দেয়াল_বন্দি (২য় পর্ব)

0
3207

#দেয়াল_বন্দি (২য় পর্ব)
লেখাঃ Md. Nazmul Huda

আমি আবিদের ঠোঁট বন্ধ করে দিলাম আমার দুই ঠোঁট দিয়ে। এই প্রথম অনুভব করলাম আবার ভালোবাসার অধিকার নিয়ে, প্রিয় মানুষের ঠোঁট লেপ্টে দিয়েছি। আবিদ ঠায় দাঁড়িয়ে আছে। ওর মাঝে কোনো অনুভূতি আমি দেখতে পেলাম না। দুইহাত আবিদের কাধের উপর রেখে মিশিয়ে আছি ঠোঁট দুটি।

আবিদ আমাকে ছাড়িয়ে নিলো। ছাড়িয়ে নিয়ে বললো…

– কথা এসব কি?প্লিজ পাগলামি ছাড়ো। আর তাছাড়া এখন আর সময় নেই,ফুরিয়ে গিয়েছে। চাইলেই এখন সব কিছু সম্ভব না।

– তুমি চাইলে সম্ভব আবিদ। আমি তোমার কাছেই থেকে যাবো। যতই বলো না কেন আমি যাচ্ছি না।

– বাসার মধ্যে চলো।

– দেখো আবিদ, এতদিন কেনো যেনো তোমাকে হারানো ভয় ছিলো না। এখন ভয় হচ্ছে। আমার ভিতরটা পুড়ে যাচ্ছে গো। আমি পারব না তোমাকে হারাতে। আবিদ আমি আসলে এতদিন একটা ঘোরের মাঝে ছিলাম। কিন্তু আজ আমি বুঝতে পারলাম তোমাকেই আমার লাগবে।

– কথা দেখো আমি এখন চাচ্ছি না তুমি আমার জীবনে রয়ে যাও। যে তুমিটা দুইটা বছরেও আমাকে বুঝলে না। যে তুমি পারলে না দুই বছরে আমার কথা তোমার পরিবারকে জানাতে। যে তুমি পারলে না তুমি আমার ভালোবাসাকে প্রকাশ করতে। সেই তোমাকে আমি এই মুহূর্তে আমার কাছে রাখার সাহস পাই না। তুমি তোমার বাবা মাকে কষ্ট দিতে পারলেও আমি পারব না তাদের কষ্ট দিতে।

– তোমার আম্মাজান তো চান আমাকে তোমার হতে? পারবে তাকে কষ্ট দিতে?

– দেখো সে এসবের কিছুই জানে না। যদি জানে তাহলে সেও বলবে তোমাকে রেখে আসতে। তুমি পারোনি ভালোবাসাকে আটকে রাখতে। যদি একটু আমার দিকে তাকাতে,যদি একটু আমার ভালোবাসাকে গভীর ভাবে ছুঁয়ে দেখতে তাহলে আজ এমন পরিস্থিতি হত না। তুমি আমাকে ভালোবাসো ঠিকই কিন্তু আমার ভালোবাসাকে স্পর্শ করতে চাওনি তুমি। শুধু ভালোই বেসে গিয়েছো। কিন্তু ভাবোনি পরবর্তীতে আমাদের কি হবে। আমারই ভুল ছিলো কথা,আমি তোমার ব্যাপারে সব কিছু জেনে শুনেও তোমাকে ভালোবেসেছি। কই তুমিও তো আমাকে ভালোবেসেছিলে। আমাদের ভালোবাসা তো এক তরফা ছিলো না। অনেক ভাবেই তোমাকে বুঝিয়েছি কিছু একটা করো,পরিবারকে জানাও আমাদের ব্যপারে।কিন্তু পারোনি তুমি। এখন কিছুই করার নেই। আজকে তোমাকে এনেছি আমার মায়ের চাওয়ার কারনেই,নতুবা তোমার সাথে আমার আর যোগাযোগ হতো না।

– আবিদ তুমি আমাকে যা খুশি বলো, আমাকে শাস্তি দাও,তবুও আমাকে এখন মাঝ রাস্তায় ফেলে দিও না। আমি স্বীকার করছি সমস্ত ভুল আমারই। আমি পারিনি তোমার ভালোবাসা প্রকাশ করতে,এখন আমি অনুতপ্ত আবিদ। আমি তোমাকেই চাই।

