দ্বিতীয়_পুরুষ,অন্তিম পর্ব

0
719

#দ্বিতীয়_পুরুষ,অন্তিম পর্ব
#নীলাভ্র_জহির

জোসনা বেগমের মেজাজ উত্তপ্ত। রুপক তাকে নির্দেশ দিয়ে গেছে চিত্রাকে ভালোমতো খাবার দিতে। সে আপন মনে বিড়বিড় করে বলতে লাগল, আমি কি ওরে খাওন দেই না নাকি? জমিদারের বেটিরে কি আমি না খাওয়াইয়া রাখছি?
একটা বড় গামলায় পাতিলের সব ভাত ও তরকারি ঢেলে দিয়ে তিনি গামলাটা নিয়ে এসে চিত্রার ঘরের দরজায় রেখে চেঁচিয়ে বললেন, খাইয়া লও। আমার পোলার মাথাটা তো আগেই খাইছো। সেই জন্য তোমার কোন দোষ তার চোখে পড়ে না। তুমি তার আদরের সোহাগী বউ। তোমার লাইগা আইজ আমারে কথা শুনাইছে। মায়েরে কথা শুনাইছে। কত্ত সাহস হইয়া গ্যাছে পোলার। পোলাপাইন মানুষ কইরা কোন লাভ নাই।
চিত্রা দরজার কাছে এসে দাঁড়াল। ঘর্মাক্ত জোসনা বেগমের মুখ যেন বহ্নিশিখা।
তিনি বললেন, এখন আমার সামনে বইসা সবগুলি ভাত খাইবা। একটা দানাও যেন গামলার মধ্যে না থাকে। সব খাইতে না পারলে খবর আছে।

চিত্রা দেখল গামলা ভর্তি ভাত। অস্বস্তির সঙ্গে সে বলল, কি হইছে আম্মা?
– নতুন কইরা কিছু হওয়ার বাকি রাখছো। বিয়াইত্তা মাইয়া। চরিত্রের কোন ঠিক ঠিকানা নাই। আমার পুলাডারে কেমনে তুমি জাদু কইরা রাখছো।
– আম্মা আপনি এতদিন যা ইচ্ছা কইছেন আমি সহ্য করছি। কিন্তু আমার চরিত্র লইয়া কিছু কইবেন না।
– না, তুমি তো রাজা-বাদশার বেটি। তোমার চরিত্র নিয়ে কিছু কওন যাইবো না। তওবা তওবা। তোমার পা ধইরা সালাম করোন লাগবো। পাও দুইটা আগাইয়া দেও সালাম করি।
– এমন করতাছেন ক্যান কইবেন? আমি কি করছি?
– মহারানী কিছু করেন নাই। এখন ভাত খাইয়া আমারে উদ্ধার করেন।
– এতগুলো ভাত খামু ক্যামনে আমি?
– আমার পোলায় কইছে তোমারে বেশি কইরা খাওন দিতে। তাই বেশী কইরা দিতাছি।
চিত্রা চোখ বড়বড় করে তাকিয়ে রইল। জোসনা বেগমের আচরণ আজকাল বড্ড বেশি উদ্ভট হয়ে গেছে। একেবারেই সহ্য করতে পারছেন না তাকে। একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে চিত্রা বলল, আমারে আপনে পছন্দ করেন না সেইটা আমি জানি। আর কয়টা দিন সহ্য করেন। আপনেরা মা আর পোলা মিইলা মাইয়া পছন্দ কইরা ফেলছেন। আমি কোনো বাধা দিমু না। আমার প্যাটের বাচ্চাটারে জন্মাইতে দেন। তারপর আপনাগো মুক্তি দিয়া আমি চইলা যামু। তখন আপনের পছন্দের মাইয়ারে দিয়া তারে বিয়া দিয়েন।
– তুমি তো তারে যাদু-টোনা কইরা রাখছো। তোমার মতো মায়াবিনি বউ রাইখা সে আর কারো দিকে তাকাইবো? তার চোখ দুইটা তো তুমি কানা কইরা রাখছ।
– আপনার কথা কিছু বুঝবার পারতাছিনা। আমি ক্যান তার চোখ কানা কইরা রাখমু? আমি আপনার পুলারে কোন যাদু টোনা করি নাই।
– তোমার লগে তর্ক করার সময় আমার নাই। ভাতের গামলা রাইখা গেলাম। খাইয়া লইবা। সবকিছু খাইতেই তো আইছো।
জোসনা বেগম উঠে চলে গেলেন। ভাতের গামলা টেবিলের উপর তুলে রাখলো চিত্রা। মানসিক অত্যাচার দিন দিন বেড়েই চলছে। চিত্রা ভেবেছিল মা মরা মেয়েটা এ বাড়িতে এসে একজন মা পাবে। সুখ টুকু তার কপালে সয়নি। কিংবা হতে পারে সব মেয়ে মা হওয়ার ক্ষমতা রাখেনা। পৃথিবীর সবচেয়ে বড় সত্য, শাশুড়ি হলেই মা হওয়া যায়না।

