দ্বিতীয়_পুরুষ,পর্ব ৩২,৩৩

0
430

#দ্বিতীয়_পুরুষ,পর্ব ৩২,৩৩
_নীলাভ্র জহির
৩২

রূপক বাড়ি ফেরার পর থেকে খেয়াল করে দেখল চিত্রার মাঝে অদ্ভুত পরিবর্তন এসেছে। চোখমুখ শক্ত , মুখে কাঠিন্য , কারো সাথে কথা বলছে না। বারান্দায় বসে এক দৃষ্টে আকাশের দিকে তাকিয়ে আছে। রূপক বাড়ি ফেরার পর সাধারণত সে রূপকের আশে পাশে থাকার চেষ্টা করে, বিভিন্ন ইংগিতে কথা বলার চেষ্টা করে। কিন্তু আজ তার একেবারেই বিপরীত। আজ চিত্রার মাঝে কোন কিছু নিয়ে ভ্রুক্ষেপ নেই। রূপক বারান্দায় ভাত খেতে বসলো। খাবার দিচ্ছেন জোসনা বেগম। রূপক নিজে থেকেই ডাকলো চিত্রাকে, ভাত খাইছো?
চিত্রার মাঝে কোন ভাবান্তর নেই। রূপক তার মায়ের কাছে জানতে চাইলো, মা ও ভাত খাইছে?
– না, বৌমা ও ডাকতাছে তুমি শুনতাছ না? ভাত খাইতে আসো।
একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল চিত্রা। তবে সেই দীর্ঘশ্বাসের চিত্র দেখতে পারলো না রূপক কিংবা তার মা। আবছা অন্ধকার ঠেলে চিত্রা ধীর পায়ে এসে মোড়া টেনে নিয়ে বসলো। জোসনা বেগম ভাতের থালা তার দিকে এগিয়ে দিলেন। থালা থেকে অর্ধেকের বেশি ভাত ভাত গামলায় নামিয়ে রাখল চিত্রা। কয়েক লোকমা ভাত নিয়েছে মাত্র। হাত ধুয়ে মাথা নিচু করে ভাত খেতে লাগলো। সে কারও দিকে তাকালো না। চোখ মুখ গম্ভীর। কয়েকবার খাবার মুখে দিয়ে নিঃশব্দে খেয়ে গেল। খাবারটা শেষ করে আবারও উঠে এসে হাত ধুয়ে ফেলল। তারপর গিয়ে বসলো তার ঘরের বারান্দায়।
জোসনা বেগম ও রূপক একে অপরের দিকে মুখ চাওয়াচাওয়ি করল। চিত্রার আচরণ এমন রোবটের মতো হয়ে গেল কি করে সেটাই ভাবছে রূপক। সেই সময়ে জোসনা বেগম বললেন, তুই মঞ্জু মিয়ারে চিনোস?
কোন মনজু মিয়া?
রাস্তার মাথায় যে নতুন বাড়ি করছে। বিল্ডিং ঘর, নীল রং করছে।
হাঁ মনে আছে। কি হইছে তার?
উনার একটা মাইয়া আছে।
মাইয়া কি অসুস্থ?
অসুস্থ হইবো ক্যান?
তাইলে কি হইছে?
তুই মাইয়াডারে একটু দেখবি।
আমি কেন দেখব?
দেখতে কইছি। আমি ওর মায়ের লগে কথা কইছি। মাইয়াডা নাকি জামাকাপড় বানাইতে দিব। তোর দোকানে যাইবো।
যাইবো। অসুবিধা কি? আমিতো দোকানেই থাকি সারা দিন। কইও গিয়া মনজু মিয়ার মাইয়া সেইডা কইতে। তাইলে কয়টা ট্যাকা কম রাইখা দিমু।
আচ্ছা, ঠিক আছে। মাইয়াডারে একটু ভালো কইরা দেখিস তুই।
রূপক মায়ের কথার কোনো ইঙ্গিত ধরতে পারল না। সে কেবল ভাবছে চিত্রার কথা। চিত্রা এতদিন স্বাভাবিক আচরণ করেছিল। স্বামীর অবহেলায় একটা স্ত্রীর কান্নাকাটি করে আবেগে আপ্লুত হয়ে থাকার কথা। সেটাই তো স্বাভাবিক। কিন্তু আজ সে হঠাৎ করে এমন কঠিন হয়ে গেল কি করে? সে কি চিত্রাকে বেশি কষ্ট দিয়ে ফেলল?

হাত ধুয়ে রূপক মায়ের কাছে এক খিলি পান চাইতে গিয়ে চাইল না। লুঙ্গিতে হাত মুছতে মুছতে চিত্রার পাশে এসে বসলো। চিত্রা কে বলল, আমারে এক খিলি পান আইনা দাও?
মুহূর্তেই ফড়াৎ করে চিত্রা উঠে গেল। রুপক বসে রইল। দখিনা বাতাস আসছে শন শন করে। গায়ের শার্ট খুলে খালি গায়ে বসল রূপক। গা হিম করা বাতাস। রূপক ভাবল চিত্রা পান নিয়ে আসলে সে খানিকক্ষণ গল্প করবে চিত্রার সঙ্গে। চিত্রার মনের অবস্থা বোঝার চেষ্টা করবে। সে নিশ্চয়ই রূপকের সঙ্গে অনেক রাগ করে আছে। অনেকদিন হল তাদের মধ্যে ঝামেলা চলছে। এসবের একটা ইতি টানা দরকার।

