#দ্বিপ্রহরের_রাত্রি,পর্ব-৭,৮
#মুন্নি_আক্তার_প্রিয়া
৭.
আজকের সকালের সঙ্গে যেন কোথাও সুখের আবেশ নেই। সকলদিকে বিরহের ছাপ। এই বাড়ির আর কেউ খুশি না হলেও শ্রুতি ভীষণ খুশি। তাই বলে এমনটা নয় যে, তার খারাপ লাগছে না। বরঞ্চ তার ভালো, খারাপ দুই-ই অনুভূত হচ্ছে। খাওয়ার সময় যতটা সম্ভব পরিবেশটা জমজমাট করার চেষ্টা করেছে সবাই। শ্রুতিকে নতুন জামা পড়ে রেডি হতে দেখে অনিক বারবার জিজ্ঞেস করছে,’কোথায় যাবেন ভাবি?’
শ্রুতি কেন জানি কোনো প্রত্যুত্তর করতে পারেনি। যাওয়ার সময়ে যখন অনিক বুঝতে পারে শ্রুতি চলে যাচ্ছে তখন সেও বায়না ধরে সাথে যাওয়ার জন্য। কিন্তু এই অবুঝকে কে বোঝাবে সে যে একেবারের জন্য চলে যাচ্ছে; বেড়াতে নয়।
সুলায়মান রহমান শ্রুতির মাথায় হাত বুলিয়ে বললেন,’ভালো থেকো মা। বাড়িতে গিয়ে যোগাযোগ রেখো।’
শ্রুতির ভীষণ রকম কান্না পাচ্ছে এখন। সে নিজেকে দমিয়ে রাখতে পারে না। ফুঁপিয়ে কেঁদে ওঠে। অদিতি বেগমও এবার নিজেকে সংবরণ করে রাখতে পারেন না। শ্রুতিকে জড়িয়ে ধরে কাঁদেন। পরক্ষণেই নিজেকে সামলে নিয়ে শ্রুতির চোখের পানি মুছিয়ে দিয়ে বলে,’এতই যখন কান্না পাচ্ছে তাহলে চলে যাচ্ছ কেন? থেকে যাও একেবারে।’
শ্রুতি কোনো উত্তর না করে নিরবে কাঁদছে। তিনিও এই বিষয়ে আর কোনো কথা বললেন না। মাথায় হাত বুলিয়ে বললেন,’সাবধানে যাবে। পারলে সবাইকে নিয়ে একবার এসো।’
সবার থেকে বিদায় নিয়ে শ্রুতি অরিত্রর সঙ্গে চলে যায়। অরিত্র বাসায় কোনো কথা বলেনি সকাল থেকে। বাসে বসেও চুপ করেই রইল। জানালার পাশে বসে বাইরে তাকিয়ে আছে শ্রুতি। কাল পর্যন্তও তার অন্য রকম আনন্দ লাগছিল। কিন্তু এখন এতটা কষ্ট লাগছে যেটা সে হয়তো ভাষায়ও প্রকাশ করতে পারবে না। অরিত্র একবার আড়চোখে তাকিয়ে দৃষ্টি সরিয়ে নিল। ভারী দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে আসে তার। অনেকক্ষণ বাদে শ্রুতি নিজেই কথা বলে।
‘আপনার সাহায্যের কথা আমি কোনোদিন ভুলতে পারব না। সেদিন আপনি না থাকলে কী হতো আমি জানিনা। তবে আপনাকে পাওয়ার পর আমি নতুন একটা পরিবারের সাথে পরিচিত হওয়ার সুযোগ পেয়েছি। আপনার পরিবারকে কখনও আমার অন্য পরিবার মনে হয়নি। নিজের আপনজন মনে হয়েছে সবসময়। আপনার বাবা-মায়ের প্রসংশা আমি যত করব, ততই কম হবে। বাবা-মায়ের ভালোবাসা কী আমি জানিনা। তবে মামা-মামি কখনই সেই অভাববোধ আমায় টের পেতে দেয়নি। এই দেড় মাস যে আমি মামা-মামিকে ছাড়া ছিলাম তবুও মনে হয়নি আমি দূরে। বাবা-মায়ের ভালোবাসার সংস্পর্শেই ছিলাম। আপনার বাবা-মায়ের কথাই বলছি।’
শ্রুতি কথা শেষে আবার নিরব হয়ে গেল। অরিত্রও শুনল। তবে তার বলার মতো কিছুই নেই। তাই সে পূর্বের ন্যায় নিরব-ই রইল। শ্রুতিও তার মনোভাব কিছু বুঝতে না পেরে নিরব হয়ে গেল। দ্রুত থেকে আরও দ্রুত সময় ঘনিয়ে এলো। ওরা পৌঁছে গেছে গ্রামে। এবার শ্রুতি খুশি। টানটান উত্তেজনা কাজ করছে তার ভেতর। অস্থিরও লাগছে। এতকিছুর মাঝেও শ্রুতির খুশি খুশি মুখাবয়ব দৃষ্টি এড়িয়ে যায়নি অরিত্রর। বাড়ির সামনে গিয়ে শ্রুতি থেমে যায়। অরিত্র ক্লান্ত গলায় জিজ্ঞেস করে,’এটাই আপনার বাড়ি?’
