#দেয়াল_বন্দি(৪র্থ পর্ব)
লেখাঃ Md. Nazmul Huda
রায়ান ভাইয়া আমার হাত ধরতেই আমি জোরে জোরে চেচামেচি শুরু করে দিলাম। আমার চিৎকার চেচামেচি শুনে সবাই আমার ঘরে চলে আসলো। রায়ান ভাইয়া ততক্ষণে আমার হাত ছেড়ে দিয়ে উঠে দাঁড়ালো। সবাইকে দেখে সে লজ্জা পেয়ে পাশে মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে আছে। বাবা জিজ্ঞেস করলো,
– কি হয়েছে কথা? এভাবে চিৎকার চেচামেচি করছিস কেন? কোনো সমস্যা?
– কিছু হয়নি। আর হলেও তোমাকে বলব না। আমার কোনো সমস্যা ই তোমাকে জানানোর প্রয়োজন মনে করিনা। কারণ তুমি আমাদের সমস্যা না কখনো বুঝতে চেয়েছো, না বুঝতে পেরেছো আর না তো বুঝতে পারবে। তুমি সবসময়ই তোমার সিদ্ধান্তে সঠিক৷ তাহলে এখন আমার কি হয়েছে কি হয়নি সেটা কেন দেখতে এসেছো??
– এসব কেমন ধরনের ব্যবহার কথা? তুই কি ভদ্রতা ভুলে গেছো??
– না ভুলে যাইনি। আর অভদ্রতাও করিনি। যেটা সত্যি সেটাই বললাম। আমাকে এখন একটু একা থাকতে দাও। সবাই এখান থেকে যাও। আমার ভালো লাগছে না।
রায়ান ভাইয়া বললো,
– আচ্ছা কথা তুমি এখন রেস্ট নাও। আমরা যাচ্ছি। পরে কথা হবে তোমার সাথে। কেমন?? আর গিফট গুলো দেখো। তোমার পছন্দের জিনিস নিয়ে এসেছি। আশা করি তোমার ভালো লাগবে।
আমি কোনো কথা বললাম না। ছোট খালা কিছু বলতে যাচ্ছিলো কিন্তু রায়ান ভাইয়া কিছু বলতে না দিয়ে তাকে নিয়ে ঘরের বাইরে চলে গেল।
বাবা আমার দিকে চোখ রাঙিয়ে তাকিয়ে বললেন,
– আমি যেন অপমানিত না হই। কথাটা মাথায় রেখো। এত বছরের আদর, স্নেহ, যত্ন, ভালোবাসার প্রতিদান হিসেবে মানুষের কাছে আমার মাথা নিচু করে দিস না।
এটা বলে আমাকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে চলে গেলেন। আমি দরজা বন্ধ করে দিলাম। ফ্লোরে বসে পড়লাম। অস্থিরতায় দম বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। একদিকে আবিদকে ছাড়া এক মুহূর্ত থাকতে পারছি না। অন্যদিকে বাবাকে বোঝাতে পারছি না। আবার আবিদ ও আমাকে এইভাবে গ্রহন করতে রাজি না। আমি এখন কি করবো? উফফ আমি যদি আগেই সাহস করে বাবাকে বলতে পারতাম! তখন তো বুঝতে পারিনি আবিদের নিরবতা আর অভিমান চেপে রাখা ভালোবাসা আমাকে এতটা কষ্ট দিবে, ওকে ছাড়া আমার এতটা পাগল পাগল লাগবে!
আবিদকে ফোন দিলাম। কয়েকবার ফোন দেয়ার পরে ধরলো।
– কতবার ফোন দিলাম কোথায় ছিলে তুমি??
– কি কারণে ফোন দিয়েছো?? এখন তো তোমার রায়ান ভাইকে সময় দেয়া উচিত। সে কতদিন পরে দেশে এসেছে। তার সাথে সময় কাটাও। আমাকে ফোন দিও না।
– শাট আপ আবিদ। এইভাবে কি করে বলতে পারো তুমি? এসব বলতে তোমার মোটেও কষ্ট হয় না??
