#ধরিত্রী_কথন
#পার্ট২০
#পিকলি_পিকু
ধরিত্রীর ফোন বাঁজছে। অফিসেই ও। নাম্বার টা তো অপরিচিত।
– হ্যালো, কে বলছেন?
– আমি রাধা বলছি। মনে আছে?
– রাফসানের ক্লাসমেট?
– জ্বী। কেমন আছ?
– ভালো। আপনি?
– ভালো। আমি তোমার নতুন স্টোরিটা পড়েছি। অনেক সুন্দর ছিল।
– ধন্যবাদ।
– তবে আমি শুধু এটা বলতেই ফোন করিনি। একটা গুরুত্বপূর্ণ কথা ছিল। রিকোয়েস্ট ছিল।
– জ্বী?
– মীরার সাথে তোমার ভালো সম্পর্ক না?
– হ্যাঁ।
– ওর সাথে ঘুরতে যাও।
– জ্বী। কিন্তু আপনি?
– ছবি দেখেছি। একটা জিনিস কী জানো ওর ব্যাপারে?
– জ্বী?
রাধা ওর ফোন টা অপর কানে নিল। এরপর বলল,
– এই মাসের ২৫ তারিখ ওর জন্মদিন।
– তাই! জানি না তো।
– বলেনি। বলবে না আমি জানি। আসলে ও এইসব জন্মদিন পালন করেনা বেশি। কিন্তু আমি ঠিক করেছি এবার ওর জন্মদিন পালন করব।
– খুব ভালো হবে।
– কিন্তু ধরিত্রী, শর্ত আছে।
– কী শর্ত?
– শর্ত হচ্ছে, ওকে বলতে পারবে না আমি করছি এসব। তোমার কাজ হচ্ছে, ২৫ তারিখ ওকে নিয়ে আমার বলা জায়গায় আসবে। প্রস্তুতি আমি নিয়ে নেব।
– আর তো মাত্র পনের দিন।
– অনেক সময়। তোমাকে আগেই বললাম।
– আমিও করতে চাই। মানে আমিও সাহায্য করতে চাই।
– দরকার নেই।
– একা পারবেন?
– না, মিম রিমা ও থাকবে। আমরা ঐদিন ছুটি নেব ভেবেছি। আর শোনো, রাফসানকে বলবে না।
– কেন? ও শুনলে কী হবে?
– আসলে ধরিত্রী, মীরা আর আমার একটা ঝগড়া হয়েছিল। কী কারণ তা আমি বলতে চাই না। আমরা অনেক বছর ধরে কথা বলি না। ঐদিন তোমাদের বিয়েতে ওকে দেখে মনে হয়েছিল সব ঠিক করে নেই। কিন্তু পারিনি। আমি সব ঠিক করতে চাই। তাই জন্য ওর জন্মদিনের আয়োজন করতে চাই। রাফসান জানলে মীরাকে বলে দিলে ও যদি আর না আসে?
– অবশ্যই আসবে। আমি আপনাদের সাহায্য করবো।
ধরিত্রী মীরার জন্মদিন উপলক্ষে খুব খুশি। ও লুকিয়ে লুকিয়ে মীরার জন্য উপহার কিনেছে। ইদানিং মীরার সাথে ওর ভাব জমেছে। মীরা তো এখন বাসাতেও আসে। এই পনের দিনে মীরা আর ধরিত্রীর বন্ধুত্ব অনেক গাঢ় হয়েছে। যেন ওরা ছোটবেলার বন্ধু। মীরা রাফসানের বেডরুমে আগে এক ঝটকায় ঢুকে যেত। এখন কেমন যেন লাগছে।
– আসোনা।
– জ্বী ধরিত্রী।
– অঙ্কন ভাইয়া কোথায়?
– অফিসে।
– উনি কী তোমাকে সময় দেয়?
– অনেক।
– ওনাকে বলো না, রাফসানকে শেখাতে। রাফসানকে একদিন পাওয়া গেলে দশদিন পাওয়া যায় না। আমি কী করে সংসার করবো।
মীরা ধরিত্রীর বারান্দায় গিয়েছে। কী সুন্দর গাছ গুলো শৈল্পিক একটা ব্যাপার। মনটা মুহূর্তে ঠান্ডা হয়ে যায়। ধরিত্রীর বারান্দাটা ধরিত্রীর মতো। কিন্তু দোলনা টা কোথায়?
– ধরিত্রী।
– জ্বী?
– তোমার দোলনা টা কোথায়?
