#দ্বিতীয়_পুরুষ,পর্ব ১২,১৩
_নীলাভ্র জহির
১২
নবযৌবনা চিত্রা স্বামীর স্পর্শে যেন পূর্ণযৌবনা হয়ে উঠেছে। তার দিকে তাকালেই রূপকের হৃদয়ে দোলা দিতে শুরু করে। এমন একজন নারীকে স্ত্রী হিসেবে পেয়ে সে নিজেকে ধন্য মনে করছে। তাইতো সকালবেলা স্ত্রীকে নাইওরে রেখে চলে যেতে মন চাইছিলো না তার। খুব ভোরে উঠে খালা তার জন্য হাঁসের মাংস রান্না করেছে। গরম ভাত দিয়ে হাঁসের গোশত দিয়ে ভাত খেয়ে রূপক কুন্দনপুর এর উদ্দেশ্যে রওনা দিল। রূপক চলে যাওয়ার পর বিষাদ নেমে এলো চিত্রার মনে ও দেহে। কোথাও যেন এতটুকুও শান্তি নেই। কোন কাজই করতে ভালো লাগছিল না। খালাতো ভাইয়ের বউয়েরা এসে তাকে সঙ্গ দিতে চেষ্টা করছিল। কিন্তু আজকে যেন গল্প করতেও চিত্রার মন বসলো না। নারী মনের অদ্ভুত রহস্য বুঝতে পারল না চিত্রা।
খালা বাড়িতে এক রাত থেকে পরদিন মেজ ভাবী বাপের বাড়িতে চিত্রাকে নিয়ে বেড়াতে গেলেন। নতুন বউ বলে সবাই বেশ খাতির যত্ন করলো তাকে। ভালো ভালো খাবারের আয়োজন করা হয়েছে, আশেপাশের প্রতিবেশীরা তাকে দেখতে আসছিলো। সব মিলিয়ে ভালো সময় কাটলো সেদিন। খালাবাড়িতে আসার একদিন পর জোসনা এলেন চিত্রাকে নিতে। সারা রাত চিত্রার ঘুম হয়নি। শশুর বাড়িতে যাওয়ার জন্য সে শুধু ছটফট করেছে। বার বার বার মনে হচ্ছিল তার আত্মা বোধহয় ফেটে যাচ্ছে রূপককে কাছে পাওয়ার জন্য, রূপককে একটু দেখার জন্য। সকাল হতেই নিজের ব্যাগটা গুছিয়ে চিত্রা অপেক্ষা করছিল কখন জোসনা আসবেন।
জ্যোৎস্না এসে খাওয়া-দাওয়া ও গল্পগুজব করলেন তার বোনের সঙ্গে। এক ফাঁকে উঠল যৌতুকের কথা। চিত্রাকে শুনিয়ে শুনিয়ে জ্যোৎস্না তার বোনের পুত্রবধূদের বাড়ি থেকে নিয়ে আসা যৌতুকের কথা বলছিলেন, তোর ছেলের বউয়েরা বাড়ি থেকে সব আনছে। ঘরের আসবাবপত্র , খাট শোকেস ,থালা-বাসন হাড়ি পাতিল, সংসারের যাবতীয় জিনিসপত্র তারা বাপের বাড়ি থাইকা নিয়া আইছে। মেজ বউয়ের বাপেরা তো ঘর ভর্তি কইরা জিনিস দিছে। অথচ আমার পোলার কপালটা এত খারাপ। এতো ভালো পোলা আমার, রাজপুত্তুর। অথচ ঘোড়ার আণ্ডা পাইছে। এমন ঘরের মাইয়া আনছি যেইখানে পোলা শ্বশুরবাড়িতে গিয়া একবেলা ভাত খাওয়ার সৌভাগ্য হইব না।
কথাগুলো শুনে চিত্রার কষ্টে বুক ফেটে যাচ্ছিল। তার স্বামী রূপকের এসব জিনিসপত্রের প্রতি কোন আগ্রহ নেই। রুপক কখনো তাকে যৌতুকের ব্যাপারে কোন কথা শোনায় না। অথচ সুযোগ পেলেই জোসনা তাকে ইনিয়ে বিনিয়ে বিভিন্ন জিনিস নিয়ে খোটা দিতে থাকেন। এসব কখনো শেষ হবে না হয়তো। চিত্রা মনে-মনে আক্ষেপ করতে থাকে। কেন তার সোহরাব উদ্দিনের ঘরে জন্ম হলো? সেও তো কোনো বড়লোকের আদরের দুলালী হতে পারত।
জ্যোৎস্নার সঙ্গে বাড়ি ফিরে এলো চিত্রা। বড় খালা সঙ্গে করে পিঠাপুলি বানিয়ে দিয়েছেন। বাড়ি ফিরতেই জোসনার ননদ ও প্রতিবেশীরা পিঠা খেতে ভীড় করলো। রূপকের জন্য সে আলাদা করে কিছু পিঠা রেখে দিল ঘরে। রূপক কখন ফিরবে সেই অপেক্ষায় তার যেন গলা শুকিয়ে আসছিল বারবার।
রাত নামলেই চিত্রা হাতমুখ ধুয়ে মাথায় সুগন্ধি তেল মাখলে। চুল আঁচড়ে খোঁপা করে একটা নরম সুতির শাড়ী পরল। মাথা ঢেকে ফেলল শাড়ির ঘোমটা দিয়ে। গালে হালকা করে ফেস পাউডার ও ঠোঁটে একটু লিপস্টিকও দিল। কুপির আলোয় বসে বসে হাতে লাগালো আলতা। রূপক কখন ফিরবে? তার খুব জোরে জোরে হৃদস্পন্দন হচ্ছে। তার অপেক্ষায় এমন তো হয়নি আগে। তিন দিন তাদের দেখা হয়নি বলেই কি এত প্রতীক্ষা?
