দ্বিতীয় স্ত্রী,১পর্ব
লেখাঃ সাদিয়া ইসলাম কেয়া
দ্বিতীয় স্ত্রী হিসেবে হিমেলের ঘরে এসে প্রথম দিনেই হিমেলের থাপ্পড় খেয়ে, এক হাতে নিজের গাল চেপে ধরে ফ্যালফ্যাল করে হিমেলের দিকে তাকিয়ে আছে নুপুর। স্বামীর ঘরে এসে প্রথম দিনেই এমন পরিস্থিতির কথা কোনো মেয়ে কল্পনা’ও করতে পারেনা।
শোকেসের ওপর রাখা ফুলদানিটা বেখেয়ালে নুপুরের হাতে লেগে নিচে পড়ে ভেঙে যায়, এটাই থাপ্পড় খাবার কারণ।
এই ফুলদানিটা হিমেলের প্রথম স্ত্রী নীলার স্মৃতিচিহ্ন হিসেবে আগলে রেখেছে হিমেল, সেই স্মৃতিচিহ্ন চোখের সামনে এভাবে ভেঙে টুকরো টুকরো হয়ে যেতে দেখে হিমেল তার রাগ কন্ট্রোল করতে পারেনি। কিন্তু হিমেলের সদ্য বিয়ে করা দ্বিতীয় স্ত্রী তো আর জানেনা এই কথা; সে ভাবছে স্বামীর বাড়িতে এসেই সামান্য একটা ফুলদানি ভাঙ্গার অপরাধে থাপ্পড় খেতে হলো! বউয়ের চেয়ে ফুলদানি হিমেলের কাছে দামী হয়ে গেল?
হিমেল কড়া মেজাজে নুপুরকে বললো, ‘এবাড়িতে থাকতে হলে চোখ, কান খোলা রেখে চলতে হবে বলে দিলাম, দ্বিতীয় বার এমন হলে ভালো হবেনা কিন্তু বলে দিলাম, মনে থাকে যেন।’
নুপুরের মেজাজটা এবার টগবগ করে জ্বলে উঠলো, দু’পা সামনে এগিয়ে হিমেলের সামনে দাড়িয়ে টেনে হিমেলের গালে একটা থাপ্পড় দিয়ে বললো, ‘ আপনার হাতে থাপ্পড় খেয়ে ভেবেছিলাম চুপচাপ হজম করে নেবো। কিন্তু থাপ্পড় দেবার পরে এই যে বাড়তি কথাগুলো বললেন এর জন্যই থাপ্পড় ফিরিয়ে দিয়ে আপনার কথাগুলো মেনে চলার সিদ্ধান্ত নিলাম। থাপ্পড় মারবেন, আবার বকাঝকা করবেন, আমি চুপচাপ হজম করে নেবো, এটা তো হয়না। এতো ভাত তো দুধ দিয়ে খাওয়ানো যায়না।’
এবার অবাক হবার পালা হিমেলের, অবাক হয়ে নুপুরের দিকে ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে হিমেল ভাবছে– এ কার পাল্লায় পড়লাম রে বাবা, কপালে দূর্গতির আগাম আভাস, দ্বিতীয় বিয়ে করে জীবনে নতুন করে দুর্যোগ ডেকে আনলাম নাকি!
মেঝেতে ছড়িয়ে থাকা ফুলদানির টুকরোগুলো ঝাড়ু দিয়ে একত্র করে তুলে বাইরে ফেলে নুপুর বললো, ‘ এই দিনে প্রতিটি মেয়ের কল্পনা জুড়ে থাকে স্বামীর আদর, সোহাগ। আর আমার কপালে কিনা থাপ্পড়! একটা ফুলদানি নতুন স্ত্রী চেয়ে যদি দামী হয়, তাহলে বিয়ে করার কী দরকার ছিল, ফুলদানি নিয়ে বাকি জীবন সন্যাসী হয়ে কাটালেই পারতেন। ’
হিমেল আমতা আমতা করে বললো, ‘ ইয়ে মানে…।’
: ইয়ে মানে কী? আপনি কি মানুষ নাকি অন্যকিছু!
: আসলে ফুলদানিটা…
: কী? ফুলদানিটা মহারাজ কৃষ্ণচন্দ্র উপহার দিয়েছিল নাকি যে ভুল বসত ভেঙে গেলেও বউকে মারতে হবে!