উপর-নিচ মাথা নাড়াল শ্রুতি। চোখ চিকচিক করছে। অরিত্র ভরসা দেয়। নিজেই আগে এগিয়ে যায়। সামনে থেকে বলে,’আসুন।’
বিশাল বড়ো উঠানের মাঝে দুই তলা একটা বাড়ি। উঠানে তো গাছ আছেই, ছাদেও বড়ো বড়ো গাছ লক্ষ্য করা যাচ্ছে। ঠিক সেই সময়ে বাড়ি থেকে বের হয় বড়ো মামি। শ্রুতি ছিল অরিত্রর আড়ালে। তাই অরিত্রকেই তার নজরে পড়ল। তিনি জিজ্ঞেস করলেন,’কারে চাও?’
অরিত্র কথা বলার পূর্বেই শ্রুতি আড়াল থেকে বের হয়ে বলল,’মামি!’
বড়ো মামি চোখ বড়ো বড়ো তাকান। বিস্ময়ে চোখ ছানাবড়া তার। বিস্মিত কণ্ঠে বলে উঠেন,’শ্রুতি! তুই?’
শ্রুতির ভয় লাগছে। এখনই বাড়ির সবাইকে ডাকবে মামি। মামারা’ও চলে আসবে। কী আছে কপালে কে জানে! শ্রুতির ভাবনা শেষ হওয়ার পূর্বেই মামি চিৎকার করে সবাইকে ডেকে বলেন,’সবাই নিচে আয় রে। শ্রুতি আইছে।’
তিনি এগিয়ে এসে শ্রুতিকে জড়িয়ে ধরেন। আনন্দে কেঁদে ফেলেন।
মামারা কেউ বাসায় ছিলেন না। দাদা-দাদী, মামি আর মামাতো ভাই-বোনেরা ছিল। মামির ডাক শুনে সবাই নিচে নেমে আসে। খুশিতে একই সাথে তারাও কিংকর্তব্যবিমূঢ়। দাদী শ্রুতিকে জড়িয়ে ধরে কেঁদে কেঁদে বলেন,’কই চইলা গেছিলি তুই হারামজাদী? আমগোরে ছাইড়া তুই কেমনে গেলি?’
শ্রুতি কাঁদছে। কিছু বলছে না। অদূরে দাঁড়িয়ে সকলের শোক দেখছে অরিত্র। কান্নাকাটি থামিয়ে সকলে যখন নিজেদের সামলে নিল তখন মামি জিজ্ঞেস করে,’এই ছেলে কে?’
পরিচয় করিয়ে দেওয়ার পূর্বেই দুই মামা বাজার থেকে বাড়িতে ফিরেন। বড়ো মামার ছেলেই ফোন করে খবর জানিয়েছিল। শ্রুতির এবার ভয় লাগছে। বড়ো মামা ভীষণ রাগী স্বভাবের। কিন্তু তার ভয়কে লবডঙ্কা দেখিয়ে বড়ো মামা কান্নায় ভেঙে পড়েন। শ্রুতির বুক মোচর দিয়ে ওঠে। বাচ্চাদের মতো ঠোঁট ফুলিয়ে নিজেও কেঁদে ফেলে। এগিয়ে গিয়ে মামাকে জড়িয়ে ধরে বলে,’সরি মামু।’
অরিত্র অবাক হয় ভীষণ। মামা-মামিও কখনও এত ভালোবাসতে পারে? আজ স্বচক্ষে না দেখলে হয়তো তারও এই ব্যাপারে অজানা থাকত। এত ভালোবাসার মানুষগুলো যেখানে থাকে সেখান থেকে দূরে থাকা তো কষ্টকর হবেই। এজন্যই শ্রুতি আর দূরে থাকতে পারছিল না। এদিকে মামারা-সহ বাড়ির সকলে অরিত্রকে শ্রুতির স্বামী ভেবে নিয়েছে। কোনো কিছু জিজ্ঞেস করেনি। বিস্তারিত কিছু জানতেও চায়নি। ভেতরে নিয়ে গেছে দুজনকে। বাড়ির ভেতর তখন বিশাল আয়োজন চলছিল। কৌতুহল দমিয়ে রাখতে না পেরে মেজ মামার মেয়ে রিমিকে শ্রুতি জিজ্ঞেস করল,’এত আয়োজন কীসের রে?’
