ধরিত্রী_কথন #পার্ট২৯,৩০

0
852

#ধরিত্রী_কথন
#পার্ট২৯,৩০
#পিকলি_পিকু
২৯

বাড়ি ফেরার পর ধরিত্রী তার বাবা মায়ের সাথে একটা কথাও বলেনি। কী বলবে? কোনো ভাষা নেই। সবই যেন দুঃস্বপ্ন! জোহরা তবুও ওকে খাইয়ে দিতে এসেছে। ওর ঘরে ঢুকে দাঁড়িয়ে আছেন। ধরিত্রী বিছানায় বসে আছে।

– আপনার কাছে খারাপ লাগে না?
– লাগে। যখন তুই এক ঝটকায় আমাকে আন্টি বলে ফেললি। এখন আবার আপনি আপনি করছিস।
– কেন করব না? আমি আপনার স্বামীর আর অন্য মহিলার পাপ।
– কিন্তু তুই আমার পূণ্য। আল্লাহর কাছে আমার হাজার অশ্রুর ফসল। আমার পুরস্কার।
– এসবই আপনার সান্ত্বনা। আপনি নিজেকে মিথ্যা বলে বলে মিথ্যার রাজ্যে বাস করছেন। আপনি বোকার স্বর্গে আছেন। সত্যি এটাই আমি অবৈধ।
– তুই আমার মেয়ে।
– আপনার তো আমার মুখে মা শুনতে খুব কষ্ট হওয়ার কথা। আমার ভাবতেই কেমন যেন লাগছে এতটা বছর সবার সামনে আপনাকে মা মা করে এসেছি। কতটা কষ্ট পেয়েছেন আপনি। কেমন লেগেছিল আপনার?
– খুব ভালো লাগে আমার মা ডাক শুনতে।
– কিন্তু আমার কষ্ট হয়!

ধরিত্রী চিৎকার করে উঠে। জোহরা দূরেই দাঁড়িয়ে থাকে। ধরিত্রী তার ঘরে একটি কোণায় গিয়ে বসে। মা মেয়ের মধ্যে আজ অনেক দূরত্ব।

– আজকে থেকে আমার পক্ষে আপনাকে আর মা ডাকা সম্ভব না।
– কেন চিনি?
– কারণ আমি ঐ মহিলার সন্তান। ঐ কুলাঙ্গার লোকটার সন্তান। আমার প্রতিটা ডিএনএ এই বিষয়ে সাক্ষী দেবে। চাইলেও বদলাতে পারব না। আপনার সাথে হওয়া প্রতিটা অন্যায় মনে পড়বে আমার। আমি যখনই মা ডাকবো মনে হবে আমি মজা করছি। এই মিথ্যা নাটক আমার দ্বারা আর হবে না। আমার অস্তিত্ব অত্যন্ত ঘৃণিত। আমি যেই জিনিসটা সবচেয়ে বেশি ঘৃণা করি আমার জন্মই সেখান থেকে।
– আমি সব মুছে দিয়েছি। তুই শুধু আমার মেয়ে। আমি ডিএনএ বুঝি না। শুধু মন বুঝি, ভেতরের মানুষ বুঝি। সেগুলো তো আমার।

জোহরা ধরিত্রীর কাছে গিয়ে বসে এই কথা গুলো ওকে আস্তে আস্তে বলে। কথার ফাঁকে ফাঁকে সে চিনির মাথায় আলতো করে হাত ও বুলিয়ে দেয়। চিনি শুধু তার কথাই শোনে। তার কাছেই কাবু হয়। পোষ মানা যে তার। ধরিত্রী কাঁদতে কাঁদতে জোহরাকে জড়িয়ে ধরে। জোহরা ধরিত্রীর চোখ মুছে দেয়। জোহরার ভিতর এখনো একই রকম মমতা। আল্লাহ্ যেই নারীকে মা হওয়ার ক্ষমতা দেননি তাকে এত মমতা কেন দিলেন? ভালোবাসার ক্ষমতা আল্লাহ্ শুধুই তার প্রিয় সৃষ্টিকে দেন। জোহরা হয়তো তাই।

– মা, আমি কী তোমার পুতুল?
– হ্যাঁ। তুই আমার পুতুলের মতো মেয়ে।
– জানো, আমার বেবীটা যখন মারা যায় তখন আমার বুকটা অনেক খালি ছিল। তোমার ও কী ছিল?
– হ্যাঁ রে, আমার বুকটা অনেক বছর খালি ছিল। তাই তো আল্লাহ্ তোকে পাঠিয়েছে।
– আমিও আমার আলমারি থেকে একটা পুতুল আমার বুকে জড়িয়ে রাখতাম। একটু শান্তি পাওয়ার জন্য। আমি কী তোমার জন্য সেই পুতুলটা?

জোহরা তাকিয়ে থাকে। ধরিত্রীর অশ্রু সিক্ত চোখ যেন গঙ্গাধারা। ভেতরে কতটা কষ্ট সে ধরে রেখেছে।

– আমি পুতুল না। আমি রক্তে মাংসে গড়া মানুষ। আমার ও প্রাণ আছে, মন আছে। আমার অনুভূতি আছে। আমার ও কষ্ট হয়।
– আমি জানি। তুই মানুষ। পুতুল না।
– আমি যদি সত্যিই সেই তুলো ভরা সেলাই করা পুতুল হতাম? কত ভালো হতো, তাই না? আমার কোনো অনুভূতি থাকতো না। কার থেকে আসলাম কিছুই আসতো যেত না।
– একদম না। তুই আমার বাচ্চা।
– আমি যদি সত্যিই তোমার সন্তান হতাম? আমি যদি সত্যি সত্যিই তোমার সন্তান হতাম? আমার জন্ম যদি তোমার গর্ভে হতো। আমি কেন তোমার সন্তান হলাম না!!

