দেশলাই -১৫,১৬

0
399

দেশলাই -১৫,১৬
জবরুল ইসলাম
১৫ পর্ব

ঢালু পথ দিয়ে মাঠে নেমে খানিকটা হেঁটে যেতেই ইলির চটিজুতো ছিঁড়ে গেল। দাঁত কটমট করে জুতো ছুড়ে ফেলে আবার হাঁটা ধরবে তখনই পেছন থেকে হাঁক এলো,
– ‘এই ইলি হয়েছে কি, চলে যাচ্ছিস যে।’
পেছন ফিরে তাকায় ইলি। রাফসান ভাই বাড়ি থেকে নেমে এদিকে আসছে। ইলি কিছু না বলে দাঁড়িয়ে রইল। রাফসান কাছাকাছি এসে আবার বলল,
– ‘কি রে, কিছু না বলেই চলে যাচ্ছিস যে, টিফিনও নিলি না।’

– ‘টিফিন তো তুমিও নিতে পারবে।’

– ‘বল তো কি হয়েছে? কেউ কিছু বলছে?’

– ‘না৷’

– ‘আর তুই রাস্তা দিয়ে না গিয়ে বন দিয়ে যাচ্ছিস কেন?’

– ‘এদিকে ক্ষেত দেখে যাব। আখের ক্ষেত, সূর্যমুখী ফুলের বাগানও আছে।’

– ‘কিন্তু এখন তো মুখ বাঁকা করে ফুলের সঙ্গে সেল্ফিও তুলতে পারবি না।’

ইলি ফিক করে হেঁসে বলল,
– ‘কেন?’

– ‘তোর মন মেজাজ তো খারাপ মনে হচ্ছে। এই অবস্থায় মুখ বাঁকা করা যায় না।’

– ‘আমার মন অযথা খারাপ হয় না।’

– ‘তাইলে বল যথার্থ কারণটা কি?’

– ‘কিছু না। এখন যাই।’

– ‘এই দাঁড়া, জুতা তো ছিঁড়ে ফেললি। আইলে-টাইলে ভাঙা শামুক থাকলে পা কাটবে আমার চটিজুতা পরে নে।’

– ‘এই আলিশান জুতা আমি পরবো?’

– ‘হ্যাঁ পরবি, এখানে তো কেউ দেখবে না। রোদ উঠেছে, নে তাড়াতাড়ি ফিরে যা। আমি একটু পরেই রেডি হয়ে আসছি।’

– ‘আচ্ছা।’

ইলি আখ ক্ষেত পেরিয়ে সূর্যমুখী বাগানের সামনে গেল। আকাশে ঝকঝকে রোদ। সূর্য কপালে এসে পিছলে পড়েছে। সেল্ফি তুলতে গিয়ে হচ্ছে বিরাট ঝামেলা। সূর্যকে পেছনে রেখে তুলতে গেলে অন্ধকার আসছে সব। আবার সূর্যের দিকে তাকিয়ে বাগানকে পেছনে রেখে তুলতে গিয়ে ওর কপাল কুঁচকে যাচ্ছে রোদে। তবুও ধৈর্যের পরিচয় দিয়ে কয়েকটি ছবি তুলে দেখলো একটাও ভালো হয়নি, নিজেকে পেত্নী লাগছে।
হাঁটতে লাগলো। জুতো বড়ো হলেও খুব বেশি অসুবিধা হচ্ছে না। সোজা এসে তাল গাছের নিচ দিয়ে কবর গলিতে উঠে গেল। বাড়ির গেইট খুলে দেখলো মা উঠোন ঝাড়ু দিচ্ছেন।
তাকে দেখে বললেন, ‘কি রে, পেঁচা মুখ করে ফিরলি যে।’

– ‘আজ মেহমান বাড়ি যাব তো মা, তাই মুখটা আরও কত রূপ ধরবে।’

– ‘তোর আরও কত কি থাকবে।’

– ‘কত কি না মা। আমি প্রায়ই খেয়াল করে দেখেছি৷ কোথাও যাওয়ার আগে আমার মুখ পেত্নী, পেঁচা কত কি হয়। কিন্তু বাড়িতে থাকলে বিশ্ব সুন্দরী।’

– ‘যা যা সর। আর টিফিন কোথায়?’

