দেশলাই -১১,১২

0
470

দেশলাই -১১,১২
জবরুল ইসলাম
১১ পর্ব

তারা ঝোপঝাড়ের আড়ালে লুকিয়ে গেল।
লোকটি টর্চ লাইট জ্বেলে জঙ্গলের ভেতর দিয়েই যাচ্ছে।

শফিক ফিসফিস করে বলল,
– ‘কি রে এতো রাতে এদিকে যাচ্ছে কেন?’

– ‘কি জানি। আমাদের কোম্পানিতেই যাচ্ছে হয়তো। স্টাফের লোকেরা ছিটকিনি খুলে দেওয়ার জন্য কাউকে তো কল দিতেও পারে।’

– ‘হ্যাঁ, তাই হবে।’

– ‘কিন্তু আরেকটা সমস্যা আছে। ভোরে কিন্তু লোকাল মানুষ বদনা হাতে পেছনের জঙ্গলে টয়লেট করতে আসে। তাদের খোলা আকাশের নিচেই টয়লেট করা নিয়ম।’

– ‘হ্যাঁ, এটাও চিন্তার বিষয়। এক কাজ করি। ব্যাগগুলো সব দূরে কোথাও ফেলে আসি৷ ভোরে শুধু জঙ্গলের এদিক-ওদিক হাঁটাহাঁটি করে সময় কাটাতে হবে।’

সকল ব্যাগ দূরের ঝোপঝাড়ের আড়ালে ফেলে এলো তারা। রাফসান বসতে বসতে বলল,
– ‘টাকা দু’জনের মানিব্যাগে যা রাখা যায় রাখি। বাকি সব তোর ব্যাগে রাখ।’

কথামতো টাকা ভাগাভাগি করে নেয় তারা। রাফসান একবার চারদিকে উঁকিঝুঁকি মেরে দেখে এসে বলল,
– ‘শোন, এখন আমাদের কাজ হচ্ছে বাইরে খাওয়া। আর কোথায় অনলাইনে ট্রেনের টিকেট কাটা যায় তা বের করা।’

– ‘মানে? মরবি না-কি? নকল কার্ড দিয়ে টিকেট কাটতে গিয়ে যদি ধরা পড়ি? স্কেন করলেই তো শেষ। সাধারণ ট্রেন চালু ছাড়া যাওয়া যাবে না৷ তাছাড়া আমাদের কাছে তো বর্তমানে কোনো দালালেরও নাম্বার নেই।’

– ‘আমরা প্রথমে অনলাইন টিকেট কাউন্টারের সামনে গিয়ে দেখবো কার্ডের শুধু নাম্বার আর নাম নেয় কি-না। যদি সেরকম হয় তাহলে স্কেন না করতেও পারে। তার আগে তোর ব্যাগে দেখ আমার মোবাইলটা আছে কি-না। কোথাও মোবাইল চার্জ দিয়ে ব্যাগে পাওয়া সিমটি ঢুকাতে হবে। বাকি সব পরে দেখা যাবে।’

– ‘মোবাইল আছে। তাহলে আমাদের কাজ এখন অনলাইন কাউন্টার খোঁজা? আর রাতে থাকবো কোথায়?’

– ‘বললাম না পরে দেখা যাবে। আজকের কাজ কাউন্টার দেখা। মোবাইল চার্জ দেয়া।’

– ‘আচ্ছা ঠিক আছে।’

