দ্বিপ্রহরের_রাত্রি,সূচনা পর্ব.(২য় অংশ)

0
870

#দ্বিপ্রহরের_রাত্রি,সূচনা পর্ব.(২য় অংশ)
#মুন্নি_আক্তার_প্রিয়া

আমার কলিজার পানি শুকিয়ে গেছে। এই লোক তো ভালো নয়। আমি তার কোনো কথাতেই কর্ণপাত না করে বললাম,’ভাইয়া,ভাইয়া রে ও ভাইয়া হাত ছেড়ে দেন আমার।’
‘কী আজব! আপনি এমন করছেন কেন? আমার কথা শুনুন?’
‘কিছু শোনা লাগবে না ভাই। আমার সাহায্যও লাগবে না। শুধু হাতটা ছেড়ে দেন।’
‘আপনি কোথা থেকে এসেছেন বলুন?’

এমনিতেই ভয়ে আমার জান যায় যায় অবস্থা। তার মাঝে এরকম খেজুর আলাপ সহ্য হয়? ভয় উধাও হয়ে এখন রাগ চড়ে বসেছে মস্তিষ্কে এবং মনে। মেজাজ বিগড়ে গেছে। আমি দাঁতে দাঁত পিষে বললাম,’আরে মিয়া তা দিয়ে আপনার কাজ কী? শয়তান ব্যাটা, হাত ছাড়েন আমার।’
তাকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়েই কথা শেষ করে হাতে কামড় বসালাম আমি। ব্যথা পেয়ে সে হাত ছেড়ে দিতেই সময় বিলম্ব করলাম না। পায়ে যতটুকু শক্তি ছিল সেটা কাজে লাগিয়েই দৌঁড়াতে লাগলাম। সে পেছন থেকে বলছে,’ইডিয়ট মেয়ে! বেয়াদব…’

এরপর বাকি কথাগুলো ঝাপসা ঝাপসা হয়ে এলো। সোজা একটা রাস্তা গিয়েছে সামনে। আর বাম দিক দিয়ে একটা রাস্তা। এই রাস্তায় গাড়ি খুব। তাই বাম দিকের রাস্তাতেই দৌঁড়াতে শুরু করলাম। পায়ে আর বল পাচ্ছি না। হাঁপিয়ে পড়েছি একদম। কিছু্ক্ষণ দাঁড়িয়ে থেকে দম নিয়ে আবারও হাঁটতে শুরু করলাম। হাঁটতে হাঁটতে বেশ কয়েকজন মানুষজনের দেখা পেলাম। অল্প বয়সী মেয়ে থেকে শুরু করে মধ্যবয়সী নারীরা সেজেগুজে এখানে দাঁড়িয়ে রয়েছে কেন? পুরুষও রয়েছে। কয়েকজন কেমন আড়চোখে আমার দিকে তাকাচ্ছে। চারপাশের হাভভাব আমি কিছুই বুঝতে পারছি না। পাশ দিয়ে তখন এক ছেলে বাইক নিয়ে যাচ্ছিল। ঠিক আমার সামনে দাঁড়িয়ে বলল,’যাবে সাথে? যা চাও দেবো। বাইকে উঠে বসো।’

অবাক না হয়ে পারলাম না আমি। এই ছেলে বলে কী? এর সাথে কেন যাব আর চাইবই বা কী? ছেলেটার ভাবভঙ্গি আমার মোটেও সুবিধার লাগছে না। আমি তাকে পাশ কাঁটিয়ে জোরে জোরে হাঁটা শুরু করলাম। ছেলেটিও আসছে আমার পাশে পাশে আর বলছে,’আরে যাচ্ছ কোথায়? যাবে না আমার সাথে? বাড়িয়ে দেবো। চলো।’

বুঝলাম হেঁটে বাইকের সঙ্গে পারব না। আর এটাও বুঝতে পারলাম এরা কারা! দৌঁড়াতে হবে। সামনেই একটা চিপা রাস্তা। মানুষ চলতে পারলেও বাইক যেতে পারবে না। এমনকি কোনো সাইকেলও না। আর কিছু না ভেবেই আমি গলি দিয়ে ঢুকে দিলাম দৌঁড়। ঘুটঘুটে অন্ধকারে কিচ্ছু দেখতে পাচ্ছি না। আল্লাহ্ আল্লাহ্ করতে করতে শুধু দৌঁড়াচ্ছি। আবারও সেই বড়ো রাস্তায় এসে পড়েছি। এখানেও খুব একটা গাড়ির চলাচল নেই। কোনো বাড়ি-ঘরও নেই। আমার ভয় হতে লাগল। ঐ ছেলেটার মতো যদি আবার কেউ আসে! উফ! আল্লাহ্ এবারের মতো বাঁচিয়ে নাও প্লিজ! এরপর আর দ্বিরুক্তি করব না। যার সাথে বিয়ে দিতে চাইবে তাকেই বিয়ে করব। সাহায্য করো আল্লাহ্, সাহায্য করো। ভয়ে ভয়ে কিছুদূর হাঁটার পর ছোট্ট একটা টং দোকান দেখতে পেলাম। দোকান বললে ভুল হবে। এটাকে বড়োজোর খুপরি বলা যায়। ল্যাম্পপোস্টের আলোয় যদিও স্পষ্ট সব দেখা যাচ্ছে, তবুও একটা মোম জ্বালিয়ে রেখেছে বুড়ো দোকানদার। মোমবাতির জ্বলন্ত বহ্নিশিখা বাতাসের তোড়ে কেঁপে কেঁপে উঠছে।

