দেশলাই -২১,২২

0
385

দেশলাই -২১,২২
জবরুল ইসলাম
২১ পর্ব

এখান থেকে ঝর্ণার পানির আছড়ে পড়া কলকল শব্দ শোনা যাচ্ছে।
মানুষ দাঁড়িয়ে আছে ফ্লাগ মিটিং শেষ হবার অপেক্ষায়। কিন্তু ইলির ভালো লাগছে না। গাইডকে বললো,
– ‘মামা ডাক দিয়েন আমরা এদিকে আছি। চলো রাফসান ভাই।’

দু’জন আবার রাস্তা থেকে উল্টো পথে হেঁটে পাহাড়ে চলে যায়। কিন্তু সেখানে বসার কোনো স্থান নেই, চারপাশে গাছগাছালি আর ঝোপঝাড়। খানিক এগিয়ে বাঁ দিকে দেখা গেল কয়েকটি শিমুল গাছের মাঝখানে ছোট্ট একটি টিলা। ইলি সেদিকে দেখিয়ে বললো,

– ‘চলো টিলায় গিয়ে বসি।’

– ‘গাইড যদি এসে খুঁজে না পায়?’

– ‘আমরা এখান থেকে খেয়াল রাখবো চলো।’

রাফসান আগে টিলায় উঠে হাত বাড়িয়ে তাকে ধরে তুলে। ইলি টিলায় দাঁড়িয়ে চারপাশে তাকায়। এখান থেকে ঝিরিপথ এবং মানুষের ভীড় দেখা যাচ্ছে। গাছের ফাঁকফোকর গলে সূর্যের আলো ভেঙে ভেঙে এসে টিলায় আছড়ে পড়ছে। রাফসান সবুজ ঘাসে দুই পা সামনে দিয়ে বসা। ইলি আলগোছে তার বুকে পিঠ ঠেকিয়ে দুই পায়ের মাঝখানে বসে পড়ে। খোঁপা করা চুলের ধাক্কা লাগে রাফসানের নাকে।
একটু ভান ধরে ‘উফ’ করে আর্তনাদ করে সে।
– ‘অযথা উফ করো না তো। এতটুকুতেই কেউ ব্যাথা পায় না-কি?’

রাফসান কোনো কথা না বলে দুষ্টামি করে খোঁপা খুলে দেয়।
– ‘এটা কি হলো, খোঁপা খুললে কেন?’

– ‘বারবার আমার নাকে-মুখে লাগবে তাই।’

– ‘আচ্ছা ঠিকাছে। তোমার দুই হাত এদিকে দাও।’

রাফসান হাত বাড়াতেই ইলি দু’দিক থেকে নিজেকে পেঁচিয়ে ওর দুই হাত নিজের পেটের ওপর রেখে প্রশ্ন করে, ‘ইন্তিশার কি পরে বিয়ে হয়ে গিয়েছিল?

– ‘হঠাৎ করে ইন্তিশার কথা কেন?’

– ‘তুমি ইন্ডিয়া থেকে এলে মাত্র দুই রাত হলো। আর কখন জিজ্ঞেস করবো?’

– ‘আমি ইন্ডিয়া যাবার আগে করতে পারতি।’

– ‘ইন্তিশার সাথে ব্রেকাপের পর ইন্ডিয়া যাবার আগপর্যন্ত তুমি স্বাভাবিক ছিলে না। মেয়েদের যা-তা গালাগালি করতে। তখন আমি এগুলো জিজ্ঞেস করবো?’

– ‘স্বাভাবিক না হলে কি মুরব্বিরা মিলে আমাকে বিয়ে দিতেন?’

– ‘আরে না, তখন তুমি একটু স্বাভাবিক হয়েছিলে। সবাই ভাবলো বিয়ে-সংসার হলে পুরোপুরি ঠিক হয়ে যাবে। আচ্ছা বলো, ইন্তিশার পরে কি হলো?’