দু’জন গাছের শেকড়ে চুপচাপ বসে আছে। মাঝে মাঝে উঁকিঝুঁকি মেরে চারপাশ দেখে আসে। কিন্তু মশার যন্ত্রণায় জীবন অতিষ্ঠ হয়ে যাচ্ছে। ধীরে ধীরে অন্ধকার গিলে আলো ফুটতেই লোকাল মানুষ বিড়ি টানতে টানতে বদনা হাতে জঙ্গলের ভেতরে আসা শুরু করে। রাফসান শফিক তখন ব্যস্ত ভঙ্গিতে পথিকদের মতো হাঁটাহাঁটি করে। ছয়টা হতেই জঙ্গল থেকে বের হয় তারা। পাকা রাস্তা ধরে হাঁটতে শুরু করে। ভোরের শীতল হাওয়া। পাখির কিচিরমিচির। কলকাতা ছাড়া ভারতের অন্যান্য সকল রাজ্যেরই অসাধারণ রাস্তা। রাস্তার মাঝ দিয়ে সারি সারি গাছ। প্রতিটি বাসার সামনে নানান ধরনের ফুল গাছ। রাতের ক্লান্তি তাদের দূর হয়ে গেল। লক্ষ্য হচ্ছে এই এলাকা ছেড়ে দূরে কোথাও চলে যাওয়া। ঘন্টা খানেক মেইন রাস্তা ধরে হেঁটে একটা ছোটখাটো বাজার পাওয়া যায়। দু’জন একটা রেস্টুরেন্টে ঢুকে চিকেন বিরিয়ানি খেয়ে নেয়। এখানকার বিরিয়ানিও কম দামে পাওয়া যায়। তারপর একটা অটোওয়ালাকে হিন্দিতে জিজ্ঞেস করলো আশেপাশে কোন বাজারে অনলাইন টিকেট কাউন্টার পাওয়া যাবে কি-না। অটোওয়ালা মোবাইল ম্যাপে খানিক্ষণ ঘাটাঘাটি করে। ইন্ডিয়ান অটো ওয়ালারা মোটামুটি ইংলিশ পড়া এবং স্মার্টফোন চালানো জানে। তাদেরকে জানালো আশেপাশে অনলাইন কাউন্টার নেই৷ যেতে হবে নারসিঙ্গী বাজার। ভাড়া আসবে পাঁচশত টাকা। তারা উঠে গেল। সেখানে গিয়ে দেখে দোকান বন্ধ করা। আশপাশের লোকদের জিজ্ঞেস করে জানে দুপুরের পর খুলবে। তারা একটা রেস্টুরেন্টে গিয়ে বসে। ভাগ্যগুণে সেই রেস্টুরেন্টেই পেয়ে গেল একজন কলকাতার ওয়েটার। রাফসান আর শফিকের কথাবার্তা শুনে এগিয়ে এসে বাংলাতেই জিজ্ঞেস করলো কি খাবে। রাফসান সমুসা সিঙ্গারার সঙ্গে বললো, আমার ফোনটা একটু চার্জ দিয়ে দিন দাদা। অফ হয়ে যাওয়ায় ঝামেলায় পড়েছি।’
ওয়েটার মোবাইল নিয়ে চার্জে লাগায়। টুকটাক বাক্যবিনিময় হলো। তার বাড়ি পশ্চিমবঙ্গের উল্টাডাঙা। তারা বললো বনগাঁ। এখানেই সময় কাটাতে লাগলো তারা। ঘন্টা খানেক বাদেই কাউন্টার খুলে। লোকজন ভীড় করছে। দূর থেকে দেখা যাচ্ছে দোকানী টিকেট হাতে কিসব করে বুঝা যায় না। স্কেন করে কি-না কে জানে৷
রাফসানের মাথায় একটা বুদ্ধি খেলে যায়। কার্ডের ছবি মোবাইলে তুলে দেখাবে। চাইলেও স্কেন করা যাবে না। আর যদি বলে মোবাইলের ছবি দিয়ে হবে না। তারমানে স্কেনের ঝামেলা আছে। তারা রেস্টুরেন্টে ফিরে যায়। মোবাইলে জিও সিমটাও ভরে নেয়। ছবি তুলে দু’জনের নকল কার্ডের। আসার সময় ওয়েটারকে অতিরিক্ত পঞ্চাশ টাকা দিয়ে খুশি করে ওর নাম্বারটাও আনে। কোনো তথ্যের জন্য কল দেয়ার দরকার পড়তে পারে। শফিকের বুক দুরুদুরু করছে। সে কাউন্টার থেকে দূরেই দাঁড়িয়ে রইল। রাফসান গিয়ে বলল, ‘দাদা ট্রেনের টিকেট আছে?’ (হিন্দিতে)
দোকানী হিন্দিতে জানায়, ‘আজকের টিকেট নাই। গতকাল সব শেষ হয়ে গেছে৷ এখনকার নিয়ম হচ্ছে একদিন আগে টিকেট কাটতে হবে। আজ আপনি আগামী কালের টিকেক বুকিং দেয়া লাগবে৷ আরও পিছিয়ে কাটতে চাইলে অগ্রীম এখন হবে না।’

রাফসান দ্বিধায় পড়ে গেল। সে কালকে টিকেট কেটে কোথায় যাবে? দালালদের কোনো নাম্বারই তো তার কাছে নাই। তবুও আমতা-আমতা করে বলল,
– ‘দু’টা টিকেট কত?’ ( হিন্দিতে)
– ‘করোনার কারণে একটু বেশি। বারোশ হবে৷’ ( হিন্দিতে)

