দ্বিপ্রহরের_রাত্রি,পর্ব-২

0
888

#দ্বিপ্রহরের_রাত্রি,পর্ব-২
#মুন্নি_আক্তার_প্রিয়া

ছেলেগুলো কিছু্ক্ষণ শ্রুতি এবং অরিত্রকে দেখে নিল। ওদের মধ্য থেকে একজন বলল,’সাথে যা আছে দিয়ে দে।’
অরিত্র বুঝতে পারল এরা ছিঁচকে চোর। এদিকে শ্রুতির গলা শুকিয়ে কাঠ। আরেকজন বলল,’ভালোই ভালো দিয়ে চলে যা। নয়তো এটা দেখছিস কী?’ কথা শেষ করে অন্ধকার থেকে একটা চাকু বের করল সে।

অবস্থা বেগতিক। কিছু না দিয়ে উপায় নেই। অরিত্র প্যান্টের পকেট থেকে মানিব্যাগ বের করে দিল। ছেলেটি বলল,’আর কিছু নাই? ফোন বের কর।’
‘নেই।’
‘ঐ চেক দে তো।’ আরেকটা ছেলেকে উদ্দেশ্য করে বলল লোকটা।
ছেলেটা অরিত্রকে চেক করে দেখল আসলেই কিছু নাই। এবার চাকু ধরে রাখা ছেলেটি শ্রুতিকে বলল,’হাতে কী? ব্যাগ দেন।’

শ্রুতি ঠোক গিলে বলল,’কেন?’
ওরা কিছু বলার পূর্বেই অরিত্র বলল,’দিয়ে দেন।’
একজন তখন ছোঁ মেরেই শ্রুতির হাত থেকে ব্যাগটা নিয়ে অন্ধকার জঙ্গলের মাঝে চলে গেল। ওরা চলে যেতেই শ্রুতি ভ্যা ভ্যা করে কেঁদে উঠল। কাঁদতে কাঁদতে বলল,’আপনার জন্য আমার টাকা-পয়সা, ফোন সব গেল। এখন আমি কীভাবে কী করব? জানেন ফোনটা আমার কত প্রিয় ছিল? ছোটো মামা বিদেশ থেকে পাঠিয়েছিল তিন মাস হবে।’
‘শুকরিয়া আদায় করেন যে, ওরা আপনাকে নিয়ে যেতে চায়নি।’

শ্রুতি এবার দমে গেল। কান্নাও বন্ধ হয়ে গেল। কথা সত্যি। সে বলল,’কীভাবে নিত? আপনি তো ছিলেন সাথে।’
‘এটা কি মুভি পেয়েছেন? আমি হিরো তাই দশ, বিশটা ভিলেনকে মেরে কুপোকাত করে দিলাম। ওরা পাঁচজন ছিল আর আমি একা। আপনাকে নিয়ে যেতে চাইলে আমায় মেরে আপনায় নিতে পারত।’

শ্রুতি নিশ্চুপ রইল। অসহায়ের মতো বলল,’টাকা ছাড়া আমি কীভাবে চলব?’

অরিত্র কিছু্ক্ষণ মৌন থেকে চিন্তাভাবনা করে বলল, ‘আপাতত আমার বাসায় চলুন। ভয় নেই। বাড়িতে মা, বাবা আর ছোটো ভাই আছে। কিন্তু আমি ভাবছি, আপনাকে কী বলে পরিচয় করিয়ে দেবো?’
তার মতো শ্রুতিও ভাবুক হয়ে ভাবতে লাগল কী বলা যায়। তারপর বলল,’আইডিয়া! আপনি বলবেন আমি আপনার প্রেমিকা। অন্যত্র আমার বিয়ে ঠিক হয়েছিল তাই পালিয়ে নিয়ে এসেছেন।’
‘ইশ! বুদ্ধির কাঁঠাল একদম।’
‘পছন্দ হয়নি?’
‘এসব প্রেম-ঘটিত কোনো বিষয় নেই আমার।’
‘আপনি কখনও প্রেম করেননি?’
‘আপনাকে একটা কথা বলি শুনুন, যদি কেউ কখনও বলে যে সে কখনও প্রেম করেনি বা কাউকে ভালোবাসেনি তাহলে সেটা ঠাহা মিথ্যা কথা। প্রেম না করলেও এক তরফাভাবে ঠিকই কাউকে ভালোবাসতো বা বাসে।’
‘তাহলে আপনার ব্যাপারটা কী?’
‘রিলেশন ছিল ৩টা। একটাও টিকেনি। থাক এসব কথা। পরবর্তী কোনো বিপদে পড়ার আগে বাড়িতে যাওয়া যাক। বাড়িতে যা বলার আমি বুঝিয়ে বলব।’

