ধরিত্রী_কথন #পার্ট২৭,২৮

0
979

#ধরিত্রী_কথন
#পার্ট২৭,২৮
#পিকলি_পিকু
২৭

ধরিত্রীকে এই অবস্থায় দেখে জোহরা বারবার মূর্ছা যাচ্ছে। নিজের একমাত্র মেয়েকে এই অবস্থায় দেখে সে নিজেকে সামলাতে পারছেনা। জোহরার ভাই আর দেবর ও পরিবার নিয়ে তার পাশে দাঁড়িয়েছে। রাফসান আর ওর মা দৌঁড়াদৌঁড়ি করছে। ধরিত্রীর ডেলিভারি এই হাসপাতালেই হওয়ার কথা। রুবাইয়া এই জীবনে অনেক ডেলিভারি করিয়েছে। ধরিত্রীর টা ও করার কথা। এভাবে তো আসতে চায়নি।

ধরিত্রীর রক্তের প্রয়োজন। ও নেগেটিভ রক্ত দাতা অনেকেই ছিল, কিন্তু এই মুহুর্তে একজন ও নেই। আত্মীয় স্বজনের কারো আছে কী? ওর মামা চাচা কারো নেই। ওনারা সবাই বি পজিটিভ। তারপর ও ফেসবুকের মাধ্যমে কিছু জোগাড় করা গেল।

তারপর ও ভোর রাতের দিকে ধরিত্রী আর রাফসানের সন্তান চলে গেল। কিন্তু রাফসানের সেদিকে খেয়াল নেই। ধরিত্রীকে বাঁচাতে হবে। ছেলেটা একটুও কাঁদার সময় পায়নি। ধরিত্রীর জন্য ইঞ্জেকশন আনতে বাইরে গিয়েছে। খিচুনির কারণে ওর অন্যান্য অঙ্গপ্রত্যঙ্গে সমস্যা দেখা দিচ্ছে। রুবাইয়ার ভয় হচ্ছে মাল্টিপাল অরগ্যান ফেইলিউর না হয়। তাহলে ও আর বাঁচবে না। এমন আশঙ্কাজনক অবস্থায় অনেক রোগীকেই দেখেছে রুবাইয়া। তবে ধরিত্রী কে দেখতে হবে তা তিনি স্বপ্নেও ভাবেননি।

ধরিত্রীর বাচ্চা আর নেই শোনার পর জোহরা চিৎকার করে উঠল। ওনাকে সবাই সামলাচ্ছে। “আমার মেয়ের কপাল টাও কী আমার মতো হলো?” তাকে এই হাসপাতালেই ভর্তি করা হয়েছে।

ধরিত্রীকে এভাবে কষ্ট পেতে দেখে রুবাইয়া ধরিত্রীর কাছ থেকে চলে এলো। যদি সে এভাবে ওনার সামনে মা*রা যায় তো নিজেকে কখনো ক্ষমা করতে পারবেন না তিনি। সবাই ভেঙে পড়েছে। সারারাত নিদ্রাহীন কাটিয়েছে সবাই। সবার এই অবস্থায় যেই মানুষটা সবচেয়ে ভেঙে পড়ার কথা সেই সবচেয়ে শক্ত আছে। কারণ ওর ধরাকে বাঁচাতে হবে। ধরাকে ও হারাতে পারবে না।

সকালে মীরা হাসপাতালে আসার পর বুঝতে পারল কিছু হয়েছে। সামির আসতেই সে জিজ্ঞেস করল,

– কি হয়েছে?
– তুমি জানো না?
– কী?
– রাফসানের বউয়ের কাল রাতে খিচুনি হয়েছে। এরপর ওর বাচ্চার হার্টবিট বন্ধ হয়ে গেছে। ভোর রাতে মারা গেছে।
– কীহ! আর ধরা?
– ভাবি আশঙ্কাজনক। ওরা আন্টির হাসপাতালে।
– সামির আমি আজকে আসছি।

মীরা দেরি না করে চলে গেল ধরিত্রী যেখানে। সবাই ঘুমাচ্ছে। একমাত্র রাফসান বসে আছে। মীরা গিয়ে ওকে ডাকলো। রাফসান উঠে এসে সামনে অন্য জায়গায় বসলো।

– সব ঠিক হয়ে যাবে।
– আমার দোষ তাই না?
– তোর কেন দোষ?
– আমি ব্যাপারটা আগে ওকে জানাইনি। আমি একটু লোভ করেছিলাম। আমি দুটোই চেয়েছি। পারসোনাল লাইফ আর প্রফেশনাল লাইফ। আমার এই দায়িত্ব টা নেওয়ার আগে একটু সময় নেওয়া দরকার ছিল। ওর সাথে ডিসকাস করা দরকার ছিল। আমি ভেবেছিলাম পারব। ভেবেছিলাম, এত কম বয়সে এত বড় দায়িত্ব নিয়ে সবাইকে দেখিয়ে দেব। সবাই আমার প্রশংসা করবে। আমি সবার সেরা। ও কিন্তু ওর পুরো প্রফেশনাল লাইফটা ছেড়ে এসেছে। আমি আরো নিয়েছি। এই সময় টা আমার সত্যিই ওর সাথে বেশি থাকা উচিত ছিল। উল্টো ওর সাথে ঝগড়া করেছি। যেখানে ওকে রাগানোর ই কথা না। আমি বিরক্ত হয়ে গিয়েছিলাম। ওর আচরণ বিরক্তিকর লাগছিল। হাসপাতালের স্ট্রেসকে ধরার স্ট্রেস ভাবছিলাম। আমিই দায়ী। দুটো মিশিয়ে ফেলেছিলাম।
– নিজেকে দোষ দিয়ে কোনো লাভ নেই।
– আমার ধরা ম*রে যাবে না তো?

রাফসান মীরার দিকে তাকালো। মীরা রাফসানের করুণ চেহারার দিকে তাকিয়ে কিছুই বলতে পারল না। ওর কান্না পাচ্ছে। রাফসান কে মীরা এত অসহায় কখনো দেখেনি।

– আমার নিষ্পাপ বাচ্চাটার মতো ও ম*রে যাবে না তো?
– চুপ কর রাফসান।

রাফসান কাঁদতে লাগলো। রাফসানের কান্না দেখে মীরাও নিজেকে আটকাতে পারল না। রাফসানের বুকের ভেতরটা যেন ক্ষত বিক্ষত হয়ে আছে। তার হৃৎপিন্ড টা যেন উন্মুক্ত। উন্মুক্ত বাতাসে রাফসানের হৃৎপিন্ড টা জ্বলে পুড়ে যাচ্ছে। তার রক্তে যেন বিষাক্ত কার্বন মনোক্সাইড মিশে আছে। ধরা নামের অক্সিজেনটার জীবন যে এখনো অনিশ্চিত। রাফসানকে এই অবস্থায় দেখে মীরা ওকে সান্ত্বনা দিতে এগিয়ে আসে। একটা সময় রাফসান মীরার কাঁধে মাথা রেখে কাঁদতে থাকে। মীরাও ওর পিঠে হাত বুলিয়ে দিচ্ছে।