‘বৃষ্টি আপু আজ আসবে শ্বশুর বাড়ি থেকে।’
‘বৃষ্টির বিয়ে হয়ে গেছে? কবে?’
রিমি ক্লাস সেভেনে পড়ে। তবে প্রচুর পাকা পাকা কথা বলে। দুষ্টুমিতেও সেরা। বিছানার ওপর দু’পা তুলে বসে বলল,’আর বলো না আপু, ঐদিন কী যে হয়ে গেছে!’
‘কোন দিন? কী হয়েছে?’
‘যেদিন রুমকি আপুর বিয়ে হওয়ার কথা ছিল। রুমকি আপু পালিয়ে গেল। এরপর তুমিও পালিয়ে গেলে। এদিকে বড়ো মামা পড়েছিল অথৈ সাগরে। রুমকি আপু আর তোমার কষ্টে খুব ভেঙে পড়ছিল। বরযাত্রীরাও চলে আসছিল। গ্রামের মানুষরা নানান রকম কথা বলছিল। তখন অনেকেই বলল বৃষ্টি আপুর সঙ্গে বিয়ে দিতে। মামা রাজি হতে চায়নি। তোমরা দুজন পালিয়ে যাওয়ার পর একই ভুল আর করতে চায়নি। তখন বৃষ্টি আপু বলেছে যে, ইচ্ছাকৃতভাবেই বিয়ে করবে।’
‘তার মানে ঐদিন বৃষ্টির সঙ্গে বিয়ে হয়েছে?’
‘হ্যাঁ। এখন বলো তো, তুমি প্রেম করলে কীভাবে?’
‘কীসের প্রেম করেছি?’
‘ইশ, ন্যাকু! এখন আর ন্যাকামো করে কী হবে আপু? তবে যাই বলো, দুলাভাই কিন্তু হেব্বি।’
‘একটা থাপ্পড় দিয়ে গাল লাল করে ফেলব। না জেনেই উল্টাপাল্টা কথা বলছিস। আমি কোনো প্রেম করিনি। আর অরিত্রও আমার স্বামী নয়।’
‘মানে? তাহলে সে কে?’
‘পালিয়ে যাওয়ার পর তার বাড়িতেই ছিলাম।’
‘মামারা যে তাকে সাথে করে নিয়ে গেল।’
শ্রুতিও এবার ভয় পাচ্ছে। যদি অরিত্রকে মারধোর কিছু করে? ভুলবশত অরিত্রর কোনো ক্ষতি হোক সেটা তো সে চায় না। তাই সত্যটা জানানোর জন্য রিমিকে নিয়ে ঘর থেকে বের হয়।
ক্যাঁচক্যাঁচ শব্দে বড়ো রুমের ফ্যানটা চলছে। এই শব্দটা এক সময়ে বাড়ির লোকদের বিরক্ত লাগলেও এখন লাগে না। বরঞ্চ সকলের অভ্যাস হয়ে গেছে।দুই মামার সামনে অরিত্র সুবোধ বালকের মতো বসে আছে। মেজো মামা জিজ্ঞেস করলেন,’নাম কী তোমার?’
‘জি, অরিত্র আহমেদ।’
‘কোথায় থাকো? করো কী?’
‘ঢাকায় থাকি। দেড় মাস হবে একটা প্রাইভেট কোম্পানিতে চাকরী করি।’
‘পরিবারে কে কে আছে?’
‘বাবা-মা, আমি আর ছোটো ভাই।’
‘শ্রুতির সাথে পরিচয় কীভাবে তোমার? সম্পর্ক ছিল কতদিনের?’
এবার অরিত্র চুপ হয়ে যায় কিছুক্ষণের জন্য। বড়ো মামা এই পর্যন্ত কিছুই বলেননি। শুধু তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে রয়েছেন। কিছুটা সময় নিয়ে অরিত্র বলল,’শ্রুতির সাথে আমার কোনো সম্পর্ক ছিল না। আর আমরা পূর্বপরিচিতও ছিলাম না। শ্রুতি যেদিন পালিয়ে যায় সেদিনই তাকে প্রথম দেখেছি।’
‘এসব কি শ্রুতি তোমায় শিখিয়ে এনেছে?’ জিজ্ঞেস করলেন মেজো মামা।
‘না। যেটা সত্যি সেটাই বলেছি।’
এবার বড়ো মামা প্রথম অরিত্রর সঙ্গে কথা বললেন এবং জিজ্ঞেস করলেন,’কোনো সম্পর্ক যদি না-ই ছিল তাহলে শ্রুতি কোথায় ছিল এতদিন?’
