#ধরিত্রী_কথন
#পার্ট১৫
#পিকলি_পিকু
ধরিত্রী ওর সহকর্মীকে নিয়ে হাসপাতালে গেল। করিডোরে গিয়ে সেই মহিলার বাচ্চাদের সাথে কথা বলার চেষ্টা করছিল। তখনই তার দেবর চলে আসে,
– আপনারা এখানে কী করছেন?
– আমরা খবর করতে এসেছি।
– কোনো খবর হবে না। যান। হাসাহাসি করার জন্য?
– না। ওনার চিকিৎসার জন্য। আর সেই প্রতারকদের শাস্তির জন্য।
– কীসের শাস্তি! খুন তো করেনি।
– এটা কী মানসিক খুন না?
– মানসিক খুন! হাহাহ! পুরা মানুষ মরে যাচ্ছে একটা খবর নেই, আর মানসিক খুন।
– আপনারা কেমন খরচ করতে পারবেন? টাকা পয়সা?
– নেই। যা আছে তাই খরচ করব। রক্ত বিক্রি করে হলেও করব। মা আমার।
– ভাবি না?
– মায়ের মতো মানুষ করেছে। এটাই আমার ভাবি, এটাই আমার মা, এটাই আমার বোন।
– আপনি কিছু মনে করবেন না। আমি ওনাকে সাহায্য করতে চাই। আমি একটি নারী বিষয়ক পত্রিকায় আছি। আপনি চাইলে আমি পরিচয় গোপন রাখবো।
– কেন? সবাই জানুক ওরা কী করেছে!
– একটু খুলে বলবেন? আমিও তা চাই। ওনাদের তো আর জেল হাজতে বিচার হবে না, জনতার আদালতেই হোক। তারা যাতে আর মাথা উঁচিয়ে না হাঁটতে পারে।
স্বামীর সাথে সম্পর্ক ভালো না হওয়ায় ভুক্তভোগী মহিলা, দিয়ার চাচাতো বোন দিবা প্রায় তার বাড়ি আসতো। পারিবারিক কলহের কথা খুলে বলতো বোনকে। তার স্বামীর অনেক মহিলার সাথে সম্পর্ক আছে। আবার সেই তাকে সন্দেহ করতো, মারধর করতো। কিন্তু দিয়া নিজেই একজন সহজ সরল মহিলা। তার বাপের বাড়ির আত্মীয় বলতে এই চাচা আর চাচাতো বোন। তার মা বাবা নেই। খুব সাধারণ একজন মহিলা হওয়ায় সে তার ক্ষমতার বোনের স্বামীর বিরুদ্ধে বোনকে কোনো সাহায্যই করতে পারেনি। স্বামী সংসার শ্বশুর বাড়ি নিয়েই থাকতো বেশি। নিজের দায়িত্ব আগে। আর দিন শেষে চাচাতো বোনের স্বামীর অত্যাচারের ঘটনা তার স্বামীকে বলে দুঃখ প্রকাশ করা। এভাবেই তার চাচাতো বোনের প্রতি তার স্বামীর সহানুভূতি তৈরী হয় আর তারপর অবৈধ সম্পর্কে জড়িয়ে যায়। এসব জানার পর খুব মানসিক আঘাত পায় দিয়া। সেজন্যই আজ তার এই অবস্থা। কিন্তু যাদের জন্য আজ সে এখানে তারা কেউই পাশে নেই। দিয়া আর তার সন্তানরা আজ অসহায়। ধরিত্রী দিয়ার ত্যাগকে সুন্দর করে তুলে ধরল তার শব্দে, তার দেবর আর সন্তানদের বক্তব্যে। এই শব্দগুলোতে অনেক নারীরাই তাদের কথা খুঁজে পেল। তারাও যেন কোনো দিয়া। তাদেরই কোনো আপনজন তাদের ক্ষতি করেছে। তবে এর মধ্যে দুই দলে বিভক্ত হয়ে গেল সবাই। কেউ বোনকে দুষছে তো কেউ স্বামী কে। রুবাইয়া ধরিত্রী কে প্রশ্ন করলো,
– তোর কী মনে হয়? বোন দায়ী না স্বামী?
– এখানে বোন আর স্বামী দুই পক্ষ কেন হবে? তারা তো একই পক্ষ। এখানে যদি দুটো দল হয় তো একটা মহিলার পক্ষে আরেকটা ঐ প্রতারক পক্ষ। স্বামী আর বোন দুজনেই দোষী। কিন্তু আসল ব্যাপার এটা না। আমি চাই ওনার চিকিৎসার কেউ দায়িত্ব নিক। ওনার সন্তানদের ও নিক। ওদের জীবনটা শেষ হয়ে গেছে।
রাফসান রেগে এসে ওর অ্যাপ্রোন ছুঁড়ে বলল,
– শেষ তো তুমি করেছ ধরিত্রী!
