#দ্বিতীয়_পুরুষ,পর্ব ৩
_নীলাভ্র জহির
নতুন বউয়ের জন্য আকর্ষণ চুম্বকের আকর্ষণের চাইতেও দ্বিগুণ। নতুন বউ ব্যাপারটাই যেন অন্যরকম। আলাদা প্রাণ, আলাদা গন্ধ, আলাদা মানুষ। সবকিছুই নতুন। শুধু নতুন নয়, নতুন এবং সুন্দর। অদ্ভুতভাবে এই জিনিসগুলো খুব আকর্ষন করতে থাকে একজন পুরুষকে। রূপক নিজেও জানেনা সে কিসের আকর্ষনে কোন প্রয়োজন ছাড়া এখন চিত্রার কাছে এসেছে। প্রয়োজন ছাড়া বললে ভুল হবে। তার প্রয়োজন চিত্রাকে, ভীষণ প্রয়োজন।
চিত্রা লজ্জায় কুঁকড়ে আছে। জিজ্ঞেস করল, কিছু কইবেন।
হ,
কন।
তোমারে বড়ই সুন্দর লাগতাছে।
চিত্রা লজ্জায় লাল টকটকে হয়ে গেল। লোকটা এই কথাটা বলার জন্য তার কাছে এসেছে? হায়রে!
রূপক আমতা আমতা করে বলল, আমার পায়ের জুতা জোড়া পাইতেছিনা। তুমি কি আমার জুতা জোড়া দেখছ?
– খাটের নিচে দেখলেই পাইতেন।
বাইরে মেয়েদের ফিসফিস হাসির রোল পড়ে গেল। লজ্জায় রাঙা হয়ে উঠল চিত্রার মুখ। ঘোমটাটা বড় করে টেনে দিল সে। এই লাজরাঙ্গা মুখ সে রূপককেও দেখাতে চায় না।
রূপক বলল, আচ্ছা, গিয়া দেহি পাই কিনা।
– না পাইলে আবার দৌড়াইয়া আইসেন না।
আবারো শোনা গেল মেয়েদের ফিসফিসানি হাসি। ওরা নিশ্চয়ই দরজার কাছে কান পেতে দাঁড়িয়ে আছে। নববিবাহিত বড় বধূর ব্যক্তিগত কথা শোনার মত অন্যায়টা সবাই কেন করতে যায় চিত্রা জানেনা। রুপক তার আরও কাছে চলে এল। কিছু একটা বলতে চায়। কিন্তু কি বলবে বোধহয় খুঁজে পাচ্ছে না? চোখের দৃষ্টি এদিক-সেদিক ঘুরিয়ে আমতা আমতা করতে করতে সে ঘর থেকে বেরিয়ে গেল। মুখ টিপে হাসলো চিত্রা। তার লজ্জা করছে সত্যি কিন্তু এই লজ্জার ভিড়েও একটা জিনিস সে ঠিকই অনুভব করছে। মানুষটা এসে তাকে শুধু লজ্জা দেয় নি। তাকে দিয়ে গেছে একরাশ নতুন আনন্দ। ভীষণ সুখ অনুভূত হচ্ছে চিত্রার। এটার নাম প্রেমে পড়ার সুখ।
রুবিনা চিত্রাকে সুন্দর করে সাজিয়ে দিলো। লাল টকটকে শাড়ি, বাজারে জুয়েলের কসমেটিকের দোকান থেকে কেনা গলার হার , ঠোটে লাল টকটকে লিপিস্টিক, গালে ফেস পাউডার। চিত্রা জানে তাকে এখন খুব সুন্দর দেখাচ্ছে। সাজলে প্রত্যেকটা মেয়ের রূপ বহুগুণে বেড়ে যায়। তার সাজগোজ করতে ভালো লাগে। গত নয়টা মাস সে কখনো সাজেনি। সে ভেবেছিল তার জীবন থেকে সাজগোজ শব্দটি উঠে গেছে। কিন্তু আজ ননদের হাতে বধূর সাজে সাজতে পেয়ে নিজেকে জন্য বড় সৌভাগ্যবতী মনে হয় চিত্রার।