পিছন থেকে রুবাইয়া এসে দেখল সবকিছু। কিন্তু এই সময়ে এসব দোষ ধরা। একটা সময় তিনি শুনলেন,

“আমার ধরাকে বাঁচিয়ে দে না মীরা। ওকে আবার জীবিত করে তোল। ”

রুবাইয়া আর সেদিকে গেল না। জোহরার কেবিনে গেল। জোহরা কাল প্রায় স্ট্রোক করেছিল। স্যালাইন দেওয়া হয়েছে। লাবণ্য রুবাইয়া কে বলল,

– মেয়েটার কিছু হবে না তো? ওর কিছু হলে আপা বাঁচবে না। আপার বেঁচে থাকার একটাই অবলম্বন।
– আমাদের হাতে কিছু নেই। আল্লাহ্ কে ডাকো।

লাবণ্যর চোখে এখনো অপরাধবোধ টা আছে। বহুবছর আগে ওর জন্যই তো। থাক। ধরিত্রীর খবর পেয়ে দুপুরে মিম রিমা রাধা এসেছে দেখতে। ধরিত্রী এখনো আইসিইউ তে। রাফসান কে সান্ত্বনা দেওয়ার মতো কারো কাছেই শব্দ নেই। ধরিত্রীর অন্যান্য বন্ধু ও অনুরাগীরাও ভিড় করেছে। মিসেস দিয়ার দেবর আর সন্তান ও এসেছে। ও কখনো কারো খারাপ চায় নি। তবুও কার পাপের শাস্তি ভোগ করছে?

ধরিত্রীর বাবা এসে ধরিত্রীর মায়ের পায়ে হাত রাখলো। তিনি সাথে সাথে বলে উঠলেন,

– এ কী করছ!
– এখন তো ক্ষমা করে দাও। মেয়েটা ম*রে যাবে। তোমার সাথে আমি অনেক অন্যায় করেছি। এর জন্য আমার মেয়েটা দায়ী না।
– মেয়েটা কী তোমার? কী করেছ ওর জন্য? চিনি আমার মেয়ে। জোহরার মেয়ে। শুধু জোহরার!

রাফসান ঢুকতেই ওনারা চুপ হয়ে গেলেন। রাফসান কিছুই বুঝতে পারল না। এটুকু বুঝল যে সে ভুল সময়ে এসেছে। নিরবতা কাটাতে ধরিত্রীর বাবা বললেন,

– কিছু হয়েছে বাবা?
– না।
– ধরিত্রী?
– ওর কিছু হয়নি। মা কে দেখতে আসলাম।

কিছুক্ষণ কথা বলার পর রাফসান চলে গেল। ও যেতেই জোহরা বলল,

– চুপ থাকো। একদম চুপ! এখানে এতসব মানুষের সামনে ওসব কথা আরেকবার উঠলে,
– আমি চুপ করে আছি। আর হবে না।

দিন যায়। ধরিত্রীর অবস্থার উন্নতি হচ্ছে না। সে একইভাবেই আইসিইউ তে আছে। ৬১ কেজির ধরিত্রী আর অর্ধেকে নেমেছে। আগের থেকেও বাজে অবস্থা। একদম কঙ্কালসার সে। একটু আগেই ওর মা এসেছিল। তিনি প্রতিদিন কাঁদেন আর বলেন, “আমার পুতুলের মতো মেয়ে টা।” কন্যা শোকে এখন তিনি না গত হন। দুটো বাড়িই যেন থমথমে হয়ে গেছে। এদিকে রাফসান, সে আছে। সারাক্ষণ তার স্ত্রীর সাথে। অন্য হাসপাতালে গেলেই তার ভয় হয় কোনো খারাপ খবর আসে কি না। তাই দায়িত্ব থেকে অব্যাহতি নিয়েছে।

প্রায় দুইমাস আইসিইউ তে থাকার পর কেবিনে দেওয়া হলো ধরিত্রীকে। কেমন যেন একদিকে তাকিয়ে থাকে। পেটের উপর হাত দিয়ে বলে, “আল্লাহর কাছে ভালো আছ তো চিড়া?” এই দৃশ্য দেখার মতো না। রুবাইয়া ধরিত্রীর মাথায় হাত বুলায় আর ভাবে, “এই মেয়েটাকে তো আনিনি। কোথায় গেল মেয়েটা?”

আরো একমাস পর ধরিত্রীকে বাড়ি নিয়ে যাওয়া হলো। সন্তান শোকে কাতর ধরিত্রী কারো সাথেই কথা বলছে না। রাফসান ওকে আর এভাবে দেখতে পারছে না। ওর ধরা কত চঞ্চল ছিল। আচ্ছা, আগের মতো ওর বুকে মাথা রেখে কাঁদতেও তো পারে। রাফসান ওর কাছে আসলেই ধরিত্রী দূরে সরে যায়।

– আমার সাথে এমন কেন করছ ধরা?
– এখন আর তোমার হাসপাতাল নেই? যাও না সেখানে। জীবন বাঁচাও। পারবে জীবন বাঁচাতে? নিয়ে আসো না আমার বাচ্চাটাকে? আমার বুকটা খালি হয়ে গেছে রাফসান।

ধরিত্রী কাঁদতে থাকে। রাফসান ও কাঁদতে থাকে। কিন্তু ধরিত্রীর কাছে যেতেই সে চলে যায়। রাফসান আসলেই দোষী। এই অপরাধের কোনো ক্ষমা নেই।

মীরাও এসেছে কয়েকবার। নানা গল্প করার চেষ্টা করেছে। ধরিত্রীর কোনো মনোযোগ নেই। রাফসান ধরিত্রীর স্কুলের নানা বন্ধু আর কাজের সূত্রে গড়া অন্যান্য বন্ধুদের ডেকেছে। মেয়েটাকে স্বাভাবিক করাই যাচ্ছে না। মাশরুফার মা এসেছে। সে ধরিত্রীর পাশে শুয়ে আছে। ওর মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছে। রাফসান ও বসে আছে পাশে,

