ধরিত্রী_কথন #পার্ট১,০২

0
2729

#ধরিত্রী_কথন
#পার্ট১,০২
#পিকলি_পিকু
০১

নিজের স্বামীকে অন্য একজন নারীর সাথে এক বিছানায় দেখাটা যে কোনো নারীর জন্য একটা দুঃস্বপ্নের মতো। ধরিত্রীর সামনে তা হচ্ছে, এখন, এই মুহূর্তে। রাফসানকে ও এমন কারো সাথে দেখবে কল্পনা ও করেনি। মীরাকে বিশ্বাস করতো। মীরার কী দোষ? নিজের মানুষটাই যখন ঠিক না।

হোটেলের দরজা খুলে ওদের দুজনকে এ রকম একটা বাজে অবস্থায় দেখে ধরিত্রী দাঁড়িয়ে থাকতে পারল না। ও এসে খাটের সামনের সোফাটিতে বসে পড়লো। এরকম একটা কাহিনী করার পর কী শান্তির ঘুম ঘুমাচ্ছে এই দুজন। বিছানার আশেপাশে ওদের জামা কাপড় ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে। এসব দেখে যে কেউই বুঝবে কাল রাতে ওরা ঠিক কী করেছে এখানে। ধরিত্রীর চোখের জল শুকিয়ে গেছে এতদিনে। তাই এসব দেখে ওর চোখ থেকে জল গড়িয়ে পড়ছে না। চট করে ওর মাথায় বুদ্ধি এলো, যে দৃশ্য ও দেখেছে, সেই দৃশ্য রাফসানের বাড়ির সবার দেখা উচিত। বিশেষ করে ওর মা বাবার। ধরিত্রী জানে, এসব দেখার পর মা বাবা ভেঙে পড়বে। অসুস্থ ও হয়ে যেতে পারে। কষ্ট হচ্ছে, কিন্তু এটাই করতে হবে।

নিজের ফোন বের করে ধরিত্রী প্রথমে একটা ভিডিও করলো। তারপর দুই একটা ছবি তুলল। খুব নোংরা লাগছে, একটা মেয়ে হয়ে আরেকটা মেয়ের এমন বাজে অবস্থার ছবি তুলতে। উপায় নেই। করতেই হবে।

রাফসান আর মীরা এখনো উঠছে না। ধরিত্রী ঠিক করেছে, ওদের ওঠা পর্যন্ত অপেক্ষা করবে। ওদের দেখিয়ে যাবে ও সব দেখেছে। এভাবে যার বিশ্বাস ভেঙেছে তাকে দেখবে না কেমন লাগছে। ও শুধু রাফসানের চেহারা দেখতে চায়। ও দেখতে চায় রাফসানকে দেখতে কেমন লাগবে, ও যখন দেখবে ধরিত্রী ওদের হাতেনাতে ধরে ফেলেছে।

সোফার উপর বসে ধরিত্রী ভাবছে দুই বছর আগের কথা। ধরিত্রী তখন একটা নারী বিষয়ক পত্রিকায় কাজ করত। পত্রিকাটির নাম ছিল জাগরণ। প্রায় নয় মাস ধরে ধরিত্রী বিভিন্ন বিয়ে বিষয়ক আর্টিকেল লিখছিল। যেমন বয়স্ক দম্পতি, নব দম্পতি বা তাদের মধ্যে দু পক্ষই কর্মজীবী বা এক পক্ষ এমন। বিভিন্ন দম্পতির সাক্ষাৎকার নিয়ে ধরিত্রী বিভিন্ন স্টোরি লিখছিল। এবারের সংখ্যার বিষয় ছিল জেষ্ঠ্য কর্মজীবী দম্পতি যাদের প্রেমের বিয়ে। তারা কীভাবে নিজেদের সমস্যা সমাধান করে আজ ও বিবাহিত জীবন যাপন করছে। এমন একটা দম্পতি খুঁজতে খুঁজতে ধরিত্রী মাথা ব্যথা হয়ে গেল। উপায়ান্তর না দেখে ফেসবুকে পোস্ট করলো। তবুও পাচ্ছে না। খুবই সাধারণ কাউকে দরকার। খুব বিখ্যাত সেলিব্রিটি ও না।