সব দ্বিধা ঝেড়ে ফেলে সীদ্ধান্ত নেয় টিকেট কাটবে। ভাবাভাবির জন্য আজ পুরো রাত আছে। ট্রেনেও ভাবা যাবে৷ আগে কলকাতা যাওয়া যাক। সাহস করে মোবাইলে কার্ডের ছবি বের করে বলল,
– ‘দু’টা টিকেট দিন।’

লোকটি মোবাইল হাতে নিয়ে বলল,
– ‘কার্ড সঙ্গে নাই?’

– ‘কোম্পানি থেকে আমাদের ব্যাগ চুরি হয়ে গেছে দাদা। বাড়ি থেকে মোবাইলে ছবি আনিয়েছি।’

লোকটি আর কোনো কথা না বলে কাজ করতে লাগলো। খানিক বাদে টিকেট বাড়িয়ে দিয়ে বলল,
– ‘টাকা দিন।’

রাফসান টাকা দেয়। লোকটি বলল,
– ‘হায়দ্রাবাদ সিকান্দারাবাদ জ্যাকসন থেকে কাল বিকাল তিনটায় হাওড়ার ট্রেন।’

– ‘ঠিক আছে।’

রাফসান টিকেট নিয়ে বাইরে এসে হাফ ছেড়ে বাঁচে। এবার তিনটি ধাপ, হায়দ্রাবাদ স্টেশনে ঢোকা, ট্রেন এবং হাওড়া স্টেশন থেকে বের হতে কোনো সমস্যা না হলেই হয়।
শফিক ঘেমে গেছে। রাফসানকে দেখেই এগিয়ে এসে বলল,
– ‘কি অবস্থা রে?’
রাফসান রাস্তার দিকে হাঁটতে হাঁটতে বলল,
– ‘ভয় নেই। আগামী কালের টিকেট কেটেছি।’
– ‘কি! আগামী কাল?’
– ‘হ্যাঁ।’
– ‘মরবি না-কি? দালাল ছাড়া কীভাবে যাবি? তাছাড়া করোনার সময় স্টেশনে ঢুকতে যদি সমস্যা হয়। ট্রেনে যদি টিটি এসে চেক করে? হাওড়া স্টেশনে যদি ঠিকানা দেখে কোয়ারান্টাইনে পাঠায়?’

– ‘হাওড়ার আগের স্টেশনে নেমে অটো করে আবার হাওড়া চলে যাবো।’

– ‘হাওড়ার আগের স্টেশনে এসে গেছিস বুঝবি কীভাবে?’

– ‘মোবাইলে রিচার্জ করতে হবে৷ একটা চার্জারও কিনতে হবে৷ ট্রেনে মোবাইল অফ হলে ঝামেলা। সবকিছু ম্যাপ দেখে বুঝতে হবে।’

– ‘আর হাওড়া যাওয়ার পর?’

– ‘বললাম না পরেরটা পরে। আগে যাই। অনিমেষ দা নাম্বার দিয়ে গিয়েছিল না। তাকে কল দেবো৷ একটা ব্যবস্থা হয়ে যাবে।’

– ‘আজকে রাত কোথায় থাকবি?’

– ‘রাতের খাবার কোনো রেস্টুরেন্টে খেয়ে আমাদের কোম্পানির পেছন দিকে কলোনিতে ঢুকে পড়ব। সিকিউরিটি তো এখন স্টাফদের সঙ্গে থাকে। কলোনি পুরো খালি।’

– ‘তা হবে।’