অবশেষে ফিরলো রূপক। তার হাতে একটা ব্যাগ। ব্যাগটা জোসনার হাতে তুলে দিল রূপক। বলল, মা এইখানে জিলাপি আছে। আমার ঘরে থালে কইরা একটু পাঠাইয়া দিও।
তারপর সোজা এসে ঘরে ঢুকলো রূপক। মিষ্টি মধুর সুরে ডাকলো, বউ ও বউ। ঘরে আছো?
চিত্রার কলিজায় যেন পানি ফিরে এলো। সে জবাবে কোন উত্তর দিতে পারল না। কেবল নিঃশব্দে গুটি গুটি পায়ে রূপকের সামনে এসে দাড়ালো। হারিকেনের মৃদু আলোয় রূপক দেখলো তার মিষ্টি বউটাকে। মনে হল যুগযুগান্তর ধরে সে তার বউকে দেখেনি। যেন দুজনের দুটি মন বহু দূরে সরে গিয়েছিল। রূপককে দেখে একই অবস্থা হল চিত্রারও। নিজেকে সংযত করে রাখা বড় দায়। চিত্রা থরথর করে কাঁপছিল। রূপক দুই হাত দিয়ে চিত্রাকে জাপ্টে ধরলো। মাথা থেকে ঘোমটা সরিয়ে চিত্রার গলায় সে মুখ ডুবিয়ে দিলো। চিত্রার প্রতীক্ষিত দেহ-মন রূপককে পেয়ে যেন পাগলপারা হয়ে গেল। রূপকের চুল খামচে ধরল সে। দুজন মিলে বেশ কিছুক্ষন ধস্তা-ধস্তি চলতে লাগলো। এমন সময় শোনা গেল জোসনার গলা। হঠাৎ ঘরের দরজায় এসে দাঁড়িয়েছেন জোসনা। ভেজানো দরজা ঠেলে ঘরে প্রবেশ করলেন। চিত্রা অপ্রস্তুত অবস্থায় একে অপরকে ছেড়ে দিয়ে দূরে সরে দাঁড়ালো।
ঘোমটা টা বড় করে টেনে দিল চিত্রা।
জোসনা কিছু না বলে জিলাপির প্লেট টেবিলের উপর রেখে বেরিয়ে গেলেন।
রূপক বলল, আস বউ জিলাপি খাই।
লজ্জায় চিত্রার মুখটা লাল টকটকে হয়ে গেছে।
রুপক কাছে এসে পেছন দিক থেকে তার পেটে হাত বুলাতেই খিল খিল করে হেসে উঠল চিত্রা। সে গায়ের জোরের ওকে ঠেলে সরিয়ে দিতে চেষ্টা করলো কিন্তু তবুও রূপক এমনভাবে তাকে ধরছিল যে বারবার তার হাসি চলে আসছিল। অনেক কষ্টে চিত্রা হাসি সংবরণ করে জিলাপি খেতে বসলো। জিলাপি খাওয়া প্রায় শেষ হয়েছে এমন সময় রুবিনা এসে বলল মা আপনারে ডাকতাছে।
চিত্রা মাথায় ঘোমটা টেনে দিল। হাতে এখনো অর্ধেক জিলাপি রয়ে গেছে তার। জিলাপি ফেলে রেখে সে শাশুড়ির ঘরে এলো।
বিছানার উপর মুখ গোমড়া করে বসে আছেন জোসনা। তার চোখে-মুখে রাজ্যের বিরক্তি। রাগে গমগম করছেন। চিত্রার ভীষণ ভয় হতে লাগলো।
জোসনা বললেন, তোমার কি লাজ শরম কিছু নাই? কিছু শিইখা আসো নাই? অবশ্য কেমনে শিখবা? মা নাই। বাপ একটা পাগলা। কে শিখাইবো তোমারে এসব নিয়ম কানুন? এত রাইতে যে তোমরা এমন বেসরমের মত হাসতাছো পাড়ার লোকে কি কইবো? মানসের কাছে শরমে মুখ দেখতে পারুম না। এত কিসের হাসি। রঙ্গ-তামাশা করবা ভালা কতা। পাড়ার লোকরে জানাইয়া করতে হইবো নাকি। আমাদের কি বিয়ে হয় নাই? আমরাও তোমাদের মত সময় পার কইরা আইছি। এত বেশরম আছিলাম না।
চিত্রা মাথা নিচু করে রইল। মনটা খুব খারাপ হয়ে গেছে। বিষন্নতার ভাড় এ শাড়ির আঁচল আলগা হয়ে যাচ্ছিল মাথা থেকে। আঁচল ধরে রাখার মতো শক্তিটুকুও তার নেই। জোসনার কথাগুলো তার গায়ে কাঁটার মতো বিঁধ ছিল।
জোসনা বললেন, তোমার বাপের বাড়িত খবর পাঠাও। তিন-চার দিনের মধ্যে সাইকেলটা দিতে কও। এক মাস তো হইয়াই গেল। আমার পোলায় আর কত কষ্ট করবো। খালার বাড়িতে তো গেছ। দেখছো ঘরভর্তি কত জিনিসপত্র। এইগুলা সব মেয়েরা বাপের বাড়ি থাইকা আনছে। তোমার কাছে তো এত জিনিস চাই নাই বাপু। এত জিনিস চাইলেও তো পাইতাম না। আমরা তো জাইনা শুইনাই বিয়া দিছি। পোলার কপাল খারাপ। আমি আর কি কমু? পোলায় কয় আমি এই মাইয়ারে বিয়া করমু। এখন তোমার বাপেরে তাড়াতাড়ি সাইকেলটা দিতে কও। আইজ হইল সোমবার। শুক্কুরবার এর মধ্যে দিতে কইবা। কথাটা কানে ঢুকছে। নাকি আবার কমু?