– আমি?
– হ্যাঁ তুমি! তোমার কারণে এখন হসপিটালের বারান্দায় ও বাচ্চা গুলো বসতে পারছে না। ওদের জীবন যা দুর্বিষহ ছিল তা তুমি আর বাকি সাংবাদিকরা করে দিয়েছ।
– কী হয়েছে?
– হাসপাতালের বাইরে এখন নানা সাংবাদিকরা বসে থাকে সারাদিন ওদের বক্তব্যের জন্য। বিরক্ত করে ওদের। বাবা খালার সাথে মাকে চিট করেছে। জিনিসটা যতটা জঘন্য ততটা জঘন্য প্রতিদিন এসব প্রশ্ন ফেস করা। এমন হবে জানলে আমি সেদিন তোমাকে হাসাপাতালে যেতে দিতাম না।
– কিন্তু আমি তো ভালো চেয়েছিলাম। ভালো করতে চেয়েছিলাম।
– অনেক সময় উপকার করতে গেলে সবচেয়ে বড় অপকার টা হয়ে যায়। তুমি সেটা কখনো বুঝবে না ধরিত্রী। মানুষ কত স্বার্থ নিয়ে কাজ করে তুমি তা জানো না। তাই সবাই সবাইকে স্বার্থপর ভাবে। আর দুনিয়ার চোখে আজ তুমিও স্বার্থপর সাংবাদিক। ওদের জীবনটা আজ ড্রয়িং রুমের বিনোদন হয়ে গেছে।
রাফসান ভেতরে চলে গেল। ধরিত্রী খুব নরম মনের মানুষ। বাচ্চাগুলোর কথা ভেবে ওর ও চোখ ভিজে এলো। রুবাইয়া ওর কাছে এসে বলল,
– রাফসান রাগের মাথায় বলেছে এসব। ওর কথায় রাগ করিস না।
– মা আমি সত্যি ক্ষতি করে ফেলেছি। আমি এটা কী করে শোধরাব? আমি ওদের বিনোদনের খোরাক করতে চাইনি।
– তুই আবার লেখ, তোর কথা লেখ। বাচ্চাদের প্রতি মিডিয়ার ব্যবহার নিয়ে লেখ।
ধরিত্রী আবার দেখতে গেল ওদের। কিন্তু এবার আর ওরা ধরিত্রীর সাথে কথা বলল না। নিজেকে খুব অপরাধী মনে হলো ধরিত্রীর। সেই মহিলার দেবর ও বাজে ব্যবহার করলো আর তাকে তার ভাবিকে দেখতে বারণ করলো। বাড়ি ফিরে ধরিত্রী তাই আরেকটা আর্টিকল লিখলো। মিডিয়ার জঘন্য ব্যবহার, মানুষ কত নির্দয়, বিনোদন আর খবর বানাতে ব্যস্ত এসব নিয়ে। এই আর্টিকল ও অনেকে পড়ল। তবে এবার সবাই ধরিত্রীকেই পাল্টা প্রশ্ন করছে, “আপনিও কী সেজন্যই এই খবর করেননি?” কিন্তু ও তো অন্য কিছু চাইছিল। অবশ্যই এমন কিছু না। এসবের মধ্যে জাগরণ অনলাইন পত্রিকা দ্রুততম বৃদ্ধি পেয়েছে। এই সপ্তাহে এক নম্বর অনলাইন পত্রিকা হয়ে গেছে। সকল রেকর্ড ভেঙে দিয়েছে জাগরণ। কিন্তু ধরিত্রী এসব চায়নি। ওর মন ভালো নেই। আরেকজনের ও মন ভালো নেই।
তিনি ফরহাদ শেখর। একজন আগাগোড়া নারী বিদ্বেষী। ধরিত্রীর ইউনিভার্সিটিতেই ওর শিক্ষক ছিলেন। তার নারী বিদ্বেষ ধরিত্রীর চোখ কখনো এড়ায়নি। ভার্সিটিতে পড়া কালীন ধরিত্রী একটি পত্রিকাতে ইন্টার্নশিপ করছিল। সেখানেও ফরহাদ ছিল। ধরিত্রী সেখানে একটা সপ্তাহিক কলাম লিখতে চেয়েছিল। এই কলামে শুধু সুবিধাবঞ্চিত নারীদের কথা থাকবে। কিন্তু ফরহাদ সেটা করতে দেয়নি। উল্টো