পুরো গ্রাম ভেঙে নতুন বউ দেখতে এসেছে। মহিলারা মুখে আঁচলে ঢেকে হাসছে। ছোট ছোট বাচ্চারা বউয়ের একদম মুখের কাছে এসে উপুড় হয়ে তাকে দেখে। কোন কোন মহিলা এগিয়ে এসে চিত্রার ঘোমটা টেনে চিত্রার চুল দেখে। কেউ কেউ সম্মুখে প্রশংসা করে বলে, রূপক সুন্দরী বউ পাইছে। কমলা সুন্দরী।
কেউবা তার লম্বা চুল দেখে বলে খায়রুন সুন্দরী। আবার কেউবা ফিসফিস করে তার বিরুদ্ধে দু-একটা কথা বলে। এই যেমন বউয়ের ভ্রু মোটা। চোখ দুইটা বড়। আরো কত কি? ফিসফিস করে বললেও সেসব কথা কানে আসে চিত্রার। বিয়ে বাড়ি মানেই যেন প্রশংসা এবং দুর্নামের একটা সমাবেশ।
ভীড় কমে গেল সকাল দশটা নাগাদ। সবাই যার যার মত বউ রেখে বাড়িতে ফিরে গেল। দুপুরবেলা আরও একবার গায়ে হলুদ হবে। এই গ্রামের বিয়ের রীতিতে দুইবার গায়ে হলুদ হয়। প্রথম গায়ে হলুদ কনেকে তার বাড়িতে তার আত্মীয় স্বজনরা মিলে দেয়। আর দ্বিতীয় গায়ে হলুদ শ্বশুর বাড়িতে স্বামীর সঙ্গে স্বামীর আত্মীয়-স্বজনদের দ্বারা দেয়া হয়। আজকে গায়ে হলুদ হবে দুপুরে। চিত্রার শাশুড়ি সবাইকে দুপুরবেলা আসতে বলে দিয়েছেন। দুপুরে গায়ে হলুদ হলেও সকাল থেকেই শুরু হয়েছে তার আয়োজন। কাঁচা হলুদের গন্ধে মৌ মৌ করছে বারান্দা । বারান্দায় বসে থেকেও চিত্রা স্পষ্ট বুঝতে পারে অদূরে তার স্বামীর ঘরে বসা মানুষটা ভীষন ছটফট করে মরছে।
হলুদ বাটা হলো । গাছ থেকে তুলে আনা তাজা মেহেদি পাতা বাটা হলো। হলুদের ডালায় আলপনা সাজানো হয়েছে লাল রং ও চুন দিয়ে । ছোট্ট একটা মাটির কলসে আম পানিতে আম পাতা দিয়ে বসিয়ে রাখা হয়েছে। উঠানে মাঝখানে লাগানো হয়েছে একটা কলাগাছ। সামনে বিশাল একটা কাঠের পিঁড়ি বাধা রয়েছে। সেখানের গায়ে হলুদ হবে চিত্রা ও রূপকের। ভাবি ও অন্যান্য আত্মীয়-স্বজনরা মিলে হলুদ এর আয়োজন করছে। কিশোরী মেয়েরা সবাই পড়েছে হলুদ শাড়ি। চিত্রাকে এখনো হলুদ শাড়ি পড়ানো হয়নি। এতকিছুর ভিড়ে আজকে হয়তো রূপকের সঙ্গে আর সময় কাটানো হবে না তার। ভীষণ লজ্জা লাগলেও ইচ্ছা করছে রূপকের পাশে কিছুক্ষণ বসতে।
