#দ্বিতীয়_পুরুষ,পর্ব ৩৫
#নীলাভ্র_জহির
বাড়ির কাজ প্রায় শেষের দিকে। ধানের ক্ষেত সবুজ থেকে সোনালী রং ধারণ করেছে। এ বছর বেশ ভালো ফলন হয়েছে ধানের। কয়েক দিনের মধ্যেই নতুন ধান ঘরে উঠবে। নতুন ঘরে নতুন ধান। সুখের সীমানা নেই জোসনা বেগম ও তার স্বামীর। ঘরের রংটা শেষ হলেই রুবিনাকে বাড়িতে নিয়ে আসবেন। মনে অশান্তি থাকলেও চিত্রা রুবিনার অপেক্ষায় আছে। রুবিনা বাড়িতে এলে তার একটা কথা বলার মানুষ হবে। এ বাড়িতে তার সঙ্গে কেউ তেমন একটা কথা বলে না।
বেশ কয়েকদিন ধরে রূপকের মনটা সারাক্ষণ ফুরফুরে থাকে। নতুন বাড়ি করার আনন্দেই নিশ্চয়ই। বাড়িতে মেয়ে জামাই আসবে, নতুন ঘরে ওঠার সময় মিলাদ করে নতুন ধান ঘরে তোলার উৎসব হবে। এত আনন্দের ভিড়ে একমাত্র চিত্রাই কষ্টে রয়েছে। তবে তার কষ্টটুকু একান্তই তার নিজের। জ্যোৎস্না কিংবা রুপক কারোরই তার দিকে তাকানোর সময় নেই।
চিত্রা নিজের ঘরের বারান্দায় বসে চুল আচড়াচ্ছে। বাড়িতে কাউকে প্রবেশ করতে দেখে মাথায় আঁচল টেনে নিল চিত্রা। একজন মহিলা ও সঙ্গে দুজন মেয়ে এসেছে। চিত্রা মহিলাকে সালাম জানাল। তিনি কিছুক্ষণ ভ্রু কুঁচকে চিত্রার দিকে তাকিয়ে রইলেন। এমন সময় বেরিয়ে এলেন জোসনা বেগম। বেশ ব্যস্ত হয়ে বললেন, আরে আপা আপনে। গরিবের বাড়িতে রানী সাহেবের পা পড়ছে।
বেশ ব্যস্ত হয়ে জোসনা বেগম চেয়ার বের করে দিলেন। বারান্দায় চেয়ারে বসলো মহিলা ও তার দুই মেয়ে। মেয়ে দুটো বেশ কৌতুহলী চোখে চিত্রার দিকে তাকাচ্ছে। জোসনা বেগম চিত্রার কাছে এসে ফিসফিস করে বললেন, তুমি ঘরে যাও।
চিত্রা নিজের ঘরে যেতে যেতে আড়চোখে মহিলাদেরকে দেখছিল।
জোসনা মেয়েটাকে বললেন, মা মৌসুমী কেমন আছো?
মৌসুমি মিষ্টি হেসে উত্তর দিলো, জি চাচি ভালো আছি। আপনি তো এখন আমাদের বাড়িতে যান না।
ঘরের কাম চলতাছে। তো অনেক ব্যস্ত থাকি।
সেজন্য আমরাই দেখতে আসলাম আপনাকে। উনি কে?
চিত্রার দিকে ইশারা করেছিল মৌসুমী। চিত্রা ততক্ষণে ঘরের ভেতর প্রবেশ করেছে। তাই জোসনা বেগমের দেয়া উত্তরটা শুনতে পায়নি। শুনলে হয়তো তখনই তার ইচ্ছে করতো মাটির নিচে ঢুকে যেতে।
জোসনা বললেন, পরে কমুনে।
তারপর ফিসফিস করে বললেন, মাথার ছিট খারাপ। পাগলী।
দেইখা তো এরকম মনে হইল না।
জোসনা বেগম সেটার উত্তর না দিয়ে মৌসুমির মাকে বলল, আপা ঘরে আসেন। প্রথমবার আইসেন আমাগো বাড়িত। গরিবের ঘরবাড়ি।
কি যে কন না আপনি?