সারাদিন দোকানে খুব বিমর্ষ অবস্থায় কাটাল রূপক। কিছুই ভালো লাগছে না। চিত্রার সঙ্গে তার এখন শতবর্ষের দূরত্ব। এই দূরত্ব চাইলেও ঘুচানো সম্ভব না। নিজেকে তার ভীষণ একা একা লাগছে। অসহায় মনে হচ্ছে। কোথায় গেলে একটু শান্তি পাবে সে?

অস্থিরতায় রূপক বারবার এদিক-সেদিক ছোটাছুটি করছিল। বাজারে দেখা হল মিস্ত্রিদের সঙ্গে। আগামীকাল থেকে তারা রং করার কাজ শুরু করবে। রংয়ের ব্যাপারে বিস্তারিত আলাপ আলোচনা করার এক পর্যায়ে রূপকের চোখের সামনে ভেসে উঠলো একটি নান্দনিক সুন্দর বাড়ি। মনটা তার ভালো হতে শুরু করল। একটা দৃশ্য কল্পনা করেই মুখে হাসি ফুটল তার। সে সমাধান পেয়ে গেছে।
মনে মনে ভাবল, নতুন ঘরে উঠবো। আমার বউডার লগে সব মিটমাট কইরা লই। সে যদি কোন ভুল কইরা থাকে তো করছে। মাইয়া হিসেবে চিত্রা খারাপ না। মৌসুমী কইলো এলাকার সবাই নাকি তার সুনাম করছে। অনেক ভদ্র একটা মাইয়া। সে ভুল করলে করছে। এখন তো সে আমার বউ। সে আমারে মন প্রাণ উজাড় কইরা ভালোবাসে। তার লগে সব মীমাংসা কইরা নেয়া উচিৎ আমার।
সমাধানের কথা ভেবেই রূপক মানসিক শান্তি পেলো। অযথা নিজেকে কষ্ট দিয়ে কি লাভ? সে চিত্রার সঙ্গে যে প্রতারণা করে চলছিল, তারও শাস্তি হওয়া উচিৎ। চিত্রা দোষী হলে সেও দোষী। সব ভুলে নতুন করে শুরু করতে হবে। মনে মনে হাসতে হাসতে রূপক বলল, নতুন কইরাই শুরু করমু। নতুন ঘরে নতুন রং। ঘরে নতুন একখান খাট বানামু। ওই খাটে বউরে লইয়া ঘুমামু৷ মেলাদিন হইয়া গেল বউটারে জরাইয়া ধরি না, সোহাগ করি না। আগে প্রত্যেকদিন রাতে বউরে জড়াইয়া ঘুমাইতাম। কতই না সুখের ছিল দিনগুলান! বউটা মনে অনেক কষ্ট পাইতাছে। নতুন খাটে শুইয়া তারে জরাইয়া ধইরা ঘুমাইলেই সব মীমাংসা হইয়া যাইবো। বউ আমার আশায় বইসা রইছে আমি জানি। আমি একবার তার কাছে গেলেই সব ঠিক হইয়া যাইবো।