চিন্তা দূর করতে ধরিত্রী গেল ওর বাসার কাছের পার্কে। তখনই এক বয়স্কা মহিলাকে দেখল ওর কাছে হাঁপাতে হাঁপাতে এগিয়ে এসে বলল, “পানি হবে ? পানি?” ধরিত্রীর কাছে পানি ছিল। কিন্তু ও আগে মহিলাটিকে শান্ত করলো। তারপর তাকে পানি পান করতে দিল। পানি পান শেষে মহিলাটি বলল,

– ধন্যবাদ।
– কিন্তু আন্টি, এভাবে হাঁপাতে হাঁপাতে পানি খাবেন না। স্বাস্থ্যের পক্ষে ভালো না।
– খেয়াল রাখবো।
– আপনার সাথে কে আছে?
– আমার হাসবেন্ড।

একটু পর এক সাদা চুলের সুঠাম দেহের লোককে দেখতে পারলো। লোকটা অন্তত ছয় ফুট তো হবেই। চুল আর শরীর দেখে ও বয়স মেলাতে পারছে না। লোকটা ওদের দিকে এগিয়ে আসলো। ধরিত্রী উঠে জায়গা দিল ওনাকে। মহিলাটি ধরিত্রীকে উঠতে দেখে বলল,

– আরে বসো না। কোথায় যাচ্ছ?
– আপনারা বসুন।
– তোমার কী তাড়া? আসো একটু গল্প করি। এই তুমি একটু সাইডে বসো। মা, তোমার নাম?
– ধরিত্রী। ফারহিন জামান ধরিত্রী।
– মাশাআল্লাহ। খুব সুন্দর নাম।
– আপনার নাম?
– রুবাইয়া, ডক্টর রুবাইয়া আহমেদ।

ধরিত্রী খানিকটা অবাক হয়ে গেল। উনি একজন ডাক্তার! তবুও সেরকম অবস্থায় পানি খেতে চাইলো।ধরিত্রী ওনার পাশে বসলো। ওনার স্বামী ধরিত্রীকে জিজ্ঞেস করলেন,

– কী করো মা?
– আমি একজন এক্টিভিস্ট, পত্রিকায় লেখালেখি করি।
– কোন পত্রিকায়?
– জাগরণ, নারীবিষয়ক।
– ও আচ্ছা।

ধরিত্রীর খুব জিজ্ঞেস করতে ইচ্ছা হচ্ছে আঙ্কেল কী করে। ও আস্তে আস্তে জিজ্ঞেস করলো,

– আঙ্কেল কী করেন?
– কার্ডিয়ালজিস্ট।
– ওয়াও! নাম?
– ডক্টর আফসার আহমেদ।
– নাইস টু মিট ইউ।

ধরিত্রী চিন্তা করছে ওনাদের জিজ্ঞেস করবে প্রেমের বিয়ে কী না? প্রথম বারই তো দেখা হলো। প্রথম বারে কেউ বলে নাকি এসব?

– আঙ্কেল আন্টি, আপনাদের পরিবারে কে কে আছে?
– আমরা যৌথ পরিবার। আমাদের একটা ছেলে আছে, আর আমার দেবর, জা আর ওদের দুটো ছেলে মেয়ে।
– ও!
– তোমাদের পরিবারে?
– আমি আর আম্মু আব্বু।
– সুখী পরিবার। হাহাহাহ!
– কয় বছর আপনাদের বিয়ের?
– বত্রিশ হবে।
– অনেক দিন! মাশাআল্লাহ! প্রেমের বিয়ে?
– জ্বী। বুঝলে কী করে?
– এমনি।