– ‘রাফসান ভাই আনবে। কিন্তু তুমি পায়ের দিকে তাকালে না যে মা?’

– ‘এ কি রে? তোর পায়ে কার জুতা?’

– ‘আমার জুতা ছিঁড়ে গেছে।’ কথাটি বলেই ইলি হনহন করে নিজের রুমে চলে গেল।

ফ্যান ছেড়ে উত্তরের জানালা খুলে খানিক্ষণ দাঁড়িয়ে রইল ইলি। মন কিছুতেই ভালো হচ্ছে না। একটা মানুষ পদে পদে শুধু ভুল করে গেল। ভুল সিদ্ধান্ত নিল। এখন তার জীবনটা বিলের ভাসমান পানার মতো হয়ে দাঁড়িয়েছে। যেদিকে বাতাস দেবে সেদিকেই পানা যাবে। নিজের হাতে কিছুই নেই। কোনো লক্ষ্য উদ্দেশ্য নেই। অথচ সমস্তকিছু নিজেরই ভুলে হলো। ইলির চোখ জলে ভরে এলো। স্পষ্ট মনে আছে। প্রাইমারি স্কুলে থাকতে হেড স্যার রাফসান ভাইকে নিয়ে খুব গর্ব করতেন। ছোট ক্লাসে পাঠাতেন ক্লাস নিতে। শুধু কি ছোট ক্লাসে? একবার তারা কয়েকজন অযথাই প্রস্রাব করার নামে বাইরে ঘুরাঘুরি করছে। হঠাৎ দেখলো হেডস্যার রাফসান ভাইকে ডেকে ফাইভের ক্লাসে নিচ্ছেন। ইলিরা উঁকিঝুঁকি মারে।
স্যার ব্লাকবোর্ডে ইংলিশে “international”
লিখে ফাইভের কয়েকজন ছাত্র-ছাত্রীকে জিজ্ঞেস করলেন উচ্চারণ কি?
প্রায় সকলে বলল, “ইন্টারনেটিওনাল”
স্যার সব শেষে বললেন, ‘রাফসান, বলো এখানে কি লেখা।’
রাফসান ভাই বলল, ‘ইন্টারন্যাশনাল।’
স্যার সবাইকে অনেক্ষণ ঝাড়ি দিলেন, ‘ক্লাস থ্রি পড়ুয়া একটা ছেলে পারে তোরা পারিস না। দু’দিন পর তোরা গিয়ে বোর্ড পরিক্ষা দিবি। অথচ তোদের ক্লাস থ্রিতে পড়ারও যোগ্যতা নেই।’
জানালার পাশে তাদেরকে দেখেও একটা ধমক দিলেন। দৌড়ে তারা ক্লাসে চলে গেল। এসএসসিতেও জিপিএ ফাইভ পেল মানুষটা। তারপর? বিলের ভাসমান পানা। লোকজন এখন পাগল বলে। ইলির খারাপ লাগে। ওর শৈশবের হিরো যে রাফসান ভাই।

– ‘ইলি গোসল করবি না?’

পেছন ফিরে তাকিয়ে বলল, ‘হ্যাঁ মা করবো।’

– ‘তুই এতো ভাবিস কি বল তো? কপালে যা আছে তাই হবে, বুঝলি? আল্লাহ কাউকে না খাওয়াইয়ে মারবে না। তাছাড়া রাফসানের এখন মা-বাবা না থাকলেও চাচারা আছে।’

– ‘থাকলেও মা। আজ বুঝলাম ওরা বিরক্ত হয়ে উঠেছে৷ তাদেরও বাচ্চাকাচ্চা নিয়ে অভাবের সংসার। তবুও পড়ালেখা বিয়ে-শাদি করালো। আর কি করবে? ভাত না হয় খাওয়ালো। আর তো কিছু করবে না।’

– ‘বিদেশ-টিদেশ পাঠাবে।’

– ‘তোমারে বলছে। কয়েক লাখ টাকা খরচ করে তাকে এখন বিদেশ পাঠাবে? তাদের সংসারই টানাটানিতে চলে।’

– ‘কাজকর্ম করে খাবে। পুরুষ হয়ে জন্মাইছে হাত থাকলে ভাত আছে। যা গোসল কর।’

