দেয়াল_বন্দি(৩য় পর্ব)

0
3760

#দেয়াল_বন্দি(৩য় পর্ব)
লেখাঃMd. Nazmul Huda

ওর মায়ের চেইনটা আবিদের দিকে এগিয়ে দিতে দিতে বললাম…

– বাবা মাকে রাজী করে যদি তোমার কাছে যেতে পারি চেইনটা তখন তুমি পড়িয়ে দিও। আর যদি দেখো আমি তোমার জীবনে ফিরতে পারিনি ভেবে নিও আমি আর এই পৃথিবীতে নেই। আবিদ আমি সত্যিই তোমাকে ভালোবাসি।

গাড়ি থেকে নামার সময় ইচ্ছে হয়েছিলো,আবিদকে খুব শক্ত করে জড়িয়ে ধরি। কিন্তু আবিদের আমার প্রতি কোনো আগ্রহ নেই। আবিদ গাড়ি থেকে নেমে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। আমি হাটা দিয়ে কিছুদূপ এগিয়ে পিঁছু ফিরে দেখি অপলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে।

আমার ইচ্ছে করছিলো,দৌড়ে গিয়ে আবিদকে জড়িয়ে ধরি। কিন্তু তা আর সম্ভব না। আমার বাড়ির গেইটের সামনে যাওয়ার পরেই আবিদ চলে গেলো।

চোখের পানি ফেলতে ফেলতে সিঁড়ি বেয়ে আস্তে আস্তে উপরে উঠলাম। পা যেনো আগাচ্ছে না। আমার কলিজাটা ছিড়ে যাচ্ছিলো। এতটা অস্থিরতা আমার মাঝে সৃষ্টি হয়েছে,এই বুঝি আমার দমটা আটকে যাবে। আমি কি করবো বুঝে উঠতে পারলাম না। দরজায় কলিংবেল চাপতেই বাবা দরজা খুলে দিলো। আমি কারো সাথে কথা না বলেই আমার রুমে গিয়ে দরজা লক করে দিলাম।

বিছানায় গিয়ে আর নিজেকে কন্ট্রোল করতে পারলাম না। হুঁহুঁ করে কেঁদে দিলাম। এই বুঝি আমি আবিদকে হারাতে বসেছি। হঠাৎ করে আবিদের এত পরিবর্তন কেনো আসলো। আমাকে কেনোই বা এখন দূরে ঠেলে দিচ্ছে। আগে যতটা সহজ ভেবেছিলাম কিন্তু এখন আমার বেঁচে থাকাটাই বেশ কষ্ট হয়ে গেলো। আমি যে আবিদকে ছাড়া আর কাউকে আমার জীবনে গ্রহন করতে পারবো না।

আমার মা এসে দরজায় নক করলো। আমি দরজা খুলিনি। ভিতর থেকে জানিয়ে দিলাম বিশ্রাম নিচ্ছি। দরজা খুলতে লেইট হবে।

ফোনটা হাতে নিয়ে আবিদকে কল দিলাম….

– খুব সহজেই আমাকে এখানে নামিয়ে দিয়ে গেলে। একটুও কি কষ্ট হয়নি আবিদ?

– কষ্ট তো সেদিন পেয়েছি,যেদিন বলেছিলে তোমার বিয়ের দিন তারিখ ঠিক হয়েছে। কথা একটা সত্য কথা বলবা?

– হ্যা বলো।

– তুমি কি সত্যি আমাকে ভালোবেসেছিলে? আমাকে নিয়ে কি একটুও অনুভূতি হয়নি?

– ভালোবাসি কিনা জানো না তুমি? আমার যে দেয়ালে পিঠ ঠেকিয়ে ফেলেছি। আমি যে সাহস করে বলতে পারিনি বাবা মাকে।

– এমনটা না করলেও তো পারতে কথা। এখন আমার কি হবে? আমি কি নিয়ে বাঁচবো? আমি যে সত্যিই তোমাকে অনেক ভালোবেসে ফেলেছি।