– ‘কি আর হবে। আমার সঙ্গে ব্রেকাপ করার জন্য বিয়ের নাটক করেছিল। তাছাড়া মা-বাবা বুঝতে পেরে মোবাইল কেড়ে নিয়েছেন এগুলোও ওর নিজের বানানো কথা ছিল।’

– ‘মাইগড৷ তারপর?’

– ‘তারপর খুব বেশি কিছু জানি না। জানার ইচ্ছেও ছিল না। শুধু সুলতানার কাছ থেকে জেনেছি ইন্তিশার বিয়ে হয়নি। অন্য রিলেশনে আছে। এরপর সুলতানাও ঠিকঠাক ফোন রিসিভ করতো না আমার। আমিও ওই গ্রামে আর যাইনি।’

– ‘এখন আর মনে পড়ে না ইন্তিশার কথা?’

– ‘ইন্ডিয়া গিয়ে অনেকটাই ভুলে গেছি। তবে এখনও মনে পড়ে, বাট কষ্ট লাগে না।’

– ‘তোমার মনে আছে আমি বলেছিলাম ইন্তিশা ভালো মেয়ে না?’

– ‘হুম মনে আছে।’

– ‘আমাকেও ইন্তিশার মতো ভাবছো না তো আবার?’

– ‘না।’

– ‘কেন?’

– ‘জানি না।’

– ‘হুম, বিশ্বাস রাখতে পারো। আমি এবার বাড়িতে গিয়েই মা’কে জানিয়ে দেবো হৃদকে বিয়ে করবো না।’

রাফসান মাথায় গাট্টা দিয়ে বলে, ‘মাইর দেবো। পাগলামি করিস না।’

ইলি ঘুরে মুখামুখি হয়ে হাঁটু ভাজ করে বসে চোখের দিকে তাকিয়ে বলে, ‘ভান করছো কেন? তুমি আমাকে মনে মনে চাও না বলো?’

রাফসান কি বলবে ভেবে পায় না৷ তার সত্যিই ইলিকে আজকাল ভীষণ ভালো লাগছে। ওর চোখ দু’টো যেন মায়ায় ভরা নদী। তাকালেই বুক শিরশির করে। তাই মনের বিরুদ্ধে ‘না’ শব্দটি বেরুচ্ছে না৷ তবুও পরিস্থিতি স্বাভাবিক করার জন্য মুচকি হেঁসে বলে, ‘পাকনামি না করে বসতো আগের মতো।’

ইলি কি মনে করে আবার বসে। রাফসানের হাত টেনে এনে পেটে রেখে ওর হাতের ওপর নিজের হাত রাখে৷ তারপর মাথা হেলে দিয়ে বলে,
– ‘জানো? ইন্তিশার সাথে তোমার রিলেশনের কথা শোনার পর কত কেঁদেছি আমি? আমার সবচেয়ে বেশি কষ্ট লাগতো মেয়েটি ভালো না মনে হলে।’

রাফসান তার থুতনি ইলির কাঁধে রেখে হাতের বাঁধন আরেকটু শক্ত করে ইলিকে জড়িয়ে ধরে বলে,
– ‘এগুলো ভুলে যা ইলি। শুধু শুধু কষ্ট পাবি।’

ইলি খানিকটা ঘুরে মুখের দিকে তাকায়,
– ‘কেন? তুমি বিয়ে করতে চাও না আমায়?’

– ‘সে তো চাই। তোকে পাওয়া আমার জন্য ভাগ্যের ব্যাপার৷ কিন্তু আমি তো জানি এ সম্ভব নয়। তাই মনের কথা মনে চাপা রেখেই চলতে হবে।’

– ‘এতো বুঝি না৷ তুমি আমাকে পছন্দ না করলে বইলো। তাহলে আর কিছুই বলবো না। বাট তুমি আর আমি চাইলে বিয়ে ঠিকই হবে। আচ্ছা তুমি ভেবে দেখেছো আমরা দু’জনের বিয়ে হলে কত দারুণ হবে? হৃদের সাথে তো একদমই ইচ্ছা হয় না আমার।’