“প্রায় সব মাইয়ার জীবনেই এই ঘটনা হয়। আমার মাশরুফার আগেরটাও নষ্ট হইয়া গেসিলো। তহন ওঝা ডাইকা আমার শাশুড়ি ঝাড়ু দিয়া পিটাইসিলো। আমারে নাকি ভূতে ধরসে। দুই বছর পর আমার মাশরুফা হইসে। এইটা আমার বংশের সবচেয়ে ব্রিলিয়ান্ট মাইয়া। আল্লাহ্ নেয় বুঝসস, ভালো টা দেওনের লাইগা। আল্লাহ্ যা করে ভালোর জন্য করে। দেখগা জান্নাতের বাগানে তোর নিষ্পাপ বাচ্চা টা খেলতেসে। খেলতে খেলতে সেই আল্লাহরে কইবো আমার মায়ের কষ্ট কমাইয়া দাও। আমার মা রে আরেকটা ফুল পাঠাইয়া দাও। দেখবি আগামী বছর তোর কোলে আরেকটা আইবো। এমনে বইসা থাকলে হইবো। তুই না কাম করস বাইরে। কাম কর। আমারে নিয়ে একটা কিছু লেখ। পত্রিকায় আমার ছবি দে। ঐ নাতবউ, অন্তত তোর শাশুড়ি তোরে ওঝা দিয়া মাইর খাওয়ায় নাই এটার শুকরিয়া কর।”
এই কথা বলে নানি হাসতে থাকেন। ধরিত্রীর চোখ বেয়ে পানি পড়তে থাকে। একটু পর সে বলে,

– নানি, আমার বাচ্চাটাই কেন?
– শুন পাগলি, বাগানে গেলে তুই সবার আগে কোন ফুল টা নিবি? সবচেয়ে সুন্দর টা না? তোর বাচ্চাটাও সবচেয়ে সুন্দর ফুল টা।
– আমাকে কেন দিল না?

রাফসান অনেক কষ্টে নিজের কান্না আটকে রেখেছে। ও যদি পারতো তো ধরিত্রীর ভেতরের সব গুলো কষ্ট নিজে নিয়ে নিত। কী করলে ওর প্রায়শ্চিত্ত হবে? রাফসান আহসান আর রাশাকে বলে আবার ছবি দেখার আয়োজন করলো। সেই আয়োজনে ধরিত্রী ছবির দিকে না তাকিয়ে এক পাশ ফিরে তাকিয়ে আছে। রাফসান ওর পাশে বসতেই ধরিত্রী উঠে চলে আসলো।

আরেকদিন দুর্বল শরীরে ধরিত্রী ওর বারান্দায় বসে বসে বেবি জার্নাল পড়ছে। কী সুন্দর করে সব লেখা। প্রতিটা সনোগ্রামের ছবি। প্রতিটা প্যারেন্টিং ক্লাসের পরে অভিজ্ঞতা। এতদিন একটা বাচ্চাকে গর্ভে ধারণ করা। আর আজ নাকি সেই বাচ্চাটি নেই। ধরিত্রী তার কষ্ট কমাতে বাচ্চার জন্য কেনা একটা ছোট পুতুল আলমারি থেকে বের করে জড়িয়ে ধরে। এরপর ড্রেসিংরুমে বসে সেই পুতুলটি ধরে কিছুক্ষণ কান্না করে। হঠাৎ ওর মনে পড়ে, প্যারেন্টিং স্কুলের একটা ক্লাসে একটা ঘুম পাড়ানি গান শিখেছিল।

“খোকা ঘুমাল পাড়া জুড়ালো
বর্গী এলো দেশে
বুলবুলিতে ধান খেয়েছে
খাজনা দেব কীসে?”

ধরিত্রী গাইতে থাকে, আর কাঁদতে থাকে। এভাবে গাইতে গাইতে মেঝেতে ঘুমিয়ে পড়ল সে। রাফসান বাড়ি এসে দেখল ধরিত্রী নেই। পুরো বাড়ি খুঁজে ব্যাকুল হয়ে গেল। বাইরে চলে যায়নি তো? ড্রেসিংরুম টা খুলতেই ধরিত্রীকে দেখতে পেল। ওর না ভয় করে অন্ধকারে। ওর না ছোট জায়গায় দম আটকে আসে। এই অন্ধকারে এভাবে কী কষ্ট কমে? যদি কমে তো রাফসান ও চেষ্টা করবে ওর সাথে এই কষ্ট কমানোর। নিজের সন্তানকে তো সেও হারিয়েছে। গর্ভে ধারণ নাই বা করল।

পুতুলটাকে জড়িয়ে ধরলে নাকি ধরিত্রীর কষ্ট কমে। ব্যস, এরপর কয়েক সপ্তাহ শুধু সেই পুতুল নিয়েই রইলো সে। ব্যাপারটা রুবাইয়ার ভালো ঠেকছে না। অস্বাভাবিক আচরণ করছে। পরিচিত এক মানসিক ডাক্তারের কাছে নিয়ে গেল ধরিত্রীকে। কারণ কাউন্সিলিংয়েও কোনো কাজ হচ্ছে না। ডাক্তার ধরিত্রীকে ভালোভাবে দেখলেন। কথা বললেন। পর্যবেক্ষণের পর বললেন,

– রুবাইয়া, ওর এই অবস্থাটা স্বাভাবিক। এত দিনের বাচ্চা হারানো।
– এখন কী করতে পারি? ও কতটা আন্তরিক আর চঞ্চল ছিল তা তুমি জানো না। আমার ভেতরটা ছিড়ে যায় ওকে এভাবে দেখে।
– আসলে মিসক্যারেজ জিনিসটাই এমন। আরেকটা সন্তান পেলে ওর কষ্ট একটু হলেও কমতো।
– আরেকটা সন্তান! ওর অবস্থা দেখেছ? কিছু খায় না। শরীর একদম ভেঙে গেছে। শারীরিক ভাবে ও অনেক বেশি ভুগেছে।
– এই অবস্থায় থাকলে আরো খারাপ হবে। কিন্তু এই অবস্থায় আরেকটা সন্তান সম্ভব না যেহেতু ওর মন ডাইভার্ট করতে হবে। স্বাস্থ্য ভালো করতে হবে। আর পরে আরেকটা বেবির ট্রাই করলে হয়তো আবার আগের মতো হতে পারে। বাচ্চা হারানোর ক্ষতটাই এমন। আসলে এক কাজ করো, আপাতত ওর ঘর থেকে বেবির সব জিনিস সরিয়ে ফেল।
– সরিয়েছি। শুধু এই পুতুল টাই ছিল। কোথায় ছিল জানতাম না।
– তো ওকে কিছুদিনের জন্য বাইরে পাঠাও। ছেলের সাথে পাঠাও। ঘোরাফেরা করলে একটু সরে আসতে পারবে।
– ও তো ছেলের নামই শুনতে পারে না। ও রাফসানকে দোষারোপ করে।
– এখন আর কী করা। বিগত কয়েক মাস ধরে ওর পুরো জীবনটা বাচ্চার আশেপাশেই ঘুরছে। সেখান থেকে বের হতে হবে। তবেই ও রাফসানের সাথে ফ্রি হবে। পরবর্তীতে চেষ্টা করলে আরেকটা বেবি নিতে পারবে যেমনটা ও চায়। ওকে কী বেশি কষ্ট দিচ্ছে জানো? এই যে এখন এই সময়ে ওর কোলে একটা আসল বাচ্চা থাকার কথা। ও কিছুতেই মানতে পারছে না যে ওর বাচ্চা নেই। কোল খালি হওয়ার কষ্টটাই এমন। আর ওর খুব স্বপ্ন ছিল এই বাচ্চা নিয়ে। এটা করবে সেটা হবে। এক্সপেকটেশন টাই ওর সবচেয়ে বেশি ক্ষতি করেছে। আমি তো ঔষধ দেব। এতে অ্যাক্সাইটি কমবে। তা সাময়িক। কাউন্সিলিং তো করাচ্ছ। কী পরিবর্তন দেখছ। কিন্তু আগের মতো স্বাভাবিক হওয়াটা অন্য কোথাও। তুমি তো আরো ভালো জানো। যা হয়েছে তা মেনে নিলেই হয়। কিন্তু মেনে নিতে হলেও একটা অবলম্বনের দরকার হয়।
– আমার মেয়েটা চলে যাওয়ার পর আমি রাফসানকে বুকে নিয়ে স্বাভাবিক হয়েছি। এটা তো ওর প্রথম বাচ্চা ছিল।
– হয়তো ধরিত্রীকে তুমি ছাড়া আর কেউ ভালো করে বুঝবে না।