ধরিত্রী মুচকি হাসলো। ও ওর নতুন স্টোরির লোক পেয়ে গেছে।

– কিছু মনে না করলে আপনাদের কী সময় হবে?
– কীসের?
– আমার সাথে কিছুক্ষণ গল্প করার। আমি আসলে সিনিয়র লাভ ম্যারেজ কাপল খুঁজছিলাম যারা কর্মজীবী। আপনাদের লং লাস্টিং ম্যারেজের সিকরেট শেয়ার করবেন।
– কোথায় আর সিক্রেট। যা আছে সামনেই।
– তবুও। একটা ফরমাল ইন্টারভিউ। এই যে আমার কন্টাক্ট ইনফো। আপনাদের?

ধরিত্রী তাদের ফোন নাম্বার নিয়ে আসলো। এরপর ওর সহকারী প্রীতি কে নিয়ে গেল তাদের বাড়ি। বাড়িতে ঢুকতেই দেখল রুবাইয়া, আফসার, আর তাদের সাথে আরো দুজন পুরুষ মহিলা। তাদের সাথে ধরিত্রীর পরিচয় করিয়ে দিলেন রুবাইয়া। এনারাই ঐ দেবর জা। দেবরের নাম আজহার, উনিও ডক্টর তবে কিডনি রোগ বিশেষজ্ঞ। আর জা হলো মাশরুফা, ডক্টর তবে শিশু বিশেষজ্ঞ। রুবাইয়া হলো গাইনোকলজিস্ট। সবাই খুবই শিক্ষিত। বাসা দেখেই বোঝা যাচ্ছে অনেক বড়লোক তারা। দুটো ফ্ল্যাটের মাঝখানে জুড়ে দেওয়া। ধরিত্রী ভাবছে ও কী স্পেশাল গেস্ট নাকি। এত সমাদর কেন?

কিছুক্ষণ পর একটা কিশোরী মেয়ে আসলো হাসতে হাসতে আর তার পেছনে একটা বার তেরো বছরের ছেলে দৌঁড়ে এসে থেমে গেল। ধরিত্রী আন্দাজ করলো এরাই দেবর আর জায়ের ছেলে মেয়ে। তবে ছেলেটা হঠাৎ বলে উঠলো, “ভাবি!” ধরিত্রী অপ্রস্তুত হয়ে গেল। এটা কী বলল? এটা শুনেই মেয়েটা তার ভাইয়ের পিঠে দু ঘা বসিয়ে দিল। রুবাইয়া অপ্রস্তুত হাসি দিয়ে বলল,

– ওরা তো বুঝেছই, আমার জায়ের মেয়ে আর ছেলে। মেয়ে রাশা আর ছেলে আহসান।
– ও! নাইস টু মিট ইউ।
– এই দুষ্টুমি করো না। আ’ম স্যরি ধরিত্রী। ও ইংলিশ মিডিয়াম, বাংলা খুব একটা পারে না। মুখে যা আসে তাই বলে।
– ইটস ওকে।

ধরিত্রী ইন্টারভিউ শেষে চলে আসছিল। রুবাইয়া আর মাশরুফা এত জোর করলো আর পাঁচটা মিনিট বসতে। কিন্তু ধরিত্রীর বাবা আবার দেরি করা পছন্দ করেন না। তাই ধরিত্রী চলে আসলো। ধরিত্রী বের হয়ে যাওয়ার পাঁচ মিনিট পরই রাফসান ঢুকলো। রাফসানকে দেখে রুবাইয়া হাত ভাজ করে বলল, ” চলে গেছে।” রাফসান হতাশ হয়ে বসে পড়লো,

– এত জলদি!
– সবাই কী তোর মতো? সারাদিন হাসপাতাল আর হাসপাতাল। ওর পরিবারকে ও সময় দেয়।
– তাও। এত তাড়াতাড়ি চলে গেল। আমি ছুটি নিয়ে আসলাম।
– ছুটি যখন নিবি আরেকটু আগে নিতে পারলি না?