‘আমার বাড়িতেই।’
‘কী পরিচয়ে? তোমার বাবা-মা’ও মেনে নিয়েছিল?’
অরিত্র ইতস্তত করতে থাকে। সত্যটা জানলে তারা শ্রুতিকে ভুল বুঝতে পারে। শ্রুতি যে তার বাড়িতে তারই বউয়ের পরিচয়ে ছিল এটা বলা যাবে না বলেই মনে মনে সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলে। বলে,’তার শহরে পরিচিত কেউ ছিল না। এজন্যই বাবা-মা আপত্তি করেনি।’
অরিত্রর কথা বিশ্বাসযোগ্য বলে মনে হলো না দুই মামার। বড়ো মামা মেজ মামাকে বললেন,’শ্রুতিকে ডেকে আন।’
শ্রুতিকে খুঁজে পাওয়া যায় মামির ঘরে। কাজিন, মামিরা, দাদী সবাই ওকে জেঁকে বসেছে। শ্রুতিও এখানে সত্যটা স্বীকার করেছে। কিন্তু কেউ বিশ্বাস করতে নারাজ। মেজ মামা তাকে বড়ো ঘরে নিয়ে এলেন। স্বভাবসুলভভাবেই শ্রুতি মাথা নত করে দাঁড়িয়ে রইল। মামা ডেকে পাশে বসালেন। আদুরে ভঙ্গিতে মাথায় হাত বুলিয়ে বললেন,’তুই অন্য কাউকে ভালোবাসিস এটা আমায় আগে বলিসনি কেন? তাহলে তো আর তোর অন্য জায়গায় বিয়ে দিতে চাইতাম না। চলে গিয়েছিলি কি আমাদের শাস্তি দিতে? আর যখন ফিরে এলি তখনও সত্যিটা লুকাচ্ছিস। তুই কি ভেবেছিস, সত্যিটা জানলে আমরা মেনে নেব না?’
শ্রুতি বিশ্বাস করানোর জন্য অস্থির হয়ে বলল,’মামু বুঝতে ভুল হচ্ছে তোমাদের। সত্যিই আমরা বিয়ে করিনি। আমাদের মধ্যে কোনো সম্পর্কও নেই।’
এবার বাড়িসুদ্ধ লোকের বিশ্বাস না করে আর উপায় ছিল না। বাড়ির প্রত্যেকে অরিত্রকে কৃতজ্ঞতা জানায়। আপ্যায়ন করেন জাঁকজমকভাবে। দুপুরের খাবার খেয়েই অরিত্র যাওয়ার জন্য বের হয়ে পড়ে। বাড়ির সকলেই বলেছিল আজকের দিনটা থেকে যেতে। কিন্তু অরিত্র রাজি হয়নি। কাল সকালে অফিসে থাকতেই হবে। নতুন চাকরী। ছুটির সিচুয়েশন এখন নেই বললেই চলে। অরিত্রর কাজের প্রতি আগ্রহ এবং দক্ষতার জন্য অল্প সময়েই বসের প্রিয় হয়ে উঠেছিল। এজন্যই আজ ছুটি পেয়েছে। কিন্তু এবসেন্ট করলে তখন চাকরী নিয়ে নির্ঘাৎ টানাটানি পড়বে। সব জানার পর আর কেউ জোর করল না। দুই মামার সঙ্গে শ্রুতি আর রিমিও স্ট্যান্ডে আসে অরিত্রকে এগিয়ে দেওয়ার জন্য এবং বৃষ্টিকে এগিয়ে আনার জন্য। টিকিট কেটে বাসে ওঠার পূর্বে অরিত্র শ্রুতির দিকে তাকায়। মেয়েটা আজ ভীষণ খুশি। প্রিয় মানুষদের ফিরে পাওয়ার আনন্দ তাঁর চোখে-মুখে স্পষ্ট। এজন্য অরিত্রর নিজেরও আনন্দ লাগছে। তবুও মনে হচ্ছে কী যেন ছেড়ে যাচ্ছে। মায়ার টান? হবে হয়তো। বাসে উঠে হাত নাড়িয়ে বিদায় জানায় সে শ্রুতিকে। প্রত্যুত্তরে শ্রুতিও হাত নাড়ায়। আস্তে আস্তে বাসটি দৃষ্টি সীমানার বাইরে চলে যায়।
অরিত্র চলে যাওয়ার মিনিট পাঁচেক পরেই বৃষ্টি আসে। গাড়িটা কেমন যেন চেনা চেনা লাগল শ্রুতির। পরক্ষণে নিজেই ভাবল, এক রঙের গাড়ির কি আর অভাব আছে নাকি? সবার আগে নামল বৃষ্টির স্বামী তিতাস। তারপর নামল বৃষ্টি। ইতিমধ্যে বৃষ্টিও ফোনে খবর পেয়েছে যে শ্রুতি ফিরে এসেছে। সে দৌঁড়ে এসে শ্রুতিকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে জিজ্ঞেস করে,’কেমন আছিস?’