দোকানে গিয়ে ছোটো পেতে রাখা একটা বেঞ্চে বসলাম। বুড়োর সঙ্গে একজন বুড়িও আছে। বুড়ো দাদু আমায় দেখে বলল,’এখন তো চা নাই দিদিভাই।’
দৌঁড়াতে দৌঁড়াতে প্রাণ ওষ্ঠাগত আমার। শরীর থেকে গরম হাওয়া বের হচ্ছে। চা খাওয়ার দরকার নেই। বরঞ্চ ফ্রিজের ঠান্ডা পানি কিংবা আইসক্রিম পেলে ভালো হতো। কিন্তু এখানে সেই আকাঙ্ক্ষা আকাশ-কুসুম বটে। আমি ছোট্টো একটা দীর্ঘশ্বাস নিয়ে বললাম,’চা খেতে আসিনি দাদা। বড়ো নিরুপায় হয়ে এসেছি। থাকার একটা জায়গার ভীষণ প্রয়োজন। এখানে থাকার মতো কোনো জায়গা হবে?’

বুড়ো বিনীতভাবে বলল,’না দিদিভাই। এখান থেকে বসতভিটা বহুত দূরে। বুড়ো বুড়ি মিলে এই দোকানেই ঝাপ ফেলে থাকি। তা কই থেকে এয়েছ তুমি?’
আমার ভেতর থেকে দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে আসে। রাত গভীর থেকে আরও গভীরতর হচ্ছে। কোথায় যাব আমি? এভাবে পালানোটা আমার ঠিক হইনি আমি বুঝতে পারছি। বুড়ো দাদুকে আর কষ্ট দিলাম না। বেঞ্চ ছেড়ে উঠে বললাম,’এসেছি গ্রাম থেকে দাদু। আচ্ছা আসছি।’
চলে যাব ঠিক তখন একটা ছেলে দোকানে এসে সিগারেট চাইল। সিগারেটটা নিয়ে কাঠি ম্যাচ দিয়ে আগুন জ্বালাল। দাম দিয়ে সোজা রাস্তা ধরে হাঁটা ধরেছে। আমি বুড়োর থেকে বিদায় নিয়ে ঐ ছেলেটার পিছু পিছু হাঁটা ধরলাম। ছেলেটির পরনে ব্লু প্যান্ট আর ব্ল্যাক শার্ট। গালভর্তি খোঁচা খোঁচা দাঁড়ি। মাথার চুলগুলো উসকোখুসকো এলোমেলো।

কিছুদূর যাওয়ার পর ছেলেটি দাঁড়িয়ে পড়ল। পিলে চমকে ওঠে আমার। আমার দিকে ঘুরে দাঁড়িয়ে সিগারেটের উচ্ছিষ্ট অংশটুকু রাস্তায় ফেলে পা দিয়ে পিষে দিল। মুখ দিয়ে ধোঁয়া বের করে কোমরে দু’হাত রেখে বলল,’কখন থেকে খেয়াল করছি আমায় ফলো করছেন। সমস্যা কী? ফলো কেন করছেন?’
হঠাৎ-ই যেন আমি থতমত খেয়ে গেলাম। কথা বলতে গিয়ে কেমন যেন জড়তা কাজ করছিল। আমতা আমতা করে বললাম,’আ…আসল…আসলে আমি দেখতে চাচ্ছিলাম আপনি কোথায় যান।’
‘আমি কোথায় যাই তাতে আপনার কী?’
‘আমার কিছু না। আমার আসলে থাকার জন্য একটা জায়গা প্রয়োজন।’
‘তো?’
‘তো এজন্যই দেখছিলাম আপনি কোথায় যান। আশেপাশে তো কোনো বাড়িঘর নেই। আর কোথায় আছে সেটাও জানিনা। এজন্য আপনায় ফলো করছিলাম।’

এবার ছেলেটি আমায় আগাগোড়া পরখ করে বলল,’বিয়ের আসর থেকে পালিয়েছেন?’
আমি কয়েক সেকেণ্ড চুপ করে থেকে ভাবলাম কী বলব। পরে সত্যিটাই বললাম,’হ্যাঁ।’
‘বুঝলাম। আমি কীভাবে সাহায্য করতে পারি? ক্ষতিও তো করতে পারি আপনার।’
‘আপনাকে দেখে তেমন মনে হয়নি।’
‘কেন?’
‘আমি দোকানে দাঁড়িয়ে থাকা সত্ত্বেও আপনি আমার দিকে একবারও তাকাননি। সিগারেট নিয়েই চলে এসেছেন। খারাপ লোক হলে অবশ্যই একবার হলেও তাকাতেন।’

