দ্বিতীয়_পুরুষ,পর্ব ২৬,২৭

0
408

#দ্বিতীয়_পুরুষ,পর্ব ২৬,২৭
_নীলাভ্র জহির
২৬

শ্বশুর বাড়িতে এসেই রুবিনার শরীর খারাপ হয়ে গেল। সারাদিনের ধকল শেষে প্রচন্ড মাথা ঘোরাতে লাগল তার। ভাবীরা তাকে আয়োজন করে বাসর ঘরে বসিয়ে রেখেছে। তার শরীর খারাপ লাগার কথা কাউকে বলাও যাচ্ছে না। বাধ্য হয়ে দাঁত মুখ শক্ত করে সবকিছু সহ্য করতে হচ্ছে। অসুস্থতার কথা বললেই আবার ডাক্তার ডাকা হবে। ডাক্তার এলেই হবে বিপদ।
সবাই চলে গেলে শিমুলকে সবটা খুলে বলল রুবিনা। চাকরিতে জয়েন করতে হবে এই অজুহাত দিয়ে একদিন পরেই রুবিনা কে নিয়ে ঢাকার উদ্দেশ্যে রওনা দিলো শিমুল। বিদায়বেলায় বাবার বাড়িতে আরো একবার এসেছিল সে। চিত্রার গলা জড়িয়ে ধরে হাউমাউ করে কান্না। রূপক ও জোসনা বেগম অবাক হয়ে দেখছিলেন। তাদেরকে জড়িয়ে ধরে ও এতটা মায়া কিংবা মহব্বতের সঙ্গে কান্না করে নি রুবিনা। অথচ ভাবির গলা জড়িয়ে ধরে এমনভাবে কাঁদতে লাগল যেন ভাবির সঙ্গে তার জন্ম জন্মান্তরের আত্মার সম্পর্ক।

রুবিনা ঢাকায় চলে গেলে চিত্রার মনটা খারাপ হয়ে গেল। কয়েকটা দিন বিষন্ন হয়ে রইল সে। গত কিছুদিনেই রুবিনার সঙ্গে তার বেশ ভাল সম্পর্ক হয়ে উঠেছিল। দিনের বেশিরভাগ সময় একসঙ্গে কাটাত তারা। রুবিনা চলে যাওয়ায় কোথায় একটা শূন্যতা তৈরি হয়েছে। তবে সেই শূন্যতাকে কল্যাণ ভেবে নেয়ার চেষ্টা করল। কারণ এই মুহূর্তে রুবিনার জন্য বিয়ে করাটাই সব থেকে বেশি জরুরি ছিল। অনেক চড়াই-উতরাই পেরিয়ে সর্বশেষ তাদের বিয়েটা যে হয়েছে এতেই খুশি চিত্রা।

মেয়ে চলে যাওয়ায় জোসনা বেগম যেন ভীষণ একা হয়ে পড়লেন। এই মুহূর্তে চিত্রাকে নিজের মেয়ের মতো বুকে টেনে নেয়া ছাড়া আর কোন বিকল্প দেখতে পেলেন না। তিনি মাঝে মাঝে চিত্রাকে ডেকে পাশে বসান। বিভিন্ন বিষয় নিয়ে সাংসারিক গল্প করার চেষ্টা করেন। বিষয়টা চিত্রার খুব ভালো লাগে। শাশুড়ির শুন্য বুকটাকে সে নিজেও দখল করে নেয়ার চেষ্টা করতে লাগলো।

সকালবেলা জোসনা বেগম চিত্রাকে বললেন, আইজ একবার বাজারে যামু। দোকানে ঘুইরা আসি। কাম কাজ শ্যাষ কইরা রেডি হও।
খুশিতে চিত্রার চোখ দুটো চকচক করে উঠলো। এই প্রথম সে নিজেদের দোকানটা দেখতে যাবে। তার স্বামীর দোকান। তার শশুরের সম্পদ। এই দোকান দিয়েই তাদের সংসারটা চলছে।