বৃষ্টি আর শ্রুতি সম্পর্কে খালাতো বোন। বৃষ্টি ওর এক বছরের ছোটো হলেও দুজন দুজনকে তুই এবং নাম ধরে ডেকেই সম্বোধন করে। শ্রুতিও আনন্দিত হয়ে বলল,’ভালো আছি রে। তুই কেমন আছিস?’
‘অনেক ভালো আছি। তোকে পেয়ে এখন আরও ভালো আছি।’
শ্রুতি হাসল। পেছনে তাকিয়ে তিতাসের উদ্দেশ্যে জিজ্ঞেস করল,’ভালো আছেন দুলাভাই?’
তিতাস হাস্যরসাত্মকভাবে বলল,’হ্যাঁ, ভালো আছি আমার না হওয়া বউ।’
শ্রুতির সঙ্গে এবার রিমি আর বৃষ্টিও শব্দ করে হেসে ফেলল। শ্রুতির হাসি মিলিয়ে যায় গাড়ি থেকে নামতে দেখা আরও একজন তরুণকে দেখে। শ্রুতি যদি ভু্ল না হয় তাহলে এটা সেই ছেলে, যার সাথে পালানোর দিন দেখা হয়েছিল। এবং এটাই তাহলে সেই গাড়ি। ড্রাইভার গাড়ি থেকে নামার পর শ্রুতি পুরোপুরি শিওর হয়ে যায়। সে বৃষ্টিকে কনুই দিয়ে গুঁতা দিয়ে বলল,’এটা কে?’
বৃষ্টি পেছনে তাকিয়ে দেখে বলল,’আমার দেবর। পিয়ুশ ভাইয়া।’
পিয়ুশের সঙ্গে শ্রুতির চোখাচোখি হতেই ভ্রুঁ কুঁচকে তাকায় পিয়ুশ।
চলবে…
#দ্বিপ্রহরের_রাত্রি
#মুন্নি_আক্তার_প্রিয়া
৮.
জার্নি করে শরীর কেমন ঝিম ধরে গেছে অরিত্রর। ঢাকা থেকে শ্রুতিদের বাড়িও কম দূরে নয়। সেখানে একদিনেই যাওয়া আবার ফিরে আসাটা ক্লান্তির কারণ তো হবেই। বাড়ি ফিরেই অরিত্র ঘুমিয়ে নিয়েছে। অদিতি বেগম শুধু জিজ্ঞেস করেছিলেন,’ঠিক মতো পৌঁছে দিয়ে এসেছিস?’
অরিত্র শুধু মাথা নাড়িয়েছিল। যার অর্থ ‘হ্যাঁ’ কে নির্দেশ করে। বালিশে মাথা রেখে ক্লান্ত হওয়া চক্ষুযুগলকে বন্ধ করে নেয় সে।চোখের পাতায় ভেসে ওঠে তখন শ্রুতির মুখটি। ফিরে আসার পথেও ভীষণ শূন্য শূন্য লাগছিল। পাশের সিটে তখন আর শ্রুতি ছিল না। এতদিন একই সাথে থেকে মায়া জন্মে গেছে। মানুষের মন তো এমনই। ভাবনার মাঝেই একসময় অরিত্র ঘুমিয়ে পড়ে।
.
বাড়ি আসার পর থেকে পিয়ুশ চোখগুলো ছোটো ছোটো করে শ্রুতির দিকে তাকিয়ে রয়েছে। এতে বেশ অস্বস্তিই হচ্ছিল তার। কিন্তু মুখ ফুটে কিছু বলার উপায় নেই আবার কোথাও যাওয়ারও উপায় নেই। বৃষ্টি তো একদমই হাত ছাড়া করছে না তাকে। পাশে বসিয়ে রেখেছে। খাওয়ার সময় হোক কিংবা গল্পের সময়ে হোক। হাত ছাড়েনি একবারও। এখানেই বোঝা যায় বৃষ্টির সাথে শ্রুতির সখ্যতা ঠিক কতটা ছিল। বৃষ্টি ক্লান্ত না হলেও শ্রুতি ক্লান্ত ছিল। লং জার্নি করলেই তার ভীষণ ঘুম পায়। না পেরে আর বলেই বসল,’আমার খুব ঘুম পাচ্ছে রে। তুইও রেস্ট নিয়ে নে এখন। ঘুম থেকে উঠে কথা হবে।’
‘ঘুমাবি এখন? আচ্ছা ঘুমিয়ে পড় তাহলে।’
গল্প করছিল এতক্ষণ বড়ো মামার ঘরেই। শ্রুতির ঘরটা একদম শেষের দিকে। সেখানেই দাঁড়িয়ে ছিল পিয়ুশ। দেখেই বোঝা যাচ্ছে সে শ্রুতির জন্যই অপেক্ষারত অবস্থায় আছে। এমনকি শ্রুতি নিজেও চাচ্ছিল এই ব্যাপারটা নিয়ে ক্লিয়ার কথা বলতে। অন্য কোনো প্রসঙ্গ না তুলেই ডিরেক্ট জিজ্ঞেস করল শ্রুতি,’কিছু বলবেন?’