ধরিত্রীর চিৎকারে জোহরা একটু দূরে সরে যায়। সে এখন হিংস্র। হিতাহিত জ্ঞান তার নেই। জোহরা আবার এগিয়ে আসে। ধরিত্রী বাচ্চাদের মতো কাঁদতে থাকে। জোহরা তাকে তার বুকে আগলে রাখে।

– সৃষ্টিকর্তার কাছে কোনো ন্যায় নেই। আমাকে তোমার সন্তান না করে ঐ মহিলার গর্ভে কেন আনলো! কিন্তু আমাকে যদি তোমার গর্ভেই আনতো তো এত ঝামেলা হতোই না।
– যা হওয়ার তা তো হতোই।
– তবে আমায় পুতুল কেন বানালো না? অনুভূতিই বা কেন দিল?
– আমার সাথে তর্ক করার জন্য। চটাং চটাং কথা বলার জন্য। আমার কষ্ট বোঝার জন্য।
– তুমি কেন সেই রাতে তাকে জায়গা দিয়েছিলে? পাঠিয়ে দিতে তার বাড়ি। আমাকে তার গর্ভেই মে*রে ফেলা হতো। কেন বের করে দিলে না? রাস্তাঘাটে ম*রে থাকতাম। কত কুকুর বিড়ালই তো মা*রা যায়।
– চুপ!
– চুপ কেন? আমি আর একটা কুকুর বিড়ালের মধ্যে পার্থক্যটাই বা কী? ওদের ও জন্মের ঠিক নেই আর আমার,
– একটা থা*প্পড় মা*রব!
– তুমি ওনাকে বিষ কেন খাইয়ে দিলে না? এতটা বছর এই আপদ কেন পালন করলে?
– মাথা ঠান্ডা কর।
– পৃথিবীতে আরেকটা বোঝা।

হঠাৎ কলিংবেল বেঁজে উঠলো। জোহরা দরজা খুলে দেখলেন লাবণ্য আর লতা এসেছে। ওদের সামনে ধরিত্রীকে আনা যাবে না। ওনারা ভেতরে আসতেই তিনি বললেন,

” ওর সাথে দেখা করো। ওর মানসিক অবস্থা ঠিক নেই। ”

ওনারা বসার ঘরে যেতেই ধরিত্রী তার ঘর থেকে বেরিয়ে আসলো। জোহরা ভয় পাচ্ছে। ধরিত্রী লাবণ্য আর লতা সামনে গিয়ে বসে বলল,

“আপনাদের কাছে আমি ক্ষমা চাই। বিশেষ করে লাবণ্য আন্টি। আমি আপনাদের অনেক কষ্ট দিয়েছি। আজকে আমি লজ্জিত। ”

তারা দুই বোন যেন আকাশ থেকে পড়লেন। এতটা অসহায় মেয়েটা। দুই বোনেরই চোখে জল এসে গেল। লাবণ্য গিয়ে ধরিত্রীর হাত ধরে ফেলল, “কী বলছিস। বুড়ি তোর কী হয়েছে? দেখ আগামী বছর আমাকে নানি বানিয়ে দিবি যখন তখন এসব মনে থাকবে না।”

ধরিত্রী চোখের জল মুছে বলল, ” কে নানী? তুমি? লাবণ্য আন্টি, তুমি আমার মামী না। তোমার স্বামী আমার মামাই না। আরে উনি আমার মা,”
জোহরা ধরিত্রীর গালে একটি চড় লাগিয়ে দিলেন। লতা জোহরাকে সরিয়ে দিল। এই প্রথম তিনি তার দুধে আলতা পুতুলের গায়ে হাত তুললেন।

“এই প্রাপ্য দিচ্ছিস তোকে বড় করার? সবার সামনে আমায় ছোট করছিস? আমি তোকে জন্ম দেইনি, জীবন দিয়েছি। বিনিময়ে আমাকে ছোট করছিস?”

জোহরা চিৎকার করে কাঁদতে থাকে। ধরিত্রী নীচের দিকে তাকিয়ে থাকে। কিছুক্ষণ চুপ থেকে বলে,

“আমাকে জীবনটাই কেন দিয়েছ? আমি কী চেয়েছিলাম? এরকম অস্তিত্ব কেউ চায়না। এর চেয়ে মৃ*ত্যু ভালো। আমাকে আর ‘আমার মেয়ে’ ‘আমার মেয়ে’ করো না। লজ্জা লাগে আমার। আমার সাথে আর যোগাযোগ করবে না প্লিজ। ঐ লোকটাকে ও মানা করে দিও।”

ধরিত্রী নিজের ঘরে চলে আসলো। সেখানে এসে ব্যাগ গুছিয়ে বসার ঘরে আসলো,

“আমি এখান থেকে চলে যাচ্ছি। আর কখনো আসব না। আমি যদি আবার তোমার মুখোমুখি হই তো সবাইকে বলে দেব আমি কে, তুমি কে। তোমার আরো খারাপ লাগবে। সত্যি বলতে আমি এসব চাই না। তবে নিজেকে সামলাতে পারব না। জোহরা জাবি, আমি হয়তো তোমার দেওয়া এই অস্তিত্বই শেষ করে দেব। আমার পক্ষে সত্যকে মেনে নেওয়া সম্ভব হচ্ছে না। যদি দূরত্ব বজায় রাখো, আমিও তোমার মতো ঘরঘর খেলব। একটা বাবা, একটা মা, একটা সন্তান আর তাদের সুখী পরিবার। তবে সেখানে আমার খোঁজ করতে যেও না। আমি তখন ওদের সামনেও বলে ফেলব।”

বেরিয়ে যাওয়ার সময় দরজা খুলতেই ওর বাবার সাথে দেখা হয়ে গেল। জোহরা ফোন করে ওনাকে এনেছেন। ওর বাবার কথা বলার আর কোনো মুখ নেই। তবুও বললেন,

– জোহরার জন্য অন্তত থাক।
– তোমার ওনার জন্য এই মিথ্যে মিথ্যে দয়া দেখাতে লজ্জা করে না?
– আচ্ছা কাল সকালে যা?
– তোমার মতো লোকের বাসায় এক মুহূর্ত ও না। তুমি অনেক বাজে লোক। কাপুরুষ! চরিত্রহীন! আমার সাথে আর কখনো কথা বলতে এসো না। যদি ম*রে যাই কবর দিও না। তুমি মাটি দিলে আমি শান্তি পাব না।
– ধরিত্রী! এভাবে বলিস না।

ধরিত্রী নিজের চোখ মুছতে মুছতে নেমে গেল। অতঃপর একটা সিএনজি নিয়ে রাফসানের বাড়ি চলে আসলো। সবাই অবাক! কিছু না জানিয়ে এভাবে হুট করে বাড়ি চলে আসলো। রুবাইয়া জিজ্ঞেস করলো,

– কীরে, মিস করছিলি?
– জ্বী?
– রাফসান কে মিস করছিলি?
– হুম।
– আমাদের করছিলি না?