সমাধান পেয়ে যেতেই রূপকের মনে হল সে আকাশের চাঁদ হাতে পেয়েছে। খুশি মনে হাঁটতে হাঁটতে সে গেল পাশের ফার্নিচারের দোকানে। একটা বইতে বিভিন্ন ডিজাইন করা খাটের নকশা থেকে সে একটা নকশা পছন্দ করলো। তার মায়ের ঘরের খাটের জন্য পছন্দ করলো আরেকটা নকশা। মনে মনে ঠিক করল সেগুন কাঠের খাট বানাবে। আর ডাইনিং টেবিল বানাবে বাগানের মেহগনি গাছের কাঠ দিয়ে। ওই টেবিলে সে তার ছোট্ট ছেলেকে নিয়ে বসে ভাত খাবে। নিজের বসার জন্য রাজকীয় একটা চেয়ার বানাতে হবে। আহা, এ যেন স্বপ্ন দৃশ্য। ভাবতেই তার মনটা বড্ড ফুরফুরে হয়ে উঠলো।

ফুরফুরে মন নিয়েই বাড়ি ফিরল রূপক। তবে মনেমনে ভেবে রেখেছে এখনই চিত্রাকে কিছু বুঝতে দেবে না। আর দিন কয়েকের অপেক্ষা। তারপর নতুন ঘরে উঠেই সবকিছুর নতুন সূচনা হবে। এখন চিত্রাকে বুঝতে দিলে সেদিনের আনন্দটা মাটি হয়ে যাবে। এসব সাত পাঁচ ভেবে রূপক বাড়ি ফিরল।
জোসনা বেগমকে দেখতে না পেয়ে সে গম্ভীর মুখে চিত্রাকে বলল, খাওন দেও।
চিত্রা ভাতের গামলা নিয়ে এসে রূপকের সামনে রেখে বলল, আমি কি গরু?নাকি রাস্তার কুত্তা? রাস্তার কুত্তার লগেও মানুষ এমন করে না।
– কি হইছে?
– আপনে আম্মারে কইছেন আমারে বেশি কইরা খাওন দিতে। উনি এইটা আমার ঘরে দিয়া গেছে। আর কইছে একটা দানাও যেন পইড়া না থাকে। সব খাইয়া তারে উদ্ধার করতে কইছে। আমি এক গামলা ভাত খামু? আমারে উনি দুই চক্ষে সহ্য করতে পারে না। তার ওপর আপনে ক্যান ওনারে কইছেন আমারে বেশি কইরা খাওন দিতে? আপনেরা আমারে এতিম ভাইবা দয়া দেখাইতাছেন।
রূপকের ফুরফুরে মনটা মুহুর্তেই বিষাদে ভরে গেল। সে বলল, চুপ করো। অল্প দুইটা খাইয়া ভাতের গামলা আম্মার ঘরে রাইখা আসলেই হইত।
– সহজ সমাধান দিলেন। দুনিয়াটা এত সহজ হইলে কামই হইত। আমার লগে উনি সারাক্ষণ কুত্তার মত করেন। কিন্তু আপনে ক্যান কইছেন আমারে খাওন দিতে? আমার জন্য তো আপনার কোন ভালবাসা মহব্বত কিছুই নাই। আমার তো খাওন দরকার নাই। এতগুলা দিন সবাই সবার মত খাইয়া লইছেন। আমি মানুষটা খাইছি না মরছি কেউ তো খোঁজ নেন নাই। আইজ এত দরদ দেখাইছেন ক্যান?

