দ্বিতীয় স্ত্রী,২য় পর্ব

0
4896

দ্বিতীয় স্ত্রী,২য় পর্ব
লেখাঃ সাদিয়া ইসলাম কেয়া।

চোখের জল মুছে উঠে দাড়িয়ে হিমেলের হাত ধরে টেনে নিয়ে রুমের বাইরে বের করে দিয়ে, ভেতর থেকে রুমের দরজা বন্ধ করে নুপুর বললো, ‘ আমার সাথে এক ঘরে থাকা যদি অসম্ভব হয়, তাহলে আপনি ঘরের বাইরে থাকেন।’

হিমেল দাড়িয়ে আছে রুমের সামনে। দাদি এসে হিমেলকে বললো, ‘ এবার বুঝলে বাছাধন, এই বনে বাঘ আছে; কী দরকার ছিল মেয়েটার সাথে গন্ডগোল বাঁধানোর।’

হিমেল শান্ত মেজাজে বললো, ‘ চুপ করো তো, আজকে তোমার রুমে ঘুমানো যাবে?’

: সর্বনাশ! ঘরে বউ থাকতে আমার রুমে ঘুমালে মহা বিপদ, বুড়ো বয়সে আমি কলঙ্কিত হতে চাইনা।

: এহ, বুড়ির ঢং কতো।

: শোন, শুধু আমার হৃদয় জুড়ে নয়, রুম, খাট-পালঙ্ক সবকিছু জুড়ে তোর দাদার স্থান যতদিন আমি বেচে আছি, সেখানে তোর যায়গা হবেনা বলে দিলাম।

: দাদি শুধু আজকের রাতটা।

: কোনো রাত না, সোস্যাল মিডিয়ার এই যুগে একবার যদি কলঙ্ক রটে ভাইরাল হয়ে যায় তবেই কেল্লা ফতে। চুপচাপ রুমের সামনে দাড়িয়ে থাকো।

: এভাবে কতক্ষণ দাড়িয়ে থাকবো!

: দাড়িয়ে দাড়িয়ে মশা মার, টাইমপাস হবে।

হিমেল ভেঙচি দিয়ে দাদিকে বললো, ‘ বুড়ি সময় আমারও আসবে।’

দাদি’ও ভেঙচি দিয়ে বললো, ‘ যখন আসবে তখন, এখন অসময়ে আমার সময় নষ্ট করিস না বদ।’

দাদি গিয়ে তার রুমে ঢুকে খটাস্ করে দরজা বন্ধ করে দিলো।

এদিকে কেঁদেকেটে ঘুমিয়ে পড়েছে নুপুর। প্রতিটা মেয়ের স্বপ্ন বিয়ের পরে স্বামীর সংসারে এসে স্বামী সহ সবাইকে নিয়ে সুখী একটি নতুন জীবন শুরু করার; স্বপ্নগুলো বাস্তবে পরিণত করার ব্যস্ততায় কাটবে সময়, স্বামী স্ত্রী মিলে ভবিষ্যত সাজানোর পরিকল্পনা। কিন্তু নুপুর স্বামীর সংসারে এসেই পড়েছে দ্বিধা-ধন্দে। আদৌও এ সংসারে টিকে থাকতে পারবে কিনা প্রতিটি মূহুর্তে সেই চিন্তা, স্বামীর ভালোবাসা, আদর সোহাগ সেটা তো পরের বিষয়। নুপুরের নিজের প্রতি আত্মবিশ্বাস খুব বেশি, সহজে কোনো বিষয়ে ভেঙে পড়ার মতো মেয়ে সে নয়। নিম্নবিত্ত পরিবারের মেয়ে বলেই বাস্তবতা, সময় এবং পরিস্থিতি সেভাবে গড়ে তুলেছে নুপুরকে। জীবনের এরকম পর্যায়ে বেশিরভাগ মেয়ে ভেঙে পড়ে, তাদের মধ্যে অনেকেই আত্মহত্যার সিদ্ধান্ত’ও নেয়; কিন্তু নুপুর জানে আত্মহত্যা কোনো সঠিক সমাধান নয়, জীবনে উত্থান পতন থাকবেই। আজ মেঘে ঢাকা আকাশটা কাল হয়তো রৌদ্রজ্বল থাকবে, আর বাঁচতে হবে সেই কালকের অপেক্ষায়। রাতের অন্ধকার শেষে ভোরের সূর্যোদয় আমাদের শিক্ষা দেয় যে– আধার শেষে আলো আসবেই। মোটকথা সমস্যার সমাধান বেঁচে থেকে করতে হবে।