ধরিত্রী অন্যমনস্ক হয়ে গেল। কেমন যেন এই পৃথিবীতে নিজেকে অবাঞ্ছিত মনে হচ্ছে? কেন এসেছে ও এই পৃথিবীতে।

রাফসান বাড়ি ফিরে অবাক হলো। ওর ধরা নিজ থেকেই ফিরে এসেছে। ঘরে গিয়েই ওকে জড়িয়ে ধরল। ধরিত্রী মূর্তির মতো দাঁড়িয়ে রইলো।

– তোমাকে বলেছিলাম না আমি নিতে আসব।

ধরিত্রী চুপ করে দাঁড়িয়েই থাকে। রাফসান ধরিত্রী কে ছেড়ে ওর চেহারা স্পর্শ করে বলে,

– একা একা এলে কেন? তর সইছিল না বুঝি?
– হুম?
– আমি আসতাম।
– না থাক।

এক সপ্তাহ পার হয়ে যায় ধরিত্রী বাড়ি এসেছে। ওর খাবারের পরিমাণ দিন দিন কমছে। খাবারে কোনো রুচি নেই। সারাদিন শুয়ে থাকে। অনেক দুশ্চিন্তা করে। রাতেও ঘুমায় না। চিন্তা করে। ওকে আবার মানসিক ডাক্তারের কাছে নেওয়া হলো। এবার রাফসান গিয়েছে ওর সাথে। ডাক্তার একা রাফসানের সাথে কথা বলছে,

– আর ইউ শিওর ওনার শুধু বাচ্চা নিয়েই সমস্যা?
– মিসক্যারেজ এর পর থেকেই তো।
– ওনার আরো কিছু বড় প্রবলেম আছে। তিনি বলতেই চাইছেন না। ভেতরে এভাবে ধরে রাখলে খাবার ও খেতে পারবে না। দিন দিন স্বাস্থ্য আরো খারাপ হবে।

ধরিত্রী ওদের বসার ঘরে বসে আছে। রাশা আর আহসান টিভি দেখছে। এর মধ্যেই ওরা খেয়াল করলো ধরিত্রী সোফা থেকে মেঝেতে পড়ে গেছে। শুধু পড়েই যায়নি, অসহনীয় যন্ত্রণায় ছটফট করছে। হাত পা মেঝেতে অনবরত আঘাত করছে। প্রথমবার কারো এপিলেপসির অ্যাটাক স্বভাবতই দুই ভাইবোন সমানে চিৎকার চেঁচামেচি করতে লাগলো। খবর পেয়ে রাফসান মীরা দুজনেই ঘরে আসলো। আবার হাসপাতালে নিয়ে নানা টেস্ট হলো। ডক্টর মোমিন সব দেখে বললেন,

– মানসিক চাপ।
– এমনটা কী বারবার হতে পারে?
– উত্তেজিত হলে হবে। কিছু একটা নিয়ে অতিরিক্ত চিন্তা করছে। প্রবল মানসিক আঘাত পেয়েছে। পরিস্কার করে বলতে হবে।

ধরিত্রী আধমরা বিছানায় শুয়ে আছে। রাফসান ধরিত্রী কে বুকে টেনে নেয়।

– কী নিয়ে এত কষ্ট পাচ্ছ? খুলে বলো। কেউ তোমাকে কিছু বলেছে?
– না।
– তো? বেবি নিয়ে এত ভাবছ কেন? কাল থেকে অফিসে যাওয়ার চেষ্টা করো। অনেক হয়েছে ছুটি। স্বাভাবিক হওয়ার চেষ্টা করো।

ধরিত্রী রাফসানের দিকে ফিরে তার চেহারা স্পর্শ করে। রাফসান ও ওর দিকে মায়া ভরে তাকিয়ে আছে।

– কী দেখছ ধরা?
– তোমার কাছে চাইলে একটা জিনিস দেবে?
– কী?
– আমাকে একটা সন্তান দেবে?
– মানে?

রাফসান কিছুই বুঝতে পারছে না। ধরিত্রী হঠাৎ এমন উদ্ভট আচরণ করছে। কেমন করে যেন তাকাচ্ছে ওর দিকে। একদমই আগের ধরিত্রী না। এ কী! ধরিত্রীর চোখে জল!

– আমাকে আবার মা হওয়ার সুযোগ দাও। আমি মা হতে চাই।
– কেন?
– আমি মা হলেই আমার সব কষ্ট শেষ হয়ে যাবে।

ধরিত্রী কাঁদতে থাকে। রাফসান আর নিজেকে সামলাতে পারছেনা। এতটা অসহায় ভাবে ও ধরাকে দেখবে তা কখনো ভাবেনি।

– তোমাকে এই কথা কে বলেছে?
– একটা আন্টি। তার জীবনে অনেক কষ্ট ছিল। অনেক অনেক বেশি কষ্ট। হয়তো আমার থেকেও বেশি। একদিন তার জীবনে একটা বাচ্চা শিশু এলো। তিনি তাকে নিজের মেয়ের মতো মানুষ করতে লাগলেন আর নিজের সব কষ্ট ভুলে গেলেন। প্রতিদিন নিজেকে মিথ্যা বলতেন যে তিনি ভালো আছেন। এই মিথ্যা ভাবতে ভাবতে এটাকেই সত্যি ভাবতে লাগলেন। তার খেলনা দুনিয়ায় তিনিই সবচেয়ে বেশি সুখী। আমিও তেমন সুখী হতে চাই রাফসান। আমি ওনার মতো অন্যের শিশু আনবো না। আমার সন্তান হবে।
– কিন্তু ধরা, তোমার সেই আন্টি তো বোকার স্বর্গে বাস করেন। সেটা তো আসল না।
– তিনি খুশি তো।
– সেই স্বর্গ ভেঙে যাবে। এরচেয়ে বরং সত্যকে মেনে নেওয়া ঠিক না?

