাক্সটা বের করলো। কাপাকাপা হাতে খুললো। দেখলো প্রথমেই একটি রক্তজবা ফুল যা শুকিয়ে গেছে। তারপর একটা চিঠি। তারপর একটা স্বর্ণের টিকলী।দেবী অতি আগ্রহে চিঠিটি খুললো। সঙ্গে সঙ্গে কিছু শুকনো গোলাপের পাপড়ি পড়লো চিঠি হতে। চিঠিতে রুহুলের লেখা~

প্রিয়তমা হৃদয়হরণী,
আলহামদুলিল্লাহ, এই মুহুর্ত আমার জীবনের শ্রেষ্ঠ মুহুর্ত। আজকের দিন আমার জীবনের শ্রেষ্ঠ দিন। কেননা এখন, আজ, এই মুহুর্তে আপনি আমাকে ভালোবাসেন। আমি নিশ্চিত আজকের দিনটি আমি আজীবন মনে রাখবো।
শুরুতেই বলি এখনো ফজরের আজান দেয়নি। পুরো পৃথিবী ঘুমে বিভোর। আজকের পর আর এই একাকী রাত কাটাতে হবে না। কেননা কাল থেকে আমার জীবনের প্রতিটি ফজর হতে এশা আপনার সাথে কাটাবো। হয়তো প্রতিদিন সকালে লেপ্টে থাকবো আপনার সঙ্গে। আজ আপনার আর আমার পবিত্র বিবাহবন্ধন হবে। আপনাকে আমার স্ত্রীর রুপে দেখার তর সইছে না।আমার সাধ্য থাকলে আমি যেদিন আপনাকে সেই লাল শাড়ি পরিহিত দেখেছিলাম সেদিনই আপনাকে বিবাহ করতাম কিন্তু দাদাজানের দেওয়া কথার জন্য আমায় অতিরিক্ত সাতদিন অপেক্ষা করতে হলো। শুনে অবাক হবেন এত কিছুর পর ও আমি আক্কাস কে উপহার দিয়েছি কেননা ওর করা ভুলের জন্যই আপনার মতো শ্রেষ্ঠ রূপবতী পবিত্র রক্তজবা ফুল আমার জীবনসঙ্গী হবে আজ।

আপনাকে আমি প্রথম দেখেছিলাম আজ থেকে এক বছরের অধিক আগে। আব্বাকে যখন মহিলাশালায় রক্তাক্ত অবস্থায় পাই সেদিন। সিরাজপুরের প্রত্যেক টা মানুষ চোখের নোনাজল ফেলেছিল কিন্তু আপনি হাসছিলেন আর কথা বলছিলেন। জীবনের প্রথম কোনো নারীর প্রতি আমার অন্যরকম অনুভব হয়। আপনার সেই হাসি টি দেখে আমি থেমে যাই। তীব্র রাগ জমেছিল আপনার প্রতি।জানি না কেন সেদিন আপনার প্রতি আমার মোহ কাজ করেছিল। অদ্ভুত মোহ যা আমি চাইছিলাম না।কেননা আমার আব্বার দুঃখের সময় হাসছিলেন। তবে আপনার হাসি আর গোলাপের পাপড়ির ন্যায় ঠোঁট আজ আমার সবচেয়ে প্রিয়। বোধহয় আপনার সেই হাসিই বিষাদ রুপে আমাকে আপনার মোহে পড়াতে বাধ্য করেছিল। কিন্তু আব্বার অসুস্থতা এবং সকল ব্যস্ততায় আমি ভুলে গিয়েছিলাম। পারিবারিক দন্দ, মানসিক ভাবে বিপর্যস্ততা আমায় ঘিরে রেখেছিল অনেকদিন। কিন্তু তারপর দ্বিতীয় বারের মতো মহিলাশালার মিলাদের দিন আপনাকে পুণরায় দেখি। আপনার মিষ্টি সুরেলা কন্ঠস্বর, নম্রতা, পবিত্রতা আমাকে পাগল করে দিয়েছিল। সেদিন সারারাত ঘুমাতে পারিনি। আপনি আমার হৃদয় বিলের সাদা শাপলা হয়ে ফুটে ছিলেন যার ফুটন্ত শ্রী আমার হৃদয়ে প্রনয় পায়রা উড়িয়ে দিয়েছিল মুহুর্তেই। তারপর আবার দেখা হয় সেই জঙ্গলে। আমি জানতাম না আপনি আমার সেই হৃদয়হরণী জানলে বোধহয় ওদের তখনি মেরে দিতাম। তবে আল্লাহর ইচ্ছে ছিল বলেই আজ আপনি সারাজীবনের জন্য আমার হবেন। আমি আপনাকে নিয়ে আমার নতুন দুনিয়া সাজাতে চাই। সুখের স্বর্গে বাস করতে চাই আপনার হাত ধরে।

ছোট থেকেই ইচ্ছে ছিল আমি কোনো পরিবার চাই না। চাই না কোনো সংসার জীবনে জড়াতে। আমি ছোট থেকেই আমার আম্মার ভালোবাসা থেকে বঞ্চিত ছিলাম। আমি চাইনি আমার মতো কোনো সন্তান পৃথিবীর বুকে আসুক যে আমার মতো করে বড় হোক। দুনিয়ার সবচেয়ে বড় অশান্তি হলো পারবারিক অশান্তি। যা দেখতে দেখতে আমার হৃদয়ে বিতৃষ্ণা হয়ে গিয়েছিল। অথচ আপনাকে দেখে বিয়ে করার সখ কেন হলো জানা নেই। সেদিন দাদাজানের সিদ্ধান্তে আপনি খুশি ছিলেন কিনা জানি না তবে এটুকু জেনে রাখুন সেদিন আমি আমার জীবনে সবচেয়ে বেশি খুশি হয়েছিলাম।সেদিন হতে আজ অব্দি আপনার জন্য ঘুম রাতে হয় না। রোজ রাতে জেগে থাকি আর আপনার কথা ভাবি।ভেবেছিলাম আপনার নামে মামলা করবো আমি। হৃদয়ের সঙ্গে সঙ্গে আমার ঘুম কেড়ে নেওয়ার মামলা।আপনাকে নিয়ে আজীবন বেচে থাকতে চাই আমি। আপনাকে আমি অনেক ভালোবাসি প্রিয়তমা।