হিমেল ঘন্টাখানেক রুমের সামনে দাড়িয়ে থেকে ছোট ভাই রায়হানের রুমের সামনে এসে দাড়ালো, রায়হানকে ডাকতেই ভেতর থেকে রায়হান সাড়া দিলো।

হিমেল বললো, ‘ রায়হান আজকে তোর রুমে ঘুমানো লাগবে আমার।’

রুমের ভেতর থেকে জবাব এলো, ‘ সিঙ্গেল খাটে ডবল নেয়া সম্ভব না, তুমি ডবল খাট ছেড়ে এখানে এলে কেন।’

: এত চালাকি করতে কে বলেছে তোকে, দরজা খোল।

: অসম্ভব, আমার যখন একলা ঘুমাতে ভয় করতো তখন তোমাকে কত বলেছি আমার সাথে ঘুমাতে, তুমি আসোনি, আর এখন আমার সুদিনে তোমার মতো বসন্তের কোকিলের দরকার নেই।

: তুই দরজা খুলবি কিনা বল।

রায়হান উঠে এসে দরজা খুলে দিলো, হিমেল রুমে ঢুকে রায়হানের খাটে শুয়ে পড়লো। পাশে শুয়ে রায়হান বললো, ‘ মানুষ গৃহ ত্যাগ করে, তুমি রুম ত্যাগ করে আমাকে প্যারা দিচ্ছো; পার্কের এক কোণে গিয়ে বসে রাত কাটালেই পারতে। নিরিবিলি শোক পালন করতা নীলার জন্য।’

: চুপ করবি তুই।

: কেন, চুপ করবো কেন, যে নীলা তোমাকে ছেড়ে চলে গেল, এবং এখনও সংসারে যে নীলার জন্য অশান্তি, সেই নীলাকে মনে রাখার কী দরকার, ভুলে যাও নীলাকে।

: অসম্ভব, নীলা আমার প্রথম স্ত্রী।

: আরে স্ত্রী ধুয়ে পানি খাবা যে প্রথম স্ত্রী, প্রথম স্ত্রী করো সারাক্ষণ!

: চুপ করবি তুই?

: না, তোমার দেখা উচিৎ কে তোমাকে ভালোবাসে, তোমাকে নিয়ে সুখী হতে চায়। প্রথম স্ত্রী, দ্বিতীয় স্ত্রী কোনো বিষয় না, বিষয় হলো কে তোমাকে ভালোবাসে সেটা।

: আরে সর্বনাশ, ভালোবাসার বিশেষজ্ঞ হয়ে গেলি নাকি, রুমে বসে এসব নিয়ে গবেষনা করা হয় বুঝি?

: ব্রো যেটা সত্য সেটা বলতে সমস্যা কি?

: আচ্ছা হইছে এবার চুপ করে ঘুমা।

হিমেল চোখ বন্ধ করে আছে, রায়হান মোবাইল বের করে পাবজি খেলা শুরু করলো, তারপর শুরু হলো– পেছনে এনিমি, গুলি কর গুলি কর, আমার বন্দুকের গুলি শেষ।

হিমেল কিছুক্ষণ কান চেপে ধরে ছিল, তারপর উঠে বসে রায়হানকে বললো, ‘ দুনিয়ায় এত এত ঠাডা পড়ে, তোর মোবাইলের ওপর একটা পড়তে পারেনা, অসহ্য একেবারে।’

রায়হান মোবাইল রেখে বললো, ‘ আমার রুমে আমি যা ইচ্ছা তাই করবো তুমি এসে আমাকে বিরক্ত করছো কেন বুঝলাম না!’