খুব কঠোর গলায় জোসনা কথাটা বলে গেলেন। চিত্রার বুকে হাতুড়ি পেটার মতো শব্দ হচ্ছে। মনে হচ্ছে তার পায়ের তলা থেকে মাটি সরে যাচ্ছে। জোৎস্না যখন তাদের ঘরে গিয়ে তাদেরকে অন্তরঙ্গ অবস্থায় দেখে ফেলেছেন তাই হয়তো তার মনে আগুন জ্বলছে। হোক সে মা কিংবা অন্য কেউ। কাউকে কাছাকাছি দেখলে হিংসা জেগে ওঠে। অন্যের প্রেম কেউ সহ্য করতে পারেনা। এখন জ্যোৎস্না খুব কঠোর গলায় চিত্রাকে যৌতুকের ব্যাপারে চাপ দিতে লাগলেন। চিত্রা মাথা নিচু করে ঘর থেকে বের হয়ে এলো। জিলিপি খাওয়ার পর হাত ধোয়া হয়নি। হাতে লেগে রয়েছে জিলাপির রস। কিন্তু এই মুহূর্তে হাত ধুতে ইচ্ছে করছে না। রান্নাঘরের পাশে একটা মোড়ার উপর ধপ করে বসে রইল চিত্রা। সে এখন কি করবে? সেদিন তার ভাই অনেক সুন্দর করে অনুরোধ করার পরও এখন ভাইয়ের কাছে কিছু চাইলে তার লজ্জা করবে। তারপরও অনেক চিন্তাভাবনা করে চিত্রা মনস্থির করল আগামীকাল সকালে একবার ওই বাড়ি থেকে ঘুরে আসবে।
অনেকক্ষণ স্তব্ধ হয়ে চিত্রা রান্না ঘরের দাওয়ায় বসে রইল। কিছুক্ষণ পর এসে দাঁড়ালো রূপক।
কিগো বউ তোমারে কখন থাইকা ডাকতাছি।
চিত্রা কোন উত্তর দিল না।
রূপক বলল, কথা কইতাছো না কেন?
চিত্রা তবুও নিশ্চুপ হয়ে রইল।
রুপক বলল, মেজাজটা খারাপ করতেছ কিন্তু। কি হইছে কইবা তো? মায় কিছু কইছে তোমারে?
চিত্রা নিরুত্তর। রূপক বসল তার সামনে। বেশ রাগী গলায় বলল, মন চাইতেছে একটা থাপ্পড় বসাইয়া দেই।
সঙ্গে সঙ্গে চিত্রা কান্না ভেজা গলায় বলল, দেন। কে নিষেধ করছে আপ্নারে?
রাগ সংবরণ করে নিল রূপক। মেজাজ ঠান্ডা করার চেষ্টা করে বলল, কি হইছে? কান্দো কেন?
চিত্রা কান্না ভেজা গলায় বলল, খুব কপাল কইরা জন্মাইছি তো তাই কানতেছি। আপনার সেইগুলা শোনা লাগবোনা। মেজাজ খারাপ হইয়া গেছে তাইনা। পিটাইতে মন চাইতাছে। পিডান আমারে।
চুপ করো বউ। মেজাজটা একটু খারাপ হইয়া গেছিল। তোমারে কখন থাইকা ডাকছি তুমি কোন উত্তর দিতেছ না। কতকিছু জিগাইতাছি তাও কিছু কইতাছো না। তাই মাথাটা গরম হইয়া গেছিলো। মায় কিছু কইছে তোমারে।
খুব তো হাসাহাসি করতে ছিলেন। এত কইরা মানা করলাম তাও শুনতে ছিলেন না। আপনার মায় খেইপা গেছে। আমাগো সুখ কারো সইতেছে না।
রূপক বলল, আস্তে কথা কও। এত জোরে কইও না।
কিছুই কমু না। কওনের দরকার নাই। সব মুখ বুইজা সইহ্য কইরা যামু।
রূপক কিছুক্ষন চুপ করে রইলো। সে খুব ভাল করেই জোসনার স্বভাব জানে। জ্যোৎস্না ভয়ঙ্কর রাগী মহিলা। ছোট ছোট ব্যাপারে তিনি অনেক রেগে যান। রেগে গেলে কাকে কি বলছেন মাথা ঠিক থাকেনা। নিশ্চয়ই চিত্রাকে খারাপ কিছু বলেছেন তিনি। রূপক চিত্রার হাতটা ধরে বলল রাগ কইরোনা বউ। আসো ঘরে আসো। কতদিন পর মনে হইতাছে তোমারে দেখতাছি। তোমারে একটু ভালো কইরা দেখমু। তোমার লগে একটু সুখ দুঃখের কথা কমু। এর মধ্যে তুমি মন খারাপ কইরা থাইকো না। তোমার মুখ আন্ধার দেখলে আমার কষ্ট হয়।
চিত্রা চুপ করে রইলো। তাকে হাত ধরে টেনে দাঁড় করালো রূপক। বলল, ঘরে চলো বৌ।
রূপকের পিছুপিছু চিত্রা ঘরে চলে এলো। এবার সে ঘরের দরজা বন্ধ করতে ভুল করল না। বিছানার ওপর পড়ে রয়েছে আধ খাওয়া জিলাপি। নিশ্চয়ই তার জন্য রেখে দিয়েছে রূপক। স্বামী তাকে অনেক ভালোবাসে। শত কষ্টের মধ্যে এটাই তার সৌভাগ্যের জায়গা।
রূপকের ফোন থেকে ফুফুর বাড়িতে একটা কল দিলো চিত্রা। তার ফুফুর সঙ্গে কথা বলে জানাল সাইকেল এর ব্যাপারে। সোহরাব উদ্দিনের সঙ্গে ফুপু যেন জরুরী কথা বলে। দু চার পয়সা যা পারে তাই দিয়েই সে যেন মেয়েকে সাইকেল কিনে দেয়ার ব্যাপারে তার ফুফাতো ভাইদেরকে সহায়তা করে। কথাগুলো বলে ফোন কেটে দিয়ে চিত্রা হাউমাউ করে কান্না চলে এলো। বালিশে মুখ গুঁজে কান্না চেপে রাখল সে।
রুপক বললো, এখনো তুমি কানতাছ। মায় কি তোমারে সাইকেল এর ব্যাপারে কিছু কইছে?