অনেক ঝামেলা সৃষ্টি করে। তায নারী বিদ্বেষের বিরুদ্ধে ধরিত্রী তার সকল নারী সহকর্মীদের এক করে আর পরবর্তীতে সেই পত্রিকার নারী কর্মীরাই স্পনসর নিয়ে শুরু করে সম্পূর্ণ নারী বিষয়ক জাগরণ পত্রিকার। সেই থেকে ফরহাদের চক্ষুশূল ধরিত্রী। তাই এই ঘটনায় ধরিত্রী আর জাগরণ পত্রিকার বিরূদ্ধে অবস্থান নিয়ে তিনি কয়েকটি আর্টিকল লিখেছেন। তার এই কট্টর অবস্থান ও অনেকে পছন্দ করেছে। ধরিত্রীর সাথে ব্যক্তিগত কোন্দলে যে সে এত নীচে নামতে পারে তা ও জানতো না। ফরহাদ একদম সেই স্বামীর পক্ষ নিয়েই কয়েকটা খবর করেছেন। অনেক মানুষই তখন ফরহাদের পক্ষ নিয়েছে।
“আপনি দেখছেন, আপনার সন্তানরা আপনার সন্তানরা বিরুদ্ধে কথা বলছে। পুরো দেশের মানুষ আপনার বিরুদ্ধে। আপনার ও তো কিছু বলার আছে।”
ফরহাদ আর সেই নিরীহ মহিলার স্বামীর কথা হচ্ছে। সেই লোক তার কৃতকর্মে খুবই লজ্জিত। কিন্তু আজ একটি টিভি চ্যানেলে ওদের নিয়ে ডিবেট করতে যাচ্ছে। তারা ধরিত্রীকে আমন্ত্রণ জানিয়েছে। কিন্তু ধরিত্রী এসব আর চায় না। রুবাইয়া ওর পাশে দাঁড়ালো,
– কেন যাবি না? যা। ঐ বদমাশ লোকটা তোর বিরূদ্ধে এত বাজে কথা বলছে। টিভি তে গিয়েও বলবে।
– বলুক।
– তুই যদি সেসব কাউন্টার না করিস তো সবাই তোকেই ভুল বুঝবে। বলবে সত্যিই তুই ক্লিকের জন্য লিখেছিস। এই অনলাইন যুগে মানুষের চিন্তাভাবনা ডাইভার্ট করা খুব সহজ।
রাফসানের তো মুড খারাপ। শুধু শুধু ধরিত্রী এসব ঝামেলায় জড়িয়ে ওদের মধ্যেই ঝামেলা বাঁধিয়ে ফেলেছে।
– কেমন আছেন উনি?
– প্যারালাইসিস।
– আর ঠিক হবে না?
– অনেক টাকা দরকার। পুরোপুরি তো হবে না। ওনার দেবরের তো এত টাকা নেই। তুমি যে কাহিনী করেছ এই কাহিনীর পরেও কেউ খুব বেশি সাহায্য করল না। এসবের পেছনে দায়ী কী জানো? তোমার পরিকল্পনার অভাব আর অনিয়ন্ত্রিত আবেগ। আবেগে সব চলেনা ধরিত্রী। তুমি খুব আবেগী।
ধরিত্রীর চোখ দিয়ে জল গড়িয়ে পড়ছে। রাফসান ধরিত্রীর চোখ মুছতে মুছতে বলল,
– এখনো আবেগ দেখাচ্ছ।
– আমি কী করব? আমার খুব খারাপ লাগছে।
এই বলে ধরিত্রী রাফসানকে জড়িয়ে ধরে কাঁদতে লাগলো। রাফসান ওর মাথায় হাত বুলাতে লাগল। ওর এই গুণ গুলোই দূর থেকে ওর মন কেড়েছে। কিন্তু সামনে থেকে এসব দেখে বুঝতে পারছে ধরিত্রীর ভালমানুষির ফলাফল এই দুনিয়াতে ভালো না।
– আমি কাল বাবাকে বলব ওনার চিকিৎসার সব খরচ নিতে।
– এত আবেগী হয়ো না ধরিত্রী। কখনো কখনো আবেগকে বাদ দিতে হয়। মানুষ তখন তোমার এই উদারতার ও ফায়দা উঠাবে। বলবে তুমি এটা আগে করলে না কেন? শক্ত হতে হবে।
– কী করে হবো?