‘আমি যদি ভুল না হই তাহলে আপনি…’
‘হ্যাঁ, আমিই সে মেয়ে।’
‘কোন মেয়ে?’
‘যার কথা আপনি ভাবছেন।’
‘আমি তো কারো কথা ভাবিনি।’
পিয়ুশের এ কথায় ভ্রুযুগল কুঁচকে তাকায় শ্রুতি। পিয়ুশের চোখেমুখে দুষ্টুমির ছাপ। এর মানে কী? সে ইচ্ছে করে মজা নিচ্ছে? শ্রুতিকে নিরব হয়ে যেতে দেখে পিয়ুশ বলল,’আমি তো বলতে চাচ্ছিলাম, আমি যদি ভুল না হই তাহলে আপনি আমার বেয়াইন হন।’
‘সেই পরিচয় তো আরও আগেই পেয়েছেন। নতুন করে এটা এখন জানার কিছু নেই নিশ্চয়ই?’
‘আপনি ক্ষেপে যাচ্ছেন বেয়াইন।’
‘আপনি মশকরা করছেন।’
‘আপনার সাথে আমার সম্পর্কটা তো মশকরারই। আদারওয়াইজ, আমরা বেয়াই-বেয়াইন।’
‘আচ্ছা। আমি এখন যাই। ঘুমাব।’
শ্রুতি সাইড দিয়ে চলে যাওয়ার সময়ে পিয়ুশ পেছন থেকে বলল,’সেদিন কামড়টা কিন্তু বেশ জোরেই দিয়েছিলেন।’
শ্রুতি এক মুহূর্তের জন্য পিয়ুশের দিকে তাকাল। সে মুচকি মুচকি হাসছে। না, শ্রুতি এখানে কোনো প্রত্যুত্তর করেনি। তার এখন কথা বলতে ভালো লাগছে না। ইচ্ছে করছে না।
ঘুমাতে যাওয়ার পর সঙ্গে সঙ্গেই সে ঘুমিয়ে পড়ে। যখন ঘুম ভেঙেছে তখন সন্ধ্যা। আলস্য ভঙ্গিতে বিছানায় উপুর হয়ে শুয়ে ছিল। বুকের ভেতরটায় কেমন যেন হাহাকার করছে। ঘরে তখন বড়ো মামি আসেন। ব্যস্ততার সাথে বলেন,’তোর ঘুম হয়নি? এখনও শুয়ে আছিস। উঠ তাড়াতাড়ি। ফ্রেশ হয়ে নাস্তা করতে আয়।’
শ্রুতি ঘুম জড়ানো কণ্ঠে বলল,’যাও। আসছি।’
বড়ো মামি চলে গেলেন। এখন আরও বেশি খারাপ লাগছে শ্রুতির। অদিতি বেগমের কথা মনে পড়ছে খুব করে। সন্ধ্যা হলেই সকল কাজকর্ম সেরে দুজনে গল্পের ঝুড়ি নিয়ে বসতেন। চা খেতে খেতে কখনও কখনও শ্বশুরবাড়ির কথা, বিয়ের আগের কথা, বিয়ের পরের কথা, অরিত্রর ছোটোবেলার কথা কিংবা রাজা-রানির গল্প শোনাতেন শ্রুতিকে। কখনও কখনও দুজনে মিলে টিভিতে দেখত সিরিয়াল কিংবা কার্টুন। আজ সেই মানুষটা নেই। তার থেকে অনেক দূরে রয়েছে শ্রুতি। সুলায়মান রহমান! যার থেকে সে বাবার ভালোবাসা পেয়েছে। যে সবসময় হাসির কথা বলত। হাসাতো সবাইকে। আজ তার কথা শুনে ঐ বাড়ির বাকি সবাই হাসতে পারলেও শ্রুতি পারবে না। অনিক এখন কী করছে? এই পিচ্চিটা তো সবসময় শ্রুতির গা ঘেঁষে বসে থাকত। স্কুলে দিয়ে আসার জন্য বায়না করত। বন্ধুরা পরে যখন জিজ্ঞেস করত তোর সাথে ঐ সুন্দরী আপুটা কে এসেছিল রে? অনিক গর্বের সাথে বলত আমার ভাবি হয়। বাড়িতে ফিরে আসার পরে এসব কথা আবার শ্রুতিকে বলত। নিজের খাওয়ার টাকা দিয়ে শ্রুতির জন্য চকোলেট কিনত। এখন থেকে অনিক কার জন্য চকোলেট কিনবে? পরে রইল বাকি অরিত্র! সে আসলে কেমন? জানা নেই বিশেষ কিছু। তবে ভালো সে।