হাঁটতে হাঁটতে শ্রুতি বলল,’আমি কিন্তু কখনও প্রেম করিনি। বলতে গেলে সুযোগ পাইনি। সবসময় মামারা আমাদের বোনদের চোখে চোখে রাখত। প্রপোজ করেছে কেউ জানলে ঐ ছেলেকে শাসাতে দেখতাম। কেউ কেউ লুকিয়েও প্রপোজ করত। কিন্তু এক্সেপ্ট করার মতো সিচুয়েশন আমার ছিল না। রুমকি আপুর মতো ফোনে ফিসফিস করে কথা বলতে পারি না আমি। আমার ফোনে কথা বলা আর মাইকে কথা বলা একই বলা চলে। প্রাইভেটের নাম করে মিথ্যা বলে দেখাও করতে পারতাম না। কারণ মিথ্যা বলতে গেলেই আমি তুতলিয়ে যাই। তবে ভালো লাগতো অনেককেই। সেটা ভালোলাগা পর্যন্তই সীমাবদ্ধ ছিল।’

‘পালালেন কেন তাহলে?’
‘বিয়ে ঠিক হয়েছিল রুমকি আপুর সাথে। আপু তার বয়ফ্রেন্ডের সঙ্গে সকালে পালিয়ে গেছে। এদিকে পুরো গ্রামবাসী, আত্নীয়-স্বজন সবাইকে দাওয়াত দেওয়া হয়েছে। খাওয়ার আয়োজন করা হয়েছে। কত কী! সবাই মিলে ঠিক করল আমার সঙ্গে বিয়ে দেবে। মামা-মামি অনেক আকুতি-মিনতি করল। আমি তখন কিছুই বলিনি। বিকেলে যখন পার্লার থেকে লোক এসে আমায় সাজিয়ে গেল, তখন মনে হলো আসলে মামার সম্মান রক্ষার্থেও যদি বিয়েটা,করি তাহলে সংসার বেশিদিন করতে পারব না।টিকবে না। কারণ বোঝার পর থেকেই ইচ্ছে ছিল বিয়ে করলে ভালোবেসেই করব। আর তাই সন্ধ্যার মুহূর্তেই সকলের চোখে ফাঁকি দিয়ে পালিয়ে এসেছি।’

‘বুঝলাম। আপনি আপনার জায়গায় সঠিক। আবার আপনার মামা দিকটা ভাবলেও খারাপ লাগছে। যাই হোক, যা হওয়ার তা তো হয়েই গেছে। আজ রাতটা না হয় আমাদের বাসায় থাকলেন। তারপর কোথায় যাবেন?’

‘জানিনা। টাকা-পয়সা আমার কাছে আর কিছুই নেই। থাকলে না হয় একটা ব্যবস্থা হতো।’
অরিত্র আর কিছু বলল না। আরও দশ মিনিট হাঁটার পর ওরা বাড়িতে পৌঁছাল। দুই তলায় গিয়ে একবার কলিংবেল বাজাতেই ওপাশ থেকে দরজা খুলে দিল কেউ। মনে হচ্ছে, সে জানতোই এখন কেউ আসবে অথবা দরজা খুলে দেওয়ার জন্যই অপেক্ষা করছিল। কিছু বুঝে ওঠার পূর্বেই দরজার ওপাশ থেকে মধ্যবয়সী এক মহিলা আক্রমণাত্মকস্বরে বলল,’তোর কাণ্ড কী আমায় বলতো? তুই কি কোনোদিনও শুধরাবি না?’ শেষের কথাটা বলতে বলতেই সে শ্রুতির দিকে তাকাল এবং কথার সাউন্ড ধীরে ধীরে কমতে লাগল। সম্ভবত ইনিই অরিত্রর মা।

শ্রুতিকে দেখার পর তার চক্ষু চড়কগাছ। একই তো এত রাতে ছেলে একটা মেয়েকে বাড়িতে নিয়ে এসেছে, তার ওপর আবার বিয়ের সাজ! যেকোনো মায়েরই বিস্মিত হওয়ার কথা। শ্রুতি নিরীহর মতো দাঁড়িয়ে আছে। অরিত্রর মা অদিতি বেগম বিস্মিত কণ্ঠে বলেন,’এই মেয়ে কে? কাকে নিয়ে এসেছিস তুই বাসায়? ওর পরনে বিয়ের পোশাক কেন? আমাদের না জানিয়ে তুই বিয়ে করে ফেলেছিস?’

