গল্পঃ দেয়াল
পর্ব -১,২
লেখকঃ Ramim_Istiaq
– রামিম পাগল হইছিস তুই? নিজের বোনকে কেউ বিয়ে করে?
– বাবা তুমি যা ইচ্ছা বলো আমি তিন্নিকেই বিয়ে করবো। কি তিন্নি করবিনা আমাকে বিয়ে?
তিন্নি চুপচাপ দাড়িয়ে থাকলো।
আরো কয়েকবার প্রশ্নটা করলাম তিন্নি চুপ।
– তিন্নি তুই বলবি নাকি মারবো তোকে আমি?
হঠাৎ ঠাঁস করে একটা শব্দ হলো তারপর সব চিৎকার বন্ধ।
কোলাহল থেমে থমথমে শান্ত একটা পরিবেশ বিরাজমান হলো।
তিন্নি চলে গেলো নিজের রুমে।
রামিম ঠায় দাড়িয়ে রইলো।
কামরুল সাহেব বুঝলেন ছেলে পথভ্রষ্ট হয়েছে নইলে তিন্নিকে কিভাবে বিয়ের কথা বলে?
ক্লান্ত না হওয়া পর্যন্ত মারা হলো রামিমকে।
ব্যাথায় শরীর ছেড়ে দিছে রামিম।
নাজনীন বেগম বাদে বাড়ির সবাই শক্ত।
তিন্নিও কিছু বলছেনা। বলবে কেনো? হোক পালিত বোন তবে বোন তো?
বোনকে কিভাবে বিয়ের কথা বলে?
দোতলা বাড়ির ওপরের তলায় পাশাপাশি রুমে থাকে রামিম তিন্নি।
রামিমের বয়স যখন দু বছর তখন তিন্নির বাবা একটা মেয়েকে নিয়ে আসেন বাড়িতে।
তিন্নি মেয়েটার বয়স তখন ১ বছর মাত্র।
গ্যাসের সিলিন্ডার ফেটে বাবা মা মারা যায়।
তিন্নির বাবা মা পালিয়ে বিয়ে করার কারনে কোনো পরিবারই এই মেয়েটাকে বোঝা বানাতে চায়নি।
নাজনীন বেগমের মেয়ের খুব শখ ছিলো আর কামরুল সাহেবের বন্ধুর পরিবারে এত বড় একটা দূর্ঘটনার পর তিন্নি মেয়েটার ভবিষ্যতের কথা ভেবেই নিজের বাড়িতে নিয়ে আসেন।
নিজের মেয়ের মত করেই মানুষ করেছেন তিন্নিকে।
আজ ২৩ বছর ধরে মেয়েটাকে আগলে রেখেছেন তিনি।
মেয়েটা দেখতে খুবই সুন্দর হয়েছে, বিয়ের প্রস্তাব আসছে রোজই।
এরই মধ্যে একটা ছেলেকে বেশ পছন্দ হয়েছে তার।
ছেলে ব্যাংকে চাকরি করে।
ভালো বেতন। দেখতে শুনতেও ভালো।
এতদিন আগলে বড় করে একটা ভালো ছেলের কাছে তুলে দিতে পারলেই তার শান্তি।
এর মধ্যে রামিম এই কাহিনী করলো।
লোকে জানলে কি বলবে? কেউ কি বিয়ে করবে মেয়েটাকে?
ছেলেটাকে মেরে নিজেও ঠিক নেই।
আড়ালে কেঁদেছেন কয়েকবার।
রামিম চুপচাপ ওপরের দিকে তাকিয়ে আছে।
পাশের রুমটাই তিন্নির রুম।
সে কি বুঝতে পারছেনা আমার প্রচুর কষ্ট হচ্ছে?
ডাক্তার এসে ঔষুধ দিয়ে গেছে। আপাতত পরিবেশ স্তব্ধ। নিঃশব্দে কেঁদে চলেছেন নাজনীন বেগম আর কাজের মহিলাটা।
এ বাড়িতে শব্দ করে কান্না করা নিষেধ।
কান্নাকাটির শব্দ শুনতে ভালোলাগেনা।
কাজের মহিলার নাম রহিমা বেগম।
(আমরা তাকে রহিমা কাকি নামে সম্মোধন করি?)