বিকেলবেলা জোসনা বেগমের সঙ্গে বাজারে যেতে যেতে তার অদ্ভুত অভিজ্ঞতা হল। তার ধারণা ছিল বাজারে শুধু পুরুষ মানুষরাই যায়। কিন্তু এখন দেখছে পুরো ব্যাপারটাই ভিন্ন। দলবেঁধে মেয়েরাও যায় বাজারে কেনাকাটা করতে। পথে যেতে যেতে পরিচিত অনেকের সঙ্গেই দেখা হল। ছোট ছোট মেয়েরা প্রাইভেট কিংবা কোচিং করতে যাচ্ছে। পরিচিত মহিলারা যাচ্ছে বাজার-সদাই করতে। কুন্দনপুর বাজার আগে তার কখনো ঘুরে দেখা হয়নি। বাজারে প্রবেশ করার পর বুঝতে পারলো বেশ আধুনিক বাজার। ইটপাথরের বড় বড় ঘরের ভেতর কাঁচ দিয়ে সুন্দরভাবে সুসজ্জিত দোকান গুলো দেখে মনে হতেই পারে কোনো শহরে চলে এসেছি। দোকানে দোকানে বসে কম্পিউটার চালাচ্ছে ছেলেরা। হিন্দি কিংবা রক মিউজিকের তালে তালে মূখরিত হয়ে উঠেছে রাস্তাঘাট। চিত্রা জানে এইসব দোকানে ছেলেরা মোবাইলের মেমোরিতে ভিডিও কিংবা ছবি ডাউনলোড দিতে আসে। বড় বড় বেশ কয়েকটা মার্কেট চোখে পড়ল। একদিকে কাপড়ের দোকান তো অন্যদিকে কসমেটিক্স। চিত্রা জোসনা বেগম কে বলল, বাজারে তো দেখি অনেক কাপড়ের দোকান।
জোসনা বেগম গর্বের সঙ্গে বললেন, হ। এগুলা দুই দিন আগেই হইল। এই বাজারে আমাগো দোকানটায় ছিল সবার পরথম। আমার বিয়ের পর কুন্দনপুর বাজারে কোন কাপড়ের দোকানে ছিল না। ম্যালা দূর থাইকা কাপড়-চোপড় মানুষ কিনা আনতো। তোমার শ্বশুর পরথম কাপড়ের দোকান দিছে এইখানে। ছোট দোকান দিছিল কিন্তু মেলা বেচাকেনা হইত। আস্তে আস্তে আমরাও দোকানটা বড় করছি। কিন্তু এখন আর আগের মতো বেচাকেনা নাই। বাজারে কতশত দোকান হইয়া গেছে। মানুষজন হরেক রকমের জিনিস কিনতে হরেক রকমের দোকানে যায়। এখন তো কেউ আবার উপজেলা থাইকা কিইনা আনে।

দোকানের সামনে এসে রূপকের সঙ্গে দেখা হতেই মুচকি হাসল চিত্রা। সব সময় রূপককে সে তার স্বামী রুপে দেখেছে। এই প্রথম একজন ব্যবসায়ী রূপে দেখে একটু ভিন্ন অনুভূতি হল। দোকানে বসে রূপক বেচাকেনা করছে। তারা আসার পর দুজন কাস্টমার এসেছে দোকানে। এরই ফাঁকে জোসনা বেগমের সঙ্গে কথা চালিয়ে যাচ্ছে রূপক। একটা ছোট্ট ছেলেকে সে কিছু খাবার ও চা নিয়ে আসার অর্ডার দিল। মুহূর্তেই দৌড়ে গিয়ে পাশের দোকান থেকে সিঙ্গারা, পিয়াজু ও চা নিয়ে এলো ছেলেটি। ততক্ষণে কাস্টমার বিদায় হলো।
রূপক চিত্রাকে বলল, প্রথমবার আইছো। কেমন লাগতাছে?
আপনার দোকানটা বড়ই সুন্দর।
সুন্দর কইরা গুছাইয়া রাখছি না? সিঙ্গারা খাও। মা, কও বাজারে কি কাম?
কাম আছে। নাক ফুলের পাথর পইরা গেছে অনেকদিন হইল। ঠিক করতে দিমু। আমি দুই গজ কাপড়ও নিমু।
দুই গজ কেন তোমার যত মন চায় নিয়ে যাও । তোমার কোন কালারটা পছন্দ বাইছা নেও।

জোসনা বেগম থরে থরে সাজানো কাপড় গুলোর দিকে তাকিয়ে নিজের পছন্দসই কাপড়টা খুঁজতে লাগলেন। রূপক উঠে এসে চিত্রাকে বলল আসো তোমারে আমার দর্জির মেশিন দেখাই।
মেশিনে বসে কিছুক্ষণ চালিয়ে চিত্রাকে দেখালো রূপক। পিছনে সাজিয়ে রাখা বেশ কিছু নতুন ডিজাইনের জামা। রূপক বলল এগুলো সব আমি সেলাই করছি। কেমন হইছে?
ভালো।
তোমার একটা সেলাই কইরা দিমু?
কি যে কন? আমার কি জামা পরার বয়স আছে? অহন তো শাড়ী আর মেক্সি পরার দিন।
হ, তোমারে দুইটা ম্যাক্সি বানাইয়া দিতে হইব। তুমি একটা কাম করো। কিছু প্রিন্টের কাপড় পছন্দ কইরা দেও। এইখান থেকে পছন্দ করো।