– ‘ওর সাথে বিয়ে হলেই দেখিস সব ঠিক হয়ে গেছে।’

– ‘কচু ঠিক হবে।’

– ‘এ ছাড়া আর উপায় নেই ইলি। হৃদকে মেনে নে।’

– ‘উপায় আছে জনাব। আমি বাড়িতে গিয়ে হৃদকে বিয়ে না করার কথা জানিয়ে দেবো৷ বাট তোমার কথা কিছুই জানাবো না। এরপর আমি পড়ালেখা শেষ করে জব নেব। তুমিও তোমার চাচাদের বলে মধুশ্বরী বাজারে কোনো ব্যবসা দিয়ে দাও। এরপর আমরা সবাইকে মানিয়ে বিয়ে করে নেবো।’

– ‘বাব্বাহ, এতোকিছু ভেবে বসে আছিস?’

– ‘বিয়ের জন্য পাগল হয়ে আছি দেখে নির্লজ্জ ভাবছো না তো আবার?’

– ‘ভাবছিই তো।’

ইলি মাথা ঘুরিয়ে তাকিয়ে মুখটা দেখে বলে,
– ‘নির্লজ্জ ভাবছো না। উল্টো তোমার ভালো লাগছে।’

– ‘উল্টাপাল্টা কথা বলিস না। তুই অন্তর্যামী হয়ে গেছিস না-কি?’

– ‘অন্তর্যামী না অনুমান করতে পারি।’

– ‘বকবক করিস না চল যাই।’

– ‘এখানে আমার এতো ভালো লাগছে। তুমি চলে যেতে চাও কেন?’

– ‘এমনিই।’

– ‘শোনো, এখানে তো পানির জন্য এভাবে ড্রেস পরে এসেছি। কাল লাউয়াছড়া যাবো শাড়ি পরে। ওইদিনের সন্ধ্যার মতো।’

– ‘আচ্ছা, তারপর ছবি তুলে হৃদকে পাঠাবি।’

– ‘ধুরো। তুমি এখন এমন হয়ে গেলে কেন?’

– ‘কেমন?’

– ‘রোবট মানব।’

রাফসান হেঁসে বললো, ‘তাই না-কি? কেন মনে হলো?’

– ‘বলবো না।’

– ‘তোকে শাড়ি পরলে অবশ্যই বেশি সুন্দর লাগবে। তবে সব সময়ই সুন্দর লাগে।’

– ‘তোমার সাথে আমার বিয়ে হলে সব কষ্টতেও সুখ লাগতো রাফসান ভাই।’

– ‘কিরে শুধু শুধু বিয়ে বিয়ে করছিস কেন?’

– ‘কেন করছি বলবো?’

– ‘কেন?’

ইলি খানিকটা মাথা তুলে চারদিকে তাকায়, তারপর চোখের পলকে রাফসানকে ধাক্কা দিয়ে সবুজ ঘাসে ফেলে ওর ওপরে উঠে বুকে মাথা রেখে চোখবুঁজে৷

– ‘এটা কি হলো ইলি?’

– ‘শুধু বিয়ে বিয়ে করছি কেন প্রাক্টিক্যালি দেখালাম। বিয়ে ছাড়া তো বুকে মাথা রেখে ঘুমানো যাবে না।’

– ‘দেখানো তো শেষ এবার উঠ।’

– ‘আচ্ছা উঠছি। তুমি শুয়ে থাকো৷ কোনো দুষ্টামি করবো না।’

রাফসান আধশোয়া হয়ে বসে বলে, ‘আমি শুয়ে থাকবো কেন?’

ইলি আসন পেতে পাশে বসে বললো,
– ‘আমার কোলে মাথা তুলতে পারো।’

– ‘না লাগবে না।’

– ‘প্লিজ আসো না। গাইড হঠাৎ ডাক দেবে।’

– ‘কি বলিস এগুলো?’

– ‘বলছি না মাথা রাখতে?’