রূপক বেশ অস্বস্তিতে পড়ে গেল। পরিস্থিতি সামাল দিতে সে বলল, মা কই?
– জানিনা।
গম্ভীর মুখে দাঁড়িয়ে রইল চিত্রা। তার অন্ধকার মুখখানা রূপকের কাছে কালবৈশাখী ঝড়ের আকাশের মতো লাগছে। এই আকাশে ফু দিয়ে স্বচ্ছ ধবধবে সাদা করে দিতে ইচ্ছে করছে। হঠাৎ রূপকের মনে হল, তার বউটা ভীষণ সুন্দরী। রাগ করে গাল ফুলিয়ে থাকলেও তাকে অসম্ভব সুন্দর দেখায়।
রূপক কিছু একটা বলতে গিয়েও চুপ করে রইলো। মনে মনে ভাবল, এখন কিছু বলবো না। বাড়ির রং করা শেষ হোক। নতুন খাট ঘরে উঠবে। তারপর বউয়ের সঙ্গে সব ঝগড়া মিটমাট করে নেবে সে। তাই নির্বিকার ভঙ্গিতে সে কেবল চিত্রার দিকে তাকিয়ে রইল।
রূপকের জন্য খাবার বেড়ে দিলো চিত্রা। রূপকের জিজ্ঞেস করতে ইচ্ছে করছিল তুমি খাও নাই? কিন্তু সংকোচে সেটা জিজ্ঞেস করতে পারলো না। এতদিনের জমানো ঝগড়া হুট করেই মিলনে পর্ববসিত করাটা অত সহজ নয়। লজ্জা করছে। ক্ষমা চাইবে কিভাবে সেটা ভেবে রূপক মাথা নিচু করে বসে রইল। চিত্রা ভাতের প্লেট এগিয়ে দিয়ে স্থির হয়ে যায়।
রূপক চুপচাপ ভাত খেতে শুরু করে। বুক ফেটে কান্না আসছিল চিত্রার। একটা মানুষ এত স্বার্থপর কি করে হতে পারে? তাকে একটি বারের জন্যও খেতে বসতে বলছে না।
চিত্রা অভিমানের সুরে বলল, আমারে লইয়া টেনশন কইরেন না। আপনি ওই মাইয়ারে বিয়া করতে পারেন। আমি কোন ঝামেলা করমু না।
রূপক নির্বিকার ভঙ্গিতে ভাত খাচ্ছে। চিত্রার চোখে জল চলে এলো। সে বলল, আম্মা ঐ মাইয়ারে খুবই পছন্দ করেন। আমারে উনি একদমই সহ্য করতে পারতেছেন না। ঘরের রংটা হইয়া গেলেই আপনি ওই মাইয়ার ঘরে তুলেন। আমারে নিয়া ভাবতে হইব না। যতদিন আমার পোলা দুনিয়াতে আসে নাই আমি বাপের বাড়ি গিয়া থাকব।
রূপক মাথা তুলে বলল, বিয়ে করার অনুমতি দিতাছো?
চিত্রার বুক ফেটে যাচ্ছিল কষ্টে। তবুও শত কষ্টে সে বুকে পাথর চেপে বললো, হ অনুমতি দিলাম। বিয়া কইরা আপনি সুখী হন। আপনার মাও সুখী হোক । আমি বাপের বাড়িত চইলা যাই। আপনার পোলা হইয়া গেলে তারে পাঠাইয়া দিমু।
– তুমি আর আইবা না ?
চিত্রা অন্যদিকে তাকিয়ে চোখের জল লুকালো, না। আর আইসা কি হইব? আমি বান্দি হইয়া পইড়া থাকতে চাই না।
– বাপের বাড়িতে থাকবা আজীবন?
-সেইটা নিয়া আপনার ভাবতে হইব না। আপনে আমারে ছাইড়া দেন। আমি তো খারাপ মাইয়া। বেইমান। খারাপ মাইয়াগো থাকার জায়গার অভাব হয় না।
কথাটা বলেই চিত্রা দৌড়ে নিজের ঘরে চলে এলো। কারণ কিছুতেই আর নিজের কান্না সংবরণ করা যাচ্ছিল না। এই অশ্রু সে রূপক’কে দেখাতে চায় না।