কিন্তু চিত্রা সেই সুযোগটুকু তাকে দিল না । সে পানের খিলি রূপকের হাতে দিয়ে সোজা ঘরে গিয়ে ঢুকলো। ঘর অন্ধকার হওয়ায় বাইরে থেকে বোঝা গেল না কি করছে চিত্রা। তবে রূপক খুব অপ্রস্তুত বোধ করলো। সে চিত্রার সঙ্গে খানিকক্ষণ কথা বলতে চেয়েছিল। চিত্রা তাকে পাত্তা দেয়নি বলে মেজাজটা খারাপ হয়ে গেল তার। পরক্ষনেই তার মনে জেগে ওঠা দরদটুকু নিমেষেই ভেঙে চুরমার হয়ে গেল। মনে মনে বলল, আমার লগে বেইমানি কইরা আবার আমারে দেমাগ দেখাইতেছে। কিসের এত দেমাগ বুঝিনা। যত মন চায় রাগ কইরা থাকুক। আমার তাতে কিছুই যায় আসে না। আমি ওর দেমাগের ধার ধারি না।

রাগের চোটে রুপক বারকয়েক পানের পিক ফেলল মাটিতে। শনশন করা বাতাসেও তার গরম লাগছে। সে রীতিমত রাগের স্বরে বলল, পাংখা টা দিয়া যাও।
মুহুর্তের মাঝে হাতপাখা নিয়ে হাজির হল চিত্রা। সেটা রূপকের সামনে রেখে আবার ঘরে গিয়ে ঢুকলো। রূপক ভেবেছিল হাতপাখা নিয়ে চিত্রা তার পাশে এসে বসবে। কিংবা দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে বাতাস করবে তাকে। চিত্রা তার কিছুই করলো না দেখে রূপকের রাগটা আরো বেড়ে গেল। তার সামনে পাখা রেখে এভাবে ঘরে চলে যাওয়া? ঠিক আছে রুপকও দেখে নিবে এভাবে কতদিন রাগ করে থাকতে পারে চিত্রা। মনে মনে রূপক বলল, আমি কোনো দোষ করি নাই। আমার কোন ঠেকা পড়ে নাই কারো কাছে দিয়া ধরণা দেয়ার।

