ধরিত্রী_কথন #পার্ট২৩,২৪

0
776

#ধরিত্রী_কথন
#পার্ট২৩,২৪
#পিকলি_পিকু
২৩

মাসুদ আঙ্কেল। অঙ্কনের বাবার বিশ্বস্ত ম্যানেজার। নিজের জীবনের অর্ধেকের বেশি সময় তিনি এই কোম্পানিকে দিয়েছেন। মীরা এখন তার সামনে বসে আছে। ওর চেহারা ঢাকা। চোখে বড় রোদ চশমা। যদিও ওরা একটা ক্যাফেতে বসেছে। তবুও চশমা খুলছে না মীরা। মাসুদ আঙ্কেল মীরাকে দেখে চোখের চশমা খুলে নিজের চোখ মুছলেন।

– আবার?
– হুম।
– কখন করল?
– জন্মদিনে।

মাসুদ আঙ্কেল কিছু বললেন না। জন্মদিনে এত বিভৎস ভাবে কেউ মারে? মীরা আবার বলল,

– আচ্ছা অঙ্কেল, আপনারা চাইলে কী আমার লাইসেন্স বাতিল করতে পারেন?
– মানে?
– ঐদিন অঙ্কন বলছিল।
– আমি এই ভয়টাই পাচ্ছিলাম মীরা।
– তারমানে পারে?
– হ্যাঁ। আরো অনেক বছর আগে অঙ্কনের বাবা করেছিল। আমাদের এখানে একজন ডাক্তার ছিল। সে সব তথ্য মিডিয়া কে ফাঁস করে দিচ্ছিল। উনি তখন ভুল চিকিৎসার দায়ে তাকে ফাঁসিয়ে মেডিকেল কাউন্সিল থেকে তার লাইসেন্স বাতিল করিয়ে জেল খাটায়।
– সত্যি!
– অঙ্কন যে কতটা ক্রেজি তোমার জন্য আমি আন্দাজ করতে পারছি না। ওর এইটা বলা মানে সামনে ও এইটা করবেই।
– এখন উপায়?
– একটা উপায় আছে। তুমি যদি এই হাসপাতাল ছেড়ে অন্য হাসপাতালে কাজ নাও। আর সেই হাসপাতাল যদি সম্পূর্ণরূপে কাজী হেল্থ কেয়ারের পৃষ্ঠপোষকতাহীন হয়।
– কেন?
– তবে ও অন্য কাউকে দিয়ে তোমাকে ফাঁসাতে পারবে না।
– আমি কী করে বের হবো এখান থেকে!

মীরা কাঁদতে থাকে। কাঁদতে কাঁদতে একসময় ওর চশমা খুলে ফেলে। মাসুদ আঙ্কেল মীরার চোখের কালচে দাগ গুলো দেখে।

– মীরা, তোমাকে প্রথম দেখায় অনেক বুদ্ধিমতী ভেবেছিলাম। অনেক ম্যাচিউর। কেন যে হ্যাঁ বললে অঙ্কনকে।
– আঙ্কেল, অঙ্কন তো এমন ছিল না।
– অঙ্কন আগেও এমন ছিল।
– জানি, তবে বদলে গিয়েছিল তো।
– সে তো ক্ষণিকের জন্য।

একটি সেমিনার হচ্ছিল ঢাকায়। দেশের নামি মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র ছাত্রীরা ছিল। অনেক নামী ডাক্তাররাও ছিল। আয়োজক ছিল কাজী হেল্থ গ্রুপ। ব্যবসায় অঙ্কন কখনোই আগ্রহী ছিল না। সেদিন শুধুই ফরমালিটির জন্য গিয়েছিল। অনেক সুন্দরী মেয়েরা ছিলো সেখানে। তবে অঙ্কনের দৃষ্টি কেড়েছিল যে সবচেয়ে বেশি, সে ছিল মীরা। কী দারুন তার ফিগার, কী সুন্দর ওর গায়ের রঙ। সর্বোপরি তার আত্মবিশ্বাস। সাধারণ সালোয়ার কামিজেও কেউ এত দৃষ্টি আকর্ষণ করতে পারে! অঙ্কন নিজের সেক্রেটারিকে মীরার ফোন নাম্বার নিতে বলল। কিন্তু মীরা ফোন নাম্বার দিতে অসম্মতি জানালো। একদম মুখের ওপর না। অঙ্কন আর সেদিকে কোনো পাত্তা দেয়নি।

কিছুদিন যেতেই অঙ্কন শুধু মীরাকে স্বপ্নে দেখত। ওর স্বপ্নের রাজকুমারী।
“She looks just like a dream
The prettiest girl I’ve ever seen”

এ শুধুই শরীরের আকর্ষণ নয়। এ অন্য মায়া। অঙ্কন মীরার সাথে দেখা করতে উঠে পড়ে লাগে। অতঃপর মীরা রাজি হয়।

– আপনি আমাকে কেন ডেকেছেন?
– কাজ ছিল।
– যে কাজটা আপনি চান, তা সম্ভব না।
– কী কাজ মনে করেছেন, বাই দ্য ওয়ে?
– দেখুন, আই নো আবাউট ইউর রেপুটেশন। সারারাত পার্টি আর প্রতিদিন সকালে নতুন নতুন মেয়ের সাথে ঘুম থেকে ওঠা। বাবার অনেক টাকা ওড়ানো। এক কথায় বড় লোক বাবার নষ্ট ছেলে…

অঙ্কন মুগ্ধ হয়ে শুনছিল। মীরা অনবরত সব বলেই যাচ্ছিল। অঙ্কনকে এভাবে ওর দিকে অপলক তাকিয়ে থাকতে দেখে চুপ হয়ে গেল।