দু’জন আনমনে হাঁটাহাঁটি আর নানান আলোচনায় দিন কাটিয়ে দেয়। রাত হতেই খাবার খেয়ে অটো করে আবার চলে গেল হাফিজপেট। কলোনিতে গিয়ে চুপিচুপি দরজা খোলা দেখে একটা রুমে ঢুকে গেল। যদিও মশার কামড়ে রাতে এক ফোটাও ঘুম আসেনি। ভোরে আবার বেরিয়ে গেল রাস্তায়। হাঁটতে হাঁটতে চলে গেল গতদিনের বাজারে। মোবাইলে রিচার্জ আর নাস্তা করে একটা অটো রিজার্ভ করে চলে যায় স্টেশনে। বাইরে বসে বিকেল তিনটা অবধি অপেক্ষা করতে হয়৷ কি হবে দুশ্চিন্তায় তাদের বুক ধুকপুক করে৷ কিন্তু স্টেশনে ঢুকতে কোনো সমস্যা হলো না। তারা বিকেল তিনটায় ট্রেনে উঠে। স্টেশন কর্তৃপক্ষের দায়িত্বের ফাঁকফোকড়ে সকল সম্ভাব্য বিপদে থেকেও বেঁচে যায়৷ ট্রেনে একদিন কেটে যাওয়ার পর কল দেয় ফোর ম্যান অনিমেষকে। সে জানায় পুরো পশ্চিমবঙ্গ কালই এক সপ্তাহের জন্য লকডাউন হয়ে যাবে। করোনা বেড়ে গেছে। সুতরাং হাওড়া এসে তারা বিপদে পড়বে৷ অন্যদের সরকারি গাড়ি পৌঁছে দেবে। রাফসান জানায় তারা আগের স্টেশনে নামবে।
অনিমেষ আরও বকাবকি করে ফোন রেখে দেয়। রাফসান আঁজলা করে মুখ ঘষে। চুল টানে। খানিকপর আবার অনিমেষ কল দিয়ে বলে, ‘কোনো দালাল তাদেরকে স্টেশন থেকে গিয়ে আনতে রাজি হচ্ছে না।’ তবে বনগাঁ চলে যেতে পারলে দালালরা বর্ডার পাস করতে পারবে। ট্রেন এক সময় হাওড়ার আগের স্টশনে থামে। তারা বাইরে বের হয়। কিন্তু লক ডাউনের জন্য বনগাঁ যেতে পারে না। অনিমেষ মোবাইলে কথা বলতে বলতে তাদেরকে একটা মন্দিরের সন্ধান দেয়। পাহাড়ের উপরের এই বিশাল মন্দিরের বারান্দায় তারা সপ্তাহ খানেক থাকতে হবে। অনিমেষ একটা নাম্বার দিয়ে বলেছে কেউ এসে কিছু জিজ্ঞেস করলে বলতে হবে বাবলা দা’র পরিচিত মানুষ।

চলবে….

দেশলাই – ১২ পর্ব

বিশাল পাহাড়ের ওপরে মন্দির। সেখান থেকে চারপাশে তাকালে গাছগাছালিকে মনে হয় সবুজ রঙের লোমশ চাদরে ঢাকা।
সপ্তাহ খানেক খুবই কষ্টে থাকতে হয়েছে তাদের। রাতে ঘুমোতে পারলেও দিনে মন্দিরে থাকা যায় না। এদিকে লক ডাউনের কারণে রাস্তায় গেলে বিপদ।
সুতরাং দিনে তারা জঙ্গলে কাটায়। মোবাইলে চার্জ থাকে না। মন্দির থেকে বের হয়ে পাড়ার সম্মুখের মুদির দোকানে বাবলা দা’র সঙ্গে ফোনে কথা বলানোর পর থেকে মোবাইলে অল্প চার্জ দিয়ে দেয়।
সেখান থেকেই কেবল কলা পাউরুটি জাতীয় খাবার খেয়েই কাটাতে হয়েছে পুরো সপ্তাহ। তবে আশার ব্যাপার হলো অনিমেষ খানিক আগে কল দিয়ে জানিয়েছে, সাত দিনের লকডাউন আজ শেষ হয়েছে। আবার দিয়ে দিতে পারে। সুতরাং অটো নিয়ে হাওড়া যেন চলে যায়। সেখান থেকে বাসে করে বনগাঁ।’

অনিমেষের কথামতো তারা অটো নিয়ে হাওড়া যায়। সেখান থেকে লোকজনকে জিজ্ঞেস করে বনগাঁর বাস খুঁজে বের করতে হয়েছে। অনেক ঝুকিপূর্ণ ছিল। কারণ হাওড়া থেকে দালালরা দেখেশুনে লোক আনে এবং নেয়। অথচ তারা নিজে গাড়ি খুঁজে বের করে যেতে হয়। বনগাঁ এসে অনিমেষ দেখা না করলেও দালালরা তাদেরকে রিসিভ করে। অনিমেষ শেষ কল দিয়ে শুধু বলল,
– ‘জানে বেঁচে গেছিস মাইরি। করোনার মাঝে তোরা এতোদিন বেঁচে আছিস এটাই অনেক ভাগ্য বাড়া। সবই ভগবানের কৃপা আর মা-বাবার আশীর্বাদ, বুঝলি? আমি দেখা করতি পারলাম না। করোনার সময় বুঝিস তো। তোদের বৌদি যেতি দিচ্ছে না। তা ভালো থাকিস, রাখছি। ভগবান তোদের মা-বাবার কাছে ভালোভাবে পৌঁছাক।’