– ‘হ্যাঁ করবো।’

– ‘আর কি দেখলি। এখন মাথায় সমস্যা-টমস্যা তো মনে হয় নাই।’

– ‘না এখন ঠিকই আছে।’

– ‘মাথা ঠিক থাকলেই হলো।’

ইলি কাপড় সাবান নিয়ে গোসল করতে ঘাটে চলে গেল।

***
ইলিকে বিদায় করে মাঠ থেকে ফেরার পর রাফসান রুমে এসে বসে আছে। তখন বড়ো চাচি নাহেরা বেগম এসে বললেন, ‘রাফসান বাবা, করোনার কারণে স্কুল তো বন্ধ। বাচ্চারা পড়ালেখা বাদ দিয়া খালি টই টই করে ঘুরে বেড়ায়। ওদেরকে একটু পড়া দেখিয়ে দিয়ো তো। এই যাও, ভাইয়ের কাছে পড়তে যাও।’

তারপর দুই চাচার পাঁচজন ছেলে-মেয়ে পড়তে এলো। আরেকজন চাচি একটা মেয়ে নিয়ে বাপের বাড়ি থাকেন। নাহেরা বেগম নিচে মাদুর বিছিয়ে দিয়ে গেছেন। সবাই গোল হয়ে পড়তে বসেছে।

রাফসান বারংবার মোবাইলে সময় দেখছে। এখন বাজে সাড়ে বারোটা। ইলি নিশ্চয় গোসল করে নিয়েছে।
– ‘তোমরা চলে যাও এখন।’

সবাই এক সঙ্গে হুড়াহুড়ি করে চলে গেল। ছোট চাচি এলেন তখনই একটা কাগজ নিয়ে।
– ‘এই বাজারগুলো একটু আনো তো। মুদির দোকানটাতেই সব পাবে।’

আচ্ছা দাও নিয়ে আসছি। রাফসান টাকা আর কাগজ নিয়ে তাড়াতাড়ি হাঁটতে লাগলো। বিল পাড়ের দোকানটা বন্ধ। খাটো রাস্তা ধরে তাড়াতাড়ি হেঁটে গেল রেললাইনের পাশের দোকানটিতে। বাজার নিয়ে ফিরেছে একটা দশে। কাপড় নিয়ে দ্রুত চলে গেল পুকুর ঘাটে। গোসল সেরে খেতে গিয়ে দেখলো রান্না চলছে। খেতে না বলে বলল, ‘ছোট চাচি এক হাজার টাকা হবে?’
– ‘না, এতো টাকা তো হবে না। দেখো তোমার বড়ো চাচিকে জিজ্ঞেস করে।’

বড়ো চাচিকে গিয়ে বলতে হলো না। ঘর থেকেই জবাব দিলেন, ‘টাকা কই পাব? বিদেশ বাড়ি ওরা করোনার লাগি রুজিরোজগার করতেই পারছে না আর টাকা।’

– ‘আচ্ছা ঠিকাছে৷ আমি শ্রীমঙ্গল যাচ্ছি চাচি। কয়েকদিন পর ফিরবো।’

– ‘খেয়ে যাও। মারিয়া রান্না হয়ে গেলে ভাত দাও তাকে।’

– ‘হয়ে যাচ্ছে৷ রাফসান একটু অপেক্ষা করো নামিয়ে ডাকছি তোমাকে।’

– ‘না চাচি। এমনিতেই দেরি হয়ে গেছে। সমস্যা নাই ইলিদের বাড়ি খেয়ে নেবো।’

– ‘এরকম করো না তো রাফসান। ওদের বাড়ি গিয়ে খেলে আমাদের কি বলবে? চাচিরা খেতে দেয়নি তাই সেখানে গিয়ে খাচ্ছ। একটু দেরি হলে মহাভারত অশুদ্ধ হবে না।’

– ‘আচ্ছা। আমি অপেক্ষা করছি।’

খানিক পরেই খানার ডাক এলো। গরম গরম ভাত তরকারি। ফ্যান ছেড়ে দিলেন ছোট চাচি। দ্রুত খেয়ে নিল সে। তারপর ব্যাগটা পেছনে ফেলে বেরিয়ে গেল সে।