– আপনি কী ভাবছেন? আমি কেন এসেছি?
– আমি ঐ ধরণের মেয়ে না মিস্টার অঙ্কন। আমার থেকে দূরে থাকলে ভালো হয়।

মীরা চলে গেল। অঙ্কন বসে রইল। ওর মধ্যে যেন একটা ঝড় বয়ে গেল। কেউ ওর সাথে কখনো এভাবে কথা বলেনি। কেউ ওকে শাসন করেনি। সেখান থেকে আসার পর ওর আর কোনো মেয়েকেই ভালো লাগছে না। কোনো নারীর স্পর্শ ওকে জাগাতে পারছে না। কোনো নেশাই ওকে মাতাল করতে পারছে না। মীরা ওকে জাদু করেছে। অঙ্কন আবার মীরার মেডিকেল কলেজের সামনে এলো। মীরা কথা বলতে চাইল না। মাসুদ আঙ্কেল এসে ওকে রিকোয়েস্ট করল,

– কী ধরণের ছেলে পছন্দ তোমার?
– যে ধরনেরই হোক, আপনি তো না। আপনার থেকে একদম অপজিট।
– গিভ মি আ লিস্ট। একদম বদলে আসবো।
– দরকার নেই। আমার চোখের সামনে থেকে দূর হন। এই চেহারা যাতে আর না দেখি।
– কেন মীরা?
– বিকজ আই হে*ইট ইউ।

অঙ্কন সেদিন খুব কষ্ট পেয়েছিল। কোনো মেয়ের কথায় ও এত কষ্ট পায়নি কখনো। সব মেয়ে ওকে চায়, কিন্তু ও যেই মেয়েকে চায় সে ওকে ঘৃ*ণা করে। অনেক মদ্য*পান করলো সেদিন অঙ্কন। অবশেষে গাড়ি গিয়ে ধাক্কা খেল একটি খুঁটিতে। আহত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হলো। সোস্যাল মিডিয়া থেকে খবর পেল মীরা। এসব ওর জন্যই হয়েছে। হাসপাতালের বেডে শুয়ে অঙ্কন বলছিল,

– মাসুদ আঙ্কেল, আমি ওকে ভুলতে কেন পারছি না।
– কারণ মীরা মেয়েটাই এমন। প্রথমবার কেউ তোমার সাথে এমন ব্যবহার করেছে।
– শুধু কী সেজন্য?
– আর কী জন্য?
– অন্য নারীদের ফিগার আমাকে আকর্ষণ করে। তাদের সিডাকটিভ চলাফেরা আমাকে সিডিউস করে। আই লাইক ইট। কিন্তু এখন আমি চোখ বন্ধ করলে শুধু মীরাকে দেখতে পাই। চোখ খুললে ওকে দেখতে চাই। কিন্ত ওর চোখে আমার জন্য ঘৃ*ণা দেখতে পাই। ওকে আমার কাছে নিয়ে আসুন প্লিজ।
– কী করবে? ওর সাথে রাত কাটাবে? কয় রাত? কত রাত পর ওর নেশা কাটবে? এক রাত না দুই রাত? ও সেরকম মেয়ে না। মারজান মোস্তাফা মীরা। ডক্টর কবির মোস্তাফার একমাত্র মেয়ে। অনেক সম্ভ্রান্ত পরিবারের। খুবই ভদ্র সে। এমন মেয়েকে তুমি কিছু রাতের শয্যাসঙ্গী করতে পার না। সবাই তোমার খেলনা না।
– আমি ওকে জড়িয়ে ধরতে চাই। ওর কোলে মাথা রেখে কাঁদতে চাই আঙ্কেল। আমি মনে হয় ওকে ভালোবাসি। সত্যিকারের ভালোবাসি। কিন্তু ও আমাকে ঘৃ*ণা কেন করে?

প্রথমবার মাসুদ অঙ্কনের চোখে পানি দেখলেন। ওর মায়ের মৃ*ত্যুতেও ওর চোখ থেকে পানি ঝড়েনি। আজকে ওর চোখ থেকে একটা মেয়ের জন্য পানি পড়ছে। অঙ্কন মীরাকে অনেকবারই কল করেছে। মীরা ফোন তোলেনি। অবশেষে ফোন তুলল,

– কী সমস্যা?
– মীরা গিভ মি জাস্ট ওয়ান চান্স!

অঙ্কন কান্না করছে শুনে মীরা ঘাবড়ে গেল।

– কী হয়েছে?
– আমাকে বল, তোমার কী কী সমস্যা। আমি নিজেকে বদলাবো।
– আপনি পুরো মানুষটা বদলাতে পারবেন না।
– চেষ্টা করব।
– সম্ভব না।
– একটা একটা করে বল, আমি লিখছি।
– শুনুন, প্রথমত আপনার চরিত্র। একশো নারীর মধ্যে একজন মীরা হবে না। মীরা ওয়ান এন্ড অনলি।
– ডান। এখন থেকে শুধু মীরা।
– আপনার এই নেশা পানি, এসব চলবে না। নেশা করলে একটা মানুষ অন্য মানুষ হয়ে যায়।
– আজকে থেকে সব বন্ধ।
– আপনার এই অ্যা*ঙ্গার ইস্যুস। থেরাপিতে যেতে হবে। আপনি নাকি ক্লাবে হাতাহাতি মারামারি করেন?
– আমার ব্যাপারে দেখছি খুব ইনভেস্টিগেশন করেছ।
– করতে তো হতোই। আশেপাশে কোন বিপদ ঘুরছে দেখতে হবে না। আর ট্যাটু, কয়টা ট্যাটু?
– ছয়টা। ভাবছি সাত নাম্বার টা করবো। “মীরা।”
– দুঃখিত। ট্যাটু ভালো জিনিস না। এসব আমার পছন্দ না। রিমোভ করতে হবে।
– ডান। আর কয়টা শর্ত?
– দায়িত্ববান হতে হবে। শুধু শুধু বাবার টাকা ওড়ানো যাবে না। আই লাভ সেল্ফ মেইড ম্যান।
– ওকে।
– আর শুনুন, এসবের পর ও আমার হাতে কিছু নেই। আমার বাবার সিদ্ধান্তই আমার সিদ্ধান্ত।