রাফসান ভ্রু কুঁচকে তাকায়। তারপর আমতা-আমতা করে মাথা রেখে বলে,
– ‘তুই হঠাৎ এমন হলি কেন?’

– ‘এতো প্রশ্ন করো না তো।’

ইলি পরম ভালোবাসায় রাফসানের ঘন কালো চুলে আঙুল ডোবায়। এক হাতে দাড়িগুলো খানিক ছুঁয়ে দেয়। রাফসান তাকিয়ে আছে সোজা মুখের দিকে। ইলির বোধহয় একটু অস্বস্তি লাগলো। হাত দিয়ে রাফসানের চোখ দু’টো বন্ধ করে বলে,
– ‘চোখবুঁজে থাকো।’

রাফসান সত্যি সত্যি চোখবুঁজে। ইলি মাথায়, মুখে হাত বুলাচ্ছে। খানিক্ষণ যেতেই রাফসান চোখ মেলে বলে,
– ‘আমার তো ঘুম পাচ্ছে।’

– ‘তাই?’

– ‘হুম।’

– ‘তাহলে ঘুমাও। আমি ডেকে দেবো।’

রাফসান বেখেয়ালি হয়ে পাশ ফিরে ইলির কোমর জড়িয়ে চোখবুঁজে। ইলির পুরো শরীর কেঁপে উঠে। রাফসানের নাক ডুবে গেছে পেটে। কোল জুড়ে উষ্ণ শ্বাস আছড়ে পড়ছে। ইলির হার্ট বিট বেড়ে গেছে। নিজেই শুনতে পাচ্ছে নিজের ধুকপুকানি। মাথায় ধাক্কা দিয়ে বলে,
– ‘রাফসান ভাই উঠো তো।’

– ‘কিরে কি হলো?’

– ‘কিছু না। উঠো চলে যাই।’

রাফসান দাঁত কটমট করে তাকিয়ে উঠতে উঠতে বলে, ‘তোর হঠাৎ কি হয় বুঝি না ইলি।’

ইলি কিছু না বলে অন্যদিকে তাকিয়ে বসে রইল। পুরো শরীর যেন কাঁপছে।

– ‘কিরে চল। তোর আবার কি হলো?’

– ‘কিছু না। চলো যাই।’

দু’জন টিলা থেকে নেমে আবার হাঁটতে শুরু করে।

চলবে…

দেশলাই – ২২ পর্ব

সরু রাস্তায় এখন আর ভীড় নেই। ঝর্ণার পানির কলকল শব্দ আরও তীব্র হয়েছে। গাইড রাস্তার পাশে আরাম করে বসে বিড়ি টানছে।
রাফসান কাছে গিয়ে বললো,

– ‘কি মামা ডাকলেন না যে?’

– ‘খুঁইজা পাইলাম না তো।’

– ‘আমরা টিলায় ছিলাম। চলুন এবার যাওয়া যাক।’

গাইড তাদের নিয়ে এই রাস্তা দিয়ে হেঁটে আবার ঝর্ণার সম্মুখের ঝিরিপথ নামে। এদিকটায় অধিক পাথর। ইলি রাফসানের হাত ধরে পা টিপে টিপে হাঁটছে। ঝর্ণার পানির তীব্র গর্জন শোনা যাচ্ছে। কেমন একটা ঘ্রাণও নাকে ভেসে আসছে। খানিকটা পথ এগুতেই ইলি পাহাড়ের দিকে তাকিয়ে উত্তেজনায় ‘ওয়াও’ বলে লাফিয়ে উঠে।
চোখের সামনে ভেসে উঠেছে এক আশ্চর্য দৃশ্য। পাহাড় থেকে ধোঁয়ার মতো ঘন কুয়াশা ভেসে উঠেছে।
এভাবেই পাহাড়ের ডাকে হাঁটতে হাঁটতে একসময় তারা পৌঁছে যায় প্রিয় গন্তব্য হামহাম জলপ্রপাতের কাছাকাছি। বেশ খানিকটা আগে থেকেই কানে আসছিল হামহাম জলপ্রপাতের গর্জন। এখন দেখা যাচ্ছে প্রায় ১৬০ ফুট ওপর থেকে আসা জলপ্রপাতের এক অপূর্ব দৃশ্য। প্রচণ্ড গতিতে নিচের পাথরের ওপর গড়িয়ে পড়ছে ঝর্ণার পানি। পাথরের আঘাতে জলকণা বাতাসে মিলিয়ে গিয়ে তৈরি করেছে কুয়াশা। সেগুলো ধোঁয়ার মতো উপরের দিকে ভেসে উঠেছে৷
– ‘দারুণ লাগছে তাই না ইলি?’