ধরা চুপ করে থাকে। সত্যি কী নিজের সন্তান হলে সে তার অস্তিত্বের ইতিহাস ভুলতে পারবে? ধরিত্রী বেঁচে থাকতে চায়। এভাবে থাকলে একদিন হয়তো আত্মহ*ত্যা করে বসতে পারে। কিন্তু সে সারাজীবন নরকে থাকতে চায় না। একদিন না একদিন সে তার মৃ*ত সন্তানের সাথে পরপারে দেখা করতে চায়। তার সন্তান টা সেখানে একা আছে।

বর্তমানে,

রাশা রুবাইয়ার পাশে বসে আছে। ভাইয়া ভাবীর এই সব ঝামেলায় সে কাল সারারাত ঘুমায়নি। শুধু রাশা না, পুরো পরিবার জেগে। রুবাইয়া রাশার হাত ধরে বলল,

– গিয়ে মণিকে একটু দেখে আয় তো।
– আমি! না জেঠিমা। ভাবী যা রেগে আছে। এই ভোর বেলা আমাকে দেখে এটা ওটা ছুঁড়ে মারে।
– ও এর আগে কখনো এমন করেছে?
– কয়েকবার করেছে।
– আমি যেতাম, কিন্তু ও আমাকে সহ্য করতে পারছে না। একটু যা।

রাশা ভয়ে ভয়ে পা টিপে দরজা ফাঁক করে দেখে ধরিত্রী ঘুমাচ্ছে। পেছন ফিরে ফিসফিস করে রুবাইয়া কে আবার তা বলে। রুবাইয়া আস্তে আস্তে বলল, “ওর গায়ে চাদড় টা দিয়ে আয়।”
রাশা পা টিপে টিপে ঘরে ঢুকে চাদড় টা ধরিত্রীর গায়ে চড়িয়ে দিতেই দেখল পানির গ্লাস চাপা একটা কাগজ। কাগজ টা দেখা মাত্রই রাশার হাত পা ঠান্ডা হয়ে আসছিল। তাও কাগজটা হাতে নিয়ে দেখলো,

“কাল সকাল বেলা ই মনে হয়েছিল পারব। এত কিছু সহ্য করেছি, এটুকু লড়াই করতে পারব। এখন মনে হচ্ছে এটাই আমার প্রাপ্য। আমি নিজেই কারো পাপের ফসল। এই জীবনটাই কারো পাপের প্রায়শ্চিত্ত। আমার সাথে হওয়া অন্যায়ের আর কী ন্যায় হবে। এই মুহুর্তে মনে হচ্ছে আর একটা দিন ও যদি বেঁচে থাকি তো আরো প্রায়শ্চিত্ত করতে হবে। প্রতিটা নিশ্বাসই বিষাক্ত। স্যরি চিড়া, আর দেখা হবে না। আমি আর অন্য কারো পাপের প্রায়শ্চিত্ত করতে পারব না। পারব না এই জীবনের বোঝা টানতে।”

রাশা ধরিত্রীর অপর পাশে ওর সবগুলো ঘুমের ঔষধের বোতল দেখতে পায়। রাশা কাঁপা কাঁপা হাতে সব গুলো বোতল ধরে দেখে। সব খালি। ও সাথে সাথে চিৎকার করতে থাকে, “জেঠিমা, জেঠু, মা, ভাবী সুইসা*ইড করেছে। ভাবী বোধহয় আর নেই।”

রুবাইয়ার কানে এই শব্দ যেতেই সে তড়িৎ বেগে কক্ষে প্রবেশ করে। ইতোমধ্যে রাফসান ও অন্য ঘর থেকে আসে। রাফসান ধরিত্রীর কাছে আসতেই রুবাইয়া রাফসানের গালে একটা চ*ড় মা*রে। রাফসান ক্রন্দনরত রাশার দিকে তাকায়। রাশা বিলাপ করতে করতে বলে, “তোমার জন্য ভাবী সুই*সাইড করেছে। তুমি ভাবীর কাছ থেকে সরো!”
(চলবে)

#ধরিত্রী_কথন
#পার্ট৩০
#পিকলি_পিকু

রাফসান আর মীরা হাসপাতালে। ফ্রি টাইমে ওরা কথা বলছে,

– তো ধরা এখন আরেকটা বেবি চায়?
– হ্যাঁ। ওর কোন আন্টি নাকি বেবি নিয়ে খুব সুখে আছে।
– কোথায় যে পায় এসব আন্টি। ওর অবস্থা দেখেছিস। এখন বেবি নিলে আবার ম*রবে।
– তাই জন্য বলছি। আমার বেবি লাগবে না। শুধু ধরা লাগবে।
– ওর যদি এতই বেবি দরকার হয় তো অ্যাডপ্ট কর।
– দেখ, ও অনেক আবেগে আছে। এই সময়ে যদি একটা বেবি অ্যাডপ্ট করি ধর কাল আমাদের নিজেদের বেবি আসলো। তখন? আর সবচেয়ে বড় কথা দত্তক এত সহজ না। আমি ওকে আশা দিলাম, কিন্তু ওরা আমাদের বেবি দিল না। আমি ওকে নিয়ে কোথায় যাব?
– ওর কাউন্সিলিংয়ে কিছু হচ্ছে না কেন?
– কী জানি। কী নিয়ে এত চিন্তা। ডাক্তারদের মতো আমার ও মনে হয় এটা শুধু বেবি না। অন্য কিছু।