মীরা ফোনটা রেখে দিল। ও জানে অঙ্কনের পক্ষে এসবের মধ্যে একটাও করা সম্ভব না। নিজেই বিরক্ত হয়ে উল্টো পথে হাঁটবে। তিন মাস পর অঙ্কন এলো, মীরার বাসায়। সাথে ওর বাবা, মামা আর মাসুদ আঙ্কেল। বিয়ের প্রস্তাব নিয়ে এসেছে। সোজা বিয়ের প্রস্তাব। মীরার বাবা অঙ্কনকে খুব পছন্দ করেছে। সবাই অবাক, অঙ্কন এত বদলে গেল! মীরা তবুও হ্যাঁ বলেনি। কিছুদিনের জন্যই এই পরিবর্তন। অঙ্কন আবার আগের মতো হয়ে যাবে।

কিন্তু না। অঙ্কন আরো তিন মাস মীরার পেছনে ঠিক এভাবেই ঘুরলো। একদিন মীরা ওকে আলাদা কথা বলতে ডাকলো। ওরা দুজনেই পাশাপাশি বসে আছে।

– আপনি যে এত বদলে যাবেন আমি বুঝতে পারিনি।
– আমি তোমার জন্য সব পারি মীরা।
– কিন্তু কতদিন আর এভাবে নাটক করবেন?

অঙ্কন স্তব্ধ হয়ে তাকিয়ে রইলো। ও কখনো নাটক করেনি। ও সত্যি মন থেকে বদলেছে।

– তুমি যাই ভাবো মীরা, নাটক বা সিনেমা। আমার জন্য এটা ভালোবাসা।
– আপনার কষ্ট হচ্ছে না? আপনি এভাবে নিজের পুরো লাইফস্টাইল বদলে ফেলেছেন।
– প্রথম কয়দিন হয়েছিল। কিন্তু তুমি পাশে থাকলে আর হবে না। এখনো আমার কষ্ট হয়, তবে তুমি পাশে নেই সেই কষ্ট।
– অঙ্কন, তুমি বদলে যাবে না তো?

মীরার মুখে তুমি শুনে অঙ্কনের খুব ভালো লাগলো। ওর মনে চাঁদ তারা জ্বলে উঠল। মীরা ওকে মেনে নিচ্ছে আস্তে আস্তে।

– আমি কখনো বদলাবো না। আমি এমনই থাকবো। কথা দিচ্ছি।
– আমি কিন্তু আমার ক্যারিয়ারের সাথে আপোস করব না। আমি খুব ভালো নিউরোলজিস্ট হতে চাই অঙ্কন। এটা আমার বাবার স্বপ্ন। তুমি প্রমিস করো আমার উপর এমন কিছু চাপাবে না যাতে আমার ক্যারিয়ারের ক্ষতি হয়।
– একদম না। তুমি পুরোপুরি স্বাধীন হবে। এক মিনিট, তুমি কী আমাকে হ্যাঁ বলছ?

মীরা লজ্জা পেয়ে ও এদিক ওদিক তাকাতে লাগলো। অঙ্কন তাড়াতাড়ি ওর জায়গা থেকে উঠে এসে বলল,

– দাঁড়াও! দাঁড়াও!
– কী?
– এখন না প্লিজ। আমার তোমাকে প্রোপোজ করা নিয়ে অনেক প্ল্যান আছে।

এরপর অঙ্কন ঘটা করে মীরাকে প্রোপোজ করলো। মীরার বাবার মত অনুযায়ী ওরা দুজন বিয়েও করল। সেই এক রাজকীয় বিয়ে। এ যেন পুরো সিনডারেলার কাহিনী। সাধারণ পরিবারের মেয়ের ভাগ্যে এমন সোনার টুকরো রাজকুমার। অঙ্কন সত্যি ভালো হয়ে গিয়েছিল। ওর আর কোনো মেয়েদের সাথে ওঠা বসা ছিল না। ও শুধু মীরার দিকে চেয়ে থাকতো। পার্টি করাও বন্ধ করে দিয়েছিল। মাসুদ সাহেব ও অবাক ছিলেন। অঙ্কন এতটা বদলে গেল! ব্যবসায় ও মন দিয়েছিল সে। ওদের কাজী হেল্থ গ্রুপ আরো উন্নতি করতে লাগলো। মীরার ভালোবাসাই এই পরিবর্তন এনেছিল। মীরা যেন প্রেমে পাগল ছিল। অঙ্কন ছাড়া কিছুই বুঝত না। ওর বাবার মৃত্যুর পর অঙ্কন মীরাকে আর ওর মাকে যেভাবে সামলেছে তা বলার বাইরে। এসবে মীরা ওর সব বন্ধুদের থেকে বেশি অঙ্কনকে সময় দিত। সব কিছুর উপরে অঙ্কনের গুরুত্ব। আগে যেভাবে অঙ্কন ওর পেছনে ঘুরতে, সেভাবে মীরা অঙ্কনের পেছনে ঘুরত। ওকে যখন নিউরোকেয়ারে ডাকা হয়েছিল ও আসেনি। ও অঙ্কনের হাসপাতালেই কাজ করবে। অঙ্কন কাজে দেশের বাইরে থাকলে মীরা দেশে থাকতে পারে না যেন। ও কখন আসবে তা নিয়ে ব্যস্ত হয়ে যেত। দেশে ফিরে অঙ্কন অফিসের কাজে গেলেও মীরা সোজা অফিসে চলে আসতো। এমনিতেই ও যখন তখন অঙ্কনকে সারপ্রাইজ দিতে চলে আসে। সবার ফেভারিট কাপল ছিল ওরা। সবার জন্য স্বাভাবিক ছিল অঙ্কনের আশেপাশে মীরার আনাগোনা।