রহিমা কাকি আজ ২০ বছর যাবত এই বাড়িতে কাজ করছেন।
কাজের লোক কেউ ভাবেনা। পরিবারের একজন সদস্য হয়ে গেছেন তিনি।
পুরো পরিবার সহ এ বাড়িতেই থাকেন তারা।
তার স্বামি ড্রাইভার।
তাদেরও প্রেমের বিয়ে। রামিমকে দুজনেই নিজেদের ছেলে ভাবেন আর তিন্নিকে মেয়ে।
রামিমও সময় পেলেই কাকির হাতে মাখা ভাত খেয়ে আসে।
নিজের হাতে খেতে ইচ্ছে করেনা তার।
হয় মা নয়তো কাকি দুজনের কেউ তাকে খাইয়ে দিবেই। মাঝে মাঝে তিন্নির কাছে বায়না ধরে,
– আজ তুই খাইয়ে দিবি নয়তো খাবোনা আমি।
– প্রতিদিন তো কাকির হাতেই খাস আজ আবার আমি কেনো?
উত্তর দেয় তিন্নি।
রামিম জবাব না দিয়ে খাবার টেবিল থেকে উঠে দাড়ায়।
তিন্নি পিছে পিছে যায়,
– আয় খাইয়ে দেই।
দুজনের এমন মিষ্টি ভালোবাসায় পরিবারের কেউ রাগ করেনা বরং খুশিই হয়।
একটা সময় কামরুল সাহেব ভাবতো মেয়েটাকে কি ছেলের বউ করে রেখে দিবে?
সময় বদলায়, মনের ভিতর শঙ্কা হয়,
লোকে কি বলবে? নিজের মেয়ের মত মানুষ করেছি যে।
নাজনীন বেগম রামিমের পাশে বসে বাতাস করছে আর কাঁদছে।
এ কান্নায় প্রান নেই,নিষ্প্রাণ।
রামিমের ইচ্ছা হয় তিন্নি কি করছে সেটা জানতে।
তিন্নি একবারো আসেনি তাকে দেখতে।
ডাক্তার ঔষুধ দিয়ে গেছে।
খাওয়ার পর খেতে বলেছে,
আজ মা বা কাকির হাতে খেতে ইচ্ছে করছেনা।
তিন্নির হাতে খাবে সে।
পাশের রুম থেকে তিন্নি শুনলো কথাটা।
খাবার আনলো তিন্নি।
রুমে ঢুকতেই রামিম স্বস্তির নিঃশ্বাস নিলো।
তবে তিন্নিকে আজ অন্যরকম লাগছে।
চোখমুখ ফুলে গেছে কিছুটা।
হয়তো ভালোবাসি বলেনি কেউই তবে কি ভালোবাসা থাকতে পারেনা দুজনের মাঝে?
রামিম কখনো বলেনি, বলেনি তিন্নিও।
তবে মনে চেপে রেখেছে অফুরন্ত ভালোবাসা।
দুজনেই জানে সত্যিটা যে তিন্নি তার আপন বোন না।
এমন কত গোধূলি গেছে,
তিন্নি রামিমের রুমের পাশে যেতেই একটা শক্ত হাত হ্যাঁচকা টান মেরে তিন্নিকে শক্তভাবে আলিঙ্গন করেছে।
কতবার ঠোঁটের খুব কাছে গিয়েও স্পর্শ করা হয়নি।
কতবার তিন্নির গরম নিঃশ্বাস রামিমের মুখের ওপর পড়েছে তার হিসেব নেই।
প্রাইভেটে পা দিয়ে পা ছোঁয়ার প্রতিযোগিতা কতবার হয়েছে তারও হিসেব নেই।
এগুলা নিজেদের মধ্যেই সীমাবদ্ধ থেকেছে।
তবে ভালোবাসি বলা হয়নি কখনো।
তিন্নি রুমে ঢুকে নিজের হাতে খাইয়ে দেয় রামিমকে।
ইশশ ছেলেটাকে কিভাবে মেরেছে। গালে লাল দাঁগ পড়ে গেছে। তিন্নি ছলছল চোখে বলে,
– রামিম তোর আর আমার মাঝে অনেক শক্ত একটা দেয়াল, সম্পর্কের দেয়াল। তুই আমি চাইলেও এ দেয়াল ভাঙতে পারিনা। পাগলামি করিসনা।
– তুই ভালোবাসিস না আমাকে?
দম বন্ধ হয়ে আসে তিন্নির।
কি উত্তর দিবে সে?
#দেয়াল
পর্ব – ২
লেখকঃ Ramim_Istiaq
.