নিজের স্বামীর দোকান থেকে কাপড় পছন্দ করতে তার এক ধরনের গর্ব বোধ হচ্ছিল। সিঙ্গারা ঠাণ্ডা হয়ে যাচ্ছে। রূপক বারবার বলার কারণে চিত্রা সিঙ্গারা নিয়ে খেতে শুরু করল। এমন সময় রাস্তা দিয়ে যাওয়া একজন পথচারী দোকানের দিকে তাকায়। লোকটা চিত্রার পূর্বপরিচিত। তার বাপের বাড়ির পাশেই ওনার বাড়ি। লোকটা চিত্রাকে দেখে বলে উঠলেন আরে আমাগো চিত্রা যে। এইখানে কি করো?
সে ভেতরে এসে দাঁড়ালো। চিত্রা হাসিমুখে বলল, কেমন আছেন চাচা?
ভালো আছি। কাপড় কিনতে আইছো?
চাচা এটাতো আমার স্বামীর দোকান। ইনি আমার শাশুড়ি আম্মা।
তোমার স্বামী কাপড়ের দোকান করে? তার না বাজারে শুটকির দোকান?
মুহূর্তেই মুখটা শুকিয়ে গেল চিত্রার। বুকটা ধ্বক করে উঠলো। হঠাৎ মনে পড়ল তার প্রথম বিয়ের সময় এই লোকটা উপস্থিত ছিলেন। শঙ্কায় চিত্রার মুখ শুকিয়ে গেল। সে চেষ্টা করল সহজ ভাবে হেসে বিষয়টাকে সহজ করে দিতে। কিন্তু সবকিছু এতটা সহজ ছিল না।
জোসনা বেগম জিজ্ঞেস করলেন, তোমার বাপের এলাকার মানুষ?
চিত্রা মাথা ঝাকালো। তার গলা দিয়ে কোন শব্দ বের হলো না।
রূপক ওনাকে সালাম দিয়ে এসে দাঁড়াল চিত্রার পাশে। বলল, চাচা ভালো আছেন? আপনি আমার শ্বশুরবাড়ির এলাকার মানুষ। আর আমার দোকানে আইসা আপনি খাড়াইয়া আছেন। বসেন তো। চা খান।

রূপক ছোট ছেলেটাকে আবারো চা ও সিঙ্গারা আনতে পাঠালো। ক্রমশ পায়ের তলা থেকে মাটি সরে যাচ্ছে চিত্রার। কারণ এই লোকটা তার প্রথম স্বামীকে দেখেছে। কী যে হবে!
চিত্রা সহজ স্বাভাবিক ভাবে বলার চেষ্টা করল, চাচি কেমন আছে?
কিন্তু মুরুব্বী আর কথার উত্তর দিচ্ছেন না। তিনি হতভম্বের মত রূপকের দিকে তাকিয়ে আছেন। সম্ভবত তিনি পূর্বে দেখা মানুষটার সঙ্গে রূপককে মেলানোর চেষ্টা করছেন। সেটা করতে পারছেন না বলেই অদ্ভুত চোখে তাকিয়ে আছেন তিনি। রূপক আবারও হাসিমুখে বলল, চাচা আপনি বসেন। চা আনতে পাঠাইছি।
লোকটা হতভম্ব অবস্থাতেই বসে পড়লেন। শুকনো হাসি দিয়ে চিত্রাকে বললেন, তো ভালোই আছ তাইলে? তোমার বাপের লগে দেখা হয়েছিল দুইদিন আগে। শুকায়ে গেছে।
আব্বারে কইয়েন আমার বাড়িতে আইতে। কিছুদিন আগে একবার খবর পাঠাইছিলাম। তাও আসে নাই। কইবেন চিত্রা আপনেরে দেখতে চাইছে।
আচ্ছা।
চা ও সিংগারা চলে এলো। রূপক বলল, চাচা চা খান। আমার শ্বশুর বাড়িতে যাওয়ার সৌভাগ্য নাই। তাই শ্বশুরের এলাকার কাউরে চিনি না। আপনি কি কোন কামে আইছেন এই বাজারে?
হ, একটা কামে আইছি।
মেলা দূর-দূরান্ত থাইকা লোকজন এই বাজারে আসে। যাইহোক মাঝেমধ্যে আসলে আইসেন আমার লগে দেখা করতে। পরিচয় যখন হইল।
হ, সেইটাই। পরিচয় যখন হইল, আসবো নে।