না,
তাইলে তুমি ফুফু আম্মারে কইলা?
কইলাম জানি আমার অশান্তি না হয়।
তোমারে কেউ অশান্তি দিব না। আমি কি তোমারে সাইকেলের কথা কিছু কইছি?
চিত্রা চুপ করে রইলো। স্বামীর কাছে শাশুড়ির দুর্নাম করতে চাইল না। তাই কথাটা হজম করে গেল সে।
এমন সময় রবিনা এসে দরজা ধাক্কা দিয়ে ডাকতে লাগলো, ভাইজান মা ভাত খাইতে ডাকতাছে।
চিত্রা বলল,আপনে যান। আমার আইজ খিদা নাই। আপনে খাইয়া লন।
রূপক হাত ধরে টানতে টানতে বলল, এত রাগ কইরা থাইকা লাভ নাই। উঠো আমার লগে ভাত খাইবা।
রূপকের টানাহেচড়ায় বাধ্য হয়ে উঠতে হলো চিত্রাকে। কিন্তু গলা দিয়ে ভাত নামল না। তিন চার দিনের ভিতরে কিভাবে সে সাইকেল জোগাড় করবে। তার বাপ-ভাই কেউই সেটা পারবে না। না পারলে নিশ্চয়ই সংসারে অনেক অশান্তি হবে। ভবিষ্যতের কথা ভেবে চিত্রা ভাত খেতে পারছিল না। অল্প একটু ভাত নিয়ে কিছুক্ষণ নাড়াচাড়া করছিল সে।
জোসনা বললেন, কিসের ঢং শুরু করছো। খাইতাছো না কেন?
মাথা নিচু করে রইল চিত্রা।
জোসনা বললেন, কাউরে দেখি কিছু কওন যায়না। ভালো কথা কইলেও দোষ। আমি তোর বউরে খালি কইছি এত জোরে হাইসোনা। পাড়ার লোকে খারাপ কয়। তাতেই সে খাওন বন্ধ কইরা দিছে। জমিদারের বেটি হইছে। কিছু কওন যাইবো না।
চিত্রার গাল বেয়ে টপটপ করে অশ্রু গড়িয়ে পড়ল। সেই অশ্রু চোখের আড়াল হলোনা রূপকের। নিশ্চুপ হয়ে রইল রূপক। চিত্রার চোখের জল ভাতে মিশে যাচ্ছে।
চলবে..
#দ্বিতীয়_পুরুষ
পর্ব ১৩
_নীলাভ্র জহির
চিত্রার শাশুড়ি তাকে তিন দিন সময় দিয়েছেন যৌতুকের সাইকেলটা দেয়ার জন্য। কিন্তু তার অসহায় বাবা জানিয়েছেন তার সামর্থ্য নেই । দুদিন কামলা দিয়েছেন কিন্তু কোন টাকা পাননি। খেয়ে না খেয়ে কোনমতে তার দিন যাচ্ছে। এমতাবস্থায় তিনি জামাইয়ের সাইকেলের জন্য কোন টাকা দিতে পারবেন না। সকালবেলা ফোন করে কথাগুলো জানিয়েছে চিত্রার ফুফু। তিনি কিছুটা আশ্বস্ত করে বলেছেন তার ছেলেদেরকে আর কিছুদিন সময় দিলে ওরা ব্যবস্থা করে দিতে পারবে। কিন্তু সেই কথার মাঝে কোন ভরসা ছিল না। চিত্রা বেশ বুঝতে পারছে সামনে তার করুণ পরিণতি অপেক্ষা করছে। নিশ্চয় শ্বশুরবাড়িতে তার মাথাটা এবার নিচু হয়ে যাবে। শাশুড়ি মায়ের সামনে কিভাবে দাঁড়াবে বুঝতে পারছেনা চিত্রা।
পরের দুদিন খুব দুশ্চিন্তায় কাটলো। সময় চাওয়ার পরেও ফুপাতো ভাইদেরকে আবার অনুরোধ করাটা সমীচীন হবে না। তাই আপন মনে দুশ্চিন্তা নিয়ে তার সংসারে পড়ে রইল চিত্রা। কেটে গেল কয়েকটা দিন। এরমধ্যে জোসনা বেগম তাকে কিছুই বলেনি। চিত্রা সর্বক্ষণ ভয়ে ভয়ে থাকে কখন তিনি সাইকেলের কথাটা তোলেন। কি উত্তর দেবে সেটাও ঠিক করে রেখেছে চিত্রা। সে বলবে আপনার পোলার লগে আমার কথা হইছে। সে আমারে কইসে কয়দিন পরে দিলেও চলব। তার উত্তরে হয়তো জোসনা বেগম বলবেন আমার পোলার মাথাটা খাইয়া বইসা রইছ। এ ধরনের অনেক কথাই হয়তো তাকে শুনতে হবে। সেটার জন্য চিত্রা নিজেকে মানসিকভাবে প্রস্তুত করল। তিনি যাই বলুক না কেন ছেলের কথা বলার পর হয়তো আরো কিছুদিন সময় পাওয়া যাবে। তবে চিত্রা এই বিষয়ের উপরে কিছুই জানালো না।