রুবাইয়া আর মাশরুফা বসে আছে,

– আচ্ছা মাশরুফা, জোহরা একবার ও ধরিত্রী কে কেন দেখতে এলো না?
– ব্যস্ত বোধহয়।
– ব্যস্ত না। জোহরা ধরিত্রীর ব্যাপারে খুব ওভারপ্রটেকটিভ। মনে আছে, বিয়ের পরপর ওর যখন জ্বর হয়েছিল।
– হ্যাঁ। ছুটে চলে এসেছিল।
– আর আজ ওর অ্যাটাক এসেছে শুনেও আসলো না। সেদিন হাসপাতালে ওকে একা ছাড়ছিলই না। ওদের মা মেয়েতে কিছু হয়েছে? ধরিত্রী হুট করেই বাসায় এসেছে।
– ভাবী, তুমি বেশি চিন্তা করছ ওকে নিয়ে।

এদিকে জোহরা শয্যাশায়ী। ধরিত্রীর ঘরেই শুয়ে আছে সে। লাবণ্য আর জায়েদ মামা তার পাশে। লাবণ্য জোহরার হাত ধরে বলল,

– আপা, আমি ওকে বোঝাতে যাব?
– না। দরকার নেই।
– আপনি ওর চিন্তায় এভাবে বিছানায় পড়ে থাকলে কী হবে।
– জায়েদ, ওর যে আবার অ্যাটাক আসলো, তার খবর নিয়েছিস?

জায়েদ বলল,

– নিয়েছি। মানসিক চাপ থেকে অ্যাটাক আসছে। রাফসান সাথেই আছে।
– ভালো।
– তুমি কী ওর সাথে কথা বলতে চাও?
– না, ওকে আর রাগাবি না। ওর ইচ্ছে হলে আসবে। যেভাবে গিয়েছে ওভাবেই আসবে।
– আপা, এবার এসব রেখে আমার কাছে চলে আসো।
– আমি এখানেই থাকবো। এত বছর আছি না?
– এখানে আর কিছুই নেই। মেয়েটাও ওর আসল রূপ দেখিয়ে দিল।
– ও অভিমান করেছে। ও আবার আসবে। তোরা বাড়ি যা।
– তুমি আর তোমার জেদ। এই জেদটাও ঐ মেয়েটা কে শিখিয়েছ। এখন সে ই তোমার উপর দেখাচ্ছে।
– আমার সামনে ওকে কখনো ঐ মেয়েটা বলবি না। ওকে আমি অনেক সুন্দর নাম দিয়েছি।

জায়েদ খুব বিরক্তি নিয়ে চলে আসলো। জামান বসার ঘরেই বসে রইলো। শাস্তি পাচ্ছে সে। এই শাস্তি টা কী যথেষ্ট?

ধরিত্রী তার ঘরেই বসে থাকে। মায়ের কথা ভাবে। বাচ্চার কথা ভাবে। রাফসান তার পাশে বসে। রাফসান যেন ধরিত্রীর জীবন থেকে হারিয়ে গেছে। ভালোবেসে ধরিত্রীকে ছুঁতে চাইলে যেন মনে হয় একটা পুতুল ছুঁইছে। ওদের মধ্যে এখন আগের চেয়েও অনেক বেশি দূরত্ব। রাফসান এখন পুরো সপ্তাহ হাসপাতালে থাকলেও ধরিত্রী কিছু বলবে না। রাফসান ও তাই তার ব্যক্তিগত জীবনের ক্লান্তি ভুলতে হাসপাতালেই বেশি থাকে। রোগীদের ঝামেলায় নিজের ঝামেলা ভুলে থাকে। তাই রাফসানের ক্লান্তি এখন তার চেহারায় স্পষ্ট। ওকে এভাবে দেখে ওর চাচা বলল,

– হাঁপিয়ে গিয়েছিস না?
– কেন?
– এই সম্পর্কে তুই সবচেয়ে বেশি ভুক্তভোগী। আমার তোকে আগেই বারণ করা দরকার ছিল। কী করব, ভাইয়া ভাবি হ্যাঁ বলে দিল।
– কী বলছ?
– শুধু মাত্র সোস্যাল মিডিয়া দেখে জীবনসাথী পছন্দ করা কী সাজে? অনেকটা অনলাইন শপিং এর মতো। বাইরে এক ভেতরে আরেক।
– তুমি ভুল বুঝছ চাচ্চু। ধরিত্রী একদম একই ছিল। এখন সময় ভালো না তাই।
– সময় আর কখনো ভালো হবেও না। ইউ বেটার মুভ অন।
– মানে?
– ডিভোর্স দে। নতুন করে শুরু কর।
– ছি চাচ্চু! আমি স্বপ্নেও ভাবতে পারি না।
– এখন সময় টা আবেগের না। মাথা থেকে চিন্তা কর। এই মেয়ে কখনো স্বাভাবিক হবে না। আরেকটা বাচ্চা সম্ভব না এর সাথে। ওর আবার এপিলেপসি আছে। ওর মা বাবা ওর অসুস্থতা লুকিয়ে তোর উপর চাপিয়ে দিল। নিজেরা এখন খোঁজ ও নেয় না। তুই আমাকে বল এই দুই বছরে তুই কী পেলি? স্ট্রেস ছাড়া।
– তাও। আমি ওকে বিয়ে করেছি, বিপদে এভাবে ছেড়ে যাওয়ার জন্য না। আর তুমি এই কথা কাউকে বলো না।

রাফসান সেখান থেকে উঠে চলে আসে। আস্তে আস্তে ঈদ ঘনিয়ে আসে। সবাই শপিং করছে। ধরিত্রীর বাবার বাড়ি থেকে উপহার লতা আর তার স্বামী এনেছে। রুবাইয়া এবার নিশ্চিত কিছু একটা হয়েছে।

– জোহরা কেমন আছে?
– ভাবি একটু অসুস্থ।
– কী হয়েছে?
– জ্বর। আর রোজা রেখে ক্লান্ত।
– মেয়েকে দেখতে আসে না যে।