: আসলে রাগ হয়েছিল খুব।
: এসব বদমেজাজ বিক্রি করে বাদাম খান বলে দিলাম, আমি কিন্তু অন্যরকম। কেউ ভালোবাসা দিলে ডবল ভালোবাসা দেই, আবার কেউ আঙ্গুল তুললে আঙ্গুলের এমন অবস্থা করি, আঙুল থাকবে কিন্তু ভেতরের হাড্ডি পাউডার হয়ে যাবে।
: বাপরে, অদ্ভুত তো তুমি।
: এখনও অদ্ভুত আছি, ফের কোনদিন গায়ে হাত তুললে অদ বাদ দিয়ে শুধু ভূত হয়ে ঘাড় মটকে দেবো বলে দিলাম।
: বেশি বাড়াবাড়ি করলে ভালো হবেনা কিন্তু নুপুর।
: বাহ! ভয় দেখাচ্ছেন? আসলে কি জানেন, যখন থেকে বুঝতে শিখেছি তখন থেকেই দেখে আসছি সংসারে অভাব অনটন, ছোটবেলায় মাকে দেখেছি অন্যের বাড়িতে কাজ করে বাবার কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে সংসারের ঘানি টানতে। জীবনের মানেটা আমার কাছে পরিস্কার, পরিস্থিতি অনুযায়ী জীবনকে নিয়ন্ত্রণ করার ক্ষমতা আমার আছে।
: এগুলো বলার কি দরকার ছিল নুপুর।
: অবশ্যই আছে, আজ গরীব বলে সবকিছু জেনেশুনে মা-বাবার ইচ্ছে অনুযায়ী আপনার ঘরে এলাম, প্রতিটি মেয়েরই একটা স্বপ্ন থাকে, আমার স্বপ্নটা পরিস্থিতির কাছে বিসর্জন দিলাম না হয়, তাই বলে স্বামীর ভালোবাসা পাবোনা এমনটা আশা করিনি।
: আসলে ঐ ফুলদানিটায় আমার প্রথম স্ত্রী নীলার স্মৃতি জড়িয়ে আছে নুপুর।
: এমন নয় যে আপনার প্রথম স্ত্রী নীলা মরে গেছে, সে আপনাকে ফেলে চলে গেছে, তার স্মৃতিচিহ্ন রেখে কি হবে, দেখে দেখে শোক পালন করবেন।
নুপুর এ কথা বলায় ভীষণ ক্ষেপে গিয়ে হিমেল নুপুরকে থাপ্পড় মারার উদ্দেশ্যে হাত উচু করতেই নুপুর খপ করে হিমেলের হাত ধরে ফেলে বললো, ‘ এতক্ষণ কী বলেছিলাম মনে নেই? কথায় কথায় গায়ে হাত তুললে ভালো হবেনা বলে দিলাম, কি ভেবেছেন আপনি, আমি গরীব বলে সমস্ত অত্যাচার সয়ে এখানে থেকে যাবো, তা মোটেই না, খাইয়ে পড়িয়ে মা-বাবা এত বড়ো যখন করতে পেরেছে, এখন আর ভয় কিসের। প্রয়োজনে নিজে কাজ করে খাবো। প্রত্যেকটা মানুষের নিজস্ব ব্যক্তিত্ব থাকে মনে রাখবেন কথাটা।
: তোমাকে আমি নিজের ইচ্ছায় বিয়ে করিনি, পারিবারিক চাপে দ্বিতীয় বিয়ে করতে বাধ্য হয়েছি, কথাটা মনে রাখবে।
: ও আচ্ছা, তার মানে স্ত্রী হিসেবে মেনে নিতে পারেননি তাই?
: হ্যাঁ একদম।
নুপুর বিদ্যুৎ গতিতে উঠে গিয়ে শ্বশুর শ্বাশুড়ি সহ দেবর রায়হান এবং দাদি শ্বাশুড়িকে ডেকে এনে সবার উদ্দেশ্যে বলল, ‘ একটা মানুষ বিয়ে করবে না, আপনারা জোর করে তাকে দ্বিতীয় বিয়ে করতে বাধ্য করলেন, এখন সে আমাকে স্ত্রী হিসেবে মেনে নিতে পারছে না, তাহলে কি এখন আমি হাওয়ার সাথে সংসার করবো?’
