#দ্বিতীয়_পুরুষ,পর্ব ১৪,১৫
_নীলাভ্র জহির
১৪
চিত্রার শাশুড়ি পাঁচ সের চাল সমেত তাকে আলাদা করে দিল । কান্না থামিয়ে স্থবির হয়ে চিত্রা উঠোনের মাঝখানে বসে আছে। একজন নতুন বউয়ের জন্য হঠাৎ করে পৃথক হয়ে যাওয়াটা ছোটখাটো একটা দুর্ঘটনার মত। শ্বশুরবাড়িতে নতুন বউ হয়ে আসা মেয়েটি নিজেকে সামলে নিতে সময় লেগে যায় । কৈশোরদীপ্ত মেয়েগুলোর সংসার বুঝে উঠতে যেখানে কয়েক বছর লেগে যায় সেখানে মাত্র কয়েকদিনের মাথায় দুম করে তার কাঁধে সংসারের দায়িত্ব চাপিয়ে দেয়া রীতিমত অন্যায়। আকস্মিক এই ঘটনা তাকে একদম স্তব্ধ করে দিয়েছে। ঘুম থেকে উঠে সকালবেলা মা ও বউয়ের মধ্যে এই কোন্দল দেখে চোখ কপালে উঠে গেল রূপকের। সে চিত্রাকে ডেকে নিয়ে জিজ্ঞেস করল কি হয়েছে?
কান্নার কারনে চোখ মুখ ফুলে গিয়েছে চিত্রার। সে কোনমতে নিজেকে সামলে নিয়ে বললো, মা আমারে কইসে আইজ থাইকা আলাদা রাইন্দা খাইতে।
রূপক ভ্রু কুঁচকে ফেলল।
জানতে চাইলো, কেন মা এই কাজ করল? তুমি মারে কিছু কইছিলা?
চিত্রা উত্তর দিল, না আমি তো কিছু কই নাই। আমি ভাত রানতে বইছিলাম। মা পাতিলটা চুলা থাইকা নামাইয়া ফেলছে। আমারে কইল সে নাকি আমার হাতের রান্ধন আর কোনদিনও খাইব না। আমারে হাড়ি-পাতিল ভাগ কইরা দিল। আমি এখন কি করমু আপনে কন?
রূপক কিছুক্ষণ স্থবির হয়ে তাকিয়ে রইল চিত্রার দিকে। তার বৌকে এখন ভীষণ নিষ্পাপ দেখাচ্ছে। কেঁদে চোখ ভিজিয়ে ফেলেছে চিত্রা। রূপকের ইচ্ছে করছে চিত্রাকে বুকের ভেতর শক্ত করে জড়িয়ে ধরতে। সে একটা গভীর নিঃশ্বাস ফেলে বলল দাঁড়াও আমি দেখতাছি।
জোসনা বেগম চুলের পাড়ে বসে ভাত জ্বাল দিচ্ছেন। রূপক এসে জিজ্ঞেস করল, আম্মা এসব কি করতাছো তুমি। সকাল সকাল ঘুম থাইকা উইঠা পাগলামি শুরু করছ কী জন্য?
জোসনা বেগম কিছুক্ষণ মুখ গম্ভীর করে রাখলেন। তারপর উত্তর দিলেন, তোমার এসব দেখতে হইবো না বাপু। বিয়া করতে না করতেই তো পর হইয়া গেছো। মায়ের কথা কাউরে চিন্তা করতে হইবো না।
কি হইছে তোমার?
আমার আর কি হইবো? পোড়া কপাল আমার। পোলারে বিয়া করায়সি এখন পোলা সুখে শান্তিতে সংসার করবো। এখানে আমার আর কিছু কওনের নাই।
আমিতো সুখে শান্তিতে আছি। তুমি কি জন্য আমাগো আলাদা কইরা দিলা? আমার বউ কি তোমারে কিছু কইছে?