– আমাকে এখানে দিয়ে গেলে কেনো? তোমার কাছে রেখে দিলেই তো পারতে।

– এছাড়া যে আমার আর কিছুই করার ছিলো না। তোমার বাবা মা তোমাকে নিয়ে কত স্বপ্ন দেখেছে। আর তুমি তো আগে থেকে পারোনি আমার ভালোবাসা প্রকাশ করতে। সব কিছু ঠিকঠাক হওয়ার পরে যদি এখন এমন কিছু করি তাহলে তোমার বাবা মায়ের কি হবে ভেবে দেখেছো? তাদের এক মাত্র মেয়ে তুমি। আর তোমার বড় ভাইটাও সবার অমতে গিয়ে বিয়ে করেছে। এখন তুমিও যদি বড় ভাইয়ের মত এমনটা করো তাহলে তারা মুখ দেখাতে পারবে? তোমার বড় ভাই সেই থেকে তোমাদের বাসায় আসে না। এখন তুমি এমন করলে তোমাকেও পরিচয় দিবে না তোমার বাবা মা। আমি কিভাবে এতটা স্বার্থপর হয়ে সবার ভালোবাসা থেকে বঞ্চিত করি?

– বাহ্! যে তুমিটা আমাকে সব সময় আশা দেখিয়েছো,সেই তুমিটাই আমাকে এখন হারিয়ে ফেলতে চাইছো। আরে কোনো না কোনো সময় আমাদের ঠিকই মেনে নিবে,কিন্তু তোমার জীবন থেকে আমি হারিয়ে গেলে আমাকে তুমি পাবে? বা তোমাকে আমি পাবো? অসম্ভব আবিদ। আমি তোমাকে হারাতে পারবো না। দরকার হলে আমি আত্মহত্যা করবো। কিন্তু তোমাকে হারিয়ে ফেলতে পারবো না। আমি বুঝে গিয়েছি তোমাকে ছাড়া আমার অন্য কারো জীবনে থাকা অসম্ভব।

– উল্টাপাল্টা বলো না। আত্মহত্যা সমাধান নয় কথা। ঠান্ডা মাথায় থাকো। আর তোমার রায়ান ভাই যথেষ্ট ভালো মানুষ। সেও তোমাকে ভালোবাসে। তার কাছেও তুমি হ্যাপি থাকবে। তাছাড়া তোমারই তো খালাতো ভাই হয়। কখনো অসন্মান করবে না। তোমার উপরে দুইটা পরিবার ডিপেন্ড করে। দুইটা পরিবারই তোমাকে অনেক ভালোবাসে।

– আর তুমি? তোমার আম্মাজান? আম্মাজান তো আমাকে ভালোবেসেই তার গলার চেইনটা খুলে আমার গলায় পড়িয়ে দিয়েছিলো। অথচ সে আমাকে চিনে না, কখনো দেখেওনি। তোমরা কি আমাকে ভালোবাসো না?

– ভালোবাসি। তোমার প্রতি ভালোবাসা থাকবে আজীবন। কিন্তু এভাবে নয়। আমি কাউকে ঠকিয়ে কিছুই করতে পারবো না। তোমার বিয়ের আর মাত্র দশদিন বাকী আছে। ভুলে গেলে চলবে না কথা।

– দেখে নিও আমি কি করতে পারি। আমিও সিদ্ধান্ত নিয়েছি,হয় আমি তোমার জীবনে থাকবো না হয় আমি দুনিয়া ছাড়বো।

– ড্রাইভিং করতে কষ্ট হচ্ছে। এখন রাখছি।

আবিদ ফোন কাটার পরপরই ছোট খালা ডাক দিলেন। আমি দরজা খুলে তার সামনে দাঁড়াতেই বললেন,….

– পরশু রায়ান আসবে। আমাদের সাথে তুই এয়ারপোর্টে যাবি। আমি তো এখানে তেমন চলাফেরা করিনি, তাই রাস্তাঘাট আমি চিনি না। দুলাভাই আর আপাকে বললাম,তারা যেতে পারবে না। কোথায় নাকি দাওয়াতের কাজ আছে।

– খালা আমিও যেতে পারবো না। আমাদের বাসার দারোয়ানকে নিয়েই যান। আমার হাতে কাজ আছে।

– কোনো কাজ নাই,আমার ছেলে আসতেছে, তাই আমার সাথে ছেলের বউকে নিয়ে যাবো।

– খালা এখনো আমি আপনার ছেলের বউ হইনি, আপনার বোনের মেয়েই আছি। আর আমার কাজ আছে বললাম তো।

– কি কাজ শুনি?

