দেশলাই-০১
জবরুল ইসলাম হাবিব
বাসর রাতেই রাফসান ভাই ক্রোধে তার বউয়ের গালে জোরে একটা থাপ্পড় দেয়।
বাড়ি ভর্তি তখন মেহমান কিলবিল করছে। অশ্রাব্য ভাষায় গালাগাল শুনে আমরা সবাই সেদিকে ছুটে যাই। ‘ঠাস’ করে দরজা খুলে বাইরে আসে রাফসান ভাই। তার ক্রোধান্বিত চেহারা আর লাল টকটকে চোখ দেখেই আমি বুঝে গেছি পুরাতন সমস্যাটা ফিরে এসেছে। দীর্ঘদিন মেয়ে মানুষকে সহ্য করতে পারতো না। বদ্ধ উন্মাদের মতো ছিল। বাড়িতে বাইরের কোনো মেয়ে এলে গালিগালাজ শুরু করে দিতো।
তবে আমার সঙ্গে সব সময়ই স্বাভাবিক আচরণ ছিল। আমি তার মামাতো বোন ইলি। কবর গলির শেষ মাথায় আমাদের বাড়ি। পাকা দালান ঘরের উপরে সবুজ রঙিন টিন। সামনে বুক আবধি দেয়াল তুলে বাউন্ডারি ফেরানো। দেয়াল ঘেঁষে নিজ থেকে অযত্নে বেড়ে উঠেছে মাইকের মতো কলমি ফুলের গাছ। কেটে পরিষ্কার করার কথা ছিল। পিংক কালারের এই ফুলগুলোর প্রতি মায়া জন্মে যাওয়ায় গাছের আয়ু বেড়েছে। আমাদের বাড়ি এ পাড়া থেকে পায়রা গলি দিয়ে হেঁটে যেতে মিনিট দশেক লাগে। গ্রামের নাম বকুলপুর। থানা টাউনের লাগোয়া গ্রাম যেরকম হয় সেরকমই। বকুল পুর আর মধুশ্বরী শহরের মাঝখান দিয়ে ট্রেনের রাস্তা গিয়েছে। দুই পাশে সারি সারি শিরিষ গাছ। রাস্তার ওপর পাশে বকুল পুর স্কুল এন্ড কলেজ। স্কুলের গেইটের বামপাশে আছে একটি শিউলি ফুলের গাছ।
রাফসান ভাইদের বাড়ি এলাকার একেবারে পশ্চিমে। উত্তর দিকে শত বছর আগের একটা নদী মরে বিল হয়ে আছে। ছোটবেলায় দেখতাম এ পাড়ার পুরুষ-মহিলারা বিলে গিয়ে সমানতালে গোসল করতো। গোসলের ব্যাপারটা আমার মনে থাকার অবশ্য কারণ আছে। বিলের দক্ষিণ পাড়ে উঁচু ভিটের উপর ছিল হিন্দু বাড়ি। সন্ধ্যায় “উলুউলু” আওয়াজ শোনা যেতো। বাড়ি ভর্তি কড়া ঘ্রাণের নাম না জানা ফুল গাছ ছিল। ওবাড়ির দিদিরা আমাদেরকে মাটির তৈরি পুতুল, পাখি দিতেন। সেসবে নানান ধরনের রঙ দেওয়া থাকতো। হিন্দু নিরীহ মেয়েরা গোসলে নামলে মতি মিয়া গিয়ে লাটিম গাছে বসে থাকে। প্রায়ই সুযোগ পেলে সেও বিলে নেমে যুবতীদের জাপ্টে ধরে বুকে আবধি হাত লাগিয়ে দেয়। ওরা কোনোভাবে ধস্তাধস্তি করে নিজেকে ছাড়িয়ে ‘হায় ভগবান, হায় ভগবান’ করে দৌড়ে পালায়। এসব নিয়ে তখন নানান সময় বিচার-আচার হয়েছে। মতি মিয়া ক’বছর আগে বয়সজনিত রোগে মারা গেল। গ্রামে এখন আর ওই হিন্দু বাড়িগুলোও নেই৷ কোথায় না-কি চলে গেছে ওরা। ইন্ডিয়া হবে হয়তো। গ্রামটিও আগের মতো নেই। চিত্রে, চরিত্রে পরিবর্তন এসেছে। আমার আর বয়স কত হবে? সবেমাত্র নারী হলাম। এই অল্প বয়সেই চোখের পলকে যেন গ্রাম হতে যাচ্ছে শহর। মানুষের সঙ্গে মানুষের যোগাযোগ কম। শহুরে হাওয়ায় সবকিছু দ্রুত পাল্টে যাচ্ছে। বকুল পুরের এখন হাওয়া বদলের পালা।