– হৃদয় দিয়ে না ভেবে মস্তিষ্ক দিয়ে ভাবো। কাল তুমি যাবে, স্টুডিও তে ঐ লোকটাকে উচিত জবাব দেবে। এরপর দেখা যাবে তার চিকিৎসার কী হবে।
স্টুডিও তে ক্যামেরা লাইটিং সেট আপ ঠিক হচ্ছে। সেখানে ধরিত্রী আছে আর ফরহাদ ও। প্রসঙ্গ একজন পুরুষ পরকীয়া কেন করে? ফরহাদ কে প্রশ্ন করলেন উপস্থাপিকা,
“ম্যাডাম, আপনাদের প্রশ্ন টা ভুল। কারণ এখানে শুধু একজন পুরুষ পরকীয়া করেনি। তার সাথে একজন মহিলাও ছিল। আর ভুক্তভোগী শুধু একজন মহিলাও নন। আরেকজন পুরুষ ও আছেন। ঐ মহিলার স্বামী। তার বক্তব্য কোথায়? সব দোষ এই সকল সস্তা অনলাইন মিডিয়ার মতো একজন পুরুষের উপর চালাবেন না। অন্তত আপনাদের আমি শিক্ষিত মনে করি।” এই কথা বলে ফরহাদ শয়তানের মতো হাসলো। ধরিত্রী চুপ করে আছে। উপস্থাপিকা এবার জিজ্ঞেস করলো, “মিসেস ধরিত্রী, আপনি কী একমত?” ধরিত্রীর সেখানে মন ছিল না। উপস্থাপিকা তাকে আবার প্রশ্ন করলো, “আপনি কী একমত?” ধরিত্রী কিছু বুঝতে না পেরে আবার প্রশ্ন করল, “জ্বী, কীসের সাথে?” ফরহাদ হেসে উঠলো, “মিসেস ধরিত্রী, আপনারা না খবর খোঁজেন না, তৈরী করেন। এসব সস্তা ইমোশন নিয়ে খেলেন। নিরীহ পুরুষরা হয় আপনাদের পত্রিকার শিকার। খুঁজলে এমন অনেক কাহিনী পাওয়া যাবে। আমি বলেছিলাম এখানে শুধু একজন পুরুষ নয়, আরেকজন নারী ও পরকীয়া করেছে। তাহলে আজকের বিতর্কের বিষয় কী ভুল নয়?”
ধরিত্রী ব্যাপারটা বুঝে মুচকি হাসলো,
– আমি কখনোই সেখানে শুধু পুরুষ বা শুধু নারীকেই দোষ দেই নি। দোষ উভয় পক্ষের ছিল। আর আমার উদ্দেশ্য ছিল সেই নিরীহ নারীকে সুবিচার পাইয়ে দেওয়া।
– শুধু কী এক নারীই নিরীহ? অন্য পুরুষটি?
– আমি যতটুকু জানি ওনার ও পরকীয়াতে আসক্তি আছে। আর ওনার আমি কোনো বক্তব্য পাইনি। সমস্ত কথা আমাকে মিসেস দিয়ার সন্তান আর দেবর বলেছেন। সেই ব্যক্তি নিজেও একই অপরাধে অপরাধী। ওনাকে অন্তত নিরীহ বলবেন না। নিরীহ এখানে শুধু মিসেস দিয়া আর তার সন্তানরা।
– এখন তো কতো কথাই বলবেন। সিম্প্যাথি চাইবেন। ভিকটিম কার্ড খেলবেন।
– একদম না। আমার মূল উদ্দেশ্যে ছিল সেই মহিলার চিকিৎসার ব্যবস্থা করা। আর্থিক ও মানসিক সহায়তা দেওয়া তার পরিবারকে। যা আইনত তার স্বামীর দেওয়ার কথা। তার ছোট সন্তান দুটো এভাবে হাসপাতালের করিডোরে একা একা বসে থাকা ডিজার্ভ করে না। অবশ্যই ঐ দুই অপরাধী শাস্তির যোগ্য। সেই শাস্তি জেল হাজতে না। কিন্তু তাদের সেই দায় নিতে হবে।
– কিন্তু আপনি কী মনে করেন, সেই ব্যক্তি কেন পরকীয়া করলো?
– আমি কী জানি? দেখুন, আমি এটা লিভিং রুমে মশলাদার ডিস্কাশন হিসেবে না, একজন অসহায় নারীর আর্তনাদ হিসেবে লিখেছি যিনি এখনো হাসাপাতালের বিছানায় কাতরাচ্ছেন। তার সাপোর্ট দরকার।
– আপনি কথা ঘোরাবেন না। সেই মহিলার ছোট বোন তার দুলাভাইকে সিডিউস করেছে। তাই সে পরকীয়া করতে বাধ্য হয়েছে।
– আপনি এসব আনছেন কেন? কারণ আনলে কী হবে? অপরাধ কী কমে যাবে?