– ‘হ্যাঁ অনেক। আমি নামবো পানিতে।’

– ‘হ্যাঁ নামতে তো হবেই।’

রাফসান পাথরের ওপর তার ব্যাগটি রাখে। ছেলে-মেয়েরা লাফিয়ে পড়ছে পানিতে। ঝর্ণার সম্মুখের জলে পাথর নেই। কাচের মতো সচ্ছ শীতল পানি।
রাফসানকে রেখেই ইলি একা একা নেমে সাতার কেটে জলপ্রপাতের দিকে যাচ্ছে। কিন্তু খানিক এগিয়ে দাঁড়াতেই পাথরে ঝর্ণার আছড়ে পড়া পানির কণা ইলিকে যেন ধাক্কাতে শুরু করে। চোখ মেলে তাকানো যাচ্ছে না। শ্বাসও যেন বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। নাকে-মুখে আছড়ে পড়া জলকণার ঠান্ডা ছাট ভিজিয়ে দিচ্ছে।
রাফসান ব্যাগ রেখে পানির কাছটায় গিয়ে চারদিকে তাকায়।
কেমন শিতল শান্ত পরিবেশ। ডানে বামে কোনোদিক থেকেই চোখ ফেরাতে ইচ্ছে করছে না। মনে হচ্ছে অনন্তকাল দু’চোখ ভরে দেখে গিলে নিই প্রকৃতির এই অপূর্ব সৃষ্টি। এই অদ্ভুত এক রোমাঞ্চকর পরিবেশে ভুলে যাচ্ছে সে কোথায় আছে, চারদিকে গহীন জঙ্গল, উপরে আকাশ, পায়ের নিচে বয়ে যাওয়া ঝির ঝির স্বচ্ছ পানির ধারা আর সামনে বহমান অপরূপ ঝর্না।
আয়নার মতো স্বচ্ছ পানি পাহাড়ের শরীর বেঁয়ে আছড়ে পড়ছে বড়ো বড়ো পাথরের গায়ে। গুড়ি গুড়ি জলকণা আকাশের দিকে উড়ে গিয়ে তৈরি করছে কুয়াশার আভা। বুনোপাহাড়ের ১৫০ ফুট উপর হতে গড়িয়ে পড়া স্রোতধারা কলকল শব্দ করে এগিয়ে যাচ্ছে পাথরের পর পাথর কেটে সামনের ডোবায়। চারিপাশে গাছ গাছালি আর নাম না জানা হাজারো প্রজাতির লতাগুল্মে আচ্ছাদিত হয়ে আছে পাহাড়ি শরীর। স্রোতধারা সে লতাগুল্মকে ভেদ করে গড়িয়ে পড়ছে ভুমিতে। রাফসান সবকিছু বুঁদ হয়ে দেখছিল। কিন্তু আচমকা ধাক্কা খেয়ে পড়লো গিয়ে পানিতে৷ পেছনে কেবল শুনতে পেল ঝর্ণার পানির কলকল শব্দের মতো হাসি। পানি থেকে সঙ্গে সঙ্গে মাথা তুলে পেছনে তাকিয়ে দেখতে পায় ভেজা কাপড়ে হাস্যজ্বল এক মায়াবিনীকে। রাফসান মুখ মুছতে মুছতে বললো, ‘এটা কি করলি?’