কিন্তু অঙ্কন, বিয়ের তিন বছর পর্যন্তই এমন সাধু পুরুষ হয়ে থাকতে পেরেছিল। এরপর আবার ফিরে যেতে থাকে নিজের চেনা রূপে। মীরা ছাড়াও অনেক মেয়ের সাথে ও রাত কাটিয়েছে। ব্যাপারটা মীরা জানত না। আগে শুধু বিদেশেই এমনটা করত, পরবর্তীতে দেশেও নানা মডেলের সাথে এমন করতে থাকে। মীরার অগোচরে। মাসুদ সাহেব সবই দেখে যান, নিঃশব্দে। কিছু বলতেও পারেন না, করতেও পারেন না।

মীরার চতুর্থ বিবাহ বার্ষিকী তে ও ভেবেছিল অঙ্কনকে সারপ্রাইজ দেবে। কিন্তু জীবনের সবচেয়ে বড় সারপ্রাইজ টা সেদিন পেয়েছিল। অঙ্কন কে ও সেদিন মিথ্যে বলেছিল ও মেডিকেল ক্যাম্পে যাচ্ছে, মেডিকেল কলেজের বন্ধুদের সাথে। কিন্তু ও সেদিন যায় নি। ফিরে এসে দুঃখী অঙ্কন কে চমকে দিতে চেয়েছিল। অফিসে ঢুকতেই মাসুদ আঙ্কেল ওকে দেখে এগিয়ে আসে,

– কী হলো মা, যাও নি?
– আরে ছিলই না কিছু। হাশশশ! ও ভেতরে না? ওকে কিছু বলবেন না।
– ও ভেতরে নেই।
– কোথায়?
– বাসায়।
– আঙ্কেল, আমি বাসা থেকে এসেছি।
– ও সত্যি এখানে নেই।
– কোথায়?
– আমি জানি না।

মাসুদ আঙ্কেলের চেহারা দেখে মীরা ভয় পেয়ে গেল। ও ভেবেছে অঙ্কনের কিছু হয়েছে,

– আঙ্কেল ওর সাথে কী খারাপ কিছু হয়েছে? আমাকে কেন বলছেন না? দেখুন আমার থেকে লুকাবেন না। ও বাইক নিয়ে বের হয়নি তো?
– কিছু হয়নি।
– তো কেন যেতে দিচ্ছেন না?
– আচ্ছা যাও।

মীরা এগিয়ে যাচ্ছিল। মাসুদ আঙ্কেল আর মীরাকে আটাকালো না। মীরা দরজা অল্প একটু খুলেই বুঝতে পারল ভেতরে কী হচ্ছে। একটা মেয়ে অঙ্কনের কোলের উপর বসে আছে। অঙ্কন সেই মেয়েটিকে চুমু খাচ্ছে। অত্যন্ত ঘনিষ্ঠ অবস্থায় তারা।

“তোমাকে না বললাম অফিসে না এসে একদম হোটেলে যেতে। এখানে আসার কী দরকার ছিল? আমি চাইনা অফিসের কেউ দেখুক।”

মীরা আর দাঁড়ালোনা। নিজেকে সামলে বেরিয়ে আসলো। মাসুদ আঙ্কেল ওর পেছনে পেছনে আসলো। মীরার মাথা ঘুরছিল। ও পড়ে যাওয়ার আগেই মাসুদ আঙ্কেল ওকে ধরলো,

– আঙ্কেল, ও কী বেশী কষ্ট পেয়েছিল আমি আজ থাকব না বলে? আমার কী গিয়ে স্যরি বলা উচিত?
– ও আজকে প্রথমবার না মা।
– কতদিন?
– অনেকদিন।
– কিছু বলেননি কেন?
– ভেবেছি শুধরে যাবে। ও আসলে এমনই ছিল।
– আমিই বোকা, তাই না?
– বাসায় যাও।
– আপনার বাসায় জায়গা হবে? আজকে আর ঐ বাসায় যাব না। মায়ের কাছেও যেতে পারব না।

মাসুদ আঙ্কেল মীরাকে তার বাসায় নিয়ে গেলেন। সেখানে মীরা তার আর তার স্ত্রীর সামনে অনেকক্ষণ কান্না করল। সেই রাতে মীরা মাসুদ আঙ্কেল কে বলল, “আপনি ওকে ফোন দিন। দিয়ে বলুন, এমনটা কেন করল? আর ওর কী ফিরে আসার ইচ্ছা আছে?”

মাসুদ আঙ্কেলের স্ত্রী বললেন, “তুমি এখনো ওকে ক্ষমা করে দেবে?”