তোর বউ আমারে কি কইবো? পোলা যখন পর হইয়া যায় তখন কি আর মানষের কথায় কষ্ট পাওনের সময় আছে।
আমি কখন পর হইয়া গেছি মা? উল্টাপাল্টা কথা কইবা না।
এখন তো কইবি মা উল্টাপাল্টা কথা কয়।
জোসনা বেগম শাড়ির আঁচলে মুখ গুঁজে ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠলেন। তিনি যেহেতু চিত্রার কোন বদনাম করছেন না। পুরো দোষটায় দিয়ে দিচ্ছেন রূপকের কাঁধে। রূপক নিশ্চিত হলো জোসনা বেগম তার সাইকেল কেনার ঘটনায় কষ্ট পেয়েছেন। মায়ের পাশে পিড়ি টেনে বসল রূপক। বেশ নরম গলায় বললো মা তুমি কি কষ্ট পাইছো আমি সাইকেল কিনছি বইলা। তুমিতো আমারে কইছিলা একটা সাইকেল কিইনা লইতে। তুমি না কইলে তো আমি কিনতাম না।
জোসনা বেগমের কান্নার শব্দ আরো বেড়ে গেল।
রূপক বললো, মা তুমি থামো। পাড়ার লোকে কি কইবো? মানুষে ভাবব আমি তোমারে কি না কি কইছি। সাইকেলটা কিন্তু তুমি আমারে কিনতে কইছিলা। এখন যদি তুমি আমার লগে এমন করো তাহলে আমি কই যামু?
জোসনা বেগম শাড়ির আঁচলে মুখ গুজিয়ে রাখা অবস্থাতেই বললেন, হ, বাজান পোলা বিয়া দিয়ে ভুল করছি। বিয়া হইলে পোলা আর পোলা থাকে না। যা হওনের হইছে। তুই আর তোর বউ আজ থাইকা আলাদা খাবি। তোরা যেহেতু সবাই নিজেগো ভালো বুঝতে শিখছস। এখন আর মায়েরে কাউরো লাগবো না। সবাই বড় হইয়া গেছোস। নিজের সংসার নিজে বুইজা লও।
মা তুমি এমন কইরো না। আমি নতুন বিয়া করছি। আমার বউডা এখনো সংসারের কিছুই বুঝে না। আমিও কিছুই বুঝিনা। তুমি আমাগোরে শিখাইয়া পড়াইয়া দিবা। এখন যদি তুমি আমার লগে এমন করো তাইলে কেমনে হইব?
কে কইছে তোরা কিছুই বুঝস না? তোরা বাপ মায়ের চাইতে বেশী বুঝস। বুঝি না তো আমরাই। আমরা আগের দিনের মানুষ। মাথায় বুদ্ধি সুদ্ধি নাই।
রূপক আর কিছু বলার সাহস করলো না। সে রান্না ঘর থেকে বেরিয়ে যেতে যেতে বলল, আমার বউ তোমার লগে থাকব। ভাত এক হাড়িতে রান্না হইবো। যদি তুমি তাও আমাগোরে আলাদা কইরা দেও তাইলে আমি কোনোদিনও আর ভাত খামু না। না খাইয়া মইরা যামু।
কথাটা বলে রাগত মুখে রূপক বাড়ি থেকে বেরিয়ে গেল। জোসনা বেগমের কান্নার রোল পড়ে গেল বাড়িতে। তার নিজেকে দিশেহারা লাগছে। কি করবেন বুঝতে পারলেন না। নিভে গেল চুলার আগুন। তিনি চোখমুখ শক্ত করে গাল ফুলিয়ে বসে রইলেন রান্না ঘরের দাওয়ায়। এদিকে তার পুত্রবধু তখন ঘরের দাওয়ায় হেলান দিয়ে দিশেহারা চোখে পথের দিকে চেয়ে আছে। কোথায় গেল তার স্বামী?
আজ বাড়িতে আর রান্না হলো না। পুত্রবধূ ও শাশুড়ি দুজনেই চরম মন খারাপ করে নিজেদের মত হতাশায় ভুগছেন। দুজনের কেউই বুঝতে পারছেন না তার এখন কি করনীয়। এদিকে রূপকের কোন খোঁজখবর নেই। সে কোথায় গেছে সেটাও কেউ জানেন না? দুপুর গড়িয়ে গেল। রূপকের বাবা ফোন করে জানালেন রূপক আজকে দোকানে যায়নি। মাথায় যেন বাজ ভেঙে পড়ল জোসনা বেগমের। তিনি উঠানে বসে উঁচু গলায় বলতে লাগলেন, ওরে আমার সোনা বাজানরে। না, খাইয়া কই গিয়া পইরা রইছস। বাড়ি ফিইরা আয়। আমি আর তোর লগে এমন করুম না।
জ্যোৎস্না বেগমের বিলাপ শুনে নিজের ঘরে শুয়ে কান্না করছে চিত্রা। আজ তার নিজেকে বড্ড অসহায় লাগছে। সব দোষ তার নিজের। একটামাত্র সাইকেলের কারণে তার সংসারে নেমে এসেছে অশান্তি। রূপক যেন তাকে কখনো ভালবাসতে ভুলে না যায়। এই মা মরা দুখিনী মেয়েটা তখন কার কাছে যাবে ।
রূপক বাড়ি ফিরল তখন প্রায় সন্ধ্যা ঘনিয়ে এসেছে। দুপুরের পরপরই নিজের হাতে যত্ন করে রান্নাবান্না করেছেন জোসনা বেগম। ছেলে উঠানে পা দেয়ার সঙ্গে সঙ্গে তিনি ছুটে বেরিয়ে গেলেন। নরম গলায় বললেন, আছিলি কই? তাড়াতাড়ি মুখ হাত ধুইয়া আয়। আমি খাওয়ান দিতাছি। দুইটা ভাত খাইয়া ল।
রূপকের মুখে কোন উত্তরের অপেক্ষা না করেই জোসনা বেগম ছুটে রান্না ঘরে গেলেন। দাওয়ায় পাটি বিছিয়ে তড়িঘড়ি করে খাবার প্রস্তুত করলেন তিনি।
রুপক ঘরে ঢোকা মাত্র চিত্রা এসে দরজা ধরে দাঁড়াল, আছিলেন কই সারাটা দিন?