কান্নার পালা একসময় শেষ হলো। চিত্রা তার সিদ্ধান্ত স্থির করে ফেলেছে। আর অপমানিতে হতে চায় না সে। শাড়ির আঁচলে মুখ মুছল চিত্রা। তারপর পাশের বাড়ির সাবিনার কাছে এসে শিমুলকে কল দিলো। ওর ধরা গলা শুনেই শিমুল জানতে চাইলো, কি হইছে ভাবী?
– তুমি তো আমার ভাই হও। বইনের একটা উপকার করবা?
– কন ভাবী। আপনের জন্য কিছু করতে পারলে জীবনটা সার্থক হইয়া যাইবো।
– আগে কথা দেও এই কথা তুমি কাউরে কইবা না। তোমার বউরেও না।
অগত্যা বাধ্য হয়েই শিমুল চিত্রাকে কথা দিলো, আচ্ছা কাউরে কমু না। আপনে কন কি উপকার করতে হইব?
– আমার মনে হয় সংসারটা টিকবো না।
– কি কন ভাবী? আপনের মতো ভালা একজন মাইয়ার..
– সবই কপাল রে ভাই। তুমি খালি এই বইনের একটা উপকার কইরো। একদিন কইছিলা তোমার ওইখানে পোলা মাইয়া সবাই কামের জন্য যায়?
– হ।
– আমারে একখান কাম জোগাড় কইরা দিতে পারবা? তুমি না আমার ভাই হও?
– ভাবী এগুলা আপনে কি কন? আমি আইজ ভাইয়ের লগে কথা কমু। আপনের সংসার টিকবো না ক্যান? কি হইছে আমারে কন।
– এত কথা কওনের সময় নাই। আমার ডেলিভারি হইয়া গেলেই আমি ঢাকায় চইলা যামু। তুমি আমারে একটু ঠাই দিও ভাই। এই বোইনটারে একটু ঠাই দিও।
– আমরা এই সপ্তাহেই গেরামে আসতাছি ভাবী। আইসা আপনের কাছ থাইকা সব কথা শুনমু।
– দেখা হইবো না আমাগো। আমি ঠিক করছি তোমার ভাইয়ের নতুন বিল্ডিং ঘরে আমি উঠমু না। যেদিন রং করা শ্যাষ হইবো, আমি ওইদিনই বাপের বাড়িত চইলা যামু। ওর নতুন ঘর দিছে এক মাইয়ার জন্য। মাইয়ার নাম মৌসুমী। আমার আম্মা ওই মাইয়ারেই ঘরে তুলবো। আমি একটা রাইতও ওর নতুন ঘরে থাকমু না।
– ভাবী মাথা ঠাণ্ডা করেন।
– অনেক সহ্য করছি রে ভাই। আর সহ্য হয় না। বাপের বাড়ি থাইকা আর আসমু না। পোলা হইলে পাঠাইয়া দিমু। আমি চইলা যামু ঢাকায়। তুমি আমারে একটু ঠাই দিবা ভাই?
– আচ্ছা ভাবী আপনে চিন্তা কইরেন না। আপনের কথা শুইনা আমার মাথা ঘুইরা গেল। যাই কইরেন ভাবী, চিন্তা ভাবনা কইরা কইরেন।
চিত্রা একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলল, বাচাইলা রে ভাই। এই বোইনটার জন্য দোয়া কইরো। দরকার হইলে তোমারে আমি কল দিমু। কল ধইরো। রুবিনারে ভালো রাইখো। ওর কপালটা যেন আমার মতো না হয় সেই দোয়া করি।
– ভাবী আমি রুবিনারে কথাটা কইতে চাই। কি হইছে আপনেগো শুনতে চাই।
– বাড়ি আইলেই জানতে পারবা। তয় আমারে ভুল বুইঝো না ভাই। তোমার এই বোইনটা অনেক দুঃখী।