“কিছু না কিছু কারণ থাকবেই এমন কিছু করার। দেখি ক্ষমা করতে পারি কি না। আমি ওকে আরো চান্স দেব। আমি একবার বদলে দিয়েছি। আবার পারব। আমি ওকে অনেক ভালোবাসি। আমার ভালোবাসা ওকে বদলাতে পারে।”

মাসুদ আঙ্কেল মীরার কথা শুনে অঙ্কনকে একটা ফোন করলেন। ফোনটা লাউডস্পিকারে,

– বাবা, আজকে তোমার ম্যারেজ অ্যানিভার্সারী।
– জানি।
– আজকে দিনটা না করলে,
– আঙ্কেল, প্লিজ ডোন্ট ইনটারফেয়ার ইন মাই পার্সোনাল লাইফ। মীরার মেডিকেল ক্যাম্প আছে জানেন তো।
– তাই বলে।
– আমার ও একটা ফিজিক্যাল নিড আছে। সমস্যা টা কোথায়? আমি টাকা দিলে ওরা আসছে, টাকা নিয়ে সব শেষ।
– এটা কী ঠিক? ঘরে বউ আছে।
– ঘরের বউ ঘরের জায়গাতে। এসব মেয়েরা ঘরের বউয়ের লেভেলের না। আর বউয়ের উপর সবকিছুর জন্য নির্ভরশীল আমি হতে চাই না। বিশেষ করে এত ছোট খাটো ব্যাপারে।
– এসব করা কী মীরাকে ছোট করা না?
– মীরা মীরার জায়গায়। ওর জায়গায় ও। ওটা কেউ নিতে পারবে না।
– এটা এক প্রকারের প্রতারণা।
– না। আমি বললাম তো, একটা রাত জাস্ট। এই মেয়েটার চেহারাও মনে থাকবে না। না মীরা জানলো, না ও আমার মনে থাকলো। আমি আর মীরা হ্যাপি আছি।
– ভবিষ্যতে তোমাদের যখন বাচ্চা হবে।
– হবে। ফ্যামিলি কমপ্লিট। একমাত্র মীরাই আমার বেবির মা হওয়ার যোগ্য। আর সেজন্যই ও আমার স্ত্রী। মীরা সবকিছুতেই পারফেক্ট! সো ডোন্ট ওরি, ওর জায়গা কেউ নিচ্ছে না।
– আচ্ছা অঙ্কন, মীরা যদি এমন করে তো তোমার কেমন লাগবে?
– আঙ্কেল! আমি আপনাকে অনেক সম্মান করি। এসব কথা বলার আগে ভাববেন। মীরা এমন মেয়ে না। আর এই ব্যাপার নিয়ে একটা কথাও বলবেন না।

“বেইবি! হোয়াই আর ইউ টকিং সো লাউড।” এক অচেনা নারী কন্ঠ ভেসে উঠল। মাসুদ আঙ্কেল ফোনটা কেটে দিলেন। মীরা মুখ চেপে কাঁদতে লাগলো। ওর কখনো নিজেকে এতটা ছোট মনে হয়নি। ডিভোর্স ও দিতে পারবে না। কারণ ওর মা সহ্য করতে পারবে না। ওর বাবা নেই। এই মুহুর্তে এসব সামলানো সম্ভব না। মীরাকে এডজাস্ট করতে হবে। তবে সেদিনের পর থেকেই মীরার অঙ্কনকে ঘৃ*ণা হয়। খুব ঘৃ*ণা হয়। স্বামীর আসনে ও আর অঙ্কনকে বসাতে পারে না। অঙ্কন মীরাকে ছুঁতে আসলেই ওর মনে হয় ও কোনো অন্য নারীকে ছুঁয়ে এসেছে। অঙ্কনের শরীরে সেই অন্য নারী লেগে আছে। অঙ্কন কাছে আসলেই ও অন্য নারীর গন্ধ পায়। নিজেকে অনেক ছোট মনে হয়। মীরা ঠিক করেছে, এখন থেকে ও শুধুই অঙ্কনের “স্ত্রী” হয়ে থাকবে। দায়িত্ব গুলো পালন করবে, কিন্তু কখনো অন্তরঙ্গ হবে না। এই জিনিসটা আর ওর পক্ষে সম্ভব না।সেই থেকে মীরা আর কখনো অঙ্কনের সাথে সেই সম্পর্ক করেনি। কারণ সে তার চাহিদা অন্য নারী দ্বারা মেটাতে পারে।

এসবের মধ্যে অঙ্কন এখন মীরার সামনেই ম*দ্যপান করতে শুরু করেছে। আবার আগের বদভ্যাসগুলোর কিছু কিছু ওর সামনেই দেখায়। মীরা কিছুই বলে না। দূরে সরিয়ে নিচ্ছে নিজেকে। আবার পুরনো বন্ধুদের সন্ধানে নেমেছে। এই প্রবল একাকীত্বে ও রাফসানের সাথে স্কুলের মতো বন্ধুত্ব গড়ে তুলেছিল। কিন্তু ও রাফসানকে কিছুই বলেনি। ওর সহানুভূতি চাইনা। শুধু একটা ভালো বন্ধু চায় ও। যার সাথে কথা বলার সময় ওর সেসব ঝামেলা মনে পড়বে না। এর মধ্যে রাফসান বিয়ে করল। মীরা মীরার মতোই আছে। ধরিত্রী আর রাফসানের সাথে সময় কাটাতে ওর যা ভালো লাগে। ভেবেছিল এভাবেই জীবন যাবে। মাঝে মাঝে মাতাল অঙ্কনের হাতে দুচারটে মা*র খেয়ে সহ্য করবে। কিন্তু ও যখন শুনলো ওর লাইসেন্স বাতিল করতে পারে তাই এবার ও ঠিক করে নিল, ওকে বের হতেই হবে। ও অনেক কষ্ট করেছে ডাক্তার হওয়ার জন্য। এভাবে অঙ্কনের পাগলামির কাছে হেরে যেতে পারেনা।

“আঙ্কেল, নিউরোকেয়ারে তো কাজী হেল্থ কেয়ারের কোনো পৃষ্ঠপোষকতা নেই তো? তাহলে আমি রাফসানের সহায়তা নিচ্ছি।”

(চলছে)

#ধরিত্রী_কথন
#পার্ট২৪
#পিকলি_পিকু

ড্রেসিংরুমে আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে ধরিত্রী ওর পেট দেখছে। এখনো বড় হয়নি। কোনো পার্থক্য নেই। তারপর ড্রেসিংরুম থেকে বের হয়ে একটা কুশন এনে পেটের উপর রেখে এদিক ওদিক ঘুরে দেখছে সে। আর কিছুদিন পর এমনই লাগবে। তখনই হুট করে ড্রেসিংরুমে রাফসান ঢুকে পড়লো। রাফসানকে দেখে ধরিত্রী ঘাবড়ে গেল। লজ্জাও পেয়েছে। রাফসান হাসি আটকাতে গিয়ে ও পারেনি।

– এসব কী করছ ধরা?
– কী? দেখছি।
– এখনো অনেক দেরি। মাত্র তো এক মাস।
– আরেকটু বেশি।
– আরো অনেক দিন পর বাম্প দেখা যাবে।

ধরিত্রীর খুব লজ্জা লাগছে। পাগল ছাগল ভাবছে না তো? কেন যে মাঝে মাঝে এমন করে?