রূপক কোন উত্তর দিল না।
চিত্রার বুক ঠেলে কান্না বেরিয়ে আসতে চাইল। মনে হতে লাগল স্বামী তাকে আর আগের মত ভালবাসে না। মানুষটা কি তবে বদলে যাবে আজ থেকে? সারাদিন চিত্রার ভীষণ কষ্ট হয়েছে। এই মুহূর্তে কষ্টের তীব্রতা অসহনীয় পর্যায়ে চলে গেল তার।
রূপক চলে গেল পুকুরে হাতমুখ ধুতে। তার পিছু পিছু পুকুর ঘাটে এসে দাঁড়ালো চিত্রা।
জানতে চাইল, আপনি কথা কইতাছেন না কেন? আমারে কষ্ট দিতাছেন। রাগ কইরা রইছেন আমার লগে। আপনার দুইটা পায়ে পড়ি আপনে সাইকেলটা ফিরাইয়া দিয়া আসেন। আমি আমার বাপের বাড়িতে কালকে খবর পাঠামু। দুই দিনের মধ্যে তারা যেমনে পারে আমারে জানি সাইকেলটা জোগাড় কইরা পাঠায়।
পানিতে খলখল শব্দ তুলে রূপক হাত মুখ ধুয়ে নিল। চিত্রার কথার কোন উত্তর দিল না। পুকুর ঘাট থেকে উঠতে উঠতে এসে বলল, গামছাটা আইনা দাও।
সন্ধ্যার অন্ধকার ঘনিয়ে নেমেছে। চিত্রা দৌড়ে গিয়ে গামছা এনে দিল। রূপক গামছা নিয়ে হাত মুখ মুছতে মুছতে বলল, গরম পড়ছে। মুখ হাত ধুইয়া শান্তি পাইলাম না। একটা ডুব দিয়া লই। লুঙ্গিডাও আইনা রাখ।
গামছাখানি পুকুরঘাটে রেখে ঝাঁপ দিয়ে পুকুরে নেমে পড়ল রূপক। তার স্বাভাবিক আচরণ ও নরম গলার স্বর শুনে মনে হচ্ছে যেন কিছুই ঘটেনি। বেশ অবাক লাগছে চিত্রার। এত কিছু ঘটে যাওয়ার পরও তার স্বামীর এই স্বাভাবিক আচরন তাকে দ্বিধাদ্বন্দ্বে ফেলে দিচ্ছে। ধীর পায়ে পায়ে ঘরে গিয়ে লুঙ্গি নিয়ে এসে চিত্রা স্তব্ধ হয়ে পুকুরঘাটে দাঁড়িয়ে রইল। আজান হয়ে গেছে মাগরিবের। অন্ধকারে মশার তীব্রতা প্রখর। মশার কামড়ে গায়ের জ্বালা ধরে গেছে। তবুও রূপকের কলকল শব্দ তুলে পানিতে ডুব দেয়ার শব্দ চিত্রার ভালো লাগলো। মনের মেঘটা আস্তে আস্তে কেটে যেতে শুরু করেছে। রূপক ঘাট থেকে উঠে এসে গা মুছে লুঙ্গি বদলে ফেলল। ভেজা লুঙ্গিটা ঘাটের উপর রেখে উঠে গেল ঘাট থেকে চিত্রা দ্রুতপদে পুকুরে নেমে এসে লুঙ্গিটা পানিতে ধুয়ে শুকাতে দিতে গেল। বাড়ি ফিরে দেখল দাওয়ায় বসে রূপক ভাত খাচ্ছে। পাশে বসে আছেন জোসনা বেগম। তিনি চামচে করে তরকারি তুলে ছেলের পাতের দিকে এগিয়ে দিয়ে বলছেন আর দুইটা মাছ দেই তোরে।
রূপক হাত দিয়ে না না করে বলছে, আর নিমুনা।
তোর লাইগা রানছি বাবা। তুই টেংরা মাছ খাইতে খুব পছন্দ করস।
তোমরা খাইও।
তুই আর দুইটা মাছ নে বাবা।
চিত্রার উপস্থিতি বুঝতে পেরে রূপক ঘাড় না ঘুরিয়েই বলল, তুমি একটা থাল নিয়ে আসো। আমার লগে দুইটা খাইয়া লও।