দিন কাটছে তার নিজের গতিতে। শাশুড়ি মায়ের সংসারে চিত্রার অধিকার খুব একটা নেই। শাশুড়ি তাকে যখন যা আদেশ দেয় সে শুধু তাই পালন করে। তিনি এসে বলেন আজকে কচুর লতি দিয়ে চিংড়ি মাছ রান্না। চিত্রা বাড়ির পাশ থেকে কচুর লতি তুলে নিয়ে এসে রান্না করে ফেলে। শাশুড়ি যখন বলে আইজ আমার ঘরের বিছানার কাপড়চোপড় গুলো ধুয়ে দিও। চিত্রা কাপড়গুলো পাজা করে নিয়ে পুকুর পাড়ে গিয়ে সানন্দে কাপড় ধুয়ে দেয়। এভাবেই চলছে তার সংসার। কখনো বা নিজের বুদ্ধিতে তাকে কাজ করতে হয়। প্রথম প্রথম এসব কিছুই বুঝতো না সে। কিন্তু সকালবেলা যখন শাশুড়ি বলতো বইসা না থাইকা যদি থালা বাসন গুলো ধুয়ে আনতা তাও তো একটা কাম হইতো। কখনো বা চিত্রাকে শুনিয়ে শুনিয়ে তিনি বলেন গরুর পেট ভরে নাই। একটু যে ঘাস কাইটা দিমু সেই সময়টাও পাইতাছি না। তাই বুদ্ধি করে আগেভাগেই চিত্রার গরুকে খাবার দিতে হয়। সংসারের টুকিটাকি কাজ এখন সে নিজে থেকেই সামলে নেয়। তবে মাঝে মাঝে হয়ে যায় ভুলভ্রান্তি। দেখা যায় সে এমন একটা কাপড় ধুয়ে ফেলেছে যেটা ময়লাই হয়নি। তখন জ্যোৎস্না তার সঙ্গে রেগে যান। দুদিন আগে ধোয়া কাপড় এখনও পড়াই হয়নি অথচ সেটা সে কেন ধুয়ে দিয়েছে। আবার কখনো দেখা যায় এমন কাজ করে বসে আছে যেটা তার করার কোন প্রয়োজন ছিল না। এভাবেই চলছে তার সংসার।
এরই মধ্যে একদিন জোছনা বেগম সাইকেলের কথা তুললেন। চিত্রাকে ডেকে নিয়ে এসে বললেন,, কোন খবর টবর নাই যে।
চিত্রা বলল, কিসের খবর আম্মা।
কিসের খবর আবার? আমার পোলাডা কি এবার হাইটা হাইটা কামে যাইবো।
চিত্রা বলে ফেলল, আপনার পোলা কি এতদিন হাইটা হাইটা কামে গেছে?
রেগে গেলেন জোসনা বেগম। রাগত স্বরে বললেন, তুমি দেখতেছ না সে কেমনে যায় কামে। অত কথা বুঝিনা বাপু। মেলাদিন হইয়া গেল। বিয়ের দুই মাস হইয়া যায়। এখনও সাইকেল দিল না। কোন দিন আর দিবো। দিতে না পারলে তোমার বাপরে কও কইয়া দিক। আমি আমার পোলারে কই সে যেন নিজের টাকায় সাইকেল কিনা লয়। পোলা মানুষ করতে পারছি আর একটা সাইকেল কিনে দিবার পারুম না। সবই পারুম। তাও মানুষের একটা শখ থাকে শ্বশুর বাড়ি থাইকা কিছু পাওনের। তাই বইলা ভাইবো না আমরা তোমাগো আশায় বইসা থাকমু। তোমার বাপে যদি না পারে তাইলে আমরা আমার পোলারে সাইকেল কিইনা দিমু। শ্বশুরবাড়ির কোন আদর যেহেতু তার কপালে নাই সাইকেলের ও কোন দরকার নাই।
চিত্রা বলল-আপনার পোলার লগে আমার কথা হইছে। সে কইছে আর কয়টা দিন পরে দিলেও চলব।
তা তো করবোই। পোলা তো আর পোলার মধ্যে নাই। সে তো নিজের সমস্যা দেখবার পারতেছেনা। অন্ধ হইয়া গেছে। পোলাগো বিয়া দিলে তখন পোলারা অন্ধ হইয়া যায়। চোখে কিছু দেখবার পারেনা।
বিড়বিড় করে নানান কথা বলতে বলতে জোসনা বাড়ির বাইরে বেরিয়ে গেলেন। তবে তার বিলাপ কমলো না। বাড়ির ভিতরে যা বিড়বিড় করে বলেছেন বাড়ির বাইরে গিয়ে তা জোরে জোরে বলছেন। বিষয়টা খুবই কষ্টদায়ক। চিত্রার মাঝে মাঝে ভীষণ কষ্ট হয়। তার শ্বাশুড়ীর এই স্বভাবটা মোটেও ভালো লাগে না তার। নিজেদের ঘরের কথা তিনি স্বেচ্ছায় এলাকাবাসীকে জানিয়ে দেন। যেখানে তার উচিত ছিল ঘরের সমস্যা ঘরেই মিটিয়ে ফেলার সেখানে তিনি সব কথা গ্রামবাসীকে জানিয়ে অনেক সুখ পান বোধহয়।
চিত্রা ভাবল আজকের মত ঝামেলাটা মিটেছে। হাতে আরও কয়েকদিন সময় পাওয়া গেল নিশ্চয়ই এর মধ্যে তার ভাইয়েরা একটা ব্যবস্থা করে ফেলবে। কিন্তু তার ধারনা ভুল। রাত্রিবেলা রূপক ফিরলে জোসনা আবারও এই কথাটা তুললেন। ঘরের দাওয়ায় বসে সবাই মিলে ভাত খেতে বসেছে।