চিত্রার মুখটা অন্ধকারে ছেয়ে গেল। চাচা গ্রামে গিয়ে চিত্রা কিংবা তার স্বামীর ব্যাপারেও ভিন্ন কিছু বলবে কিনা সেই দুশ্চিন্তা কাবু করে ফেলল চিত্রাকে। তার গ্রামের লোকজন কিছুই জানেনা। এই লোকটা যদি গিয়ে সবকিছু নিয়ে গবেষণা শুরু করে দেয়, তাহলে তো বিপদে পড়তে হবে। পুরো গ্রামবাসীকে সে জানিয়ে দেবে চিত্রার আগের বিয়ের কথা, রূপকের কথা। চাচার সঙ্গে একাকী কথা বলতে পারলে ভালো হতো। কিন্তু তখনই দোকানে চলে এল চিত্রার শ্বশুরমশাই। শশুরের সামনে লোকটার সঙ্গে একাকী কথা বলার সুযোগ পেলো না চিত্রা। তিনি এসে জোসনা বেগমকে বললেন, বউরে লই মোস্তফার দোকানে যাইও। যাইতে কইছে তোমারে।
জোসনা বেগম তাগাদা দিয়ে তাকে বললেন, চলো বৌমা। কাম সাইরা আসি। সন্ধ্যা হইয়া যাইতাছে।
চিত্রা তার গ্রামের লোকটিকে বলল, চাচা ভালো থাইকেন। চাচিরে আমার সালাম দিয়েন।
লোকটা হতভম্ব হয়ে সিঙ্গারা খাচ্ছেন। তার অদ্ভুত দৃষ্টি চিত্রার বুকে কাঁপন ধরিয়ে দিল।
লোকটা যদি রূপককে কিছু বলে দেয়? এই এক দুশ্চিন্তা মগ্ন করে ফেলল চিত্রাকে। লোকটা বিদায় না নেয়া পর্যন্ত চিত্রা কাপড় পছন্দ করার অজুহাতে দোকানে বসে রইল। তিনি চলে যাওয়ার পর মনটা কিছুটা শান্ত হল। কিন্তু তবুও এক ধরনের অজানা আশঙ্কায় চিত্রার আর কোন কিছুই ভালো লাগছে না। জোসনা বেগমের সঙ্গে জুয়েলারির দোকানে এসেও তার দুশ্চিন্তা কিছুতেই কমলো না। বাজারের কাজ শেষ করে বাড়ি ফিরতে সন্ধ্যা হয়ে এলো। জোসনা বেগম চুলায় ভাত বসিয়েছেন। চিত্রার খুব অস্থির লাগছে। কেন যেন মনে হচ্ছে তার জীবনে কোনো বিপদ নেমে আসতে যাচ্ছে। এতদিন এই ভয়টা তার মনে ছিল না। আজ বিকেলের পর থেকেই ভয়টা দানা বেঁধেছে মনে। চিত্রা নিবিড়ভাবে প্রার্থনা করতে লাগল যেন তাঁর জীবনে বিপদাপদ গুলো কেটে যায়।

রূপক বাড়ি ফিরল রাত্রিবেলা। ভয়ে ভয়ে তার সঙ্গে কথা বলল চিত্রা। রূপকের কথাবার্তা বেশ স্বাভাবিক। তারমানে বিপদের আশংকা নেই। চিত্রা শংকায় ম্লান।
দেখতে দেখতে কেটে গেল কয়েকটা দিন। চিত্রার ভয়টা আস্তে আস্তে কেটে যাচ্ছে। প্রাণ ফিরে পেয়েছে সে। রূপক স্বাভাবিক আচরণ করছে তার সঙ্গে। সবকিছু যেন এভাবেই থাকে। তার জীবন থেকে রূপক হারিয়ে গেলে কি নিয়ে বাঁচবে সে?

চলবে..