লতা আর তার স্বামী একে অপরের দিকে তাকায়। ধরিত্রী আসতেই নকল হাসি দিয়ে উপহার বুঝিয়ে দেয়। ওনারা যাওয়ার পর রুবাইয়া ধরিত্রীকে বলে,

– শপিং এ যাবি না?
– এবার আর যাব না।
– কেন?
– ভালো লাগছে না।
– তোর ঐ প্রিয় শাড়ির দোকানে ডিসকাউন্ট চলছে।

ধরিত্রী উঠে চলে আসলো। কী দরকার ওর মা বাবার এই বাড়িতে এসব পাঠানোর। বিকালে মীরা আসে বাসায় ইফতার নিয়ে। সাথে রাশা আহসানের জন্য উপহার। ওরা দুই ভাইবোন খুব মীরা আপু মীরা আপু করছে। ধরিত্রী সেদিকে তাকিয়ে আছে। কিছু একটা বদলে গেছে। গত ঈদে ওদের জন্য এভাবে ধরিত্রী উপহার এনেছিল। রাশা আর আহসান ওকে এভাবে ভালোবাসতো। ইফতার টেবিলে ধরিত্রী হঠাৎ জিজ্ঞেস করলো,

– মীরা অঙ্কন ভাই কোথায়? তাকেও ডাকলে ভালো হতো।

সবাই যেন হকচকিয়ে গেল। রাফসান ধরিত্রীর হাত চেপে ধরল। ধরিত্রী বুঝতে পারছে না কী হয়েছে। মীরা কিছু বলার আগেই চাচ্চু বলল,

“কোথায় কী বলতে হয় জানো না ধরিত্রী?”

মাশরুফা চাচাকে থামিয়ে দিল। মীরা এবার নিজেই বলল, ” স্যরি ধরিত্রী, তুমি হয় তো জানো না। আমি আর অঙ্কন এখন আলাদা থাকি। সামনেই ডিভোর্স হবে। দ্যাটস ইট।”

ধরিত্রী ক্ষমা চাইলো অনেক। রাফসান তো ওকে কিছু বলে না। ওর ও বোঝা উচিত ছিল। মীরাকে ও ইদানিং এই বাসায় অনেক দেখে, কিন্তু একবার ও অঙ্কনের কথা বলে না। ঈদের দিন ও মীরা এসেছে বাসায়। রান্নাঘরে গিয়ে সবার সাথে কাজ করছে। খাবার রান্না করছে। আবার খাবার বেড়েও দিচ্ছে। ধরিত্রী সব দেখছে। এভাবে আগে ধরিত্রী করতো সব। রুবাইয়া ও এখন মীরাকে কিছু বলছে না। সেমাই খেতে খেতে ধরিত্রী কে রুবাইয়া বলল,

– তোর কী মনে খারাপ মা?
– কই? না তো।
– ঈদের দিন একটু হাস। রাফসানকে নিয়ে মা কে দেখে আয়।

ধরিত্রী আবার অন্যমনস্ক হয়ে গেল। তখনই মীরা একটি বাটি ভেঙে ফেলল। ওর নজর ওদিকে গেল। এই বাটি টা রাফসানের মায়ের সবচেয়ে প্রিয় বাটি। তবুও উনি মীরাকে কিছুই বললেন না। উল্টো হেসে হেসে ওকে উৎসাহ দিচ্ছেন। সবাই ওর মন ভালো করতে ব্যস্ত। সব যেন ওর হাতের নাগালের বাইরে চলে যাচ্ছে। ধরিত্রীর নিজেকে এই বাড়িতে বহিরাগত মনে হচ্ছে।

ধরিত্রীর ফোনে একটি মেসেজ আসলো, “ঈদ মোবারক।” নাম্বারটি ও চেনে না। তার কিছু দিন পর আসলো, “স্বামী কী হাত থেকে চলে যাচ্ছে?”

এসব কী বাজে মেসেজ। ধরিত্রী নাম্বার টা ব্লক করে দিল।

“স্বামী তার বেস্টফ্রেন্ডের সাথে বেশি সময় কাটায়?”

ধরিত্রী আবার ও ব্লক করে দিল। ওয়াশরুম থেকে ফিরে আরেকটা মেসেজ পেল, “আপনার স্বামী এখন কোথায়? কার সাথে কী করছে?”

ধরিত্রী নাম্বার টি ব্লক করার আগে একটা ছবি আসলো। মীরা আর রাফসান একটি রেস্টুরেন্টে। এরপর আরেকটা মেসেজে, “ছবি টা একটু আগের। এখনো তারা সেখানেই আছে।”

ধরিত্রী অনেক চাইলো সন্দেহ করবে না। তবুও একটা ফোন করল রাফসানকে। সে ফোনটা তুলল। বলল হাসপাতালে ব্যস্ত আছে। ধরিত্রী একটু শান্তি পেল। আবার আরেকটা মেসেজে, “মীরাকে ফোন করুন।”

ধরিত্রী মীরাকে ফোন করল। মীরাও হাসপাতালে। আবার মেসেজে, “হাসপাতালে ফোন করুন।”

ও ভয়ে ভয়ে হাসপাতালে ফোন করল। সেখানকার রিসেপশনিস্ট বলল, “ডাক্তার রাফসান আর ডাক্তার মীরা দুজনেই আজ হাসপাতালে আসেনি।” ধরিত্রীর হাত পা অবশ হয়ে আসছিল। চোখের সামনে শুধুই অন্ধকার। রাফসান এমন করতে পারে না। ভুল বোঝাবুঝি হচ্ছে। মীরা আর রাফসান বন্ধু। তবে মিথ্যা কেন বলবে? ধরিত্রী সেই নাম্বারে ফোন করল। কিন্তু এইবার বন্ধ এলো। ঘর থেকে বের হতেই ধরিত্রী আহসানের সাথে দেখা হলো।

– ও ভাবি, কেমন আছ?
– ভালো।
– সামিয়া এসেছে। দেখা করবে?
– সামিয়া মানে ঐ মেয়েটা? ঐ যে চিঠি?
– হ্যাঁ।
– চলো।