ইলি খাওয়া-গোসল শেষ করে রেডি হয়ে বসে আছে। জোহরের আজান হয়ে ঘড়ি দু’টা ছুঁইছুঁই করছে এখনও রাফসান আসার নামগন্ধ নেই। আরেকটু দেরি হলে মা-বাবা আজ যেতেই দিবেন না৷ ইলি রাস্তা থেকে একটু পর পর উঁকি দিচ্ছে। লিয়াকত মিয়া ক্ষেত থেকে দুই হালি শসা নিয়ে এসে বললেন, ‘কি রে রাফসান আসেনি এখনও?’
– ‘না বাবা।’
– ‘গর্দভের লগ ধরেছিস। ওর কি কোনো ঠিক আছে। আচ্ছা দেখিস তো দুইজনের ব্যাগে ভরে শসাগুলো তোর ফুপুদের জন্য নেয়া যায় কি-না।’
– ‘তুমিও না বাবা। শসা কি ফুপুর বাড়ির ওদিকে কিনতে পাওয়া যায় না?’
– ‘আরে পাওয়া যায়। তারপরও ক্ষেতের জিনিস বইন-ভাগ্নীকে দিতে হয়। আগে তো মানুষ প্রথম আম, প্রথম ধানের পিঠাও বইন-ভাগ্নী রেখে খেতো না।’
– ‘আচ্ছা রাখো ঘরে নিয়ে৷ ব্যাগে ভরা যায় কি-না দেখবো।’
– ‘ওই তো রাফসান আসছে।’
– ‘হ্যাঁ, ওই দেখা যাচ্ছে।’

‘চল ঘরে সে আসুক।’ ইলি আর তার বাবা ঘরে গেলেন। রাফসান খানিক পর ইলির ঘরে এসে বলল, ‘ফ্যানটা ছাড় গরম লাগছে।’

ইলি ফ্যান ছেড়ে দিয়ে তাকিয়ে দেখলো খানিকটা ঘেমে গেছে রাফসান। এলোমেলো চুল। কালি পড়া চোখ। পোড়া ঠোঁট। দাড়ি-গোঁফে জঙ্গল মুখ। গায়ে একটা ফুলহাতা পুরোনো শার্ট৷ গ্যাবার্ডিন প্যান্ট। পায়ে কবেকার কেডস। কি বিচ্ছিরি লাগছে দেখতে।

– ‘এতো দেরি হলো কেন?’

– ‘পিচ্চিরা পড়তে এলো তাই দেরি হয়ে গেছে।’

– ‘ও, খাওয়া-দাওয়া করে এসেছো?’

– ‘হ্যাঁ।’

– ‘তোমার ব্যাগে কি দুই হালি শসা ভরা যাবে। ফুপুকে দিতে চাচ্ছেন বাবা।’

– ‘হ্যাঁ ভরা যাবে নিয়ে আয়। পলিথিনের কোনো ব্যাগে করে আন।’

ইলি শসা এনে দিলো।
রাফসান শসা ভরতে ভরতে ফিসফিস করে বললো, ‘আমার কাছে তো টাকা-পয়সা তেমন নাই ইলি। তুই মামার কাছ থেকে টাকা বাড়িয়ে নিতে পারবি?’

– ‘তোমার টেনশন করতে হবে না।’

খানিক পরেই তারা রেডি হয়ে বেরিয়ে গেল। রিকশায় উঠার সময় লতিফ মিয়া রাফসানকে এক হাজার টাকা বাড়িয়ে দিয়ে বললেন, ‘এই টাকা নে। দেখেশুনে যাবি। আর শ্রীমঙ্গল গিয়ে বেড়াতে গেলে বাড়িতে সন্ধ্যার আগে আবার ফিরে আসবি ওরে নিয়ে।’

– ‘টাকা লাগবে না মামা। আমার কাছে আছে।’

– ‘টাকা নিতে বলছি নে।’

রাফসান টাকা নিল। রিকশা চলছে মধুশ্বরী বাজারের দিকে। মধুশ্বরী থেকে তারা শেরপুর গেল একটা সিএনজি করে। সেখান থেকে বাসে উঠলো ঠিক আড়াইটায়।

