#দ্বিপ্রহরের_রাত্রি,সূচনা পর্ব
#মুন্নি_আক্তার_প্রিয়া
বিয়ে বাড়ি থেকে পালিয়েছি অনেকক্ষণ হবে। এখন ভবঘুরে হয়ে রাস্তায় হাঁটছি। এছাড়া তো কিছু করারও নেই। সন্ধ্যা ছাপিয়ে ঘুটঘুটে অন্ধকার ঝাঁপিয়ে পড়েছে বহু আগেই। চতুর্দিকে ল্যাম্পপোস্টের আলো। প্রথমে পালানোর সময় ভয় না লাগলেও এখন বেশ ভয় লাগছে আমার। না পালিয়েই বা কী করতাম বলুন? যাকে ভালোবাসি না, যাকে চিনি না তাকে কেন বিয়ে করব? তাও না হয় করতাম, যদি বিয়েটা আমার সঙ্গে ঠিক হতো। বিয়ে তো আমার সঙ্গে ঠিক হয়নি। হয়েছিল আমার মামাতো বোন রুমকির সাথে। রুমকি আপুর যেই ছেলের সাথে সম্পর্ক ছিল সেই ছেলের হাত ধরে আজ সকালে পালিয়ে গেছে। আমি ওদের সম্পর্কের কথা জানতাম। কিন্তু পালিয়ে যে যাবে তা জানতাম না। জানব কী? ক্ষুণাক্ষরেও টের পাইনি আমি। রুমকি আপু যে কী ধুরুন্দুর মেয়ে তা আজ বুঝেছি। বিয়ে ঠিক হয়েছে আরও এক সপ্তাহ্ আগে। এ ক’দিনে দেখে বুঝার উপায়ই ছিল না যে, আপু এমন একটা কাজ করে বসবে। বিয়ের শপিং করল, গয়না কিনল, গায়ে হলুদও পর্যন্ত হলো। আমার ধারণা ছিল পালালে হলুদের আগেই পালাবে।
গায়ে হলুদ যখন হয়ে গেল তখন আমি আপুকে আড়ালে নিয়ে জিজ্ঞেস করলাম,’আপু তুমি তাহলে সত্যি সত্যি বিয়েটা করছ? ঐ ভাইয়াটার কী হবে যার সাথে তোমার সম্পর্ক ছিল?’
উত্তরে আপু বলল কী! বলল,’শোন শ্রুতি, বিয়ে বাড়িতে ইনজয় কর। এত কথা বলে এখন লাভ আছে?’
আমি ভাবলাম, আসলেই তো। এখন আর এসব বলে লাভ কী? তাই হয়তো আপুও মেনে নেওয়ার চেষ্টা করছে। কিন্তু কে জানত এই মেয়ের পেটে পেটে যে এত শয়তানি! রুমকি আপু পালিয়েছে এতে আমার কোনো মাথা ব্যথা নেই। আমার মাথা ব্যথা হচ্ছে, মামা এখন রুমকি আপুর জায়গায় আমায় বিয়ে দিতে চাচ্ছে। একি অনাসৃষ্টি কাণ্ড! আমি এখানে কোত্থেকে আসলাম রে বাবা। আমি মাঝেও নেই সাঝেও নেই। যাকে চিনিনা তাকে বিয়ে করা আমার পক্ষে অসম্ভব। আমি বিয়ে করব তাকেই, যাকে আমি ভালোবাসব। হ্যাঁ, মামার কাছে আমি ঋণী। কারণ তারা আমায় ছোটো থেকে বড়ো করেছে, লেখাপড়া শিখিয়েছে। ভীষণ ভালোওবাসে আমায়। কিন্তু ঐযে বললাম, আমার সমস্যাটা কী!
আশেপাশে কোনো দোকানপাট নেই। বাড়িঘর তো দূরের কথা! সম্ভবত আমি হাইওয়েতে চলে এসেছি। কোনদিকে যাব সেই দিশাও পাচ্ছি না। প্রচণ্ড বেগে চলতে থাকা ছুটন্ত গাড়িগুলোও থামছে না। এখানে কোনো লোকাল গাড়ি নেই। নেই কোনো রিকশাও। বড়ো বড়ো ট্রাক, মাইক্রো আর প্রাইভেট কার চলছে। রাস্তার দু’ধারে বিশাল মহীরুহ, বন-বিটপী। দেখতে অশরীরীর মতো লাগছে। ভয়ে আত্মা কেঁপে ওঠার জোগার। এভাবে নিরুদ্দেশ হয়ে কতক্ষণ হাঁটব? আর যাবই বা কোথায়? আমার কাছে সম্বল বলতে এখন আট হাজার টাকা আর একটা ফোন আছে। টাকা আমি চুরি করিনি। এগুলো আমার জমানো টাকা। জামা-কাপড় সঙ্গে আনার ফুরসত হয়নি। তাহলে ধরা পড়তাম নির্ঘাৎ। পরনে এখন ভারী একটা লেহেঙ্গা শুধু। গায়নাগাটি কিছু আনিনি। সব বিছানার ওপর রেখে এসেছি। হাঁটতে হাঁটতে পা দুটো লেগে আসছে। ব্যথায় টনটন করছে। একটু বিশ্রাম মিললে শান্তি পেতাম। কিন্তু সেই জায়গাটুকুই বা কোথায় পাই?