চোখ ভিজে উঠলো চিত্রার। দখিনা বাতাসের মত মিষ্টি একটা হাওয়া তাকে মুহূর্তে আবিষ্ট করে তুলল। সে আজকে সারা দিন ভাত খায়নি সেটা কিভাবে বুঝতে পারলো রূপক? তার স্বামীকে এই পৃথিবীর সবচেয়ে সেরা মানুষটা মনে হচ্ছে তার। এই মানুষটাকে ভালোবেসে সারাজীবন সেবা করার বিনিময়ে চিত্রা আর কিছুই চায় না। ভয়ে ভয়ে থালা ধুয়ে নিয়ে এসে চিত্রা রুপক ও জোসনা বেগম এর চাইতে খানিকটা দূরত্ব বজায় রেখে বসল। রূপক বলল, ভাত নাও। মা, তুমি মাছটা ওরে দাও।
জ্যোৎস্না বেগমের মুখের দিকে তাকানোর সাহস পেল না চিত্রা। তবে কোনো প্রতিউত্তর বা বিলম্ব না করেই জোসনা বেগম দুই পিস মাছ ঝোল সহ চিত্রার পাতে তুলে দিলেন। চিত্রা মাথা নিচু করা অবস্থায় বলল আম্মা সারাদিন ভাত খায় নাই। ওনি না খাইলে আমিও খামু না।
রূপক বললো, আম্মা তো আমারে কইল ভাত খাইছে। কি গো মা তুমি ভাত খাও নাই কেন? বউ আরো একটা থাল নিয়া আসো। এই থাল আম্মারে দিয়া দাও।
চিত্রার সামনে থেকে ভাতের প্লেট টা নিয়ে রূপক তার মায়ের হাতে তুলে দিল। তারপর চিত্রা কে বলল আরেকটা থাল নিয়া আইসা তুমিও বসো।
মনটা ভীষণ ভাল হয়ে গেল চিত্রার। দৌড়ে রান্নাঘরে গিয়ে আরেকটা প্লেট নিয়ে শাশুড়ির পাশে বসলো। জোসনা বেগম আর কোন ঝামেলা করলেন না। তার অভিমান হয়তো বুকে চাপা রয়েছে তবুও তিনি নিঃশব্দে ভাত খেতে লাগলেন।
হঠাৎ করে চিত্রার শরীরটা গুলিয়ে উঠলো। ভাত খেতে পারল না সে। কাউকে কিছু না বলে হুট করে উঠে গেল বারান্দা থেকে। জোসনা বেগম সঙ্গে সঙ্গে ছেলেকে অভিযোগ করলেন, তোর বউ আমার হাতের রান্না খাইবো না। বুঝবার পারছি। কেমন কইরা উইঠা গেল দেখছোস? মনে হইতাছে আমি ওর ভাতে বিষ মিশাইয়া দিসি।
রূপক কোন জবাব না দিয়ে তার বউয়ের দিকে তাকালো। উঠানের মাঝখানে গিয়ে তার বউটা ছটফট করছে। আর ভাত খেতে পারো না রূপক। সে দ্রুত উঠে ছুটে গেল চিত্রার কাছে। জানতে চাইলো বউ তোমার কি হইছে? তুমি এমন করতেছ কেন?
চলবে..
#দ্বিতীয়_পুরুষ
পর্ব ১৫
_নীলাভ্র জহির
উঠানের মাঝখানে ছটফট করছে চিত্রা। রূপক এসে তার হাত চেপে ধরলো। জানতে চাইল, তোমার কি হইছে বউ। তুমি এমন করতেছ ক্যান?
নিজেকে সামলে নিতে কিছুক্ষণ সময় নিল চিত্রা। তারপর লাজুক কন্ঠে মৃদু স্বরে বলল, আমার বমি আসতাছে। শরীর খারাপ লাগতাছে। ভাত খাইতে পারতাছি না।
এমন ক্যান হইতাছে বউ?