– ভেঙে গেছে।
– কী করে? তুমি এত হালকা।
– আমার জন্য না। রাফসানকে বলো না। নিজে বসলো, আবার আমাকে নিয়েও বসলো। আর ধড়াম করে পড়লাম।
মীরা হাসতে হাসতে শেষ। রাফসান ও না।
– কিন্তু ওটাতে তো একজনই বসতে পারে।
– হ্যাঁ।
– দুজন কী করে? আরেকজনের জায়গা হলো কীভাবে?
– এখন, কী করে বলি?
ধরিত্রী লজ্জায় লাল হয়ে গেছে। মীরা আরো জোরে হাসতে লাগলো।
– ছাত্রীকে কোলে নিয়ে পড়া বোঝাচ্ছিল?
– যাহ! মীরা তুমি ও একদম।
– ওরে লজ্জাবতী! কিন্তু এখন আর তুমি দোলনায় বসে লেখ না?
– না। ওটা আবার লাগানো হয়েছে। রাশার বারান্দায়। রাফসানকে বলেছি এরপর একটা দুজনের দোলনা আনতে। এতই যখন চড়ার শখ।
– ভুলে গেছে?
– তা আর বলতে। থাক। আমি এই মোড়ায় বসি এখন। পা তুলে বসা হয় না।
মীরা ঘরের ভেতরে আসলো। ঘরটা একদম ধরিত্রীময়। ধরিত্রীর পছন্দের জিনিসে ঘেরা। ধরিত্রী ছবি, ধরিত্রীর আঁকা ছবি, ধরিত্রীর প্রিয় ফুল সব। ধরিত্রী ওর ড্রেসিংরুমে গেল। জামা বদলে এখন দরজা খুলে সাজছে। মীরা উঁকি দিয়ে দেখছে। ধরিত্রী ওকে ভেতরে ডাকলো।
– বাহ! তোমার ড্রেসিংরুম ও তোমার মতো।
– এটা তো রাফসানের প্রিয় জায়গা।
– সত্যি?
– হ্যাঁ।
– কী করে ও? এটা তো সাজার জায়গা। ও তো এত সাজে না।
ধরিত্রী আর কিছু বলল না। ওর গয়না পরছে। গায়ের সাথে লাগিয়ে লাগিয়ে দেখছে।
– কোনটা ভালো, বলো না?
– মাটির টা পরো।
ধরিত্রী মাটির গয়না পরে মীরার দিকে তাকায়। ও তেমন কোনো গয়না পরেনি।
– তুমি তো কিছুই পরোনি।
– আরে, কাজের জন্য জলদি জলদি বের হতে সাজার অভ্যাস টাই চলে গেছে। আর এত গয়নাগাটির সাধ নেই আমার।
– আজকে পরো।
– কোথায় পাব?
– আমার এখান থেকে পরো। অনেক আছে, দেখি।
ধরিত্রী ওর পুরো গয়নার ড্রয়ার খুলে বসলো। অনেক গয়না ওর।র অনেক গুলো এলোমেলো। অনেক গুলো গোছানো। মীরাকে ও খুব সুন্দর সুন্দর গয়না পরিয়ে দিল। কিন্তু বিপত্তি এখানেই, মীরার হাতে ওর চুড়ি ঢুকছেই না। অতঃপর ধরিত্রী রাফসানের দেওয়া লাল চুড়ি গুলো বের করলো। সেগুলো মীরার হাতে একদম সুন্দর করে ঢুকেছে।
– একদম পারফেক্ট!
– বাহ! এগুলো বড় সাইজের কী করে?
– কারণ এগুলো তোমার বন্ধু এনেছে। ও আমার হাতের মাপ জানে না।
– এত শুকনো হাত তো কী করবে?
ওদের দুজনকে বের হতে দেখলো রুবাইয়া।
– আজকাল ধরিত্রী ম্যাডামের দেখছি নতুন বন্ধু জুটেছে।
– হ্যাঁ, খুব।
– নতুন পেলে বুঝি পুরনোকে ভুলে যেতে হয়?
– ভুলেছি কোথায়? তুমি এখন কখন আসো তো আমি দেখি না। যাবে আমাদের সাথে?
– না থাক। অন্যদিন যাই।
– কেন শরীর খারাপ করল নাকি?