তাছাড়া আর কি? ভেতরে বসেন। আমি একটু নাস্তা পানির ব্যবস্থা করি।
এত ব্যস্ত হইবেন না আপা। বসেন আপনার লগে গল্প করি।
আরে প্রথমবার আইছেন। নাস্তা পানি দেই। একটু বসেন। মা তোমরাও আসো ভিতরে।
জোসনা বেগমের অনুরোধে মৌসুমী তার মাকে নিয়ে ঘরের ভেতরে ঢুকে বসল। তড়িঘড়ি করে বিস্কুট চানাচুর, মুড়ি মাখার ব্যবস্থা করলেন জোসনা। মৌসুমী ওর ছোটবোন কে বলল বলল,চল আমরা একটু ঘুইরা দেখি।
সঙ্গে সঙ্গে বাঁধা দিয়ে জোস্না বললেন, আমি লইয়া যামু। নাস্তা খাইয়া লও, তারপর।
হাতের মুঠোয় মুড়ি নিয়ে কুরকুর করে চিবোতে লাগলো মৌসুমী। তার কৌতুহলী চোখ বারবার এদিক-সেদিক ঘুরছে। ঘর থেকেই সে বাড়ির উঠোনে চিত্রাকে দেখতে পেল। চিত্রা নিশ্চয়ই উনার মেয়ে নয় সেটা তো নিশ্চিত। নিজের মেয়ে পাগল হলেও কেউ অন্যের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিতে লজ্জাবোধ করে না। অথচ জোসনা বেগম চিত্রাকে নিয়ে যারপরনাই লজ্জিত। হয়তো নিকট কোন আত্মীয় হবে। তাই বিষয়টা নিয়ে সে আর কোন মাথা ঘামাল না।
নাস্তা খাওয়া শেষ হলে জোসনা বেগম তাদেরকে নতুন করা ঘর গুলো দেখাতে লাগলো। ঘরের বেশ প্রশংসা করলেন মৌসুমীর মা। জোসনা বেগম নিজের ছেলের প্রশংসা করতে ভুললেন না। তার পরিশ্রমী ছেলে নিজের চেষ্টায় দোকানটাকে অনেক বড় করেছে, অনেক জায়গা জমি কিনেছে, বাড়িটাও করল। সেসব সুনাম করতে তিনি এক বিন্দু দেরি করলেন না। মুগ্ধ হয়ে শুনছিলেন মৌসুমীর মা। কথায় কথায় একটা সময়ে এসে তিনি বেশ আবেগী কন্ঠে বলে উঠলেন, কিন্তু আমার পোলার কপালটা খুব খারাপ। আমার নিস্পাপ পোলাটা কিসের শাস্তি পাইতাছে আল্লাহই জানে।
মৌসুমির কৌতুহলী প্রশ্ন – কেন কি হইছে?
জোসনা বেগম বেশ করুণ গলায় দুঃখ মিশিয়ে বললেন, দুঃখের কথা আর কি কমু রে মা। ওইযে পাগল মাইয়াডারে দেখলা ওইটা আমার পোলার বউ ।
চমকে উঠল মৌসুমী। বিস্ফারিত চোখে সে তার মায়ের দিকে তাকালো । অবিশ্বাসের সুরে বলল, রূপক ভাই বিয়া করছে ?