চিত্রা আরো লজ্জায় কুকড়ে গেল। নিজের মুখখানা অন্যদিকে ঘুরিয়ে ফেলল সে। কিন্তু অস্থিরতা আরো বেড়ে গেল রূপকের। তার বউ কেন হঠাৎ করে এমন অসুস্থ হয়ে পড়ল সেটা ভেবেই সে পাগলের মত এদিক সেদিক তাকাতে লাগলো।
রূপক চিত্রার হাত টেনে ধরে বললো, আপনি থামেন। এত অস্থির হইয়েন না। আমার মনে হয় খারাপ কিছু হয় নাই।
কি কও তুমি? ভাত খাইবার পারতাছ না। ক্যামন ছটফট করতাছো? আর কইতাছো খারাপ কিছু হয় নাই?
চিত্রা মুচকি হাসলো। লাজুক কন্ঠে বলল, মনে হয় আপনের মনের আশা পূরণ হইতে যাইতাছে।
মানে ? ও বউ মানে কি আমারে বুঝাইয়া কও?
বিয়ের পর থেইকা আমার এখনো শইল খারাপ হয় নাই।
সেইটা তো আমি জানি। আইজ ক্যান খারাপ হইলো?
আরে এই খারাপ সেই খারাপ না। বুঝেন না আপনি?
ঘোমটার আড়ালে নিজের মুখটা লুকিয়ে ফেলল চিত্রা।
রূপক আরও অস্থির গলায় বলল কি হইছে তোমার বউ। তোমার কি খারাপ লাগতাছে?
চিত্রা মুচকি হেসে বলল, এগুলো আপনি বুঝবেন না। আপনি একটু আম্মারে আসতে কন।
রূপক উঠে দাওয়ায় চলে গেল। জোসনা বেগম ভাত খাচ্ছেন। ছেলের বউয়ের বাড়তি এই উঠে যাওয়ার ঘটনায় তার খাওয়া বন্ধ হয়নি। বরং তিনি আরো জোরে জোরে রাগের বশে ভাত গপগপ করে গিলছেন। ভীষণ মেজাজ খারাপ হয়ে গেছে তার। চিত্রার ভাব দেখে মনে হচ্ছে জোসনা বেগম তাকে বিষ খাইয়েছেন। এসব ঢং ওনার পছন্দ না।
রুপক এসে জোসনা বেগমকে বলল আম্মা চিত্রার কাছে একটু যাও তো। দেখো তো ওর কি হইছে? ওর নাকি বমি আসতাসে। ভাত খাইবার পারতাছে না।
জোসনা বেগম ভ্রু কুঁচকে চোখ বড় বড় করে রূপকের দিকে তাকিয়ে রইলেন। বিষয়টা তিনি আন্দাজ করতে পেরেছেন। ভাতের প্লেট নামিয়ে রেখে হাত ধুয়ে তিনি উঠে গেলেন চিত্রার সাথে কথা বলতে।
চিত্রা লজ্জায় কোন কথা বলতে পারছে না। জোসনা বেগম নিজে থেকে জিজ্ঞেস করলেন কী হইছে বউ।
চিত্রা চুপ করে রইলো। কিছুক্ষণ পর আমতা আমতা করে বললো, আম্মা খুব বমি আসতেছে।
শইল খারাপ হইছিল কোনদিন?
বিয়ার আগে। এরপর তো আর হয় নাই।
বুঝছি । কাইল সকালে তোমার একখান জিনিস আইনা দিমু। ওইটা দিয়া পরীক্ষা কইরা দেইখো।
চিত্রা জানে শাশুড়ি মা কি পরীক্ষা করার কথা বলছেন। লজ্জায় সে আরো মাথাটা নিচু করে ফেলল। আঁচলে মুখ ঢেকে অন্যদিকে তাকিয়ে রইল চিত্রা।
জোসনা বেগম নরম গলায় বললেন, দুইটা ভাত খাইয়া লও। সারাটা দিন তো কিছুই খাও নাই।
জোসনা বেগমের পিছু পিছু দাওয়ায় এসে বসল চিত্রা। রূপক খুব অস্থির চোখে বারবার তার দিকে তাকাচ্ছে। তার আদরের বউয়ের হঠাৎ করে কি হল সে বুঝতে পারছে না। দুশ্চিন্তার ছাপ রূপকের চোখেমুখে। এমন হওয়াটাই হয়তো স্বাভাবিক। চিত্রা নামের মেয়েটা যে এই কয়েকদিনের তার অর্ধেক অংশ হয়ে উঠেছে। তাইতো চিত্রার কিছু হলে তার হৃদপিণ্ড কেঁপে উঠবে। চিত্রাকে ছাড়া বাঁচতেই পারবে না সে। বাকি ভাত রূপক ভালোমতো খেতে পারল না। মায়ের সামনে চিত্রার প্রতি দরদ দেখাতে লজ্জা করছিল। তাই বারবার চিত্রার দিকে খেয়াল করে মাথা নুইয়ে ভাত খাচ্ছিল রূপক।
খাওয়া শেষ করে ঘরে আসতেই রূপক চিত্রাকে জিজ্ঞেস করল তোমারে কি ওষুধ আইন্না দিমু? ডাক্তারের দোকান এখনো খোলা আছে।
ওষুধ লাগবোনা।
লাগবো না কেন? তুমি তো কইলা তোমার শরীর খারাপ হইছে।
ওইসব আপনার বুঝতে হইবো না।
আমি বুঝছি তোমার কি হইছে?