চিঠিটার আগে বাক্সে থাকা রক্তজবা ফুলটি পেয়েছেন নিশ্চয়।ফুলটি সতেজ আছে নাকি শুকিয়ে গেছে জানবো না হয়তো তবে আপনি জেনে রাখুন আপনার প্রতি আমার মহব্বত আজীবন একই রকম থেকে যাবে যা কোনো দিন না শুকিয়ে যাবে আর না ফুরিয়ে যাবে। এই ফুলটা দেখছেন এটা আপনার একটা ছোট শাখা তবে এই রক্তজবা ফুলের চেয়ে আপনার সৌন্দর্য বেশি। আমার দেখা এই পৃথিবীতে বহু সুন্দরী নারী আছে তবে তাদের মাঝে আমার আম্মা সবচেয়ে বেশি সুন্দরী। আর তার পরেই হলেন আপনি।

রক্তজবার রক্তাক্ত রঙের চেয়েও গাঢ় প্রেম আমার আপনার প্রতি। আপনি আমার রঙহীন জীবনে রক্তাক্ত রঙিন ফুল হয়ে এসেছেন। আপনার এই রক্তাক্ত পদধূলি আমার বিষাদময় সাদাকালো জীবনে রঙিন পাহাড় নিয়ে এসেছে। আজীবন আমার জীবনের ফুটন্ত ফুল হওয়ার জন্য স্বাগত জানাই আমি আপনাকে।

সবিশেষে বলবো যে টিকলি টি পেয়েছেন এটা পড়ে আজ আমার সামনে আসবেন। আমাদের বংশের রীতি বাসররাতে স্ত্রীকে মাথায় তাজ অথবা টিকলি দিতে হয় আপনাকেও তাই দিলাম। আজ আপনি একটা সুন্দর শাড়ি আর এই টিকলিটা পড়বেন। আমি বুঝে নেবো আপনি আমায় ভালোবাসেন। মোহরনা হিসেবে নিজের টাকার অনেক গহনা দিয়েছি আপনাকে। তবে স্বামী হিসেবে মোহরানা স্বরুপ আমার হৃদয় নিংরানো সকল ভালোবাসা আপনাকে দিলাম। আর আজ আমাকে এই চিঠির সাথে লিখে দিলাম সবটুকু আপনার নামে।

একবার কি আজ মুখ ফুটে বলবেন ভালোবাসেন আমায়। বলবেন কিন্তু আমি অপেক্ষায় থাকবো। আপনার মুখে ভালোবাসি শব্দ শোনার জন্য আমার হৃদয় ব্যাকুল হয়ে আছে আজ সাতদিন। আপনার ছোয়া, আপনারা কন্ঠ, আপনার ঘ্রাণ সব কিছু অনুভব করতে চাই আমি। আপনাকে আগলে রাখতে চাই শেষ নিশ্বাস অব্দি। আমি মৃত্যুর শেষ মুহুর্ত অব্দি আপনার সাথে থাকতে চাই। আপনার ভালোবাসা চাই। জীবনের প্রত্যেক রন্ধ্রে রন্ধ্রে কেবল আপনাকে চাই। আমার শিরা উপশিরায় কেবল স্ত্রী রুপে আপনাকে চায়,আপনার ভালোবাসা চায় ।আমি ভালোবাসি, খুব ভালোবাসি আপনাকে প্রিয়তমা হবু বিবিজান।

ইতি
আপনার প্রেমে মাতোয়ারা রুহুল সিরাজী।

চিঠিটা পড়ে দেবী আরেকদফা রুহুলের প্রেমে পড়লো। ডুকরে কেদে উঠলো। চিঠিটা বুকে জড়িয়ে চিৎকার করে বললো, “কেন আল্লাহ কেন এই পৃথিবীতে একমাত্র আমাকেই এত কষ্ট সইতে পাঠালেন। তাকে তো কোনো দিন আমি আমার জীবনে চাইনি, ভালো বাসতেও চাইনি।তবে কেন তার প্রতি আসক্ত করলেন। কি করে শাস্তি দেবো বলুন যে আমায় নিয়ে শেষ নিশ্বাস অব্দি বাচতে চায়। যে জান্নাতের সত্তর টি হুরের বদলে আমায় চায়। যে মৃত্যুর পর জান্নাতেও আমার সাথে তাল মিলিয়ে হাটতে চায়। সব কিছু যখন আমি না চাইতেই আমায় দিয়েছেন তাহলে তাকে শাস্তি দেওয়ার ক্ষমতাও আমায় দিন। আমার মায়ের রক্তমাখা হাত ছুয়ে দেওয়া কথা কিভাবে ফিরিয়ে নেবো আমি।পারবো না আমি ফিরয়ে নিতে আমার মাকে দেওয়া কথা।পারবো না আমার বাবার হত্যাকারীকে ক্ষমা করতে। পারবো না আমি।”

চলবে…..

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here