দেয়াল বন্দি (১ম পর্ব)

0
4335

#দেয়াল বন্দি (১ম পর্ব)
লেখাঃ Md. Nazmul Huda

” আমার শরীরের উপরে আবিদের কোনো চাহিদা ছিলো না।”

কিন্তু আমার যেই বিয়ে ঠিক হয়েছে সেই তারপরে,
ভালোবাসার উপহার হিসেবে আবিদ আমার কাছে চব্বিশ ঘন্টা চেয়েছে। মানে একরাত এবং একদিন। সেই চব্বিশ ঘন্টা তার কাছে আমাকে বিলিয়ে দিতে হবে। তার ইচ্ছা মত আমার সময় কাটাতে হবে।

কোন পরীক্ষার মাঝে পড়ে গেলাম জানিনা।

যেহেতু আমার কারনেই আবিদ আমাকে হারিয়ে ফেলতে চলছে,তাই যেভাবেই হোক আমি আবিদের চাওয়াটা পূরন করবো। যদিও আমার দৃঢ় বিশ্বাস আছে আবিদ কখনোই আমার ক্ষতি করবে না।

আবিদের দেওয়া গোলাপী রঙের শাড়িটা পড়েছি আজ । ঠোঁটে গাড়ো লাল লিপস্টিক আর কপালে ছোট একটা কালোটিপ দিয়েছি। আবিদের সাথে আমার দেখা হয়েছে মাত্র পাঁচবার। তার মধ্যে একবারই আমি শাড়ি পড়ে ওর সামনে গিয়েছি। তাও বছর খানেক আগের কথা।

বারবার ঘড়ির দিকে তাকাচ্ছি কখন তিনটা বাজবে। কারন আবিদ আমাকে বলেছে আমার বাসার সামনে জাস্ট তিনটায় আসবে। এখন বাজে পৌনে দুইটা। এখনো অনেকটা সময় আছে। তবুও আগে থেকে আমি রেডি হয়েছি। আমার ছোট খালাকে বলেছি বন্ধুবীর বাসায় যাবো। আর আব্বু আম্মু বিয়ের দাওয়াত দিতে গ্রামের বাড়িতে গিয়েছেন। সেই সুবাদেই আজ আমি বাসা থেকে বের হতে পারবো।

আর তাছাড়া বাবা মায়ের পছন্দ মতই বিয়ে করে নিচ্ছি। কোনো ধরনের অনিচ্ছা প্রকাশ করিনি। তাই তাদের কোনো সন্দেহ বা ভয় কিছুই নেই। সব সময় বাবা মায়ের কথা মত চলেছি।

আমার বিয়েটা হচ্ছে আমার খালাতো ভাইয়ের সাথেই। মানে ছোট খালার ছেলে। তাকে বলেই আজ বের হচ্ছি। যেহেতু তাকে বলে পারমিশন নিচ্ছি,সেহেতু কোনো ধরনের ঝামেলা হবে না।

ছোট খালা আমাকে অনেক ভালোবসে। তার মেয়ের মতই দেখে আসছেন সব সময়। আমার বাবা মায়ের কাছে তার একটাই আবদার তার ছেলের বউ বানাবে আমাকে। এটাও বলে রেখেছেন স্কুল লেভেলে যখন পড়ি। যদিও আমার বাবা মা ছোট খালার কাছে ঋণী। মুখ ফুটে বলতে পারেনি কিছু।

আমি রায়ান ভাইকে দেখেছি সেই ছোট বেলায়, তারপরে আর দেখিনি। কিন্তু যখন থেকে আমি জেনেছি ছোট খালা তার পুত্রবধূ বানাবে আমাকে,কেনো যেনো তার প্রতি ভালোবাসা আগের মত নেই। সত্যি বলতে তার মাঝে আর খালার ছাপ দেখতে পাইনি। অথচ আমার ফুফুরা আমাদের ভালো চোখে দেখে না,তবুও কেনো যেনো তদের প্রতি ভালোবাসা বেড়ে গেলো।