রাশা এসে বলল, “তুমি তো এত স্লো ভাইয়া! তোমার ভাই তো অলরেডি ভাবি ও বলে ফেলেছে।”

রাফসান লাফিয়ে বলল, “কী!”

আহসান চোরের মতো করছে। মাশরুফা বলল, “সারাদিন তো খালি খাবে। বুদ্ধিটাও তাই মোটা। এভাবে কারো মেয়ে কে অপ্রস্তুত করে নাকি?”
আজহার বলল, “আমরা পুরো পরিবার ওর সামনে ওকে স্বাগতম জানালাম। ও কী আজব ভাবছে না?”

রাফসান বলল, “চাচ্চু তুমি কেন ছিলে? তোমার কোনো কাজ আছে এখানে? রোগী রেখে বাড়ি এসে বসে থাকো।”

আফসার বলল, “বাহ! তোর হবু বউকে ও দেখবে না? পরিচিত হবে না?”
রাফসানদের কাজের বুয়া রুমির মা এসে বলল, “ভাইয়া, মাইয়াডা কিন্তু সুন্দর আর ভালাও। আমার চা আর নাস্তার প্রশংসা করসে।”

রাফসান লজ্জা পেয়ে ভেতরে চলে গেল। সবাই পরিচিত হলো। শুধু রাফসানই হতে পারলো না। আর কবে হবে পরিচিত? আজকে সাত বছর পরিচিতই হতে চাইছে। হতেই পারছে না। হঠাৎ মীরার ফোন এলো,

– এই! কথা বলার দরকার নেই। সামনে থাকলে কেটে দে। সামনে আছে?
– নেই।
– কেন?

মীরা যেন মর্মাহত হলো। সেই একটান, কেন?

– দেরি হয়ে গেছে। ও চলে গেছে।
– তুই একটা গর্ধব। এত পারফেক্ট প্ল্যান করে শেষ পর্যন্ত এই কাহিনী করলি।
– আমি কী করবো? সামনে একটা রোগী চলে আসলো। ইমার্জেন্সি।
– এভাবেই থাক। এভাবে থাকলে সিঙ্গেল ম*রবি। এক কাজ কর, ধরিত্রীকে ভুলে যা।
– সম্ভব না।
– অ্যারেঞ্জ মারেজ করে করে নে অন্য কোথাও। লাভ তো তোর দ্বারা হবে না।
– অন্য কাউকে সম্ভব না!
– কিছুই করার নেই। এই মেয়ের সাথে কথা বলানোর জন্য তোর পুরো পরিবার মাঠে নেমেও পারলো না। আর কখন হবে?
– অপেক্ষা করবো।
– তোর দ্বারা হবে না।

রাফসান আর মীরা এখনো একই অবস্থায় আছে। বিধ্বস্ত অবস্থায় ধরিত্রী সেই জায়গায় এখনো বসে আছে। এই দুজনেই ওর বিশ্বাস ভেঙেছে। ওদের যে করেই হোক শিক্ষা দিতে হবে। কঠোর থেকে কঠোর শিক্ষা দেবে ধরিত্রী।