চলবে…

দেশলাই – ১৬ পর্ব

বাস শাঁ শাঁ করে এগিয়ে চলেছে। দু’জন ব্যাগ কোলে নিয়ে বসা। ইলি জানালার পাশটায়। রাফসান একবার ওর দিকে তাকায়, খুব বেশি সাজগোজ নেই। বুদ্ধিদীপ্ত চোখ। ঘন কালো ভ্রু। রোজকার মতো একাপাশের চুল কানে গুঁজে অন্যপাশের চুল কপাল বেয়ে বুকে এসে পড়েছে৷ চটপটে স্বভাব, কিছুতেই জড়তা নেই। কৃত্রিমতা নেই।

– ‘কি রে চুপচাপ বসে আছিস যে?’

– ‘কি কথা বলবো?’

– ‘সারাক্ষণ বকবক করা তো তোর অভ্যাস। এখন কথা খুঁজে পাচ্ছিস না?’

– ‘আমার বকবকানির অভ্যাস আছে জানি বলতে হবে না।’

– ‘আচ্ছা আমি চলে যাওয়ার পর কি হয়েছিল সেদিন?’

– ‘বুঝিনি কথাটা।’

– ‘আমি বিয়ের রাতে চলে যাওয়ার পর নববধূকে কীভাবে বিদায় করা হলো? কোনো ঝামেলা হয়নি?’

– ‘বিয়ের রাতেই বর যদি বধূকে গ্রহণ না করে বাড়ি ছেড়ে চলে যায় তাহলে কীসের ঝামেলাটাই হবে?’

– ‘এভাবে কথা বলছিস কেন?’

– ‘তুমিই বা এই কথাগুলো বাসে জিজ্ঞেস করছো কেন? বাড়িতে তো জিজ্ঞেস করোনি?’

– ‘আমি মাত্র গত কাল এলাম। তোকে জিজ্ঞেস করবো করবো করে করা হয়নি। আচ্ছা এগুলো এখন থাক পরে জানা যাবে। এখন বল তো হুট করে তোর মেজাজ খারাপ হলো কেন?’

– ‘কেন খারাপ হয়েছে বলবো?’

– ‘বল।’

– ‘আমাকে বাসে বসিয়ে তুমি বাইরে গিয়ে তাড়াহুড়ো করে সিগারেট টেনে এসেছো। এখন গন্ধে আমার বসতে অসুবিধা হচ্ছে তাই মেজাজ খারাপ।’

– ‘ওরে আল্লাহ। তুই এতো খেয়াল করিস কেন সবকিছু?’

– ‘তার আগে বলো তোমার যদি সিগারেট খেতেই হয় বুঝেশুনে খেলে না কেন? তুমি তো জানো সিগারেট টেনেই আরেকজনের পাশে গিয়ে বসবে।’

রাফসান আর কোনো কথা না বলে ম্লান মুখে বসে রইল।
ইলি তাকিয়ে বলল, ‘তুমি রাগ করোনি আমি জানি। রাগ করলে সীট ছেড়ে চলে যেতে। কি বলবে খুঁজে না পেয়ে ভারি মুখ করে বসে আছো।’

– ‘আমি অযথা রাগ করবো কেন? আচ্ছা যা, আমি দাঁড়িয়ে যাচ্ছি। তবে রাগ করে না। এমনিই।’

– ‘না, বসো। তোমার বউয়ের কথা জানতে চাইছিলে।’

– ‘আমার বউ মানে?’

– ‘ওমা এখনও তো সে তোমার বউ।’

– ‘উল্টাপাল্টা কথা বলবি না তো।’

– ‘আচ্ছা শোনো কি হয়েছিল। তুমি চলে যাওয়ার পর ফুপু অনেক ভেঙে পড়েছিলেন। তিনিও বউ রাখবেন না। কিন্তু মুরব্বিরা তোমার অপেক্ষায় ছিলেন। তুমি এলে কনেপক্ষকে ডেকে আলোচনা করে কিছু করা যাবে। কিন্তু তুমি আসছিলে না। বধূও লজ্জা-অপমানে নিজ থেকে বলে ওর অবিভাবকদের ডাকতে সে চলে যাবে। তারপর আর কি। আব্বা ঘটকের মাধ্যমে ওর অভিভাবকদের ডেকে জানালেন মেয়ের অসুখ গোপন রেখে বিয়ে দেওয়ায় বর কনেকে মেনে নিচ্ছে না। বাড়ি থেকেও কোথায় চলে গেছে খোঁজ-খবর নেই। ওরা অবশ্য নানান কথা তুলেছিল। আইন-কানুন দেখাচ্ছিল। কিন্তু কনে পরিষ্কার ভাষায় বলেছে থাকবে না। তারপর ওরা নিয়ে গেল।’

– ‘বুঝেছি। মা শেষদিকে অনেক ভেঙে পড়েছিলেন তাই না?’