চিত্রা স্তব্ধ হয়ে বিছানায় শুয়ে আছে। তার ঘরের জানালা দিয়ে হাওয়া আসছে। চুলের খোপা খুলে গেছে তার। বাতাসে চুল উড়ছে দিগ্বিদিকভাবে। এই মুহূর্তে অতীত-বর্তমান কিংবা ভবিষ্যৎ কোন কিছু নিয়েই সে আর ভাবতে পারছে না। তার ভাবনা গুলো সব কেমন যেন পাথর হয়ে গেছে। অতীতের ভয়ঙ্কর যাতনাময় স্মৃতি কিংবা ভবিষ্যতের কষ্টের শঙ্কা কোনটাই তার মনকে প্রভাবিত করছে না। বর্তমানে সে কোন দহনে দগ্ধ হচ্ছে সেটাও তাকে ভাবাচ্ছে না। তার কাছে সবকিছু মনে হচ্ছে দুঃস্বপ্নের মত। সবটা যেনই স্থির। তার চোখ দুটো হয়ে গেছে পাথরের মত। রূপক কখন এসে তার পাশে শুয়ে পড়েছে চিত্রা খেয়ালই করল না। দেখতে দেখতে রাত বেড়ে যায়। ঘুম নেই তার চোখে। সে ঘুমের ভান ধরে পড়ে রইল। রূপক কয়েকবার ডাকলেও সাড়া দিলো না। যেন গভীর ঘুমে মগ্ন সে। কিন্তু কেবল তার চোখ দুটোই জানে, নির্ঘুম এক রাত্রি কাটিয়েছে তারা।
এভাবেই কেটে গেলো দুটো দিন। বিচিত্র এক ঘটনা ঘটল দুদিন পর। রূপক মাত্র বাড়ি ফিরেছে। ভাত খাওয়ার পর জোসনা জিজ্ঞেস করলেন, আইজ মাইয়াডা তোর দোকানে গেছিল?
– হ। তোমারে কে কইল?
– আমি ওগো বাড়িত গেছিলাম সন্ধ্যয়। আপার লগে আমার খুব খাতির হইছে। অনেক ভালো মহিলা। আমি গেলে আমারে এটা-ওটা খাইতে দেয়। ঘরে সারাক্ষণ বিস্কুট কেক নাস্তা পানি থাকেই।
– তুমি বুঝি বিস্কুট নাস্তা পানি খাইতে যাও?
– আরে না আমিতো গল্প করতে যাই। মহিলার দিল ভালো। ওরা আগে আছিলো নোয়াখালী। ওনার স্বামী চাকরি করতো। দুই পোলা, দুই মাইয়া। মাইয়া দুইটাই সুন্দরী। গেলেই আপা আমার লগে এত কথা কয়, খুব ভালো লাগে। পরান টা জুড়ায় যায়। উনার মাইয়াগুলা খুবই ভদ্র। এত সুন্দর কইরা আমার লগে কথা কয় ,সালাম দেয়।
– হু আমারও তাই মনে হইলো। মাইয়াগুলা ভদ্র। আজকে দুইটা মাইয়া দোকানে আইছিলো। থ্রি পিস লইছে।
– দাম টাম কমাই আর রাখছস?
– হ, কমাইয়া রাখছি। সিঙ্গারা খাইতে কইছিলাম, খায় নাই।
– মাইয়া কি বোরকা পইরা গেছিল?
– হ,
– তাইলে তো তুই ওর মুখ দেখস নাই? হতাশ শোনালো জোসনা বেগমের গলা ।
– মুখ দেখছি। মুখ খোলা ছিল।
জোসনা বেগম খুশি হয়ে উঠলেন, মাইয়া কেমন দেখছস? ছোট মাইয়াটা তো কেবল ক্লাস ফোরে পড়ে। বড়ডারে কেমন দেখলি?
ভালোই। আচার আচরণ দেইখা শিক্ষিত মনে হইল।
শিক্ষিত হইলে শিক্ষিত মনে হইবো না? ইন্টারে পড়ে।
এটা নিয়ে আর কোন কথা বাড়ালো না রূপক। জোসনা বেগম বললেন, মাইয়াডারে কেমন দেখছস কইলি না?
এক কথা কয়বার জিগাও মা? কইলাম তো দেখছি ভালই। পরের মাইয়া দেইখা আমি কি করমু? তুমি কি কারো জন্য ঘটকালি করতাছো?
মুচকি হাসলেন জোসনা বেগম, হ। মাইয়াডারে আমার বড় ভালো লাগছে। আদব-কায়দা আচার-আচরণ সব দিক দিয়া খুব ভালো।
তো কার জন্য দেখতাছো? শরিফের লাইগা?
আরে ধুর। আমাগো শরিফের বিয়ের বয়স হইছে নাকি।
তাইলে কার জন্য দেখতাছো?
জোসনা বেগম খানিকটা ইতস্তত বোধ করলেন। তারপর বললেন, মাইয়াডারে কি তোর ভালো লাগে?
রুপক খানিকক্ষণ তার মায়ের দিকে স্তব্ধ চোখে তাকিয়ে রইল। জোসনা বেগম কিসের ইঙ্গিত দিচ্ছে সেটা বুঝতে আর দেরী হলো না তার। সে জানতে চাইলো, আমার ভালো লাগা দিয়া কাম কি?
ওদের লগে আত্মীয়তা করতাম। মাইয়ার মা রাজি আছে। বাপ রাজী হইবো কিনা সেইটা জানিনা। ওর মায় কইছে ওনারে রাজি করোন যাইবো।
মা তোমার মাথা ঠিক আছে?
হ, ঠিক আছে। তুই আমার যোগ্য পোলা। তোর জন্য একটা যোগ্য মাইয়া দরকার। তুই যারে বিয়া করছোস সে কোন দিক দিয়া তোর যোগ্য না। মঞ্জু মিয়ার মাইয়াডা দেখতে শুনতে যেমন সুন্দরী, তেমনি আচার ব্যবহার। কয়েকদিন হইল এই গ্রামে আইছে। সবাই তার প্রশংসা করে। কলেজে পড়ে, জ্ঞান-বুদ্ধির অভাব নাই। ওর বাপের টাকা পয়সাও আল্লাহ দিলে অনেক। আপা কইসে, মাইয়ারে ঘরভর্তি কইরা জিনিস দেওয়ার লাইগা জমা-জমি রাখছে। একটা জমি বেইচা শুধু মাইয়ারে জিনিসই দিব। মাইয়ার জামাইরে ব্যবসা করার লাইগা টাকা পয়সা দিব। আমি সারাক্ষণ তোরে লইয়া সুনাম করি। তোরে উনি অনেক পছন্দ করে। খালি যদি তোর বিয়ার আগে ওনারা এখানে আইতো, ওই মাইয়ার লগেই তোরে বিয়া দিতাম।
এখন তো আমার বিয়া হইয়া গেছে। এখন আর এসব আলাপ কইরো না।
বিয়া হইছে তো কি হইছে?
আম্মা তোমার মাথা খারাপ হইছে। বিয়া হইছে মানে বিয়ে হইছে। একটা ছেলে কয়বার বিয়ে করে?
তুইতো যোগ্য বউ পাস নাই। তাই যে তোর যোগ্য হইব তুই তারে বিয়া করবি।
তারমানে তুমি কইতে চাইতেছো আমি আমার বউটারে ছাইড়া দেই? আর ওই মাইয়ারে বিয়া করি?
জোসনা বেগম খানিকক্ষণ চুপ করে রইলেন। তারপর ইতস্তত করে বললেন, আমি চিত্রার লগে কথা কইয়া দেখি। সে যদি কোন ঝামেলা না করে, চুপচাপ এই বাড়িতে পইড়া থাকতে চায়, তাইলে তো কোন অসুবিধা নাই। সে থাকবো এই বাড়িতে, কাম কাজ করব। পোলা দেখাশুনা করব। তুই আর একটা বিয়া করলি অসুবিধা কি? কয়েকদিন পরে দেখবি মাইয়া নিজে থাইকা চইলা যাইতাছে।
রূপক বলল, এটা কেমন কথা কইলা মা? একটা মাইয়ারে আমি এমনে কষ্ট দিমু?
– কষ্ট তো সে আগে দিছে। বেঈমান মাইয়া। সত্য গোপন কইরা বিয়া দিছে। তোর যদি বেশি বিবেকে লাগে তাইলে তুই ওরে ছাইড়া দে। ওর আগে বিয়ে হইছিল। তুই ওর বাপের বাড়ির মানুষের লগে বসবি। কইবি, যে মাইয়ার আগে বিয়ে হইছিল তার লগে সংসার করবি না। তাছাড়া ওই মাইয়া সংসারের কিছুই বুঝে না। তুই ওরে ছাইড়া দে। তাইলে দেখবি তোর সবকিছু ভালো মত হইবো । ব্যবসা-বাণিজ্য করতাসোস। শশুর বাড়ি থাইকা বেশি করে টাকা পয়সা পাইলে দোকান বড় করবি। মার্কেট বানাবি। সুন্দরী বউ লইয়া সুখে সংসার করবি। শ্বশুরবাড়ি গেলে অনেক আদর যত্ন পাইবি। বুঝোস না ক্যান?