– ভার্সিটিতে যাবো।

– আপাতত আর ভার্সিটিতে যেতে হবে না। আমার ছেলে দেশে তিনমাস থাকবে,তুই সেই তিনমাস আমার ছেলেকেই সময় দিবি।

– আমার প্রচুর ঘুম পাইছে। একটু ঘুমাই?

– এই অসময়ে ঘুমাবি?

– এখন যে ঘুম পেয়েছে।

– তার চেয়ে চল, কিছু কেনাকাটা করে আসি। হাতেও তো সময় নেই। তাড়াহুড়ায় সবই ভুলে যাবো।

– মাকে নিয়ে যান। আমার খুব খারাপ লাগছে।

রায়ান ভাই আসার কথা শুনে মেজাজ কিছুটা বিগড়ে গেলো। এখন তাদের কোনো কথাই আমার ভালো লাগছে না। এখন আমার কি করা উচিত বুঝতে পারছি না।

ঘুম থেকে উঠলাম সন্ধ্যার পরে। মাথা কিছুটা ব্যথা করছে। কিচেনে গিয়ে চা বানিয়ে নিয়ে আসলাম। বাবা সোফায় বসে আছে তার হাতে কাপটা বাড়িয়ে দিয়ে বললাম।

– বাবা চা নেন। মা আর খালা কি বাহিরে গিয়েছে?

– হ্যা কি যেনো কেনাকাটা আছে তোর খালার। আচ্ছা তুই নাকি তোর খালার মুখের উপর কথা বলেছিস।

– মুখের উপরে বলিনি ঠিক। কিন্তু তার ছেলের বউ হওয়ার আগেই আমার তাদের কথা মানতে হবে কেন?

– তাই বলে ওভাবে?

– কিছু কথা ছিলো।

– বুঝিনি!

– তোমার সাথে কিছু কথা ছিলো।

– হ্যা বল কি বলবি?

– ভাবছি কিভাবে বলা যায়।

– আরে ইনিয়েবিনিয়ে না বলে সরাসরি বলে ফেল।

– বাবা আমি তো তোমাদের মেয়ে তাই না? আমি যদি কোনো ভুল করে থাকি ক্ষমা করবে?

– ঠিক বুঝতে পারছি না। কি এমন ভুল বলতো। আমায় ক্লিয়ার করে বল।

– বাবা আমি যদি মারা যাই মেনে নিতে কষ্ট হবে তাই না?

– কি সব আবল তাবল বলছিস কথা?

– উহু আবল তাবল হয়। যা বলছি সত্যিই।

– আরে তোর কি হয়েছে বলবি তো!

– চা ঠান্ডা হয়ে যাচ্ছে শেষ করো।

– আমার মাথায় কিছুই ঢুকলো না।

– আমার ভাইয়াকে তো গ্রহন করে নাওনি,সেই তিন বছর হলো, সে বাসায় আসছে না। একটা বার তো বললে না তাকে বাসায় আসতে।

– দেখ কথা ওর ব্যপারে আমার কাছে কিছু বলবি না।

– তোমাদের এই যে এগ্রিমেন্ট, তাতে আমরা ভাই বোনেরা তোমাদের কাছে ক্লজ হবো কিভাবে বাবা? আমাদের চাওয়া পাওয়ার কথা শেয়ার করবো কিভাবে? কখনো সুযোগ দিয়েছো আমাদের চাওয়া পাওয়া গুলো বলার জন্য। ফ্রি ভাবে কিছু বলতে দিয়েছো?

– হঠাৎ এই কথা?

– কারন তো অনেক কিছুই আছে। তোমরা যে রায়ান ভাইয়ের সাথে আমাকে বিয়ে দিতে প্রস্তুত, কখনো কি আমার মতামত জানতে চেয়েছো?

– তুই তো সবই জেনেছিস, শুনেছিস।

– হ্যাঁ জেনেছি,শুনেছি,তাই বলে একটাবারও কি আমার কথা চিন্তা করলে না। তোমাদের মতামতই কি সঠিক সিদ্ধান্ত?