অরিত্রকে কিছুটা বিরক্ত দেখাল। ক্লান্ত ভঙ্গিতে বলল,’আগে আগেই এতকিছু ভেবে নিচ্ছ কেন? আমায় এক্সপ্লেইন করতে তো দাও।’
‘রাখ তোর এক্সপ্লেইন! তুই এই কাজটা কীভাবে করলি? তোর একটুও কলিজা কাঁপল না? আমাদের বললে কি তোকে বারণ করতাম?’
‘উফ মা! ভেতরে তো যেতে দেবে? মেয়েটা অনেক দূর থেকে এসেছে। ওর বিশ্রাম প্রয়োজন।’

অদিতি বেগম আড়চোখে একবার শ্রুতিকে দেখে নিয়ে দরজা ছেড়ে দাঁড়ালেন। অরিত্র শ্রুতিকে নিয়ে ভেতরে ঢুকল। ফ্ল্যাটটা খুব বেশি বড়ো নয়। দুটো রুম। একটা ছোটো কিচেন আর মাঝখানে অল্প জায়গাটুকুতে ড্রয়িংরুম। তাতেই সোফাসেটগুলো গাদাগাদি করে রাখা। আলো-বাতাস প্রবেশ করার মতো কোনো জায়গা চোখে পড়ল না। কেমন যেন ভ্যাপসা গরম। চারপাশ দেখতে দেখতেই অদিতি বেগম একজন পুরুষকে নিয়ে আসলেন। সন্দেহ নেই, ইনি হচ্ছে অরিত্রর বাবা। কেমন যেন গম্ভীর গম্ভীর চাহনী তার। হাত দুটো পেছনে একত্রিত করে রেখে তিনি গম্ভীরকণ্ঠে অরিত্রকে বললেন,’তুমি নাকি বিয়ে করেছ? এই মেয়েটি কি তোমার বউ?’

অরিত্র বিরক্তিসূচক ‘চ’ এর মতো শব্দ করে বলল,’মা! বাবাকেও কথাটা লাগিয়ে দিয়েছ?’
অদিতি বেগম ভ্রুঁ কুঁচকে বললেন,’তো বলব না? তুই এত বড়ো কাণ্ড করে বসবি আর আমি চুপ করে থাকব? এলাকায় আমি মুখ কী করে দেখাব রে বাবা!’ শেষের কথাটি একই সঙ্গে কান্না এবং আফসোসেরস্বরে বললেন তিনি।

অরিত্রর বাবা সুলায়মান রহমান বললেন,’আহ্! থামো তো। রাত-বিরাতে ন্যাকা কান্না বন্ধ করো।’
এরপর অরিত্রর কাছে এগিয়ে এসে পিঠ চাপড়ে বললেন,’সাব্বাস ব্যাটা, সাব্বাস! এই না হলো আমার ছেলে। ভালোবাসার মানুষকে কোনোভাবেই অন্যের হতে দেওয়া যাবে না। নেভার! তবে, তোর ওপর রাগ করেছি। আমায় বললি না কেন? আমিও যেতাম বৌমাকে নিয়ে আসতে।’

শ্রুতির এবার অবাক হওয়ার পালা। এই লোক বলে কী? মাথা ঠিক আছে উনার? অরিত্র ওর বাবার হাত সরিয়ে দিয়ে বলল,’তোমরা বেশি বেশি ভাবছ। আমি বিয়ে করিনি। উনার নাম শ্রুতি। রাস্তায় দেখা হয়েছে। যাওয়ার মতো জায়গা নেই তাই বাড়িতে নিয়ে এসেছি। আজকের রাতটা আমাদের বাসাতেই থাকবে।’
‘অ্যা! তুই বিয়ে করিসনি তাহলে?’