ধরিত্রী দেখা করতে গেল। ঘরে যেতেই মাশরুফা ওদের জন্য নাস্তা নিয়ে আসলো।

– ধরিত্রী, তুমি আহসানের বেস্টফ্রেন্ডের সাথে দেখা করেছ?
– হ্যাঁ।
– চেনো?
– আগে স্কুলে দেখা হয়েছিল।

ধরিত্রী ঘর থেকে বের হতেই মাশরুফা বলল,

– আমার ছেলেটার ও যে রাফসানের মতো একটা বেস্টফ্রেন্ড হবে ভাবতেও পারিনি। ওদের দেখলে রাফসান আর মীরার কথা মনে হয়।
– জ্বী?
– হ্যাঁ। ওরা এভাবেই বাড়িতে এসে পড়া লেখা করতো। রাফসান বিপদে পড়লে মীরা সাহায্য করত। রাফসানের খুব ভালো বন্ধু ছিল না তো। এখনো তো শুধু মীরা।

ধরিত্রী একটু একটু করে সব বুঝতে পারছে। কারো সাথে কিছু বলতে পারছে না। ভেতরে ভেতরে শেষ হয়ে যাচ্ছে। তবে কী ওর নিয়তি ও ওর মায়ের মতো? নাকি নিজের জন্মদাত্রীর পাপের ফল সে পাচ্ছে। রাফসান ইদানিং বাসার বাইরে বেশি থাকে। ধরিত্রী কিছু প্রশ্ন করতে চায়, কিন্তু পারে না। সবশেষে ওর কাছে আরেকটা মেসেজ এসেছে,

“স্বামীর প্রতি অবহেলা করে তাকে অন্য নারীর দিকে আপনিই ঠেলে দিয়েছেন।”

ধরিত্রী ফোন হাতে বসে আছে। আরেকটা মেসেজ আসার আগেই সে কল করে বসলো। এবার আর ফোন বন্ধ নেই,
– হ্যালো, আমি ধরিত্রী। আমাকে সব খুলে বলুন।
– সত্যি বলতে, আপনার স্বামী মীরার সাথে পরকীয়া করছে।

এক নারী কণ্ঠ ধরিত্রীকে এসব বলছে। ধরিত্রী বুঝতে পারল না এই নারী কে?
– আপনি এত কিছু কী করে জানেন?
– আমি আপনার শুভাকাঙ্ক্ষী তাই। ওনাদের প্রেম শুধু রেস্টুরেন্ট পর্যন্ত না। হোটেলে ও গড়িয়েছে।
– জ্বী?
– হোটেল ব্লু মুনে তারা প্রায় রাত কাটায়। তিনি এখন নাইট ডিউটি করেন না। মাঝে মাঝে দিনের বেলাও সময় কাটায়। আপনি জানেন, কী ধরনের। যে পুরুষের স্ত্রী তাকে খুশি রাখতে পারছে না সে তো এমনই করবে।
– মুখ সামলে। কী প্রমাণ আছে? রাফসান এমন না। ও অনেক ভালো মানুষ।
– অবশ্যই ভালো মানুষ। ভালো মানুষের অভিনয় টা খুব ভালোই পারে। আর মীরা, উনি ওনার স্বামী কে ডিভোর্স দিয়েছেন।
– তা জানি।
– তাও এত বোকা? আপনি যখন সন্তান শোকে কাতর ছিলেন, ওনারা দুজন তখনই একে অপরের খুব কাছে চলে এসেছে। দুজন বিবাহিত জীবনে অসন্তুষ্ট বেস্টফ্রেন্ড, একে অপরের সহায়তায় নিয়োজিত। আর আপনি একজন বোকা মহিলা।

ধরিত্রী ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদতে থাকে। সারারাত কান্না করার পর রাত তিনটায় ওর ফোনে মেসেজ আসে। “আজ রাতে তারা ব্লুমুনে এসেছে। চাইলে ধরিত্রী হাতে নাতে ধরতে পারে তাদের।” ধরিত্রী কিছু না ভেবেই ঘর থেকে বেরিয়ে গেল। ওদের বিল্ডিংয়ের কয়েক বিল্ডিং পরেই একটা গাড়ি আসলো। তারপরই ওর ফোনে মেসেজ, উঠে পড়তে হবে সেই গাড়িতে। গাড়ি এসে থামালো ব্লু মুনে। রিসেপশনে গিয়ে মিসেস আহমেদ বলতেই ওকে একটা এক্সট্রা চাবি দেওয়া হলো। দরজা খুলেই ও দেখলো রাফসান আর মীরাকে। আর সেই থেকেই…

রাফসানকে সবাই যখন ঘৃণা করছিল তখন সে বাড়ি থেকে বের হয়ে যেতে চাইছিল। তার মা তাকে ধরিত্রীর সামনেই বের হয়ে যেতে বললেন। কাল সকালে ধরিত্রীর মা বাবা আসবে। রাফসানের বিচার হবে। তবে রাফসান বলেছে সে প্রমাণ করবে সে নির্দোষ। প্রমাণ খুঁজতে রাফসান আর তার চাচা গিয়েছে ব্লু মুন হোটেলে। সেখানকার সিসিটিভিতে থাকবে তারা কী করে এসেছে।

– তোর কী সত্যি মনে নেই এখানে কী করে এসেছিস?
– না চাচ্চু। আমি মীরাকে ওর বাসায় পৌঁছে দিতে ট্যাক্সি তে উঠি। এরপর আমার আর কিছু মনে নেই। অ্যালার্ম বাজতেই আমার ঘুম ভাঙে আর ভাঙতেই আমার মাথায় তীক্ষ্ম ব্যথা অনুভব হয়। এরপর ই আমি ওদের দুজনকে দেখতে পাই।
– তো এসব ষড়যন্ত্র? মীরা কোথায়?
– ফোন তুলছে না।