জোসনা বেগম রূপককে বললেন, তোর শ্বশুর বাড়ির ব্যাপার স্যাপার কিছু বুঝতাছিনা। তারা কি তোর সাইকেলটা দিব না নাকি? আমি কিন্তু তোর বউরে কইয়া দিছি যদি না দিবার পারে তাইলে না কইরা দিক। তুই একটা সাইকেল কিইনা লস। একটা সাইকেলের দাম আর কতই হইবো। এত কিছু করবার পারতাছস, একটা সাইকেল কিনবার পারবি না। অবশ্যই পারবি।
রূপক নিঃশব্দে ভাত খাচ্ছে। এক ফাঁকে বলল, আচ্ছা দেখি পুরান সাইকেল একটা পাইলে কিনা লমু।
সঙ্গে সঙ্গে ভয়ঙ্কর রেগে গেলেন জোসনা বেগম। তবে সরাসরি স্বামী ও সন্তানের মুখের উপর কিছু বলতে পারলেন না।
খাওয়া-দাওয়ার পর বিড়বিড় করে জোসনা বেগম ছেলের দুর্ভাগ্যের বিলাপ করতে লাগলেন। মৃদু স্বরে কথা গুলো চিত্রার কানে এলো, সে রূপককে এ ব্যাপারে কিছুই বলল না। এ তার দুর্ভাগ্য। সে জন্মেছে গরীবের ঘরে। এতোটুকু দুঃখ তো তাকে সইতেই হবে।
পরপর কয়েকটা দিন কেটে গেল। সাইকেল নিয়ে আর তেমন কোন কথা উঠল না। চিত্রার জীবনে অশান্তি নেমে এলো সেদিন, যেদিন রূপক একটা পুরনো সাইকেল কিনে বাড়ি ফিরল। যেন আকাশ ভেঙ্গে পড়ল জোসনা বেগম এর মাথায়।
রূপক সাইকেল চালিয়ে বাড়িতে ঢুকে ঘরের দাওয়ায় হেলান দিয়ে রাখলো সাইকেলটা। জোসনা বেগম চোখ বড় বড় করে বললেন, এটা কই পাইলি? কার থাইকা আনছোস? মানসের সাইকেল লইয়া কদ্দিন চলবি।
রূপক সঙ্গে সঙ্গে হেসে উত্তর দিলো, মা আমি এইটা কিনছি। তুমিতো কইছিলা একটা সাইকেল কিনা লস। তাই কিইনা আনলাম। রফিককে কইছিলাম একটা সাইকেলের খোঁজ করতে। ও আইজ সাইকেলটার কথা কইল। দেখতে গিয়া নিয়া আইলাম।
জোসনা বেগম রাগত স্বরে বললেন, তোর মাথা খারাপ হইয়া গেছে। কিল্লাইগা সাইকেল কিনছোস। তুই আইজ রাইতেই সাইকেল ফেরত দিয়া আসবি।
রূপক বলল, সেটা তো আর হইব না মা। সাইকেলটা আমি ঘন্টাখানেক চালাইয়া দেখছি। জিনিস সব ঠিকঠাক। নগদ টাকা দিয়া আইছি। এটাতো আর ফেরত দেওয়া যাইবো না। এই সাইকেল এখন আমার।
মাথা গরম হয়ে গেল জোসনা বেগমের। যে জিনিস ছেলের শ্বশুরবাড়ি থেকে পাবার কথা সেটা ছেলে নিজের টাকায় কিনে নিয়ে এসেছে। অথচ তার নতুন বউ হেসে-খেলে ফুর্তি করে বেড়াচ্ছে। সাইকেলের ব্যাপারে সে বাপের বাড়িতে কোনো জোরাজোরি ও করেনি মনে হচ্ছে। উলটো সে হয়ত নিজেই রূপককে কুবুদ্ধি দিয়ে এই পুরনো সাইকেল টা কিনিয়ে নিয়েছে। সব দোষ ঐ মেয়ের এটা ভেবে জোসনা বেগম ভয়ঙ্কর রেগে ঘরের ভেতরে গিয়ে ঠাস করে দরজা আটকিয়ে দিয়েন। তার শ্বাসকষ্ট শুরু হয়েছে। এত বড় একটা ঘটনা কিছুতেই তিনি মেনে নিতে পারছেন না। এই মেয়ে তার সংসারে একটা অশান্তি বয়ে নিয়ে আসবে তিনি নিশ্চিত ।
চিত্রা ঘর থেকে বের হয়ে সাইকেল দেখে ভীষণ খুশি হয়ে উঠল। রুপক তাকে ভালোবাসে এটা সেই ভালোবাসারই বহিঃপ্রকাশ। সে সাইকেল কিনে এনেছে মানে চিত্রার সম্মানটাকে উঁচু করেছে। কারণ এতে করে চিত্রাকে আর বাপের বাড়িতে সাইকেলের জন্য তাড়া দিতে হবে না। শ্বশুর বাড়িতে থাকতে হবেনা ছোট হয়ে। রুপক ভীষণ ভালবাসে তাকে। চিত্রা ছুটে এসে রূপকের হাতটা খপ করে ধরলো। এই প্রথম রূপকের হাত ধরতে তার লজ্জা করল না। অধিকারবোধের প্রবল টানে সে রূপকের বুকের কাছে নিজেকে লেপ্টে নিল। আবছা অন্ধকারের মাঝে চোখে চোখ রেখে বলল আপনি সাইকেল কিইনা আনছেন। কত টাকা দাম লইছে?