স্মৃতিচারণ করতে গিয়েই আরও বেশি খারাপ লাগছিল শ্রুতির। দম বন্ধ করা অনুভূতি হচ্ছিল। বলা চলে তার কান্নাও পাচ্ছে। আর শুয়ে না থেকে উঠে গিয়ে ফ্রেশ হয়ে নেয়। চোখেমুখে ভালোমতো পানির ঝাপটা দেয়। বের হয়ে দেখে ঘরে আগে থেকেই বৃষ্টি আর রিমি বসে আছে। বৃষ্টি অভিযোগের সুরে বলে,’তুই কত ঘুমাতে পারিস রে? কয়বার এসেছিলাম আমি জানিস?’
‘জার্নি করলে এমনই হয়। ঘুম পায় আমার।’
‘আচ্ছা এখানে বোস এখন। তোর গল্প বল।’ শ্রুতির হাত ধরে বিছানায় বসিয়ে বলল বৃষ্টি। শ্রুতি তোয়ালে দিয়ে মুখ মুছতে মুছতে বলল,’গল্প আবার কী? কিছুই না।’
‘কিছুই না বললেই হলো? কীভাবে পালিয়ে গেলি? কার কাছে ছিলি?’
শ্রুতি সংক্ষেপে সব বলল। শুধু পিয়ুশের সঙ্গে দেখা হয়েছিল এই কথাটাই লুকিয়ে গেছে। দরজায় তখন তিতাস নক করে বলে,’আসব?’
শ্রুতি বলল,’আসুন দুলাভাই।’
তিতাসের পিছু পিছু পিয়ুশও আসলো। পিয়ুশ পিঞ্চ মেরে বলে,’একা একাই গল্পে করছেন দেখি। আমাদের সাথেও একটু গল্প করুন।’
‘আরে ভাই, রাখ তোর গল্প। আমি তো আসছি আমার শালীকাকে ধন্যবাদ দিতে।’
ওদের দুজনকে বসার জায়গা দিয়ে সরে বসেছে শ্রুতি, বৃষ্টি আর রিমি। এখানে রিমি জিজ্ঞেস করল,’কাকে দুলাভাই?’
‘শ্রুতিকে।’
‘আমায়? কিন্তু কেন?’ জিজ্ঞেস করল শ্রুতি।
‘তুমি সেদিন পালিয়ে গেলে বলেই তো বৃষ্টির সাথে আমার বিয়েটা হলো। ভাগ্যিস পালিয়ে গিয়েছিলে! না হলে তো বৃষ্টির মতো মিষ্টি বউ পেতাম না।’ কথা বলে সে নিজেই হাসি শুরু করে। সঙ্গে হাসে পিয়ুশ, শ্রুতি আর রিমিও। শুধু বৃষ্টিই লজ্জা পাচ্ছিল। পিয়ুশও হাসতে হাসতে বলল,’আর আমি পেয়ে গেলাম সুন্দরী বেয়াইনকে।’
হাসি থেমে যায় শ্রুতির। কোনো এক অজানা কারণেই পিয়ুশের মশকরা তার পছন্দ হয় না। যদিও লোকটা খারাপ নয় এবং খারাপ কিছু বলেনি। তবে পাঁচ জনের গল্পও এক সময় জমে ওঠে। আর একটা সময়ে শ্রুতিও আনন্দে মেতে উঠে ভুলে যায় কিছু সময়ের আগের হাহাকার করা অনুভূতিগুলো।
.
.