– একটু ক্লান্ত। দুটো ডেলিভারি করেছি।
– রেস্ট নাও। আর বেশি চাপ নিও না।
– নিচ্ছি না। তুই সাবধানে যা।
ধরিত্রী এরপর মীরার সাথে বেরিয়ে গেল। মীরা খুব ভালো করেই বুঝতে পারে রুবাইয়া ওকে এখনো খুব একটা পছন্দ করে না। বাইরে মাশরুফার সাথেও দেখা হলো। ভেতরে আসার পর মাশরুফা বলল,
– মীরা ইদানিং অনেক আসে, তাই না?
– ধরিত্রীর বন্ধু এখন।
– ওর তো সবাই বন্ধু। ভাবী, তুমি কী এখনো ওর উপর রাগ?
– আরে না। যা করেছিল তা তো অনেক বছর আগেই।
– তাও। এখনো কী ওরকমই তর্ক করে?
– টিনেজাররা ওরকম করেই। যেই ঘটনা বলছি সেটা অনেক বছর আগের। রাফসানের এইচএসসির টেস্ট পরীক্ষার সময়কার। আমার মনে হয় মীরার ও মনে নেই।
– মনে নেই না ছাই। ওর মধ্যে সবসময় কম্পিটিশন ছিল। যেন ও জানে রাফসানকে তোমার থেকে বেশি। এমন যদি জেনেই থাকে তো বিয়েটা রাফসানকেই করলে পারতো।
– মাশরুফা!!! কী যা তা বলছ!
– স্যরি ভাবী।
– রাফসান এখন বিবাহিত। ধরিত্রী আছে। এসব আজেবাজে কথা যাতে আর না শুনি।
– না, বলছিলাম, ও যদি এখন ধরিত্রীর সাথে কম্পিটিশন করে?
– ওরা দুজনেই এখন বিবাহিত আর যথেষ্ট ম্যাচিউর। মাশরুফা তুমি এসব কেন চিন্তা করছ?
– বলছি ওদের এত সখ্যতা,
– তো কী হয়েছে? ধরিত্রী এমনই। মীরা কিছু দেখালেও ধরিত্রী ওর সাথে রাগবে না।
– তুমি বুঝি নিপাকে ভুলে গেছ?
– তোর স্বামীর ক্লাসমেট? আচ্ছা, বল তো, নিপা এখন কোথায়?
– কী জানি?
– পাশে কে?
– আমি আর কে? তবুও, অশান্তি তো হয়েছিল।
– তা আপনি করেছেন তাই। বলি মাশরুফা, কেউ কিছুকে স্বাভাবিক দেখতে চাইলে আমরা কেন তাকে সব আমাদের মতোই দেখাই? ধরিত্রী তো মীরাকে হিংসে করে না। এটা একটা পজিটিভ পয়েন্ট যে ওদের মধ্যে ঝামেলা হবে না।
ধরিত্রী আর মীরা রিক্সায় রাধার বলা সেই রেস্টুরেন্টে যাচ্ছে।
– ধরিত্রী আমরা কোথায় যাচ্ছি?
– ভালো একটা জায়গায়।
– রাফসান কী তোমাকে কিছু বলেছে?
– কিছু না।
– সত্যি করে বলো।
– কিছু না মীরাবাঈ।
– এই! তুমি কী বললে?
– স্যরি, স্যরি। রাগ করেছ? ভুলে বললাম।
– উফফ! এই মীরাবাঈ গানটা আমাকে অতিষ্ঠ করে দেয়।
– ঝাঁকানাকা ঝাঁকানাকা!
– চুপ করো!
– এটা তোমার পছন্দ না? আমার নামে কোনো গান হলে আমার খুব পছন্দ হয়। আমার মা আমাকে চিনি ডাকে। ছোটবেলায় যখনই “আমি চিনি গো চিনি তোমারে …” গানটা বাজতো, আমার খুব ভালো লাগতো।
– মানে, সবই ঠিক। শুধু এই দেহ দোলানা। খুবই বিচ্ছিরি। তবে মীরাবাঈ নামটা সুন্দর।
– তোমাকে আমি মীরাবাঈ ডাকি? রাগ করবে?
– কেন?
– আমার না, সবাইকে নতুন নতুন নাম দেওয়ার অভ্যাস।
– ভালোবেসে ডাকো?
– হুম।
– রাফসানকে কী ডাকো?
– বলা যাবে না।
– থাক স্বামী স্ত্রীর ব্যাপার। নাক না গলাই।
মীরা কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বলে,
– এক শর্তে মীরাবাঈ ডাকতে দিতে পারি।
– কী?