জোসনা বেগম বিষয়টাকে সামাল দেয়ার চেষ্টা করলেন, সেই দুঃখের ইতিহাসটাই তোমারে কই শোনো। আমার পোলার এক বন্ধু আছে। স্কুলে এক লগে পড়ছিল। এই মাইয়া তার বোন হয়। আমার পোলার কাছে সবকিছু গোপন কইরা আমার পোলারে ভুলাইয়া ভালাইয়া বিয়া পড়াইয়া দিছে। বিয়ার পরে আস্তে আস্তে জানতে পারলাম মাইয়ার সব ইতিহাস। মাইয়ার মাথায় দোষ আছে। ওর বাপ টাও পাগলা। সেজন্য ফুপুর বাসায় থাকতো। ফুফাতো ভাইয়ের কান্ধে বোঝা হইলে যা হয়। আমার পোলাটারে বলির পাঠা বানাইলো। সবচাইতে বড় দুঃখের ইতিহাস হইল মাইয়াডার আগেও একবার বিয়া হইছিল। পাগল বইলা সেইখানেও সংসার করতে পারে নাই। কিন্তু আমার পোলার বন্ধু এই কথাটা একদমই গোপন রাখছে। আমার পোলার মনটা বড় ভালো। সে বিবেক কইরা মাইয়াডারে তাড়াইয়া দেয় নাই। মাইয়াডা পোয়াতি হইছে। পেটের বাচ্চাটার কথা চিন্তা কইরা আমরা ওরে তাড়াইয়া দেই নাই। এখন ভাবতাছি পোলাডারে আবার বিয়া দিমু। আমার এত ভাল পোলার কষ্ট তো আমি সইতে পারিনা। আর এই মাইয়াডার বাচ্চাটা হইয়া গেলে ওরে রাইখা আসবো। আমার পোলা কইছে ওই মাইয়ার যত খাবার খরচ ভরণপোষণ টাকাপয়সা সে যথেষ্ট ওরে সাহায্য করবো। আপনি কন এমন ভালো পোলা কি আজকালকার দুনিয়ায় আছে? যারা বেইমানি কইরা আমার পোলারে ফাঁসাইছে, আমার পোলা সেই মাইয়ার ভালোর কথা চিন্তা করতাসে। পাগল মাইয়া লইয়া তো সংসার করন যায়না।
মৌসুমী স্থির চোখে তার মায়ের দিকে তাকালো। তার চোখ দেখে মনে হচ্ছে চোখে একটাই প্রশ্ন, তার মা আগে এই বিষয়টা জানতো কিনা? জেনে শুনে কেন তাকে বারবার তিনি রূপকের কথা বলতেন? রুপকের প্রশংসায় পঞ্চমুখ থাকতেন। তার উৎসাহেই রূপকের দিকে এগিয়ে গিয়েছিল মৌসুমী। কিন্তু এই মুহুর্তে তার বুকটা বিতৃষ্ণায় ভরে গেল। মায়ের উপর প্রচন্ড রাগ হচ্ছে। মৌসুমী দাঁতে দাঁত চেপে রাগটা নিয়ন্ত্রণ করল।
মৌসুমির মা জোসনা বেগমকে বললেন, আপা কষ্ট পাইয়েন না। যারাই এমন করছে আল্লাহ তার বিচার করব। রূপকের মত একটা পোলার লগে এইরকম করাটা ঠিক হয় নাই।
– আমার সাদামাটা পোলাডারে পাইয়া ছাগল বানাইছে গো আপা। পোলাটা আমার কত মানুষের উপকার করে। বিয়ের পর থাইকা কি যে অশান্তির মধ্যে আছে। আমি মা হইয়া ওর অশান্তি একদম সহ্য করবার পারতাছিনা। সেইজন্য ভাবতেছি পোলাডারে বিয়া করামু। একটা ভালো মাইয়া খুজতাছি।
– মাইয়া পাইয়া যাইবেন আপা। আপনেগো মতো ভালো মানুষের লগে নিশ্চয়ই আল্লাহ ভালো কাউরে মিলাইয়া দিব।
– দোয়া কইরেন। সে কষ্ট কইরা কি সুন্দর বাড়িটা করল!
মৌসুমীর মা-ও জোসনা বেগম তখন রূপকের সুনাম করতে ব্যস্ত। তখন মৌসুমীর দৃষ্টি উঠানে দাঁড়িয়ে থাকা চিত্রার দিকে। চিত্রা বারবার তার দিকে তাকাচ্ছে। দৃষ্টিতে যথেষ্ট কৌতূহল এবং শঙ্কা। মৌসুমী চোখ পিটপিট করে চিত্রা কে দেখতে লাগলো। চোখাচোখি হলো তাদের। মেয়েটার দৃষ্টি দেখে তার মোটেও পাগল মনে হচ্ছে না।
মৌসুমী তার মাকে বলল, মা চলো এখন বাড়ি যাই।
জোসনা বললেন আরে, এত তাড়াতাড়ি কিসের যাওয়া? রান্নাবান্না করি, ভাত খাইয়া তারপর যাইও।
না, চাচী। বাড়ি গিয়ে আমাকে পড়তে বসতে হবে। সামনে পরীক্ষা।
জ্যোৎস্না আর কোন উত্তর দিতে পারলেন না। আর কিছুক্ষন গল্প করে তারা বেরিয়ে গেল। সঙ্গে সঙ্গে জোসনা বেগম এসে চিত্রাকে বললেন, তোমারে কইছিলাম ঘরে যাইতে। বাইরে খাড়ায় আছো কেন?