চলবে

#ধরিত্রী_কথন
#পার্ট২
#পিকলি_পিকু

রাত জেগে ধরিত্রী সেই ডাক্তার দম্পতির বিয়ের কাহিনী লিখলো। তাদের প্রেম, বিয়ে, কাজ, পরিবার সব নিয়ে সুন্দর ছবি দিয়ে তিনদিন পর ধরিত্রী একটা লেখা প্রকাশ করলো। তাদের কাহিনী অনেকেই পছন্দ করলো। ভালোবাসা, বিশ্বাস, বন্ধন আর বন্ধুত্ব দিয়ে আগলে রেখেছেন একে অপরকে। লেখাটি প্রকাশের পর ডক্টর রুবাইয়া অনেক পরিচিত হয়ে গেলেন। বিভিন্ন টিভি চ্যানেল পত্রিকায় তার সাক্ষাৎকার নেওয়া হয়েছে। তবে সেটা বিয়ে নিয়ে নয়, চিকিৎসা নিয়ে। এখন তো তার চেম্বারে রোগী হুমড়ি খেয়ে পড়ে। তিনি চিন্তা করলেন ধরিত্রী কে আরেকবার দাওয়াত দেবেন। ধরিত্রীও তো ব্যস্ত। আসার সময় হচ্ছে না। মানাও করেনি। তবে বাড়ি গিয়ে না। বাহিরেই দেখা করবে। ক্যাফেতে দেখা করতে এলো ধরিত্রী।

– আসসালামু আলাইকুম আন্টি।
– ওয়ালাইকুম আসসালাম। কেমন আছ মা?
– আলহামদুলিল্লাহ, ভালো। আপনাদের কী অবস্থা?
– সবাই ভালো। তুমি বাসায় আসো না কেন?
– সময় হয় না।
– ব্যস্ত মানুষ। বুঝতে পেরেছি। তোমার লেখা তো খুব ভালো। রাফসান খুব পছন্দ করেছে।
– কে? আপনার ছেলে?
– হুম।
– ধন্যবাদ।
– এই যে, এটা আমি তোমার জন্য এনেছি।
– এ মা! এর কী দরকার?

খুব সুন্দর একটা ঘড়ি ধরিত্রীর জন্য। ধরিত্রী তো অপ্রস্তুত। ও তো কিছুই আনেনি।

– আমি এটা নিতে পারব না।
– কেন?
– আপনার থেকে কী করে?
– আমি কী তোমার বন্ধু না? বন্ধু কী উপহার দিতে পারে না?
– পারে। তবে এত দামি।
– এত দামি কোথায়? এটা আমি পছন্দ করেছি।
– ধন্যবাদ।

কাল সারা বিকেল রাফসান আর ওর মা মল ঘুরে শেষ পর্যন্ত ওর জন্য এই ঘড়িটা কিনলো। রাফসান তো উপহার পছন্দই করতে পারে না।

– হাবা ছেলে কোথাকার! বিয়ের পর ও মা পছন্দ করে দেবে?
– আমি পারি পছন্দ করতে। কিন্তু নার্ভাস হয়ে যাই। ওর যদি পছন্দ না হয়?
– উপহার টা কী আমি দেব?
– চেনে তো তোমাকে। আমি অপরিচিত লোক উপহার দিলে কেমন হবে?

উপহার টা ধরিত্রী ওর মাকে দেখালো। ওর বাবা ও এলো,

– এত দামি ঘড়ি শুধুমাত্র একটা লেখার জন্য?
– মা, শুধু সন্দেহ করো। আন্টি অনেক ভালো মানুষ। বলো না, আমি কী দেব?
– বাড়তি খরচ। এক কাজ কর, শাড়ি দে। শাড়ি আর চুরি পেলে যেকোনো বয়সের নারী খুশি।
– কী শাড়ি দেব?
– তাঁতের?

ধরিত্রী গেল ওর মাকে নিয়ে তাঁতের শাড়ি কিনতে। সেই শাড়ি নিয়ে ডাক্তার রুবাইয়ার চেম্বারে গেল। উনি তো অবাক! এভাবে দেখা সাক্ষাতে ধরিত্রী আর ডাক্তার রুবাইয়া খুব ভালো বন্ধু হয়ে গেল।

– ইস! আমার যদি তোর মতো একটা মেয়ে থাকতো না।
– থাকলে বুঝতে।
– কী হতো?
– মাকে জিজ্ঞেস করো। যার আছে, সেই যন্ত্রণা বুঝে।
– তুই বুঝি যন্ত্রণা?
– মা তো বলে। আমি বিয়ে করে পালালেই উনি শান্তি।
– তো চলে আয় আমার কাছে।
– অ্যাডপ্ট করবে?
– করেই নেই।