#দ্বিতীয়_পুরুষ
পর্ব ২৭
_নীলাভ্র জহির

আজ রুপক ভরসন্ধ্যায় বাড়ি ফিরেই চিত্রার হাত ধরে ঘরের ভেতরে টেনে নিয়ে আসলো। মুখোমুখি দাড়িয়ে জানতে চাইল, একটা সত্যি কথা কইবা?
কোন কিছু বুঝতে না পেরে চিত্রা থতমত খেয়ে তাকিয়ে রইল। ঘাড় বেঁকিয়ে বলল, কি কথা?
তোমার কি আগেও একবার বিয়ে হইছিল?
প্রশ্নটা শুনে যেন আকাশ থেকে পড়লো চিত্রা। নিজেকে সামলে নিতে পারল না। মনে হচ্ছে পায়ের তলা থেকে মাটি সরে যাচ্ছে। সমস্ত পৃথিবী অন্ধকার হয়ে যাচ্ছে তার। শ্বাস বন্ধ হয়ে আসছে। কথা বলার মতো অবস্থায় রইল না সে।
রূপক আবারো জানতে চাইলো, চুপ করে রইছো কেন? কও তোমার কি আগে একবার বিয়ে হইছিল?
চিত্রা বহু কষ্টে নিজেকে সামলে নেয়ার চেষ্টা করল। মৃদুস্বরে শুধু বললো,, এই কথা আপনার কে কইলো।
কে কইছে সেইডা তোমার শুনতে হইবো না। তুমি শুধু কইবা কথাটা সত্য নাকি মিথ্যা। আমি আর কিছুই শুনতে চাইতেছি না। তোমার আগে একবার বিয়ে হইছিল? কথাটা সইত্য। নাকি মিথ্যা শুধু সেইডা কইবা।

ভীষণ দোটানায় পড়ে গেল চিত্রা। বুঝতেই পারলো না এই মুহুর্তে তার কি করা উচিত। এত বড় সত্য কিছুতেই সে চাইলে লুকিয়ে যেতে পারবে না। যেখানে রূপকের কান পর্যন্ত কথাটা পৌঁছে গেছে সেখানে এখন আর লুকিয়ে রাখার কোন মানেও হয়না।
চিত্রা মাথা নিচু করে ফেলল। উপর নিচে মাথা ঝাকিয়ে মৃদু স্বরে বলল সত্য। কিন্তু আমার সব কথা আপনাদের শুনতে হইবো। সব কিছু না শুইনা আপনি কিছু করতে পারবেন না।
মুহূর্তেই যেন রূপকের চেহারায় অন্য কেউ এসে ভর করল। চোখ দুটো বিস্ফোরিত হয়ে জ্বলে উঠলো তার। মনে হল তার বুকটা বোধহয় যন্ত্রনায় জ্বলে পুড়ে ছারখার হয়ে যাচ্ছে। বুক চেপে ধরে চৌকির উপর বসে পড়ল। মৃদু স্বরে বলল, শেষ পর্যন্ত আমার জানের দোস্ত আমারে ঠকাইলো। সবাই আমারে ঠকাইলো। যারে আমি এত ভালোবাসলাম সেও ঠকাইলো আমারে। তুমি কেমনে পারলে আমারে ঠকাইতে?
কথাগুলো যেন চিত্রার কান দিয়ে নয় বুক ফুঁড়ে ভেতরে ঢুকে যাচ্ছে। কি উত্তর দিবে বুঝতে না পেরে দিশেহারা হয়ে তাকিয়ে রইল চিত্রা। তার বুকের ভেতর ক্রমাগত যে আর্তনাদ হচ্ছে তা কীভাবে সে রূপক কে দেখাবে? রূপকের হতাশ মুখ দেখে ভীষণ কষ্ট হতে লাগল তার।
চিত্রা রুপকের কাঁধে হাত রেখে বলল, আপনি আমার কথাগুলো শুনেন। না শুইনা কাউরে দোষ দিয়েন না।
কাউরে তো দোষ দিতেছি না। দোষ আমার ভাগ্যের। ভাগ্যে ছিল বইলাই আমার দোস্ত আমার লগে বেইমানি করছে। তার বইনের বিয়া হইছে সেই কথা আমার লগে লুকাইয়া তারে আবার আমার লগে বিয়া দিছে। বেইমানি করছে আমার দোস্তের পরিবার। বেইমানি করছো তুমি। তুমি এমন ভাবে আমার লগে অভিনয় করছ যেন আমি তোমার জীবনে প্রথম পুরুষ। সবাই বেইমান।
চিত্রার চোখ ফেটে জল চলে এলো। কিছু বলতে পারলো না। কথা বলতে গিয়ে বুঝতে পারলো তার গলা ধরে এসেছে। চোখ বেয়ে টলটল করে জল গড়িয়ে পড়ল মাটিতে।
রুপক বলল, একটা কথা মনে রাইখো। সত্য কখনো চাপা থাকেনা। যতই চেষ্টা করো সেটা কোন না কোনদিন প্রকাশ পায়বই। এত বড় সত্য লুকাইয়া তোমরা কামডা ঠিক করো নাই। আজ কেমনে তুমি আমার বিশ্বাস ভাইঙ্গা দিছো আর কোনদিনও তোমার উপরে আমার বিশ্বাস আইবো না।