রুবাইয়া বাড়ি এসে রাফসানকে জানালো। রাফসান ভাবছে ও আবার লেখালেখি শুরু করলে কেমন হয়? ধরিত্রীর এডিটরকে ডাকা হয়েছে। তিনি এসে ধরিত্রীর সাথে কথা বললেন। নতুন একটা স্টোরি লিখলে হয়তো একটু ব্যস্ত হতো। আর মনটাও বাচ্চা থেকে সরানো যাবে তখন। ধরিত্রীর এডিটর চা খেতে খেতে বললেন,

“এই সপ্তাহে ব্যাক করোনা ধরিত্রী। আমার কাছে একটা আইডিয়া আছে। তুমি না বলেছিলে মম জার্নাল, বেবি জার্নাল বানাচ্ছ। পরে প্রকাশ করতে পারো। এবার তোমার মিসক্যারেজ জার্নিটা লেখ। তোমার বেবি জার্নালের কিছু অংশ থাকবে। এরপর মিসক্যারেজের কথা।”

ওরা সবাই মহিলার দিকে তাকিয়ে রইলো। এটা কী ধরণের কথা? মিসক্যারেজ স্টোরি! ধরিত্রী সেখান থেকে উঠে চলে আসলো। রাফসানের খুব রাগ হলো।

– আপনি কী পাগল? আমি আপনাকে এখানে ডেকেছি ওর কষ্ট কমানোর জন্য।
– তাই তো করছি। ওর কষ্টটাকে ইউটিলাইজ করার কথা বলছি। ব্রেক আপ হলে মানুষ ব্রেক আপের কবিতা লেখে। সেটাকে ইউটিলাইজ করে ওভারকাম করে।
– এটা কী ব্রেক আপ মনে হয় আপনার! বাচ্চা হারানোর যন্ত্রণা জানেন?
– আই নো ইটস ডিফারেন্ট। কিন্তু হারানোর কষ্ট আর কীভাবে কমায়? এক্সেপ্ট করে নিয়ে।
– হ্যাভ সাম এম্পেথি।
– আই হ্যাভ। এখন পুরো জিনিসটাকে আঁকড়ে ধরে বা একদমই অবহেলা করে কিছুই হবে না। ওর পুরো ব্যাপারটা কে যেতে দিতে হবে। প্রপারলি গুডবাই বলতে হবে। তাই নিজের বাচ্চাকে একটা লেটার লেখা, গুডবাই বলা জরুরি। ও যেটা বলতে পারেনি। এটাই ওর কষ্ট।
– দেখুন, আপনাদের এসব কাব্যিক জিনিস সব জায়গায় খাটে না। ও গুডবাই বলতে না, ও বাচ্চাটাকে চায়।
– ওয়েল, আমি ওকে এখন একটা সম্পূর্ণ আলাদা কাজ দিলে ওর অনেক সময় লাগবে মন বসাতে। হয়তো সম্ভব ও না। ওর ডিপ্রেশন যে বিষয়ে ওটা ফেস করা জরুরি। ওকে বেবিটা কষ্ট দেয় তাই ও বলল সামনে ও বেবিই নেবে না। এভাবে থাকবে। বা ওর সামনে কেউ বেবিই আনতে পারবে না। তোমার চলবে? ফেস করতে হবে তো।

রাফসান আর সেই মহিলাকে কিছুই বলল না। বলেও কোনো লাভ নেই। ওনার মধ্যে কোনো সহমর্মিতা নেই।

এর কিছুদিন পর রুবাইয়া জোহরার সাথে কথা বলল। কিছুদিন হয়তো মায়ের কাছে থাকলে মেয়েটার ভালো লাগবে। জোহরা ধরিত্রীর ঘরটা আগের মতো করে সাজাতে লাগলো। ওর জন্য ছবি আঁকার সরঞ্জাম আর নতুন নতুন কবিতার বই এনে ভরিয়ে রেখেছে। পুরনো আলমারি থেকে ওর ঘুঙুর এনে রেখেছে। কিছু একটা তো করুক। রাফসান সহ রুবাইয়া ধরিত্রীকে এই বাড়িতে আনলো। রাফসানের মন টানছে ওকে এভাবে রেখে যেতে। কেন এত অভিমান? কেন একটুও কথা বলছে না। তাকিয়েও দেখছে না। দুজনের মা ওদের রেখে চলে গেল। একদম প্রথম দিনের সাক্ষাতের কথা মনে পড়ে গেল। এভাবেই এই ঘরে দুজন একা ছিল। একইভাবেই আলো বাতাস আসছে এই ঘরে। কিন্তু ওর ধরা ওকে রেখে চলে যাচ্ছে। রাফসান ওর ডান হাত উঁচিয়ে ধরিত্রীর ডান হাতটা পেছন থেকে ধরে ফেলল। এই হাত আজ এত ঠান্ডা কেন? এত নরম, এত দুর্বল। রাফসান দাঁড়িয়ে গেল। অতঃপর ধরিত্রীর কাছে এসে ওকে জড়িয়ে ধরল। অনেকদিন পর ওকে জড়িয়ে ধরেছে। এই জিনিসটা আরো আগেই হওয়ার কথা। আজ রাফসানের একটু শান্তি লাগছে। ওর ধরা ওর বুকের মধ্যে। ধরিত্রী অনেক শুকিয়ে গেছে তা রাফসান অনুভব করতে পারছে। কিন্তু ধরিত্রী রাফসানকে জড়িয়ে ধরেনি।