ধরিত্রী হাসলো। কিছু বলল না। রুবাইয়া ভাবছে ব্যাপারটা বলেই দেখি। কয়দিন আর ঘোরাবে।

– বয়ফ্রেন্ড্ আছে তোর?
– সময় কোথায়? আর বয়ফ্রেন্ড্ থাকলে তোমার সাথে ঘুরতাম?
– বিয়ে করার ইচ্ছা আছে?
– না নেই। তবে মায়ের দুশ্চিন্তা দেখলে মাঝে মাঝে মনে হয় করেই নেই। আবার আমাদের পত্রিকাতেই তো স্টোরি ছাপে, স্বামীর অত্যাচারে ডিভোর্স। স্বামীর পরকীয়া। এসব দেখে ইচ্ছা হয় না বিয়ে করি। তার উপর আবার শাশুড়ি ননদ। আমি বুঝি না, মেয়ে হয়ে মেয়েরাই নিজেদের কষ্ট আগে বোঝার কথা।
– তো ভালো শাশুড়ি পেলে করবি?
– ভালো পরিবার। ওভার অল সবার ভালো হওয়া চাই। শুধু স্বামী ভালো, শুধু শাশুড়ি। ওসবে অ্যাডজাস্ট হয় না। আমি ভালো ফ্যামিলি চাই। একটা ফ্যামিলি থেকে অন্য ফ্যামিলিতে অ্যাডজাস্ট করতে ফ্যামিলির ও সহায়তা দরকার।

ধরিত্রীর মন খারাপ হয়ে গেল। রুবাইয়া ধরিত্রীর হাত ধরে বলল,

– কিছু হয়েছে?
– না। কিছু না।
– কিছু তো হয়েছে।
– আজকে একজনের সাথে কথা বললাম। ওনার চার বছরের প্রেম। বিয়ে ছয়মাস। শ্বশুরবাড়ির লোকজন মেনে নেয়নি। স্বামী ভালো ছিলো, তবে হঠাৎ উল্টে গেল। যৌতুক চাইলো শাশুড়ি। স্বামীর আবার পরকীয়া। স্বামী আর শাশুড়ি মিলে হারপিক খাইয়ে দিল।
– কী বলছিস!
– বাচ্চা ছিল পেটে। চার মাসের।
– কী নিষ্ঠুর! কী নিষ্ঠুর! হায় আল্লাহ্!
– এখন বলো, এসব দেখে বিয়ে করতে ইচ্ছে করে?
– এটা তো লাভ ম্যারেজ। তাহলে অ্যারেঞ্জ কর।
– ওটা তো আরো ভয়ঙ্কর। চেনা মানুষই রূপ বদলে ফেলে আর অচেনা। আমার দেরি হয়ে যাচ্ছে। আমি আসছি। আবার দেখা হবে।

ধরিত্রী চলে গেল। রুবাইয়া বসে রইলো। এভাবে চললে ধরিত্রী কে তিনি বউ করে আনতে পারবেন না। রাতে রাফসান এলো বাসায়। রাত দেড়টা। রুবাইয়া বসে বাতি নিভিয়ে বসার ঘরে বসে আছেন। রাফসান বুঝতে পেরে পা টিপে টিপে ভেতরে যাওয়ার আগেই। রুবাইয়া বাতি জ্বালিয়ে ফেলল,