রাফসান ভাই মেয়েদের সহ্য করতে না পারার পেছনে একটি মর্মান্তিক ইতিহাস আছে। সেটা ছ্যাঁকা-ট্যাকা খাওয়ার মতো পুরোপুরি সিনেমাটিক না। তবে সিনেমা থেকেও বেশ নাটকীয়। অবিশ্বাস্য এই ঘটনা উঠতি বয়সেই রাফসান ভাইয়ের সঙ্গে ঘটে৷ আমি ছাড়া আর কেউ সেগুলো স্পষ্ট জানে না। রাফসান ভাই তখন বিয়ে না করারও সীদ্ধান্ত নিয়েছিল। একা জীবন কাটিয়ে দেওয়ার প্রতিজ্ঞায় ছিল অটল। তবুও এই বিয়েটি তার সম্মতিতেই হয়েছে। মা-চাচিরা বিয়েতে রাজি করানোর জন্য যা যা করা দরকার সবই করে অসাধ্য সাধন করেছিলেন। কিন্তু এতোকিছুর পর বিয়ে হলেও টিকেনি। পরবর্তীতে সব জেনেছি। মেয়েটি নানাবাড়িতে থাকে। বাবা-মা কেউ নেই। কিন্তু কনে কিছুতেই চায়নি সত্য গোপন রেখে প্রতারণা করতে। অন্যদিকে প্রকাশ করে কোথাও বিয়ে হচ্ছিল না। তাই মামি, খালা, ফুপু সকলেই বোঝালেন মা-বাবা কেউ নাই তোকে পালবে কে? তোর ভবিষ্যৎ আছে না? কোনোমতে বিয়েটা হয়ে গেলে পরবর্তীতে জেনে গেলেও সমস্যা হবে না। এভাবে সবাই এতিম এই মেয়েকে নানান কিছু বুঝিয়ে বিয়েতে রাজি করায়। শেষ অবধি গোপন রেখেই বিয়ে হয়। কিন্তু নিজের ভেতরকার অপরাধবোধ থেকে বাসর ঘরেই নববধূ বলে ফেলল, ‘আসলে আপনাদের কাছে একটা বিষয় গোপন রাখা হয়েছে।’
রাফসান ভাই বিস্মিত হয়ে বললো, ‘কি?’
সে ঘোমটা সরিয়ে জানায়, ‘আমার কখনও সন্তান হবে না। মাত্র সতেরো বছর বয়সেই ঋতু বন্ধ হয়ে যায়। ডাক্তাররা জানিয়েছিল আমার আর কখনও সন্তান হবে না।’
রাফসান ভাইয়ের মাথায় আগুন ধরে যায়। চড় দিয়ে অশ্রাব্য ভাষায় গালিগালাজ শুরু করে। এমনিতেই সে মেয়ে মানুষ সহ্য করতে পারতো না। এখন আবার এতো বড় একটি প্রতারণার শিকার। রাফসান ভাই চিল্লাচিল্লি করে বাসর ঘর থেকে বাইরে আসে।
ফুপু গিয়ে হাত ধরে জিজ্ঞেস করলেন, ‘কি হয়েছে?’
হেঁচকা টানে হাত ছাড়িয়ে বলল,
– ‘কি হয়েছে মানে? বেইমানের সঙ্গে সংসার করা যায় না৷ এরা বেইমানের জাত। মেয়েরে বাপের বাড়ি পাঠিয়ে দাও। এই বিয়ে আমি মানি না।’
কথাটি বলেই রাফসান ভাই পুকুর পাড়ের দিকে ছুটে যায়। পেছন থেকে ফুপু ‘রাফসান, রাফসান’ করে ডাকেন। না ফিরে হেঁটে হেঁটে রাতের অন্ধকারে মিলিয়ে যায় রাফসান ভাই। সেই যে গেল, আর দেখা নেই। যোগাযোগ নেই। আমি কিছুদিন পর পর ওর নাম্বারে কল দেই, ফোন অফ দেখায়। পুরুষ মানুষ যে কেন এতো নিষ্ঠুর, কঠিন হয় আল্লাহ জানেন! মানলাম সেদিন তার একটু রাগই হয়েছিল। তাই বলে এভাবে সবাইকে ছেড়ে হারিয়ে যাবে? তাছাড়া এসএসসি দিয়ে সে বায়না ধরেছিল বকুল পুর কলেজ রেখে ইন্টারে ভর্তি হবে গিয়ে সিলেট। সেখানে মেসে উঠবে। ওর চাচারাও না পারতে রাজি হয়ে যায়। তারপরের ইতিহাস খুবই করুণ। এরজন্য দায়ী হচ্ছে রাফসান ভাই নিজে। আমি একদিন বললাম, ‘সিলেট গিয়ে কি হবে? এখানে তো কলেজ আছেই। বাড়ি থেকে পড়ালেখা করতে পারবে।’