তিন্নি জবাব না দিয়ে উঠে যায়।
এ প্রশ্নের উত্তর তার কাছে নেই। হয়তো আছে সে বলবেনা। বলবে কেনো? সমাজে বসবাস করতে হলে সমাজের নিয়ম কানুনও মানতে হবে।
রামিমের আর ঔষধ খাওয়া হয়না।
মার বেশ ভালোই পড়েছে তার রিয়েকশন এখন দেখা যাচ্ছে।
জ্বর এসে গেছে শরীরে, ব্যাথার তো কথাই নেই।
রহিমা কাকি এসে গরম তেল মালিশ করে দেওয়ায় কিছুটা ব্যাথা কমেছে রামিমের।
তিন্নি রুমে ঢুকে দরজা বন্ধ করেছে আর খোলার নামগন্ধও নেই।
রাতে খেতেও যায়নি সে। কামরুল সাহেব মেয়েটাকে ভিষন পছন্দ করেন। সে নিজের হাতে প্লেটে করে ভাত আর মাছের মাথাটা নিয়ে রওনা দেন তিন্নির রুমের দিকে।
রামিমের প্রতি বাড়ির সবারই প্রচুর দুর্বলতা আছে।
বাড়ির ড্রাইভার মানে রহিমা কাকির স্বামি রোস্তম মিয়া সেও এসে কামরুল সাহেবকে বললো,
– আমার ছেলেটাকে মারবেন কেনো? ভুল করেছে আমাকে বলতেন এভাবে মারার কোনো দরকার ছিলো?
কামরুল সাহেব বেশ অবাক হন।
কতটা আপন হলে বাড়ির ড্রাইভার রামিমকে নিজের ছেলে ভাবে।
এ বাড়িতে রামিমকে নিয়ে মাথা ঘামানোর আর কেউ নেই, তবে তার মামাবাড়ি একজন আছে।
মেয়েটার নাম তিথী, রামিমের মামাতো বোন।
মামাবাড়ি গেলে তিথীর চাইতে খুশি কেউ হয়তো হয়না।
ছোটবেলায় একরুমেই ঘুমাতো মামাবাড়ি গেলে এখন বড় হয়ে গেছে কেমন একটা লজ্জা কাজ করে তাই দুইজন আলাদা রুমে ঘুমালেও ঘুমানোর আগ পর্যন্ত ফেবিকলের মতো পিছু লেগে থাকে তিথী।
ছেলেটাকে যে তার এত ভালোলাগে তার অবশ্যি কিছু কারনও আছে।
কারন ছাড়া কাওকে ভালো কেনো লাগবে?
রামিমের চুলগুলা তিথীর ভালোলাগে।
ঘন, কালো আর সিল্কি চুল।
এতটা সিল্কি মেয়েদেরও হয়না, রামিম মামাবাড়ি গেলে তিথীর ইচ্ছা হয় ছোটবেলার মতো রামিম ওর কোলে মাথা রেখে শুয়ে থাকবে আর তিথী চুলে হাত বুলিয়ে দিবে।
এতো গেলো তিথীর কথা। এবার রামিমের কথা বলি।
রামিম ছেলেটার সাথে তিন্নির গলায় গলায়।
সে সবসময় ঝগড়া করতে চায় তিথীর সাথে।
দুজন দুজনের প্রতি দুইরকম ইচ্ছা প্রকাশ করে।
তিথী যেখানে রামিমকে কোলে মাথা রাখিয়ে চুলে হাত বুলাতে চায় রামিম সেখানে তিথীর চুল টেনে ছিঁড়ে ফেলতে চায়।
ছোটবেলায় অবশ্য এমন ছিলোনা তবে বড় হওয়ার পর এই ইচ্ছাটা তিব্র হচ্ছে রামিমের।
দরজায় টোকা দেন কামরুল সাহেব।
সাড়াশব্দ না পেয়ে ডাক দেন,
– তিন্নি মা দরজাটা খুলতো।
দরজা খুলে যায়।
কামরুল সাহেব রুমে ঢুকতেই তিন্নি
বিছানায় গিয়ে বসে। দেখেই বুঝা যাচ্ছে সে কেঁদেছে এতক্ষণ। কেমন একটা গ্লানি দেখা যাচ্ছে তিন্নির চোখেমুখে।
– শুনলাম খাওয়া দাওয়া নাকি করিসনি?
– হ্যা বাবা, ভালো লাগছেনা।
– মন খারাপ?
– নাতো।মন খারাপ কেনো থাকবে?