– না, আপনারা নারীরাই নারীর শত্রু! আমাদের পুরুষদের কেন জড়াবেন? আমার কথা হচ্ছে আপনারা প্রচুর একচোখা আর পুরুষ বিদ্বেষী! আপনার লেখার ধরণ পুরুষদের ছোট করে। আপনি আরেকজন পুরুষকে ভুক্তভোগী হিসেবে দেখেনই না।
– আশ্চর্য! ব্যাপারটা সেটা নয়!
ধরিত্রী আর ফরহাদ তুমুল বাকবিতণ্ডায় জড়িয়ে পড়লো। অবস্থার অবনতি দেখে উপস্থাপক তাদের থামিয়ে দিল। ধরিত্রীর মেজাজ খারাপ হয়ে যাচ্ছিল। এত ফালতু কথা মানুষ কী করে বলতে পারে! উপস্থাপিকা এবার যোগ করলো সেই অপরাধী স্বামীকে। ইনি যে আসবেন তা ধরিত্রীকে বলা হয়নি। ধরিত্রী রেগে যাচ্ছিল। ” আপনারা আমাকে বলেননি ইনিও আসবেন!” লাইভ টিভি তাই কিছুই করার নেই। পরকীয়ার পেছনের কারণ বলে এবার তারা সব সহানুভূতি নিজেদের কাছে টেনে নেবে। রাফসান হাসপাতাল থেকে এই অনুষ্ঠান দেখছে। ও বুঝতে পারছে, টিভি চ্যানেল ও ধরিত্রীকেই ভিলেন বানাতে চায়। রুবাইয়া সবার সাথে বাসা থেকেই এই অনুষ্ঠান দেখছে। ওদের এই পলিটিক্স বুঝতে পারলে তিনি কিছুতেই যেতে দিতেন না ওকে। এখন তো তার খারাপ লাগছে। তিনিই বলেছিলেন যেতে। অতঃপর সেই লোক কথা শুরু করলো,
” আমি মানছি, আমি অপরাধী। কিন্তু আমার ও কিছু করার ছিল না। আমি একজন কর্পোরেট অফিসার। অনেক কম বয়সে বিয়ে করি। দুটো বাচ্চা আছে। ওদের সাথে অন্যায় করেছি আমি। কিন্তু কেন করেছি তাও শুনতে হবে। দিবা, আমার স্ত্রীর চাচাতো বোন। ওর স্বামী ওকে খুব মারতো। তার অনেক আজেবাজে নারীর সাথে সম্পর্ক আছে। অনেক কষ্টে ছিল দিবা। হাসিমুখে ও আমাদের কিছুই বুঝতে দিত না। আমার স্ত্রীকে বললেও ও কিছু করেনি। দিবা আমার থেকে লুকাতে চাইলেও আমি বুঝে ফেলি। ওর স্বামীর বিরুদ্ধে কিছু করার ক্ষমতা ছিল না। শুধুই সহানুভূতি দিতে পারতাম। আর তাই দিচ্ছিলাম। আমি জানিনা, এসব সহানুভূতির মধ্যে আমিও কখন দুর্বল হয়ে পড়লাম ওর প্রতি। আমার স্ত্রী ও সারাদিন ব্যস্ত থাকতো। আমার জন্য ওর কখনো সময় ছিল না। আমাদের মধ্যে যে দূরত্ব ছিল, পুরুষ হিসেবে আমার যে প্রয়োজন তা ও কখনো দেখতো না। আমি বলছি না আমি ঠিক করেছি। তবে আমি এতটা ভুল ও নই যতটা মিসেস ধরিত্রী আমাকে নিয়ে লিখেছেন।”
তার কথা শেষে বোঝা যাচ্ছে ধরিত্রী হয়তো অনেক বড় একটা ভুল করে ফেলেছে। ফরহাদ মুচকি হেসে ধরিত্রীকে বুঝিয়ে দিচ্ছে খবরের দুনিয়াতে সে এখন ও কিছু না। ধরিত্রীর চোখ ভিজে আসছিল। সে তার চোখ মুছে বলল, ” তার মানে আপনার সাথে পঁচিশ বছর সংসার করার পর সামান্য একটু সময় না দেওয়ার জন্য ঘরের বাইরে সেই ভালোবাসা খোঁজার অধিকার আপানার আছে?”