অনেকদিন বাদে আজ অরিত্র রাতে হাঁটতে বের হয়েছে। এতদিন বাইরে তেমন আসা হয়নি। সিগারেটে ধোঁয়া উড়াতে উড়াতে সে উদ্দেশ্যহীনভাবে হাঁটতে থাকে। তার অবচেতন মন তাকে নিয়ে আসে সেখানে, যেখানে শ্রুতির সঙ্গে প্রথম দেখা হয়েছিল। এই মুহূর্তে সে সেই টং দোকানের সামনেই দাঁড়িয়ে আছে যেখানে সেদিন শ্রুতিও দাঁড়িয়ে ছিল কিন্তু সে লক্ষ্য করেনি। আজ সেই রাত আছে, সেই দোকান আছে, আছে অরিত্রও। শুধু নেই শ্রুতি! মেয়েটা থাকাকালীন কখনই অরিত্রর এমন কোনো অনুভূতি হয়নি। আর আজ যখন যোজন যোজন দূরে ঠিক তখনই প্রচণ্ড পরিমাণে তার কথা মনে পড়ছে। দূরত্ব সব সম্পর্ক কেবল নষ্টই করে না, মাঝে মাঝে ব্যক্তির অনুপস্থিতি তার গুরুত্বও বুঝিয়ে দেয়। শ্রুতির চিন্তা মাথা থেকে তৎক্ষণাৎ নামিয়ে ফেলার চেষ্টা করে। দোকানের বেঞ্চে বসে সিগারেট খেতে খেতে কানে হেডফোন গুঁজে গান শোনে। হাত ঘড়িতে সময় তখন রাত ১টা বেজে ২৫ মিনিট। এখন বাড়িতে যাওয়া প্রয়োজন। এখান থেকে অলি-গলি ঘুরে সে বাড়িতে পৌঁছায়। যাতে অতিরিক্ত হাঁটার ফলে অতিরিক্ত পরিশ্রম হয় এবং রাতে তাড়াতাড়ি ঘুমও চলে আসে। হয়েছেও তাই। বাড়িতে ফিরে শোয়ার পরই ঘুম চলে এসেছে। রাতে খায়নি। সকালে উঠতেও লেট হয়েছে। সকালের নাস্তাও মিস হয়ে গেছে। অদিতি বেগম অনেকবার জোর করেও খাওয়াতে পারেনি। সোফায় বসে যত দ্রুত সম্ভব মোজা পরছিল সে।
অনিকের খাওয়া প্রায় শেষের দিকে। সুলায়মান রহমান তাড়া দিয়ে বললেন,’তাড়াতাড়ি খা বাবা। তোকে স্কুলে দিয়ে আমি অফিসে যাব।’
‘ভাবি কি আর কখনও আসবে না আব্বু?’ খাওয়া বাদ দিয়ে জিজ্ঞেস করল অনিক।
অরিত্রর হৃদস্পন্দন কাঁপতে থাকে শ্রুতির নাম শুনে। তাড়াহুড়া এবং ব্যস্ততার মাঝে থাকায় সকালে একবারও মনে পড়েনি।কিছু্ক্ষণ স্তব্ধ হয়ে সুলায়মান রহমান বললেন,’না।’
এই ‘না’ শব্দে আরও বেশি যন্ত্রণা অনুভব হয় অরিত্রর। সে চলে যায় অফিসে। অফিসের সময়টাও তার ব্যস্ততার মাঝেই কাটল। তবে এর মাঝেও হুটহাট কয়েকবার মনে পড়েছিল শ্রুতির কথা। তবে ব্যস্ততার জন্য সে কাবু হয়ে যায়নি।
অফিসের সমস্ত কাজ শেষ হতে হতে তার আবারও ঘুম পাচ্ছিল। কোনো রকম মাথা রাখার জায়গা পেলেই ঘুমিয়ে পড়তে পারবে বলে মনে হচ্ছে। ক্লান্ত হয়ে সে বাড়িতে ফিরে। হাতে আজ চটপটি। কলিংবেল বাজানোর পর দরজা খুলে দেন অদিতি বেগম। মুহূর্তেই অরিত্রর ভাবনায় ভাঁটা পড়ে। সে জিজ্ঞেস করে,’শ্রুতি কোথায়?’
তিনি একদৃষ্টিতে কিছু্ক্ষণ ছেলের দিকে তাকিয়ে থাকেন। হাত থেকে চটপটির প্যাকেট নিয়ে বলেন,’ভুলে গেছিস?’
অরিত্র আর কিছু বলল না। নিরবে চলে গেল ঘরের ভেতর। অসহ্য রকম কষ্ট হচ্ছে তার। শ্রুতি আজ দরজা খুলে দেয়নি। আজ বাড়ি ফিরেই তার হাসিমাখা মুখটা দেখতে পায়নি অরিত্র। হাসফাঁস লাগছিল তার। ভারী তপ্ত দীর্ঘ নিঃশ্বাস বুকজুড়ে ছড়িয়ে পড়ে। স্বগতোক্তি করে সে বলে,’আই মিস ইউ শ্রুতি।’
চলবে…