– কথা বেশিই বলতেছিস। আমরা তো তোর খারাপ চাইবো না। রায়ান ভালো একটা ছেলে,ওর ভালো ইনকাম আছে। আর তাছাড়া বড় কথা হলো তোর খালা তোর মায়ের জীবন বাঁচিয়েছে।

– ভুল বললে বাবা। জীবন মরণ আল্লাহের হাতে। সে তো শুধু রক্ত দিয়েছিলো। হতে পারে দুইবার রিস্ক নিয়ে রক্ত দিয়েছে। তাই বলে??

– তো সমস্যা কি?

– সমস্যা নেই কোনো, আর আমি বলছিনা রায়ান ভাই খারাপ। কিন্তু তাকে বিয়ে করা আমার পক্ষে সম্ভব না।

– তোর মাথা ঠিক আছে?

– হ্যাঁ। আমি ভেবে চিনতে করেই বলেছি।

– সবাইকে দাওয়াত দেওয়া কমপ্লিট। আর এই মূহুর্তে কোনো কিছু করা সম্ভব না।

– ভালোবাসি। আমি একটা ছেলেকে প্রচুর ভালোবাসি। আমি তোমাকে অনেকবার বলতে চেয়েছি,কিন্তু তুমি বলার সুযোগ দেওনি। যেমনটা ভাইয়া’ও পেয়েছিলো না।

– এতদিন বললি না কেন?

– ওই যে বললাম সুযোগ দাওনি। এখন যে দেয়ালে পিঠ ঠেকে গিয়েছে,তাই তোমাকে এখন বলা।

– এখন আর কিছু করা সম্ভব না। মানিয়ে নিতে হবে। হুটহাট কোনো কিছু হয় না কথা। আর প্রেম ভালোবাসা হয়ে থাকে। ওসব সাময়িক সময়ের জন্য। আস্তে আস্তে সব ঠিক হয়ে যাবে।

– তোমাদের এটাই বড় সমস্যা যে আস্তে আস্তে সব ঠিক হয়ে যাবে। আমি রায়ান ভাইকে বিয়ে করতে পারবো না। যদি বুঝো তো ভালো না বুঝলে আমার কিছুই করার নাই। আমি চলে যাবো ওই ছেলের সাথে।

– যা ইচ্ছা বলে ফেললেই হবে? আমি যে সিদ্ধান্ত নিয়েছি,তোর সেটাই মানতে হবে। আমি তোর বাবা।

– হ্যা তুমি আমার বাবা এটাই বড় সমস্যা। কারন বাবাদের যে কিছু বলা যায় না। তাদের কথা’ই সব সময় রাইট। আমরা কি চাই না চাই তাতে তোমাদের কিচ্ছু আসে যায় না।

– বেয়াদব! মুখের উপরে তর্ক করছিস?

টেবিল থেকে বাবা কাপটা ছুড়ে ফেলে দিলো। রাগে সে ফোসফোস করছে। আমিও কম নই। আমার হাতের কাপটা ছুড়ে মেরে সোকেজের গ্লাসটা টুকরো টুকরো করে ফেললাম। এতদিন সব মেনে নিয়েছি,কিন্তু আর না।

দুইদিন কারো সাথে কথা বলিনি। ছোট খালা অনেক ডাকাডাকি করেছি,সাড়া দেইনি। হয়তো কিছুটা আঁচ করতে পেরেছে।
রাত এগারোটার দিকে রায়ান ভাই এসেছে। খালা আমাকে ডাক দিলো যাইনি। বাবার সাথে কথা বলে আমার রুমে এসে একটা ব্যাগ রাখলো রায়ান ভাই। রেখে বললো…

– অনেক বড় হয়ে গিয়েছো। এই ব্যাগে যা কিছু আছে সবই তোমার জন্য এনেছি।

আমি শুনেও না শোনোর ভান ধরে বসে রইলাম। রায়ান ভাই আমার কাছে গিয়ে হাতটা ধরে বললো….

– এই কথা,চুপ করে আছো কেনো?

– আপনি আমার হাত ধরলেন কেনো? বলুন হাত কেনো ধরেছেন? আর আপনি যে আমার রুমে এসেছেন,আমার পার্মিশন নিয়ে এসেছেন?

কিছুটা চিৎকার দিয়ে বললাম। সবাই দৌড়ে আসলো…….

[চলবে…….]

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here