– আয় আমি তোকে খাইয়ে দেই।
কামরুল সাহেব ভাত মেখে খাইয়ে দেয় তিন্নিকে।
এ বাড়িতে কামরুল সাহেব যা বলেন তাই হয়।
তবুও তিন্নিকে মাঝে মাঝে লুকিয়ে লুকিয়ে খাইয়ে দিয়ে যায় কামরুল সাহেব।
অন্যরকম ভালোলাগা কাজ করে তার মধ্যে।
দরজা খোলাই ছিলো হঠাৎ রহিমা কাকি এসে দেখে বাবা মেয়ের এই দৃশ্য।
বেশ কঠিন গলায়ই বলে,
– ভাব দেখে আর বাঁচিনা, ছেলেকে আধমরা বানিয়ে রেখে মেয়েকে খাইয়ে দেওয়া হচ্ছে।
কামরুল সাহেব আমলে নেননা।
বলবেই তো বলবেনা কেনো, একবারো তো ছেলেটাকে দেখতে যায়নি সে। ছেলেটার প্রতি কি একটুও ভালোবাসা নেই তার?
রাত দুইটা,
গা ঘাঁমিয়ে জ্বর ছেড়েছে রামিমের, হয়তো আবারো আসবে।
শরীরের কয়েক জায়গায় বেশ ফুলে গেছে।
ওটা যেনো একটা ব্যাথার বাক্স।
অল্প ছোঁয়া লাগলেই সারা শরীরে ব্যাথার সাপ্লাই দিয়ে দেয়।
পাশের রুমে লাইট জ্বলছে এখনো।
রামিম ভাবে,
তিন্নি কি ঘুমায়নি? এত রাতে জেগে কেনো আছে?
অন্য সময় হলে রামিম রুমে যেতো অথবা দেয়ালে লাথি দিয়ে ওর ঘুম ভাঙিয়ে বলতো – লাইট অফ করে ঘুমা আমার রুমে আলো আসলে আমি ঘুমাতে পারিনা।
তিন্নির আবার বদঅভ্যাস।
রামিমকে জ্বালানোর জন্য রাতে লাইট অন করেই ঘুমায়।
রামিম আবার ভাবে,
নাহ ও তো জেগে নেই লাইট অন করেই ঘুমায় সবসময়।
শুয়ে থাকতে ইচ্ছা করছেনা আর রামিমের।
উঠে দাড়াতেই খেয়াল করে শরিরে প্রচুর ব্যাথা।
অনড়ভাবে শুয়ে থাকার দরুন এতক্ষণ বোঝা যায়নি তবে এখন উঠতেই পুরো ব্যাথাটা অনুভব করছে রামিম।
হঠাৎ রামিমের মনে পড়ে জিরু বাবার কথা।
রামিমের ওখান থেকে মাত্র ১০ মিনিটের রাস্তা।
মাজার শরীফে একটা পাগলা বাবা থাকে নাম জিরু বাবা।
হাতে পায়ে গলায় প্রায় ৩৬ কেজি ওজনের শিকল বাধা।
ওই অবস্থাতেই খায়, ঘুমায়।
গোসল করেনা লোকটা তবুও সবসময় আতরের গন্ধ লেগেই থাকে গায়ে।
জিরু বাবার সাথে রামিমের ভালো সম্পর্ক।
মাজারে গেলেই জিরু বাবা ডাকে,
– কিরে ব্যাটা এসেছিস? আয় একটা ডিম খা। কলা পাওরুটি খা।
প্রথম প্রথম ঘেন্না লাগলেও পরে একসময় রামিম বুঝলো লোকটার আশ্চর্য কিছু ক্ষমতা আছে।
লোকটার শরীর দিয়ে কখনো দূর্গন্ধ বেরোয় না, ৩৬ কেজি শিকল পড়ে আরামসে ঘুরে বেড়ায়।
আর সবচেয়ে মজার ব্যাপার হলো লোকটা কাছে গেলেই মন ভালো হয়ে যায়।
রামিম ভাবছে কাল একবার যাবে জিরু বাবার কাছে।
হয়তো কোনো উপায় বের করে দিবে তিনি।
হঠাৎ দরজায় ঠকঠক শব্দ।
তারপর ফিসফিসে কণ্ঠে আওয়াজ আসে,
– রামিম জেগে আছিস?
তিন্নির গলা।
এতরাতে ও আমার রুমে কেনো?
চলবে?