চিত্রা স্থির চোখে জোসনার দিকে তাকাল। জ্যোৎস্না বললেন, চুপ কইরা আছো কেন? মানুষের সামনে আমারে বেইজ্জতি না করলে তোমার হয়না? এখানে খাড়াইয়া রইছ কি জন্য? রাস্তা দিয়ে কি তোমার ভাতার যাইতাছে? ভাতাররে দেখার জন্য খাড়ায় আছো।
মা এইসব কি কইতাছেন?
তো কি কমু? বাড়িত মেহমান আইছে আমার। তোমারে কইছিলাম ঘরে গিয়া বইসা থাকো। তুমি কি জন্য এখানে খাড়াইয়া রইছ আমারে বুজাও?
আমিতো আপনার মেহমানের সামনে যাই নাই।
সামনে যাও নাই? তারা তোমাকে দেখে নাই ওইখান থেইকা?
তারা দেখলে কি হইবো মা? আপনি কি ওই মাইয়ার লগে ছেলের বিয়ে দিতে চাইতেছেন নাকি?
হ, চাইতেছি। তাতে তোমার কি? তোমারে যে এই বাড়িত থাকতে দিছি সেইটা তোমার সৌভাগ্য মনে কইরা চুপচাপ থাকবা।
সেজন্য আমারে কইলেন ঘরে গিয়ে থাকতে। ওই মাইয়া কি জানে আমি আপনার পোলার বউ?
হ, জানে। লগে এইডাও জানে আমার পোলা তোমারে ছাইড়া দিবো। ছাড়াছাড়ি হইয়া গেলে আমি ওই মাইয়ার লগে আমার পোলার বিয়া দিমু।
আচ্ছা, আম্মা। দিয়েন। আপনের চান্দের টুকরা পোলার জন্য এমন চাঁদের টুকরা মাইয়ায় তো আপনি চাইছিলেন। বিয়া দিয়া মা ও পোলা খুব সুখে থাইকেন। আমি চইলা যামু বাড়ি থাইকা।
চইলা গিয়া আমারে উদ্ধার করো।
করব আম্মা। আর কয়টা দিন ধৈর্য ধরেন। ডেলিভারি টা হোক। ডেলিভারির পর পোলারে রাইখা আমি বাপের বাড়ি চইলা যামু। পোলারে বিয়া দিয়েন। নাতি, পোলা , বউ লইয়া সুখে থাইকেন।
জ্যোৎস্না রাগী চোখে তাকিয়ে রইলেন। আর কোন উত্তর দিতে পারলেন না। চিত্রা অন্য দিকে তাকালো। তার চোখে পানি আসছে। ভেজা চোখ সে আর কাউকে দেখাতে চায় না। দেখাতেও হলো না। তার পাশ থেকে সরে গেছেন জোসনা বেগম। চিত্রার ইচ্ছে করলো হাউমাউ করে কাঁদতে। বুকের পাথর ঠেলে বেরিয়ে আসা কান্নাটাকে এখন সে সংবরণ করতে শিখেছে। কান্নাটা একটা দীর্ঘশ্বাস হয়ে বেরিয়ে এলো। আর ঝাপসা হয়ে আসা চোখে সে দেখতে পেলো আকাশে উড়ছে একটা বড় চিল। তার খুব চিল হতে ইচ্ছা করছে। সে যদি পারত পাখির মত উড়ে যেতে। তবে কবেই উড়ে যেত রূপকের কাঁধের বোঝা নামিয়ে দিয়ে।
বাড়ি ফিরেই মৌসুমী একটা মেসেজ পাঠিয়েছে রূপক কে, সেখানে বাংলায় লেখা- চিটার। এরপর সে কলব্যাক করলেও রিসিভ করেনি মৌসুমী। হঠাৎ তার আবার কি হলো? তাই দোকান থেকে ফেরার সময় রূপক মৌসুমীর সঙ্গে দেখা করল। মৌসুমীর চোখে-মুখে ভয়াবহ ক্রোধ।
রাগত স্বরে মৌসুমী বলল, কি করতে আইছেন? আর জীবনেও কোনদিন আমার সামনে আসবেন না।
কি করছি আমি? আমার লগে কিসের এত রাগ করলেন হঠাৎ আমি বুঝলাম না।
আজ আপনার বাড়ি গেছিলাম। আপনার বউরে দেইখা আইছি।
ইতস্ততবোধ করল রূপক। কি বলবে বুঝতে পারল না। মৌসুমী বলল, চরিত্রের ঠিক নাই। ঘরে বউ রাইখা আরেকটা মাইয়ার লগে কথা কইতে শরম করে না?