– আমি তোমাকে ধরাবাঈ ডাকবো।
– তাহলে ডান। মীরাবাঈ আর ধরাবাঈ। হাহাহাহ!
এই বলতে বলতে ওরা চলে এসেছে সেই ক্যাফেতে। ঢুকতেই সেখানে গান বাঁজছে।
“ঝাঁকানাকা ঝাঁকানাকা ঝাঁকানাকা দেহ দোলানা
মন বলে মন বলে মন বলে দেহ ঝোকা না
মীরাবাঈ
হেইলা দুইলা দরবার নাচায়। ”
মীরা ধরিত্রীর দিকে তাকায়। ধরিত্রী হাত সামনের দিকে দেখায়। মীরা সামনে তাকাতেই মিম রিমা আর রাধা “সারপ্রাইজ! ” বলে এগিয়ে আসে।
“হ্যাপি বার্থডে টু ইউ!
হ্যাপি বার্থডে টু ইউ!
হ্যাপি বার্থডে ডিয়ার মীরা
হ্যাপি বার্থডে টু ইউ!”
মীরা অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকে। রাধা! মিম! আর রিমা! এই তিনজন! ওরা কী করতে চায়?
“ধন্যবাদ ধরিত্রী। তুমি না থাকলে ও এখানে থাকতো না।”
রাধা বলল। মীরা ধরিত্রীর দিকে তাকায়। ধরিত্রী হাসতে থাকে। তো ওরা এখন ধরিত্রীকে ব্যবহার করছে ওকে অপদস্থ করতে।
“স্যরি রে মীরা। সেদিন যা হয়েছিল, তার জন্য ক্ষমা করে দিস। আমরা আবার বন্ধু হয়ে যাই?” রাধার মুখে এসব শুনে মীরার রাগে গা জ্বলে যাচ্ছে। রাধা মুচকি হাসছে। কারণ অন্যায় টা মীরা করেছিল ওর সাথে। আজকে ওকে অপদস্থ করতেই এখানে এনেছে। ওর নিজের মুখ থেকে স্বীকার করাবে মীরা ঠিক কতটা বিষধর। এদিকে রিমা মিমের কানে বলছে,
– হচ্ছে টা কী?
– রাধার প্ল্যান আছে।
– সত্যি? ধরিত্রীর সামনে?
– হুম। কিন্তু আমি এসেছি রাধাকে আটকাতে। আর যাই হোক, ধরিত্রী এখনো কিছু জানে না। ওর সাথে এত খারাপ আচরণ হওয়া উচিত না।
– ঠিক। রাধা কী করবে?
– ও জানে। কিন্তু রেডি থাকিস।
সবাই মিলে এবার মীরার জন্মদিনের কেক কাটলো। ওকে উপহার দিল। ছবি তুলল। এখন রাধার স্পেশাল গিফ্ট।
“প্রিয় বন্ধু মীরা, তোর জন্মদিনে আমি তোর জন্য এই সারপ্রাইজ গিফ্টের আয়োজন করেছি। এই ভিডিওটা, আমাদের বন্ধুত্বের সাক্ষী। অনেক দুর্লভ ছবি আছে এতে।”
রাধা ওর ল্যাপটপে সেই ভিডিও প্রদর্শন করছে। ওরা পাঁচজন বসে সেই ভিডিও দেখছে। মীরাদের স্কুলের ছবি সব। মীরা রাধার অনেক ছোটবেলার ছবি। এবার আস্তে আস্তে রাফসানের ছবি। রাফসান আর মীরা, অনেক ভালো বন্ধু। তাই বাকি সবার থেকে ওদের ছবি গুলো বেশি কাছাকাছি। অনেক অন্তরঙ্গ, যে কেউ বলবে ওদের প্রেম চলছে। মিম রাধাকে খোঁচা মেরে বলল এখন বন্ধ করতে। রাধা ওর কথা শুনেও শুনল না। তাই পরিস্থিতি সামলাতে,
“ওরা অনেক ভালো বন্ধু ছিল।” মিম বলল।
“হ্যাঁ, হ্যাঁ। অনেক ভালো বন্ধু। ” রিমা বলল।
” এত ভালো বন্ধু যে রাফসানের পাশে কাউকে সহ্যই করতে পারে না।” এই কথা বলে রাধা মুচকি হেসে চুল ঠিক করে আবার বলল, “এখনো পারেনা।”
মীরার ইচ্ছে হচ্ছে রাধাকে দুটো চ*ড় মা*রতে। ও আর ধরিত্রীর দিকে তাকাচ্ছে না।
“রাফসান কী সারাদিন পড়তো? তখন ও অনেক কিউট ছিল। গালে একদম দাড়ি ছিল না। যেন বাচ্চা একটা।” ধরিত্রী খিলখিল করে হাসতে থাকে। এ কী! ওর কী একটুও অনুভূতি নেই? ওর স্বামীর এত কাছে একজন মহিলা। মীরা এবার হেসে বলল, “হ্যাঁ, আর তখন হাইটেও ছোট ছিল। এরপর হুড়হুড় করে তালগাছ হয়ে গেল। নইলে আমি ওর মাথায় থাপড়ানো কখন ছেড়েছি।” ওর কথা শুনে ধরিত্রী বলল, “তাই?”