দরজা খুলে গটগট করে ঘর থেকে বেরিয়ে রূপক বাড়ির বাইরে চলে গেল। স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে রইল চিত্রা। রূপকের সঙ্গে তার কথা বলা দরকার। সবকিছু খুলে বলা দরকার তাকে। চিত্রা দৌড়ে ঘরের বাইরে বেরিয়ে এলো। ততক্ষনে অন্ধকারে আড়াল হয়ে গেছে রূপক। কোথায় গেলো কে জানে?
চিত্রা অন্ধকারে দাঁড়িয়ে রইল মূর্তির মতন। যে ভয়টা বিয়ের প্রথম দিন থেকেই সে পাচ্ছিল আজকে সেটা ফলে গেল। রূপকের চোখে সে একজন বেইমান। সবকিছু খুলে বলার পরও হয়তো সম্পর্কটা আর কখনো স্বাভাবিক হবে না। বেইমান হয়ে থাকতে হবে তাকে। কি করবে চিত্রা এখন? তার খুব পাগল পাগল লাগছে।
চিত্রা নিজের পেটে হাত রাখল। তার গর্ভে রূপকের সন্তান। তার তার ভবিষ্যৎ কি হবে? সে আপন মনে বলল, বাবারে তোর অসহায় মা এখন কই যাবে? যারে জীবনে প্রথম ভালোবাসিলাম সে আমারে বেইমান বলল। কেমনে বুঝাবো আমি তারে? সে যদি আমারে ভুল বুঝে, আমারে ছাইড়া চইলা যায়। তোরে লইয়া আমি কই গিয়ে দাঁড়ামু।
পথে দাঁড়িয়ে হাউমাউ করে কেঁদে উঠলো চিত্রা। তার কান্নার শব্দে জোসনা বেগম এসে দাঁড়ালেন। জানতে চাইলেন কি হইছে? রূপকরে দেখলাম বাড়িতে আইছিল। কিছু কইছে তোমারে?
কথা বলতে পারল না চিত্রা। পথের মাঝখানে পড়ে বসে পড়ল। জোসনা বেগম আর্তনাদ করে উঠলেন, ও বউ। এখানে বইলা কেন? কি হইছে আমারে কও?
চিত্রা জোসনা বেগমের পা জড়িয়ে ধরে বলল আমার সব শেষ হইয়া গেছে আম্মা।
জোসনা বেগম নিজেও চিত্রার পাশে বসলেন। উদ্বিগ্ন কণ্ঠে বললেন, কি হইছে আমারে কও। রুপক তোমারে কী কইছে।
সব শেষ হইয়া গেছে আম্মা।
আরে কইবা তো।
চিত্রা কোন কথা বলল না। হাউমাউ করে কাঁদতে লাগল। তার গগনবিদারী কান্না আকাশ পাতাল ফুঁড়ে যেন সপ্ত আসমানে চলে যাচ্ছে। এমন অসহায় এভাবে কখনো কাউকে কাঁদতে দেখেননি জোসনা বেগম। পাছে গ্রামের লোকজন জড়ো হয়ে যায় এই ভয়ে তিনি চিত্রাকে টানতে টানতে ঘরের ভিতরে নিয়ে গেলেন। ঘরে গিয়েও চিত্রার কান্না থামল না।
ধীরে ধীরে রাত বাড়তে লাগল। বাড়ি ফিরল না রূপক। অর্ধমৃতের মত বিছানায় পড়ে আছে চিত্রা। চোখ দিয়ে টপটপ করে গড়িয়ে পড়ছে গরম জল। সেই জলে ভিজে যাচ্ছে বালিশ। কিন্তু মুখে তার কোন শব্দ নেই। সবকিছু যেন থমকে গেছে হঠাৎ।

অনেক রাত হয়ে গেলে বাড়ি ফিরে আসলো রূপক। তবে ঘরে প্রবেশ করল না। মাকে ডেকে ভাত দিতে বলে দিল। জোসনা বেগম কোন প্রশ্ন না করে ছেলেকে ভাত খেতে দিলেন। দরজার আড়াল থেকে তাকিয়ে রইল চিত্রা। রূপক স্বাভাবিক ভঙ্গিতে ভাত খাচ্ছে। জোসনা বেগম মৃদুস্বরে জানতে চাইলেন, বউরে কিছু কই ছিলি নাকি?
রূপক শুধু চোখ তুলে একবার মায়ের দিকে তাকালো। কোন উত্তর দিল না।
জোসনা বেগম কি বুঝলেন কে জানে। মৃদু স্বরে বললেন, খুব কান্নাকাটি করতাছে সন্ধ্যা থাইকা। তুই মনে হয় খারাপ আচরণ করছস। কিছু কইস না। পোয়াতি মাইয়া। এত কান্নাকাটি করোন ভালো না।

রূপক একটা নিশ্বাস ফেলে বলল, ওর কথা বাদ দাও।

কষ্টে বুকটা ফেটে যেতে লাগল চিত্রার। তার কথা রূপক বাদ দিতে বলছে। অথচ এই রূপক দুদিন আগেও মায়ের কাছে তার প্রশংসায় পঞ্চমুখ থাকতো। ভালোবাসার নিবিড় বন্ধনে আগলে রাখত তাকে। এক কালবৈশাখী ঝড় সবকিছু নিমিষেই তছনছ করে দিয়ে গেল। এখন কি নিয়ে বাঁচবে সে?