রাফসান আর শফিকের চোখ জলে ভরে গেল। ভাষা আর আদি বন্ধনের কারণে বাংলাদেশীদের প্রতি তাদের সীমাহীন ভালোবাসা। অনিমেষের এতটুকু উপকারের জন্য তারা চির কৃতজ্ঞ থাকবে।

দালালরা তাদেরকে দু’দিন জঙ্গলের খুপরি ঘরটিতে রাখে। সেখানে আরও ছয়জন পাওয়া গেল। তারা কলকাতায়ই ছিল। এখন বাংলাদেশে যাবে। কিন্তু লাইন ক্লিয়ার হচ্ছে না। অন্যদিকে বাংলাদেশে লকডাউন পুনরায় হওয়ার সম্ভাবনা আছে। বাংলাদেশী দালালদের চাপে তারা ঝুঁকি নিয়ে আটজনকে নিয়ে যায় নদীয়ার দিকে। দিনে একটা বাড়িতে রেখে রাতে হাঁটিয়ে সীমান্তে নেয়। কিন্তু কাঁটাতারের পাশে যেতেই বিএসএফরা দৌড়ানি দেয়। সবাই দৌড়ে জঙ্গলের নানান দিকে ছুটে গিয়ে হারিয়ে যায়। দালালরা আবার সকলকে খুঁজে এনে একত্র করে। একপর্যায়ে গালাগালি করে জানায়, বিএসএফ কখনও জঙ্গলের ভেতরে আসবে না। শুধু সীমান্তের পাশে পেলে ধরবে। সুতরাং দৌড়ে হারিয়ে যাওয়া যাবে না। পুরো রাত রক্ষীদের সঙ্গে লুকোচুরি করে তিনটার দিকে কাঁটাতার কেটে দিল। লাইন ধরে পার করছে। সবার পেছনে শফিক তার আগে রাফসান। আচমকা বিএসফরা চলে এলো কোত্থেকে। রাফসানের আগের সবাই বাংলাদেশ ঢুকে গেছে। সেও দৌড়টা দিল বাংলাদেশের দিকেই। কিন্তু শফিক দ্বিধাদ্বন্দের কারণে ধরা পড়ে গেল বিএসএফের হাতে। রাফসান যেদিকে চোখ যায় খানিকক্ষণ দৌড়াল। তার সামনের ছয়জনের কাউকে পেল না। দৌড়ে কে, কোনদিকে ছুটে গেছে বুঝা যাচ্ছে না৷ রাফসান একা চুপচাপ গহীন জঙ্গলে বসে হাপাচ্ছে। ক্ষুদার্ত নিদ্রাহীন ক্লান্ত বিধস্ত শরীর। এখন সে কোন জায়গায় আছে ঠিক বুঝতে পারছে না। মোবাইলে এখনও ভারতের নেটওয়ার্ক দেখাচ্ছে। অনিমেষকে কল দেয়। অনিমেষ লাইনের লোকদেরকে রাফসানের নাম্বার দিচ্ছে বলে ফোন রাখে। ঘন্টা খানেক পর লাইনের লোকেরা তাকে ফোনে কথা বলতে বলতে বের করে। রাফসান তখনও জানে না শফিক কোথায়। তার ধারণা ওপারে রয়ে গেছে হয়তো।
দেখা হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে লাইনের লোকদের বলল, ‘আমার সাথের জন কোথায়?’
তারা জানায় লাইনের দু’জন লোক সহ শফিক বিএসএফের হাতে ধরা পড়েছে।
রাফসানের মনটা নিমিষেই খারাপ হয়ে গেল।
আমতা-আমতা করে বলল, ‘এখন কি হবে ওর?’
– ‘ক্যাম্পে আমাদের লোক গিয়ে কথা বলবে। যদি বিএসএস টাকা চায়। শফিককে বলা হবে মা-বাবার সঙ্গে কথা বলে টাকা আনতে। কিছুই হবে না।’