– বিয়ে করবি বললি তো একটু দায়িত্ববান হ।
– আমি কী করবো। একজন রোগী,
– চুপ! সকাল ছয়টায় চলে যাবি। রাত দেড়টায় আসবি। মাঝে মাঝে আসবিও না। চেহারার কী অবস্থা করেছিস। আমার তো মনে হয় এই জীবনে আর নাতি নাতনির মুখ দেখা হবে না।
– মা আস্তে। বাবা উঠে পড়বে।
– উঠুক। আমি চিন্তা করছি ধরিত্রী আর তোর বিয়ে হলে ওর সাথে কত বড় অন্যায় হবে। তুই পড়ে থাকবি হাসপাতালে আর ও একা। আমি ওর সাথে এত অন্যায় করতে পারব না।
– মা তুমি ওকে এখনো আমার কথা বলোনি?
– না।
– কী কথা বলো সারাদিন ওর সাথে? আমাকে নিয়ে কিছু বলতে পারোনা? আমি কী এইজন্য তোমাদের বন্ধুত্ব করিয়েছি?
– বন্ধুত্ব তুই না, আমি করেছি। নিজে করেছি।
– এখন তাড়াতাড়ি ছেলের বউ করে আনবে তা না।
– ও বলেছে অ্যারেঞ্জ ও করবে না। লাভ ও করবে না।
– কেন?
– কারণ চেনা মানুষই রূপ বদলে ফেলে আর অচেনা।

চেনা মানুষই রূপ বদলে ফেলে আর অচেনা …

মীরা একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে চেয়ারে হেলান দিয়ে বলল,

– কথাটা ভুল বলেনি। মেয়েটার কথাটা সুন্দর।
– এখন কী করবো বল?
– আমার মনে হচ্ছে তোদের হবে না।
– একই কথা বারবার!
– দুই মাস মাস হলো আন্টি ওর সাথে কথা বলছে। তুই ওর সাথে কথা বলতে পারছিস না। তোদের অবস্থান এখনো একই জায়গায়। আর এদিকে আন্টি তুমি আপনি থেকে তুই তুমি তে চলে গেছে। কিন্তু তুই দেখাও করলি না।
– কী করতে পারি?
– আন্টিকে বল ওকে কোথাও আনতে। তুই যাবি। হুট করে দেখা হয়ে যাবে।
– তাই করবো।

রাফসান ওর মা কে মীরার প্ল্যান বলল। ধরিত্রীকে নিয়ে রুবাইয়া আর মাশরুফা গেলো সিনেমা দেখতে। রাফসান আজকে ছুটি নিয়েছে। সুন্দর শার্ট পরে পারফিউম মেখে সিনেপ্লেক্সের উদ্দেশ্যে গেল। ওনাদের প্ল্যান ধরিত্রী আর রাফসানের পরিচয় করিয়ে দুই জা কেটে পড়বে। এদিকে সিনেমা হলে ধরিত্রীরা সিনেমা দেখছে।

– তুমি মাশরুফা আন্টিকে আনবে জানলে আমি আমার মা কেও আনতাম।
– আনোনি কেন?
– ভাবলাম শুধু তুমি আসবে। আরেকদিন আনবো। তবে মা এ ধরণের সিনেমা দেখে না। একটু ড্রামাটিক পছন্দ করে।
– ওনার পছন্দেরটাই দেখবো। সমস্যা নেই।

রাফসান আসতে আসতে সিনেমা শুরু হয়ে গেল। পুরো হল অন্ধকার। সিট খুঁজে পেতে একটু কষ্ট হয়েছে। ও এসে বসলো মাশরুফার পাশে। এরপর ফিসফিসিয়ে বলল,

– কোথায়?
– অফিসে ডেকেছে।
– মানে?

রাফসান চমকে উঠলো। মাশরুফা হাত দিয়ে থামতে বলল ওকে।
– চলে গেছে।
– আজকেও? আজকে তো আমি তাড়াতাড়িই আসলাম!

রাফসান এই কথা বলতেই হলের অন্য লোকগুলো বলে উঠলো, “চুপ করেন না ভাই! আমরা বুঝতেসি না!”