ভাগ্য সুপ্রসন্ন হল। আত্মীয়-স্বজনরা মিলে কাদা ছোড়াছুড়ি খেলায় মেতেছে। শাশুড়ি মা এসে বললেন, ঘরে খাওন দিয়া আইছি। দুইজন মিইলা খাইয়া লও।
খুশিতে চিত্রার চোখ দুটো চকচক করে ওঠে। খাবার খাওয়ার লোভে নয়। তার নতুন স্বামীর সঙ্গে একসাথে বসে ভাত খেতে পারার আনন্দে। সে দ্রুতপদে নিজের ঘরে চলে আসে। এসে দেখে ঘর ফাঁকা। খাটের নিচে স্যান্ডেল জোড়াও নেই। তখন খুব মন খারাপ হয়ে যায়। তার মনের আশা কি আজ পূরণ হবে না। একসঙ্গে বসে ভাত খাওয়া হবে না তাদের।
চিত্রা নিজেও না খেয়ে বসে রইল। খাবারের প্লেট এর ঢাকনা তুলে দেখল কি খাবার পাঠানো হয়েছে। গরম গরম ধোঁয়া ওঠা খিচুড়ি। বিয়ে বাড়িতে অনেক মেহমান এসেছে। সবাই খাবে দুপুরবেলা বৌভাতে। তাই এখন সবার জন্য সহজ রান্নার রেসিপি খিচুড়ি। এক গামলা খিচুড়িতে দু এক পিস মাংস দেখা যাচ্ছে। খিচুরির ঘ্রাণে খিদেটা আরো মাথা চাড়া দিয়ে উঠল। খাবার আবারো ঢেকে দিল চিত্রা। আজকে বোধহয় তার খাওয়া হবে না। তার মানুষটাও আজকে এখনো খায়নি। কিংবা কে জানে হয়তো সে আগেভাগেই খেয়ে ফেলেছে?
এমন সময় দেখা গেল দুলতে দুলতে ঘরের দিকে আসছে রূপক। কলিজায় পানি এল চিত্রার। সে ছোট বাটিতে পানি ঢেলে হাত ধোয়ার ব্যবস্থা করে দিল। ঘরের দরজা আলগোছে লাগিয়ে রেখে বিছানায় মুখোমুখি হয়ে খেতে বসলো তারা।
চিত্রা লাজুক মুখে বলল, দুয়ার আটকায় দিলেন কেন? মানুষে আসলে কি ভাববো।
– যা মন চায় ভাবুক। ভাত খাওনের সময় কেউ ডিস্টার্ব করে সেইটা মন চাইতেছে না। পেট ভইরা দুইটা খাইয়া লও। সারাদিনে আবার কখন খাওয়ন দিব তার ঠিক নাই। খাইয়া শুইয়া একটু ঘুমাইয়া লও ।
চিত্রা লজ্জানত মুখে বলল এহন আমি ঘুমাবো?
– ঘুমাইবা। রাতে তোমার ঘুম হয় নাই। অহন না ঘুমাইলে মাথায় যন্ত্রণা হইবো।
– আমার যন্ত্রণার কথা আপনার ভাবতে হইবো না।
– তাইলে কার যন্ত্রণার কথা ভাব্বো? উত্তরপাড়া থাইকা একদল মাইয়া আইছিল বউ দেখতে। তাগো মধ্যে সবথাইকা মোটা মাইয়াটার কথা ভাবব?