“আমি কিন্তু আবার আসব, তোমাকে আবার নিয়ে যাব। তৈরী থেকো ধরা। আমার অপেক্ষা করো।”

রাফসান ধরিত্রী কে ছাড়তেই ধরিত্রী রাফসানের দিকে তাকালো। ধরিত্রীর করুণ চোখ দেখে রাফসান আর কিছুই বলেনি। কেন যেন ওকে রেখে যেতে ইচ্ছে করছে না। মন টানছে না। তারপর ও চলে গেল।

ধরিত্রীকে ওর বাবার বাড়ি পাঠিয়ে প্রতিদিন ওকে নানান সময়ে ফোন করতে থাকে। ও কথা না বললে শাশুড়িকে কল দেয়। মাঝে মাঝে রাতের বেলা এসে দেখে যায়। ধরিত্রী ওদের বাসায় প্রায় পঁচিশ দিন। হঠাৎ সেদিন রাতে খবর আসে , ওর আবার অ্যাটাক এসেছে। হাসাপাতালের নেওয়া হয়েছে। কথাটা শুনেই রাফসানের পায়ের নীচের মাটি সরে গেল।

(চলবে)

#ধরিত্রী_কথন
#পার্ট২৮
#পিকলি_পিকু

মায়ের কাছে আসার পর ধরিত্রী ছবি আঁকা শুরু করেছে। ছবি আঁকতে ওর ভালোই লাগে। অনেকদিন পর সে হাতে তুলি ধরেছে। আসলে একজন শিল্পীর হাতে তুলি আর রং আসলেই হলো। ধরিত্রী মোট তিনটি ক্যানভাসে ছবি এঁকেছে। প্রথমটায় একটা সুন্দর বাগান আর তাতে ফুল। দ্বিতীয়টায় সেই বাগানে ফুলটি নেই। শেষের টায় একই বাগানে আরো সুন্দর একটা ফুল এসেছে।

জোহরা বসে বসে মেয়ের আঁকা ছবিগুলো দেখছে। কী সুন্দর। কত প্রতিভাবান মেয়ের মা সে।

– তোর বাগানেও অনেক সুন্দর একটা ফুল ফুটবে চিনি।
– মা আমার রাফসানের সাথে কথা বললেই ওর সেদিনের ব্যবহার মনে পড়ে। ও কতটা বিরক্ত ছিল আমার উপর।
– এখন তো সে ভুল বুঝতে পেরেছে। রাফসান এখন তোর জন্য কী না করছে।
– মা আমার বারবার আমার বাচ্চাটার কথা মনে পড়ে। আমি সেদিন তেমন দুশ্চিন্তা না করলে ও থাকতো।
– যে থাকার সে থাকতো। যে আসার সে আসবে। যে আছে তাকে দেখ মা। রাফসানকে দেখ। আবার শুরু কর। ও ফোন করলে কথা বল। ও আসলে একটু গল্প কর। ওকেও জিজ্ঞেস কর কেমন আছে। ছেলেটা ও তো সন্তান হারিয়েছে। সেও তো খুশি তে নেই।

রাফসান ওদের বাসায় আসার পর ধরিত্রী অনেকবার কথা বলার চেষ্টা করেছে। বারবার সে থমকে গেছে। বারবার আগের কথা মনে হয়। আগের কথা মনে হলেই মনে পড়ে বাচ্চাটা আর নেই। সব স্বপ্ন কেমন মরীচিকা। সবই যেন এক পলকে চেনা থেকে অচেনা হয়ে গেছে।

আজ ধরিত্রীর মা ওর আঁকা ছবিগুলো বসার ঘরের দেওয়ালে টাঙাতে ওর মামাকে ডেকে এনেছে। মামা আবার হালকা পাতলা ড্রিলের কাজ জানেন। শখ আছে তার। আসার সময় তিনি তার প্রিয় ভাগ্নির জন্য পুরান ঢাকার বিখ্যাত এক হালিম আনলেন। ধরিত্রী যখন গর্ভবতী ছিল তখনো কয়েকবার নিয়ে গিয়েছিল। সে মামাকে বলেছিল তার এই হালিম খাওয়ার ইচ্ছে হচ্ছে। তাই আজ বাড়ি এসে সেই হাড়িটি টেবিলে রেখেই বললেন, “তোর প্রিয় হালিম বুড়ি। চিন্তা করবি না। ভালো মাংসের টুকরো বেছে এনেছি।” ধরিত্রী আস্তে আস্তে এগিয়ে আসতেই ওর আগের কথা মনে পড়ে গেল মামা যখন ওর শ্বশুরবাড়ি নিয়ে গিয়েছিল। কাছে এসেও ধরিত্রী বলল, ” না, খাব না। ” জোহরা বাটিতে ঢেলে ধরিত্রীর কাছে নিয়ে ধরল। ধরিত্রী মাথা নেড়ে আবার বারণ করল। জোহরা জোর করে আবার ধরলো। ধরিত্রী হঠাৎ চিৎকার করে বলল, “বললাম তো না!!!” ধরিত্রী দৌঁড়ে নিজের ঘরে চলে গেল। জোহরার হাতে গরম হালিম পড়ে গিয়েছিল। বেশি গরম না হওয়ায় কিছু হয়নি। জোহরা কিছু না বলে হালিম টা পরিষ্কার করতে লাগলো। ধরিত্রীর মামা জায়েদ দাঁতে দাঁত চেপে দাঁড়িয়ে আছে। ঘরে ধরিত্রীর বাবাও নেই। তিনি রান্না ঘরে গিয়ে বললেন,

– আপা তোমার সহ্য হয় কী করে?
– নিজের মেয়ে আমার। আমার সহ্য হবে না তো কার সহ্য হবে?

জোহরা ঠোঁট কামড়ে বসার ঘরে আসলো। তার শরীর কাঁপছে। সবসময় যে হাসি টা থাকে তা নেই।

– এদিকে দেখ। এই দেওয়ালে লাগাবো।
– নিজের মেয়ে? আপা সত্যি? তুমি কী খেয়ে চামড়া এত মোটা করেছ বল না? শুধু মাত্র তোমার জন্য ওকে আপন ভাগ্নি হিসেবে দেখি। তবে মনে রাখো, পর কখনো আপন হয় না।
– শোন, প্রথমটা লম্বালম্বি, দ্বিতীয় টা সমান্তরাল শেষটা আবার লম্বালম্বি।
– ঐ মেয়েটা তোমার দত্তক নেওয়া মেয়ে হলেও বুঝতাম। এটা তোমার স্বামীর অন্য নারীর সাথে পাপের ফসল। সেই মেয়েটিকে তুমি এভাবে মাথায় নিয়ে ঘোরো কী করে।
– মেয়েটি মেয়েটি কেন করছিস? ধরিত্রী আমার মেয়ে। জন্ম দিলেই মা হয়? যে বড় করে সে না?
– কিন্তু আপা ও দুলাভাই আর অন্য মহিলার অবৈধ,

জোহরা ধরিত্রী কে দেখে ফেলল। ও দরজার বাইরেই ছিল। ও স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। জোহরা ওর সামনে গিয়ে অপ্রস্তুত হয়ে বলল,

– চিনি, কী হয়েছে? কিছু লাগবে?
– মামাকে আর তোমাকে স্যরি বলতে এসেছিলাম।
– লাগবে না। তুই কী সত্যি খাবি না?