– ‘হুম। তোমার জন্য অনেক দুশ্চিন্তা করতেন।’

দু’জন অনেক্ষণ চুপচাপ থাকে। খানিক্ষণ পর ইলি নীরবতা ভেঙে বলল, ‘আচ্ছা রাফসান ভাই। আমি না-কি ফুপুর মতো হয়েছি?’

– ‘কোন ফুপু?

– তোমার আম্মা।

– আমার কাছে লাগে না তো।

– বাবা বলেন।

– ও আচ্ছা।

– যেদিন ফুপু মারা গেলেন তার আগেরদিন আমি রাতে স্বপ্নে দেখলাম সবাই খুব ব্যস্ত হয়ে বাঁশ কাটছে। কেউ কেউ মাটি খুঁড়ছে।

– তাই না-কি?

– হ্যাঁ। আমি এরকম দেখি। যেমন তোমার মৃত্যুর আগেও স্বপ্নে দেখতাম কত কি।

– আমার মৃত্যুর আগে মানে? তুই পাগল হয়ে যাচ্ছিস না-কি।

– তুমি জীবিত?

– কি বুঝাতে চাচ্ছিস?

– কিছু না।

– তোর একটা অভ্যাস কি জানিস?

– কি?

– ছোট থেকেই তোর অভ্যাস ছিল খালি বড়দের মতো ভাব নেয়া। যেমন ছোট বেলায় শাড়ি পরে মামীর মতো ব্যস্ত ভঙ্গিতে কাজ করা। কথা বলা।

– মিথ্যে।

– সত্য। গিয়ে জিজ্ঞেস করিস মামীকে।

– তার মানে কি দাঁড়াল। আমি এখন মুরব্বিয়ানা করছি। তাইতো?

– সব সময়ই করিস।

– করতেই পারি। ফোর্থ ইয়ারে পড়ি৷ দু’দিন পর গ্রাজুয়েশন কম্পেলেট হবে। মুরব্বিয়ানা করলে বেমানান লাগার কিছু নাই।

– বাবা।

ইলি ম্লান মুখে বাইরে খানিক্ষণ তাকিয়ে থেকে আবার বলল, ‘আমার মুরব্বিয়ানায় তুমি বিরক্ত তাই না?’

– ‘সিরিয়াস হচ্ছিস কেন? আমি এমনিতেই বললাম।’

– ‘বিরক্ত হলেও মুরব্বিয়ানা করবো।’

রাফসান হেঁসে বলল, ‘আচ্ছা করিস।’

– ‘শ্রীমঙ্গল টাউনে নেমে অনেক মুরব্বিয়ানা করবো। সব বাধ্য ছেলের মতো শুনতে হবে।’

– ‘কি করবি?’

– ‘নামার পর দেখা যাবে।’

– ‘আচ্ছা।’

তারপর আবার দু’জন নীরব। ঘন্টা দুয়েকের ভেতরেই তারা শ্রীমঙ্গল পৌঁছে গেল। ব্যস্ত শহর। ব্যস্ত মানুষ। রিকশার টুংটাং শব্দ। গাড়ির সাইরেন। তারা বাস থেকে নেমে গেল।
ইলি চারদিকে তাকিয়ে বলল,
– ‘হোটেল একটা দেখা যাচ্ছে। চলো চা খেতে খেতে বলি।’

– ‘কি এতো বলবি? শুধু ঢংই করছিস।’

দু’জন হোটেলের ক্যাবিনে গিয়ে বসে। ওয়েটার চা দিলো।
ইলি চুমুক দিয়ে বলল, ‘একটা কথা রাখবে তো?’

– ‘কি?’