মিম আর রিমা স্বস্তির নিঃশ্বাস ছাড়লো। ধরিত্রী কিছুই মনে করেনি। নানা কথার পর মিম রাধাকে ডেকে বলল,
– আজকে যা করছিস পরে আর কখনো করিস না।
– কেন করবো না? আমরা কোনো বদলা নেব না?
– বদলা প্রকৃতি ঠিকই নেবে। প্রকৃতির প্রতিশোধ সবচেয়ে বড় আর সন্তুষ্টির। আর তোর এই বদলায় ধরিত্রীকে টানিস না। ও নিষ্পাপ। মীরাকে অপদস্থ করতে গিয়ে ধরিত্রী ও অপদস্থ হতে পারতো।
– কিন্তু আমার ধরিত্রীর সাথে মীরার বন্ধুত্ব সহ্য হয় না। ও ওকেও আমার মতো রাফসানের কাছে থেকে সরিয়ে দেবে।
“কেন?” মীরা বলল। রাধার মেজাজ এখন সপ্তম আকাশে।
– তোর লজ্জা করে না ধরিত্রীর পাশে ঘেঁষতে?
– না। আমার লজ্জা করে না। কারণ আমি কোনো ভুল করছি না। আর ধরিত্রীর পাশে আমি ঘেঁষিনি। ও নিজেই আমার পাশে এসেছে। ও আমাকে পছন্দ করেছে। আমার পার্সোনালিটিটাই এমন।
– তোর না ওর। ও সবার সাথেই মিশতে পারে। আসল রূপটা দেখতে জানে না।
– যেটাই হোক। তোর আমার আর রাফসানের মাঝে বিষ মেশানোর স্বভাব টা গেল না।
– আমি বিষ মেশাই? তুই মিশাস মীরা! আর তাই আমি তোকে ধরিত্রী আর রাফসানের মাঝে আসতে দেব না। দেখবি একদিন, ধরিত্রী তোকে ওর আর নিজের স্বামীর মাঝখান থেকে ছুঁড়ে ফেলে দেবে।
এই কথা শোনার পর মীরা রাধার দিকে তাকিয়ে ভ্রূ উঁচু করলো। এরপর হেসে বলল,
– এই চুড়ি টা দেখতে পারছিস?
– কী আছে এই চুড়িতে?
– এই চুড়ি গুলো রাফসান এনেছিল, ধরিত্রীর জন্য।
– তুই কী করেছিস!
রাধা উত্তেজিত হয়ে যাচ্ছিল। মিম রাধার হাত টেনে ওকে ঠান্ডা করতে থাকে, “রাধা, এটা পাবলিক প্লেস। সিন ক্রিয়েট করিস না।”
– আমি কিছু করিনি। ধরিত্রী নিজেই দিয়েছে। ভালোবেসে দিয়েছে। ওর মনে আমার জন্য কোনো নেতিবাচক ধারণা নেই।
– কিন্তু তুই!
– আমার ও নেই। অনেক দিন পর একটা ভালো বন্ধু পেয়েছি। অনেক দিন পর নিজেকে একা লাগছে না। আল্লাহর দোহাই তোরা এটা নষ্ট করিস না।
– স্যরি মীরা, আগে হলে তোকে বিশ্বাস করে নিতাম। কিন্তু তুই কারো আপন না। হতে পারিস না।
“ধরিত্রী! এই মীরা মিম রাধা এদিকে আয়! ওর কী যেন হয়ে গেছে।” ওরা সবাই সেখানে গিয়ে দেখলো ধরিত্রী অজ্ঞান হয়ে পড়ে আছে। মীরা গিয়ে ওর পালস রেট পরীক্ষা করল। এরপর ওর জ্ঞান ফেরালো। দুর্বল ধরিত্রীকে নিয়ে ওরা পার্শ্ববর্তী একটা হাসপাতালে গেল। সেখানে খবর দেওয়ার পর রাফসান আর রাফসানের মা ও আসলো।
“ধরা, তুমি ঠিক আছ?” রাফসান এসে ধরিত্রীর হাত ধরে ওর খাটে বসলো। রুবাইয়া এসেই কেবিনের বাইরে মীরাকে দেখল। এরপর সে ধরিত্রীর দুর্বল শরীর দেখে রুদ্রমুর্তি হয়ে মীরাকে জিজ্ঞেস করল,
– তুমি ওকে নিয়ে কোথায় গিয়েছিলে?