ইলি হাসতে হাসতেই জবাব দেয়,

– ‘তুমি নামছিলে না তাই।’

– ‘দাঁড়া এখানে তোকে কি করি দেখ।’

রাফসান লাফ দিয়ে কিনারায় উঠে। ইলি খিলখিল করে হাসতে হাসতে পা টিপে টিপে এদিক-ওদিক দৌড়াতে থাকে। কিন্তু খানিক যেতেই সামনে শুধু পাথর৷ দৌড়ানো আর সহজ হচ্ছে না। ইলি বারবার বলছে, ‘রাফসান ভাই আমি পড়ে যাবো। আমার পিছু ছাড়ো।’

– ‘তাহলে থাম।’

– ‘তুমি পানিতে নিয়ে ফেলবে।’

– ‘তা তো ফেলবোই।’

ইলি আগের মতো দৌড়ায়। কিন্তু বেশিদূর যেতে পারে না। রাফসান পেছন থেকে কোমর জড়িয়ে শুন্যে তুলে নেয়। ইলি হাপাচ্ছে আর ছাড়ার জন্য কাকুতি-মিনতি করছে। কিন্তু রাফসান তাকে নিয়ে যাচ্ছে পানির দিকে।
মাথা তুলে তাকাতেই দেখলো অন্যরা তাদের দিকে তাকিয়ে দাঁত কেলিয়ে হাসছে। দৃশ্যটি দেখে রাফসান ইলিকে ছেড়ে দিয়ে বললো,

– ‘যা ছেড়ে দিলাম।’

ইলি গিয়ে পাথরে বসে হাপাতে থাকে। রাফসান নেমে যায় পানিতে। অন্য সবার সঙ্গে সাঁতার কাটতে থাকে। মাঝে মাঝে জলপ্রপাতের সামনে যতটুকু যাওয়া যায় গিয়ে চোখবুঁজে পানির ছাট নিচ্ছিল। দারুণ লাগে নাকে-মুখে এসে পড়লে।
আবার জলপ্রপাতের দিকে এগিয়ে যায় রাফসান। হাত মেলে চোখবুঁজে দাঁড়ায়। পুরো শরীরে এসে আছড়ে পড়ছে জলকণা। ভিজিয়ে দিচ্ছে পুরো শরীর। হঠাৎ কারও স্পর্শে চোখ মেলে তাকাতেই পানির ছাট চোখ বন্ধ করে দেয়।
– ‘ইলি তুই..
কথা বলতেই মুখে ঢুকে গেল পানি। ‘থু-থু’ করে বামদিকে ফেলে। ইলি রাফসানের সামনের দিকে এসে জড়িয়ে ধরেছে। পাথরের আছড়ে পড়া জলকণা পড়ছে এসে ইলির পিঠে। তার চোখ মেলে তাকাতে বা কথা বলতে কোনো অসুবিধা হচ্ছে না। তবুও শক্ত করে জড়িয়ে ধরে চোখবুঁজে আছে৷ পিঠে শীতল পানি বেয়ে যাচ্ছে।
রাফসান দুই হাত সামনে নিয়ে জলকণা ফিরিয়ে বলল, -‘লোকজন দেখছে ইলি ছাড়।’

– ‘সবাই সাতার কাটছে। ওরা আমাদেরকে চিনেও না। তাছাড়া এসব জায়গায় প্রেমিক-প্রেমিকা, হাসবেন্ড-ওয়াইফ এগুলো করে।’

– ‘তবুও ছাড় ইলি।’

– ‘প্লিজ, চোখবুঁজে থাকো। আমাকে স্বর্গ সুখ থেকে বিতাড়িত করতে ব্যস্ত হয়ে যাচ্ছ।’

রাফসান হাত দিয়ে ছাড়াতে যাচ্ছিল। ইলি আরও শক্ত করে ধরে চোখ বন্ধ রেখেই ওর গালে নিজের নাক ঠোঁট দিয়ে ঘষতে থাকে।

– ‘ইলি করছিস কি কেউ দেখবে তো।’

– ‘তাহলে চুপচাপ আমাকে জড়িয়ে ধরে দাঁড়িয়ে থাকো প্লিজ।’

– ‘কি বলছিস এগুলো?’