– উহু। অনুভূতি মরে গেছে। ছোট ছোট অনুভূতি গুলো জড়ো হয়ে বিশাল এক ভালোবাসার সৃষ্টি হয়েছিলো। কিন্তু বড় এক ধাক্কায় সেটা ভেঙে গেছে। এখন আর এমন ছোট ছোট ব্যপারে কোন কষ্ট বা আনন্দ কোনোটাই পাই না।
– আবিদ।
আবিদের কথাগুলো বুকে তীরের মতো বিঁধছে। কেঁদে ফেললাম।
– কেঁদো না। ফোন রেখে রায়ান ভাইয়ার সাথে কিছুটা সময় কাটাও, ঘুরতে যাও, শপিং করো। অনেকটা হালকা লাগবে। একটা সময় আস্তে আস্তে অভ্যস্ত হয়ে যাবে।
– আবিদ, প্লিজ তুমি আমাকে এখান থেকে নিয়ে যাও। আমি মরে যাবো, প্লিজ নিয়ে যাও।
আবিদ ফোন কেটে দিলো। আরো কয়েকবার ট্রাই করলাম। কিন্তু ফোন তুললো না। এতটা অভিমান! কাঁদতে কাঁদতে ফ্লোরেই ঘুমিয়ে পড়লাম। পরদিন সকালে উঠে ফ্রেশ হয়ে রুমের ভেতরে শুয়ে ছিলাম। এর মাঝে আবিদকে বেশ কয়েকবার ফোন দিয়েছি। কিন্তু ধরে নি। এত এত মেসেজ করেছি কিন্তু একটা মেসেজের ও রিপ্লে দেয়নি। কি যে করবো বুঝতেছি না।
বাবা এসে ডাকাডাকি করে গেল। বলে দিয়েছি বের হবো না। পরে খালা এসেও ডাকলেন। পরে দেখি রায়ান ভাইয়া ও এসেছেন। দরজা খুলে দিলাম। রায়ান ভাইয়ার সাথে কথা বলা দরকার। কারণ এখন একমাত্র রায়ান ভাইয়া-ই পারে বিয়েটা ভাঙতে।
– খেতে এসো কথা।
– ভাইয়া আপনার সাথে আমার একটু কথা বলার ছিলো।
– ঠিক আছে। আগে খেতে এসো। সবাই একসাথে খাবো অনেকদিন পরে। এসো এসো।
– ভাইয়া কথাটা খুবই জরুরী।
– আরে বাবা শুনবো তো। তোমার সব কথাই শুনবো। এত বছর দেশের বাইরে ছিলাম এখন দেশে এসেছি, আর তোমার কথা শুনবো না? আমার এত এত জমানো কথা বলব, তোমার জমানো কথা শুনবো। তবে এখন আগে খেতে এসো। আমার ভীষণ খিদে পেয়েছে।
– হুম।
আমি আর কোনো কথা না বলে চুপচাপ খেতে বসে গেলাম। খাবার নামছে না গলা দিয়ে। কিন্তু তবুও খাচ্ছি।
খাওয়া দাওয়া শেষ হওয়ার পরে রায়ান ভাইয়া বললেন,
– রেডি হও। শপিং করতে বের হবো।
– কিন্তু ভাইয়া আমি যে বলেছিলাম আমার আপনাকে জরুরি কথা বলার আছে?
– তো আমি কখন মানা করলাম? বাইরে বসেও তো বলা যায়। আর জরুরি কথা ভালো কোনো জায়গায় বসেই বলা উচিত। তাই না??
– না আমি কোথাও যেতে চাইনা। আমি এখনই বলবো।
– কিন্তু আমি তো এখন শুনবো না। আমার সাথে বাইরে গেলে তবেই শুনবো।
বাধ্য হয়ে রেডি হয়ে বের হলাম ভাইয়ার সাথে। ভাইয়া একটা রিকশা নিলো।
– তুমি কিছু বলার আগে আমি তোমার কাছে ক্ষমা চাচ্ছি কাল রাতে তোমার হাত ধরার জন্য। আসলে আমি ওইভাবে তোমার হাত ধরিনি। আর বুঝতেও পারিনি এইভাবে রিয়েক্ট করবে। স্যরি। তুমি খারাপ কিছু মনে করো না প্লিজ।
– আচ্ছা ঠিক আছে। এখন আমার কথাটা আপনাকে শুনতে হবে। এটা আমার জীবন মরণের প্রশ্ন।
– আচ্ছা বলো।
– ভাইয়া আমি একজনকে ভালোবাসি। ওকে ছাড়া কাউকে বিয়ে করা আমার পক্ষে সম্ভব না। বাবাকে আমি অনেক বুঝানোর চেস্টা করেছি। কিন্তু উনি আমার কথা বুঝতেই চান নি। তাই আমি আপনার কাছে বললাম।
– ওও আচ্ছা, এই ব্যাপার?