সে ভাব নিয়ে বলল, ‘মেসে থাকবো৷ বিন্দাস লাইফ। কোনো প্যারা নাই। যা ইচ্ছা করা যাবে। তুই এসব বুঝবি না।’
ওর ইচ্ছেই ছিল একা একা ‘বিন্দাস’ লাইফ কাটাবে। কেউ ঘাটাবে না। স্বাধীন আর স্বাধীন। এবারও হয়তো বাড়ি থেকে পালিয়ে নাম্বার পাল্টে বেঁচেছে। কি শান্তি! কিছু কিছু পুরুষ মানুষরা আসলে এমনই। এরা সুযোগ পেলেই নিরুদ্দেশ হতে চায়। আর একটু আঘাত পেলে তো পরিচিত জগত ছেড়ে কোথাও হারিয়ে গেলে যেন বাঁচে তারা। যেখানে কেউ তাদের চিনবে না। কেউ ঘাটাবে না। একা একা নিজের মতো থাকবে। বন্ধনহীন, ছন্নছাড়া জীবনের প্রতি যতিহীন ঝোঁক। এইসব পুরুষরা দীর্ঘ জীবনে অসংখ্যবার ভাবে সবকিছু ছেড়ে-ছুড়ে নিরুদ্দেশ হয়ে যেতে। আমি সকল বিখ্যাত ব্যক্তিদের ইতিহাস পড়ে দেখেছি, অনেকেই সবকিছু ছেড়ে বেরিয়ে গেছেন। অনেকে অতীতের একটু আঘাতের জন্য বিয়েও করেননি। কেউ কেউ এগুলো না করলেও অন্ততপক্ষে পরিবার-পরিজন ছেড়ে দূরে থেকেছেন। অসংখ্য সৃষ্টিশীল মানুষ বিয়ে করেননি। জগত বিখ্যাত সৃষ্টিশীল মানুষ, যুগ শ্রেষ্ঠ পুরুষ। তাদের তালিকা করলে দেখা যাবে অনেকেই অবিবাহিত। এগুলো ভাবলে মন খারাপ হয়। আমরা নারীদের শরীরে আছে জীবন মূল। পুরুষ মানুষ সেখানে বীজ বপন করবে৷ সেই বীজ থেকে নারীর জরায়ুতে ফুল ফুটবে। একজন বিখ্যাত, জ্ঞানীগুণী, সৃষ্টিশীল মানুষের বীজ থেকে আরেকজন সৃষ্টিশীল মানুষ জন্ম নেওয়ার সম্ভাবনা প্রবল। বেশিরভাগ সন্তানই তো মা-বাবার কিছু না কিছু পায়। তাহলে বিয়ে না করা কি ঠিক হলো? আচ্ছা রাফসান ভাইও কি হারিয়ে না গিয়ে আরেকটি বিয়ে করতে পারতো না?
আমি প্রচুর বই পড়ি৷ এই কারণে বোধহয় সবকিছু নিয়ে ভাবাভাবির অভ্যাসটা হয়ে গেছে। আর হ্যাঁ, আমার আরেকটি বদ অভ্যাস আছে। বেশি কথা বলা। গল্প বলা শুরু করলে পাখির মতো এক ডাল থেকে আরেক ডালে উড়াল দিয়ে চলে যাই।
নববধূর পাশে গিয়ে বসেছিলাম। মেয়েটি দুই হাতে মুখ ঢেকে কান্নায় বারংবার কেঁপে কেঁপে উঠছে। ঘরে উৎসুক মহিলাদের ভিড়। নানান প্রশ্নবাণে মেয়েটি জর্জরিত। রাফসান ভাইকে ডেকে ব্যর্থ হয়ে ফুপু বধূর ঘরে এলেন। তাকে দেখেই জা একজন ছুটে গিয়ে জানাল, ‘বড় ভাবি, মাইয়া তো বন্ধ্যা।’
ফুপুর মাথায় যেন আসমান ভেঙে পড়লো। ছুটে এলেন নববধূর পাশে। বধূ দুই হাতে মুখ ঢাকা। পিঠে ধাক্কা দিয়ে বললেন, ‘এই বেটি, বড় টাইট হইয়া বইসা আছস দেখি। কি শুনি এইগুলা। বন্ধ্যা না-কি তুই? হেএএ? এই কথা ক বান্দি। আমার ছেলের সর্বনাশ কইরা টাইট হইয়া বইসা আছস৷ তোর মামা-মামি তো আগে কিছু বলেনি। বন্ধ্যা মাইয়া আমাদের গছাই দিল ক্যান? ঝাড়ু দিয়া পিটাইয়া ঘর থাইকা বার কইরা দিমু। উঠ এখান থাইকা, উঠ।’
চলবে