ইলি চোখ মেলে সতর্কভাবে সামনের লোকগুলো দেখে ওর ঘাড়ের চুল খামচে ধরে গালে গাল ঘষে বলে,
– ‘কেন বিয়ে হয়নি বলে তো? যাও বলে দিচ্ছি কবুল কবুল কবুল। এখন আর এতো নিষেধ নেই।’

রাফসান হেঁসে ফেললো। তারপর অসহায়ভাবে বলে, ‘আমি শ্বাস নিতে পারছি না ইলি ছাড়।’

ইলি গাল ফুলিয়ে ছেড়ে দিয়ে বললো,
– ‘কত অজুহাত, যাও লাগবে না।’

ইলি ছেড়ে দিয়ে পানিতে নেমে সাঁতার কেটে যেতে থাকে। রাফসাম যায় পিছু পিছু।
– ‘ইলি কি হলো গাল ফুলিয়ে চলে যাচ্ছিস কেন?’

ইলি কোনো জবাব দিলো না। সে একা একা বুক সমান পানিতে সাঁতার কাটতে থাকে। রাফসান তাড়াতাড়ি গিয়ে ওর কোমর জড়িয়ে ধরে। ইলি উল্টো হয়ে নিজেকে ছাড়িয়ে পানি ছিটা দিতে থাকে। রাফসান চোখ মেলতেও পারে না। ইলি খিলখিল করে হাসছে। রাফসান বুদ্ধি করে পানিতে ডুব দিয়ে গিয়ে পেট জড়িয়ে ধরে উপরে তুলে পানিতে ছেড়ে দেয়। নাকে-মুখে পানি ঢুকে কাশি উঠে ইলির। রাফসান হাসতে থাকে। ইলি দাঁত কটমট করে তেড়ে যায়। রাফসান সাঁতার কাটতে থাকে। ইলি ধরে ফেলে পায়ে। ওর সাঁতারের গতি কমে আসে। ইলি বেয়ে বেয়ে কোমর থেকে উপরে উঠে গলা জড়িয়ে ধরে ঘাড়ে কামড় দেয়। রাফসান আর্তনাদ করে উল্টে গিয়ে ইলিকে নিচে ফেলে দেয়। কিন্তু আবার কোমর জড়িয়ে পেট কামড়ে ডুব দিয়ে দূরে সরে যায়। রাফসান রাগান্বিত হয়ে তাড়া করে। ইলি এক ডুবে চলে যায় অন্য মানুষদের মাঝখানে। রাফসান মাথা তুলে চারদিকে তাকাচ্ছে। ইলি একা একা দূর থেকে হাসছে। হঠাৎ দেখে এদিকে আসতে থাকে। ইলি আবার ডুব দিয়ে জলপ্রপাতের দিকে ইচ্ছে করে ছুটে যায়। সাঁতার কেটে গিয়ে জলপ্রপাতের সামনে হাত মেলে দাঁড়িয়ে চোখবুঁজে একা একা জলকণার শীতল ছাট নিতে থাকে। খানিক পর আচমকা ইলি ঘাড়ের দিকে তীব্র ব্যথা অনুভব করে। বুঝতে পারে রাফসান প্রতিশোধ নিচ্ছে। ইলি চুপচাপ ব্যথা সহ্য করে দাঁড়িয়ে থাকে। প্রতিক্রিয়া না পেয়ে রাফসানের বোধহয় একটু রাগই হলো। সে আবার একটু জোরে কামড় দেয়। ইলির ব্যথায় চোখ দিয়ে পানি এসে যায় তবুও প্রতিক্রিয়া দেখায় না৷ রাফসান রেগেমেগে ইলির মতোই সামনে গিয়ে কোমর জড়িয়ে পেটে নাক ডুবিয়ে কামড় দেয়। ইলি যন্ত্রণায় দুই হাতে মুখ ঢেকে কেঁদে ফেলে। রাফসান দাঁড়িয়ে হাত সরিয়ে দেখে কাঁদছে ইলি। অবাক হয়ে বলে, ‘ওমা, এমন ভাব নিচ্ছিলি যেন লাগছেই না তোর। এখন কাঁদছিস কেন?’