– একটা সময় মানুষ পাথর হয়ে যায়। ভালোবাসতে হলে একে অপরকে বুঝতে হয়। সব কিছু একার চিন্তায় থাকলে সফল হওয়া যায় না। দুজনেরই আপ্রান চেষ্টা করে ভালোবাসাকে জয়ী করতে হয়। ভালোবাসাকে শক্ত করে ধরে রাখতে হয়,আর সেই শক্ত করে ধরেই জীবন পাড় করে দেয়া যায়। সিচুয়েশন? আরে সিচুয়েশন তো সবারই আসে। কখনো বলেছো তুমি আমাকেই বিয়ে করবে? যদি কেউ না মানে তাহলে আমার হাতটি ধরবে। ভালোবাসি! ভালোবাসি! আর ভালোবাসি। এটাই বলে গিয়েছো। কিন্তু একটাবার ভাবলে না আমাদের ভবিষ্যৎটা কি! আজ আমার আম্মাজান না থাকলে বা আরেকটা ভাই থাকলে আমি হয়তো আত্নহত্যার পথ বেছে নিতাম। ভাবছো কষ্ট পেয়ে? উহু একদম না। কষ্ট কিসের? তুমি আমার ভালোবাসাকে সন্মান দাওনি,আমার ভালোবাসাকে তুমি সেই চোখে দেখোনি। ঘৃণা লাগে বড্ড ঘৃণা লাগে নিজের উপর। আর এই ঘৃণা থেকেই মরে যেতে ইচ্ছে করে।

– আবিদ প্লিজ! এভাবে বলছো কেনো? আমার অনেক কষ্ট হচ্ছে। সমস্ত অপরাধ আমার। এখন আমাকে এভাবে ফিরিয়ে দিও না।

– দেখো এসব শুনতে ভালো লাগছে না। ঘুমাবো এখন,তুমি মায়ের কাছে যাও। আর হ্যা সকালে রেডি হয়ে থেকো।

আবিদ আমাকে এখানে রেখেই চলে গেলো। আমি চুপচাপ দাঁড়িয়ে আছি। চাঁদের আলো আমার মুখের উপরে পরছে। কিছুটা বিরক্ত লাগছে আমার। যত সময় আবিদ ছিলো এখানে,বেশ ভালোই লাগছিলো,ওর মায়া ভরা মুখ দেখে। অনেক অভিমান নিয়ে আবিদ আমাকে কথা গুলো বলেছে। কিন্তু আমার প্রতি আবিদের রয়েছে অসীম ভালোবাসা।

আমি সিদ্ধান্ত নিয়েছি আবিদের ব্যপারে আজই বাবাকে ফোন দিয়ে বলবো। আমি কোনো ভাবেই আবিদকে হারাতে পারবো না। যদি আমার বাবা মা আমার ভালোবাসা মেনে নেয় তো, আবিদকে নিয়ে তাদের সামনে যাবো। আর যদি মেনে না নেয় তাহলে আমি এখানেই আম্মাজানের কাছে থেকে যাবো।

ফুল বাগান থেকে আমি আমার ফোনটা নিতে আবিদের রুমে গেলাম। এরই মধ্যে আবিদ আমাকে বললো….

“আম্মাজান তোমাকে ডেকেছে”

আমি আস্তে আস্তে আম্মাজানের কাছে গেলাম। আবিদ দরজার সাথে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। আম্মাজানের পাশে গিয়ে বসার পরে বললেন…..

– মা কথা,সেই কখন তোমাকে ডাকলাম।

– আম্মাজান আমি ফুল বাগানে ছিলাম।

– কথা মা আমার দুইটা সন্তান। আমার বড় মেয়েটা তো সেই অনেকদিন হলো অস্ট্রেলিয়া আছে। আসার কোনো নাম গন্ধ নাই। আর আমার ছেলেটা থাকে চিটাগং। আমার এখানে একারই কাটাতে হয়। কারো সাথে যে সময় কাটাবো সেই মানুষটা পাই না। আর তাছাড়া আমি অন্ধ মানুষ, বছর পাঁচেক হলো চোখের দৃষ্টি হারিয়েছি। আমার কিছুই ভালো লাগে না মা। আমার ছেলেটা চেয়েছে ওর সাথে চিটাগং নিয়ে যেতে। কিন্তু আমি যাইনি। ওর বাবার কবরটা এখানে, তাকে একা ফেলে আমি কিভাবে যাই। আবিদকে এত করে বললাম তোমাকে এখানে নিয়ে আসতে,তোমার বাবা মায়ের সাথে কথা বলিয়ে দিতে। কিন্তু আমার ছেলেটা কিছু শুনলোও না। এখন তুমি যেহেতু এখানে এসেছো, তোমার বাবা মাকে আসতে বলো। আমি তাদের সাথে কথা বলবো। মা কি বলছি শুনেছো?