বাড়ির রং করা শেষ। আকাশী, হালকা গোলাপী রংয়ে উজ্জ্বল হয়ে উঠেছে রূপকদের নতুন বাড়িটা। চকচক করছে অসংখ্য পুরনো টিনের বাড়ির মাঝখানে। গাছপালায় ঘেরা বাড়িটা দেখলে যে কারও ঈর্ষা জাগবে। রংয়ের ঘ্রাণ এখনো ফুরায় নি। রূপকের মা মেয়ে ও জামাইকে দাওয়াত করেছেন। বাড়িতে মিলাদ দিয়ে এতিম মিসকিনদের খাইয়ে তারপর নতুন ঘরে উঠবেন তারা। এদিকে ধানের ক্ষেতে সোনালী হয়ে ওঠা ধানও কাটার সময় হয়ে গেছে। দু একদিনের মধ্যেই উঠানে ধান উঠবে। নতুন ধানের গন্ধে ম ম করবে পুরো বাড়ি।
রূপক একটা নতুন খাট এনে ঘরে তুললো। সেগুন কাঠ দিয়ে বানানো বক্স খাট। তার ঘরটাকে এখন ভারী অপূর্ব দেখাচ্ছে। আগামীকাল রুবিনা ও শিমুল আসবে। বিকেলে মিলাদ হবে। রাতে নতুন ঘরে ঘুমাবে তারা। আগামীকাল চিত্রার সঙ্গে সব ঝামেলা মিটমাট করে নেবে। সারাদিন ধরে রূপক ভেবে চলেছে কীভাবে ক্ষমা চাইবে তার স্ত্রীর কাছে? এই বোকা বোকা স্বামীটা ক্ষমা চাওয়ার কোনো ভাষা জানে না। চিত্রাকে একবার জড়িয়ে ধরলেই হবে। তাহলেই আর কিছু বলতে হবেনা মুখ ফুটে।
দূর্ভাগা রূপক জানতেও পারবে না চিত্রা তাকে সেই সুযোগ দেবে না। এত অবহেলা, অত্যাচার সহ্য করতে করতে দেয়ালে পিঠ ঠেকে গেছে তার। চিত্রা সিদ্ধান্ত নিয়েছে আগামীকাল সকালেই সে এই বাড়ি ছেড়ে চলে যাবে বাপের বাড়িতে। সোহরাব উদ্দীনের ভাঙা বাড়িতেই কিছুদিন থাকতে হবে। যতদিন তার সোনামণি পৃথিবীর আলো না দেখছে, ততদিন। বাচ্চাটা দুনিয়াতে এলেই তাকে বাপের কাছে পাঠিয়ে দিয়ে সে নিজের মতো জীবন বেছে নেবে। কিন্তু আজকাল তার খুব ভয় হয়। সন্তানের মায়া খুব করে জাগে তার হৃদয়ে। এই সন্তানকে ছেড়ে কি করে থাকবে সে? নতুন মা তার এই কলিজার টুকরো সন্তানকে আদর স্নেহ করবে তো? সৎ মা কখনো নিজের মা হতে পারে না। তার সন্তানের ভাগ্যটাও তার মতো খারাপ হবে। এতিমের মতো বড় হবে সে-ও।
ঘুমানোর আগে চিত্রা রূপককে বলল, আমি কাইল বাপের বাড়িত চইলা যামু। আপনে যখন খুশি বিয়া করতে পারেন। ওই মৌসুমীরে ঘরে তুলেন। আমার কোনো আপত্তি নাই।
রূপক মুচকি হেসে বলল, আইচ্ছা ঠিক আছে।
– আপনে সত্যি সত্যি বিয়া করবেন?
রূপক দুষ্টুমি করে বলল, হ। তুমি আপত্তি না করলে বিয়া তো করাই যায়।
– আমি কাইল চইলা যামু।
– আমি রাইখা আসমু নে।
– রাইখা আসা লাগবো না।
চিত্রার গলা ধরে এলো। এত সহজেই তাকে চলে যেতে দিচ্ছে রূপক? কষ্টে চিত্রার দম বন্ধ হয়ে আসতে চাচ্ছে। রূপক বিয়ে করবে এ কথাটা তার মুখ থেকে শোনার চাইতে জঘন্য কিছু হতে পারেনা। বালিশ ভিজছে নোনা জলে। এতকিছুর পর চিত্রার কষ্ট হয় নিজের সন্তানের জন্য। এসব স্বার্থপর মানুষদের ভীড়ে সে নিজের সন্তানের ভবিষ্যত নষ্ট করে দিচ্ছে।