রুপক বলল, দাম শুনে কি করবা? জিনিসটা কেমন কিনছি হেইডা কও?
চিত্রা সাইকেলটা পরখ করে বললো ভালোই তো মনে হইতাছে।
আন্ধারের মধ্যে তো কিছুই বুঝবা না। সকালবেলা দেইখো। আমার মেলা দিনের শখ আছিল সাইকেলে বউরে বসাইয়া ঘুরতে বাহির হইবো।
লজ্জায় রাঙা হয়ে গেল চিত্রার মুখ। সে বলল, আপনি খালি বেশি বেশি কথা কন? আম্মা সাইকেল দেইখা কি কইলো?
কিছু কয় নাই। অনেক ক্ষুধা লাগছে দুইটা ভাত দাও তো খাই।
আপনে হাত মুখ ধুইয়া আসেন আমি ভাত দিতাছি।
চিত্রা রান্নাঘরে গিয়ে গামলা ভরে ভাত ও বাটিতে করে তরকারি নিয়ে দাওয়ায় রাখল। হাতমুখ ধুয়ে এসে খেতে বসলো রূপক। তার শাশুড়ি ঘরের ভেতর। তাই চিত্রা নিজেই তার স্বামীকে আজকে আপ্যায়ন করল। এই প্রথম সংসারের এক অন্যরকম স্বাদ আস্বাদন করতে পারলো চিত্রা। স্বামীর ভাতের প্লেটে তরকারি তুলে দিয়ে পাখা দিয়ে বাতাস করতে পরম আনন্দ হচ্ছিল। যদিও বাতাস করার কোন প্রয়োজন নেই। দাওয়ায় দক্ষিণ দিক হতে শিরশির করে বাতাস আসছে। গা হিম করা বাতাস। সেই হাওয়ায় বসে পেট ভরে ভাত খাচ্ছে তার স্বামী। তবুও মনের সুখে চিত্রা হাতপাখা নেড়ে বাতাস করছে। এতে তার পরমানন্দ।
সারারাত আজ চিত্রার মনে পরম সুখ বিরাজ করল। সে জানতেও পারল না পরের দিন তার কপালে কত বড় দুর্ভোগ অপেক্ষা করছে। আজ রাতে রাগ করে জোসনা বেগম ভাত খেলেন না। স্বামীর সঙ্গে আগেভাগে ভাত খেয়ে ফেলায় সেটা জানতেও পারল না চিত্রা। খুব ভোরে ঘুম থেকে উঠে সংসারের কাজকর্ম করার সময় ভাতের হাড়িতে অনেকখানি ভাত দেখে চিত্রা অবাক হল। গরুর জন্য প্রতিদিন অল্প কিছু নষ্ট ভাত থাকে । কিন্তু এতগুলো ভাত থাকার কথা নয়। তাহলে এতগুলো ভাত পাতিলে কি করে এলো।
চিত্রা তার ননদকে ডেকে জিজ্ঞেস করলো রাতে আব্বা আম্মা ভাত খাইছে?
তার ননদ মৃদু স্বরে বলল আব্বা খাইছে আম্মা উঠে নাই।
উঠে নাই মানে?
আমার কাইল শরীর ভালো ছিল না। তাড়াতাড়ি শুয়ে পড়ছিলো। আব্বা আসার পর আর উঠে নাই। আমি তো আব্বারে ভাত দিছি।
চিত্রার মাথা মোচড় দিয়ে উঠলো। তার শাশুড়ির শরীর খারাপ ছিল অথচ সে জানতো না। সে একবার খোঁজ নেয়নি এমনকি ভাত খাওয়ার ব্যাপারে শ্বশুর-শাশুড়িকে সাধেনি। একদম অন্যায় হয়েছে তার। অপরাধবোধে চিত্রা কুকড়ে গেল। টুকিটাকি কাজ করতে করতে মনে মনে সে ভাবছিল শাশুড়ি মায়ের কাছে আজকে ক্ষমা চেয়ে নেবে।
চিত্রা যখন পাতিলে চাল ধুয়ে দিয়ে জ্বাল ধরিয়ে দিল। তখন কোথা থেকে উদয় হলেন জোসনা বেগম। তার মুখটা গমগম করছে। চিত্রা বুঝতে পারল না কি হয়েছে উনার।
সে জিজ্ঞেস করল, আম্মা আপনার কি শইলটা খারাপ?
জোসনা বেগম কোন উত্তর দিলেন না।
চিত্রা আবারো বললো, আম্মা আপনের মনে হয় জ্বর আইছে। চোখ মুখ দেইখা তাই মনে হইতাছে। আপনে শুইয়া থাকেন। কি কাম করতে হইবো আমারে কন? আমি করতাছি।
জোসনা বেগম সঙ্গে সঙ্গে ক্যাটক্যাটে গলায় উত্তর দিলেন, কি কাম আর করতে হইবো তোমার? স্বামীর লগে গিয়া শুইয়া থাকো। রঙ্গ তামাশা করো। পিরিতি পিরিতি খেলো। আর কি করবা?