– শরম করব ক্যান? আমি তো আর আপনের লগে প্রেম করিনা।
– বেহায়া লোক আর একটাও কথা কইবেন না। যেইটা করেন সেটার নাম কি? ইটিশ পিটিশ? মাইয়া মানসের লগে কথা কইতে খুব মজা লাগে?
রূপক রেগে বলল, আমি কি আপনারে কইছিলাম আমার লগে ইটিশ-পিটিশ করেন? আপনি নিজেই তো আমার কাছে আইছেন।
– বড় ভুল করছি। আপনার মায়ে সত্যগোপন কইরা পোলার নাম এমন কইরা আমার মায়ে কাছে কথা শুনাইছে, আমার মা আপনার লাইগা পাগল হইয়া গেছিল।
– সেগুলা শুইনা আপনে গইলা গেছেন।
– আপনের মত লোকের কোন লজ্জা শরম কিছু নাই। নিজে দোষ কইরা আবার বড় বড় কথা। আর কোনদিন আমার সামনে আসবেন না। নির্লজ্জ কোথাকার। আর আপনার মায়ে একটা মহা শয়তান মহিলা। সে কয় আমার পোলার বউ পাগল। পাগল দেইখা তার আগের সংসারটা টিকে নাই। আপনের বাড়ি থাইকা বাইর হইয়া পাশের বাড়ির এক মহিলা রে জিগাইছিলাম আপনার বউ পাগল কিনা। সে কয়, এমন ভালো একটা মানুষরে পাগল কইলে পাপ হইব। তারপর আরো দুই জনরে জিগাইছিলাম আপনার বউ পাগল নাকি না। সবাই শুনে হা কইরা তাকাইয়া কয়,এমন তো কোনদিন শুনি নাই। পাগল হইব কেন? সে তো খুব ভালো মাইয়া। ভদ্র, লক্ষী, আচার-আচরণ ভালো। এই বউডারে পাগল কইতে আপনার মায়ের বিবেক একটু বাধলো না?
– আমার মায়েরে নিয়া কিছু কইবেন না। ওই মাইয়ার আচার-আচরণ এখন ভালো ঠেকে না। পাগলামি করে। সেজন্য আমার মায়ে এই কথা কইছে।
– আর আগের বিয়ার কথা কি কইবেন? আমি মানুষরে জিগাইছিলাম ওনার নাকি আগেও বিয়া হইছিল? সবাই কইছে, আরে না। ওনার মত ভালো মাইয়াই হয়না। রূপকের লগেই পরথম বিয়া হইছে। আপনের মায়ে ক্যামনে এত বড় মিছা কথাটা বানাইল?