তারপর মোবাইল হাতে অন্যদেরও ফোন দিয়ে একত্র করে। সীমান্ত থেকে হাঁটিয়ে নিয়ে যায় একটা বাজারে। দালালদের মাধ্যমে মানিব্যাগের সকল রুপি দিয়ে টাকা এনেছে। সেখান থেকে রাফসানকে বাসে তুলে দেয়। হঠাৎ বাস থামিয়ে পুলিশ সবার ব্যাগ-প্যাক চেক করে। রাফসানের কাছে কোনো ব্যাগ নেই। কেবল মোবাইলে জিও সীম ভরা। কিন্তু কিছুই হলো না। বাস আবার ছেড়ে দেয়। দেশে ফিরেছে অবশেষে৷ হাফ ছেড়ে বেঁচেছে৷ আহা নিজের দেশ। মুক্ত বাতাস। কিন্তু শফিক? শফিকের জন্য খারাপ লাগছে। মনটা বারংবার হু-হু করে কেঁদে উঠছে। তবে ওর ব্যাগে মোটামুটি সব টাকাই রয়ে গেছে। এই টাকা দিয়ে ছুটে আসতে পারলেই হলো। খানিকটা ঘুম পায়। এক সময় ঢাকা আসে। খাওয়া-দাওয়া করে ঢাকা থেকে বাসে উঠে পরেরদিন ভোরে সিলেট। পুরো রাস্তা ঘুমিয়েছে। বকুল পুর ঢুকতেই রাস্তাঘাটে মানুষের প্রশ্নের নির্যাতনে রীতিমতো ক্লান্ত হয়ে গেল সে। প্রশ্ন করারই কথা৷ কেউ জানতো না এতোদিন সে কোথায় ছিল। স্কুল, ট্রেনের রাস্তা, এই মাটি, মানুষ সবকিছুর প্রতি অন্য এক নয়নে তাকাচ্ছে আজ। কবরগলি পেরিয়ে একটা বাড়ির সামনে এসে দাঁড়ায়। পাকা দালান ঘরের উপরে সবুজ রঙিন টিন ওয়ালা বাড়ি। আহা ইলি। এই একমাত্র মেয়ে। যে কি-না তাকে প্রথমেই মুখের ওপর বলে দিয়েছিল ইন্তিশা ভালো মেয়ে মনে হচ্ছে না। সেদিন যদি সে ওর কথা শুনতো তাহলে তার জীবনটা আজ এমন হতো না। রাফসান পরবর্তীতে সবই জেনেছিল। ইন্তিশার বিয়ের আলাপ-টালাপ কিছুই আসেনি। সবই ছিল ওর ছলনা, প্রতারণা। রাফসান গেইট খুলে ইলিদের ঘরে ঢুকে। দরজা ভেজানো। ধাক্কা দিয়ে খুলেই প্রথমে পেল রহিমা বেগমকে। তিনি চমকে উঠার আগেই সে ঠোঁটে আঙুল নিয়ে বলল, ‘চুপ মামী, ইলি কোথায়?’
তিনি হা করে তাকিয়ে রইলেন। কিছুই বলতে পারলেন না। রাফসান ধীরে ধীরে ইলির রুমে গেল। ‘খ্যাঁক’ করে দরজা খুলতেই ইলি মুখের সামনে থেকে উপন্যাস সরিয়ে তাকায়। তারপর আর কোনো কথাই যেন বলতে পারছে না। নিজের চোখকে বিশ্বাস করাতে পারছে না। এ কোন রাফসানকে সে দেখছে? এ কি অবস্থা হয়েছে ওর?

– ‘কেমন আছিস ইলি?’

– ‘তুমি কোথা থেকে? কোথায় ছিলে এতোদিন?’

– ‘বলবো। সবই পড়ে বলবো। শুধু এটা জানতে পারিস৷ আমি এখন পুরোপুরি সুস্থ। এখন আমাদের বাড়ি চল। আম্মা অনেক বকাঝকা দেবেন জানি। তুই থাকলে একটু সামলে নিবি। হা-হা-হা। চল।’

রাফসানের আচমকা মনে হলো ইলির চেহারা ধপ করে নিভে গেছে। ধীরে ধীরে মুখ লাল হলো। তারপর ঠোঁট নড়তে নড়তে নাক ফুলে গেল। অস্ফুটে বলল,
– ‘দাঁড়াও আসছি।’

রাফসান কিছুই বুঝতে পারলো না। ইলি কি কাঁদছে? কিন্তু কাঁদার কারণ কি?