জোসনা বেগম বলেন, তোর বউরে ডাক। ভাত খাইতে ক। না, খাইয়া রইছে। পোয়াতি মানুষ না খাইয়া থাকুন ভালো না।
আমার খাওয়া হইয়া গেলে তারে ডাইকা ভাত খাওয়াইয়া দিও।
চিত্রার বুকের ভেতর যেন উত্তাল স্রোত ধাক্কা দিল। তার স্বামী এই প্রথম তাকে রেখে খাবার খাচ্ছে। আর বলছে তার খাওয়া হয়ে গেলে যেন তাকে খাইয়ে দেয়া হয়। সে অভিমানে না খেয়ে রয়েছে এতে তার কিছুই যায় আসে না। অবশ্য কেনইবা যায় আসবে। তার চোখে সে একজন বেইমান।

চিত্রা কাঁপতে কাঁপতে বিছানায় এসে বসলো। চোখ মুছে মনে মনে ভাবল, এত ভেঙে পড়লে চলবে না। তাকে শক্ত হতে হবে। জীবনের সঙ্গে যা ঘটে গেছে তাকে চাইলেই মানুষ কখনো এড়িয়ে যেতে পারে না। সেই সত্যগুলো সারাজীবন ঘুরেফিরে মানুষের সামনে আসবেই। সেগুলোকে সামাল দিতে হবে। একদিন না একদিন এই সত্যের মুখোমুখি তাকে হতেই হত। চিত্রা নিজেকে শক্ত করার চেষ্টা করলো। রূপকের মুখোমুখি হয়ে তাকে সবকিছু জানাতে হবে। তার জীবনের কঠিন অতীতের কথা জানলে নিশ্চয়ই তাকে ক্ষমা করে দিবে রূপক।

রূপক ভাত খেয়ে ঘরে এসে ঢুকলো। চিত্রার সঙ্গে কোনো কথা না বলে শুয়ে পড়ল বিছানায়। কিছুক্ষণ পর কথা বলল চিত্রা, আপনে আমার কথা শুনবেন না?
কোন উত্তর নেই রূপকের। চিত্রার কান্না এলো। এভাবে কখনও তার সঙ্গে রূপক রাগ করে থাকেনি। তার প্রিয় রূপক তার সঙ্গে কথা বলছে না। এর চেয়ে কষ্টের আর কি হতে পারে?
চিত্রা বলল, কথাগুলান আপনার শুনতে হইবো। না শুইনা আপনি আমারে দোষারোপ করতে পারবেন না। হ আমি বেইমান। আমি আগের বিয়ের কথা আপনার কাছে লুকাইছি। কিন্তু ক্যান লুকাইছি সেইটা আপনার শোনা দরকার।
বিয়া মনে হইয়া থাকুক আর যেমনেই ভাইঙ্গা দিয়া থাকুক। সত্য হইতাছে তোমার আগে বিয়ে হইছিল। তার চাইতে বড় সত্য হইতাছে যে বন্ধুরে আমি আমার আপন মানুষ মনে করতাম সে নিজেও এই সত্যটা লুকাইয়া তোমারে বিয়া দিয়ে দিছে। এর চাইতে বড় কষ্ট আর কিছু নাই।
আমার জায়গায় আপনি থাকলে আপনে ও ওইটাই করতেন। সব কথা আপনার শোনা লাগবো। আমি মাইনা নিসি যে আমিও ভুল করছি। এই সত্যটা গোপন কইরা বিয়া দেওয়াটা উচিত হয় নাই। কিন্তু আপনি বিশ্বাস করেন আমি মানুষটা খারাপ না। আমারে অন্তত বিশ্বাস করেন।
আমার কারো উপর বিশ্বাস নাই।
রূপক অন্য পাশ ফিরে শুয়ে পড়ল। চিত্রা বলল, বিশ্বাস না হওন স্বাভাবিক। আপনি এই পাশে ফিরেন। আমার অনেক কথা কওনের আছে আপনারে।
তোমার কথা শোনার কোন টাইম আমার নাই। কোন ইচ্ছাও নাই। জীবনে মনে হয় অনেক পাপ করছিলাম। সেই জন্য মানুষের কাছ থাইকা আমার শুনতে হয় আমার বউয়ের আগে বিয়ে হইছিল। মানুষের কাছে আমার ছোট হইতে হয়। হাসির পাত্র হইতে হয়। কোন পাপের শাস্তি পাইতাছি আল্লাই জানে।