– ওর আগে বিয়ে হইছিল এইটা সত্যি। আমি আর আমার মা ছাড়া কেউ জানেনা। আমার ওর বাড়ির পাশের এক লোকে কইছে। উনি বিয়াতে উপস্থিত আছিল। ওর ভাইয়ে সত্য গোপন কইরা ওরে আমার কাছে বিয়া দিছে।
– ভালোই করছে। তারাও চিটার আপনারাও চিটার। তারা যত বড় প্রতারক আপনারা তার চাইতে বড় প্রতারক। উনার ভাইয়ে আগের বিয়ার কথা গোপন রাইখা আপনার কাছে বিয়া দিছে। আর আপনে এমন প্রতারক যে ঘরে বউ রাইখা আমার লগে মোবাইলে কথা কন। আর আমার কথা শুইনা এমন ভাব ধরেন যে আমার প্রেমে পইরা গেছেন। আমি যখন যা কই সেই কথাই শুনেন। তাল মিলান। নির্লজ্জ বেইমান কোথাকার।
রূপক নিজের রাগ সংবরণ করতে পারল না। কিন্তু রাগে কিছু বলতেও পারল না। কেবল গজ গজ করে কাঁপতে লাগলো।
মৌসুমী বলল, আপনার মায়ে এত সুনাম গায় আপনার। শোনেন আপনার মতো দশটা রূপক’রে আমি নাকে দড়ি দিয়ে ঘোরাই। আপনার মত শত শত পোলা আমার পিছনে লাইন ধইরা পইড়া আছে। আর আপনার মায়ে ভাবছে আপনার মত বিয়াইত্তা পোলারে আমি বিয়া করমু। ঘরে পোয়াতি বউ। পোয়াতি বউয়ের লগে এইরকম দুই নাম্বারি করতে আপনার বিবেকে বাধে না?
রূপক কোন উত্তর দিল না। তার ইচ্ছে করছিল মৌসুমীর গালে কষে একটা থাপ্পর বসিয়ে দিতে। কিন্তু পারল না। কারণ তারা কথা বলছিল মৌসুমীর বাড়ির উঠানে দাঁড়িয়ে। পিছনে দাঁড়িয়ে আছে ওর ছোটবোন। তাই আর কোন কথা না বাড়িয়ে অন্ধকারে পিছু হটল রূপক। কাঁচা রাস্তা ধরে সোজা বাড়ির পথে রওনা দিল। হাত নিশপিশ করছে। ইচ্ছে করছে বাড়িতে গিয়ে চিত্রাকে মেরে রক্তাক্ত করে দিতে। প্রচন্ড রাগে গজরাতে গজরাতে সে দ্রুত হাঁটতে লাগলো। কিন্তু যতোই বাড়ির পথে এগিয়ে আসছিল ততই যেন মৌসুমীর কথাগুলো তার বিবেকের কাঠগড়ায় নিজেকে আসামি রূপে দাঁড় করাতে লাগল। একটা কথা বারবার মাথায় ভেসে বেড়াতে লাগলো, তারা যদি প্রতারক হয় আপনারা তার চাইতে বড় প্রতারক। তারা মাইয়ার বিয়ার কথা গোপন রাইখা বিয়া দিছে। আর আপনি ঘরে বউ রাইখা আর একটা মাইয়ার লগে ইটিশ-পিটিশ করতাছেন। এই একটা বাক্য যেন রূপকের সমস্ত সত্তাকে নাড়িয়ে দিয়ে যাচ্ছে। সত্যিই তো। সে নিজেও তো একজন প্রতারক। সে মৌসুমীর প্ররোচনায় পড়ে তার সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলছিল। অথচ নিজে বিবাহিত। তবে রূপকের ধারণা ছিল মৌসুমী জেনেশুনে তার কাছে এগিয়ে আসতে চাইছ। তাই রূপক নিজে থেকে কখনো স্ত্রীর কথা তোলেনি। মৌসুমির প্রতি তার কোন দূর্বলতা নেই। ক্ষনিকের ভালোলাগা, সে কেবল মৌসুমীর কথায় তাল মিলিয়ে যাচ্ছিল। তবুও তো এটা প্রতারণা। মৌসুমীর সঙ্গে প্রতারণা। তৎক্ষণাৎ স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে পড়ল রূপক। হঠাৎ তার মাথায় একটা কথা জেগে উঠলো, চিত্রার সঙ্গেও প্রতারণা করছিল সে!