এই কথা বলতেই জোহরা কেঁদে উঠলো। ধরিত্রী ওর মামার দিকে তাকিয়ে বলল, “কে অবৈধ?”

ধরিত্রী বাবা কলিংবেল বাঁজালেন। সবাই একই জায়গায় দাঁড়িয়ে রইলো। কিছুক্ষণ পর জোহরা সব বলতে লাগলো,

“তোর নানি আর দাদি যেমন সই ছিল তেমনি তোর নানা দাদা ছিল বিজনেস পার্টনার। তোর বাবা ছোট থাকতেই তোর দাদা মারা যায়। তখন আমার বাবা বিজনেস দেখতেন। পরবর্তীতে তোর বাবাকে কাজ শেখান। আমি ষোলো হতেই আমাকে বিয়ে দিয়ে দিলেন ওর সাথে। ওর তখন বাইশ। ও আমার বাবার কাছে অনেক কৃতজ্ঞ ছিল। সেই কৃতজ্ঞতা থেকেই দায়বদ্ধতা। তাই আমাকে বিয়ে করে। আমার বিয়ের কিছুদিন পরেই বাবা মারা গেলেন। বাবা চলে যাওয়ার পর আমি অনেক বিষণ্ণ থাকতাম। এরপরই আমার গর্ভের সন্তান ও চলে গেল। আমি সতেরো বছরের ছিলাম যখন আমার সন্তান চলে গেল। স্বাস্থ্য খুবই খারাপ ছিল। এরপর আমি অনেক চেষ্টা করেও আর কখনো মা হতে পারিনি। তোর বাবার ও বেশি বয়স ছিল না। আমাদের উপর তার দায়িত্ব পালন ছাড়া আর কোনো কিছুতেই ও ছিল না। ও আমার খবর রাখতো না। ব্যবসার কাজে বাইরে বাইরে থাকত। কখনো কক্সবাজার, কখনো সিলেট। আমি ঢাকায় পরিবারের সাথে থাকতাম। দূরত্ব ছিল আমাদের মধ্যে। একদিন দেখলাম একটা আঙটি। তাতে J+J লেখা। এই যে আঙটি টা। ভেবেছিলাম Johora + Jaman, কিন্তু জোহরা আমি Z দিয়ে লিখি। ভেবেছিলাম ভুল করে করেছে। আমি এটা হাতে পরে সবাইকে দেখিয়েছি। তোর বাবা এসে আর এটা খুলে নিতে পারেনি। তার সাথে যে কার্ড টা ছিল ওটা গায়েব হয়ে গেল। সেদিন ও তোর বাবাকে বলতে পারিনি জোহরা Z দিয়ে। কষ্ট পাবে তাই। তখন থেকেই জোহরা আমি J দিয়েই লিখি। তবে কিছুদিন পর আমি ঠিক করি আমি কক্সবাজার যাব তোর বাবার সাথে দেখা করতে। সেদিনই প্রথমবার আমি একা সফরে বের হই। তোর বাবার বাসায় এসেই দেখি অন্য একটা মেয়ে তোর বাবার সাথে।”

ধরিত্রীর বাবা লজ্জায় মুখ লুকাচ্ছেন। ধরিত্রী ওর বাবার দিকে তাকিয়ে আছে,

” বুঝতে দেরি হয়নি মেয়েটা কে। ওর গলায় ঐ একই ডিজাইনের J+J লকেট ছিল। এই যে এটা, আমার গলায় এখনো আছে। আমি অনেক বেহায়া যে, তাই এটা এখনো পরি। ঐ মেয়েটা অনেক সুন্দরী ছিল। লম্বা, ছিপছিপে, ফর্সা, ঘন সোজা লম্বা চুল। বয়স ও কম। কুড়ি বাইশ হবে। মেয়েটাকে দেখে আমি সেখানে এক মুহূর্ত ও দাঁড়াইনি। চলে আসলাম। তবে এভাবেই আমার আর জুঁইয়ের প্রথম দেখা হয়েছিল। জুঁই, বোকা মেয়েটা। তোর বাবার কক্সবাজারের বিজনেস পার্টনারের মেয়ে। ও জানতো এই লোকটার একটা বউ আছে। আর মজার ব্যাপার তোর বাবা নিজের বিয়ে করা বউকে ভুলে গিয়েছিল। আবার একটা অবিবাহিত মেয়ের সাথে বিবাহ বহির্ভূত সম্পর্কে ছিল। আশ্চর্য না? এখন আমি একা তো বেরিয়ে গেছি। ঢাকা আসব কীভাবে জানতাম না। এর মধ্যে তোর বাবা আসলো পেছন পেছন। আমি অনেক কান্নাকাটি করলাম। বিরাট বড় তামাশা করলাম। সেই তামাশায় জুঁইয়ের বাবা আর সমাজপতিরা এলো। সকালে সালিস বসলো। সেখানে জামানকে সারাজীবনের জন্য কক্সবাজার ছাড়তে বলা হলো। আর ওরা দুজন আমার পা ধরে ক্ষমা চাইলো। জুঁইকে অন্য জায়গায় বিয়ে দিয়ে দিতে বলল। লেনদেন করে জামান আর আমি সেই রাতেই সিলেট আসলাম। সেখানে দুইমাস আমরা একই ঘরে থাকলাম। আমি চাইলেও ছাড়তে পারতাম না ওকে। আমার ভাই ছোট, আমি ব্যবসার কিছু বুঝিনা। আমার বাবা ব্যবসার সব কাজ জামানকে শিখিয়ে আমার ভবিষ্যতের জন্য আমাকে ওর সাথে বিয়ে দিয়েছে। কিন্তু আমাকে তৈরী করেনি। আমাকে ওর জন্য ভালো বউ তৈরী করেছে। আমাকে ওর সাথেই থাকতে হতো। এর মধ্যে আমরা ডাক্তার দেখালাম। আবার যদি শুরু করা যায়। সন্তান আসলে জামান আর আমার দূরত্ব কমবে। জানতে পারলাম আমি আর মা হতে পারব না। আর কোনো আশা নেই। আমি বন্ধ্যা! পরিবারের কেউ জানতো না। আমার মা হওয়ার সব স্বপ্ন শেষ হয়ে গিয়েছিল। কিন্তু এক রাতে আমার স্বপ্ন আমার দরজায় কড়া নাড়লো। খুলে দেখি জুঁই, বিধ্বস্ত অবস্থায় দাঁড়িয়ে। আমাকে দেখেই মাটিতে বসে আমার পা জড়িয়ে ধরল। ”

সেই রাতে…

– আপা, আমাকে ক্ষমা করে দিন। আমি পাপ করেছি। আমি শাস্তি পাচ্ছি। কিন্তু আমার বাচ্চা কোনো দোষ করেনি।
– তোমার বাচ্চা!
– আমার আর জামানের বাচ্চা। আপা আমি তিন মাসের গর্ভবতী!