– জি আম্মাজান। (আম্মাজানের কথা শুনে আমি কি বলবো জানা নেই। তার কথা যতই শুনি ততটা চোখ ফেটে কান্না আসে।)

– মা আমার ছেলের কিন্তু কোনো কিছুতে কমতি নাই। আর তাছাড়া ভালো একটা চাকরি করে। তোমরা দুজন দুজনাকে তো ভালোবাসো। এখন বিয়েটা করে নাও। মা তোমার হাতটা আগাও তো…

আমি তার সামনে হাতটা এগিয়ে দিয়ে বললাম…

– আম্মাজান এইতো আমার হাত।

– আমি তো অন্ধ মানুষ, এই চেইনটা তুমি আসার পরে খুলে রেখেছি,এটা পড়ো তুমি। আমি দেখলে তো নিজ হাতেই পড়িয়ে দিতাম।

– আম্মাজান সেই থেকে অন্ধ অন্ধ বলতেছেন। এটা কিন্তু ঠিক না। আম্মাজান চেইনটা পরে পরলে হয় না?

– না এখনি পড়বে। আমি গলায় হাত দিয়ে অনুভব করবো। ভালো লাগার তৃপ্তি নিবো যে আমার কথা মা চেইনটা পরেছে।

আমি আবিদের দিকে তাকিয়ে আছি। কি করবো বুঝতেছিনা। তাই আবিদের দিকেই তাকিয়ে আছি। আবিদ মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে আছে। ওর কাছে কোনো জবাব পেলাম না। তাই আম্মাজানের পাশে বসেই চেইনটা গলায় দিয়ে বললাম….

-আম্মাজান পড়েছি।

– এইতো আমার মিষ্টি মা। আমি দেখতে পারলে হয়তো খুবই ভালো লাগতো,নিজ চোখে আনন্দ উপভোগ করতাম। কিন্তু আল্লাহ তায়ালা আমার চোখ দুইটা কেড়ে নিলো।

আম্মাজানের সাথে কথা বলা শেষ করে ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখি রাত একটা ছুঁইছুঁই। ভেবেছিলাম আমার বাবার কাছে ফোন দিবো। কিন্তু এতরাতে বাবাকে ফোনে পাওয়া যাবে না। বাবা তাড়াতাড়ি ঘুমিয়ে পরে।

বেলকনির রেলিং ধরে দাঁড়িয়ে আছি। অপরপাশে তাকিয়ে দেখি আবিদ সিগারেট টানছে। আমি রেলিং ঘেঁষে আবিদের পাশে গিয়ে দাঁড়ালাম। আবিদ সিগারেটটা ফেলে দিয়ে ধোঁয়া ছেড়ে বললো…

-ঘুমাওনি যে?

– ঘুম আসবে না।

– না ঘুমিয়েই কাটিয়ে দিবে?

– জানি না।

– যাও ঘুমিয়ে পড়ো।

– কোলের উপর রেখে ঘুম পাড়িয়ে দাও।

– উহুঁ,নিজেই ঘুমাও।

– দেখো আবিদ আমি তোমার কথা শুনে এখানে এসেছি। আমার চাওয়াটা তো পুরন করবে তাই না?

– আমি কিন্তু জোর করিনি এখানে আসতে। তোমাকে একবার বলেছিলাম। তুমি রাজী হয়ে গেলে।

– কি হয়েছে তাতে? দাওনা একটু মাথাটা তোমার কোলে রাখতে।

আমার কথার দিকে আবিদের তেমন গুরুত্ব নাই। আমি অপলক দৃষ্টিতে বাহিরে তাকিয়ে আছে। আমি যে ওর পাশে দাঁড়িয়ে আছি সেই অনুভূতিটুকু নাই। আনমনে কি যেনো ভাবছে? আমি আবিদের হাতটা আঁকড়ে ধরে ওর কাধে মাথা রাখলাম। অপর হাত দিয়ে আবিদের কোমড়টা ধরে বললাম….