মাথাটা অন্যদিকে ঘুরিয়ে ফেলল চিত্রা। মুহুর্তেই তার হৃদয়টা একদম বিষাক্ত হয়ে উঠলো। এ আবার কোন ধরনের ভাষা। নিজের কান ঝালাপালা করছিল তার। চিত্রা চুপ করে রইলো। জোসনা বেগম রান্না ঘরে ঢোকা মাত্রই চুলার ধার থেকে উঠে বেরিয়ে এলো সে।
চুলায় ভাত বসিয়েছিল। চুলার আগুন নিভাতে শুরু করেছে। জ্যোৎস্না বেগমের সেদিকে ভ্রুক্ষেপ নেই। তিনি রান্নাঘরের মাচা থেকে পাতিল ও থালা বাসন গুলো নামিয়ে নিচে রাখতে লাগলেন। বারান্দায় দাঁড়িয়ে দেখতে লাগল চিত্রা।
সব হাড়ি-পাতিল নামানো হয়ে গেলে ছোট ছোট কিছু পাতিল একদিকে সরিয়ে দিয়ে জোসনা বেগম বললেন, এগুলা নিয়া যাও। আর কিছু দিতে পারমু না। অনেক কষ্টে সংসার এর জিনিস করছি।
কাহিনীর আগামাথা কিছুই বুঝতে না পেরে চিত্রা বললো এগুলো দিয়ে আমি কি করুম?
যা চাইতাছ তাই করবা।
বুঝতে না পেরে চিত্রা অবাক হয়ে তাকিয়ে রইল তার শাশুড়ির দিকে।
জোসনা বেগম বললেন, তোমারে পাঁচ সের চাউল দিতাছি। নতুন চাউল ঘরে উঠলে তখন ভাগ কইরা দিমু চাউল। এইগুলা শেষ হইলে রূপককে কইবা বাজার থেইকা চাউল কিনা আনতে।
চাউল দিয়ে আমি কি করমু?
ভাত রাইন্ধা খাইবা।
আর আপনেরা?
তুমি কি ভাবছো আমি তোমার হাতের ভাত এখনো খামু? আমার কপালে যেন সেই খাওয়ান আর না জোটে। তোমার ভাত তুমি রাইন্ধা খাইও। তোমার নায়করেও খাওয়াইয়ো। ঘরের ওই পশ্চিম দিকে ওই জায়গায় ছোট কইরা একটা চালা তুইলা রান্না ঘর বানাইয়া লইও।
মুহূর্তেই চিত্রা বুঝে গেল তার শাশুড়ি কি করতে চাচ্ছেন। জোসনা বেগম আলাদা করে দিচ্ছে তাকে। এখন থেকে জোসনা বেগম আর তার সঙ্গে একই হাড়ির ভাত খাবেন না। একই বাড়িতে থাকলেও চিত্রার রান্না-বান্না ও সংসারের হিসাব-নিকাশ সবকিছুই হবে আলাদা। তাকে আলাদা করে বাজার করে নিজের মত করে সংসার চালাতে হবে। আর তার শ্বাশুড়ীর সংসারে তার কোন অধিকার থাকবে না। এমনকি চিত্রার সংসারে থাকবেনা জোসনার কোন অধিকার। বিয়ের মাত্র ক’দিনের মাথায় অকস্মাৎ এই আলাদা হওয়ার ব্যাপারটা চিত্রার খুব কষ্টদায়ক মনে হল। তার শাশুড়ি নিশ্চয়ই সাইকেল কেনার ঘটনায় আঘাত পেয়েছেন। কারণ তিনি সাইকেলটা যৌতুক হিসেবে পেয়েছিলেন। আর এ কারনেই আলাদা করে দিলেন চিত্রাকে। সবকিছু বুঝতে পেরে চিত্রার পায়ের নিচ থেকে মাটি সরে যেতে লাগল। তার নিজের মা নেই সে ভেবেছিল জোসনা বেগমের বুকে মেয়ের মত থাকবে সে। অথচ এই বাড়ির বউ হয়ে আসতে না আসতেই মায়ের ছায়াটুকু সে হারিয়ে ফেলল। জোসনা বেগম তাকে সংসার থেকে আলাদা করে দিলেন।
চিত্রা হাউমাউ করে কাঁদতে কাঁদতে তার শ্বাশুড়ীর পায়ের কাছে এসে বসলো, আম্মা আমারে আলাদা কইরা দিয়েন না। আমি আপনাগো লগে থাকব। আমি তো সংসারের কিছুই বুঝিনা। আমি তো আপনের মায়ের মত।
জোসনা বেগম চোখমুখ শক্ত করে রইলেন। চিত্রা আবারও কাঁদতে কাঁদতে বলল আম্মা আমারে আলাদা কইরা দিয়েন না।
জোসনা বেগম কোন কথা না বলে চুলার ওপর থেকে চিত্রার তুলে দেওয়া ভাতের পাতিল সাইডে নামিয়ে রাখলেন। তারপর অন্য একটা পাত্রে পানি ঢেলে সেই পাতিলটা যখন চুলার উপরে তুলে দিলেন তখন চিত্রা নিশ্চিত হলো তার শ্বাশুড়ীর হৃদয়টা ভীষণ নিষ্ঠুর। সবকিছু মেনে নিয়ে আলাদা তাকে হতেই হবে।
চলবে..