লোকটি ধরিত্রী কে পাল্টা জবাব দিল, “আমি একবার ও বলিনি আমি ঠিক করেছি বা এটা আমার অধিকার। তবে আপনিও ঠিক করেননি। আপনার কারণে আমার বাচ্চারা ছোট হচ্ছে। সারাজীবন তারা এসব নিয়ে বাঁচবে। আপনি আপনার লাভের জন্য শুধু এক পক্ষের খবর ছেঁপেছেন। আমার ও কিছু বলার ছিল। আর এটা আমাদের ব্যক্তিগত ব্যাপার ছিল। যেদিন আপনার ব্যক্তিগত ব্যাপার নিয়ে এভাবে লাইভ টিভিতে আলোচনা হবে বুঝবেন। ”
ধরিত্রীর আর কিছু বলার থাকে না। হয়তো পরকীয়া করে ধরা খাওয়ার পর এভাবেই দিয়াকে পাল্টা দোষারোপ করেছিল। বিশ্বাসঘাতকতা আর মানসিক চাপ, দুটোর জন্যই তিনি স্ট্রোক করেছিল। ফরহাদ হাতে তালি দিয়ে বলল, “এভাবেই এমন অদক্ষ সাংঘাতিক, উপস! সাংবাদিকদের দিয়ে লেখালে এমনই হবে। আপনি তো আবার সাংবাদিক নন।” ধরিত্রী ফরহাদের কোনো কথাই কানে নিচ্ছিল না। সে রেগে বলল, “আপনি যদি অনুতপ্ত হন, এতটা খারাপ না হন, তবে কেন ওনার পাশে হাসপাতালে ছিলেন না কেন? আপনার ছোট দুই সন্তানের পাশে ছিলেন না কেন? কেন তারা অসহায়ের মতো দাঁড়িয়ে আছে। এত বাজে কাজ করার পর জাস্টিফাই করছেন কোন সাহসে!” ধরিত্রী খুব উত্তেজিত হয়ে গেল। উপস্থাপিকা ধরিত্রী কে বলল, “মিসেস ধরিত্রী, কাম ডাউন। ইউ কান্ট শাউট হিয়ার। প্রিয় দর্শক, আমরা যাচ্ছি একটি ছোট্ট বিরতিতে। ” বিরতিতে যাওয়ার পর ফরহাদ ধরিত্রীকে বলল, ” স্যরি ধরিত্রী, আজকের পর হয়তো আর জাগরণ পত্রিকা থাকবে না। কারণ আমি এরপর প্রস্তাব করবো জাগরণ পত্রিকার লাইসেন্স বাতিল করতে।” ধরিত্রী অত্যন্ত ঘৃণার সাথে তাকালো ফরহাদের দিকে, “আপনার কী লজ্জা করে না? একটিবার কী মানুষ কে নারী পুরুষের বাইরে শুধু মানুষ হিসেবে দেখতে ইচ্ছে হয়না?” ফরহাদ কিছু বলল না।
মীরা রাফসানকে ফোন দিয়ে বলল,
– তুই কোথায়?
– হাসপাতালে।
– ওর কাছে না?
– না।
– প্লিজ ওর কাছে যা। ও হয়তো মানসিক ভাবে ভেঙে পড়েছে। একটু পর যা হবে এরপর ও তোকে দরকার। ওকে ইয়েলো জার্নালিস্ট হিসেবে ঘোষণা করবে বলে মনে হচ্ছে। এই লোকটা খুবই বাজে। অলরেডি তার আর্টিকলে ধরিত্রীকে কয়েকবার ফ্রড ইয়েলো জার্নালিস্ট বলেছে। আমার খুব খারাপ লাগছে। ওর ক্যারিয়ারের ব্যাপার।
রাফসান ফোনটা রেখে দিল। ও বের হতে যাবে তখনই ওর মনে হলো ধরিত্রীর উদ্দেশ্যকে সেই ব্যক্তি ভুল ভাবে ব্যাখ্যা করছে। ওর তুলে ধরতে হবে সেই উদ্দেশ্য কে।
ব্রেকের পর ফরহাদ কে বলার সুযোগ দেওয়া হলো, “আমার আর কিছুই বলার নেই। আমার বক্তব্য এই ভদ্রমহিলা নিজেই প্রমাণ করে দিয়েছে। উনি ইয়েলো জার্নালিজমের নিকৃষ্ট উদাহরণ। উনি নারীবাদী নামের কলঙ্ক। উইমেন কার্ড আর ভিকটিম কার্ড খেলতে ইনি অভ্যস্ত। এর আগেও করেছেন। আমার আহ্বান তথ্য মন্ত্রণালয়কে, এসব ব্যাঙের ছাতার মতো অনলাইন মিডিয়া বন্ধ করুন। বিশেষ করে এনাদের লাইসেন্স বাতিল করুন।”