ছেলেটা ফিক করে হেসে ফেলল। আজব তো! এখানে হাসির কী বললাম আমি? মনে মনে বললেও সরাসরি বলার সাহস হলো না। উল্টো ভয় হতে লাগল। সে হাসি থামিয়ে বলল,’একটা ছেলেকে বিশ্বাস করতে এইটুকু ধারণাই যথেষ্ট নয়। আপনি মেয়ে মানুষ। কাউকে বিশ্বাস করার আগে প্রয়োজনে দশবার ভাববেন।’
‘এতবার ভাবতে গেলে তো আপনি চলে যেতেন।’
কথাটা বলে নিজেই দমে গেলাম। কেমন বোকা বোকা কথা বলে ফেললাম। সে বলল,’আচ্ছা যা হোক, আমার কোনো কুমতলব নেই। চলুন দেখি কী ব্যবস্থা করা যায়।’

এতক্ষণ আমাদের মাঝে দূরত্ব ছিল পাঁচ হাতের মতো। এখন আমরা পাশাপাশি হাঁটছি। সে একদম নিশ্চুপ। কোনো কথা বলছে না। হাইহিল পরে হাঁটতেও কষ্ট হচ্ছে। জুতাগুলা খুলে হাতে নিয়ে হাঁটা শুরু করলাম। তাও তার অনেকটা পিছে পড়ে গেছি আমি। সে একবার পিছু তাকিয়ে বলল,’কী হলো? আসুন। এরকম পিঁপড়ার মতো হাঁটলে রাত পার হয়ে যাবে পৌঁছাতে।’

হাঁটুতে দু’হাত রেখে আমি দম নিচ্ছিলাম। বললাম,’আর পারছি না!’
‘তাহলে থাকুন। আমি যাই।’
‘এই না, না।’ বলেই আমি দৌঁড়ে উনার পাশাপাশি হাঁটা শুরু করলাম। কিন্তু এতে লাভ খুব একটা হলো না। আমি আবারও পিছে পড়ে গেলাম। নেতিয়ে যাওয়া স্বরে বললাম,’গায়ে শক্তি পাচ্ছি না একটুও। জুতোগুলো একটু হাতে নেবেন?’

সে ভ্রু কিঞ্চিৎ বাঁকা করে আমার দিকে তাকাল। আমার বেহাল দশা দেখেই বোধ হয় তার মায়া হলো এবং সে আমার হাত থেকে জুতো নিল। আরও একটা জিনিস লক্ষ্য করলাম সে তার হাঁটার গতি একদম কমিয়ে দিয়েছে। সোজা ভাষায় বলা চলে, আমার সঙ্গে সঙ্গে হাঁটছে। না, লোকটি মন্দ নয়। নেহাৎ-ই ভালো মানুষ। হাঁটতে হাঁটতে আমরা মেইন রাস্তা পার হয়ে একটা এলাকার রাস্তায় প্রবেশ করলাম। চারদিকে শুনশান নিরবতা। পাশের জঙ্গল থেকে ঝিঁঝিঁ পোকার অস্পষ্ট আওয়াজ শুনতে পেলাম। আমার কেমন যেন ভয় ভয় লাগছে। ভালো মানুষীর পেছনে আবার খারাপ কোনো রূপ নেই তো? আমি তো তার নামটাও জানিনা। কথা বলার উচিত। দেখি, মতলব টতলব কিছু বোঝা যায় নাকি। আমি গলা খাঁকারি দিয়ে জিজ্ঞেস করলাম,’আচ্ছা আপনার নাম কী?’
সে যেন নিতান্তই অনিচ্ছার সাথে বলল,’অরিত্র।’
‘অদ্ভুত! অপরিচিত কেউ, কেমন আছো, নাম কী এসব জিজ্ঞেস করলে তাকেও জিজ্ঞেস করতে হয়। আপনি তো করলেন না।’

অরিত্র কথা বলতে বলতে আরেকটা সিগারেট ধরিয়েছিল। মুখ থেকে ধোঁয়া বের করে বলল,’আমার কৌতুহল কম। তাও শুনি নাম কী আপনার?’
‘শ্রুতি। নামটা সুন্দর না?’
অরিত্র কিছুই বলল না। আশেপাশে সতর্ক দৃষ্টি বুলাল। তখনই জঙ্গল থেকে কয়েকটা ছেলে এসে আমাদের প্রায় ঘিরে দাঁড়াল। ওদের চেহারাই কেমন যেন ভয়ংকর! চাঁদের আলোয় দেখতে পেলাম অরিত্রও কেমন বিচলিত হয়ে পড়েছে। আমি ভেবে পাচ্ছি না ওরা কারা। ওরা কি ডাকাত?

চলবে?

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here