সারা রাত এপাশ ওপাশ করে দুর্ভাবনায় চিত্রার ঘুম এলো না। ভোররাতে সে সিদ্ধান্ত নিলো, রূপক আমারে ছাইড়া দিলেও আমি আমার বাচ্চাটারে ওরে দিমু না। ওরে লগে নিয়াই ঢাকায় যামু। যেইখানেই যামু, ও আমার লগেই থাকবো। ওরে আমি এতিম হইতে দিমু না। আমার মতো দুঃখে বড় হইতে দিমু না। অবশেষে এসব ভেবে স্বস্তির সঙ্গে ঘুম নেমে এলো চোখে।
ভোরের আলো ফুটছে সবেমাত্র। কোমরের পেছনে সুক্ষ্ম ব্যথা নিয়ে চিত্রার ঘুম ভেঙে গেল। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে ক্রমশ বাড়ছিল ব্যথার তীব্রতাও। চিত্রার আর বুঝতে বাকি রইল না এটা কীসের ব্যথা? তার সন্তানের পৃথিবীতে আসার সময় হয়েছে। কিন্তু তার যে আজকে বাড়ি চলে যাওয়ার কথা! এ বাড়িতে সন্তানের জন্ম হলে কিছুতেই তাকে সঙ্গে নেয়া যাবে না। রেখে যেতে হবে। ভাগ্য তাকে এ কোন পরীক্ষায় ফেলল?
কাঁদছে চিত্রা। প্রসব বেদনায় নয়, এই বাড়িতেই তার সন্তানকে রেখে যেতে হবে সেই ভাবনায়। জোসনা বেগম ছোটাছুটি করে ধাত্রী ডেকে আনলেন। উত্তেজনায় ছটফট করছে রূপক। আজকেই তারা নতুন ঘরে উঠবে, আর আজকেই তার সন্তান পৃথিবীর আলো দেখতে চলেছে! সে সত্যিই সৌভাগ্যবান। এ বছর ধানও হয়েছে ভালো।
ব্যথার তীব্রতায় চিত্রার চিৎকার শোনা যাচ্ছিল উঠান থেকে। জোসনা দরজায় গিয়ে বারবার বলছেন, আস্তে চিল্লাও। আমরাও পোলা মাইয়্যা জন্ম দিছি।
ঘর্মাক্ত চিত্রার কানে জোসনার গলা বিষের মতো লাগে। সে মুক্তি চায় এই যন্ত্রণা থেকে। এই বেদনা থেকে, শোক থেকে। তার ভেতর থেকে হু হু করে কান্না আসে।
রুবিনা ও শিমুল এসে পৌঁছেছে ততক্ষণে। ভাবী প্রসব বেদনায় ছটফট করছে শুনে রুবিনাও ছটফট করে। এদিক ওদিক ছুটে যায় আর আল্লাহকে ডাকে। কতক্ষণে ভাবীর কষ্ট দূর হবে!
ধাত্রী দরজা খুলে রক্তমাখা এসুকটা ছোট্ট শিশুকে কোলে নিয়ে বের হয়ে আসে। শিশুটির কান্না আকাশ কহ প্রতিধ্বনিত হয়। সদ্যজাত শিশুর মুখটা দেখেই রূপকের আত্মা ফেটে হু হু করে কান্না আসে। ওই পবিত্র শিশুটি তার নিজের সন্তান! এ যেন দুনিয়ার সবচাইতে সেরা সুখ। সন্তানের মুখ দেখার চাইতে সুখের আর কিছুই হতে পারে না।
বাচ্চাকে রেখে এক দৌড়ে চিত্রার কাছে ছুটে গেল রূপক। এমন পবিত্র সুখটুকু যে এনে দিয়েছে, তার পা ধরে ক্ষমা চাইবে। চিত্রাকে আর একমুহূর্তও দূরে রাখবে না। প্রয়োজনে হাত পা ধরে বলবে, বউ আমারে মাফ কইরা দেও। আর কোনোদিনও তোমারে কষ্ট দিমু না।