রহিমা বেগম ম্লান মুখে রাফসানের কাছে এসে বললেন, ‘বাবা গোসল করে আমাদের এখানে খাওয়া-দাওয়া করে যাও।’

– ‘না, বাড়িতে চলে যাই মামী। ভয়ে আছি আম্মাকে কি বলবো। আর মামা কোথায়? দেখছি না যে?’

– ‘তোমার মামা বাজারে বাবা। আর তুমি এখানে গোসল করে খেয়ে নাও। আমিও যাবো তোমাদের বাড়িতে।’

রাফসান কিছু বুঝতে পারছে না। তবে কেমন ভয় ভয় করছে তার।

রহিমা বেগম লুঙ্গি আর গামছা এনে দিলেন। রাফসান সাবান হাতে পেছনের শানবাঁধানো পুকুর ঘাটে যায়। খানিক সাঁতার কাটে। বেশ আরাম লাগছে। তবুও মনের ভেতর কীসের আশংকায় ভয় করছে। গোসল করে সে খেতে বসে। রহিমা বেগম টুকটাক কথা বললেন। ইলিও একটা কামিজ পরে ওড়না পেঁচিয়ে বসেছে পালঙ্কে।
রহিমা বেগম জিজ্ঞেস করলেন, ‘এতোদিন কোথায় ছিলে তুমি?’

– ‘ভারত।’

চমকে উঠলেন রহিমা বেগম। ইলিও পালঙ্ক থেকে বলল,
– ‘ভারত মানে? ভারত তুমি হঠাৎ কীভাবে গিয়েছিলে?’

রহিমা বেগম বাঁধা দিলেন,
– ‘বাদ দাও, খাওয়ার সময় এতো কথা বলা ভালো না।’

খাওয়া-দাওয়া শেষ করে রাফসান উঠে দাঁড়ায়। রহিমা বেগম ইলিকে বললেন,
– ‘তুই বাড়িতে থাক মা। আমি যাচ্ছি। বাড়ি খালি রেখে দু’জন যাব না-কি?’

– ‘আচ্ছা তুমি যাও।’

রহিমা বেগম রাফসানকে নিয়ে গেলেন তাদের বাড়িতে। রাফসান নিজেদের ঘরে গিয়ে মা’কে খুঁজে পাচ্ছে না। এদিকে তার চাচি আর মামীরা কীভাবে বলবেন বুঝে উঠতে পারছেন না। ছেলেটি আবার বাড়ি থেকে যদি চলে যায়? আবার যদি মাথায় সমস্যা আসে? রাফসান নিজে থেকেই ছোট চাচীকে এসে বলল,
– ‘আম্মা কোথায় গেছেন?’

তিনি রহিমা বেগমের মুখের দিকে তাকান। রহিমা বেগম বললেন, ‘এখানে বসো বাবা। মাথা ঠান্ডা করে বসো। সব বলছি তোমাকে।’

রাফসান আঁজলা করে মুখ ঢেকে পালঙ্কে বসে। সে যেন খানিকটা বুঝে গেছে। তার জন্য হয়তো কোনো বড়ো দুঃসংবাদ অপেক্ষা করছে। রহিমা বেগম রাফসানের পিঠে এক হাত রেখে বললেন, ‘তোমার মা দুই সাপ্তাহ আগে স্ট্রোক করে মারা গেছেন রাফসান।’

সে মুখ তুলে তাকালো না। মুখ ঢেকেই কেঁপে কেঁপে উঠলো কান্নায়। মায়ের মৃত্যুর জন্য নিজেকেই দোষী মনে হচ্ছে তার৷ ছোট্ট জীবনে সে একটু বেশিই ভুল করে ফেলেছে। বিধবা মা’কে রেখে সেদিন বেরিয়ে যাওয়াটা ঠিক হয়নি৷ এখন সে কি করবে? কি করার আছে? তার জীবনটা এমন হয়ে গেল কেন? মাথা তুলে বলল,
-‘আম্মার কবর কোথায়?’

– ‘তোমার বাবার পাশেই।’

ছুটে গেল পশ্চিমের পারিবারিক কবরস্থানে। তাকিয়ে দেখলো বাবার পাশেই নতুন আরেকটি কবর৷ হাউমাউ করে কাঁদতে থাকে। সবাই গিয়ে টেনে আনেন বাড়িতে।

চলবে…

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here