অদিতি বেগম কথার মাঝে ফোঁড়ন কেটে বললেন,’তুমি ওর কথা বিশ্বাস করছ? মিথ্যে বলছে এখন। যেই বুঝতে পেরেছে মেনে নেব না, ওমনি এখন গল্প বানাচ্ছে।
এই মেয়ে, তুমি বলো তোমাদের বিয়ে হয়নি?’
শ্রুতি থতমত খেয়ে বলে,’অ্যা মানে হ্যাঁ, না!’
‘কী অ্যা হ্যাঁ করছ? তুমিও দেখি অরিত্রর মতোই।’
অরিত্র ধমক দিয়ে বলল,’কী শুরু করলে তুমি? আমায় বিশ্বাস করো না? তোমরা ভালো করেই জানো, আমি তোমাদের থেকে কিছু লুকাই না। সব বলি। সেখানে একটা মেয়েকে নিয়ে আমি পালিয়ে আসব আর তোমাদের জানাব না?’

এবার তিনি দমে গেলেন কিছুটা। অরিত্র বলল,’এই ব্যাপারে আর কিছু জানার থাকলে সকালে কথা হবে। এখন তুমি কিছু খাওয়ার ব্যবস্থা করো। নাকি সেটাও পারবে না?’
তিনি কিছু বললেন না। তবে খাওয়ার ব্যবস্থা করতে রান্নাঘরে গেলেন। অরিত্র বাবাকে বলল,’আব্বু তুমি আজ আমার সাথে আমার ঘরে ঘুমাও। শ্রুতি তোমাদের ঘরে মায়ের কাছে থাকুক।’
‘হ্যাঁ, থাকুক। সমস্যা কী? সমস্যা নেই তো।’

তিনি সোফায় বসলেন আরাম করে। ঘটনা সত্য নাকি মিথ্যা যাচাই করতে হবে। এজন্য কথা বলা প্রয়োজন। খেতে খেতে যতটুকু পারা যায় কথা পেট থেকে বের করবে ভেবে নেন। অরিত্র শ্রুতিকে নিয়ে বাবা-মায়ের ঘরে গিয়ে বলল,’আপনি এখানেই থাকবেন। ঐযে বাথরুম। ফ্রেশ হয়ে নিন।’
‘একটা কথা বলব?’
‘শিওর।’
‘আপনার বাবা প্রথমে কেমন গম্ভীর হয়ে কথা বললেন। পরে আবার মেনেও নিলেন যে আমরা পালিয়ে এসেছি।’
অরিত্র হেসে ফেলল। বলল,’আমার বাবা ওমনই। অনেক বেশি মিশুক আর রসিক। পরিচিত না হলে বুঝবেন না। আমার মাকে ভুল বুঝবেন না। সেও খুব ভালো। তবে একটু অভিমানী। আমার বিয়ে নিয়ে তার অনেক স্বপ্ন।’
‘বুঝতে পেরেছি।’
‘আচ্ছা ফ্রেশ হয়ে নিন তাহলে।’
‘আরে শুনুন, শুনুন।’

অরিত্র যাওয়ার জন্য এক কদম এগিয়েছিল। শ্রুতির ডাক শুনে ফিরে তাকিয়ে বলল,’কিছু বলবেন?’
শ্রুতি চোখ দুটো ছোটো ছোটো করে অনুরোধেরস্বরে বলল,’মাথার ক্লিপগুলো খুলে দিবেন প্লিজ? পার্লার থেকে ঘোমটার সাথে এমনভানে লাগিয়েছে যে আমি খুলতেই পারছি না। পথে অনেকবার চেষ্টা করেছি। পারিনি। এত বড়ো ঘোমটা নিয়ে ওয়াশরুমেই বা যাব কীভাবে? এটাই শেষ সাহায্য!’
‘আরে আপনি এভাবে বলছেন কেন? দিন আমি খুলে দিচ্ছি।’

অরিত্র নিজেই এগিয়ে গেল। শ্রুতির চুলের খোঁপায় গোলাপফুল লাগানো ছিল। ফুলের সঙ্গেও ঘোমটার এক অংশ ক্লিপ দিয়ে লাগানো। অরিত্র ঘাড় বাঁকা করে খোঁপার ক্লিপগুলো খুলছিল। পেছন থেকে দেখলে নিঃসন্দেহে মনে হবে ঘাড়ে চুমু খাচ্ছে। বিধির কী নিয়তি! তখনই খেতে যাওয়ার জন্য ডাকতে আসেন অদিতি বেগম। এই অবস্থা দেখতে ভড়কে গিয়ে বলেন,’করছিস কী রে তোরা!’

চলবে…

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here