হিমেল উঠে রায়হানের রুম থেকে বেরিয়ে গিয়ে ড্রইং রুমের সোফায় গিয়ে শুয়ে পড়লো।

সকালে নুপুরের ডাকে ঘুম ভাঙলো হিমেলের। হিমেলের মেজাজ এমনিতেই বিগড়ে আছে, তার ওপর যায় জন্য মেজাজের এই অবস্থা তার ডাকে যদি কাচা ঘুম ভাঙে তাহলে কি অবস্থা হয় একবার ভাবুন।

নুপুর চায়ের কাপ হিমেলের দিকে বাড়িয়ে দিতেই, হিমেল কাপটা ধরে আছাড় দিতেই ফ্লোরে পড়ে টুকরো টুকরো হয়ে গেল কাপটা।

নুপুর অবাক হয়ে তাকিয়ে আছে হিমেলের দিকে। নুপুরের শ্বশুর মানে হিমেলের বাবা এসে নুপুরকে বললো, ‘ আমার চা কোথায় বৌমা?’

নুপুর আমতা আমতা করে বললো, ‘ আব্বা আমি একটু ব্যস্ত বলে আপনার ছেলের হাতে কাপটা দিয়েছিলাম আপনাকে গিয়ে দিতে, কিন্তু কাপটা উনি আছাড় দিয়ে ভেঙে ফেলেছে।’

এই কথা শুনে হিমেলের ভিরমি খাবার অবস্থা। বাবা চোখ লাল করে তাকিয়ে আছে হিমেলের দিকে। হিমেল আমতা আমতা করে নুপুরকে বললো, ‘ তার মানে চা আমার জন্য ছিলনা?’

নুপুর বললো, ‘ না, আমি বদমেজাজী লোকের জন্য চা বানাই না।’

বাবা হিমেলকে কড়া ভাবে বললো, ‘ অসভ্যতার একটা সীমা থাকা দরকার হিমেল, সময় থাকতে এসব বাদ দাও।’

হিমেল মাথা নিচু করে চুপচাপ বসে রইলো।

দাদির রুমের সামনে দিয়ে যাবার সময় দাদি টান মেরে নুপুরকে রুমে ঢুকিয়ে দরজা বন্ধ করে, নুপুরের গালে একটা চুমু দিয়ে বললো, ‘ প্ল্যান সাকসেসফুল, এভাবেই কলে কৌশলে হিমেলকে সায়েস্তা করতে হবে। তুই একদম মন খারাপ করবি না, কটা দিন ধৈর্য ধর, সবকিছু ঠিক হয়ে যাবে দেখবি।’

: সেই আশায় তো আছি দাদি।

: আরে পাগলি একটা ভালো তরকারি রান্না করতে গেলে সব ধরনের মশলার পরিমাণ মতো সংমিশ্রণ দরকার, ধর লবনে কম হলেই অথবা বেশি হলে তরকারির স্বাদ মাটি। তেমন দুঃখ, কষ্ট, আনন্দ, বেদনা ছাড়াও একটা জীবন হয়না পরিপাটি। শুধু সুখে থাকলে দুঃখের স্বাদটা অজানা রয়ে যায়, আবার শুধু দুঃখে থাকলে সুখের স্বাদ অজানা রয়ে যায়। জীবনে অল্প করে সবই দরকার।

: সবই ঠিক আছে দাদি, তবুও…

: তবুও কি, আমি আছি তোর সাথে, একদম মন খারাপ করবি না বলে দিলাম।

নুপুর মুচকি হেসে দাদির কপালে একটা চুমু দিয়ে বললো, ‘ এবাড়ির সকলের ভালোবাসা পেলাম, শুধু ঐ একটা মানুষের অবহেলায় এই সুখ পরিপূর্ণ হচ্ছে না, তুমি দোয়া করো দাদি, আমি যেন ঐ মানুষটার মন জয় করতে পারি।

চলবে…

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here