– ‘সেলুনে চলো। তুমি সিলেট থাকতে যেভাবে চুল আর দাড়ি কাটছাঁট দিয়ে রেখেছিলে সেরকম কাটবে।’

– ‘ও বাবা কতবার কতভাবে কেটেছি মনেই তো নাই।’

– ‘ওই যে একদিন আমি পড়ার টেবিলে ছিলাম। তুমি এলে। গালে কাটছাঁট মেরে রাখা দাড়ি। চুল স্টেইট করা। বাম হাতে কালো ঘড়ি। পরনে পানপাতা রঙের গেঞ্জি। কালো ট্রাউজার।’

– ‘সব মনে আছে তোর? কিন্তু এখন চুল স্ট্রেইট দেবার সময় নাই।’

– ‘স্ট্রেইট লাগবে না, সামনের চুল লম্বা রেখে সেরকম কাটবে। তারপর বাজার থেকে ঘড়ি, গেঞ্জি কিনবো।’

– ‘এতো টাকা তো নেই আমার কাছে।’

– ‘আমার কাছে আছে।’

– ‘কই পেলি?’

– ‘আমি তো করোনা আসার আগে লাগাতার টিউশনি করিয়েছি। কিন্তু টাকা খরচ হয় না কিছুই। পড়ালেখা সহ সব খরচ তো খালারা পাঠিয়ে দেন।’

– ‘তাহলে টিউশনি কষ্ট করে করতে যাস ক্যান?’

– ‘আমার ব্যস্ত থাকতে ভালো লাগে।’

রাফসান খানিক হেঁসে বলল,
– ‘ব্যস্ত থাকতে ভালো লাগে এটা কেমন কথা?’

– ‘থাকুক কেমন কথা। এখন চা খেয়ে সেলুনে চলো।’

– ‘বাদ দে। পরে কাটবো। তোর টাকা খরচা করার দরকার নাই।’

– ‘শোন রাফসান ভাই, ঘাড়ত্যাড়ামি অভ্যাসটা ছাড়ো। তুমি কিন্তু নিজের ভুলে লাইফটা নষ্ট করেছো। পড়ালেখা সবকিছু বাদ গেছে। ইন্ডিয়া গিয়েও এক বছর নষ্ট হয়েছে। বিধবা মাও তোমার চিন্তায় তিলে তিলে শেষ হয়েছেন। বিয়ে একটা করেও ঝামেলা হলো। লোকে এখন তোমাকে পাগল বলে জানো সেটা? এই অবস্থায় তুমি মেহমান বাড়ি গেলে সবাই দেখে কি বলবে? আমার কথা শোন। শ্রীমঙ্গল এসেছো, এখন রিফ্রেশ হও। আমারও বেড়ানোর ইচ্ছা৷ এই কয়দিন তুমি আমার কথামতো চলতে পারবে না? আমি শ্রীমঙ্গলে সব জায়গা তোমাকে নিয়ে ঘুরবো। আমি যেভাবে বলবো সেভাবে চলবে।’

– ‘তারপর কি হবে? রিফ্রেশ হয়ে গেলে আমার সবকিছু কি ফিরে আসবে?’

– ‘না, কিন্তু নতুন করে ভাবতে হবে তো তোমাকে। মনটা সতেজ হোক। তাছাড়া হঠাৎ করে এসে শুনেছো ফুপু মারা গেছেন। সবকিছু মিলিয়ে তোমার কিছু ভালো মুহূর্ত কাটুক। চুল-দাড়ি কেটে সেলুনে মাথা ধুয়ে-মুছে নেবে। তারপর শপিং করে ট্রায়াল রুমে গিয়ে সব পরে নিবে।’

– ‘তুই নিজেই ঘাড়ত্যাড়া। আমাকে উল্টো বলিস।’

– ‘তোমার মাথা। উঠো। আর এই টাকাগুলো তোমার কাছে নাও। সব জায়গায় তুমিই বিল দেবে।’

চা বিল চুকিয়ে তারা সেলুনে যায়। ইলি সেলুনের বাইরের সোফায় বসে মোবাইল টিপে। কোনো বিব্রতবোধ নেই। চুল-দাড়ি কেটে রাফসান বেরুল। ইলি তাকিয়ে মুচকি হেঁসে বলল,
– ‘এবার অনেকটা ভালো লাগছে।’

– ‘তাই না-কি?’