আমার জন্মের সময় আমার মা নাকি মৃত্যুর পথযাত্রী ছিলেন। কিন্তু ছোট খালা মাকে রিস্ক নিয়ে দুইবার রক্ত দিয়েছেন। রক্ত একসাথে দুইবার ডোনেট করলে নাকি জীবনের মারাত্মক ঝুঁকি থাকে,তবুও তিনি রক্ত দিয়েছেন আমার মাকে। সেই থেকে আমার ছোট খালার চাওয়ার কাছে আমার বাবা সব সময় প্রস্তুত।

ও হ্যাঁ! কি যেনো বলছিলাম! রায়ান ভাইকে সেই ছোট বেলার পরে আর আমি দেখিনি। রায়ান ভাইয়ের বাবা বেঁচে নেই। আমার জন্মের আগেই খালুজান মারা গেছেন। আমার ছোট বেলায় মাঝে মধ্যে আমাদের বাসায় আসতেন,কিন্তু ছোট খালা অন্য শহরে চাকরি পাওয়ার পরে আর আসেনি। এর পরে যখন একটু বড় হয় রায়ান ভাই বিদেশ চলে যান। বিদের যাওয়ার পরেই ছোট খালা আমার আব্বা মাকে বলেন আমাকে তার ছেলের বউ বানাবেন।

রায়ান ভাই সেই দেশের বাহিরে চলে গিয়েছেন, আর দেশে আসেনি। মাঝে মধ্যে ছোট খালা কয়েকমাস করে থেকে আসেন। অনেকবার আমার সাথে কথা বলতে চেয়েছেন রায়ান ভাই। কিন্তু আমার কেনো যেনো লজ্জা পাচ্ছিলো। তাই আর তার সাথে কথা হয়নি। রায়ান ভাইও লাজুক টাইপের। তিনিও তেমন চায়নি কথা বলতে।

আমার এইযে সকল কসমেটিকস, হাতের দামী মোবাইল সবই রায়ান ভাইয়ের দেওয়া। মানে ছোট খালা ভাইয়ের কাছে যেতেন আর এগুলা নিয়ে আসতেন।

আর আবিদ! হাহা আবিদের সাথে পরিচয় কাকতালীয় ভাবে। মাঝে মধ্যে ভাবলে ঠোঁটের কোনো হাসি পায়। সিনেমাটিক ধাক্কা যাকে বলে আরকি। আমার বান্ধবীর বড় বোনের বিয়েতে গিয়ে আবিদের সাথে পরিচয়। হোচট খেয়ে আবিদের গায়ের উপরে পরে যাই। এ কারনেই হয়তো ওর সাথে আমার প্রেমটা হয়েছে।

আবিদের কথা না হয় পরে এক সময় বলবো।

তিনটা বেজে গেছে। এখনই নিচে নামতে হবে। আবিদ ম্যাসেজ দিয়ে জানিয়ে দিলো আমার বাসার সামনের স্কুল গেইটে অপেক্ষা করতে। আমি মিনিট পাঁচেক অপেক্ষা করলাম,এরই মধ্যে আবিদ চলে আসলো। ওর গাড়িতে উঠে বসলাম।

কিছুক্ষন পরে ব্রেক কষে আবিদ বললো সামনে বসতে। আমি সামনে বসতে কিছুটা আনইজি ফিল করলাম,তবুও সামনে গেলাম।

– বা সাইডের কাজল লেপ্টে আছে।

– দেখলে কিভাবে?

-লুকিং গ্লাসে।

-এরই মধ্যে এত নজর?

– বিয়ের তারিখ ঠিক হয়েছে?

– হ্যা আগামী মাসের সাত তারিখ।

– আর মাত্র এগারো দিন আছে।

– হ্যা!

– পানির বোতলের মুখটা খুলে দাও তো তৃষ্ণা পেয়েছে।

– লং ড্রাইভ করে এসেছো?

– হ্যা চিটাগং থেকে এসেছি।

– সামনে গিয়ে ফ্রেশ হয়ে নাও।

– নাহ ঠিক আছে।

– কোথায় যাচ্ছি?

– চিটাগং।

– এতদূর?

– হ্যাঁ।

– কাল ফিরতে পারবো?

– হয়তো!

– হয়তো মানে?

– পারব ফিরতে।

– ভেবে বলছো?