কী হইছে কন তো দেখি।
মাইয়াগো প্রতি মাসে যা হয়।
অট্টহাসিতে ফেটে পড়ল চিত্রা। হাসতে হাসতে মুখ শাড়ির আঁচলে লুকালো। রুপক তার হাসির কারণ জানতে চাইলে চিত্রা বলল আপনার জানতে হইব না। এখন ঘুমান। সারাটা দিন কই আছিলেন আপনে?৷
আর কইও না। মন মেজাজ খুব খারাপ হইয়া গেছিল। মাঠে গিয়ে বইসা ছিলাম।
আর আমরা দুইটা মানুষ বাড়িতে চিন্তায় চিন্তায় মইরা যাই। আর কখনো এমন কাম করবেন না। আমরা টেনশনে থাকি আপনি বুঝেন না?
না গেলে তো টেনশনটা হইতো না। সবকিছু ঠিক হইতো না। তুমি আর আম্মা মিইলা ঝগড়া কইরা বাড়ি মাথায় তুলতা। এ বাড়িতে থাকা যাইতো না। এইযে রাইতে ভাত খাইলাম এইটাও হইতো না। বাড়িতে আমি ছিলাম না, মা আমার জন্য আমার পছন্দের খাবার রান্না কইরা রাখছে। এখন বুঝছো মাঝে মাঝে একটু রাগ করতে হয়।
চিত্রা মুচকি হেসে বলল, হ, আপনার রাগে কামে দিছে। সকালে আমি কি যে ভয় পাইছিলাম। ভাবছিলাম সবকিছু বুঝি শেষ হইয়া যাইতাছে। আর কোনোদিনও এমন কাম করবেন না।
রাত বাড়লে পুরো বাড়ি নিস্তব্ধ হয়ে উঠল। কিন্তু ঘুম এলোনা চিত্রার চোখে। অস্থির হয়ে রইল। সত্যি সত্যিই সে রূপকের সন্তানের মা হয়ে যায় তবে এটাই হবে তার জীবনের সবচেয়ে বড় সৌভাগ্যের বিষয়। কারণ রূপক এটাই চেয়েছিল। রূপকের আশা যেন পূরণ হয় মনে মনে সেটাই প্রার্থনা করতে লাগল চিত্রা।
ভোর হলো। আজকের সকালটা প্রতিদিনের সকালের মতো নয়। একবুক উত্তেজনা নিয়ে চিত্রা ঘুম থেকে উঠেছে। ঘরের বাইরে আসতেই জোসনা বেগমের সঙ্গে চোখাচোখি হল। তিনি মনে হচ্ছে চিত্রার অপেক্ষাতেই ছিলেন। চিত্রা তার দিকে না তাকিয়ে পায়খানার (টয়লেটের) দিকে যাচ্ছিল। জোসনা বেগম ডাক দিয়ে বললেন, খাড়াও । কই যাইতাছো?
চিত্র শংকাগ্রস্ত মুখে দাঁড়িয়ে পড়ল। মনে হলো এভাবে তার যাওয়াটা উচিত হচ্ছে না। কিন্তু কারন বুঝতে পারল না সে।
জোসনা বেগম বললেন, আমার লগে আসো।
জ্যোৎস্না বেগমের ঘরের দরজায় এসে দাঁড়ালো চিত্রা। কাপড়ের আড়ালে তিনি একটা কাঠি চিত্রার হাতে দিলেন। সকালের প্রথম প্রস্রাব দিয়ে কিভাবে পরীক্ষা করতে হবে সেটাও শিখিয়ে দিলেন চিত্রাকে।
কাঠি হাতে নিয়ে পায়খানার (টয়লেটের) দিকে যেতে যেতে চিত্রার হাত-পা থরথর করে কাঁপছিল। সে জানে না তার সঙ্গে কি ঘটতে চলেছে। আজকেই হয়তো তার জীবনের মোড় ঘুরে যাবে। মা হবে সে। রূপকের সন্তানের মা। আর কোন ঝড় ঝাপটা তাদেরকে কখনো আলাদা করে দিতে পারবে না। মনে মনে প্রার্থনা করতে করতে ব্যাকুল হয়ে রইলো চিত্রা।
রূপকের চোখে ঘুম। চিত্রার ধাক্কায় তার ঘুম ভাঙলো। বিরক্ত হল রূপক। চোখ কচলে চিত্রার দিকে চেয়ে সে জানতে চাইল, কি হইছে? এত ভোরে ডাকতাছো ক্যান?