ইলি জবাব না দিয়ে আবার মুখ ঢেকে দাঁড়িয়ে থাকে।

– ‘কিরে বেশি ব্যথা পেয়েছিস?’

ইলি আচমকা জড়িয়ে ধরে রাফসানকে। পানির ছাট এসে চোখে-মুখে পড়ে। কথা বলার জন্য ইলি রাফসানের চওড়া বুকে লুকিয়ে বলে, ‘হুম ব্যথা পেলেও সহ্য করেছি।’

– ‘কেন?’

– ‘তুমি তো ব্যথা দেবার জন্যই কামড় দিয়েছো। আদর করে তো দেবে না।’

– ‘তাই বলে কামড়ের সাথে সাথে চেঁচিয়ে উঠবি না? তুই নড়লেও আমি ছেড়ে দিতাম৷ এমন ভাব করছিলি যেন কিছুই টের পাচ্ছিস না।’

ইলি কাঁদো কাঁদো গলায় বলে, ‘ব্যথাই লাগুক। তবুও তো তোমার ছোঁয়া।’

– ‘কি বলিস এগুলো? সিরিয়াসলি না-কি কোনো উপন্যাস বা সিনেমা দেখে ন্যাকামো করছিস?’

ইলি মাথা তুলে আহত চোখে তাকিয়ে বলে, ‘এমন মনে হয় কেন তোমার? মানুষ কি প্রেমের জন্য মরে না? তাহলে আমি প্রিয় মানুষের স্পর্শের জন্য সামান্য ব্যথাও সহ্য করতে পারবো না কেন? তোমার মতো কি সবাই অনূভুতিহীন রোবট হয়ে গেছে?’

রাফসানের বুকটা যেন শিরশির করে। হাত বাড়িয়ে ইলির মুখটা আঁজলা করে ধরে চোখের দিকে তাকায়।
– ‘আল্লা জানেন ইলি তোর কপালে কতো দুঃখ আছে। গোপনে এতো ভালোবেসে যে ফেললি। এর পরিণতি কি শুভ হবে?’

– ‘তুমি পুরুষ মানুষ হয়ে মেয়েদের মতো আচরণ করছো রাফসান ভাই।’

– ‘কীভাবে?’

– ‘কিছু না।’

– ‘শক্ত হ ইলি৷ বাড়িতে গিয়ে দেখ হৃদের সাথে বিয়েও ভেঙে দিতে পারবি না।’

– ‘তো কি হয়েছে? সেই ভয়ে কি এমন সুন্দর জায়গায় এসে প্রিয় মানুষকে পাশে রেখেও গোমড়ামুখো হয়ে থাকবো।’

– ‘সেটা না, তুই খুশিতে যতো বেশি উড়ছিস। সেখান থেকে নিচে পড়লে ঠিক ততটাই ব্যথা পাবি। তাই আগে বাড়িতে গিয়ে দেখ বিয়ে ভেঙে দিতে পারিস কি-না৷ আর তুই তো এমন ছিলি না কখনও৷ কত বুদ্ধিমান, বুঝমান, ম্যাচিউর মেয়ে। এখন এতো দূর্বল হয়ে যাচ্ছিস কেন?’

ইলি রাফসানের কথাগুলো শুনে মুচকি হেঁসে জড়িয়ে ধরে বুকে মাথা রেখে বললো,
– ‘ইশ, আমার বরটা কত সুন্দর করে বুঝায়।’

চলবে…

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here