রুপক বলল, এসব নিয়ে আর কথাবার্তা কইও না। আর নিজেদের ঘরের কথা বাইরে কাউরে কইবানা। এতে নিজের মান সম্মান নষ্ট হইবো। কপালে যা ছিল তাই হইছে। এখন আর ও অশান্তি বাড়াইতে চাইতেছি না।
অশান্তি বাড়াবি কেমনে? এমনিতে কি কম অশান্তিতে আছোস? ঘরে কোন শান্তি নাই। তোর লাইগা আমার কষ্ট হয়।
হোক। আমারে নিয়া উল্টা পাল্টা চিন্তা কইরো না।
আমি কিন্তু তোর ভালোর জন্য কইছি। তুই ওই মাইয়ারে বাপের বাড়িত পাঠাইয়া দে। টাকা পয়সা দিবি খাওয়ার লাইগা। পোলা হইয়া গেলে পোলারে নিয়া আসবি। তারপর ছাড়াছাড়ি করবি।
এসব কথা কইও না মা। চিত্রা শুনলে কষ্ট পাইব।
তার কষ্ট পাওয়াই উচিৎ। সে তোরে জাইনা শুইনা ঠকাইছে। কামডা ঠিক করে নাই।
তোমারে কে কইছে এই কথা?
জোসনা চুপ করে রইলেন।
রূপক একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বাড়ির বাইরে বেরিয়ে এলো। তার অশান্ত মনটাকে জোসনা বেগম এসব কথা বলে আরো অস্থির করে দিয়েছে। এখন একটা সিগারেট ধরাতে হবে। সিগারেট টানলে মনের অস্থিরতা খানিকটা কমে।

চলবে..
#দ্বিতীয়_পুরুষ
পর্ব ৩৩
নীলাভ্র জহির

আজ চিত্রার সঙ্গে একটা দুর্ঘটনা ঘটেছে। পুকুরঘাটে পা পিছলে গিয়েছে তার। তবে মাটিতে না পড়ে সরাসরি পানিতে গিয়ে পড়ার কারণে খুব একটা আঘাত পায়নি। তবুও দুশ্চিন্তা থেকেই যায় । তাইতো শরীরে আঘাত না লাগলেও জোসনা বেগম এই ঘটনার পর থেকেই তাকে মানসিকভাবে আঘাত করে যাচ্ছেন। ঘরে শুয়ে নীরবে অশ্রু বিসর্জন করছে চিত্রা।
জোসনা খবর পাঠিয়ে রূপককে বাড়িতে আসতে বলেছিলেন। রূপক আসার সঙ্গে সঙ্গে তিনি প্রলাপ বকতে শুরু করলেন, এই মাইয়ারে দিয়া সংসার হইবো না। আমি তোরে আগেই কইছি। আমরাও পোলাপাইন পেটে ধরেছি। পোলা পেটে আসার পর থাইকা মনে করতাম আমি আর আমি নাই। একটা দম ছাড়লেও অনেক সতর্ক হইয়া দম ছাড়তাম। ওই মাইয়া কেমনে পুকুরঘাটে পিছলাইয়া গেল। যেইখানে পিছলা ঐখান দিয়ে ওরে কেন পা দিতে হইব? শুকনা জায়গায় পা দিতে পারল না? আর আমি কই তুই যদি পুকুর ঘাটে গোসল করতে নাই পারস তোরে পুকুরে নামতে কইছে কিডা? তুই কলের পানি দিয়া গোসল করতে পারোস না? আমারে যদি কইতি আম্মা আমারে এক বালতি পানি তুইলা দেন আমি তো ঠিকই এক বালতি পানি উঠাইয়া দিতাম। সব কাম করতে পারতাছি আর এক বালতি পানি তুইলা দিতে পারতাম না? তোরে তো আমি রাজ রানীর মত কইরা রাখছি। সবার ঘরে গিয়া দেখ বউরে দিয়া গু মুত পর্যন্ত ধোয়ায়। আমিতো তোরে কত আরামে রাখছি, রানীর মতন। এই সংসারে আমি এতগুলো বছর ধইরা খাটতাছি। তারপরও তোরে কোনদিন কই না যে বৌমা এই কামটা আমারে কইরা দেও। তারপরও তুই কেন পুকুর ঘাটে গোসল করবি। তুই কেন পা পিছলাইয়া পরবি? আজ যদি আমার নাতির কিছু হইয়া যায়, তখন কি হইব? আমার পোলায় তো তার সাত খুন মাফ কইরা দেয়।

রূপক স্থির চোখে মাটির দিকে তাকিয়ে আছে। চোখ-মুখে ভর করেছে কাঠিন্য।
জোসনা বললেন, আমি কিন্তু আর সহ্য করুম না। পোয়াতি মাইয়া একটু হুস কইরা চলাফেরা করে না। আমি ওরে দিয়া সংসারের একটা কাম করাই না। আমি তারে সবসময় রেস্টে থাকতে কই। তাও সে পইড়া যায়।
রুপক জোসনা কে থামিয়ে দিয়ে বলল, তুমি চুপ করো। আমি দেখতেছি।
তুই কি দেখবি সেটা আমার জানা আছে। একটা কথা আইজ আমি পরিষ্কার কইরা কইতাছি, এই মাইয়ারে দিয়া সংসার হইবো না। সংসারে তার কোন মন নাই। সারাডা ক্ষণ খালি উড়ু উড়ু করে। তুই দেইখা লইস আমার কথা।