চিত্রার চোখ ভেজা। লম্বা করে ঘোমটা টেনে রেখেছে। ঘোমটা সরিয়ে দিতেই ভেজা চোখ দেখে রূপকের বুক শুকিয়ে গেল। আজ সকালেও নিশ্চয়ই মায়ের সঙ্গে কোনো ঝামেলা হয়েছে।
রূপক বলল কি হইছে? কথা কইতাছো না ক্যান?
চিত্রার বুক কাঁপছে। কিছু বলতে পারছেনা। সর্বাঙ্গ কাঁপছে থর থর করে। অনেকক্ষণ পর যখন রূপক অধৈর্য হয়ে আবার বালিশে শুয়ে পড়েছে তখন চিত্রা মৃদু স্বরে বলল, একখান সুখবর আছে।
রূপক মুখ তুললো না। উপুড় হয়ে বালিশে শুয়ে সে জানতে চাইল, কি?
আপনি বাবা হইতেছেন।
মুহূর্তেই তড়াক করে বিছানার উপর লাফিয়ে উঠে বসল রূপক। পলকেই ঘুম চলে গেল তার। অবাক চোখে বড় বড় চোখ করে চিত্রার দিকে তাকিয়ে রইল। চিত্রাকে ঝাকুনি দিতে দিতে রূপক বলল, সত্য কইতাছ? ও বউ তুমি যা কইছো তা সত্য? কওনা সত্য কইতাছো?
চিত্রা লজ্জায় রূপককে জরিয়ে ধরল। মাথা ঝাঁকিয়ে বললো, হুম। আর কিছুই বলতে পারলোনা। চোখ বেয়ে ঝর-ঝর করে জল গড়িয়ে পড়তে লাগল।
রুপক আনন্দে হইহুল্লোড় করে উঠলো। লুঙ্গি ভালো করে বেঁধে দৌড়ে বাইরে বেরিয়ে এলো রূপক। তার মাকে ডাকতে ডাকতে বলল ওমা শুনতেছ। এদিকে আসো। আরে খবর শুনছো।
জোসনা বেগম বেরিয়ে এলেন। তিনি শুনেছেন। চিত্রা নিজের ঘরে যাওয়ার আগে তার কাছে জানিয়ে গেছে কথাটা। মূলত তিনিই নিশ্চিত করেছেন চিত্রাকে। তিনি মৃদু স্বরে বললেন কি হইছে চুপ কর। এত আমোদ করতাসোস কেন?
আমোদ করুম না। আরে তোমার নাতি আসতাছে। তুমিও আমোদ করো।
এত ফাল পারিস না। ।
রুপক তার মায়ের হাত ধরে নাচাতে নাচাতে বলল আরে আনন্দতো করমু। আমি যখন তোমার কোলে আইসিলাম তোমরা কি আনন্দ করো নাই। আমার বাপে কি খুশি হয় নাই? বাপ হওয়ার যে কি আনন্দ সেটা আমার বাপে ভালো জানে।
জোসনা বেগম হাসলেন। তিনি খুশি হয়েছেন। তবে খানিকটা বিরক্তও হয়েছেন । এত তাড়াতাড়ি ছেলে বাবা হয়ে যাক সেটা তিনি চাননি। এমনিতেই সংসারের দায়িত্ব হঠাৎ করে রূপক সামলে উঠতে পারছে না। তার ওপর নতুন বউ। এখন আবার বউয়ের সঙ্গে সঙ্গে নতুন বাচ্চা। সবকিছুকে রূপক সামলাবে কি করে? সেসব ভাবছেন তিনি। তবে এসব ভেবে এখন আর কোনো লাভ নেই। ছেলের আনন্দ দেখে তার বুকটা ভরে গেছে। হঠাৎ করেই তার মনে হলো উনার ছোট্ট সেই রুপক অনেক বড় হয়ে গেছে। বাবা হয়ে যাচ্ছে তার ছোট্ট ছেলেটা।
রূপক পুকুর পাড়ে যেতে যেতে বলল গোসল দিয়ে আসি। দোকানে যামু। মিষ্টি আনতে হইব। আরে আমি বাপ হইতাছি।
আনন্দে হইচই করতে করতে রূপক পুকুরে লাফ দিল। কলকল শব্দ তুলে কয়েকবার ডুব দিয়ে দ্রুত উঠে এলো। চিত্রাকে ডেকে বলল, ওগো আমার গামছাটা দিয়া যাও।