– আমি না আন্টি, ও আমাকে এনেছিল।
মীরাও পাল্টা জবাব দিল। অনেক ঝাঁঝালো গলায়ই বলল। ওর এই তর্ক করার স্বভাব টা গেল না। তাই রুবাইয়া ও পাল্টা প্রশ্ন করল,
– কোথায় গিয়েছিলে তোমরা? আমিও তো যাই ওর সাথে। তখন তো এমন কিছু হয় না।
– আমি কী করে বলব? ওর স্বাস্থ্য ভালো ছিল। ওখানেও ভালো ছিল। এখন হুট করে অসুস্থ হয়ে পড়লে আমার কী করার আছে আন্টি?
রাধা আর মিম রিমা মীরার বকা খাওয়া দেখছে। আলাদা এক সন্তুষ্টি হচ্ছে। এমন দৃশ্য আগেও কয়েকবার দেখেছে। স্কুল কলেজের সময়। পুরনো স্মৃতি মনে পড়ে গেল। কিন্তু রুবাইয়ার আর মীরার সাথে বাকবিতণ্ডার ইচ্ছে নেই।
– ডাক্তার কোথায়?
– ওদিকে।
– কী টেস্ট করেছে? প্রেসার কেমন?
“এক্সকিউজ মি! ফারহিন জামান ধরিত্রী?”
রাফসান ভেতর থেকে এগিয়ে এসে বলল, “আমি! আমি ওনার হাসবেন্ড। ”
“কংগ্রাচুলেশন! আপনার স্ত্রী প্রেগনেন্ট। উনি মা হতে চলেছেন। ওনার ব্লাড টেস্ট রিপোর্ট।”
সবাই স্তম্ভিত হয়ে গেছে। রুবাইয়া কথা বলতে পারছে না। তাও ধরিত্রীর পাশে গিয়ে বসলো। “কংগ্রাচুলেশন মামনি!” ধরিত্রী ভ্যাঁ ভ্যাঁ করে কাঁদতে লাগলো। আর এদিকে রাফসানের চোখে জল চলে আসলো। ও কতটা খুশি ও বলে বোঝাতে পারবেনা। মিম রিমা আর রাধা হাত তালি দিয়ে নতুন মা বাবাকে অভিনন্দন জানাচ্ছে।
“আরে ধরিত্রী, এভাবে কাঁদছো কেন? তুমি মা হবে এটা তো খুশির খবর।” মিম হাসতে হাসতে বলল।
ধরিত্রী রুবাইয়া কে জড়িয়ে ধরে এখনো কান্না করছে। রাফসান কিছু বুঝতে না পেরে দাঁড়িয়ে আছে। রুবাইয়া রাফসানকে বলল, “তোর বন্ধুদের মিষ্টি মুখ করা।”
“না, আন্টি। ওকে ধরিত্রীর পাশে থাকতে দিন। আমরা ওকে মিষ্টি মুখ করাই।” রিমা এই কথা বলে মিম কে নিয়ে বেরিয়ে এলো। আর এদিকে রাধা মীরাকে টেনে বাইরে নিয়ে আসলো। হাসপাতালের বাইরে ওরা চারজন। রাধা হেসে বলল, “কীরে, তুই খুশি না? এভাবে থাকলে সবাই বলবে তুই নজর দিচ্ছিস। বাই দ্য ওয়ে, মিম। তোর ঐ কথাটা ঠিক। প্রকৃতির প্রতিশোধ সবচেয়ে বড় আর সন্তুষ্টির! ধন্যবাদ ভগবান! আমি বলে বোঝাতে পারব না আমার সন্তুষ্টি। কালই আমি কালী মন্দিরে পূজো দিতে যাব।” রাধা ওর দুই হাত জোড় করে চোখ বন্ধ করে ভগবানকে স্মরণ করে।
(চলবে)