– হ্যাঁ।

কিছুক্ষন পরে আবিদ আর আমি নামলাম। বুঝতে পেরেছি আবিদের খুধা পেয়েছে। রেস্টুরেন্টে গিয়ে আবিদের একার জন্য খাবার অর্ডার দিলাম। আমি খেয়ে বের হয়েছি,তাই খুধা লাগেনি। আমি লক্ষ্য করলাম আবিদ কিছুটা নিশ্চুপ। অন্য মনস্ক হয়ে তাকিয়ে আছে। খাবার সামনে।

আমি আবিদের পাশে গিয়ে বসলাম। আর খাবার ওর মুখে পুড়ে দিলাম। মাথা নিচু করে খাচ্ছে। হঠাৎ করে বলে উঠলো।

– খুবই সুন্দর লাগছে। আমি আবারো তোমার প্রেমে পড়ে গেলাম। কিন্তু প্রেমে পড়ার আগেই যে তোমাকে হারিয়ে ফেলতে চলেছি।

– কোনো কথা নয়। চুপচাপ খাও।

– হুম খাচ্ছি,গলা থেকে নামছে না।

– খাইতে দিচ্ছিতো।

– যাচ্ছিনা চিটাগং, এই শহরের আসে পাশেই থাকবো।

– তাল পাকিয়ে ফেলেছো? কি সব আবল তাবল বলতেছো।

– চার তারিখ ফ্লাইট।

– মানে?

– অস্ট্রেলিয়া যাচ্ছি,আপুর আছে। ফিরব না।

– অভিমান জমিয়ে?

– নাহ,ভালোবাসাকে উপহার দিয়ে।

– ঠিক বুঝলাম না।

– এই দেশটাকে আমার ভালোবাসাকে দিয়ে যাচ্ছি।

– ওহ।

– চলো আর খাবো না।

লং ড্রাইভ। ঘুমিয়ে পরেছি আমি। আবিদ ডাক দিয়ে উঠালো। আমি তাকিয়ে দেখি অন্ধকার রাত। সময় রাত সাড়ে নয়টা। আবিদকে জিজ্ঞেস করলাম কোথায় এসেছি আমরা। আমাকে বললো ওর মামাবাড়ির এলাকায়। গাড়ি থেকে নেমে ওর সাথে একটু পথ হাটলাম। আমি লক্ষ্য করলাম আবিদ আমার হাতটা ধরে আছে। আবিদের সাথে হাটলাম।

কলিংবেল বাজাতেই একজন ভদ্র মহিলা দরজা খুলে দিলেন। খোলার সাথে সাথে বললো… ”আমার আম্মাজান। ”

পায়ে সালাম করে নিলাম। কিন্তু আমি লক্ষ্য করলাম সে ঠায় দাঁড়িয়ে আছে। ঘরের মধ্যে ঢুকে আবিদ ওর মায়ের হাত ধরে মেঝেতে নিয়ে সোফায় বসালেন। বসিয়ে বললো….

– আম্মা কথা এসেছে, তুমি বলেছিলে কথাকে নিয়ে আসতে।

– কথা মা আসছে?কই আমার পাশে বসতে বল।

তার মানে আবিদের আম্মা চোখের দৃষ্টি শক্তি হারিয়ে ফেলেছে। চোখে দেখতে পায় না। আমার কিছুটা কান্না পেলো।

আমি আবিদের আম্মার পাশে গিয়ে হাতটা ধরে বললাম….

– জি আম্মা আমি বসেছি আপনার পাশে।

– মা! কথা জানো সেই কবেই আবিদকে বলেছি তোমাকে আমার কাছে নিয়ে আসতে। তার আজ হলো তোমাকে আমার কাছে নিয়ে আশার।

আমি চুপচাপ হয়ে আছি। তিনি আবারো বললেন…

-আচ্ছা মা অনেক দূর থেকেই মনে হয় আসছো। খাবার খেয়ে নাও। একটু রেস্ট নাও। তারপরে তোমার সাথে কথা বলি। কেমন মা!