– হুম ভাইয়া আপনি প্লিজ কিছু করুন।
– আচ্ছা।
এরপরে এই বিষয় নিয়ে আর কোন কথা হয়নি।ভাইয়া জোর করে কিছু শপিং করে দিলো। সেগুলো নিয়ে কিছুক্ষণ পরে বাসায় ফিরে আসলাম।
বাসায় এসে কারো সাথে কথা বললাম না। খালা এসে অনেক কিছু জিজ্ঞেস করে গেলেন। কিন্তু আমি কোনো কথার উত্তর না দিয়ে নিজের ঘরে চলে গেলাম। খালা কিছুটা আন্দাজ করতে পেরেছেন হয়তো। বিড়বিড় করে কিসব বলতে বলতে বেরিয়ে গেলেন আমার ঘর থেকে। কিছুক্ষণ পরে আবিদ কে কল দিয়ে বেলকনিতে এসে দাঁড়ালাম। তখন বাবার রুম থেকে জোরে জোরে কথা বলার আওয়াজ পেলাম। কি কথা হচ্ছে বুঝতে পারছি না। ওখান থেকে বাবার ঘরের সামনে গেলাম। খালা আর বাবার মধ্যে কি নিয়ে যেন কথা কাটাকাটি হচ্ছে।
– আমার ছেলে কথাকে অনেক পছন্দ করে। কিন্তু আপনার মেয়ের আচার আচরণ আমার কাছে সন্দেহজনক মনে হচ্ছে। যদি আমার ছেলে কষ্ট পায় তাহলে আমি কিন্তু ছেড়ে কথা বলব না। আর যে টাকাগুলো নিয়েছেন এর জন্য আমি আইনের আশ্রয় নিবো।
এটা বলেই খালা বাবাকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে রুম থেকে বের হয়ে গেলেন। কি নিয়ে কথা বললেন? টাকা কিসের? বাবা আর খালার মধ্যে টাকা নিয়ে কোন লেনদেন আছে বলে তো আমার মনে হয় না। ভাবতে ভাবতে নিজের রুমে চলে আসলাম। আবিদকে ফোন দিলাম আবারো। চারবার দেয়ার পরে ধরলো।
– আবিদ আমি তোমার সাথে দেখা করতে চাই।
– সম্ভব না।
– তুমি এরকম কেন করছো আবিদ? আমাকে কি বুঝতে পারছো না?
– তুমি আরেকজনের বউ হতে যাচ্ছো কথা, বুঝতে পারছো না?
– আমি তোমার বউ হতে চাই।
আবিদ আমার ফোন কেটে দিলো। এই আবিদের কি হলো বুঝতেছি না। ওর বাসায় যাবো আমি।কাল সকালেই যাবো।
সকালে ঘুম থেকে উঠে নিজেই চমকে গেলাম। সারাবাড়ি সাজানো হচ্ছে। মায়ের কাছে জিজ্ঞেস করতে বললেন আজ নাকি আমার এংগেজমেন্ট। মুহূর্তেই মাথায় আকাশ ভেঙে পড়লো। আমি মায়ের সাথে জোরে কথা বলছি দেখে বাবা আমাকে হাত ধরে টেনে নিজের ঘরে নিয়ে গেলেন। কি করব বুঝতে পারছি না। আবিদকে ফোন দিয়েই যাচ্ছি কিন্তু পাচ্ছি না। রায়ান ভাইয়াকে তো আমি বলেছিলাম কিন্তু তা সত্বেও উনি আমার সাথে এরকম টা কিভাবে করতে পারলেন? অনেক বড় অন্যায় হচ্ছে আমার সাথে। আমি এটা কিছুতেই মানবো না। আমি আবিদকে ভালোবাসি, আর বিয়ে যদি করতে হয় তাহলে ওকে-ই করবো। নাহলে নিজেকে শেষ করে দিবো।
গলায় ওড়না পেঁচিয়েছি। কিন্তু সেই মুহূর্তে মনে হলো আমি যদি মরে যাই তাহলে কি লাভ? আবিদকে তো পেলাম না। আর তাছাড়া আমার কিছু হয়ে গেলে অবিদ ও বাঁচবে না। তার থেকে। এনগেজমেন্ট টা করে নেই। তারপর এখান থেকে বের হতে পারলেই আমি আবিদের কাছে চলে যাবো। আমার সাথে সবাই মিলে অন্যায় করেছে। আমি কেন অন্যের কথা ভাববো??
ওড়না খুলে চুপচাপ বিছানায় বসে পড়লাম। এর মধ্যে আবিদের একটা মেসেজ আসলো,
“আজ তাহলে অন্যের হয়েই যাচ্ছো? দোয়া করো আমার জন্য যাতে নিশ্বাস টা নিতে পারি অন্তত আমার আম্মাজানের জন্য।”
মেসেজটা পড়ে বুকের ভেতর মোচড় দিয়ে উঠলো। চোখের দুইফোটা পানি গড়িয়ে পড়লো ফোনের ওপরে! ফোন টা বুকের সাথে চেপে ধরে আছি। চোখের পানি বাঁধ মানছে না।
রায়ান ছোট খালা ডাক দিলেন….
-মেহমান আসছে তাড়াতাড়ি বের হবে……
[চলবে………]