– তুমি না কাঁদছিলে সেদিন?
– তো কী হয়েছে?
– আজকে একদম এসব?

ধরিত্রী ড্রেসিংরুম থেকে বেরিয়ে যেতেই রাফসান ওকে টেনে ধরলো। এরপর আয়নার সামনে ওকে দাঁড় করিয়ে নিজেও ওর পেছনে দাঁড়ালো। “দেখি তো, আমার ধরাকে চিড়ার মা হিসেবে কেমন লাগে?”

চিড়ার মা? হ্যাঁ তো তাই।

– আচ্ছা রাফসান, ও কী আমাকে মা ডাকবে না আম্মু?
– কোনটা তোমার ভালো লাগবে?
– মম্মা।
– মাম্মা শুনেছি।
– মম্মাও বলে এখন। তোমাকে কী ডাকবে?
– বাবা বা বাবাই।
– চিড়ার বাবাই?
– পাপাই? তোমাকে মম্মা তো আমাকে পাপাই?

ধরিত্রী রাফসান আর ওদের সন্তান একসাথে আয়নার সামনে। এই ভালোবাসার মুহুর্ত বেড়ে এখন দ্বিগুণ। তখনই ওরা চিৎকারের আওয়াজ শুনতে পারল।

বাইরে চাচ্চু আহসানকে বকছে। মাত্র ক্লাস এইটে উঠেছে সে, আর এখনই ওর বিজ্ঞান বইয়ে লাভ লেটার পাওয়া গেছে। রুবাইয়া আর মাশরুফা চাচ্চু কে থামাতে চাইছে।

“ক্লাস এইটে এসব! না মাশরুফা! একে আমি বোডিংয়ে পাঠাবো। এখনই।”

ধরিত্রী এগিয়ে গিয়ে বলল, “স্যরি চাচ্চু! আসলে আমিই ওকে লিখতে বলেছিলাম।”

সবাই এমন ভাবে তাকালো ওর দিকে। আহসান হাতজোড় করে আছে।

– মানে টা কী?
– আমি ওর ক্রিয়েটিভিটি বাড়ানোর লেটার লিখতে বলেছিলাম। এটা তেমন কিছু না যেটা তুমি ভাবছ।
– এইটা একটা লাভ লেটার ধরিত্রী! তুমি আমার ছেলেকে দিয়ে এসব কী লেখাচ্ছ। ভাবি! ওকে এসব ফাজলামো করতে বন্ধ করো। আমার বাচ্চা ছেলেকে দিয়ে এসব কী!

রাফসান লেটারটা হাতে নিয়ে বলল, “এটা তো আহসান লেখেনি। আহসান কে লিখেছে।” ধরিত্রী সাথে সাথে গিয়ে লেটারটা হাতে নিয়ে দেখলো। সত্যিই লেটারটা আহসানকে লিখেছে। আহসান ও লাভ লেটার পায়!

– সত্যি বলতে চাচ্চু, লেটার টা আমি বলেছি ও যাতে নিজেকে লেখে।
– নিজেকে? হোয়াট রাবিশ!
– আসলে ওর কন্ফিডেন্স বাড়াতে আর সেল্ফ লাভের জন্য।
– ভাবী, তোমার আদরের বউকে বলো আমার বাচ্চাদের নষ্ট না করতে। ওদের একটা ফিউচার আছে। পড়াশোনা আছে।

চাচ্চু চেঁচিয়েই যাচ্ছে। রুবাইয়া তার দেবরকে থামিয়ে ধরিত্রীকে ভেতরে নিয়ে গেল। কিছুক্ষণ পর সব ঠান্ডা হতেই ধরিত্রী আহসানের কাছে গেল।

– কীরে, ফার্স্ট লাভ লেটার না অনেক অভিজ্ঞতা আছে?
– ভাবি আমি জানতাম না। আজই পেলাম।
– তাই বলে সাইন্স বইয়ে রাখবি? চাচ্চু কিন্তু তোর সাইন্স বইটা ই দেখে।
– আমি জানতাম না ভাবি। কী করে কী হলো।
– মেয়েটা কে?
– আছে একটা। প্র্যাংক করছে না তো?

পরদিন ধরিত্রী সহ আহসান স্কুলের বাইরে। মেয়েটার নাম সামিয়া। অনেক কিউট। এই বয়সে লাভ লেটার দিয়েছে দেখে ধরিত্রী অবাক হচ্ছে। দেবর আর দেবরের সম্ভাব্য প্রেমিকাকে নিয়ে ধরিত্রী পাশের বার্গারের দোকানে গেল। সেখানে বার্গার অর্ডার দিয়ে বসে আছে ওরা।

– এই যে আপুনি, এই ছোট বয়সে প্রেম পত্র দিচ্ছ?
– প্রেম পত্র?
– লাভ লেটার। তুমি ওকে ভালোবাসো বুঝলে কী করে?
– ও কত কিউট। ওর কথা অনেক ভালো লাগে। অনেক ফানি। আলাদা সবার থেকে।
– স্ট্যান্ডার্ড এইটের বাচ্চা তোমরা বয়স হয়েছে প্রেম করার?