– ‘হুম। আচ্ছা চলো। তোমার শপিং করবে।’

তাদের কেনা-কাটা শেষ হতে সন্ধ্যা হয়ে গেল। শীতের কারণে ইলি সিদ্ধান্ত পরিবর্তন করলো শপিংমলে গিয়ে। গেঞ্জি না কিনে শার্ট নিল। রাফসানের ব্যাগেই ছিল গোল গলার কালো গেঞ্জি। সেটির উপর শার্ট। বাম হাতে ঘড়ি। শার্টের হাত গুটানো। প্যান্ট আগেরটাই চলার মতো আছে। কিন্তু টাকায় টান পড়তে পারে ভেবে কেডস পরিবর্তন করা হলো না। তারা রাস্তায় বেরিয়ে এলো। শহরজুড়ে নানান রঙের বাতি জ্বলছে। ইলি তাকিয়ে রসিকতা করে বলল,
– ‘পুরাই হিরো লাগছে।’

– ‘পাম দিস না।’

– ‘সত্যি বলছি। তোমার নিজেকে ফ্রেশ লাগছে না?’

– ‘হ্যাঁ।’

– ‘চলো মেহমান বাড়ির জন্য কিছু নিই।’

দু’জন গেল একটি দোকানে। এরমধ্যেই হৃদ কল দেয় ইলিকে। ফুপুর বাড়ি বেড়াতে যাচ্ছে বলে রেখে দেয় ইলি।
দোকান থেকে বের হয়ে একটা সিএনজি নিয়ে তারা চললো বাসার দিকে। চারপাশে উঁচু উঁচু পাহাড়ের মাঝখান দিয়ে চলছে সিএনজি।
– ‘যা শালা। সীম তোলা হয়নি।’

– ‘কাল বেরুলে তুলে নেয়া যাবে। আমারও মনে পড়েনি।’

– ‘হ্যাঁ কাল তুলতে হবে।’

মিনিট বিশেক পরেই তারা পৌঁছে গেল। ব্যাগ-প্যাক নামিয়ে ভাড়া চুকিয়ে তারা বাড়ির দিকে যাচ্ছে। ইলি তাকিয়ে দেখলো গাড়ির শব্দ শুনেই ফুপু আর ফুফা উঠোনে এসে দাঁড়িয়ে আছেন৷ তারা যেতেই রোগাটে ফুপু দু’জনকে জড়িয়ে নিয়ে বললেন, ‘সেই কখন লতিফ মিয়া কল দিয়ে বললো তোরা বেরিয়েছিস। এতো দেরি হলো কেন রে? চলো ঘরে চলো।’

ঘরে গেল। তাদের দেখে পর্দার আড়ালে লুকোচুরি করছে বাচ্চা একটি মেয়ে। ইলি এগিয়ে গিয়ে তাকে টেনে বের করে কাছে নিয়ে বলল, ‘ফুপু ও মিনহাজ ভাইয়ের মেয়ে তাই না?’

– ‘চিনবি কেমনে? এসে দেখেছিস ওর জন্মের পর?’

– ‘পড়ালেখার জন্য আসা হয়নি। আব্বা তো এসেছিলেন। ওর নাম লিজা তাই না?’

– ‘হ্যাঁ।’

– ‘আমার এক বান্ধবীর নামও লিজা। আচ্ছা মিনহাজ ভাই কোথায়?’

– ‘দোকানে আছে। দশটার পর চলে আসবে।’

লিজার মা এলেন। তাদের সঙ্গে কথা হলো।
মিনহাজের সঙ্গে রাতের খাবার টেবিলে দেখা হয়।
ভদ্রতার বাক্য বিনিময়ের পর ইলি জিজ্ঞেস করল, ‘মিনহাজ ভাই, হামহাম জলপ্রপাতের রাস্তা এখন কেমন?’

– ‘ওদিকের রাস্তা সব সময়ই খারাপ। এখন কিছুটা ভালো আছে। তবে বর্ষাকালে জায়গাটা বেশি ভালো লাগে। যাবি না-কি?’

– ‘হ্যাঁ, কালই যাবো।’

চলবে…

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here