রূপক নিজের ঘরে এসে দরজা ধরে দাঁড়াল। চোখের জল মুছছে আঁচলে। ভেজা গলায় বলল, আমি অনেক সতর্ক হইয়া ছিলাম। তারপরও কেমনে পইড়া গেছি আমি জানিনা।
একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়ল রূপক, আমার মায়ে তোমার উপর খুব রাগ করছে।
জানি। উনি আমারে একেবারে সহ্য করবার পারতাছে না।
স্বাভাবিক। তোমার চালচলন ইদানিং খুবই খারাপ হইয়া গেছে। এমন করলে কেমনে হইব?
আপনেরও কি তেমন মনে হইতাছে?
কি?
আমারে সহ্য করবার পারতেছেন না?
রূপক চুপ করে রইলো। আবারও চোখের জল মুছল চিত্রা। রুপক শক্তভাবেই দরজা ধরে দাঁড়িয়ে রইল।
চিত্রা বলল, কয়টা দিন থাইকা আম্মা খালি সারাটা দিন একই কথা কয়। আমারে দিয়া সংসার হইবো না। সারাদিন আমারে শুনায় আমি আপনার যোগ্য না। আপনিও কি তাই মনে করেন?
কোন উত্তর নেই রূপকের। সে স্থবির। দুপুরের কাঠফাটা রোদ্দুরে গরমের তীব্রতা যেন আরো বেড়ে গেছে। কুলকুল করে ঘাম ছিল সে। শার্টের বোতাম খুলে শার্টটা দরজার উপরে রেখে সে চেয়ারের ওপর এসে বসলো। তার ঘাড় বেয়ে দরদর করে ঘাম ঝরছে। জানালা দিয়ে কোন বাতাসও আসছে না।
চিত্রা বলল, আপনি আমারে কইয়া দেন। আপনারও যদি আমারে খুব অসহ্য লাগে, আমারে যদি আপনার যোগ্য মনে না হয়, তাইলে কন। আমি আপনারে শান্তি দিয়া চইলা যামু।
কই যাইবা?
যেইখানে দুইচোখ যায়। ভয় পাইয়েন না। আপনার পোলারে নিয়া যমুনা। পোলা জন্ম দিয়া তারপর যামু। কয়টা মাস তো কাইটাই গেছে। আর তো কয়টা দিন। কষ্ট কইরা পইড়া থাকমু। পোলা জন্ম দিয়া আপনার কাছে রাইখা আমি চইলা যামু। জীবনে আর আমার মুখ দেখামু না।
চুপ করে রইল রূপক।
চিত্রে কাঁদতে কাঁদতে বলল, আমি ছোট থাইকা অনেক কষ্ট কইরা বড় হইছি। আমার জীবনে কষ্ট বইলা কিছু নাই। সব সইয়া গেছে। নিজেরে মনে হইতাছে আপনার কান্দের বোঝা। গলার কাঁটা হইয়া বিনছি। কাটা বমি কইরা ফেলতেও পারতাছেন না, গিলতেও পারতাছেন না।
– এইসব কথা বাদ দাও। মন মেজাজ ভালো নাই। শুইয়া রেস্ট নাও। এখন থাইকা একটু সাবধান হইয়া চলাফেরা কইরো। গোসল দেয়ার আগে আমার মারে কইও তোমারে পানি তুইলা দিব। আর পুকুর ঘাটে নাইমো না।
– পানি তো তুইলা দিব। কিন্তু মন থাইকা তো দিবোনা। তিনি আমার উপর খুব রাগ কইরা আছেন। তিনি আমারে দেখবার পারেন না। তারপর কেমনে উনারে কমু আমারে পানি তুইলা দেন?
– আমার মা তোমারে দেখতে পারে না এটা মিছা কথা। তোমার আচার আচরণের জন্য তিনি একটু রাগ করছেন। আর কিছু না।
– সেজন্য সারাদিন আমারে শুনান আমি আপনার যোগ্য না।
– এসব কথা কানে নিও না। তুমি আমার যোগ্য না হইলেও এখন তো তুমি আমার স্ত্রী। তোমারে তো আর ফেইলা দিতে পারব না।
– পারবেন না কেন? আপনার মায়ের আচার-আচরণ তো কইয়া দেয় তিনি আমারে ফেলাই দিবেন।
– তোমারে বিয়া রাইতেই একটা কথা কইছিলাম। আমার মায়ের মাথাটা একটু গরম। কখন কি কয় তার কোনো ঠিক নাই। তুমি সহ্য কইরা যাও। মার লগে কোন তর্কে যাইওনা।

চিত্রা চুপ করে রইলো। রূপকের সঙ্গে আর কোনো কথা হয় না তার। ভরদুপুরে কাঠফাটা রোদে ঘর থেকে বের হয়ে যায় রূপক। সে কোথায় যায় তা জানতে ইচ্ছে করলেও চিত্রা কোন প্রশ্ন করে না। কেবল বিছানায় শুয়ে শাড়ির আঁচলে চোখের জল মুছে। আর মনে মনে ভাবে তার জীবনে কি তবে কষ্টগুলো দীর্ঘস্থায়ী হয়ে গেল? ঠিক এই কারণেই কি শুরু থেকেই তার মনে শঙ্কা ছিল এত সুখ তার কপালে সইবে না?