জুঁই কাঁদতে লাগলো। জামান এক পাশে দাঁড়িয়ে রইলো। জোহরার বলার মতো কোনো শব্দ থাকেনা। ওর জীবনে আর কী কী হওয়া বাকি? কিন্তু এ শুধু বিপদ নয়। আশার বাণী ও হতে পারে। জোহরার সাথে সবসময় খারাপ হবে এমন তো না।

– তুমি কী চাও?
– আপা, আমি বাচ্চাটা জন্ম দিতে চাই। আমার বাবা আমার গর্ভপাত করিয়ে আমাকে অন্য জায়গায় বিয়ে দিতে চায়। আপা আমি কথা দিচ্ছি, আমি কিচ্ছু চাই না। জামানকে ও না। আমার বাচ্চাটাকে জন্ম দিয়ে ওকে নিয়ে অন্য কোথাও চলে যাব।

জোহরা চুপ করে দাঁড়িয়ে থাকে। অনেকক্ষণ চিন্তা করার পর বলে,
– কোথায় যাবে? যাওয়ার জায়গা আছে?
– জানি না। যেদিকে দু চোখ যায়। আপনাদের থেকে অনেক দূরে চলে যাব।
– তো তুমি এখানে থাকো। বাচ্চা জন্ম দাও। আমার সাথে যে অন্যায় করেছ, তার প্রায়শ্চিত্ত করে যাও।
– কী করে?
– বাচ্চাটা আমাকে একেবারের জন্য দিয়ে দাও। ও আমার সন্তান হবে। আর বাচ্চা টা আমাকে দেওয়ার পর ফিরেও তাকাবে না। তোমাকে আমি যথেষ্ট টাকা পয়সা দেব। তোমার বয়স এখনো কম, আর খুব সুন্দরী ও। আরেকটা বিয়ে করে নিবে।
– আমার সন্তান আমি আপনাকে ?
– নইলে বাবার বাড়ি যাও। গর্ভপাত করে ফেল। রাস্তাঘাটে থাকলে এমনিতেও হয়ে যাবে। আমার প্রস্তাব টা ভালো। বিবেচনা করে দেখ। জামানের সন্তান জামানের ঘরে থাকবে।

জামান জোহরাকে আটকাতে গেলেই জোহরা অগ্নিমূর্তি হয়ে তাকালো। জামান আর কিছুই বলল না। এই মেয়েটার সাথে সে অনেক অন্যায় করেছে। আজ সে যা চাইছে তার থেকে জামান তা কেড়ে নেবে না। জামান অনুতপ্ত তার কৃতকর্মের জন্য।

“সেই মুহূর্তে আমার শুধু মা ডাক শোনার ইচ্ছে ছিল। আমি আর পারছিলাম না। এক অসম্পূর্ণ নারী হয়ে আমি থাকতে পারছিলাম না। স্বামীর ভালোবাসা না পেলে সে ও নারী। আর যে নারী মা হতে পারে না, সমাজের চোখে সে অপয়া। সেদিন থেকে আমি মিথ্যা শুরু করলাম। আমি গর্ভবতী, সিলেটে মানত করার কারণে আমি কারো সাথে দেখা করবে না। বাচ্চা জন্ম দিয়েই আমি সবার সাথে দেখা করব। সিলেটে আমরা তিনজন একই ঘরে ছিলাম। তোকে নিজের পেটে ধারণ করিনি। তবে তোকে তৈরী হতে দেখেছি। আমার সন্তান অন্য নারীর গর্ভে। তবে সে অন্য নারী আমার জন্য সন্তান তৈরী করতে করতে যে নিস্তেজ হয়ে যাচ্ছিল। অবশেষে তোকে জন্ম দিতে গিয়ে সে মারা গেল। খিচুনি হয়েছিল তোর মতো। জুঁই আমাকে বলেছিল ওর মৃগী রোগ আছে। আমি ওর আলাদা খেয়াল রাখতাম তাই। কিন্তু তুই হওয়ার পর ওর যখন খিচুনি হয় ও ভালো চিকিৎসা পায়নি। ওখানে এত ভালো হাসপাতাল ছিল না। জুঁই কে সিলেটেই কবর দেওয়া হয়। এই লকেটটা ওর শেষ চিহ্ন। এই লকেট আমার সাথে হওয়া বিশ্বাসঘাতকতার চিহ্ন।”

জোহরা হাত দিয়ে সেই লকেট আবার তুলে ধরে। জুঁই আর জামানের ভালোবাসার চিহ্ন শুধু এই লকেট নয়। আরেকটা জলজ্যান্ত চিহ্ন ওনাদের সামনে বসা। ধরিত্রী তার মায়ের গলায় জন্মদাত্রীর সেই চিহ্নের দিকে তাকিয়ে থাকে। জোহরা ওর মা নয়!

” এরপর ই তুই অসুস্থ হয়ে পড়িস। তোকে বাঁচাতে আমরা এদিক ওদিক ছুঁটি। জানি না জুঁই মরেছিল তাই খুশি হয়েছিলাম কিনা, তবে তুই কোলে আসায় খুব খুশি হয়ে ছিলাম। তোকে বড় করে তুললাম। প্রথম প্রথম সবাই বলতো জোহরার মতো চেহারা। আমিও তাই কখনো তোর মাঝে অন্য কাউকে দেখিনি।”

ধরিত্রী নীচের দিকে তাকিয়ে বলল,

“নানি দাদি জানতো?”