– ঠিক আছে আম্মা।

আবিদ আম্মাকে খাবার টেবিলে বসিয়ে দিলেন। কিছুক্ষন পরে আসলেন এক মুরুব্বি। তার পরে আস্তে আস্তে কয়েকজনেই আসলেন।

খাবার টেবিলে বসেছি। একে একে সবার সাথে কথা বলে নিলাম। কিন্তু আমি খেতে পারছি না। আবিদ চোখের ইশারায় খেতে বললো। আমি পারছি না।

জোৎস্না রাত। আবিদের সাথে ওদের ফুল বাগানের মাঝে একটা বেঞ্চে বসলাম। আবিদ আমাকে বললো….

– “কথা, তোমার ব্যপারে আমার মায়ের কাছে সব কিছুই বলেছি। সেই অনেকদিন হয়েছে তোমাকে মায়ের কাছে নিয়ে আসতে বলেছে। কিন্তু কিভাবে নিয়ে আসবো বলো? আমার মা জানে না তুমি আমার হতে পারবে না। আমার মা যে অন্ধ তা তোমাকে বলিনি। কোথায় থাকে তাও বলিনি।

জানো কথা আমি তোমাকে অনেক ভালোবাসি। ঠিক কতটা ভালোবাসি বুঝেতে পারবো না। আমি তোমাকে যেমন ভালোবাসি আমার মাকেও তেমন ভালোবাসি। এই অন্ধমানুষটার কারনে আমি আত্মহত্যা করতে পারছি না। যদি কোনো ওয়ে থাকতো আমি হয়তো আত্মহত্যা করে ফেলতাম।

আর তোমাকেও আমার ধরে রাখার ক্ষমতা নেই। আমি ভেবেছিলাম আমার এই অনিশ্চিত ভালোবাসা জয়ী হয়ে আমার জীবনে তুমি থেকে যাবে। কিন্তু ঠিকই অনিশ্চিত থেকে গেলো। আমি তোমাকে আমার করে নিতে পারলাম না। তাই ভেবেছি আমি এবং আমার আম্মাজান অস্ট্রেলিয়া চলে যাবো। যদিও আম্মাজানকে আমি এখনো কিছু বলিনি। তবে ফ্লাইটের আগে আম্মাজানকে সব কিছু বলবো।”

আবিদের কথা শুনে চোখ ফেটে কান্না আসলো। আমার দমটা একেবারেই যেনো আটকে গেলো। আমি নিশ্বাস নিতে পারছিনা। আবিদকে খুব শক্ত করে জড়িয়ে ধরে কান্না করে দিলাম। কান্নার শব্দটা আমি আটকে রাখতে পারলাম না। হুঁহুঁ করে কেঁদে দিলাম। আবিদ আমাকে জড়িয়ে ধরে ঠায় দাঁড়িয়ে আছে। কোনো কথা বলছে না। আবিদ যেনো আমাকে খুব করে কাঁদতে সুযোগ দিচ্ছে।

আমি কতক্ষন আবিদকে জড়িয়ে ধরেছিলাম ঠিক মনে নেই। আবিদের শার্টটা ভিজে গিয়েছে চোখের পানিতে। আবিদের চোখের পানি আমার চোয়াল বেয়ে বড়ছে। তবুও কথা বলছে না। এক পর্যায়ে আমি আবিদকে বললাম…..

“আমি যাবনা। তোমার কাছেই থাকবো। ওই দিকে যা হবার হোক। কিন্তু তোমাকে ছেড়ে আমি যাব না। ”

– স্বার্থপরের মত কথা বলো না। বাবা মা আছেন। কত আশা করেছে তোমাকে নিয়ে।

– ঠিক হয়ে যাবে,আমি তোমাকে রেখে কোথাও যাব না।

– তুমি না গেলেও আমি এগিয়ে দিয়ে আসবো। তোমার জন্য কাউকে আমি কষ্ট পেতে দিব না। দরকার হলে আমি মরে যাবো,এই পৃথিবী ছা….

আমি আবিদের ঠোঁট বন্ধ করে দিলাম আমার দুই ঠোঁট দিয়ে। এই প্রথম অনুভব করলাম আবার ভালোবাসার অধিকার নিয়ে, প্রিয় মানুষের ঠোঁট লেপ্টে দিয়েছি…….

[চলবে……]

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here