চিত্রা কপট অভিমানী সুরে বলল, তাগো মধ্যে সবথাইকা মোটা মাইয়াডারে আপনি দেখছেন? ঘরে নিজের বউ থাকতে মানুষের দিকে দেখুন ঠিক না।
হো হো করে হেসে উঠল রূপক। তার হাসি দেখে চিত্রার আর ও অভিমান হল। সে খিচুড়ি খাওয়া বন্ধ করে তাকিয়ে রইল রূপকের দিকে।
হাসি ও খুনসুটিতে খাওয়া শেষ হল তাদের। পুরনো একটা কাঠের চেয়ারের ওপর খাবারের গামলা ও প্লেট সরিয়ে রেখে বউয়ের হাত ধরে টেনে নিয়ে গেল রূপক।
বলল, এখন তুমি আমার সঙ্গে ঘুমাইবা।
চিত্রা ছটফট করতে থাকল। বাসাভর্তি মেহমান কে কী ভাববে। সে নতুন বউ। তাকে প্রত্যেকটা নিঃশ্বাস ফেলতে হবে ভেবে চিন্তে। কিন্তু সত্যিটা হচ্ছে সেও মনে মনে চাইছে এখন কিছুটা সময় রূপকের সঙ্গে কাটাতে।
রূপক চিত্রার গায়ে হাত দিলো। শিউরে উঠল চিত্রা। এই মানুষটার স্পর্শ তার ভালো লাগে। তবুও কেমন যেন ছন্দ খেলা করে মনে ও শরীরে। রূপক বউকে জড়িয়ে ধরে নিজের বুকের মধ্যে শক্ত করে জাপটে ধরে। চিত্রা অস্থির হয়ে সেই বুক থেকে বাহির হতে চেষ্টা করে। বাহুবন্ধন আরও শক্ত করে রূপক। চিত্রার নরম গালে সে চুমু খায়। কানে কামড় দেয়, গলায় মুখ ডোবায়। চিত্রা থরথর করে কাঁপে। পুরুষ মানুষের স্পর্শ এমন কেন! সুখও দেয়, আবার যন্ত্রণায় পুড়িয়ে ছারখারও করে দেয়।
রূপক তাকে অনেক আদর করে। যতটা আদর না করলে বউকে ছেড়ে দিতে মন চায় না, ঠিক ততটাই। আদর শেষে ক্লান্ত শরীরে পাশে শুয়ে থাকে তার স্বামী। চিত্রার বুকের ভেতর খুব জোরে জোরে আওয়াজ হচ্ছে। ধুকপুক ধুকপুক। লজ্জায় বালিশে উপুড় হয়ে মুখ ঢেকে রেখেছে চিত্রা। রূপক হাসিমুখে টিনের চালের দিকে মুখ করে রেখেছে। চিত্রা চোখ খুলে ওর দিকে তাকাতে পারেনা। লজ্জায় মরে যায় যায় অবস্থা।
ভাবীরা কেউ ডাকছে না, শাশুড়ীও ডাকতে আসছে না। হলুদের সময় কি হয় নাই? নাকি সবাই বুঝে গেছে নতুন বর বউ এখন রঙ্গলীলায় মগ্ন, তাদেরকে ডাকা যাবেনা। জগতের এইসব নিয়মের কথা ভাবলে চিত্রার খুব লজ্জা করে। মানুষ এমন ক্যান? কারও কি শরম নাই?
কখন যেন ঘুমিয়ও পড়েছিল ওরা। হৈ হুল্লোড় শুনে ঘুম ভাংল। চিত্রা লজ্জা পেয়ে দ্রুত উঠে শাড়ি ঠিক করল। তারপর দরজা খুলতে গেল। শাশুড়ী মা জিজ্ঞেস করলেন, ঘুমাই পড়ছিলা?
– হ আম্মা।
– যাও মুখ ধুইয়া আসো। হলদিয়া শাড়িটা পিন্দো।
ঘাড় ঘুরিয়ে আচ্ছা বলে চিত্রা। ওর মনে ভয়, শাশুড়ী কিছু বুঝতে পারেন নাই তো? ভয় পেয়েই বা কী! সেই সময় পার করে এসেছেন শাশুড়ী নিজেও। চিত্রা তারাহুরো করে মুখ ধুতে যায়। টিউবওয়েলের পাড়ে অনেকে এসে ঘিরে ধরে ওকে। ওর ভয় লাগে, যদি আবার ওকে সকালের মতো প্রশ্ন করা হয়? কিন্তু কেউ কোনো প্রশ্ন করল না দেখে মানসিক শান্তি পায় চিত্রা।
উঠোন থেকে মহিলাদের গানের আওয়াজ শোনা যাচ্ছে। সাঁড়িবেধে গান গাইছে মহিলারা।
চলবে..