ধরিত্রী চুপ করে বসে আছে। ও অবাক হচ্ছে, এরকম একজন অপরাধীকে এই টিভি চ্যানেল আত্মপক্ষ সমর্থনের সুযোগ দিয়েছে। টি আর পি এর জন্য এরা সব করতে পারে। হঠাৎ উপস্থাপিকা বলতে লাগলো, “দর্শক, আমাদের সাথে এই মুহূর্তে একজন বিশেষ অতিথি যোগ দিচ্ছেন ফোন কলের মাধ্যমে। জ্বী, আপনার পরিচয় দিন।”
“আমি আমার কী পরিচয় দেব তা আমি জানি না। লজ্জা করছে, তবে এখানে থাকা অভিযুক্ত লোকটি আমার ভাই। তবে যেই ভুক্তভোগী মহিলা আছেন, তিনি আমার ভাবি। তিনি আমার মা। এই অকৃতজ্ঞ লোকটির পরিবারের জন্য তিনি সর্বস্ব বিলিয়ে দিয়েছেন। তিনি অপরাধী, কারণ তিনি তার স্বামীকে সময় দেননি। কারণ তিনি তার মুমূর্ষু শাশুড়ির সেবা করছিলেন। তিনি অপরাধী, কারণ তিনি তার সন্তান আর শ্বশুর শাশুড়ির সন্তানদের মানুষ করছিলেন। তিনি অপরাধী, কারণ তিনি এত বছর পর বয়সের ভারে পরিবর্তন হয়ে গেছেন। আগের মতো আর সুন্দরী নেই। তিনি অপরাধী, কারণ তিনি তার চাচাতো বোনকে তার ক্ষমতাধর স্বামী থেকে বাঁচাননি। তাহলে উনিও কেন বাঁচাননি? সহানুভূতি দেখাচ্ছিলেন, অ্যাফেয়ার কেন করলেন? সেই মহিলার স্বামী না হয় খারাপ, আমার ভাই আর সেই মহিলাও তো ওনার পথেই হাঁটলেন। একজন মানুষ প্রতারিত হয়ে সর্বস্ব হারিয়েছে। সেখানে তার পাশে দাঁড়ানোর থেকে এই সমাজের মানুষের কাছে প্রতারকের কাছ থেকে কাহিনী শোনা গুরুত্বপূর্ণ। আপনারা আপনাদের সমাজ নিয়ে থাকুন। আমি চাইবো আমার ভাবি যাতে আপনাদের এই রূপ না দেখে। এই লোকটা তাকে চিট করে উল্টো তাকেই দোষারোপ করেছে। আর তার বোনের কথা না হয় বাদ দিলাম। আমি তাকে চিনি না। কিন্তু আমার ভাইকে চিনি। আমি কোনো বিচার চাই না। কারণ যে দেশে ধর্ষ*কের বিচার হয় না সে দেশে বিশ্বাসঘাতকদের কী হবে? আপনাদের বিবেক অনেক আগেই মরে গেছে। জানি ভাইয়া তোমার জেল হবে না, ঐ মহিলার ও হবে না। তোমাদের অবস্থানে তোমরাই ভুক্তভোগী। কিন্তু আমার দিক থেকে আমি ভাবিকে দেখেছি। লজ্জা যদি থাকে অন্তত এই চেহারা আর কাউকে দেখিও না। ”
উপস্থাপিকা এবার ধরিত্রী কে কিছু বলতে বলল, ” আমি ভালো না খারাপ তা বিচার নিয়ে আমার কিছু আসে যায় না। আমি চাইবো ওনার চিকিৎসার দায়িত্ব কেউ নিক। ওনার সন্তানদের পাশে কেউ দাঁড়াক। উনি যাতে আবার বাঁচতে পারেন। আমি কোনো ক্লিকের জন্য এই খবর করিনি। আমার স্বামীর পেশেন্ট উনি। আমার খারাপ লেগেছিল। আমি খবর বানাতে জানি না ফরহাদ স্যার। ওটা আপনি আমাকে সেখাননি। তার আগেই আমি বের হয়ে গেছি। ওটা আপনি ভালো জানেন। ”
একটু পর আরেকটা কল আসলো স্টুডিও তে। উপস্থাপিকা কল টা স্পিকারে দিল, “আমি কাজী হেল্থ কেয়ার থেকে বলছি। ভুক্তভোগী মহিলার চিকিৎসা নিয়ে কোনো চিন্তা করতে হবে না। তার দায়িত্ব আমাদের সিইও নিতে চাইছে। আর তার সন্তানদের দায়িত্ব ও। ওনাদের কোনো গার্জেন থাকলে আমাদের সাথে যোগাযোগের ব্যবস্থা করে দিলে ভালো হয়।”