জোসনা বেগম এখন আর রান্নার পর চিত্রাকে খেতে ডাকেন না। রূপক দোকানে যাওয়ার সময় তাড়াহুড়া করে ভাত খেয়ে দোকানে চলে যায়। চিত্রা খেয়েছে কিনা তা কেউ জানতেও চায় না। চিত্রার মন খারাপ হয়। অসহায় লাগে নিজেকে। কিছু খেতে ইচ্ছা করে না। তবুও সে জোর করে একটু খাবার মুখে দেয়। কারণ দিন দিন শুকিয়ে যাচ্ছে। আশে পাশের বাড়ির মানুষজন বলাবলি করছে গর্ভাবস্থায় মেয়েরা মোটা হয় আর চিত্রা শুকিয়ে যাচ্ছে। চিত্রার বাচ্চা অসুস্থ হবে, অপুষ্টিতে ভুগবে, এই ধরনের নানান কথা শোনায় তাকে। মানুষের কথা শুনে তারও খুব ভয় জাগে মনে। ইচ্ছে করে এখন থেকে ভালো মতো খাবার খাবে। সবাই তাকে বুদ্ধি দেয় দিনে বেশ কয়েকবার করে খাবার খেতে। কিন্তু তার কোন খাবারের রুচি নেই। দুইবার খাবার মুখে দিলে একবার ফেলে দিতে হয়। কারণ খাবার কেবল চিবিয়ে গেলেই হয় না, গিলতেও হয়। তার গলা দিয়ে খাবার নামে না।

স্বামী-স্ত্রী কেবল পাশাপাশি শুয়ে থাকে। চোখে ঘুম এলে দুজনে ঘুমিয়ে পড়ে। কিন্তু মনে হচ্ছে যেন বহুবছর একজন আরেকজনকে স্পর্শ করে না। কেউ কারো দিকে তাকায় না পর্যন্ত। প্রয়োজন ছাড়া খুব একটা কথাও হয়না তাদের। ক্রমাগত মনের দূরত্ব কেবল বেড়েই চলছে। একই ঘরে থাকলেই মানুষ আপন হয় না। পাশাপাশি ঘুমালেও দুজনের মাঝে আকাশ সম দূরত্ব থাকতে পারে।

এদিকে মঞ্জু মিয়ার মেয়ে মৌসুমী জামার ডিজাইন বলে দেয়ার অজুহাতে বেশ কয়েকবার রূপকের দোকানে এসেছে। সে রূপকের দিকে তাকিয়ে হেসে হেসে কথা বলে। তার হাসিতে যেন মুক্তা ঝরে। সাদা সাদা দাঁত যেন স্বচ্ছ পাথর। প্রাণখোলা হাসি হাসতে হাসতে বলে, ভাইয়া আমার কিন্তু গলায় এই ডিজাইন টা দিতে হবে। জামার হাতা কিন্তু থ্রি-কোয়ার্টার দিয়েন।
রূপক হাসার চেষ্টা করে উত্তর দেয়, ঠিক আছে। জামার মাপ তো দিয়া যান নাই। একটা জামা দিয়ে যাইয়েন।
মৌসুমী বলে, আচ্ছা ঠিক আছে। কাল কলেজ যাওয়ার সময় একটা জামা নিয়া আসবো।

পরের দিন কলেজ যাওয়ার সময় সে আবার রূপকের দোকানে আসলো। তার ভ্যানিটি ব্যাগ থেকে একটা শপিং ব্যাগ বের করে সে রূপকের দোকানে রাখে। তারপর মুচকি হেসে বলল , ব্যাগটা খুইলা দেইখেন। মা পিঠা বানাই ছিল। বাটিতে কইরা কয়টা পিঠা দিছে।
রূপক আন্তরিকতার সহিত ধন্যবাদ জানায়। মুচকি হেসে চলে যায় মৌসুমী। কিন্তু রূপকের মনে যন্ত্রণা হয়। এই মেয়েটাকে মা তার পিছনে নিশ্চয়ই লেলিয়ে দিয়েছে। নয়তো তার প্রতি মেয়েটার এত দরদ কেন? কেন সে বারবার আসে তার দোকানে? আর কেনই বা হেসে হেসে তার চোখের দিকে তাকিয়ে এত সুন্দর করে কথা বলে? মা চায় এই মেয়েটাকে পুত্রবধূ করতে। কিন্তু চিত্রার প্রতি মন উঠে গেলেও রূপক এতো সহজেই আর কাউকে মন দিতে পারবে না। আজকাল চিত্রার জন্য তার কষ্ট হয়। মন চায় সব কিছু ঠিকঠাক করে ফেলতে। কিন্তু কিসের যেন একটা দেয়াল মাঝখানে দুজনকে দুই পৃথিবীতে রেখেছে। সে চাইলেও সেই দেয়াল ভেঙে চিত্রার কাছে যেতে পারে না। সবকিছুর আগে তার মনে হয় চিত্রা বেইমান। চিত্রা তাকে ঠকিয়েছে। চিত্রার প্রতি আগের মতো মায়া কিংবা প্রেমটা ঠিক আসে না। ঘরে কিংবা দোকানে কোথাও এসে একটু শান্তি পায় না রূপক। সারাক্ষণ তার মনে অশান্তি। এই অশান্তি থেকে সে বের হয়ে আসতে চায়। কিন্তু কিভাবে সেটা সম্ভব রূপক জানেনা?