– চাঁদটা কিন্তু সুন্দর, আলোটা একদম তোমার মুকে এসে পড়েছে। আমার কিন্তু হিংসে হচ্ছে, আলো তোমায় ছুঁয়ে দিচ্ছে। এদিকে তো একটু তাকাবে?

– কথা এখন আর আমরা প্রেম করছি না। এসব বাদ দাও।

– দেখো তো আম্মাজানের দেওয়া চেইনটায় আমায় কেমন মানিয়েছে।

– সুন্দর মানিয়েছে।

– যখন আমি তোমার কাছে আসলাম,তোমার সাথে আজীবন থাকতে চাই সেই তুমি আমাকে দূরে ঠেলে দিচ্ছো। দাও ঠেলে,আমি আর এখান থেকে যাবো না।

– কারণ তুমি এতদিনে আমাকে বুঝোনি, আগের গতিতেই তুমি চলেছো। কিঞ্চিৎ পরিমান তুমি ভাবোনি যে আমাদের পরবর্তীতে কি হবে।

– বাদ দাও না প্লিজ। আমাকে একটু জড়িয়ে ধরো। খুব করে বুকের সাথে মিশিয়ে নাও না। আমার কিন্তু খুব কষ্ট হচ্ছে।

আবিদ আমাকে জড়িয়ে ধরেছে ঠিকই,কিন্তু ও অন্য মনস্ক হয়ে আছে। আবিদ এতটাই পাথর হয়ে আছে,যেনো আমার চোখের জল ওর মনটা নরম করতে পারেনি। আবিদের গলাটা ধরে বললাম…

– আমাকে হারিয়ে ফেলতে চাও?

– জানি না।

– রেখে দাও না তোমার কাছে।

– উহুঁ!

– একবার হারিয়ে গেলে যে আর কোনো দিন আমাকে পাবে না।

– আমার ভাগ্যে যে এটাই ছিলো।

– এখন আমি তো চাই থেকে যেতে।

-এভাবে সম্ভব না

– মরে যাই?

– শখ হয়েছে?

– জানি না। তবে এখন তুমি ছাড়া আমি কিছু ভাবতে পারি না। দুইটা বছর যতটা তোমাকে অনুভব করতে পেরেছি,তারচেয়ে আজকের দিনটায় তোমার মাঝে ডুবে গিয়েছি।

– করুনা করছো?

– না তোমার হয়ে থাকতে চাচ্ছি।

আবিদের গলা থেকে আমার হাত দুইটা সরিয়ে নিয়ে বললো….

তোমার বিয়ের আর মাত্র দশদিন আছে। দশদিন পরে তুমি অন্যের হয়ে যাবে। এখন এসব চিন্তা না করলেও হবে।

পরেরদিন সকালে আবিদ আমাকে নিয়ে বের হয়েছে। ওর মায়ের চেইনটা এখনো আমার গলায়। গাড়িতে উঠে জিজ্ঞেস করলাম কোথায় যাচ্ছি আমরা। জবাবে বললো আমাকে বাসায় এগিয়ে দিতে যাচ্ছে।

আমি আর কিছু বললাম না। চুপ করে রইলাম। যাকে এত করেই বললাম তার কাছে রেখে দিতে,সে এখন আমাকে বাসায় পৌঁছে দিতে যাচ্ছে। ঘন্টা পাঁচেক সময় গাড়িতে বসেছিলাম দুজনে তেমন কোনো কথাই বললাম না।

আমার বাসায় নামার আগ মুহূর্তে আবিদ আমাকে বললো…

– যদি বাবা মাকে আমার কথা বলার সাহস পাও,তবেই আমার জীবনে এসো। অপেক্ষায় রইলাম দশটা দিন।

ওর মায়ের চেইনটা আবিদের দিকে এগিয়ে দিতে দিতে বললাম…

– বাবা মাকে রাজী করে যদি তোমার কাছে যেতে পারি চেইনটা তখন তুমি পড়িয়ে দিও। আর যদি দেখো আমি তোমার জীবনে ফিরতে পারিনি ভেবে নিও আমি আর এই পৃথিবীতে নেই…

[চলবে………]

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here