চিত্রা গামছা হাতে নিয়ে দৌড়ে পুকুরপাড়ে এল।
রূপক বলল, আরে আস্তে আস্তে। দৌড়ানির দিন শ্যাষ। এখন থাইকা পা টিইপা হাঁটবা।
চিত্রা লজ্জায় লাল হয়ে উঠলো। এখন কারো সামনে যেতেই তার লজ্জা লাগছে। নিশ্চয় এতক্ষণে আশে পাশের বাড়ির সবাই জেনে গেছে কথাটা। শাশুড়ি মা কিংবা রুবিনা হয়তো সবাইকে বলে এসেছে। সবাই কি ভাবছে তাকে নিয়ে? ইস কত লজ্জা লাগছে তার।
রূপকের কথায় সম্বিত ফিরল চিত্রার, দেখতো কান্ড । খালি গামছা নিয়ে আসছো। লুংগি আনবো কে? আমার পোলা?
কথাটা শুনে ফিক করে হেসে ফেললো চিত্রা। একই সঙ্গে তীব্র লজ্জাও পেল। বলল, থামেন তো আপনি। লাজ শরম কিছু নাই ।
রূপক হাসতে হাসতে বলল কিসের লাজ শরম। আমি আমার মায়ের পোলা। আমার মা আমারে পোলা পরিচয় দিতে কী শরম কর? তুমি আইজ থাইকা শরম পাইবা না।
চিত্রা লম্বা করে ঘোমটা টেনে দিল। তারপর ঘর থেকে লুংগি এনে দিল রূপককে। লুঙ্গি বদলানোর পর প্রতিদিন পুকুরঘাটে লুঙ্গিটা ফেলে যায় রূপক। আজকের লুঙ্গি বদলে ভেজা লুঙ্গিটা নিয়ে সে নিজেই পুকুর থেকে ধুয়ে ফেলল। ভীষণ অবাক হল চিত্রা। বিস্মিত চোখে সে রূপকের দিকে তাকিয়ে রইল। রূপক লুঙ্গির পানি ফেলে দিয়ে লুঙ্গি শুকাতে দিল। তারপর হাসিমুখে চিত্রাকে বলল, এখন তোমার রেস্ট নেওয়ার সময়। সবকিছু তোমার লাইগা ফালায় রাখলে তো হইবো না। পান্তাভাত থাকলে দেও দুইটা খাইয়া দোকানে যাই। মিষ্টি নিয়া আসি।
মাথাটা খারাপ হইছে আপনার। এত সকালে কোন দোকানদার মিষ্টি নিয়ে বইসা রইছে আপনার লাইগা?
আরে দোকানদারকে ক্যান লাগবো? দোকানে না পাইলে দোকানদারের বাড়ি থাইকা মিষ্টি নিয়া আসব।
ম্যালা সময় পইরা রইছে । এত অস্থির হইয়েন না ।
তুমিও যে কথা কও আম্মাও সেই কথা কয়। আমি যে পোলার বাপ হইতাছি সেটা কেউ বুঝতেছেনা। বাড়িতে আসমু না সারাদিন। হইছে এবার খুশি তোমর?
চিত্রা শঙ্কায় মুখ কালো করে ফেলল, না না এমন কথা কইয়েন না। কালকের মতো আর পাগলামি কইরেন না। সময়মতো বাড়িতে আইসেন।
হ, সেই জন্যই তো কইতাছি দুইটা মিষ্টি নিয়া আসি। আমাদের দুইটা পান্তাভাত থাকলে দাও।
চিত্রা রান্নাঘরের দিকে এগিয়ে গেল। যেতে যেতে তার মনে হল এ জীবনটা ভীষণ সুন্দর। তার জীবনে আসা এই পুরুষ মানুষটি অন্যরকম একজন মানুষ। গোলাপ ফুলের মতো সুন্দর নিষ্পাপ একটা মানুষ। চিত্রা রূপককে ভালোবাসে। তার সন্তানের মা হতে পারাটা চিত্রার জন্য গৌরবের। এই সুখ যেন তার কপালে চিরস্থায়ী হয়।
চলবে…