ধরিত্রী খুশি হয়ে বলল, “অনেক অনেক ধন্যবাদ। আমি এটাই চেয়েছিলাম। আর চেয়েছিলাম সবাই যাতে এই প্রতারকদের ঘৃণা করুক। সহানুভূতি না দিক। কারণ যেটাই হোক না কেন তাদের কাছে আসার, মিসেস দিয়ার কোনো দোষ ছিল না।”
মীরা ওর হসাপাতালে টিভির সামনে এসব দেখেছে। ওর আশেপাশে সবাই আনন্দ করছে। কারণ ও কাজী হেল্থ কেয়ারের হাসপাতালে কাজ করে। অঙ্কনদের হাসপাতাল। অঙ্কন ও কী এই শো দেখছিল? ও হঠাৎ এমন কেন করল? হঠাৎ ওর ফোনে মেসেজ আসলো, “আর ইউ হ্যাপি নাও?” মীরা কোনো জবাব দিলো না।
রাফসান সেই মহিলার দেবর আর বাচ্চাদের পাশেই দাঁড়িয়ে ছিল। ও গিয়েই তাদের ফোন করিয়েছিল। যাক অন্তত ধরিত্রীর বক্তব্য সবাই জানলো।
“আমার স্ত্রীর উদ্দেশ্য কখনো খারাপ ছিল না। আশা করি তোমরা ওকে এরপর থেকে ভুল বুঝবে না। ও এরপর আসলে একটু সুন্দর করে কথা বলো, প্লিজ।” রাফসানের কথা শুনে ওরা খুশির হাসি হাসলো। এরপর মিসেস দিয়ার মেয়ে বলল, “ধরিত্রী আপুকে একটা ধন্যবাদ দিতে হবে। ওকে কাল আসতে বলবেন।”
রুবাইয়া ধরিত্রীকে ফোন দিলো,
– তুই ঠিক আছিস?
– জ্বী মা।
– সোজা গাড়িতে উঠবি। ঐ বদমাশ লোকটার সাথে কথা বলার কিছুই নেই। সে তোকে আরো উষ্কাবে।
– জানি। তাই বলছি না।
অনুষ্ঠান শেষে ফরহাদ ধরিত্রীকে বলল,
– বিয়ে করেছ, দাওয়াত ও দিলে না।
– আপনি নিজেকে প্রশ্ন করুন, আপনি দাওয়াতের যোগ্য কি না।
– হ্যালো, কথা বলতে শিখেছ দেখেছি।
– মিস্টার ফরহাদ, আজকে আপনি যা করেছেন তা অনেক নিকৃষ্ট ছিল। আপনি যে এত নীচে নামবেন আমি জানতাম না। আপনি আপনার ব্যক্তিগত লাভের জন্য ঐ মহিলার কাহিনীকে ব্যবহার করেছেন!
– করলাম। কারণ একজন সাংবাদিক কখনো পুরো সত্য তুলে ধরে না। মিথ্যার সাথে সত্য তুলে ধরে। কারণ শত ভাগ সত্যি ঘটনা কখনো খবর হয় না। মিশ্রণটাই খবর।
– আর আমি সেই সাংবাদিক না। আমি সত্যই তুলে ধরি।
– দেখ ধরিত্রী, বড় হয়েছ। বিয়েও করেছ। এমন থাকলে বেশিদিন লাগবে না ডিভোর্স হতে।
– আমি ঠিকই আছি, আর আমার স্বামী ও ঠিক আছে।
– ধরো ধরিত্রী, তোমার স্বামী ও এমনটাই করে বসলো। সহানুভূতি দিতে দিতে পাশে শুয়েই পড়লো। তখন কী করবে?
– ও করবে না স্যার।
– দেখা যাক, তোমাদের মতো নেড়িবাদীদের কপালে এমন “সুপুরুষ” ই জোটে।
– আর আপনাদের কপালে কিছুই জোটে না।
এই বলে ধরিত্রী সেখান থেকে চলে আসলো। মিনিটেই ধরিত্রীর ফোনে অনেক অনেক শুভেচ্ছা বার্তা আসতে শুরু করলো। সেখানে অঙ্কনের ও শুভেচ্ছা আছে। আর সমালোচনা শুরু হলো ফরহাদ সাহেবের আর এই টিভি চ্যানেলের। তারা কীভাবে নিজেদের ফায়দার জন্য নীচে নামতে পারে। এদিকে মীরার মনে দুশ্চিন্তা, অঙ্কন কেন ধরিত্রীর শো দেখছিল?
(চলবে)