এমন অশান্তির একদিনে হঠাৎ তার ফোনে একটা রং নাম্বার থেকে কল এলো। দোকানে কাজ করছিল রূপক। ফোন ধরতেই শুনতে পেল একটা মিষ্টি মেয়েলি কণ্ঠস্বর, হ্যালো আসসালামু আলাইকুম।
ওয়ালাইকুম সালাম। কে বলছিলেন?
একটা মিষ্টি হাসির শব্দ শোনা গেল। রিন রিন করে কানে বাজতে লাগল সেই হাসি।
আমি মৌসুমী।
রূপক ভীষণ অবাক হল। জানতে চাইল, আমার নাম্বার কই পাইছেন?
– দর্জি মিয়া খালি কি ইন্দুরের মতো কাপড় কাটাকুটি করলেই হইবো। নাকি মাথায় একটু জ্ঞান বুদ্ধি ও থাকতে হইবো।
বলেই আবারো খিল খিল করে হেসে উঠল মেয়েটি। রুপক ইতঃস্তত বোধ করতে করতে বলল, আমার কি জ্ঞান বুদ্ধি কম?
– কম না হইলে কেমনে আপনি এই কথা আমাকে জিজ্ঞাস করেন। দোকানের রিসিট এর মধ্যেই তো ফোন নাম্বার দিয়ে রাখছেন। প্রোপাইটর মোহাম্মদ রূপক মিয়া। মোবাইল নাম্বার জিরো ওয়ান সেভেন এইট।
বলতে বলতে মেয়েটি খিলখিল করে হাসতে লাগলো। তার বলার ধরন শুনে হাসি পেয়ে গেল রূপকের। রূপক নিজেও হেসে ফেলল শব্দ করে।
মৌসুমী বলল, শুনেন এইবার কামের কথায় আসি। আমার জামাটা কি সেলাই করা হইছে?
হ্যাঁ, হইছে। আপনি এসে নিয়ে যাইয়েন।
– আপনি বাড়িত আসার সময় নিয়ে আইসেন। আমাগো বাড়িতে দিয়ে যাইয়েন জামাটা। আমাগো বাড়ির সামনে দিয়েই তো রোজ বাড়িতে যান।
রূপক ইতস্তত করে বলল, আপনি বুঝি রোজ আমারে দেখেন?
– তা কেন দেখতে যামু। আমার কিসের ঠেকা পড়ছে। আপনার বাড়ি থাইকা বাজারে যাওয়ার রাস্তা তো এই একটাই। আপনি যে এই রাস্তা দিয়ে না গিয়া আকাশ দিয়ে উইড়া উইড়া যাইবেন না সেইটা বুঝার জন্য তো আর ওকালতি পাস করুন লাগেনা।

মেয়েটি আবারো খিল খিল করে হেসে উঠল। তার উত্তর শুনে রূপকের এতটাই ভাল লাগল যে বিমোহিত হয়ে অনেকক্ষণ সে কথা বলতে পারল না। মৃদু হেসে রূপক বলল, আসলে আমার জ্ঞান বুদ্ধি কম মনে হইতাছে।
– আপনার মা কয় আপনার অনেক জ্ঞান বুদ্ধি। আমার মনে হইতেছে কি জানেন? কাপড় কাটতে কাটতে ভুল কইরা একটু জ্ঞান বুদ্ধি ও কাইটা ফেলছেন।

মৌসুমী আবারও হেসে উঠলো। আবারো হেসে ফেলল রূপক। মেয়েটি এত চমৎকার করে কথা বলে। এত সুন্দর করে উত্তর দেয় প্রত্যেকটা কথার। এমন বুদ্ধিমতি মেয়ে কখনোই দেখেনি রূপক। তার হাসির রিমঝিম শব্দ অনেকক্ষণ মনের ভেতর বাজনা বাজে। মাথার ভেতর ঘুরতে থাকে সেই হাসি। আর তার সঙ্গে কথা বলার সময় মনটাই ভালো হয়ে যায়।
মৌসুমী বলল, আইজ জামাটা নিয়ে আইসেন। আপনি তো কোনদিনও আমাগো বাড়িতে আসেন নাই। আজকে আইসা একটু পানি খাইয়া যাইয়েন।
– শুধু পানি খাওয়াইবেন?
– আরো কিছু খাইতে চান নাকি?
– যদি খাইতে চাই?
– সস্তা জিনিস চাইলে পাইবেন। দামি জিনিস চাইলে পাইবেন না।
– কেন?
– দামি জিনিসের জন্য একটু ধৈর্য ধরতে হয়। দামি জিনিস দামি মানুষরে খাওয়াইতে হয়।
রূপক মুচকি হেসে বলল দামি মানুষ হইতে হইলে কি করতে হইবো?
যারা দামি মানুষ তারা এর উত্তর জানে। আর যারা দামি মানুষ না তারা চাইলেও দামি হইতে পারেনা।
তাই নাকি। তাইলে তো আমি দামি মানুষ হইতে পারলাম না। একটু চেষ্টা কইরা কি দেখন যাবে না?
চেষ্টা করতে পারেন। ক্ষতি নাই। জামাটা নিয়ে আইসেন। জামা ভালো হইলে আপনারে শিখাইয়া দিমু নে।
কি শিখাইবেন?
দামি মানুষ কেমনে হইতে হয়।
কথাটা বলেই খিল খিল করে হেসে উঠল মৌসুমী। রুপক বলল, আপনি অনেক সুন্দর কইরা কথা কন।
এই ডায়ালগ অনেক শুনছি। নতুন কিছু থাকলে ঝাড়েন।
হেসে ফেললো রূপক, এই কথা কি দামি মানুষরা কইছে?
না, এগুলো আমি সস্তা মানুষের কথা। দামি মানুষ এইগুলা কয়না।
তারা কি কয়?
কইলাম তো জামাটা নিয়ে আইসেন। জামা ভালো হইলে শিখাইয়া দিমু নে। এখন রাখি।

মৌসুমী কল কেটে দিল। হাসি পাচ্ছে রূপকের। কোন এক অজানা কারণে তার মনটা আজকে ভীষণ ভাল হয়ে গেল। মনে হচ্ছে দীর্ঘদিনের ট্রমা কেটে গেছে। অকারণেই তার হাসি পাচ্ছে। কাজ করতে করতে মুখে সারাক্ষণ হাসির রেশ লেগে রইল। আজকে একটা জামা সেলাই করতে গিয়ে গুন গুন করে গান গাইতে লাগল রূপক। দোকানের ছেলেটা জানতে চাইল কিগো রূপক ভাই, আজ মনে এত খুশি?
আজকে কেন জানি মনটা বড়ই ভালো লাগতাছে।
আপনারে খুশি দেখলে আমারও ভালো লাগে ভাই।
রূপক আবার গুন গুন করে গান ধরল। মৌসুমির জামাটা হ্যাঙ্গার থেকে নিচে নামিয়ে সে ভালো করে দেখতে লাগল আসলেই জামাটা সুন্দর হয়েছে কিনা। জামায় কোন খুত থাকা যাবে না। নিখুঁত হতে হবে।