রূপক দৌড়ে এসে চিত্রার পাশে বসল। ক্লান্ত, ঘমার্ক্ত চিত্রার মুখে কোনো কষ্টের ছাপ নেই। সে সন্তান জন্ম দেয়ার আনন্দে আরাম করে ঘুমাচ্ছে। রূপক চিত্রাকে ডাক দিলো। ওর হাত ধরে নাড়া দিলো। কোনো সাড়া নেই। ধাত্রী এসে ধাক্কাধাক্কি করতে লাগল। খিঁচুনিতে মাইয়াডা খুব কষ্ট পাইছে- কথাটা শেষ করার আগেই তিনি বুঝে গেলেন, চিত্রা আর নেই। সন্তানকে ভূমিষ্ঠ করেই তার প্রাণপাখিটা বিদায় নিয়েছে এই স্বার্থপর পৃথিবী ছেড়ে।

রূপক স্থির হয়ে গেল, যেন পাথরের মূর্তি।
রুবিনার গগনবিদারী চিৎকারে আকাশ বাতাস কম্পিত হতে লাগল। পুরো গ্রামবাসী অবাক চোখে দেখল রুবিনার কান্না। কেউ কেউ বলে বসল, মা মরলেও কেউ এত কান্দে না!

সবাই চলে গেল যার যার মতো। লাশ দাফন হলো। বারান্দায় বসে ধরা গলায় রুবিনা বলে উঠল, সে যা করছে সেইটা তো মায়ের চাইতেও বেশি। আমার মা-ও আমার জন্য এইটা করতো না।
জোসনা বেগমের কাঁধে মাথা রেখে কাঁদতে কাঁদতে রুবিনা অকপটে স্বীকার করে তার কুকর্মের কথা। বলে, মা গো। ভাবী আমারে বাচাইছে শুধু না, সে আমাগো সম্মান বাচাইছে। এই কথাটা সে আমার ভাইরেও কয় নাই। এমন একটা মানুষ তুমি এই গেরামে আর একটাও পাইবা না।

স্থবির হয়ে যান জোসনা বেগম। যে মানুষটা তার পরিবারের সম্মান বাঁচানোর জন্য এতকিছু করেছে, তাকে অবহেলায় তিলে তিলে শেষ করে দিয়েছেন তিনি!

অনুশোচনার কড়াল গ্রাস আঁকড়ে ধরল জোসনা বেগমকে। কিছু পাপের প্রায়শ্চিত্ত সারাজীবন অনুশোচনা করলেও হয়তো শেষ হয়না। এটা হয়ত তেমনই একটা অন্যায়। কাঠের মতো স্তব্ধ হয়ে জোসনা বেগম রূপক’কে দেখেন। তার চোখ ফেটে অশ্রু গড়ায় না। কেবল আত্মা ফাটে।

রূপকের সমস্ত পৃথিবীটা টলছে, প্রিয়তমা স্ত্রী’র কাছে ক্ষমা চাওয়ার সুযোগটুকু পেলো না সে। ভেবেছিল নতুন ঘরে উঠে নতুন জীবন শুরু করবে তারা। এটা তো এক অর্থে নতুন জীবনই। চিত্রা নতুন জীবন পেলো, তাকেও দিয়ে গেল পাহাড়সম কষ্টের, অনুশোচনার একটা নতুন জীবন!

মাঠভর্তি সোনালী উজ্জ্বল ধান, নতুন রং করা বাড়ি, সেগুন কাঠের উজ্জ্বল খাট, বংশের নতুন প্রদীপ, সবকিছু বৃথা পড়ে রইল। সবই রইল, শুধু ম্লান হয়ে গেল ভেতরের শান্তি। এতকিছুর ভেতরেও সবকিছু জুড়ে শুন্যতা। জীবন সবসময় ক্ষমা চাওয়ার সুযোগ দেয় না।

>>শেষটায় কান্নায় আমার নিজেরই গলা ধরে আসছিলো। এমনটিই হচ্ছ। কেউ বেঁচে থাকে তবে ভেতরটা যাদের মরে যায়! বেঁচে থাকার ইচ্ছেরা মরে যায়।
পুরো গল্প জুড়ে সবাইকে বেশ অপেক্ষা আর অপেক্ষায় রেখেছিলাম। চিত্রা যেমন নিজে মুক্তি নিয়েছে তেমনই সবাইকে গল্পের অপেক্ষা থেকে মুক্তি দিলাম। এটা গল্প হলেও গল্প নয়। এটি আমাদের চারপাশে সমাজের হাজারটা চিত্রার মনে লুকিয়ে থাকা আর্তনাদ। প্রতিটি মেয়ের সংসার ভাঙার পেছনে আরেকটি মেয়ে কিংবা শাশুড়ির এমন দৃশ্য অদৃশ্য নির্যাতনের হাত থাকে।
বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই মেয়ে (মহিলারা) অন্য মেয়েদের শত্রু হয়।
যেখানে আবার শশুর নামক পুরুষটি থাকে হয় নির্বিকার নয়তো মেরুদন্ডহীন অথবা রূপক।
সকলের জন্য শুভকামনা, ভুলত্রুটি ক্ষমাসুন্দর দৃষ্টিতে দেখবেন।

আপনাদের অপেক্ষমান রাখা ক্ষুদে নীলাভ্র জহির

সমাপ্ত

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here