নুপুরের শ্বশুর হিমেলের উদ্দেশ্যে বললো, ‘ এগুলো তোমার কাছে আশা করিনা হিমেল, দ্বিতীয় বার নুপুর যেন অভিযোগ করার মতো কারণ না পায়।’
কথা শেষে নুপুরের শ্বশুর শ্বাশুড়ি চলে গেল। দাদি শ্বাশুড়ি এগিয়ে এসে নুপুরের মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বললো, ‘ আসলে হিমেল এখনও নীলাকে ভুলতে পারেনি তো, ধীরে ধীরে সব ঠিক হয়ে যাবে।’
নুপুর বললো, ‘ নীলা নেই কিন্তু রোজ রোজ নীলাকে নিয়ে আমি কেন যন্ত্রণা ভোগ করবো। তারচেয়ে একদিন নীলার স্মৃতির শ্রাদ্ধ করে ওসব স্মৃতি-মিতি মেমরি থেকে ডিলিট করে দিলেই তো হয়।’
নীলার কথা শুনে দেবর রায়হান হেসে উঠে হাততালি দিয়ে বললো, ‘ ভাবী এটা কিন্তু দারুণ বলেছো, স্মৃতির শ্রাদ্ধ।’
হিমেল চোখ গরম দিয়ে রায়হানকে থামিয়ে দিলো।
দাদি শ্বাশুড়ি বললো, ‘ শোন নুপুর, তোর দাদাভাই প্রথম প্রথম খুব ঘাড়ত্যাড়া ছিল, পরে ধীরে ধীরে আমি টাইট দিয়ে লাইনে এনেছি। তুইও একটু ধৈর্য ধর।
নুপুর বললো, ‘ আমার আবার ধৈর্য কম দাদি, আমি টাইট দিতে গেলে তোমার নাতির ঘাড় ভাঙতেও পারে বলা যায়না। ’
নুপুরের কথা শুনে রায়হান এবং দাদি মুখ চেপে হেসে ঘর থেকে বেরিয়ে গেল।
একটু পরেই দাদী আবার ফিরে এসে দরজার দাড়িয়ে নুপুরকে বললো, ‘ দরজা বন্ধ করে আমার নাতিকে ভালো করে টাইট দিয়ে দে তবে।’
নুপুর মুচকি হেসে বললো, ‘ দাদি, বয়সের কালে তুমিও কম ছিলেনা বুঝতে পারলাম।’
দাদি মিষ্টি হেসে চলে গেল।
দাদি চলে যেতেই হিমেল গিয়ে দরজা বন্ধ করে নুপুরকে বললো, ‘ একটু বেশিই বাড়াবাড়ি হয়ে গেল বলে দিলাম।’
: বাড়াবাড়ি মানে কী? সত্যটা সবার জানা দরকার। আমার অধিকার আমাকেই আদায় করে নিতে হবে।
: হাহ, যাকে মন থেকে মানতে পারলাম না, তার আবার অধিকার।
: আপনার এখানে আমি খাবার জন্য নয়, দামী অলঙ্কার পেতে নয়, আপনার ভালোবাসা পেতে এসেছি, এবং সংসার সাজাতে এসেছি, যতদিন এই বাড়িতে আছি ততদিন মিশন বহাল থাকবে।
: তোমার ইচ্ছে আর পূর্ণ হচ্ছে না জেনে রাখো।
নুপুর গিয়ে খাটে হিমেলের পাশে বসে মিষ্টি করে বললো, ‘ সেটা পরে দেখা যাবে, রাত অনেক হলো চলুন শুয়ে পড়ি, বাদবাকি ঝগড়া কালকে হবে, এবার ঘুমাই চলেন।’
নুপুর আলতো করে হিমেলের কাঁধে হাত রাখতেই নুপুরকে জোরে ধাক্কা দিয়ে ফেলে দিয়ে হিমেল বললো, ‘ তোর সাথে এক ঘরে থাকা আমার পক্ষে অসম্ভব।’
নুপুরের দুই চোখে জল টলমল করে উঠলো।
নুপুর কি পারবে হিমেলের মন জয় করতে? নাকি একবুক যন্ত্রণা নিয়ে বিদায় নিতে হবে প্রথম স্বামী এবং সংসার ছেড়ে?
চলবে…