আজকে সন্ধ্যার পরপরই রূপক দোকান থেকে বের হলো। মৌসুমির জামাটা সঙ্গে নিয়েছে। তার বাবা বাজার করে সন্ধ্যার আগেই বাড়ি ফিরেছে। তারও আজ দোকানে মন বসলো না। বেচাকেনা খুব একটা নেই। বাড়ি ফেরার পথে রাস্তার ধারে হওয়া নতুন বাড়ির গেটে রূপক ডাক দিল। দরজা খুলে দিল মৌসুমী ও তার ছোট বোন। পরনে থ্রিপিস ও মাথায় ওড়না দেয়া মৌসুমীর মুখটা লাইটের আলোয় চিকচিক করছে। মনে হচ্ছে গালে ফেস পাউডার মেখে রেখেছে। যেন রূপকের অপেক্ষাতেই ছিল তারা।

মৌসুমী বলল, ভিতরে আসেন।
নতুন বাড়ি। চমৎকার রং করার কারণে বেশ আকর্ষণীয় লাগছে। বাড়ির বারান্দার মেঝে পাকা করা। তার ওপরে কাঠ দিয়ে বানানো লম্বা সোফা। সোফার ওপর কোন ফর্ম নেই। শক্ত সোফা। সেখানে রূপক কে বসতে দেয়া হলো। বারান্দার একদিকে একটা বড় খাবার টেবিল। টেবিলের ওপর পানির জগ ও গ্লাস। সৌরবিদ্যুতের আলো জ্বলছে। বারান্দা থেকে ঘরের ভিতরে তাকালে একটা সুন্দর কাঠের খাট চোখে পড়ল। সম্ভবত ডিজাইন করা বক্স খাট।
মঞ্জু মিয়ার স্ত্রী আসতেই রূপক তাকে সালাম জানালো। মহিলা বললেন, কেমন আছেন বাবা?
জি আছি ভালো আছি। আপনি কেমন আছেন?
ভালোই আছি।
চাচাজান বাড়িত নাই?
তিনি এখনো ফিরেন নাই। তা আপনার আব্বা আম্মা ভালো আছে?
হ, চাচি ভালো আছে।
আপনার আম্মারে কালকে আসতে কইয়েন। উনিত দুই দিন হইলো আসেনা।
আপনি তো একদিনও আমাগো বাড়িতে আইলেন না।
যামু। সারাদিন অনেক কাম কাজ থাকে। সময়ই পাই না। আর আপনার চাচাজান বাড়িতে থাকলে কোথাও বের হইতে পারি না।

মৌসুমী একটা ট্রেতে করে নাস্তা পানি নিয়ে এসে রাখল টেবিলে। তারপর রূপককে ডেকে বললো ভাইয়া নাস্তা খাইতে আসেন।
মহিলা বললেন যান বাবা নাস্তা খাইয়া লন।
চাচী এইসব কোন দরকার আছিল না।

রূপক বাড়িতে ঢোকার সময়ই মৌসুমীর হাতে জামার ব্যাগটা দিয়ে দিয়েছিল। নাস্তার প্লেট টেবিলে রেখেই মৌসুমী ঘরে গিয়ে নতুন জামা পরে ফেলল। তারপর জামাটা দেখতে দেখতে মাকে এসে দেখাতে লাগলো, মা দেখতো জামা কি ভালো হইছে। আমারে কেমন লাগতাছে?
সুন্দর লাগতাছে। তোর গায়ে ফুটছে।
আমারে সব জামাতেই সুন্দর লাগে।
মৌসুমীর ছোট বোন বলল, তোরে একটুও ভালো লাগতেছে না আপু।
তুই তো সেইটাই কইবি। তোরে বানাইয়া দেয় নাই সেইজন্য।
দুই বোন মিলে খুনসুটি শুরু করে দিল। মঞ্জু মিয়ার স্ত্রী চোখ রাঙ্গালেন। নাস্তার টেবিলের পাশে চেয়ার ধরে দাঁড়াল মৌসুমী। রূপক নাস্তা খাওয়া শুরু করেছে। সে বলল, শরবত কেমন হইছে?
ভালো। চিনি একটু বেশি হইছে।
সবাই কয় আমি অনেক মিষ্টি একটা মাইয়া। আমি যেইটাই ধরি সেইটাই মিষ্টি হইয়া যায়।
মৌসুমির মা খানিকটা রেগে বললেন, তুই ঘরে যা তো।
মৌসুমী হাসতে লাগলো। হাসতে হাসতে চলে গেল ঘরে।

মৌসুমির মা জামার সেলাইয়ের টাকাটা রূপকের হাতে এনে দিলেন। নাস্তা শেষ করে রূপক বলল, আজকে আমি যাই। মৌসুমী তখন ঘরে। আর বের হলো না। রূপকের ইচ্ছা করছিল মৌসুমীর সঙ্গে একটু কথা বলতে। সে কয়েকবার ঘরের দিকে তাকালেও মৌসুমীকে দেখতে পেল না।
রাস্তায় এসে মৌসুমীর নাম্বারে কল দিল রূপক। একবার রিং হতেই কলটা রিসিভ হল। খিলখিল হাসির শব্দ শোনা গেল ওপাশ থেকে।

চলবে..

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here