দুজনেই নীচের দিকে তাকিয়ে আছে। ধরিত্রী আর তিক্ত কথা বলল না।

– বন্ধু হতে পারো। এখন পড়াশোনা আর খেলাধুলার সময়। শৈশব উপভোগ করো। এত বড় হওয়ার দরকার নেই।
– কিন্তু আপু, আই লাইক হিম।
– হ্যাঁ। লাইক করো। এজ আ ফ্রেন্ড। ওটার বয়স হয়নি এখনো। আর তোমার এই লেটার দেখে ওর বাবা ওকে বোডিংয়ে পাঠিয়ে দিচ্ছিল। আমি মিথ্যা বললাম তাই বেঁচে গেল।

খাবার আসতেই আহসান খেতে লাগলো। ধরিত্রীর এতক্ষণ তো খুব ক্রেভিং হচ্ছিল বার্গারের। কিন্তু হঠাৎ বার্গার দেখেই ওয়াশরুমে দৌঁড় দিল। সামিয়া আর আহসান ওদিকে তাকিয়ে রইলো। এরপর আহসান অসুস্থ ধরিত্রীকে ধরে ধরে বাসায় আনলো। রুবাইয়া ওদের দেখেই বিচলিত হয়ে গেল।

– বার্গার খেতে যাওয়ার দরকার কী ছিল?
– ক্রেভিং হচ্ছিল তাই।
– অর্ডার করতে পারতি। এখন থেকে বাইরের খাবার খাওয়া বন্ধ!

অসুস্থ অবস্থায় ধরিত্রী পড়ে আছে নিজের ঘরে। রাফসান তো এসেই হাজার টা প্রশ্ন করল। ওর তেমন কিছুই হয়নি। রুবাইয়া আর রাফসান বসার ঘরে বসেছে। মাশরুফা ও যোগ দিল।

– মা, ওর কী একটু তাড়াতাড়ি সমস্যা হচ্ছে না?
– ওর ইমিউনিটি কম। আর এই হরমোনাল ব্যাপারগুলো একটু আর্লি সমস্যা তৈরী করছে।
– ওর রক্তের দরকার আছে?
– সাপ্লিমেন্ট দিচ্ছি তো রক্তের সমস্যা নেই। আসল সমস্যা, রক্তচাপ। এখন তো মাত্র একমাস। রক্তচাপ ঠিকই আছে। সামনে আমাদের খেয়াল রাখতে হবে।

মাশরুফা বলল,

– ভাবি, ওর কী এক্লামসিয়ার কথা বলছেন? আপনি কী একটু বেশি চিন্তা করছেন না?
– ওর এপিলেপসি আছে মাশরুফা। আমি আগে বলিনি তোমাকে। এটা অনেক ছোটবেলায় ছিল। প্রেগনেন্সিতে ওর ঝুঁকি আছে। তাই আজহারকে একটু কম চিৎকার করতে বলো ওর সাথে।
– আপনি আমাকে আগে বলেননি কেন?
– এটা এমনি বলিনি। এখন বলছি। আসলে ও নিজেকে ছোট মনে করে। আমাদের ও বলতে চাইছিল না। বারবার ওকে এসব মনে করিও না। এর সাথে ওর কিছু খারাপ স্মৃতি আছে। আমি চাইনা ও বারবার সেই স্মৃতি দিয়ে যাক।

ধরিত্রী পানি খেতে এসে ব্যাপারটা শুনেছে। রুবাইয়া ওকে অনেক ভালোবাসে। মাঝে মাঝে ওর নিজেকে খুব ভাগ্যবান মনে হয়। খুব কম মেয়েদের কপালে এমন শাশুড়ি জোটে।

মীরা অঙ্কনের জন্য অপেক্ষা করছে। রাফসানকে কিছু বলার আগে অঙ্কনকে বলা দরকার। ও আবার পরে যদি কোনো ঝামেলা করে। অঙ্কন আসতেই বুঝলো মীরা ওকে কিছু বলবে। একটু তো ভয় কাজ করছেই।

– অঙ্কন।
– কী বলবে?
– আমি আমার ক্যারিয়ারের কথা ভাবছিলাম।
– আর কতো?এটাই তো ভাবো সারাদিন।
– সেরকম না। আমি চিন্তা করছিলাম কী আমাদের হাসপাতালে ভালো নিউরোলজিস্ট নেই। আমি এখানে কিছু শিখতে পারছি না।
– এখন কোথায় শিখতে চাচ্ছ?
– তুমি কোথায় ভাবছ?
– আশ্চর্য! আমি কী করে বলব?
– তুমি একজন অভিজ্ঞ মানুষ। এই সেক্টরে তোমার ভালো জ্ঞান আছে।
– তোমার কী মনে?
– বিদেশে যেতে পারি?

অঙ্কনের মনটা ঘপ করে উঠলো। মীরা বিদেশে চলে গেলে ওর থেকে দূরে সরে যাবে। তখন আরো দূরত্ব আসবে।

– দেশে কী ভালো হাসপাতাল নেই?
– এখন আমি কোথায় পাব? দেশে ভালো হাসপাতাল কোনটা যে আমি শিখতে পারব?
– খুঁজে দেখ।
– মাসুদ আঙ্কেল কে বলবে?
– কী?
– খুঁজে দেখতে। ওনার এসব ক্ষেত্রে অভিজ্ঞতা আছে।