হোটেলের ম্যানেজার বলল সিসিটিভি ফুটেজ দেওয়া যাবে না। তবে তারা কী করে এলো এর ও কোনো রেকর্ড নেই। রাফসান সেখানে এক প্রকারের ঝগড়া করে এলো। “কী ধরণের হোটেল এটা? মানুষ কী করে এন্ট্রি নেয় তার কোনো প্রমাণ নেই!” আজহার চাচা রাফসান কে টেনে বাইরে আনলেন। কাল তারা পরিচিত পুলিশ কর্মকর্তার সাথে কথা বলে কিড* ন্যাপিংয়ের অভিযোগ করবেন।

আজহার চাচা অনেকটা জোর করেই রাফসানকে বাড়ি আনলেন। রুবাইয়া না দেখে মতো তাকে আহসানের ঘরে লুকিয়ে রাখা হলো। রুমির মা কে বলে খাবার পাঠানো হলো। মাশরুফা বিষয়টা পছন্দ করল না।

– তুমি এটা কেন করলে?
– কেন করব না?
– রাফসান যে কাজটা করেছে, এরপর ভাবি ওকে বের করে দিয়েছে। এখন যদি ধরিত্রী ওকে এখানে দেখে তো?
– তো? বাড়ির ছেলেকে বাইরের মেয়ের জন্য বের করে দেব? আমাদের রাফসান এমন করতে পারে না। আর করলেও ওর দোষ দেখি না। এই আধাপাগল বউ নিয়ে আর কতো?
– আজহার! তুমি বলতে পারলে? তোমার ও মেয়ে আছে।
– রাফসানের ও কিছু বলার আছে। আর যদি প্রমাণ ও হয় ও এই বাসাতেই থাকবে।
– আজহার, এটাই তোমার আসল রূপ?
– নিজের ভাতিজার বিপদে পাশে দাঁড়ানো খারাপ হলে খারাপ। ভাবিকে বলবে না।

মাশরুফা রুবাইয়া কে আর বলল না। রুমির মা ধরিত্রীর ঘরেও গেল খাবার নিয়ে। ধরিত্রী রুমির মাকে জিজ্ঞেস করল,

– বাইরে সবার কী অবস্থা?
– সবার মন খারাপ।
– মা?
– প্রেসার বাইড়া গেসে।

ধরিত্রী কিছুক্ষণ চুপ করে রইলো। মনে মনে ভাবছে মাথা গরম করে ও রুবাইয়া কে অনেক কিছু বলে ফেলেছে। ক্ষমা চাওয়া উচিত। এরপর ওর আবার হঠাৎ মনে পড়লো রাফসানের কথা। ও কী সত্যি বাহিরে?

– রাফসান কোথায়?
– কেন?
– বাসায়?
– হ।

ধরিত্রী বুঝতে পারল। রাফসান বাসায়ই আছে। ওরা সবাই শুধু শুধু একটা লোক দেখানো সান্ত্বনা দিয়েছে। ও এত কিছু কী করে আশা করে?

– কথা কইবেন?
– না। আপনি চলে যান।

ধরিত্রী একা একা বসে রইলো। এর মানে রুবাইয়া ও ওর সাথে মিথ্যা বলেছে। স্বাভাবিক, সে তার ছেলের পক্ষেই থাকবে। এত আশাই বা কেন করে সে। কাল সকালে মা বাবা আসবে। ওনারা কী বলবে? মাকে কীভাবে মুখ দেখাবে? যেখান থেকে ও পালাতে চাইছিল ঘুরে ফিরে সেখানেই আসলো। আজ জোহরা আর ধরিত্রী একই পথের যাত্রী। ও কোনো দোষ না করে কেন এত শাস্তি পাচ্ছে? আর পারছে না প্রায়শ্চিত্ত করতে।

সারারাত সে অনেক লড়াই করেছে বেঁচে থাকার জন্য। সবচেয়ে সহজ পদ্ধতিতে এই পৃথিবী ছেড়ে চলে যাওয়ার উপায় কী? এমন ভাবে চলে যেতে হবে যাতে কেউ বুঝতে না পারে। ধরিত্রী একটি চিঠি লিখলো। ওর হাতের শেষ লেখা। ভোরের দিকে ধরিত্রী ওর সব ঘুমের ঔষধ একসাথে হাতে ঢেলে পানি গ্লাস হাতে নেয়। ঔষধ খাওয়া শেষে গ্লাস দিয়ে চিরকুট চাপা দেয়। এরপর আস্তে করে বিছানায় শুয়ে পড়ে। অনেক ধকল গেছে তার আজ। অনেক ক্লান্ত হয়ে গেছে। চোখ বন্ধ করতেই সে গভীর ঘুমে মগ্ন হয়। কেউ চাইলেও তাকে আজ জাগাতে পারবে না। কারো ভালোবাসা ও না, অবহেলা ও না।

এত ভোর বেলায় যখন জোহরার কাছে রুবাইয়ার ফোন আসে তখন তার হাত কাঁপতে শুরু করে। কাঁপা কাঁপা গলায় সে বলে,

– হ্যালো।
– জোহরা, তুমি একটু সিটি হসপিটাল আসবে?
– কেন?
– আসো।
– কী হয়েছে? অ্যাটাক এসেছে? ভালো আছে?
– একটি বার আসো।

রুবাইয়ার কান্না শুনে জোহরা বুঝল আজ অন্য কিছু হয়েছে।

– আমার মেয়েটা ঠিক আছে?
– আসতে বলছি আসছ না কেন?
– ওর ঠিক কী হয়েছে তা না শুনে আমি আসব না।

জোহরা হেঁটে জামানের ঘরে গেল। জামান বিছানায় উঠে বসলো,

– ওকে শেষ বার দেখতে আসো।
– শেষ বার? রুবাইয়া, মিথ্যা বলো না। বেঁচে আছে তো? আমি লা*শ দেখতে পারব না।

জামান জোহরার হাত থেকে ফোন নিয়ে বললেন,

– কী করেছে? ধরিত্রী কী করেছে?
– ঘুমের ঔষধ খেয়েছে।

জামান দেখল জোহরা তার সামনে মেঝেতে পড়ে গেছে।

(চলবে)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here