চিত্রা বলল, আমি আপনার সব কথা শুনমু। তার আগে আপনার আমার কথাগুলো শুনতে হইবো।
কি কথা কইবা তুমি? যার লগে তোমার বিয়ে হইছিল সে নিশ্চয়ই অনেক খারাপ আছিল এইটা কইবা? তোমারে অনেক নির্যাতন করছে। তাই তার লাগে তোমার ছাড়াছাড়ি হইয়া গেছে। তোমার এখানে কোন দোষ নাই। তুমি, তোমার বাপ, তোমার চৌদ্দগুষ্টি ধোয়া তুলসী পাতা। সব দোষ আমার। আমার পরিবারের। কারণ আমরা ভালোমানুষি দেখাইছি। আমার দোস্ত কইছে আর আমি কোন ভাল-মন্দ খোঁজখবর না লইয়াই চোখ বন্ধ কইরা তোমারে বিয়া কইরা ফেলছি। মানুষে বিয়ে করার আগ মাইয়ার বংশ দেখে। পরিবারের সব খোজ-খবর শুইনা তারপরে বিয়ে করে। আর আমি আমার বন্ধুরে বিশ্বাস কইরা ছাগলের বাচ্চার মত বিয়া কইরা ফেলছি।

চিত্রা দাঁতে দাঁত চেপে কথাগুলো হজম করলো। সে অসহায়। আজ না হলেও দুদিন পর তাকে এই কথাগুলো শুনতে হবে। তার কপালটা এতটাই খারাপ যে সারাজীবন কথা শুনে এসেছে। বাকি জীবনটাও তাকে কথা শুনেই কাটিয়ে দিতে হবে।
একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে চিত্রা বলল, আমার স্বামী আমারে নির্যাতন করে নাই। যেটা করছে সেটা শুনলে আপনের বিশ্বাস হইবো না।
তোমার স্বামী না? এমন কইরা কইতাছো। থাক আমি আর মুখটা খারাপ করলাম না। ভাবতে ঘেন্না লাগতেছে আমি তোমার জীবনে দ্বিতীয় পুরুষ।
আমার জীবনে প্রথম পুরুষ দ্বিতীয় পুরুষ বইলা কিছু নাই। আমি আমার জীবনে আপনেরে প্রথম ভালোবাসছি। সব উজার কইরা ভালোবাসছি। আমার শরীরে আপনি প্রথম হাত দিছেন। আপনার আগে কোন পুরুষ আমারে ছুঁইতেও পারে নাই।
কেন? তোমার আগের স্বামী তোমার এমনি এমনি ছাইড়া দিছে? ছুঁইয়া দেখেনাই?
না, ছুঁইয়া দেখেনাই। আমি ছুঁইয়া দেখতে দেই নাই। এইজন্য কইতাছি আপনি আমার কথাগুলো শুনেন।
কি শুনতাম? আবার কোন নাটক বানাইয়া বানাইয়া আমার একটু শুনাইবা। মাইয়া মানুষ রে আমি ভালোমতো চিনি। সুযোগ পাইলে তারা যেমন চোখের জল দিয়া পুরুষ মানুষকে বশ মানাইতে পারে। তেমনি যখন তখন মনগড়া নাটক বানাইয়া মানুষ রে বোকাও বানাইতে পারে।
আমি কোন নাটক বানানোর মত মাইয়া না। সেইটা আপনি ভালো কইরাই জানেন।
হ কিন্তু ভুল জানছি। তো সত্যটা আমারে জানাও। একটা পুরুষ মানষের লগে তোমার বিয়ে হয়েছে অথচ সেই তোমারে ছুঁইয়া দেখেনাই। তার লগে তুমি হুদাহুদি সংসার করছো।
তার লগে আমার কোন সংসারও হয় নাই। বিয়ের রাইতে আমি পলাইয়া আছি।
বিয়ার রাতে পলাইছো? শেষ পর্যন্ত আমার এইডা শোনা লাগলো। কি এমন ঘটছিল যে তোমারে বিয়া রাইতে পলাইতে হইল?
চিত্র একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়লো। রূপক কঠিন চোখে তার দিকে চেয়ে আছে।

চলবে..

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here