মামা বললেন, “তুই হারিয়ে যাওয়ার পর আমি জানতে পারি। এরপর মা।”

জোহরা আবার বলল, ” তুই হারিয়ে যাওয়ার তোর বাবা আমাকে দোষারোপ করেছিল। বলেছিল আমি হিংসায় তোকে ইচ্ছে করে বের করে দিয়েছি কারণ আমি তোকে জন্ম দেইনি। যে জীবনে তোকে একদিন ও স্কুলে নেয়নি, খাইয়ে দেয়নি, যার একটা ভুল হিসেবে জন্ম তোর, সে আমাকে এই কথা বলার সাহস রাখে। জায়েদ এই কথাটা শুনে ফেলেছিল। তোকে খুঁজে পাওয়ার পর জীবনে প্রথম ও শেষ বার আমি সিদ্ধান্ত নেই আমি তোর বাবাকে ডিভোর্স দেব। তোকে নিয়ে আলাদা হয়ে যাব। জায়েদ বড় হয়েছে, আমার দায়িত্ব শেষ। এখন বাবার ব্যবসা জায়েদ বুঝে নেবে। কিন্তু এই লোকটা আমাকে হুমকি দেয় তোকে আমার থেকে কেড়ে নেবে, কারণ তোকে জন্ম দেইনি। সেদিন আমি মাকে সব বলি। মা প্রথমে বিশ্বাস করতে চায়নি তুই ওনার নাতনি না। তার কিছুদিন পর মা হার্ট অ্যাটাক করে। আমি আর সাহস পাইনি ডিভোর্স দেওয়ার। তোকে আমি হারাতে পারব না। এই লোকটা কী এমন করেছে তোর বাবা হওয়ার মতো? হয়তো জুঁই তোকে জন্ম দিয়েছে, কিন্তু তোকে আমি পালন করেছি। হয়তো তোর চোখ জুঁইয়ের মতো টানাটানা, কিন্তু এতে কাজল আমি দিয়েছি। হয়তো তোর চুলের ধাঁচ জুঁইয়ের মতো, কিন্তু এর পরিচর্যা আমি করেছি। হয়তো তোর কন্ঠস্বর জুঁইয়ের মতো কিন্তু তোকে কথা বলা আমি শিখিয়েছি। মা তুই আমাকে ডেকেছিস। সর্বোপরি আমি যেমনটা হতে চেয়েছিলাম, শক্ত, স্বনির্ভর তেমনটা তোকে বানিয়েছি। তোর ভেতরের চিন্তাটা আমার। তুই মানুষটা যেমন তা আমি গড়েছি। তবে তুই ওদের মেয়ে কেন হবি? আমার মেয়ে কেন না?”

“তোমার কী খারাপ লাগে না, আমি যখন তোমাকে মা বলি?” ধরিত্রী এই কথাটা বলতে জোহরা বলল,
” আমার গর্ব হয়। তুই যখন মা বলিস আমার আনন্দ হয়। তোকে দেখলেই আমার আনন্দ হয়। মনে হয় আমি সার্থক। জানিস, আমার খুব ইচ্ছা ছিল, আমার যমজ মেয়ে হবে। একটার নাম রাখব অরিত্রী, আরেকটা ধরিত্রী। ধরিত্রী নামটা তোর বাবার দেওয়া ছিল না। তোর বাবা সবসময় তোর দায়িত্ব থেকে পালিয়েছে কারণ তার লজ্জা হয়। তোর সব নাম আমার দেওয়া। তোর ভেতরে বাইরে সব আমার দেওয়া। অরিত্রী চলে গেছে। আমার একটা সন্তান হয়েছিল। আমি ভাবতাম পরের টা ধরিত্রী হবে। পরের টা ধরিত্রী হয়েছে।”

“কীভাবে বাবাকে ক্ষমা করে দিয়েছ?”

কথাটা শুনে জোহরা জামানের দিকে তাকায়। “তোর মনে হয় ক্ষমা করেছি? প্রতিদিন তুই আমাকে মা ডাকিস, তখন ওর হার হয়। তুই আমাকে বেশি ভালোবাসিস, সব বলিস, এতে কে জিতলো? আর সেদিন তুই টিভিতে পরকীয়া করা লোকদের ধিক্কার দিচ্ছিলি, আমার পাশে বসে তোর বাবা মাথা নিচু করে পুরো শো শুনেছে। গর্বে আমার মাথা উঁচু ছিল। এখন বল, ক্ষমা পেয়েছে? প্রতিদিন শাস্তি পাচ্ছে। আমার কোনো আফসোস নেই। কারণ আমার তুই আছিস।”

ধরিত্রী জোহরার দিকে তাকিয়ে থাকে। এতটা উদার একটা মানুষ কী করে হয়? কী করে ওনার ঋণ শোধ করবে? মা না হয়েও এত বছর মায়ের মতো আগলে রেখেছিল যে, এ তো মা নয়, মায়ের ঊর্ধ্বে কেউ। এরপর হঠাৎ করেই মনে পড়ে ওর জন্মদাতারা এই মহিলার সাথে কী অন্যায় করেছে। সারাজীবন কষ্টই দিয়েছে। আর আজ সে এই চেহারা নিয়ে তার সামনে বসে তাকে আরো কষ্ট দিচ্ছে। ধরিত্রী নিজে একটা পাপের ফসল। সে অবৈধ সন্তান। লজ্জায় আর ঘৃণায় সে জোহরার দিকে তাকাতে পারে না। জোহরা ধরিত্রীর কাছে আসতেই ওর খিচুনি শুরু হয়। জোহরা চিৎকার করতে থাকে , “আমার মেয়ের কী যেন হয়েছে জায়েদ!” ধরিত্রী মাটিতে পড়ে ডাঙায় আসা মাছের মতো ছটফট করতে থাকে। ওর বাবা আর মামা ওর হাত মালিশ করতে থাকে। জোহরা ধরিত্রীকে বাতাস করতে থাকে। একটু পর ওনারা সবাই মিলে ওকে হাসপাতালে নিয়ে গেল। সেখানে রাফসান আর ওর বাড়ির লোক এলো। কেন হঠাৎ অ্যাটাক আসলো তারা কেউ সঠিক কারণ টা বলল না। আস্তে আস্তে ওর জ্ঞান আসতেই সবাই দেখা করলো। ও কারো সাথে কিছু বলল না। আসল কারণ টা কেউ বলবে না। সবাই চলে যাওয়ার পর জোহরা রইলো সেই কেবিনে। কিছুক্ষণ চুপ থাকার পর জোহরা হাতজোড় করে বলল,

– প্লিজ কাউকে বলিস না। আমার থেকে এই বয়সে মা হওয়ার অধিকার টা কেড়ে নিস না। আমি তোর মা হয়ে এই পৃথিবী থেকে যেতে চাই। বন্ধ্যা নারী হয়ে না।
– চিন্তা করবেন না আন্টি, আমি কাউকে বলব না।

জোহরা এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে। ওনার চোখ দিয়ে জল গড়িয়ে পড়ছে। আন্টি! এক সেকেন্ডে পর করে দিল। জায়েদ বলেছিল, পর কখনো আপন হয় না। ধরিত্রী তো ওনার পর না। তবে কেন?

(চলবে)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here