মীরা খুবই অদ্ভুত ব্যবহার করছে। ও একবার বিদেশে গেলে কোনো না কোনো ভাবে নিজেকে ছাড়িয়ে নেবে। অঙ্কন মীরাকে ছাড়তে পারবে না। এদিকে মীরা ধরিত্রীর জন্য ওর উপহারের ডায়মন্ড সেট নিয়ে দেখা করতে গিয়েছে। সেই সেট হাতে নিয়ে ধরিত্রী বসে আছে। খুবই অন্যরকম লাগছে। মানুষ তো বিয়েতেও এত দামী উপহার দেয় না। মাশরুফাও তাকিয়ে আছে। মীরা বুঝতেই পারছে ওনারা এত দামী উপহারে অভ্যস্ত না। ওনারা মীরার মতো সাধারণ মানুষ।

– এসবের কী দরকার?
– এটা ধরিত্রীর মা হওয়ার উপহার। আমার আর অঙ্কনের পক্ষ থেকে।
– দোয়া করলেই হতো।

কলিংবেল বেঁজে উঠলো। রুমির মা দরজা খুলে রাধাকে আসতে বলল। রাধা মীরাকে দেখেই অপ্রস্তুত হয়ে গেল। ওর হাতে ছিল ফল মিষ্টি আর পুজোর ফুল আর প্রসাদ। মীরা জানে রাধা এখন দোষ ধরবে। তাই ও গয়নার বাক্সটা বন্ধ করে দিল। রাধা স্বাভাবিকভাবেই ঢুকে পুজোর ফুল ছুঁইয়ে নানা কথায় ব্যস্ত হয়ে পড়ল। মাঝে মাঝে আবার বাঁকা চোখে তাকাচ্ছে মীরার দিকে। ধরিত্রী উঠতেই বলল,

– পটাতে চলে এসেছিস?
– তুই চুপ করবি? প্লিজ এখানে না।
– জানি তো আমি। সুঁচ হয়ে ঢুকে ফাল হয়ে বের হবি।
– তোর যা ইচ্ছা ভাব।

রাধা আজ ব্যস্ত থাকায় চলে যেতে হলো। মীরা রাফসান আসা পর্যন্ত অপেক্ষা করলো। রাফসান আসতেই মীরা কেমন ব্যস্ত হয়ে পড়ল। জরুরী কথা আছে।

– কী হয়েছে? এত জরুরি হলে হাসপাতালে আসতি।
– তোর যে স্যার আছে, আবদুল মোমিন।
– হ্যাঁ।
– ওনার সাথে কাজ করতে কী কী দরকার?
– কেন?
– আমি ভাবছি ওনার সাথে কাজ করব।
– তোদের হাসপাতালে কী হয়েছে?
– নিজেদের আস্তানায় কী আমি পাখনা মেলে উড়তে পারব?

ধরিত্রী ওদের কথার মধ্যে ঢুকতে চাইছিল না। কিন্তু শুনেই ফেলল।

– ধরা, ধরা বল না তোমার স্বামীকে।
– তুই ও ধরা বলিস!
– হ্যাঁ। ধরাবাঈ। ও আমাকে মীরাবাঈ বলে। ধরা দেখ, আমি যদি ওর হাসপাতালে যাই তো রাফসান তোমার সাথে অনেক সময় কাটাতে পারবে। আমি হাসপাতালে সামলে নেব। ও বাসায় আসতে পারবে।
– ঘুষ দিতে চাইছিস?
– ঘুষ না, ম্যানেজ। সামনে তোর কত ছুটি নিতে হবে। আমি না থাকলে কে সামলাবে বল? আমি তোর সেক্রেটারি। প্রমিস।

ধরিত্রী ও বুঝতে পারল। তাই সে রাফসানকে অনুনয় বিনয় করতে লাগলো। ধরা আর মীরার অনুরোধে রাফসান ডাক্তার মোমিনকে মীরার কথা বলল। আর এদিকে অঙ্কন ও ঠিক করল মীরাকে ও বিদেশে পাঠাবে না। দেশেই থাকবে ও।

– রাফসানের হাসপাতালে তোমার জন্য বেশি সহজ না?
– না। ও তো স্ট্রোক নিয়ে কাজ করে। আমি করব স্পেশিয়ালি এপিলেপসি। মোমিন স্যরের আন্ডারে।
– রাফসান থাকলে কী ভালো হত না?
– না। রাফসান ওর জায়গায়। আমি অনেক পিছিয়ে গেছি।
– মানে?
– রাফসান আর আমি বেস্টফ্রেন্ড হলেও একটা কম্পিটিশন হতো। সাইলেন্ট কম্পিটিশন। মেডিকেল কোচিংয়ে সবসময় আমিই এগিয়ে ছিলাম। কিন্তু অল্পের জন্য ও ডিএমসি গেল। আমি পারলাম না। আর আজ দেখ কর্মক্ষেত্রে ও কত এগিয়ে। ওর অ্যাচিভমেন্ট অনেক বেশি। তুলনা চলে না। আমি একজন সামান্য ডাক্তার, আর ও স্পেশিয়ালিস্ট। খুব শীঘ্রই ওর প্রমোশন হবে। আর আমি ওর আন্ডারে কাজ করা অতি সামান্য ডাক্তার।

মীরা দীর্ঘশ্বাস ছাড়লো। কেমন যেন ব্যর্থ লাগছে নিজেকে। অঙ্কনের পেছনে কেমন ধ্বংস করে ফেলেছে নিজেকে। ঠিক তখনই অঙ্কন বলল, “তুমি না বললে রাফসানের আন্ডারে কাজ করবে না?” মীরা নীরবে অঙ্কনের দিকে তাকিয়ে রইল। কিছুক্ষণ পর নিঃশব্দে হেসে বলল, “তাই তো ওর আন্ডারে কাজ করব না। মোমিন স্যারের আন্ডারে করব।” অঙ্কন এখনো ওভাবেই তাকিয়ে আছে। মীরা মনে মনে ভাবছে কিছু মানুষ কখনো বদলায় না।

(চলবে)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here