নিরুদ্দেশ হয়ে গন্তব্যহীন পথ হাঁটছিলাম একদম সোজা রাস্তা ধরে। সামনেই সাইড করা নীল রঙের একটা প্রাইভেট কার দেখতে পেলাম। কাছে এগিয়ে গিয়ে দেখলাম জানালার কাঁচ লাগানো। ড্রাইভার আছে বাইরে। খুব সহজেই ড্রাইভার বলতে পারলাম তার কারণ হচ্ছে, উনার পরনে সম্পূর্ণ সাদা রঙের শার্ট-প্যান্ট। মাথায় চকচকে একটা টাক। ক্লান্ত মুখে কী যেন করছে। ড্রাইভারদের ড্রেসাপ সাধারণত এমনই তো হয়।
আমি বিনয়ের সঙ্গে বললাম,’কাকু আশেপাশে কোনো দোকানপাট নেই? থাকলে সেটা কতদূর বলতে পারেন?’
অত্যন্ত বিরক্তির সহিত সে আমার দিকে তাকাল। ল্যাম্পপোস্টের আলোয় স্পষ্ট আমি তার মুখ দেখতে পাচ্ছি। কপাল বেয়ে তার ঘাম পড়ছে। বাম হাতে সে কপালের ঘামটুকু ঝেড়ে ফেলে বলল,’এই হাইওয়েতে আপনি দোকান কই পাইবেন? এইখান থেইকা দোকানপাট আরও তিরিশ মিনিটের পথ। হাঁইটা যাইতে আরও সময় লাগব।’
সময় যত লাগুক সমস্যা ছিল না। কিন্তু কথা হচ্ছে, এতটা পথ হাঁটার জন্য যেই মনোবলটুকু দরকার এই মুহুর্তে সেটাও আমার নেই। একান্তই নিরুপায় হয়ে আমি তাকে বললাম,’কাকু আমায় কি সেখানে পৌঁছে দেবেন?’
এবার যেন তিনি একটু সন্দেহের দৃষ্টিতে তাকালেন আমার দিকে। আড়চোখে আমায় পরখ করে জিজ্ঞেস করলেন,’আপনি আইছেন কই থেইকা?’
কথা বলতে ইচ্ছে করছে না। গলা শুকিয়ে কাঠ। তারমধ্যে অযথাই প্রশ্ন বিরক্ত লাগছিল। কিন্তু এ মুহুর্তে আমার সাহায্যর প্রয়োজন। তাই ভাবলাম উত্তর দেবো। তখন গাড়ি থেকে একটা সুদর্শন ছেলে বেরিয়ে আসে। সঙ্গে সঙ্গে নাকে এসে লাগে পারফিউমের সুঘ্রাণ। কী মিষ্টি ঘ্রাণ! চারদিকে গাড়ির ধোঁয়ায় দম বন্ধ লাগলেও এখন বেশ লাগছে ঘ্রাণটা।
‘এখনও কি তোমার গাড়ি ঠিক হয়নি?’ ড্রাইভারের দিকে তেজী কণ্ঠে প্রশ্নটি ছুড়ে দিল সুদর্শন ছেলেটি। মনে হচ্ছে সে এখন বেজায় বিরক্ত। আমার দিকে দৃষ্টি পড়ার পর সে ড্রাইভারকেই জিজ্ঞেস করল,’এই মেয়ে কে?’
ড্রাইভার এতক্ষণ কাচুমুচু ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে ছিল। এবার স্বাভাবিক হয়ে বলল,’চিনি না সাব। সাহায্য চাইতাছে। বলতেছে সামনের বাজারে যেন পৌঁছাই দেই।’
ড্রাইভারের কথা শেষ হতেই আমি লক্ষ্য করলাম লোকটি আমার পা থেকে মাথা পর্যন্ত দেখে নিলেন। সম্ভবত বিয়ের পোশাক দেখেই তিনি একটু বিস্মিত হলেন। জিজ্ঞেস করলেন,’কোথা থেকে এসেছেন আপনি? আর যাবেনই বা কোথায়?’
এবার আমার ভয় হতে লাগল। এই লোক যদি খারাপ লোক হয়ে থাকে? সাহায্য নিয়ে মরব নাকি! অথবা যদি সন্দেহ করে পুলিশে ধরিয়ে দেয়? তখন তো তারা আমায় বাড়িতে পৌঁছে দেবে। তখন মামা ধরে-বেঁধে বিয়ে দিয়ে দেবে। না, সর্বনাশ হয়ে যাবে তাহলে। পালাতে হবে। এখান থেকেও এখন আমায় পালাতে হবে।
আমি ঝেড়ে গলা পরিষ্কার করে বললাম,’না, আমার সাহায্য লাগবে না। আমি হেঁটেই যেতে পারব।’
এক মুহূর্তও সময় নষ্ট করা যাবে না। আমি প্রাণপনে দৌঁড়াচ্ছি। শুনতে পেলাম পেছন থেকে সে বলছে,’আরে শুনুন। দৌঁড়াচ্ছেন কেন? কী হয়েছে? অ্যাই মেয়ে!’
আমি লক্ষ্য করলাম সেও আমার পিছু পিছু আসছে এবং একটা সময়ে খপ করে সে আমার হাতও ধরে ফেলে…
চলবে?