ঘন অন্ধকারের মাঝে রাস্তায় দাঁড়িয়ে নিজেকে তার ভীষণ অপরাধী বলে মনে হল। চিত্রা না হয় অন্যায় করে ফেলেছে। সত্য গোপন করে হয়তো সে অপরাধী। কিন্তু তাই বলে চিত্রাকে ঠকিয়ে অন্য একটা মেয়ের সঙ্গে নিয়মিত যোগাযোগ রাখাটা অন্যায়। সে নিজেও তো চিত্রার সঙ্গে প্রতারণা করল। নিজের দিকে তাকাতে ঘৃনা হচ্ছিল রূপকের। মৌসুমিকে বিয়ে করা কিংবা দ্বিতীয় বিয়ে নিয়ে রূপকের মাথায় কিছু আসেনি। তবে কিছুদিন তার ভেতর যেন অন্য কেউ এসে ভর করেছিল। স্রোতে গা ভাসিয়ে দিয়ে সে নিজেকে মেলে দিয়েছিল।
রূপক ঘরে ফিরল না। অনেকটা সময় বাড়ির বাইরে বসে রইল। ঘন অন্ধকারে বসে বসে তার অনুশোচনা হচ্ছিল। কিভাবে সে এতটা প্রতারক হতে পারে সেই যন্ত্রণা দগ্ধ করছিল তাকে। যখন অনেক রাত বেড়ে গেল তখন ঘরে ফিরল সে। লাইট জ্বালিয়ে দেখল চিত্রা ঘুমিয়ে পড়েছে। অনেকদিন সে চিত্রার দিকে তাকায় না। আজ এক মুহূর্তের জন্য তাকাতেই তার মনে হলো চিত্রা একদম শুকিয়ে কাঠ হয়ে গেছে। চোখের নিচটা হয়ে গেছে অনেক কালো। গায়ের রং তো আগের থেকে অনেক চাপা হয়েছে। রোগা পটকা শরীরের মাঝে ছোট্ট একটা পেট উঁকি দিচ্ছে। এই পেটে তার সন্তান আছে। সন্তানের জন্য হলেও চিত্রার এখন ঠিকমতো খাওয়া-দাওয়া করা উচিত। অথচ চিত্রা কি খায় না খায় রূপক সেসব কখনো খেয়াল করেনা। নিশ্চয়ই খাওয়া-দাওয়া করে না চিত্রা। অবহেলা অনাদরে মেয়েটার চেহারাটা শেষ। তার সন্তানও হয়তো ঠিক ভাবে বেড়ে উঠছে না। রূপকের আজ খুব মানসিক পীড়া হচ্ছে। সে নিজেও ভাত খেতে ভুলে গেল। অনেক রাত অব্দি বিছানায় শুয়ে এপাশ ওপাশ করল। ঘুম এলো না তার।
পরদিন সকালে জোসনা বেগম রূপককে বললেন, কাল মৌসুমী আর ওর মা আইছিল। ঘর দেইখা তোর অনেক প্রশংসা করছে। মৌসুমির মা অনেকটাই রাজি। কাইল সব কইয়া দিছি। এখন তুই মৌসুমীর লগে বেশি বেশি কইরা কথা কবি। তাইলে দেখবি মাইয়া তোর জন্য পাগল হইয়া যাইবো । তুই বউ ছাইরা দিলেই ওরে ঘরে তুলতে পারবি।
রূপক স্থির গলায় জোসনাকে বলল, এতদিন যা করছো আমি কিছু কই নাই। এখন একটু বেশি হইয়া যাইতাছে। তুমি আর ওদের বাড়িত যাইবা না।
কেন যামু না?
আমি যাইতে মানা করছি। আর কোনদিনও যাওয়ার দরকার নাই।
মুখটা অন্ধকার করে ফেললো জোসনা বেগম। দাঁতে দাঁত চেপে দাঁড়িয়ে রইলেন।
রূপক বাড়ি থেকে বের হওয়ার সময় বলল, আর একখান কথা, চিত্রারে একটু ভালোমতো খাওন দিও।
আজ নিশ্চিত পাঠকদের মনে কিঞ্চিৎ সুখ সুখ লাগবে। দেখি সুখের মাত্র মন্তব্যে কতটুকু প্রকাশ পায়।
চলবে..