দুঃখে কষ্টে রাফসান সেখান থেকে বেরিয়ে আসলো। আর কোথায় যাবে? মীরার কাছে। মীরাই তো ওর বেস্ট ফ্রেন্ড। সবই তো মীরাকে বলে। মীরা ছাড়া দুঃখ দুর্দিনের সাথী আর কে? সেখানে গিয়ে মন খারাপ করে বসে আছে। মীরা খুব ব্যস্ত, তাও,

– আজকেও?
– আজকে আমি দেরি করিনি।
– কখন গিয়েছেন?
– সিনেমা শুরু হওয়ার পনের মিনিট পর।
– বাহ! তুই সিনেমা চলাকালীন পরিচিত হতি? ছাগল! মানুষ আগে যায়, তারপর সিট খুঁজে। এভাবেই কথা হয়।
– ইন্টারভ্যাল?
– ওটাও। তবে আগেরটা আগে। আন্টির সাথে কেন যাস নি?
– একসাথে গেল ভাবতো প্ল্যানড।
– তাই মা ছেলে আলাদা আলাদা গিয়ে পাশাপাশি সিট খুব কো ইন্সিডেন্স? তুই একটা রাম ছাগল! হাঁদা।
– আর তুই? খুব মহীয়সী নারী? মহিষী নারী!
– চুপ! আমার সাথে বাজে ব্যবহার করলে কিন্তু আমি আর হেল্প করব না। মনে রাখিস, এসব চিত্রনাট্য কিন্তু আমার। পরিচালনায় যত ভুল হচ্ছে।
– বয়েই গেছে তো চিত্রনাট্য শুনতে। পোড়া কপাল আমার।
– আরে না, শোন। সেদিন যে ও বলল না চেনা মানুষই রূপ বদলে ফেলে আর অচেনা। আমার মনে হয় ওর কোনো বয়ফ্রেন্ড ছিল। অনেক বড় ছ্যাঁকা খেয়েছে।
– কী যা তা। সবসময় মজা করিস।
– না রে, আমি সিরিয়াস। অনেক কষ্ট পেয়েছিল বোধহয়। আন্টিকে বল না, ওকে জিজ্ঞেস করতে।
– কী?
– ওর কোনো বয়ফ্রেন্ড ছিল কি না। ওসব না জানলে আগাতে পারবি না।

হঠাৎ করেই চেম্বারের দরজা খুলে অঙ্কন ঢুকে পড়লো। অঙ্কন, মীরার স্বামী। রাফসান মাথা ঘুরিয়ে অঙ্কনকে দেখে একটা হাসি দিল। অঙ্কন এসে রাফসানের সাথে হাত মেলালো।

– তো মীরা, রাফসান এসেছে যে বললে না?
– তখন ও আসেনি। একটু আগেই আসলো।
– আমি যখন বললাম ঘুরতে যাব, তখন তো বললে ব্যস্ত।
– ব্যস্তই তো। রাফসান সামান্য কাজে এসেছে।
– আমি এতদিন পর আসলাম দেশে।

অঙ্কন মন খারাপ করে ফেলল। মীরা ওর অ্যাপ্রোন টা নিয়ে জায়গা থেকে উঠে দাঁড়ালো। রাফসানের কেমন অপরাধবোধ হচ্ছে। সে বলল,

– অঙ্কন ভাই কে এভাবে কষ্ট দিতে তোর খারাপ লাগে না।
– আসছে, অঙ্কন ভাইয়ের চামচা। আমার এখন একটা পেশেন্ট অ্যাটেন্ড করতে হবে। আমি তোর সাথে ও খেজুরে আলাপ করতাম না এতক্ষণ। কিন্তু তোর মন খারাপ ছিল তাই। আর অঙ্কন, বাসায় যাও। আমার অপেক্ষা করো না। আমি ফিরতে তিন ঘন্টা লাগতে পারে।

মীরা চলে গেল। এরপর রাফসান ও চলে গেল। আর অঙ্কন দাঁড়িয়ে আছে অসহায়ের মতো।

চেনা মানুষই রূপ বদলে ফেলে আর অচেনা …
(চলবে)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here